এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  খ্যাঁটন  হেঁশেলে হুঁশিয়ার  খাই দাই ঘুরি ফিরি

  • পাকশালার গুরুচণ্ডালি (৪৯)

    শারদা মণ্ডল
    খ্যাঁটন | হেঁশেলে হুঁশিয়ার | ০৩ নভেম্বর ২০২২ | ৬৯০ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | পর্ব ১৭ | পর্ব ১৮ | পর্ব ১৯ | পর্ব ২০ | পর্ব ২১ | পর্ব ২২ | পর্ব ২৩ | পর্ব ২৪ | পর্ব ২৫ | পর্ব ২৬ | পর্ব ২৭ | পর্ব ২৮ | পর্ব ২৯ | পর্ব ৩০ | পর্ব ৩১ | পর্ব ৩২ | পর্ব ৩৩ | পর্ব ৩৪ | পর্ব ৩৫ | পর্ব ৩৬ | পর্ব ৩৭ | পর্ব ৩৮ | পর্ব ৩৯ | পর্ব ৪০ | পর্ব ৪১ | পর্ব ৪২ | পর্ব ৪৩ | পর্ব ৪৪ | পর্ব ৪৫ | পর্ব ৪৬ | পর্ব ৪৭ | পর্ব ৪৮ | পর্ব ৪৯ | পর্ব ৫০ | পর্ব ৫১ | পর্ব ৫২ | পর্ব ৫৩ | পর্ব ৫৪ | পর্ব ৫৫ | পর্ব ৫৬ | পর্ব ৫৭ | পর্ব ৫৮ | পর্ব ৫৯ | পর্ব ৬০ | পর্ব ৬১ | পর্ব ৬২ | পর্ব ৬৩ | পর্ব ৬৪ | পর্ব ৬৫ | পর্ব ৬৬ | পর্ব ৬৭ | পর্ব ৬৮ | পর্ব ৬৯ | পর্ব ৭০ | পর্ব ৭১ | পর্ব ৭২ | পর্ব ৭৩
    ছবি - র২হ


    ধূসর রামধনু




    “জীবন মানে এমন তো নয়,
    একক কোনও ঋতুর আয়োজন!
    বৃষ্টি বুকে শ্রাবণ আসে,
    শীতল হাওয়ায় পৌষ আসে,
    তেমন আসে একাকী আশ্বিনও...”

    বর্ষশেষের শীতের ছুটি প্রায় শেষ হয়ে এল। এমন সময়ে মনে একটা মিশ্র অনুভূতি হয়। একদিকে নতুন বছরের আনন্দ, আবার অন‍্যদিকে শহরে গিয়ে একঘেঁয়ে জীবন শুরু করতে হবে, সেই বিরক্তি। দুই মেয়ের সঙ্গে একটা ফুলপ্রুফ প্ল‍্যান বানিয়ে ফেললাম, ৩১ শে ডিসেম্বর সকালে পুরোনো রাসমঞ্চের সামনে দেবদারু বনে চড়ুই ভাতি, সেখানে ভাত, মুড়োর ডাল, মাছের কালিয়া আর টমেটোর চাটনি হবে। চড়ুই ভাতির বাসনকোসন, মশলা, আলু, পেঁয়াজ, টমেটো গুছিয়ে ফেললাম। পাশের বাড়ির ফুচন, মাঠে দুটো গর্ত করে তার ওপরে ইট সাজিয়ে উনুন বানাতে জানে। তাকেও দলে জোটানো হল। তাছাড়া রান্নাঘরের বৌদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা তো আছেই। মাছের ভার কর্তার, যদিও চড়ুই ভাতির এই বালখিল্যপনায় তিনি সরাসরি নেই। দুটি জিনিস দরকার, এক হল উনুনের জ্বালানি আর দুই খড় বিচালি। জ্বালানি নিয়ে চিন্তা নেই, কারণ রান্না ঘরে শুকনো ডালপালা আর পাতার গাঁটরি বাঁধা আছে। খড় বিচালি যোগাড় করা একটু মুশকিল। আগের যুগে যে দেশি ধানের চাষ হত, তার খড় ছিল তেজী, সহজে পচে যেতোনা, তাই গাঁ গঞ্জের বাড়িও হত খোড়ো চালের। এখন তো হাইব্রিড ধানের খড়, নরম, তাড়াতাড়ি পচে যায়, কাজে লাগেনা। আমার বিয়ের সময়ে দেখেছি আমাদের বাড়িতেই বিরাট খড়ের গাদা ছিল। এখন আর নেই। যাই হোক শুকনো ডালপালার সঙ্গে একটু খড় পেলে ভাল। ঐগুলো দিয়ে কনকনে ঠান্ডায় রাতে বনফায়ার করে নতুন বছরকে আহ্বান করা যাবে। কয়েকবছর আগে দীঘায় এক বর্ষশেষের রাতে বেসরকারি কোম্পানির বিচ ফেস্টিভ্যালে গিয়েছিলাম। একেবারে খোলা মেলার মধ‍্যেই কোম্পানির তরফ থেকে মদিরার বিপণি বসেছিল। আর রূপম ইসলামের গানের মাঝে মাঝে সুন্দরী সঞ্চালিকা মঞ্চ থেকেই মদিরা পান, মদিরায় স্নানের আহ্বান জানাচ্ছিলেন। বেশিরভাগ পরিবারই বাচ্চা কাচ্চা সমেত ছিল। খোলা মেলায় যে এমন হতে পারে, এ ধারণা আমার ছিলনা, কোনদিন এমন তো দেখিনি। গান শোনা মাথায় উঠেছিল, দুই মেয়েকে নিয়ে খুব তিক্ত মনে উঠে আসতে হয়েছিল। এবারে তাই বর্ষশেষে নো দীঘা, এবারে মানে ভবিষ্যতে সব বারেই নো, নো অ্যান্ড নো। বাড়িতে বালিয়াড়ির ওপরে দেবদারু বনের নিশ্ছিদ্র অন্ধকারকে হারিয়ে দিয়ে আকাশে চাঁদ আলো ছড়ায়। চাঁদের ওপরে ঝুপসি গাছের কালো ডাল, উঠোনের একধার দিয়ে গোপীনাথের চাতাল, গোপীনাথের রান্নাঘর, দুর্গাদালান আর সেই জোছনা ধোয়া উঠোন – কতজনের কপালে থাকে এই স্বর্গ?

    কিন্তু নির্দিষ্ট দিনের আগের দিন ঘটে গেল এক বিসদৃশ ঘটনা। মুঠোফোনে বার্তা এল ঐদিন সকাল দশটা থেকে রঞ্জার ইস্কুলে নতুন ক্লাসের বই দেওয়া হবে। কিন্তু আমরা তো গ্রামের বাড়িতে। কর্তা তাই খুব ভোরে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

    এদিকে বাড়িতে আমাদের অজান্তে অন্য একটা ঘটনা ঘটছিল। সকালে প্রাতরাশের সময়ে মতি বৌয়ের বড় ছেলেটাকে দেখলাম পিঠে একটা ছেঁড়া ইস্কুল ব‍্যাগ নিয়ে গম্ভীর মুখে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। তার মা বলছে খেয়ে যেতে, ছেলে কথা কানে তুলছেনা। শীতের ছুটিতে আমরা বাড়িতে এসেছি, তাই মতি বৌও কাজে লেগেছে। তার ছেলেরাও এসে আছে। মেজ আর ছোটটি আমার কর্তার খুব ন‍্যাওটা। কিন্তু এই বড় ছেলেটিকে আমি একেবারেই পছন্দ করিনা। না করার অনেকগুলো কারণও আছে। দুর্গাপুজোর সময়ে বাড়িতে অনেক লোকজন খায়, তাই একশো মতো চেয়ার ভাড়া করা হয়েছিল। এই ছেলেটা বদরাগী, একবার নিজেদের বন্ধুদের কার কার সঙ্গে মারামারি করে লাথি মেরে ডেকরেটারের অনেক চেয়ার ভেঙে দিয়েছিল। রাগের অজুহাতে অনেক টাকার ক্ষতি করে দিয়েছিল। একবার মেয়েকে দোতলার বারান্দায় বসে পড়াচ্ছিলাম। লুকিয়ে আড়াল থেকে আমার সামনে আমার মেয়ের মাথায় টিপ করে ইট মেরেছিল। এখন কলকাতায় থেকে হাসপাতালে ক‍্যান্টিন বয়ের কাজ করে। আসলে মতি বৌয়ের বর খুব অল্পবয়সেই তিন ছেলে সমেত মতিকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। তারপর যা হয়, বরটা একের পর এক বিয়ে করে গেছে। সব বৌগুলোর খোঁজও পাওয়া যায়নি। তাদের পাচার করে দিলেও অবাক হবনা। এমন লোক – এই জেলে গেল, জামিন হল, আবার নতুন কেসে ঢুকে গেল – বছরভর এই চলতে থাকে। মতি বৌ তার বরের প্রথম শিকার। বরটা বহু অপরাধ করে এখন পুলিশের ইনফর্মার হয়েছে। ছেলে তিনটে ছোট থেকে বাপে খেদানো ছেলে বলে গাঁয়ের লোকের টীকা টীপ্পনী শুনেছে। দু মুঠো খাবারের জন‍্য বাড়ি বাড়ি নুড়ো নুড়ো হয়েছে। এসব ছেলের ভাল মানুষ হওয়া খুবই মুশকিল, অসম্ভবই বলা যায়। প্রথমে ইস্কুল ছুট হল, তারপর গ্রামতুতো কাকা শহরে ক‍্যান্টিনে কাজে লাগিয়ে দিল। এবার আর কী! বাপের লাইনটাই ধরে নেবে হয়তো। শুনেছি প্রেম ট্রেমও করছে। এসব ছেলের এদিক নেই ওদিক আছে। যা হোক, সকালে না খেয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে দেখে মতিকে জিজ্ঞেস করলাম, 'কী হয়েছে? তোমার ছেলে কোথায় যাচ্ছে?' এবাড়িতে না খেয়ে বেরিয়ে যাবার দস্তুর নেই। এমন উল্টো পুরাণ ঘটার কারণ কী? উত্তর পেলাম, ক‍্যান্টিন মালিক জরুরী তলব পাঠিয়েছে, এবারে কাজে যোগ না দিলে ছাড়িয়ে দেবে। এই এক মুশকিল। যে কাজটা করছে, তাতেও মন নেই। মাঝে মাঝেই বাড়ি পালিয়ে আসে। এর ওর বাগানে কলাটা মূলোটা ধ্বংস করে, আর টাকা ফুরোলে মায়ের ওপর হুজ্জোতি তো আছেই। মতি বৌ প্রতিবেশী দের কাছে গাল খায়, কৈশোরে বরের মার খেয়েছে, এখন যৌবনে ছেলের জ্বালা। ছেলের বয়স কুড়ি আর মায়ের চৌঁতিরিশ পঁয়তিরিশ হবে। মতি বৌকে যুবতীই বলা যায়। পরের ছেলে দুটো ইস্কুলে পড়ে। জানিনা আর কতদিন। এর মধ‍্যে আবার বড়ছেলে ধরেছে পশ্চিম এশিয়ায় গিয়ে চাকরি করবে। সেখানে নাকি অনেক টাকা। অবস্থা ফিরে যাবে। শহরে এর মতো ছেলেদের কানে ফুসমন্তর দেবার লোকের অভাব নেই। ছেলে মাকে টাকার স্বপ্ন দেখায়, মাও দেখে। আমি জানার পর থেকে মতি বৌকে অনেক বুঝিয়েছি, এ তো কোন হোয়াইট কলার জব মানে আপিস বাবুর কাজ নয়, অনেক টাকা কোথা থেকে আসবে? দূর দেশে এদের মতো ছেলেদের কী পরিণতি হতে পারে, খবরের কাগজ থেকে পড়ে শুনিয়েছি। মতি বৌ ঘাড় নাড়ে, মুখে বলে যেতে দেবনা, কাজে কী করবে কে জানে? কর্তা আমায় বলেন, ওদের নিয়ে বেশি মাথা ঘামিওনা, নিজের অশান্তি বাড়বে। আমার মন মানেনা। কানে শুনেছি যখন, ঠিক ভুল বিচারটা বলবোনা? যাই হোক, শুনলাম এখন গোমড়া মুখে ছেলে কলকাতা যাচ্ছে। তার মাকে জিজ্ঞেস করি,

    – মালিকের ফোনটা কখন এসেছিল?
    – কাল রাতে
    – কাল রাতে? আজ যে রঞ্জার বাবা ইস্কুলের বই আনতে কলকাতা যাবে, তুমি তো জানতে। বাড়ি থেকে একটা ফাঁকা গাড়ি গেল, সেই গাড়িতে তো ছেলেকে পাঠিয়ে দিতে পারতে। পাঠালেনা কেন?

    মা ছেলে কেউই উত্তর দিলনা। যাকগে বাবা যা পারে করুক। চায়ের কাপটা নিয়ে বাগানের দিকে হাঁটতে শুরু করি। সকালের মিঠে হাওয়াটা খুব ভাল লাগে আমার। সদর পুকুরের ওপরে কেয়াঝোপ আর বাঁশঝাড়ের ছায়া পড়েছে। ছায়ার মধ‍্যে মধ‍্যে রোদ্দুরের খেলা। মেয়েরা ঘুম থেকে ওঠেনি এখনও। রঞ্জা যখন খুব ছোট ছিল, তখন এমন সকালে ওকে কোলে নিয়ে বেড়াতাম। আরও একটু বড় হলে এই পথেই ওর পিছন পিছন দৌড়ে হাঁপিয়ে যেতাম। সেসময়ে দুই মেয়ের জন্য আমি দোতলায় আলাদা রান্না করতাম। রান্নাঘরের বৌদের হাতের রান্না বাচ্চাদের দেবার সাহস ছিলনা। জানকী তখনও বেঁচে। একদিন ঘরমোছা জলে জানকীকে নারকেল ধুতে দেখেছিলাম। সেই থেকে আমার খুব ভয়। কেউ আনাজ ধুয়ে কাটেনা, কাটার আগে বঁটি ধুয়ে নেয়না। কাটা কুটো বাটা বুটোর আগে যে হাত ধুয়ে নিতে হয়, সেই ধারণাও নেই। আলু ধুয়ে কাটতে বললাম। তার ফল হল বিষময়। রান্নাঘরে দেখি এক ডেকচি জল নিয়ে বসেছে আলু কাটুনি। কাদা মাখা আলুগুলো ডেকচির জলে ডুবিয়ে ধুয়ে কাটা হচ্ছে, আর খোসা ছাড়িয়ে কাটার পর ধবধবে কাটা আলুর টুকরো গুলোকে সেই ডেকচিতে কালো কুচকুচে কাদা জলের মধ্যেই রাখা হচ্ছে। ধুয়ে কাটার এমনতরো নমুনা দেখে থমকে যাই। মূর্খের দেশে পণ্ডিতি দেখিয়ে কাজ হয়না, তাই সরে আসি।

    আমি কিছুদিন এদের স্বাস্থ্য জ্ঞান শেখানোর চেষ্টা করে সব ভগবানের হাতে ছেড়ে দিয়েছি। কর্তা বলেন, এদের তো চেনোনা, পিছনে বেশি টিকটিক করলে কী খাইয়ে দেবে, তার ঠিক নেই। কেবল যেদিন রুণাদা রান্না করে সেদিন নিশ্চিন্ত। যেমন ভাল রাঁধুনি, স্বাস্থ্য বিধির ব‍্যাপারে ততটাই কড়া।

    একদিন হল কী, আমি দোতলায় বাচ্চাদের মাংস রান্না করেছি, তেল কড়াটা বারান্দায় একপাশে সরিয়ে রেখেছি। কর্ণাকে নিয়ে কোনো ঝামেলা ছিলনা। একজায়গায় বসিয়ে খাইয়ে, মুখ মুছিয়ে, পিঠ চাপড়ে দিলেই ঘুমিয়ে পড়তো। ওর পর্ব মিটিয়ে ছুটকীকে নিয়ে পড়তাম। ও দৌড়োতো, আমিও থালা নিয়ে প্রতিযোগিতায় নামতাম। মেয়ে মাংসের তেলকড়া নিয়ে তেল মাখতে বসল, সেই ফাঁকে আমি দুটো দুটো গাল মুখে ঢুকিয়ে দিই। এমন সময়ে রুণাদা বাটি ভরা টমেটোর চাটনি দিয়ে গেল। আমি জানি রুণাদা যে বাটিটাতে চাটনি এনেছে, সে বাটিটাও আগে খাবার জলে ধুয়ে নেয়। এখানে সমুদ্র কাছে বলে ভূগর্ভস্থ জলস্তর ভূপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি। তাই মাটির স্তরে জল প্রাকৃতিক ভাবে ফিল্টার হবার সুযোগ পায়না। টিউবয়েল খুঁড়লে এক পাইপে জল পাওয়া যায়, লোকে তাই আরও গভীরে যাবার জন্য খরচ করেনা। আর এই জল খেয়ে ঘরে ঘরে পেটের বালাই। আমরা যতদিন থাকি খাবার জল কিনতে হয়। বাড়িতে খরচ করে মেশিন বসাতে ভয়। পরের বার এসে হয়তো দেখবো, ভোল্টেজের জন্য মেশিন পুড়ে গেছে, বা ঝেড়ে মুছে সব ফাঁকা।

    যাই হোক মেয়ের চোখ পড়ল চাটনির বাটির দিকে। এদিকে বারান্দায় আসবাব অপ্রতুল। মেয়ের নাগালের বাইরে উঁচুতে বাটিটা কোথাও তুলে দেব সে উপায় নেই। উপায়ান্তর না দেখে একহাতে ভাতের থালা আর এক হাতে চাটনির বাটি উঁচু করে ধরে চাটনিটা আমি নিজের গলায় ঢালতে লাগলাম। কিছুটা তো সদ্ব‍্যবহার হোক। এবাড়িতে আবার চাটনিতে জল দেবার সিস্টেম নেই। দিশি টক টক টমেটোর খোসা ছাড়িয়ে গলিয়ে অনেকটা চিনি, এক চিমটে নুন দিয়ে শুকিয়ে নেয়। এবারে আলাদা পাত্রে পাঁচ ফোড়ন শুকনো লঙ্কা ফোড়ন দিয়ে তেলটা ওপরে ঢেলে দেয়। এটা বাচ্চার জন্যে করেছে বলে লঙ্কা দেয়নি। এমন টাইট চাটনি গলায় পুরোটা যাবার আগেই এক ছোঁয়ে বাটিটা মেয়ের হাতে গেল, তারপর চাটনির মালিক বাটিটা মাথায় উপুড় করে দিল। তার সারা গায়ে তেলকড়া থেকে মাখা তেল তো ছিলই, এবারে তার ওপর শতধারায় চাটনি নামতে লাগল। আমি তাকে সেই সুযোগে ভাত খাওয়াতে লাগলাম। সেই মেয়ের মুখে এখন কত পাকা পাকা কথা। পুরোনো কথা মনে করে নিজের মনে হাসতে হাসতে বাড়ির দিকে ফিরছিলাম। এমন সময়ে আমার চিন্তাসূত্র কেটে বাইকে করে ঝড়ের গতিতে দেওর এসে বললো – 'মেয়েরা কোথায়?' এখনও ওঠেনি শুনে বললো – 'শিগগির ওদের তুলে, খাইয়ে রেডি করে দাও। ওদের নিয়ে বেরোব।'

    ব‍্যাপার যা শুনলাম, পাশের গ্রামে মাটির ঘরে কোনো বিষাক্ত সাপ ধরা পড়েছে। অভিজ্ঞ লোকে সন্দেহ করছে যে সেটি পদ্ম গোখরো। কিছু পরিবেশ সচেতন মানুষ মিলে বন দফতরে খবর দিয়েছে। সর্প উদ্ধার পর্বের সাক্ষী করানোর জন্য দেওর মেয়েদের নিয়ে যেতে চায়। তা যাক। এলাকায় সাপের একটা ইতিহাস আছে। আমাদের বাড়িগুলো বালিয়াড়ির ওপরে, আর বালিয়াড়ি শ্রেণীর মাঝের নিচু উপত‍্যকা গুলোই রাস্তা। সেখান দিয়ে বালিয়াড়ির চুঁইয়ে পড়া জল নিকাশ হয়, আর পথ আট মাসই ভেজা থাকে। তাই পথগুলোর নাম নালবাট – নালাও বটে, রাস্তাও বটে। এই সরু নালবাট গুলো বছর পাঁচেক হল মাঝারি চওড়া ঢালাই রাস্তা হয়েছে। আমাদের বক্সি বাড়ির রাস্তার ধারের জমির অনেকটা জায়গা রাস্তা খেয়েছে। আশেপাশের সব বাড়ির কিছু কিছু জমি গেছে। কিছু পেতে গেলে কিছু ছাড়তে তো হবেই। কিন্তু সেই রাস্তা বানাতে গিয়ে দেখা গেল হাজারে হাজারে কেউটে মরছে। ঐ সরু রাস্তার ধারে ধারে যে এত কেউটে থাকে, তা আমরা কোনদিন জানতে পারিনি, কারণ মানুষের সঙ্গে তাদের কোনো সঙ্ঘাত ছিলনা। অন‍্যদিকে এ এলাকায় কোনদিন ছিলনা, এমন সব সাপের উপদ্রব শুরু হয়েছে। যারা রাস্তা করছে, তাদের বক্তব‍্য ইট বালির লরিতে করে অন‍্য জায়গার সাপ উপকূল অঞ্চলে ঢুকে পড়ছে। কিছুদিন আগেই কালাচের আক্রমণে দুই ভাইবোন মারা গেছে। অথচ কালাচ বা ঘামচাটা সাপ সুন্দরবনের দিকে থাকে, এপারে নয়। বিয়ের পর থেকেই দেখছি আমাদের বাড়িতে রান্নাঘরের জ্বালানি রাখার ঘরে বা খড়ের গাদার নীচে বাস্তুসাপ থাকে। ওগুলো বিষ নেই – দাঁড়াস সাপ, বেশ লম্বা আর মোটাসোটা। বিয়ের সময়ে দোতলাটা টালির চাল ছিল। আমাদের শোয়ার ঘরের দেয়ালের মাথায় কাঠবিড়ালি বাচ্চা দিয়েছিল। হঠাৎ দুপুরে খাওয়ার পরে শুতে গিয়ে দেখি একটা ইউ – এর মতো কালো রড দেয়ালের মাথায়। আমি চিন্তা করছিলাম এখানে কি কোনো রড ছিল! হঠাৎ কর্তা বলে কিনা

    – ঐ দেখো সাপ কাঠবিড়ালির বাচ্চা খাচ্ছে।
    – কী বললে? ভ‍্যাঁ – অ্যাঁ, ও রুণাদা গো ঘরে সাপ ঢুকেছে।

    নিচের লোকেরা শুনেও কেউ পাত্তা দিলনা। কর্তা একটা ফুলঝাড়ু দিয়ে হুস করে দেওয়ালের মাথা থেকে সাপটাকে বাইরের দিকে ঠেলে দিল। সাপটা তখন লেজটা দেওয়ালের মাথায় রেখে ঠিক নিচেই জানালার বাইরে থেকে সোজা ঘরের মধ্যে তেড়ে এল। আমার হৃদপিণ্ড ব্লকড। কর্তা তেড়ে আসা সাপের মাথায় ঝটাস করে ঝাঁটার বাড়ি বসালো। সাপটা বাইরে ছিটকে পড়ে গেল। সরসর করে জঙ্গলে চলে গেল। কর্তা ঝাঁটা রেখে শুয়ে পড়ল, আর আমাকে বললো,
    – এটাই জ্বালান ঘরে থাকে। না মারলেও হত। কিন্তু ঘরে ঢুকেছে বলে রাগ হয়ে গেল। ব‍্যাটা কাঠবিড়ালির বাচ্চা খেল, ঐজন‍্য ঝাঁটার বাড়ি দিলাম।

    এই বলে সে ঘুমিয়ে পড়ল, আমি তখন হাফ অজ্ঞান।


    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
    পর্ব ১ | পর্ব ২ | পর্ব ৩ | পর্ব ৪ | পর্ব ৫ | পর্ব ৬ | পর্ব ৭ | পর্ব ৮ | পর্ব ৯ | পর্ব ১০ | পর্ব ১১ | পর্ব ১২ | পর্ব ১৩ | পর্ব ১৪ | পর্ব ১৫ | পর্ব ১৬ | পর্ব ১৭ | পর্ব ১৮ | পর্ব ১৯ | পর্ব ২০ | পর্ব ২১ | পর্ব ২২ | পর্ব ২৩ | পর্ব ২৪ | পর্ব ২৫ | পর্ব ২৬ | পর্ব ২৭ | পর্ব ২৮ | পর্ব ২৯ | পর্ব ৩০ | পর্ব ৩১ | পর্ব ৩২ | পর্ব ৩৩ | পর্ব ৩৪ | পর্ব ৩৫ | পর্ব ৩৬ | পর্ব ৩৭ | পর্ব ৩৮ | পর্ব ৩৯ | পর্ব ৪০ | পর্ব ৪১ | পর্ব ৪২ | পর্ব ৪৩ | পর্ব ৪৪ | পর্ব ৪৫ | পর্ব ৪৬ | পর্ব ৪৭ | পর্ব ৪৮ | পর্ব ৪৯ | পর্ব ৫০ | পর্ব ৫১ | পর্ব ৫২ | পর্ব ৫৩ | পর্ব ৫৪ | পর্ব ৫৫ | পর্ব ৫৬ | পর্ব ৫৭ | পর্ব ৫৮ | পর্ব ৫৯ | পর্ব ৬০ | পর্ব ৬১ | পর্ব ৬২ | পর্ব ৬৩ | পর্ব ৬৪ | পর্ব ৬৫ | পর্ব ৬৬ | পর্ব ৬৭ | পর্ব ৬৮ | পর্ব ৬৯ | পর্ব ৭০ | পর্ব ৭১ | পর্ব ৭২ | পর্ব ৭৩
  • খ্যাঁটন | ০৩ নভেম্বর ২০২২ | ৬৯০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Kishore Ghosal | ০৩ নভেম্বর ২০২২ ২০:২৬513411
  • দারুণ লাগল, ম্যাডাম। তবে ধুসকা ব্যাপারটা ভুলিনি। 
     
    প্রজেক্ট কন্সট্রাকসনের সময় সাপ চালাচালি খুব সাধারণ ঘটনা। গুজরাটের সাপ আসামে, হরিয়ানার সাপ ছত্তিশগড়ে এমন বেশ কয়েকবার দেখেছি।    
  • Sara Man | ০৩ নভেম্বর ২০২২ ২২:৩৪513413
  • হি হি, ধুসকা আসবে কয়েক পর্ব পরে। সাপগুলো এসে মানিয়ে নিয়ে ভালোই বংশবৃদ্ধি করেছে। নানান সমস্যাও বাড়ছে। 
  • শ্রাবণী মজুমদার | 122.170.135.187 | ০৪ নভেম্বর ২০২২ ০৮:৪৪513422
  • অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এবং এ আমার চিন্তার বাইরে। তোকে অনেক ভালোবাসা নিজের অভিজ্ঞতা share করার জন্য।
  • Sara Man | ০৪ নভেম্বর ২০২২ ১৩:০৭513426
  • ভালো থেকো শ্রাবণী দি। 
  • Manisha Deb Sarkar | 2409:4061:2dce:6daa::c84a:a912 | ০৫ নভেম্বর ২০২২ ১৬:৩৪513470
  • সাপের ব্যাপার টা দারুণ I এরকম দেখার  অভিজ্ঞতা আমার আছে I খুব  ভালো  লাগলো  পড়ে I 
  • | ০৫ নভেম্বর ২০২২ ১৮:২৫513474
  • পশ্চিম এশিয়ায় গিয়ে চাকরি করার কথায় মঞ্জিরার 'লেবারের বিদেশ যাত্রা'র কাহিনীগুলো রেফার করতে পারেন। তবে ওই আর কি মাথায় একবার ঢুকলে যাবার চেষ্টা করবেই তারপর যাই হোক না কেন। 
  • Sara Man | ০৫ নভেম্বর ২০২২ ২১:৪৪513486
  • ধন‍্যবাদ মনীষাদি, তোমার অভিজ্ঞতা শুনব। 
    দ ম‍্যাডাম, আপনি ঠিক বলেছেন,  এবার থেকে ঐ লেখাগুলো পড়ে শোনাব - একেবারে রেডি রেফারেন্স। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। দ্বিধা না করে মতামত দিন