পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | পুনঃপ্রচার |
(এই লেখাটার বেশিরভাগটাই লিখেছিলাম একটি ফেসবুক পোস্টের কমেন্টে, তাই পুরো লেখাটাই একটু খাপছাড়া লাগতে পারে। এখানে আমি সামান্য পরিমার্জন ও সংযোজন করেছি মাত্র।)
আমরা অনেক সময়ই খেয়াল করি না, প্রকৃতির যে ‘ইন্টেলেকচুয়ালটি’—সেটি অত্যন্ত জটিল, যদিও তা প্রাকৃতিক। জটিল এই অর্থে যে আমরা কিছু কিছু সরলরেখা আবিষ্কার করেছি, জটিল কার্ভগুলির বেশীটাই জানি না। আর প্রাকৃতিক এই জন্য যে, প্রকৃতি সচেতনভাবে এককোষী প্রাণী থেকে জটিল ম্যামাল তৈরি করেনি। যে করেছে তার নাম অভিযোজন। সময় চালিত করেছে তাকে। কিন্তু যেহেতু সময় করেছে “প্রাকৃতিক নির্বাচন”-এর মাধ্যমে, তাই মানুষের হিসেবে তার সময় লেগেছে অনেক। প্রকৃতিতে সবকিছুর একটা জীবনচক্র আছে। এই জীবনচক্র ন্যাচারেলি কমপ্লিট হতে একটা সময় লাগে। কিন্তু বেঁচে থাকতে গেলে মানুষের যা যা প্রয়োজন সেগুলিকে উৎপাদন করা দিয়ে শুরু করে মানুষ, এই সময়-লাগার শৃঙ্খলাটা নষ্ট করে দিয়েছে। মানুষের ইতিহাসে সবচেয়ে বৈপ্লবিক চিন্তা হল কৃষিকাজ। অল্প সময়ে অনেক উৎপাদন, অনেক মুনাফা, অনেক অবসর এবং বিনোদন-কলার ক্রমবিকাশ। মূলধনের উদ্ভব, প্রতিযোগিতা, শ্রেণীবিভাজন। এর সবটাই মানুষ-কেন্দ্রিক। এখানে অন্য কারও কথা, ভালো করবার কথা, ভাবার অবকাশ নেই, অন্তত সেই সেদিনের মানুষ ভাবেনি। সে প্রকৃতিকে পুজো করেছে কিন্তু ওই পর্যন্তই। তার মনস্তত্ত্ব আলাদা। কিন্তু ওই যে অ্যাটম বম্ব ইত্যাদি, এসবই অনেক আধুনিক ব্যাপার। অপরকে পরাজিত করে নিজের বংশগতির ক্রমবিকাশ, প্রতিটি স্পিসিসই করতে চায়, চেয়েছে। আন্তঃপ্রজাতিক ও অন্তঃপ্রজাতিক লড়াই ঝগড়া, একদম প্রথম দিন থেকেই ছিল। এটাই নিয়ম। ফার্মিং কিন্তু তুলনায় একেবারেই আধুনিক একটা ব্যাপার। মাত্র হাজার দশেক বছর পুরনো। মানুষ যখন প্রথম ভাষা আবিষ্কার করেছে, নিজেদের মধ্যে সংযোগ-রক্ষা করতে শিখেছে, তখনকার একটা গুহাবাসী মানুষের বাচ্চার সঙ্গে আজকের ম্যানহাটন বা বাগুইআটির নার্সিং হোমে জন্মানো একটা বাচ্চার শারীরিক পার্থক্য তো কিছু নেই। কিন্তু ভাষা এবং সংযোগ-রক্ষার পদ্ধতি অনেক জটিল হয়েছে। অবস্থানগত দূরত্ব অতিক্রম করে কমিউনিকেশনের নানাবিধ পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে মানুষ। অথচ শরীর একই রয়ে গেছে। এখান থেকে জন্ম হয়েছে অন্য এক সংকটের। সেই প্রসঙ্গ অন্য একদিন আলোচনা করা যাবে। কিন্তু বলার কথা এই যে সমস্ত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও মানুষ, যারা আজও খুব প্রিমিটিভ, এই যেমন পিগমি, জারোয়া বা অন্যান্য যে কোনো উপজাতীয়েরা, যারা আজও আনটাচড তাদের কিন্তু গড় পরমায়ু অনেক বেশী, উনিশ শতকের বাঙ্গালী বা ডাচদের থেকে।(এখনকার গড়পড়তা মানুষের যে আয়ু বেড়েছে, তার কারণ শুধুই চিকিৎসাবিজ্ঞানে অসম্ভব উন্নতি।) অর্থাৎ এই যে ভাবে মানুষ বেঁচে আছে, যে পরিবেশে বেঁচে আছে, সেটা মানুষের জন্য অ্যাবনর্মাল। আবার অন্যান্য যারা মানুষের সংস্পর্শে এসেছে, একটা হাতি, চালতা গাছ, জোঁক বা আরশোলা, এরাও কিন্তু নিজে থেকে নিজেদের জীবনযাপন বদলে ফেলেনি। মানুষের নিজের বদল, প্রায় প্রতিটি স্পিসিসের উপর যদিও প্রবলভাবে ছাপ ফেলেছে। তাহলে কী মানুষের সভ্যতার ওই যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ালেই ভালো ছিল? এই সব কূট-প্রশ্নের জবাব দেবার জন্য অবশ্য এই লেখা নয়।
আমি বরং একটা বা দুটো খুব সরল উদাহরণ দিই, যাতে করে অনেকগুলি বিন্দু আমি ছুঁয়ে যেতে পারব।
প্রাকৃতিক ভাবে মানুষ এবং অন্যান্য মাংসাশী প্রাণীর কাছে ডিম একটা সুষম খাবার। মানুষ ডিম খায় মূলত মুর্গির। কিন্তু মুর্গিকে মুর্গির মতো করে তুলতে প্রকৃতির সময় লেগেছে অনেক। মিলিয়নস অব ইয়ার। তো এই বন-মুর্গির ডিম আর মাংসের একটা সীমিত যোগান ছিল মানুষের কাছে। কিন্তু বেশী করে ডিম ও মাংস খাবার জন্য সেই বন-মুরগিকে মানুষ পোষ মানাল। সেটাই ছিল একটা বিরাট উল্লম্ফন। এখন বিংশ শতকে শেষার্ধে এসে এই পদ্ধতিটাকেই আমরা আরও কমার্শিয়ালাইজড করে ফেললাম। একটা খাঁচার ভিতর রেখে তাকে ব্রিড করাতে শুরু করলাম। ফলে এই অসামঞ্জস্যটা আরও বেড়ে গেল। প্রকৃতিতে আর মানুষের নিজের মধ্যেও (বড়লোক ডিম খেতে পারল, গরীব পারল না)। কিন্তু আরও পরে সাম্প্রতিককালে আমাদের জেনেটিক এঞ্জিনিয়াররা একটা জৈব-মেশিন বানাল, যার নাম “ব্যাটারি হেন”। একটা ব্যাটারির মত এক-চিলতে জায়গায়, সে থাকবে কিন্তু নড়বে না। প্রাকৃতিক আলো দেখবে না। মানে জৈব-যন্ত্রটির লক্ষ-লক্ষ বছরের অবচেতনার দিকটি ইগনোর করা আর কী! কিন্তু প্রাকৃতিক মুর্গি, যে সুস্বাদু ও সুষম-খাদ্য ডিম দেয়, মাংস দেয়, তার ওইরূপটি তৈরি হতে তো লক্ষ-লক্ষ বছর লেগেছে। আমরা ডিম দেবার মেশিন চাইছি, ডিমের ভিতর খাদ্যপ্রাণকে ইনট্যাক্ট চাইছি বা মুর্গির মাংস চাইছি কিন্তু ওই মুর্গিটি, যার চৈতন্য আমরা পুরোপুরি মুছে ফেলতে পারিনি, তাকে অন্ধকারে আটকে রেখেছি, দৌড়তে দিচ্ছি না, দৌড়ে গিয়ে মাটি আঁচড়ে একটা কেঁচো মুখে দিতে দিচ্ছি না (যেটা তার স্বাভাবিক খাদ্যাভ্যাস)। তার অসহায়তা, তার অস্তিত্বের আর্তনাদটুকু, আমরা চাইছি না মুর্গির মাংসে বা ডিমে প্রবাহিত হোক। কিন্তু আমাদের ‘বিজ্ঞান’ তো আর এতটা উন্নতি করে উঠতে পারেনি। কারণ মুর্গি, ডিম বা মাংস দেবার (জৈব)যন্ত্র হিশাবে, সাঙ্ঘাতিক জটিল। মানুষের তুলনায় তার যে সামান্য অবচেতনাটুকু ধরা রয়েছে মটর দানার থেকেও ছোট একটি মস্তিষ্কে, সেও কিন্তু কল্পনাতীত জটিল। ঠিক একই ঘটনা ঘটে মাংসের জন্য উৎপাদিত গরু-বাছুরের ক্ষেত্রেও। বিশেষত অত্যাধুনিক মাংস ফার্মগুলিতে। একটা বাছুর জন্মাবার পরেই তাকে মা-গরুর থেকে আলাদা করে একটা ছোট কাঠের ঘেরার, প্রায় চৌবাচ্চার মতো, ভিতর রেখে দেওয়া হয় আমৃত্যু। কখনো অন্য কোনো বাছুরের সঙ্গে সে আর খেলার সুযোগ পায় না। হাত-পা টানটান করবার প্রথম এবং একমাত্র সুযোগ পায়, যখন এই বাছুরটিকে হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় স্লটার-হাউসের দিকে। এই প্রথম ও শেষবারের জন্য সে আরেকটি বাছুরের সঙ্গে একই সাথে হাঁটতে পারে বা আরেকটি বাছুরকে স্পর্শ করতে পারে। অনেকেই ভাবছেন, গরুর জায়গায় ‘বাছুর’ কেন লিখছি এখানে। তাদেরকে বলি, একটা চার, সাড়ে চার মাসের গরুকে আপনি কী বলবেন? চার, সাড়ে চার মাসের বেশি বয়স হলে এই বাছুরগুলির তুলতুলে সুস্বাদু মাংস, ধীরে ধীরে জটিল আঁশযুক্ত হয়ে যেতে শুরু করে ক্রমে, যার দাম নেই বাজারে। (ভারতীয় উপমহাদেশে অবশ্য এমন সব অত্যাধুনিক ফার্ম নেই বললেই চলে।)
এখন কথা হল, মিউটেশান একটা খুবই অলৌকিক ঘটনা। সর্বোচ্চ মানের ইনফরমেশন টেকনোলজি ব্যবহার করে প্রকৃতি। কী ভাবে জিনের ভিতর কোডিং করে প্রকৃতি বা প্রাণ, বিজ্ঞান তা অনুমান করতে পারলেও এখনো তার সিকিভাগও বুঝে উঠতে পারেনি। বিজ্ঞান শুধু ধরে নিয়েছে ‘ট্রায়াল অ্যান্ড এরর’ পদ্ধতিতে এই সব কোডিং হয়। কিন্তু এ ব্যাপারে অনেক ধোঁয়াশার জায়গা আছে। এ নিয়ে লিখতে গেলে লেখাটা, যেমন ছোটো লেখা লিখতে চাই, তেমন হবে না। তার চেয়ে বরং শুধু একটা তথ্য দিই। প্রকৃতির এই কোডিং বা তথ্য-প্রযুক্তি কতটা সফিস্টিকেটেড সেটা বোঝার জন্য এই একটি তথ্যই যথেষ্ট, আর তা হল এক গ্রাম ডিএনএ-এর ভিতর যে ডেটা মজুত থাকে তার পরিমাণ প্রায় ২১৫ পেটাবাইট বা ২১৫ মিলিয়ন গিগাবাইট। মানে? একটা পুরো সল্টলেক আই টি হাব, হ্যাঁ ওই এক গ্রামের ভিতর! জিন যে ভাবে ইনফরমেশান বা ডেটা স্টোর করে রাখে, তাতে আজ পর্যন্ত যত বই লেখা হয়েছে সেই একদম শিলালিপির যুগ থেকে, আজ পর্যন্ত যত গান গাওয়া হয়েছে, যত মুভি তৈরি হয়েছে, মোট কথা মানুষের সব জ্ঞান-বিজ্ঞানকে একটা ঘরের মধ্যে স্টোর করে ফেলা যায়।হ্যাঁ, স্রেফ একটা ঘর। তাই আমরা একটা বাছুরের ওই কল্পনাতীত জটিল জিন-কোড থেকে বাছুরটির উতরোল কান্না, সীমাহীন হতাশাকে নির্মূল করে, শুধুই তুলতুলে সুস্বাদু মাংস ব্রিড করবার পদ্ধতি আয়ত্ত করতে পারিনি। হয়তো সম্ভবই না। কিন্তু ফার্মিং হ্যাচিং ব্রিডিং কোনো কিছুতেই এই জটিলতাকে ‘অযথা’ গুরুত্বও দেওয়া হয়নি। এমনকি এটা কেউ স্বীকারও করছে না। অবশ্য অল্প কিছু বড়োলোক মানুষ, কোনো ঝুঁকি না নিয়ে, অরগ্যানিক ডিম, দুধ, মাংস সবজি কিনতে পারছেন এবং সেগুলি খাচ্ছেন। (এখানেও অসাম্য তৈরি হচ্ছে। সবাই পারছেন না)
তাই হয়তো খুবই ভাসাভাসা করে বলা হল জানি, ফার্মিং বা চাষবাস থেকে যেমন সভ্যতার শুরু আবার সেখান থেকেই শেষেরও শুরু। কেননা এখান থেকেই শুরু হল সঞ্চয়, মুনাফা, চাহিদা, শোষণ। শুরু হল অসম প্রতিযোগিতা, নিজের গোষ্ঠীর ভিতর এবং প্রকৃতির অন্যান্যদের সঙ্গে। জঙ্গল-ধ্বংস থেকে দাস-প্রথা সবকিছুরই শুরু এখান থেকে। মানুষের এই জীবনযাপনের বদলটা পৃথিবীটাকেই বদলে দিল। এটা ঠিক মেরুপ্রদেশের বরফ গত দশবছরে যতটা গলেছে, গত দশ হাজার বছরেও ততটা নয়। কিন্তু আমি বলতে চাইছি, শেষের শুরু এখান থেকে নয়, অনেক আগে থেকে শুরু হয়েছে। মাসানোবু ফুকোওকা (Masanobu Fukuoka) একটা সমাধান দিয়েছিলেন এই বলে, যে আমাদেরকে আবার সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে চাষ করতে হবে, মানে একদম আদিম উপায়ে। কীটনাশক তো দূরের কথা, কর্ষণ পর্যন্ত করবার দরকার নেই। এবং এই পৃথিবীতে বসবাসকারী প্রতিটি মানুষকে এই চাষে অংশগ্রহণ করতে হবে, দেশের প্রেসিডেন্টকেও। মানে দিনের নির্দিষ্ট একটা সময়, চাষবাসের জন্য বরাদ্দ রাখতেই হবে প্রত্যেককে, শারীরিকভাবে সক্ষম হলে। তিনি “একটি তৃণ-খণ্ডে বিপ্লব”-এ ব্যাখ্যাও দিয়েছিলেন, এতে কীভাবে প্রকৃতি তার ভারসাম্য বজায় রাখতে পারবে। প্রসঙ্গক্রমে, এই যে পৃথিবীর প্রাণীকুল জীবজগৎ একটা সংকটকালে এসে উপস্থিত হয়েছে, এর শুরুও কিন্তু মানুষের নিজের কৌমকে রক্ষা করার তাগিদ থেকেই। অপত্যস্নেহ, শিশুর প্রতি মায়ের ভালবাসা, তা সে যতই স্বর্গীয় হোক না কেন, একটা বেসিক ইন্সটিঙ্কট। আর প্রকৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে, খাদ্য-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে, রুখে দিতে হবে উষ্ণায়ণ, গ্রিনহাউজ এমিশন—এইসব চিন্তা যে উদ্দেশ্যে, কৃত্রিম প্রজনন বা আধুনিক পদ্ধতিতে চাষবাস, এসবের শুরুও হয়েছিল সেই একই উদ্দেশ্যে। উদ্দেশ্যহীনতা কখনো মানবসভ্যতার অংশ নয়। আজও নয়। উদ্দেশ্য একটাই, ‘আমার জিন-কোডকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে’। মানুষ এটা সচেতন এবং অচেতন, দুভাবেই করে। আর মানুষ ব্যতীত অন্য সব প্রাণী, উদ্ভিদ এই একই উদ্দেশ্য ধাবিত, অবচেতনভাবে বা প্রবৃত্তিগত ভাবে। ভালো বা খারাপ যাই করুক মানুষের সবটাই তুলনামূলক ভাবে সচেতন, মনুষ্যত্বর প্রাণের তুলনায়।
পছন্দ | জমিয়ে রাখুন | গ্রাহক | পুনঃপ্রচার |
ভালো লাগছে