এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক

  • করোনাকালীন দ্বিতীয় খন্ড

    Anuradha Kunda লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৬৩৩ বার পঠিত | রেটিং ৩ (২ জন)
  • #করোনাকালীন (দুই)


    ষোলো


    ( আগের সব পর্ব ও প্রথম খন্ড আছে গুরুচন্ডালীর ব্লগে)


    হাতিটা কোমর সমান জলে দাঁড়িয়ে । ভিতরে ভিতরে ফেটে যাচ্ছে। মরে যাচ্ছে। জলের কাছে গেছিল ঠান্ডা পেতে ।ও ভেবেছিল শীতলতা ওর যন্ত্রণা জুড়িয়ে দেবে। কিন্তু মনুষ্যকৃত বোমা অধিকতর শক্তিশালী । জল হেরে গেল।অদিতি চোখের সামনে কেবল একটা বিশাল জন্তুকে দেখতে পাচ্ছে।যার বাইরে কোনো যন্ত্রণার প্রকাশ নেই।সমস্ত যন্ত্রণা ভিতরে ।মুখের মাংসপেশি বিস্ফোরনে ছিন্নভিন্ন। অনাগত সন্তানটির প্রাণ আস্তে আস্তে নিভে যাচ্ছে । তিলে তিলে মরে যাচ্ছে জননী হস্তিনী।মানুষগুলো পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে দেখছে নিজেদের কৃতকর্ম। 


    অতিরিক্ত স্ট্রেসের জন্যই হবে হয়তো।অদিতির গা গুলোচ্ছে। বহুদিন বাদে এইসময় ও বাড়িতে। দোতলার চারটি ঘরের একটিতে অচ্যুত' ও মুমতাজ থাকেন। বাকি দুটো দুই বোনের আরেকটি বেশ বড় ঘর অচ্যুতের স্টাডি।আইনের বই ঠাসা।তবে ফিল্মে যেরকম আইনি কেতাব ঠাসা বদ্ধ সেট হয়, এই ঘরটি সেরকম নয়।যথেষ্ট খোলামেলা।বড় বড় জানালা আছে ।আছে একটি বে উইন্ডো।অদিতি ছোটোবেলাতে এই বে উইন্ডোতে উঠে বসে থাকতো। এখান থেকে অনেকটা সবুজ দেখা যায় । 


    ঘরগুলির সামনে একটা লম্বা টানা বারান্দা।মুমতাজের শখের কিছু গাছপালা সাজানো তাতে।মুমতাজ এতদিন না থাকাতে সুনি তাদের পর্যাপ্ত দেখাশোনা করেছে।ফনফন করে বেড়ে উঠেছে সবুজ। 


    বস্তুত এই বাড়িতে তা বা এই বারান্দাতে দাঁড়িয়ে মনেই হবে না যে কোভিড নাইন্টিন নামক কোনো ভাইরাস গোটা পৃথিবীর গতি থামিয়ে দিয়েছে। কর্মচ্যুত মানুষ, মরে যাওয়া মানুষ, পায়ে হাঁটা মানুষ, ভেন্টিলেশনে মানুষ, কিছুই বাস্তব বলে মনে হবে না এই বারান্দাতে বাঁশের দোলনায় বসলে।এখানে পৃথিবী অনেকটাই স্থির।নিস্তরঙ্গ । কাঠের রেলিংএ পিচ্ছিল মেহগনি বার্ণিশ।অদিতি হাত বোলাচ্ছিল।মুমতাজ খুব দক্ষভাবে নিয়মিত'এসবের দেখাশোনা করেন।একটি লোক আছে। তাকে দিয়ে সব কাজ করান নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। সুনি যতটা পারছে করছে।এখন তো লোক আসছে না।গোটা বাড়ি দেখে রাখা চাপ তো বটেই।করে যাচ্ছে মেয়েটা।


    মুমতাজ ফোন করেছিলেন খানিকক্ষণ আগে।আম্ফানের পর নেটওয়ার্ক ছিল না।এখন একটু একটু করে ঠিক হচ্ছে। পাকসার্কাসে মুমতাজের ফুফুর বাড়ি।প্রথমে তিনি সেখানেই ছিলেন। লকডাউন হয়ে যাওয়ার পর আর ফিরতে পারলেন না।ফুফুর বাড়িটি ছোট ফ্ল্যাট।সবসময় তাদের বসার ঘরটি অধিকার করে থাকা অস্বস্তিকর ।বিশেষ করে যখন ছেলেমেয়েরাও বড় হয়েছে। লকডাউনের মধ্যেই কোনোমতে গাড়ি অ্যারেন্জ করে মুমতাজ তাঁর বান্ধবী নাজমার ফ্ল্যাটে চলে এসেছেন। নাজমা ও তাঁর স্বামী আমজাদ পার্কস্ট্রীটের একটি বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকেন।ছেলেরা বিদেশে। কাজেই এখানে কোনো অসুবিধে নেই।বরং দুই বন্ধু বহুদিন বাদে মিলেছেন।এরকম সুযোগ আর কবেই বা হবে। সব ঠিক কিন্তু ভেতরে প্রচন্ড চাপা টেনশন।নাজমার ছেলেরা ক্যালিফর্নিয়াতে একজন। ইউ কে তে আরেকজন।টিভিতে মৃত্যুমিছিল দেখতে দেখতে দুই বন্ধুই কেঁপে ওঠেন। 


    মুমতাজের টেনশন ফোনে স্পষ্ট।


    - বাবলস। তুমি বাইরে যাওয়া বন্ধ করো প্লিজ।পুণের অবস্থা ভালো না 


    - ডোন্ট ওরি মা। আমি ঠিক আছি। আচ্ছা শোনো।দেব কি ফোন করেছিল তোমাকে?


    - করেছিল।হিজ মাদার হ্যাজ গান টু ডিপ ডিপ্রেশন।ও বলছিল একদিন ওদের বাড়িতে যেতে। আই ডোন্নো ওয়াট টু ডু।লকডাউন চলছে।বাট হি সিমড টু বি ভেরি ডিস্টার্ব্ড।


    মুমতাজ, স্পষ্টতই দেবরূপকে খুব স্নেহ করেন।অদিতি আর দেবরূপের সম্পর্ক তাঁর জানা।তাই তাঁর চিন্তা কিছু অধিক।


    - তুমি যাবে মা? সেটা ঠিক হবে?


    - শি ইজ সিক।ফিজিক্যালি অ্যান্ড মেন্টালি। যাওয়া তো উচিত বাবলস। নয় কি?


    অদিতি চুপ করে থাকে।রেলিংএর ফাঁকে পিছলে পড়া রোদের মায়া বড় তীব্র।মুমতাজের মুসলিম আইডেন্টিটি উইল সার্টেইনলি ক্রিয়েট আ হিউজ ইশ্যু। ও শুনে শুনে দেবরূপের মা' কে অনেকটা বুঝতে পারে। উনি নিজেও অন্য'কাস্টে বিয়ে করেছেন।শি ওয়জ মন্ডল অ্যান্ড ত্রিদিব ওয়জ সেনগুপ্তা।অনেক সমস্যা হয়েছে ত্রিদিবের বাড়িতে দেবের ঠাকুমা ওয়জ রুড টু হার। উনি অনেক প্লিজ করে চলেছেন ভদ্রমহিলাকে।


    অদিতি অত প্লিজ করতে পারবে না। সে নিজের কাজের জায়গাও শিফ্ট করতে চায় না।বড়জোর মুম্বাই ।নট ইন কলকাতা। কাজেই মালবিকার সঙ্গে থাকার কোনো গল্প নেই।বাট কনসেন্ট ম্যাটারস।দেব ইজ হার ওনলি সন।দেয়ার ওনলি সন।


    অন্যমনস্কভাবেই অদিতি বলল, যাও।


    - আজ যাব ভাবছি।


    - গাড়ি?


    - ও দ্যাটস নট আ প্রবলেম। আমজাদ ভাই ড্রপ করে দেবে। 


    আমজাদ কলকাতা পুলিশে আছেন। কোনো অসুবিধে হবার কথাই নয়।


    - বাট দেন।মা। আমাদের কথা বোলো না।অন্তত এখন।


    - ডোন্ট বি কিডিশ বাবলস। উনি অসুস্থ আর এর মধ্যে গিয়ে আমি তোমাদের বিয়ের কথা বলব? ভাবলে কী করে? টেক গুড কেয়ার অব ইওরসেল্ফ।


    মুমতাজ ফোন রেখে দেন।


    অদিতি তবু চিন্তায়।আফটার ওল, মা তো । যদি মুখ ফসকে কিছু বেরিয়ে যায়! অদিতি তার মা' কে খুব ভালো চেনে।অসম্ভব রিসার্ভড প্রকৃতির মহিলা।কিন্তু দেবরূপের বাড়িতে যাবার উদ্দেশ্য শুধু মালবিকাকে কার্টসি ভিসিট নয়। মা খুঁটিয়ে ওদের বাড়ির চালচলন দেখে নেবে, অ্যাম্বিয়েন্স, অ্যাটিচ্যুড সব দেখবে।অদিতি কতটা কমফর্টেবল ফিল করবে ওদের সঙ্গে ক্যালকুলেট করবে। মায়ের ক্যালকুলেশন খুব শার্প।সিক্সথ সেন্সও। এমনিতে অদিতি নিজেই দেবরূপকে বলে, বাড়িতে বলছিস না কেন। কিন্তু এখন ওর নিজেরই অস্বস্তি হচ্ছে। দরকার নেই তাড়াহুড়োর। আর বিয়ে করতেই হবে তারই বা কী মানে আছে! ছোটবেলার মতো বে উইন্ডোতে উঠে বসে আছে অদিতি। অচ্যুতের এই স্টাডিতে একটা অদ্ভুত গন্ধ আছে।ন্যাপথালিন।ওডোনিল শুধু না।আরো কিছু। ছোট থেকে গন্ধটা পায় ও।।


    আজ কিছুতেই দেবরূপের কথা ভাববে না ঠিক করেছে কারণ ভাবলেই টেনশন, রাগ। এমন কিছু কাজ করতে হবে যাতে মন তাতে এনগেজড থাকে।পুরোনো খবরের কাগজ ডাঁই হয়ে পড়ে আছে।জানালা থেকে লাফ দিয়ে নেমে কাগজগুলো গোছাতে লাগল অদিতি।


    ফোন করল সুনি।ও খুব বেশি ওপর নীচ করে না।আর এই করোনার সময় একদম না।এখন ডাক্তার পাওয়া ভীষণ মুশকিল ।বন্ধু যারা ডাক্তার তারা কোভিড পেশেন্ট নিয়ে ভীষণ ব্যস্ত ।নিজেরাও বাড়িতে ফিরতে পারছে না। 


    সুনি জিজ্ঞেস করলো লাঞ্চে কী খাবে। অদিতি লাঞ্চ বাড়িতে করেই না প্রায় । আজ একটা ওকেশন। কিছু না ভেবেই চোখ বুজে বলে দিল বিরিয়ানি। বিরিয়ানি রান্না হলে বাড়িতে একটা মা মা অ্যাটমসফিয়ার তৈরি হয়।ওর এখন সেটা খুব দরকার ।


    পরক্ষণেই ভাবল সুনির ওপর চাপ হয়ে গেল না তো।বিরিয়ানির সরঞ্জাম আছে কিনা কে জানে।বলল, লিভ ইট।মেক সামথিং নাইস।


    সুনি ফোন রেখে দিল।অদিতি জানে ও বিরিয়ানিই বানাবে। টুকটুক করে কিচেনে অনেকটা সময় দেয় ও। ভালোবাসে।শি হ্যাজ হার ওন ওয়ে।বাড়িতে একা একা থাকতে ভালোবাসে।খুব কম বন্ধু বান্ধব।অদিতির অপোজিট । 


    একটা সাদা লং স্কার্ট পরেছে অদিতি।ফ্লোয়িং টাইপ। সাদা কালো চেক শার্ট। চুল খোলা।এত ক্যাজুয়ালি ওকে খুব কম দেখা যায় ।অতুল ফোন করে জানিয়ে দিয়েছে যে ব্রেকফাস্ট হ্যাজ বিন সার্ভড। তিনি খেয়েছেন।ওষুধ খেয়েছেন।নিশান্ত চলে যাবে সময়মত।


    অচ্যুত এখন অনেকটা সময় বাগান পরিচর্যা করবেন। অদিতি জানালা দিয়ে দেখল দীর্ঘদেহী অচ্যুত গাছের গোড়া কোপাচ্ছেন।উইডস তুলে ফেলে দিচ্ছেন। এত নরম ভঙ্গিতে এইসব কাজ করছেন যে মনে হচ্ছে কোনো বৃক্ষদেবতার সেবা করছেন তিনি। অচ্যুত শিবরামণ, অকল্পনীয়ভাবে এবং আশাতীত ভাবে ঈশ্বর নিয়ে কোনো বাড়াবাড়ি করেন না। তাঁর সম্প্রদায়ের মধ্যে তিনি কালাপাহাড় এই বাড়িতে পূজোপাঠের চল নেই।অচ্যুতের দেবতা তাঁর ক্লায়েন্টরা।সম্ভবত।


     নামাজ পড়েন মুমতাজ।সেও একান্তে। কোনো আড়ম্বর নেই।অদিতি ও সুনিধি কিছুই করে না।তাদের বলাও হয়নি কখনো। অচ্যুত ও মুমতাজ দুজনেই এ ব্যাপারে আশ্চর্য নীরব ।নির্মোহ। মেয়েরা নিজেদের মত' বড় হয়েছে । অদিতি খুব ধর্মভীরু কোনো পরিবারে গিয়ে মানিয়ে নিতে পারবে না।সে নিজেও জানে।ইট যাস্ট ডাসন্ট স্যুট হার টেম্পেরামেন্ট। প্রেম যখন এসেছিল তখন এতসব কিছু তলিয়ে ভাবেনি অদিতি।বাট নাউ ইট ইজ টাইম টু থিংক। দেবরূপের মা।মালবিকা মন্ডল ট্রায়েড হার বেস্ট টু বিকাম মালবিকা সেনগুপ্ত।অদিতি সেটা করতে পারবে না। লাভ ইজ ইমপরট্যান্ট। বাট ম্যারেজ ইজ নট দ্যাট ইম্পরট্যান্ট টু হার। 


    অদিতি নিজেকে ঝাঁকিয়ে দেখছে সে ঠিক কী চায়।অচ্যুত গাছের গোড়ায় সার দিচ্ছেন। অল্প জল।এই বাড়ির ধারেকাছে কোথাও অতিমারীর প্রকোপ চোখে পড়ে না।সামনে লোহার গেট বন্ধ ।শুধু টেলিভিশনের খবরে বা খবরের কাগজে ।অথবা ফোনে নেটে। মৃতের সংখ্যা দেখা যায় ।মৃত্যুর গন্ধ ভেসে আসে। কাগজ সরাতে গিয়ে চোখ পড়ে রেস্তঁরা বন্ধ। মাইনে নেই।গলায় দড়ি দিয়েছে কর্মচারী। অনেক অনেক নির্মাল্য সামন্ত।


    অদিতির আবার বমি পায়।কেন যে সুনিকে বিরিয়ানি বানাতে বলল! টোস্ট ফোস্ট কিছু খেলেই হত! 


    ওর মাথা থেকে হাতিটি কিছুতেই যাচ্ছে না।জলের মধ্যে তার করুণ দাঁড়িয়ে থাকা হাতুড়ির মত বাজছে।চারদিন মুখের মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে জলে দাঁড়িয়ে । দুটি হাতি আনা হয়েছিল তাকে সরাবার জন্য।সে নড়ে নি।মৃত্যুর অপেক্ষা করে গেছে শুধু। অদিতির কান্না পাচ্ছে।


    এই মুহূর্তে দেবরূপের সঙ্গে কথা বলতে পারলে অনেকটা হালকা লাগত। অনেকটাই অভ্যেস। কাজের ফাঁকে ফাঁকে স্কুটি নিয়ে দৌড়ানো। খাবার তৈরি করা।একসঙ্গে সময় কাটানো।


    টিপ টিপ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ছোটবেলার মত হাত বাড়িয়ে জলের স্পর্শ নিল অদিতি। অচ্যুত ঐ টিপ টিপ বৃষ্টি পাত্তা দিচ্ছেন না। প্যাশন ফ্লাওয়ারগুলো দিব্যি ফুটেছে।এই রকম বৃষ্টিতে অদিতি আর দেবরূপ হামেশাই স্কুটি নিয়ে বেরিয়ে যেত। ভিজত। মুথা পার করে চলে যেত ঐ প্রান্তে। কতদিন দেবরূপের ফ্ল্যাটে থেকে গেছে সে। দেবরূপের বারমুডা আর শার্ট পরে নিয়েছে।তুমুল ভালোবেসেছে তারা। অতলান্ত নিবেদন ছিল তাদের মিলনে সেই সব বর্ষণমুখর দিনে।নাথিং ক্যালকুলেটেড। আবার ভাবছে তাই কী? সব স্বতস্ফূর্ত ছিল? বাট দেন দে টুক প্রিকশান। তবে?


    সমুদ্রের ঢেউ ছিল তবু।অদিতি চোখ বুজে মনে করে। দোজ ওয়ের ডেজ ।তারপর সব অভ্যেস।


    কোভিড কি সব আনন্দ গিলে ফেলল?


    তেতো লাগছে। কষটে সব কিছু। তবু একটা মেসেজ করে ফেলল অদিতি। টু বি পলিটিক্যালি কারেক্ট। এও বাহ্য ।প্রেমের পলিটিক্স না। হিসেব । আর মিসআন্ডারস্ট্যান্ডিং বাড়িয়ে দরকার নেই।যত সব ছেলেমানুষি।লিখল


    স্ট্রেসড। টেকিং টোটাল রেস্ট অ্যাট হোম টুডে।অতুল উইল টেক কেয়ার । 


    লিখে শেষ লাইনটা কাটল । আবার লিখল 


    ক্যান ইউ ম্যানেজ?


    আধঘন্টা পর রিপ্লাই এল। হমমম। 


    ঝেড়ে ফেলে নিজের ঘরে ঢুকে গেল অদিতি।প্রজেক্টর আছে ছোট।স্ক্রিন আছে একটা।দেওয়াল জোড়া তাকে ফিল্মের বইপত্র।


    সাতাশহাজার বন্য হাতি ভারতে। বিপন্ন। মানুষ গিলে নিচ্ছে হাতির অধিষ্ঠান ক্ষেত্র । ভাইরাস গিলে নিচ্ছে মানুষকে। এ তো হবারই ছিল। 


    চেন্নাই থেকে , কোচি থেকে ক্লিপস পাঠিয়েছে রাঘবেন্দ্র । সেও ডকু ফিল্মমেকার। নর্থ কাভার করছে যশবন্ত , তুর্ণা আর মিরাজ।


    রাঘবেন্দ্রর ক্লিপস দেখবে আগে। ওর ঘরে কফির ব্যবস্থা আছে। কড়া করে কফি বানিয়ে ঝাঁকড়া চুলগুলো টাইট করে বাঁধলো। 


    টাইম টু ওয়র্ক। কনসেনট্রেট। কোভিড কি সত্যি থামিয়ে দিয়েছে সবকিছু?


    হ্যাজ কোভিড স্টপ্ড দ্য ওয়র্ল্ড।


    নিজের আসে পাশে দ্যাখো।ডোন্ট গো বাই মিডিয়া। অচ্যুত বলেন।


    প্রজেক্টর চলছে।কেরলের পালাক্কাড জেলার পুক্কোতোকাভু গ্রামে ডকু তুলেছে রাঘবেন্দ্র জয়সওয়াল ।জলের প্রচন্ড অভাব ওখানে।মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিমে কাজ । মেয়েরা মাটি খুঁড়ে কূপ বানাচ্ছে। প্রায় তিনশো মেয়ে মিলে একশো নব্বইটি কূপ খনন করেছে। রাধা নামে একটি মেয়ের ইন্টারভিউ চলছে। 


    -প্রথমে খুব ভয় ছিল আমাদের। খুব অস্বস্তি ।ভাবতাম যে এটা পুরুষদের কাজ। আমরা কেমন করে পারব? তারপর কাজ শুরু করলাম।প্রতিদিন কাজ এগোয় আর আমাদের সাহস বেড়ে যায় । দিন প্রতি দুশো চল্লিশ টাকা রোজগার।মেয়েরা হাসছে।কী ঝকঝকে হাসি! 


    মুড ভালো হয়ে গেল।রাঘবেন্দ্র দারুণ কাজ করেছে। লাইফ ইজ নট স্টপ্ড।


    গন্ধ আসছে একতলা থেকে । জাফরান , জয়ত্রী, এলাচ, দারচিনি সব একসঙ্গে বেটে ভাজছে বোধহয় সুনি।


    ঠিক সেই মুহূর্তে ফোন।মুমতাজ ।


    - বাবল্স ।ডোন্ট ওরি। আমি দেবরূপের বাড়ি খুঁজে পেয়েছি।হিজ সিস্টার ইজ উইদ মি। 


    - ওকে। বি কেয়ারফুল।বেশি কিছু বোলো না।


    ওপাশে ঝরঝর করে হেসে ফেললেন মুমতাজ।(চলছে)



    # করোনাকালীন ( দুই)


    সতেরো


    বাঁধ ভেঙে গেছে ঝড়ে।লেবারদের কাম নাই দুই মাস। ঝড়ের পর ফিশারির কামও নাই।মাছ মরে গেলে কী বেচব? কী খাব? বলছিলেন সুপ্রভাত দাস। সুঠাম কৃষ্ণবর্ণ মানুষটি।চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা।সাদা কালো ছবির পর্দা থেকে উঠে এসেছেন যেন। সেই এক সমস্যা সর্বত্র। নোণা জল ঢুকে সব মিষ্টি পানি লবণাক্ত হয়ে গেলে মাছ মরে যায়।বাড়িঘর নাই।সুপ্রভাত এখনো দুঃস্বপ্ন দেখেন টিন আর অ্যাসবেসটাস উড়ে যাচ্ছে।


    টুপুর নোট নিতে নিতে বুঝতে পারছিল , তার কাজটা নেহাত শৌখিন।ফালতু। তার ঝড়ের অভিজ্ঞতাও নেহাত কিছু না।কাঁচ ভেঙে পড়ে আছে, হাত পায়ে কাটাকুটি আর বাগানটা শেষ শুধু।আর কিছু খুচরো ক্ষতি । 


    উত্তর'চব্বিশ পরগণার পঁয়ত্রিশ হাজার বাড়ি উড়ে গেছে।কিছু নেই।কিচ্ছু না।হাসনাবাদ গেছিল ওদের টিম রিলিফ নিয়ে । গিয়ে বুঝেছে যে রিলিফ একটা হাস্যকর' টার্ম।ক'দিন চলবে! একটার পর একটা রিলিফ আসছে ঠিক ।কিন্তু ভেতরে বিস্তর গন্ডগোল।হাসনাবাদ আগে এসেছে ও।মা আর মায়ের কলিগদের সঙ্গে । ফ্যামিলি ট্রিপ বহুদিন হয়না ওদের। সেই ছোটবেলায় ।এখন মা কলিগ বা ক্লাসমেটদের সঙ্গে বেড়াতে যেতে বেশি পছন্দ করে। বাবা গেটস হিজ ফান টাইম উইদ রিনা। হাসল টুপুর। কী ফ্যামিলি বাবা।এর জন্য মা হেদিয়ে মরেছিল। এখন চারজন কোথাও গেলে কথা খুঁজে পায় না।ভাবে সন্ধেবেলা কী করবে।তার চেয়ে মায়ের ক্লাসমেটসরা ভালো। সন্ধেবেলা ব্যাজার না। ব্রিজার নিয়ে বসবে। ফিশ ফ্রাই। ফাটিয়ে আড্ডা ।ওরা সেবার এসেছিল সোনার বাংলাতে। সুইমিং পুলের নীল জলে গা ডুবিয়ে স্নান সকালে বিকেলে। ইলিশের ভ্যারাইটি নিয়েছিল সবাই । ও ইলিশ খেতে পারে না।টুয়েলভ ছিল তখন। দুরন্ত জেদী কিশোরী এক । একটা টোটো নিয়ে একাই ঘুরেছিল টাকি, হাসনাবাদ। তখনো নুসরত এম পি হন নি।খুব পিসফুল মনে হয়েছিল জায়গাটা।


    এবার পুরো ধ্বংস দেখছে। 


    এবার কোনো শান্তির ছবি নেই।এমনিতেই জোয়ারের সময় নোণা জল মিষ্টি জল মিশে যায় ।আম্ফান চরমটা দেখিয়ে দিয়েছে।মিষ্টি জলের মাছ শেষ।বলছিলেন মাছ ব্যবসায়ী অরিন্দম গাংগুলি । মিষ্টি জলের মাছ মানে রুই, কাতলা, পুঁটি।মাছের চাষ বন্ধ পুরোপুরি।পুকুরে একটা শোল মাছও ঘাই মারে না।ল্যাটা পুঁটিও'নেই। গেঁড়ি গুগলি পুড়িয়ে খাবে কী, নেই তো!


    ওদের টার্গেট এরিয়া প্রথম সপ্তাহে ছিল সুন্দরবন। দ্বিতীয় সপ্তাহে ক্যানিং, গোসাবা, বাসন্তী, বসিরহাট, হিঙ্গলগঞ্জ, হাসনাবাদ।


    জাহির আর মেধা খুব যত্ন করে প্ল্যানিং করেছে। একটা দিকে বেশিবার যাওয়া যাবে না।পলিটিকাল ইন্টারফিয়ারেন্স চলে আসবে।লোকাল পলিটিক্স খুব মারাত্মক।ওরা সবরকম লোকাল রাজনীতির বাইরে থেকে ত্রাণ দেবার চেষ্টা করছে।যেটা খুব কঠিন।একটা ফুটবল টিম।ওরা এগারো জন ।


    হাসনাবাদে বিদ্যুত নেই।তাই জল নেই ।


    নুর আলি মোল্লার বাড়িতে অনেকটা সময় ছিল ওরা। পিসিকালচারে কয়েক লক্ষ টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন উনি।ঝড়ে সমস্ত পুকুরে উড়ে এসে পড়েছে গাছের ডাল আর পাতা ।দেড় কোটি টাকা ক্ষতি হয়ে গেছে ওঁর। ছয় সাতদিনেও পচা মাছ তুলে শেষ হচ্ছে না।


    রক্তিম ফোন করেছিল যখন তখন ওরা নুর আলির বাড়িতে বসেই মুড়ি গুড় খাচ্ছে। টুপুরের মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। রক্তিম অদ্ভূত একটা ডমিনেটিং ফোনে কথাবার্তা বলে আজকাল। ইরিটেশন হয়।


    প্রথমেই প্রশ্ন করবে


    - কী করছিস? কোথায় আছিস?কে আছে সঙ্গে?


    টুপুরের জাহিরদের সঙ্গে কাজ করাতে ঘোরতর আপত্তি রক্তিমের। ওর মতে এগুলি ইউজলেস। ওয়েস্টেজ অব টাইম।এনার্জি।মানি। লোক দেখানো।


    - কেন?


    - আমরা রেগুলার ট্যাক্স পে করি। সরকারের দায়িত্ব ন্যাশনাল ডিজাস্টার কন্ট্রোল করা। যেটা করছিস সেটা ঐ বালের জাহিরের পোঁদপাকামির জন্য।ব্লাডি মাদারফাকার।


    রক্তিমের মধ্যে ইদানীং একটা ক্রুড হিন্দুত্ববাদ দেখা দিচ্ছে।আগে এটা ছিল না।বা প্রকাশ পায় নি।


    ঐ সময় ভীষণ অসুস্থ বোধ করতে থাকে টুপুর। এই রক্তিমকে ও ছোটবেলা থেকে জানে মায়ের বন্ধুপুত্র হবার সুবাদে। ওর মাথায় নারকেল তেলের গন্ধ থাকত তখন। ভীষণ ছোট করে ছাঁটা চুল। গোল চোখ। ক্যাডবেরি অন্যের মুখের কাছে ধরেই নিজের মুখে ঢুকিয়ে নিত গোটাটা। হা হা করে হাসত।রেগে গেলে চিমটি কাটত'জোরে। দুন স্কুল আর ব্যাঙ্গালোরে এম বি এ। তারপর ফ্র্যাঙ্কফার্ট স্কুল অব ফিনান্স অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট।রক্তিম এলিজিবল ব্যাচিলর হয়ে গেল বাবা মায়ের কাছে। 


    ওরও তো প্রথমে খারাপ লাগেনি।ভেবেছিল এত এক্সপোজার পেয়েছে রক্তিম।নিশ্চয়ই খুব লিবারেল হবে। তাছাড়া ও তখন ডেসপেরেটলি কাউকে চাইছিল।যার সঙ্গে সব কিছু শেয়ার করা যায় । অনেকটা কমন ইন্টেরেস্ট থাকে। বন্ধুদের সবার বয়ফ্রেন্ড আছে।শি শুভ হ্যাভ সামওয়ান।


    এখন বোঝে সেটা কত বড় বোকামি ছিল, ছেলেমানুষি ছিল , এখন ফিল করে মাঝখানের গ্যাপ। লিবারেল হওয়া মানেই ঔদার্য নয়। ঔদার্য ইজ সামথিং এলস। হুইচ হ্যাজ গট সামথিং টু ডু উইদ স্পিরিচুয়ালিটি। নট রিচুয়ালস । সামথিং এলস।দ্য ডিভাইন ইনসাইড ইউ।


    মিশতে মিশতে মনে হয়েছে ।রক্তিমের মধ্যে সেটা নেই। খাওয়া শেষ করে ও নুর আলির বাড়ি থেকে বেরিয়ে সামনে পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে ।পচা পাতাতে ভরে আছে চারদিক।গন্ধ উঠছে।ও হাঁটছে।বকে যাচ্ছে রক্তিম ফোনে। কনস্ট্যান্ট নিজের কথা বলে।নিজের মত।নির্লজ্জভাবে। ঠিক যতটা নির্লজ্জভাবে ফিজিক্যাল ইন্টিমেসির কথা বলেছিল প্রথম।তখন অবশ্য ওর মনে হয়েছিল অলজ্জ। ও নিজে তখন বিদ্রোহের তুঙ্গে ।সাহসী হতে চাইছে তারুণ্যের তোলপাড়ে। নিরাবরণ হতে হতে মনে হয়েছিল রক্তিম যেন কোনো মিলস অ্যান্ড বুন হিরো হবার বৃথা চেষ্টা করে যাচ্ছে। অ্যান্ড হি ইজ আ ড্যাম ফেইলিওর। ও জানেই না হাউ সেক্স ইজ রিলেটেড টু ব্রেইন।টু ইমোশন। প্রথমকয়েকবার মিলিত হবার পর থেকেই রক্তিমকে সেডিস্ট মনে হয়েছে ওর। উদারা , মুদারা, তারার সা থেকে সা বাজতে পারতো যে মেয়ে, সে বেজে ওঠেনি। কড়ি মা তে সুর'বসেনি।গান্ধার অকেজো। যতবার বেসুর , হয়ে উঠে গেছে সে, মনে মনে গাছ হয়ে গেছে। নিরাভরণ।নিরাবরণ।সে গাছকে কোনোদিন রক্তিম বেঁধে রাখতে পারবে না।একটিও ফুল স্পর্শ করতে পারবে না।


    ওকে একা হাঁটতে দেখে একজন এগিয়ে এলো।রোগা লম্বাটে অল্পবয়সী ছেলেটি । এরা খুব নাইভ। কেউ ফোনে কথা বললে যে তাকে একা ছাড়তে হয় , সেসব কেতা অত জানেনা।সোজা ওর পাশে পাশে হাঁটছে।টুপুর একবার চোখ তুলে হাসল।


    আপাতত ওরা আছে কলকাতা থেকে তিরাশি কিমি দূরে সুলকুনিতে। গাড়ি আসে না এখানে।এক কিলোমিটার হেঁটে আসতে হয়েছে। এবং ও জুতো পরে এসেছে।ইছামতীর শাখা নদী বইছে এখানে।ডানসা। তিন কিলোমিটার দূরত্বে নদীর জল ঢুকে গেছে গ্রামে।জলের মধ্যে ভাসমান বাড়ির চাল দেখা যায় ।জমি পুরো ডুবে গেছে।মুছে গেছে বলা যেতে পারে। 


    যে ছেলেটি পাশে হাঁটছে সে নিশীথ বটব্যালের ছেলে। সুদীপ নাম।বোঝা যাচ্ছে অনেক কিছু বলতে চাইছে। 


    রক্তিমকে ফোন রাখতে বলল টুপুর। রক্তিম এটা খুব অপছন্দ করে।ওর ইগোতে লাগে।লাগুক।টুপুর ডাসন্ট কেয়ার এনিমোর।অনেক হয়েছে।


    সুদীপ বটব্যাল ওকে দেখাচ্ছিল বাঁধের কোন তিনজায়গাতে ফাটল ধরেছে।ওদের বাড়ি ডুবেছে পুরো।এখন এক কাকার বাড়ীতে আছে কোনোমতে।এদিকে হাইরোড ছাড়া সব জলের নিচে।'


    টুপুর' জল দেখছে। এই দৃশ্য দেখেনি কোনোদিন।রক্তিম দেখেনি।দেখতে চায়ও না।একটা আর্টিফিশিয়াল দুনিয়াতে থাকে। হি লাভস স্মার্ট গার্লস অ্যান্ড টুপুর ইজ ওয়ান অব দেম। 


    হাঁটতে হাঁটতে ওরা পৌঁছে গেছে সাধারণ বিদ্যা মন্দিরে। এখানকার শিক্ষক চিরঞ্জীব মন্ডল এগিয়ে এসে নমস্কার করলেন। কোনো খাবার, জল নেই। সরকারি রিলিফ মানে চিঁড়ে আর গুড়।এখনো কিছুই আসেনি। গরু সব মরে গেছে। এখানে অনেকেই খোলা আকাশের নিচে হাইরোডে আশ্রয় নিয়েছে ।ত্রিপল জোটেনি সবার।


    সুদীপ বটব্যাল আরেকটু দূরে নদীর কাছে যেতে বলেছিল।টুপুর ফিরতে বলল।এত ভিতরে ফোনে নেটওয়ার্ক নেই।বাঁচা গেছে।রক্তিম ফোনাতে পারবে না এখনি।কিন্তু জাহিরও ফোনে পাবে না।নুর আলির বাড়ির কাছে নেটওয়ার্ক আছে।এখান থেকে ওরা যাবে জামবেড়িয়া গ্রামের দিকে।ফিরে এসে দেখল নুর আলির বাড়ির সামনে অপেক্ষা করছে দল।তার জন্যেই। 


    ডানসা নদী এখানে প্রলয়ংকর হয়েছিল।হিঙ্গলগঞ্জ। বা সুলকুনির পশ্চিমে জামবেড়িয়া । কোনো বাড়ি দাঁড়িয়ে নেই। হাচিনি বিবি রাস্তার ধারে বসে বাচ্চা কোলে । ইঁট ভাঁটার কাজ ছিল ।বর লেবার।মাটির বাড়ি এখন কেবল থকথকে কাদা। হাচিনি বিবি ভিক্ষা করা ছাড়া গতি দেখছে না কোনো এবং তার মত অনেকেই। অদূর ভবিষ্যতে কাজের কোনো সম্ভাবনা নেই।রিলিফের মাল কতদিন ? ভিক্ষা করবো।ঘর আর তুলতে পারবুনি কোনোদিন।


    ওরা বেশ জোরে হাঁটছে।অনেকটা এরিয়া কাভার করতে হবে।ইতস্তত পড়ে আছে ভাঙা নৌকা।


    ভাঙা নৌকা দেখে ওর রক্তিমের চোয়ালটা মনে পড়ল।কেন কে জানে। ঐরকম কঠিন।অথচ ভাঙা।নিষ্প্রাণ ।মায়ামমতাহীন।


    এদিকেও এখনো কোনো সরকারি রিলিফ আসে নি। চিরঞ্জীব বলছিলেন আগামী কয়েক বছর এখানে জমিতে চাষ আবাদ করা যাবে না। এত নূণ ঢুকেছে জমিতে যে আবাদের অযোগ্য' হয়ে গেছে বহুদিনের জন্য।


    রক্তিম প্রতিটি মেয়েকেই তার কর্ষণযোগ্য আবাদভূমি ভাবে। প্রথমদিকের তাড়নায় সে এতটা বোঝেনি। রক্তিম ব্যাঙ্গালোরের বান্ধবী বা ফ্র্যাঙ্কফার্টের প্রেমিকাদের কথা প্রায়শই সগর্বে বলে।ওটা ওর ইগোকে বুস্ট করে।বিশেষত সঙ্গমশেষে। যেটা টুপুরকে ছুঁড়ে মাটিতে ফেলে দেয় ফিজিক্যাল ভায়োলেন্স ব্যতীত। এবং রক্তিম অ্যানালিসিস করতে থাকে হু প্রুভড বেটার ইন বেড। 


    টুপুর দাঁতে দাঁত চেপে বলে , বাস্টার্ড।


    চিরঞ্জীব মন্ডল চমকে বলে, কিছু বললেন? 


    টুপুর ঘাড় নাড়ে।না।কিছু বলেনি। 


    মোমিনপুরে ভারত দাসের ছেলে আম্ফানের দিন মরে গেছে ।একটাই ছেলে ছিল মাহাতা। বন্ধুর বাড়িতে গেছিল।সেখানেই ঘাড়ে গাছ পড়ে সঙ্গে সঙ্গে মরেছে।বন্ধু বিশ্বনাথ বসিরহাট হাসপাতালে ভর্তি আছে। অবস্থা ভালো না।ফ্র্যাকচার আছে হিপ বোনে।সুদীপ মোটামুটি গাইডের কাজ করে চলেছে।খুব শার্প নাক চোখ।চটপটে ছেলে।


    টুপুর অনেক ইনফরমেশন পাচ্ছে ওর কাছে।ইনফরমেশন ।নট ডেটা।কারণ কেউ জানে না ঠিক কতজন মরে গেছেন বা ভেসে গেছেন।


    রক্তিম বিশ্বাস করবে না।এই পৃথিবী ওর কাছে এক্সিস্ট করে না।হি সিম্পলি ডিনাইস। নিষ্ঠুরভাবে ডিনাই করে, ঠিক যতটা নিষ্ঠুরভাবে ও ডিনাই করে টুপুরের সেনসুয়ালিটি।এক্সপেক্ট করে টুপুর তাকে উদ্দীপিত করবে। না পারলে হি শাউটস লাইক এনিথিং। এখন বোঝে টুপুর।নিজের অক্ষমতা ঢাকতে চেঁচায়। ষোলো বছর বয়স থেকে যান্ত্রিক ও মনহীন যৌনতা প্র্যাকটিস করতে করতে ফুরিয়ে গেছে ছেলেটা ।পুওর থিংগ।বাট টুপুর উইল নট প্লে দ্য ভিক্টিম রোল।নেভার।শি হ্যাজ টার্ণড হার ব্যাক।


    পাশের ছেলেটি আগ বাড়িয়ে বলে, আপনি কিছু ভাবছেন ম্যাডাম? টুপুর ঘাড় নেড়ে না বলে।ছেলেটি ওকে আঙুল দিয়ে দেখায়।কাদাতে মিশে যাওয়া বাড়ির উঠোনে ভাঙা আলমারি।গোলাপি দরজা খুলে গেছে।কাদা মাখামাখি হয়ে পড়ে আছে কিছু কাপড়জামা।


    ঠিক একটি কর্দমাক্ত সম্পর্ক যেমন থাকে। 


    এটা চম্পাপুকুর।বুঝলি? জাহির চেঁচালো। ওরা ত্রাণ নিয়ে ঢুকছে মোমিনপুর প্রাইমারি স্কুলে।প্রায় বাইশটি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে এখানে। শ্যামলী আর সাধন কথা বলছিল।লকডাউনের জেরে দু মাস হল ইনকাম নাই।তারপর ঝড়ে বাড়িটাও গেল।আর কোনোদিন ঘর তোলার আশা নেই ওদের। উদ্যম তো দূরের কথা।


    - কী করবে তাহলে?


    - ভিক্ষা করতে হবে।আর তো কোনো উপায় নাই।


    ভিক্ষা করছে টুপুর।মনে মনে।এই সম্পর্কের হাত থেকে মুক্তি ভিক্ষা করছে। জানে অনেক ঝামেলা হবে।অনেক কথা।দুবাড়ির প্রবল ইচ্ছেতে গড়া সম্পর্ক ।


    আমরা আর ঘর গড়তি পারবনি গো।কাঁদছে নিবারণ হালুই, আখহারুল শেখ, আকিব , মইদুল, নয়ন।কাঁদছে হরিপদ বাউড়ি, মুনিরা খাতুন, চন্দনা দাস, জরিনা বিবি।ভাঙা নৌকা, উল্টে থাকা আলমারি, থাকথাক কাদা বেয়ে উঠে আসা মৃত পশুদের গায়ের দুর্গন্ধ । টুপুর মাথা ঘুরে বসে গেছে।


    জাহির বলল, কীরে?ঘামছিস এতো?


    - মে বি মাই ব্লাড প্রেশার হ্যাজ ফলেন আগেইন।


    অনলাইনে অর্ডার দিয়ে আনানো সুরভিত লেবু গন্ধের স্ক্রাবার দিয়ে যত্ন করে স্ক্রাব করা ওর মসৃণ পায়ের ত্বক জুতো খুলে মাটি ছুঁলো।পা ডুবে যাচ্ছে কাদাতে।ঠান্ডা।ও কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, আমাকে একটা সিগারেট দিবি? আনতে ভুলে গেছি।


    সিগারেট একটু শান্ত করল। অন্য কিছু ভাবতে চায়।


    সকালে গাড়ি থেকে যে মহিলা নামলেন তাঁর মুখ মনে এলো।দাদার বন্ধু অদিতিদির মা। কী অপূর্ব দেখতে! হার অ্যারাইভাল ইজ ওয়ান গুড থিংগ ইন রিসেন্ট পাস্ট।


    ভদ্রমহিলাকে দেখে ভীষণ ইমপ্রেসড ও।


    কী জানি বাড়িতে কী হল! মা ঠিকমত রিসিভ করবে তো মহিলাকে? একটু লোকজন আসা ভালো, তাতে কিছুটা নর্মাল হবে সব। 


    ফোন করতে গিয়ে দেখল নেটওয়ার্ক নেই।ফিরতে রাত হবে বোঝাই যাচ্ছে। মেধা এসে বসল পাশে।শি ক্যান ওয়র্ক লাইক অ্যান আমাজন। অভ্যস্ত কাজ করে। অন্ধকার নামছে ।কোথাও বিদ্যুত নেই। কোনো প্রাগৈতিহাসিক ধ্বংসস্তূপের মধ্যে বসে আছে কিছু প্রাণী, যাদের মানুষ বলা হয়।অনেক ওপর থেকে দেখলে এইরকম মনে হবে।


    এই মহাপ্রলয়ের পর ঝিঁঝিঁও ডাকছে না আর।( চলছে)



    #করোনাকালীন (দুই)


    আঠেরো।ক্রিওস্লিপ ভাঙছে।


    ত্রিদিব ছেলের সঙ্গে ফোনে কথা শেষ করতেই শ্যামা এসে বলল, দাদা, কে একজন দেখা করতে এসেছে। বউ একটা।ওলা থেকে নামল। 


    আজকাল রোজ ছেলেকে ফোন করেন।কোভিড আক্রান্ত হবার পর থেকে।এখন সেরে উঠেছে।তাও মন খুঁৎখুঁৎ করে।একা থাকে ছেলেটা।মালবিকা তো ফোন করেন না আর।


    বুকটা ধ্বক করে উঠল।রিনা চলে এলো নাকী! কিছু বিচিত্র নয়।এতদিন দেখা সাক্ষাৎ নেই।সেদিন ডাকাডাকিতেও গেলেন না।যা মুডি।হয়তো চলেই এলো।তাহলে সর্বনাশ। তাড়াতাড়ি গায়ে শার্ট চাপালেন।


    - আমাকে চাইছে নাকী?


    - না।বলল তো বউদির সঙ্গে দেখা করবে।বসিয়ে এসেছি।


    ত্রিদিবের টেনশন বেড়ে গেল। রিনা কী মালবিকার সঙ্গে দেখা করতে চায় নাকী রে বাবা? দ্রুত পায়ে নিচে নামলেন শার্টের বোতাম লাগাতে লাগাতে। শ্যামা মালবিকাকে তুলতে গেল। যাবার আগে উঁকি মেরে ফের একবার অতিথিকে দেখেও নিল। কার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে কে জানে বাবা! তবে গোলাপি শাড়িতে মানিয়েছে ভালো। বউদি সুন্দর।ইদানিং নয় অসুখ করে করে কেমন শুকনো হয়ে গেছে। আগে যখন ইস্কুল যেতো কী সুন্দর লাগতো।


    তবে এ বউটা আরো সুন্দর। চকচকে একেবারে। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন মালবিকা।শ্যামা আলতো করে গায়ে হাত দিল।ঝাঁকিয়ে তুলতে নেই।চমকে যাবে।ডাক্তার নাকী বারণ করেছে।


    বউদি।ও বউদি!


    মালবিকা অনেকক্ষণ পরে সাড়া দিলেন।উঁ...


    শ্যামার কঠিন প্রাণ। ঝড় ঝাপটা তো কম সহ্য করেনি। বাবলুর বাবা ভেগে যাওয়ার পর থেকে সমানে চলেছে। সেইসব সামলাতে সামলাতে শ্যামা শক্ত' হয়েছে যেন পাথর।তবু এখন মালবিকার আচ্ছন্ন মুখের দিকে তাকিয়ে ভারি মায়া হল শ্যামার। চেহারাটা সত্যি খারাপ হয়েছে বউদির। মেয়েদের মুখ দেখে অনেক কিছু বোঝে শ্যামা।বউদির জীবনে কিছু একটা ফাঁক আছে। দাদার তো চরিত্তির খারাপ নয় বলেই মনে হয়।এতদিন আছে শ্যামা এই বাড়িতে ।কোনোদিন ভুলেও দাদা বেসামাল হয়নি। তাকানোর সময়ই পায়নি শ্যামার দিকে।এখন নাহয় বাড়িতে । অন্য সময় তো বাইরে বাইরেই থাকে।কিন্তু বন্ধ দরজার আড়ালের কথা তো কানে চলেই আসে আর কান বন্ধ করেই বা থাকবে কেন শ্যামা। পরের ঘরের কথা শুনতে তার খুবই ভালো লাগে। তবে বাইরে করে না এসব কথা। হরপ্রীতকে টুকটাক বলে কারণ শ্যামা জানে হরপ্রীত এসব কথা মাথাতেও রাখবে না, মনেও রাখবে না।


    মোদ্দা কথা, বন্ধ ঘরের কথাবার্তা কানে গেলে শ্যামার শরীর মন ভালো থাকে।মনে হয় যে এই এত বড়ো পৃথিবীতে সে একা দুখিয়ারি নয়।


    তাই শ্যামা আন্দাজ করতে পারে দাদা বউদির মধ্যে আঁঠা আলগা। আঁচ কম। মাঝে কেউ একটা আছে।যার জন্য বউদির এত অশান্তি।শ্যামা হাড়ে হাড়ে বোঝে সে জ্বালা। তার পাল্টা নিতেই তো সে সুফল , দশরথদের সঙ্গে মৌজ মস্তি করেছিল। কিন্তু এই করোনার সময় সে আগা পাশ তলা লোক চিনেছে। কেউ না।কেউ না। খারাপ সময় পাশে দাঁড়ানোর জন্য কোনো আলগা আশিক থাকে না। তখন চাই একটা শক্ত পোক্ত মানুষ। যে বুক পেতে আগলে রাখবে। বাড়িঘর পড়ে গেলেও বলবে, যাক, আবার ঘর তুলব। রাজমিস্ত্রির ঘর করা বউ শ্যামা।এক, দুই না। দশ বছরের সংসার। সেই তিল তিল করে জমানো সুখ দুঃখ ছেড়ে যখন বাড়ির মানুষ চলে যায়, তখন কেমন লাগে শ্যামা জানে । এখনো ঘুমের ঘোরে সুখনলালের হাত খোঁজে। 


    বড্ড ঘামতো লোকটা ঘুমে।হাতের কাছে গামছা রাখতো শ্যামা ।মুছিয়ে দিত মাঝরাতে।বাবলুও ঐ ধারা পেয়েছে।ঘুমের মধ্যে ঘামে।মুছিয়ে দিতে হয় মুখ, ঘাড়, গলা।


    নিঃশ্বাস চেপে আরেকবার বউদিকে ডাকল শ্যামা। কী সুন্দর ঘরখানা। এসি মেশিন। নীল পর্দা ।ঠিক যেন সিনেমার ঘর।কত সুন্দর ছবি।দেওয়ালের সঙ্গে রঙ মেলানো আলমারি ঠাসা কাপড় জামা।ড্রেসিংটেবল ভর্তি কত সাজের জিনিস।শ্যামা নাম পর্যন্ত জানে না।তবু বউদির চোখের তলায় ঘন কালি। কত অসুখ জমে আছে মনে কে জানে। যে বউটা এল দেখা করতে, শ্যামা দরজা খুলে দিল, সে আগে কখনো এ বাড়িতে আসেনি।অন্তত শ্যামা দেখেনি।কিন্তু একনজরে তার মুখ দেখেই শ্যামা বুঝে নিয়েছে যে মেয়েমানুষটা সুখী। যেই সানগ্লাস খুলল, শ্যামা দেখতে পেল চোখের কোণে, নাকের পাটায় , ঠোঁটের ভাঁজে সুখ উপচে পড়ছে। শুধু সাজগোজ দিয়ে ঐ সুখ ধরে না চেহারাতে।শ্যামা বেশ বোঝে।ও হল ভালোবাসার সুখ।


    মেয়ে মানুষটা সেই সুখে ভরা।লোকদেখানি না।


    তাই ঐ মেয়ে মানুষটা বাড়িতে আসাতে শ্যামা খুশিই হয়েছে।বাড়িটা বড় ছন্নছাড়া । বউদি এখন ওষুধ খেয়ে পড়ে থাকে। দাদা কাজ নিয়ে হুমড়ি খেয়ে থাকে।মেয়ে আগে সারাদিন ঘরবন্দি থাকত।এখন সারাদিন বাইরে চরে।ছেলেটা কতদূরে একা পড়ে আছে। কতদিন আসে না।ভূতের বাড়ি যেন।বউদি যখন ভালো ছিল, তখন তাও একটু রোদ হাওয়া খেলতো। 


    একটা সুখী মানুষের পায়ের ছাপ ধরে যদি এ বাড়িতে একটু সুখ আসে তো আসুক। 


    বাবলু বই নিয়ে বসেছিল। একটুও মন লাগে না পড়তে। খুব অশান্ত বোধ করে সে ভেতরে ভেতরে। রাগী মেয়েটা বকবে।তাই পড়া করেখ রাখতে হয়।মেয়েটা অংক করতে দিয়ে গেছে।রাতে ফিরে দেখবে। অনেক রাতে ফেরে।বাবার মত। বাবলু টিভি দেখতে ভালবাসে না।যখন বাবা ছিল, বাপ ব্যাটাতে জড়াজড়ি করে টিভি দেখত।খেলা।কিছুই বুঝতে পারতো না।তবু বাবার গায়ের গন্ধ নিতে নিতে হি হি করে হাসতো। 


    এই বাড়িতে বাবলুর সবচেয়ে ভালো লাগে ছাতটা। অনেক গাছ ছিল।সব ভেঙে চুরে আছে।তবু ছাতে কল খুলে স্নান করতে ওর ভালো লাগে।টবগুলো ভাঙাচোরা। গাছগুলো ছেত্রে পড়ে আছে। কোনো ফুল নেই। এই ছাতটাকেই খানিকটা আপন বলে মনে হয় বাবলুর।অনেকটা সময় ধরে স্নান করে। এখানে জলের অভাব নেই।ট্যাঙ্কি ভরা জল।ফুরিয়ে গেলে পাম্প চালাতে হয়। তাদের কলতলার মত কাড়াকাড়ি মারামারি নেই।কেউ আসেও না ছাতে। মা ছাড়া ।ছাতে যত ইচ্ছে জল ছেটাছেটি করা যায় কেউ বকার নেই। তবু বাবলুর মনে পড়ে তাদের কলতলায় তিন চারজন মিলে স্নান করার কথা।আজ স্নান করে মা তাড়াতাড়ি নিচে যেতে বলেছে ভাত খেতে। মায়ের কাজ আছে অনেক। আজ বাবলুর জন্মদিন। ভেজা কাপড়জামা কোনো মতে চিপে তারি মেলে দিল সে।টপ টপ করে জল পড়ছে।রোদে হাওয়ায় শুকিয়ে যাবে।


    নিচে নেমে বাবলু দেখল মা রান্নাঘরে চা বানাচ্ছে। বাইরের বড় ঘরে কে একজন এসেছে।মামা আর মামী তার সঙ্গে কথা বলছে। শ্যামা তাকে বলেছে এ বাড়ির লোকটাকে মামা আর তার বউকে মামী ডাকতে।রাগী মেয়েটাকে কিছুই বলে উঠতে পারে না সে। 


    শ্যামা দেখল ছেলের মাথা ভিজে জবজব করছে।এখনো ঠিকমত মাথা মুছতে পারে না। 


    ভালো করে মোছ মাথা, বলে থালায় ভাত বাড়ল সে। ডিম সেদ্ধ।আলু সেদ্ধ।ডাল সেদ্ধ। ছেলেকে খেতে বসিয়ে দিল রান্নাঘরের কোণে। একটা পর্ব শেষ। ট্রেতে চায়ের কাপ বসাতে বসাতে শ্যামা দেখল ছেলে মন দিয়ে ভাতের গরাস মুখে তুলছে।কী শান্তি! বুক ভরে শ্বাস নেয় শ্যামা। ঝড়, সুখন, সেন্টার, আধার কার্ড, দশরথ, কালু কিছুই মনে থাকে না।রান্নাঘরে গরম ভাতের সুবাস।বাবলু পেট ভরে খাচ্ছে। আপাতত এর চেয়ে বড় স্বস্তি আর কিছু নেই শ্যামার কাছে।


    মালবিকা বসে আছেন ডিভানে। একটা ঘন মেরুন বেডকাভারে আচ্ছাদিত ডিভান। পেছনে কাঁচ বসানো গুজরাতি কাঁচ বসানো কুশন ।মালবিকা ডান হাতে ভর দিয়ে বসেছেন। মেরুন বেডকাভারে চম্পক কলির মত ফুটে আছে তাঁর নরম আঙুলগুলি । মধ্যমাতে একটি আংটি। চুলটা আঁচড়ে গুছিয়ে বেঁধে দিয়েছে শ্যামা এখানে নিয়ে আসার আগে।ঘন মেঘের মত চুলে দু এক গাছি পাক।ছোট কপালের নিচে একটি বেদনাবিধুর ছোট মুখ।মুমতাজ মুখোমুখি সিঙ্গল সিটার সোফাটিতে বসে মালবিকাকে দেখছিলেন। 


    মালবিকার পরনে একটি গাঢ় হলুদ রঙের কাফতান। তাঁর এক বন্ধুর বুটিক থেকে কেনা অনলাইন। আজকাল সবাই বুটিক বলে। আসল বুটিক হারিয়েই গেছে।অবশ্য' কাফতানটি এক্সক্লুসিভ ।হলুদের ওপর সূক্ষ্ম এমব্রয়ডারি নীল সুতোতে।আড়াআড়ি ভাবে উঠে এসেছে। গলায় সোনার চেন।আর কোনো আভরণ নেই।মুমতাজ মনে মনে মালবিকার রুচি পছন্দ করেছেন। 


    ত্রিদিব বসে আছেন ডানদিকের সিঙ্গল সিটারে। পাজামার ওপরে শার্ট। তাড়াহুড়োতে একটা বোতাম উল্টোপাল্টা লাগিয়েছেন। মুমতাজের মনে হল ভদ্রলোক টেনশনে আছেন। হতেই পারে।স্ত্রী অসুস্থ ।ছেলে দূরে।তার ওপর সেও তো কোভিড থেকে উঠল।


    মালবিকা জেগে উঠছিলেন ।অতলান্ত ঘুমের থেকে জেগে ওঠা এক অতিমানবিক অভিজ্ঞতা ।বরফ গলে যাচ্ছে।খুব ধীরে।পৃথিবীর তাপমাত্রা যত বাড়ছে, বরফ গলছে।মালবিকার কিছু কথা কানে যাচ্ছে।কিছু যাচ্ছে না।ত্রিদিব আর মুমতাজ কথা বলছেন।ঘুমের মধ্যে, ঘোরের মধ্যে কথা আসছে কানে। একটু ঘামছেন। কী বলছেন ওঁরা? বাবু অসুস্থ হয়েছিল? কী ? কোভিডের কথা বলছেন কেন মহিলা? বাবুর কোভিড অ্যাটাক হয়েছিল? বাবু মায়ের মত হাসপাতালে পড়েছিল, একা ? দ্রুত হচ্ছে নাড়ির স্পন্দন। অপত্যস্নেহের কাছে হেরে যাচ্ছে জমে থাকা যত ক্ষোভ, অভিমান। 


    আইসবার্গ গলছে গ্লোবাল ওয়ার্মিং এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ।যত বরফ গলছে, তত জেগে উঠছে হাজার বছরের ঘুমিয়ে থাকা ভাইরাস ।ব্যাকটেরিয়া তাদের সমস্ত ক্ষমতা নিয়ে জেগে উঠছে তারা।


    ক্রিয়োস্লিপ। কয়েকশো বছর বরফঘুমে ভেসে থাকা ভাইরাস জাগছে। বনজঙ্গল কেটে কেটে নগর বানানো মানুষের দিকে এবার যেতেই হবে তাদের। কে বলেছিল এইসব? বাবু? কী বলেছিল! করোনা ভাইরাসের ফেটালিটি রেট খুব কম।ওয়ান পার্সেন্ট। সবচেয়ে ক্ষতিকর ভাইরাস হল রেবিস মা। বাঁচার কোনো সম্ভাবনা থাকে না। 


    বাবু বেঁচে আছে তো? কী বলছিস বাবা? এই যে মা বসে আছে পাশে।ছোটবেলায় জ্বর হলে পাশ থেকে উঠতে দিত না ছেলে।


    ভাইরাস থাকবে মা।এই তো সবে শুরু।যত গাছ কাটা যাবে, গ্লোবাল ওয়ার্মিং বেড়ে যাবে তত বরফ গলবে আর ভাইরাস অ্যাক্টিভেটেড হবে।হবেই। বনের পশু বেরিয়ে আসবে লোকালয়ে। ভাইরাস ছড়াবে। জেনেটিক ইমিউনিটি বাড়বে না। মনের ইমিউনিটি বাড়াও। হরমোনস উইল বি অ্যাকটিভ।অল গুড হরমোনস। রোগ আসবে কিন্তু ইউ উইল সারভাইভ। ওনলি বেটার হিউম্যান বিঙ্গস উইল সারভাইভ।


    কথাগুলো হারিয়ে যাচ্ছে। মিলিয়ে যাচ্ছে।মুমতাজের হাত'চেপে ধরে মালবিকা বলে উঠলেন, আমার ছেলেটা ভালো আছে তো? ঠিক আছে তো? মিসেস শিবরামণ?


    ত্রিদিব আশ্চর্য হয়ে তাকালেন। মায়ের মৃত্যুর পর থেকে এত স্বাভাবিক উদ্বেলতা দেখা যায় নি মালবিকার মধ্যে। আম্ফানের তান্ডবও নাড়াতে পারেনি তাকে। 


    শ্যামা এসে দাঁড়িয়েছে । চা দিয়েছিল আগেই। এবার ট্রেতে ছোট ছোট কাঁচের বাটিতে পায়েস আর মিষ্টি। ট্রে একটি সুদৃশ্য কাজ করা কাপড়ে ঢাকা।যেমন মালবিকা পছন্দ করেন।শ্যামা জানে সব।


    - কেন এতকিছু।মুমতাজ বলে ওঠেন।


    - আমার ছেলেটার জন্মদিন আজ। একটু পায়েস খান।শ্যামা ট্রে নামিয়ে রাখছে সেন্টার টেবল নামক অ্যান্টিক সিন্দুকটির ওপর ।


    রোদ আসছে পর্দার ফাঁক দিয়ে । কাঁচ ভেঙে পড়ে আছে।তাই আনফিল্টার্ড রোদ আসে।রোদ যায় ।


    মালবিকা পায়েসের বাটি তুলে দিলেন মুমতাজের হাতে।


    মুমতাজ জানেন এটা একটা মেক্যানিকাল অ্যাকশন।বা রিঅ্যাকশন। 


    ত্রিদিবের ভালো লাগছে।বহুদিন বাদে মালবিকা যেন একটু জেগেছেন।


    শ্যামা বলল, দিদি কেকের অর্ডার দিয়ে গেছে।মুখে একগাল হাসি। যেন ঝড়ে কিছুই ক্ষতি হয়নি ওর। 


    মুমতাজ বলে উঠলেন, আমি কী দেব ওকে? এ তো জানা ছিল না।


    ভাত খাওয়া শেষ।বাবলু পর্দার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছিল।শ্যামা চোখের ইশারা করল সরে যেতে। এই বাড়িতে এসব করলে মুশকিল। 


    হাসল একগাল।কী দেবেন আবার! দিদি বলেছে সন্ধেবেলা লুচি মাংস করতে।খেয়ে যাবেন।


    মুমতাজের ফোনে রিং হচ্ছে।পায়েসের বাটি নামিয়ে ফোন নিলেন মুমতাজ ।


    অদিতি।মেয়ে বড় টেনশন করছে।


    - মা! প্লিজ! তুমি কিন্তু দেবরূপের কোভিড অ্যাটাকের কথা বলবে না। 


    মুমতাজ 'ওকে' বলে ফোন রেখে দিয়েছেন।


    বড় ছেলেমানুষ এরা। ভাবে সব বোঝে।সব জানে। কখন কী বলতে হবে , হবে না তাই নিয়ে মায়ের ওপর খবরদারি।


    মুমতাজ জল খেলেন অনেকটা। শ্যামার দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার ছেলেকে আমার আদর দিও।


    মালবিকার দিকে তাকালেন।স্পষ্ট।


    - দেবরূপ ইজ ফাইন। হ্যাঁ ।হি ওয়জ কোভিড পজিটিভ। আপনার হাজব্যান্ড জানেন। সেরে উঠেছে। এখন একদম কিওরড। আপনি কিচ্ছু ভাববেন না মালবিকা। ওখানে ওর বন্ধুরা সবাই খুব হেল্পফুল। আর নিশান্ত ইজ আ রিনাউন্ড ডক্টর অ্যাট অ্যান আর্লি এজ।


    মালবিকা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। যেন কিছুটা বুঝেছেন।কিছুটা নয়।


    শ্যামা ভিতরে চলে গেছে। অজান্তে একটি ট্রায়াঙ্গল তৈরি হয়েছে। ত্রিদিব দেখছেন মালবিকাকে।কিংবা হয়তো দেখছেন না।তাকিয়ে আছেন শুধু।মালবিকার 'দৃষ্টি শূন্য।মাঝেমাঝে মুমতাজের দিকে নিবদ্ধ ।একবারও ত্রিদিবের দিকে তাকাননি। মুমতাজ দেখছেন মালবিকাকে।পিছনে ডোকরার দুর্গামূর্তির চালচিত্র, মধুবনী পেইন্টিংএর ওপর এরিকা পামের ছায়া।সব মিলিয়ে মালবিকা যেন স্থাণু কোনো প্রস্তরমানুষ। 


    নৈঃশব্দ্য ভাঙে।একটা দুটো কথা বলেন ত্রিদিব।


    মুমতাজ বললেন, অদিতি আর দেবরূপ খুব ক্লোজ বন্ধু, জানেন তো মালবিকা?(চলছে)



    # করোনাকালীন ( দুই)


    উনিশ- ইনফিনিটলি সাফারিং জেন্টল থিংগস


    এইসব এলাকাতে করোনার নাম করছে না কেউ এখন। ঝড় সব কিছুকে ছাপিয়ে গেছে। টুপুরের পাশেই হাঁটছিল করুণা সাহা।লোকাল মেয়ে। পরের দিন ওরা গেছিল ইঁটখোলা, দক্ষিণ বুদোখালি , রেদোখালি, সদাশিবতলা অঞ্চলে ।মাছ মরে আর জলে আবর্জনা পচে চরম দুর্গন্ধ । তার থেকে রোগ ছড়াতে শুরু করেছে । ওদের মাস্ক ভেদ করে নাকে পৌঁছাচ্ছে দুর্গন্ধ । তন্ময় হাসতে হাসতে বলল, এই যে গন্ধ পাচ্ছিস, এতে অন্তত প্রমাণিত হচ্ছে যে তোদের করোনা ধরেনি এখনো। ওদের সবার মুখে ট্রিপল লেয়ার্ড মাস্ক। করুণা সাহা একটা রুমাল বেঁধেছে মুখে। ইটখোলাতে বাড়ি ।টুপুর দেখছিল কী সহজভাবে একটা ময়লা খয়েরি রঙের শাড়ি আর স্যান্ডাল পরে অনায়াসে কাদাজলের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল মেয়েটা । তাদের থেকে একটু ছোট হবে।মুখটা খুব কচি।কিন্তু শুকনো।


    করুণা বলছিল ঝড়ের দিনের কথা। দুপুর থেকে হাল্কা বৃষ্টি। হাওয়া ।কে জানত বিকেলের মধ্যে বাড়ি ঘর সব উড়ে যাবে! ওরা নিঃস্ব এইমুহূর্তে ।কিন্তু ডিপ্রেশন নেই। হাহাকার শুধু।


    করুণা সরকারি শস্য পর্যায়ভিত্তিক কৃষি প্রশিক্ষণের মেয়ে।মানে কাজ শিখছে।চটপটে।বুদ্ধিমতী। হায়ার'সেকেন্ডারি পাশ । পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি,কৃষি আধিকারিক, গ্রামপঞ্চায়েত উপপ্রধান, সবার সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলেছে। মাতলানদীর বাঁধ ভেঙেছে এই অঞ্চলে । সেই এক দৃশ্য আর শ্মশানের নৈঃশব্দ্য ।ধান শেষ ।মাছও । ঘরের উঠোনে লাউ, পুঁই, সজনে , কিছুই নেই। ত্রাণ সরকারি তরফে এসেছে কিনা জিজ্ঞেস করাতে করুণা একটু চেপে গেল। বোধহয় সত্যি কথা বলে ঝামেলা বাড়াতে চায় না। ট্র্যান্সফর্মার ভেঙে পড়ে আছে।সারাবার লোক নেই। কবে বিদ্যুত আসবে কেউ জানে না।


    এত পচা গন্ধে আর ধ্বংসদৃশ্যে ওর' গা গুলিয়ে ওঠে। করুণার গা গুলায় না। সে দ্রুত হাঁটতে হাঁটতে কথা বলে ।


    দুর্গন্ধ উঠছে চারদিক থেকে।ওদের সবার মুখে ট্রিপল লেয়ার্ড এন নাইন্টিফাইভ মাস্ক। করুণার মুখে রুমাল বাঁধা। রোজগারপাতি সব বন্ধ দুমাস।ঝড়ে হাঁস মুরগি ও মরে গেল সব।ডিম বেচে খাবার উপায়টাও নেই। মৃত কুকুর'বেড়ালের স্তূপ পার হয়ে যায় ওরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে।


    তন্ময় আবাথ হা হা করে আসে। এই গন্ধটাও পাচ্ছিস ? করোনাময়ী রক্ষে করো মা! ওই ইয়ার্কি ফাজলামি করে স্পিরিটটা উজ্জ্বল রাখছে।


    প্রাইমারি স্কুলের দালানে বসেছে ওরা।বস্তা থেকে বেরোচ্ছে চাল, ডাল, সয়াবিন। কাপড়জামা কিছু। ক্রাউড ফান্ডিং হয়েছে মোটামুটি ভালো। 


    গতরাতে বাড়িতে ফিরতে পারেনি টুপুর।বাবাকে ফোন করে বলে দিয়েছে। থেকে গেছে মেধার বাড়িতে । ফ্রেশ রাতপোশাক ছিল।নতুন সাবান শ্যাম্পু ছিল।শান্তি ছিল না। রক্তিম রাতে ফোন করেছে আবার।গলায় সেই অনাদি অনন্ত আধিপত্যের টোন। কোথায় আছিস? বাড়ি ফিরলি?


    গতরাতে কুচি কুচি করে রক্তিমের ইগোকে কেটেছে ও। ইচ্ছে করে বলেছে, ফিরিনি।বন্ধুর বাড়িতে আছি।ছেলে না মেয়ে বন্ধু বলেনি। রক্তিমের উদ্ধত এক্তিয়ার বোধকে আটকেছে। আর কিছু জিজ্ঞেস করবি না। ইনাফ।


    বিজনেস ম্যানেজমেন্ট এই প্রতিরোধকে ট্যাকল করা শেখায় নি। এটা রক্তিমের হিসেবের বাইরে। হি ডিডনট নো হাউ টু রিঅ্যাক্ট। টুপুরের সেটা ভালো লেগেছে। পেরেছে ও। পেরেছে। ও তো ন্যাকাবোকা নয় ।তবু সামনাসামনি দুর্বল হয়ে পড়ে কেন ? নিজেকে শাসন করেছে বারবার। 


    পাঁচ বছর । একটা অস্বস্তিকর সম্পর্ক ওকে জ্বালাচ্ছে।কাউকে বলতে পারছে না। এখন ফিল করছে সম্পর্কে ঢোকার সময় ও যা ছিল , এখন আর সেরকম নেই। রক্তিম ইজ দ্য সেইম পার্সন উইদ হিজ গডড্যাম ইগো অ্যান্ড হোয়াট নট।কিন্তু এই পাঁচ বছরে ও নিজে পাল্টেছে। ওর চিন্তা পাল্টেছে।সেনসিটিভিটি, সেক্সুয়ালিটি সব।সব নতুন মোড় নিয়েছে অ্যান্ড নাউ শি হ্যাজ রিয়ালি আউটগ্রোন রক্তিম। এই কথাগুলো কীভাবে বাড়িতে বলা যায়, মাথাতে ঘুরছে। মেধা খেয়াল করেছে ও অন্যমনস্ক। 


    - এনিথিং ট্রাবলিং ইউ?


    টুপুর ঘাড় নেড়ে না বলেছে।এইসব কনফ্লিক্ট নিজেকে সলভ করতে হবে।


    যতই বন্ধু হোক, নিজের বিছানা, নিজের রাতপোশাকে ঘুম আলাদাই হয়। সারারাত এপাশ ওপাশ করেছে ও। 


    মেধাদের ফ্ল্যাটটা বড্ড ঝকঝকে ।কোথাও একফোঁটা ময়লা নেই।ধুলোবালি নেই।আরশোলা টিকটিকি, মশা মাছি কিছুই নেই এই চোদ্দতলার মহার্ঘ্য ফ্ল্যাটে ।সাদা মার্বল ঝকঝক করছে একস্ট্রা কিচ্ছু নেই কোথাও । একটা লম্বা টানা সোফা।সাদা।কয়েকটা সিঙ্গল সিটার। দেওয়াল জোড়া বিশাল এল ই ডি। একটা গলা পর্যন্ত লম্বা ফুলদানিতে ড্রাইভার ফ্লাওয়ার্স । ব্যস । এখানে বসে টুপুর ওর নিজের বাড়ির অ্যাম্বিয়েন্স ফিল করে ।মা যেভাবে উষ্ণতায় মুড়ে রাখে। অনেক পরিশ্রম করে ধরে রাখতে চায় সবাইকে।শূণ্য কোণগুলি ভরে রাখে পিতলের কলসিতে একছড়া ফুলে বা মাটির প্রদীপে রং করে।মালবিকা বাহুল্য ভালবাসেন ।তাঁর বাড়িতে, তাঁর সম্পর্কসমূহে। কোথাও কিছু ন্যাড়া, প্রাণহীন তাঁর পছন্দ নয়।কন্ট্রাস্ট রঙ মিলিয়ে কুশন।লাল।হলুদ।ঘন নীল। প্যাঁচার পাশে উঁকি মারে বাঁকুড়ার মনসামূর্তি। মেধাদের পাঁচতারা হোটেলসম ঝকঝকে ঘরে বসে টুপুর মালবিকাকে মনে করে। হাউ উইল শি রিঅ্যাক্ট ওয়েন শি উইল কাম টু নো অ্যাবাউট হার ডটারস ডিসিশন ? 


    মা এত শিক্ষিত । কালচার্ড।রবি ঠাকুর অন্ত প্রাণ।চিত্রাঙ্গদা আওড়ায়। কিন্তু এখনো মা ভাবতে পারে না যে একটা নারী পুরুষের সম্পর্কে মেয়েটি " না" বলবে, কিম্বা বেরিয়ে আসবে । যাস্ট লাইক দ্যাট। মা পার্লার যায়, ভীষণ ভালো সাজে। হাল ফ্যাশনের ডিজাইনার পোশাক।ব্লাউজ। গ্যাজেটস। রান্নার ভ্যারাইটি। কিন্তু সম্পর্কের ব্যাপারে ইনসিপিড। অ্যান্ড শি নোজ দ্যাট হার ডটার ইজ ফিজিক্যালি ইনভল্ভড উইদ হার ফিউচার সন ইন ল। ব্যস।হয়ে গেল। শারীরিক সম্পর্ক হওয়াটাই শেষ কথা হয়ে গেছে মায়ের কাছে।মা ভাবতে পারে না যে এর পরে বিয়েটা হবে না।মানে ও করবে না। ও শুধু নিজেকে এক্সপ্লোর করেছে এই কয়েক বছর। এখন বুঝতে পারছে দিস রিলেশন উইল টেক হার টু ডেসট্রাকশন । মে বি রক্তিম গালাগাল দেবে।বলবে স্লাট।যেমন ও বলে থাকে মেয়েদের সম্পর্কে ।যাদের ও ডিনকার্ড করে এসেছে এতদিন। অ্যান্ড নাউ টুপুর উইল ডিসকার্ড হিম। ফোন বন্ধ রেখেছে কাল রাত থেকে। 


    মা। অবসন্ন।ক্লান্ত। টুপুর মায়ের মত হতে চায় না। ইনফিনিটলি সাফারিং জেন্টল থিং। নো। নেভার।


    সিগারেট খায় নি।ঘুমও হয়নি ।অচেনা জায়গায় ঘুম আসে না। যতই বন্ধু কর্ডিয়াল হোক । মেধাদের বাড়িতে নিজেকে সংযত রেখেছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে এখন। অভ্যেস। যত কষ্টের ও নষ্টের গোড়া হল অভ্যেস।


    এই যে করুণা কাদা জলের মধ্যে শাড়িটা একটু উঁচু করে অবলীলায় হেঁটে যাচ্ছে, এও অভ্যেস।বলল, ঝড়ের পর তিনদিন ওরা কিছু খায়নি। তারপর চিঁড়ে গুড়। দুবেলা। শুধু চিঁড়ে । এটাও অভ্যেস। আজ অনেকদিন পর ওরা ভাত খাবে। সব শস্য নষ্ট হয়ে গেছে এই কাদাজলে সাপ , পোকামাকড়ের অভাব নেই। বাট শি ইজ সো কনফিডেন্ট! 


    প্রাইমারি স্কুল থেকে মাণিক মন্ডলের বাড়িতে যেতে হল জলের মধ্যে দিয়ে । ভয় করেছিল।সাপ থাকে যদি? করুণা নির্বিকার।বলল, থাকতিও পারে। মাণিক মন্ডলের বাড়ি একটু উঁচু জমিতে। চার পাঁচটি পরিবার ওখানে মাথা গুঁজেছে। মাটিতে ধপ করে বসে পড়ে নয়না বলল, গুরু একটা সিগারেট দিবি? আমাদের স্কলারশিপের টাকা বন্ধ মাইরি।বাপের হোটেলে খাচ্ছি, সিগারেটের পয়সা চাওয়া যায়?


    এম এইচ আর ডি, এম ও ই ভেবেছে স্কলারদের টাকা লাগে না।ওরা হাওয়া খেয়ে বাঁচবে।কিংবা বাপের টাকায়। ইউনিভার্সিটিতে পাঁচশ গবেষক। আত্মহত্যাপ্রবণ বেশ কয়েকজন। নয়নার চলে যাচ্ছে।ওদের যাচ্ছে না। কিন্তু তিরিশে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কোনো অ্যাপয়েন্টমেন্ট দেওয়া হবে না। 


    কিছুটা শুকনো জমি জেগে আছে জলে ডোবা প্রান্তরে। কিছু ক্ষুধার্ত মানুষ।ছেলে বুড়ো মিশিয়ে জনা কুড়ি । ওরা ছ' জন এসেছে এপারে।বাকিরা গেছে নিশুন্দির দিকে। কোনোমতে শুকনো কাঠ জ্বেলে ভাত বসিয়েছে। টুপুর দেখছে।এদের কারু দৃষ্টি শূন্য নয়। যন্ত্রণা আছে। আর্তনাদ আছে।শূন্যতা নেই।


    সেইজন্য এখানে এই মোটা চালের ভাতে সুগন্ধ । শুধু ভাতের গন্ধ এতটা ভালো হতে পারে! এত তৃপ্তির! দু চোখ জুড়ে ঘুম এল ওর। 


    জলের ওপারে দাঁড়িয়ে ইরফান খান হাসলেন।


    - আপ? ইতনে দিন কঁহা থে?


    - থা ইধার উধার। পর তুম ? ক্যায়সি হো? ভালো আছো? 


    - ভালো আছি ইরফান। বেশ ভালো।যতদিন ঘরে বন্ধ রেখেছিলাম নিজেকে, খুব খারাপ ছিলাম। এখন অক্সিজেন পাচ্ছি। অক্সিমিটার ছাড়াই বলছি।ভালো আছি। অ্যান্ড আই হ্যাভ ডিসাইডেড টু লিভ রক্তিম।


    - সাচ? বোলা উসকো?


    - নহি।বলুঙ্গি। বলবো। ফিরে যাই। এই জলে ডুবে যাওয়া শস্য'ক্ষেত্র, না খেতে পাওয়া মানুষ, জলহীন , বিদ্যুত্হীন জনপদগুলি, এই খোলা আকাশের নিচে বেকুবের মত মানুষের কাছ থেকে আমি সাহস সঞ্চয় করছি ইরফান। তুমি আছো তো সঙ্গে?ইউ হ্যাভ সাচ আ নাইস স্মাইল। ইট মোটিভেটস। 


    জলের ওপার থেকে পচা পাতার গন্ধ ঢেকে ভাতের গন্ধ । ইরফান হাত বাড়িয়ে দিলেন।( চলছে)



    # করোনাকালীন ( দুই)ভুলে গেছিলাম আজ শনিবার!


    কুড়ি 


    ড.ঈশান মজুমদার চশমার ফাঁক দিয়ে দেখলেন মেয়েটিকে। তিনি নিজেও বয়সে তরুণ।এই বয়েসের মেয়েদের সাইকোলজি তাঁর পেশাগত এবং দৃষ্টিগোচরভাবে অধীত।


    মেয়েটা ত্যাড়া টাইপ নয় তবে বিদঘুটে রকমের জেদি। অনেক প্রি কনসিভড নোশন নিয়ে বাঁচে।আবার সেগুলো থেকে বেরোতেও চায়।সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং ওর হাতের ট্যাটু। বাদুড়, বেবুন, সাপ।বিভিন্ন ডিজাইনের সঙ্গে এরাই জড়িয়ে আছে । নাকে আবার একটা বেসর টাইপের কী পরেছে। ঈশান মজুমদার নাকে এই গয়না দেখেছেন মেথর সম্প্রদায়ের মেয়েদের মধ্যে ।মারাঠী মেয়েরাও পরে কিন্তু মুক্তো টুক্তো দিয়ে একটা অন্য এফেক্ট থাকে।এটা পিওর বেসর।মেয়েটা বোধহয় এটা দিয়ে ওর ক্লাসলেসনেস প্রজেক্ট করতে চাইছে।অবশ্য' গয়নাটা ওর মুখে মানিয়েছে চমৎকার ।প্রেটি সেক্সি। 


    ঈশানের চেম্বার এমনিতে পেশেন্টের সমাগমে ভর্তি থাকে। দিনে কুড়ি জন।সন্ধ্যায় পনেরজন।লকডাউনে পেশেন্ট কম। চেম্বারের মধ্যে একটি বিশাল ম্যারিন অ্যাকুরিয়াম। তাতে একটি সি হর্স আছে।মেয়েটা ভ্রূ কুঁচকে সি হর্সটা দেখছিল। বাইরে আপাতত দু' জন পেশেন্ট।ঈশানের অ্যাসিসট্যান্টরা লকডাউনে অল্টারনেটিভ ডে আসে।সকালে।সন্ধ্যাবেলা ঈশান নিজেই সামলে নেন।চেম্বার খোলা, পেশেন্ট বসানোর জন্য একটি ছেলে আছে।


    এইসময় বহু বিচিত্র রকম কেস দেখছেন ঈশান।একজন মহিলা এত হাত ধুচ্ছেন ও বাড়ির লোকদের ধোয়াচ্ছেন যে তারা অতিষ্ঠ হয়ে গেছে।পিওর ওসিডি। মহিলা দিনে প্রায় দশবার স্নান করে ঠান্ডা লাগিয়ে জ্বর বাঁধিয়েছেন। আরেকজন পেশেন্ট আছে তাঁর যিনি ভীষণ ডিপ্রেশনে ভোগেন। স্ত্রী, ছেলে সবাই ফেড আপ। ভদ্রলোক চেম্বারে ঢুকেই বেরিয়ে যাচ্ছিলেন।ছেলে আবার ধরে এনে বসালো। খানিকক্ষণ নিমপাতা গেলার মত মুখ করে বসে থেকে ভদ্রলোক বললেন, কেন যে আজ এলাম।এবার তো করোনা থেকে কেউ বাঁচাতে পারবে না। ঈশান জিজ্ঞেস করেছিলেন , কেন? তাতে ভদ্রলোক খুব রেগে যান।


    - এই যে চেম্বারে এসি চালিয়ে রেখেছেন। জানেন এসি থেকে করোনা ভাইরাস ছড়াচ্ছে? আপনি ডাক্তার হয়ে এরকম করছেন। 


    এরপর পুরো কাউনসেলিংটা এসি বন্ধ করে চলে।


    মালবিকার অবশ্য কোনো একসেনট্রিসিটি নেই।ঈশানের ক্যালকুলেশন বলছে ওর দাম্পত্য সম্পর্কে একটা গন্ডগোল আছে।যদিও অ্যাপারেন্টলি সব খুব ঠিকঠাক।ভদ্রলোক দুদিন এসেছিলেন স্ত্রীর সঙ্গে ।বেশ কেয়ারিং মনে হল।তারপর সিটিং এ মেয়েই আসে। আজ আবার নিজের জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিয়ে একাই এসেছে।


    ঈশানের চেম্বার বিলিতি মতে সাজানো। ব্লাইন্ডস।হ্যাটস্ট্যান্ড। একপাশে সোফা।সেন্টার টেবিলে চায়ের সরঞ্জাম ।


    মেয়েটা খুঁটিয়ে ঘরটা দেখতে দেখতে বলল, হ্যাটস্ট্যান্ড রেখেছেন কেন? এখানে টুপি পরে লোকজন আসে?


    ঈশান সোজা চোখে তাকিয়ে বললেন, যদি আসে।


    মেয়েটা দেখতে বেশ। পড়াশোনাতেও তো ভালো।আই আই টি তে রিসার্চ করছে। একটা স্লিভলেস টপ আর হাঁটু ছেঁড়া জিনস পরে এসেছে।চুলগুলো কালার করা। একটু খেপী আছে মনে হয়। 


    ঈশান যথাসম্ভব গম্ভীর হয়ে কথা বলছেন কারণ ও মাঝেমাঝেই আউট অব কনটেক্সট চলে যাচ্ছে, বাউন্সার দিচ্ছে ।ডাক্তারকে সাবধানে খেলতে হয়।


    আই আই টি, ফিজিক্স ও মেটালার্জি নিয়ে বেসিক কথা হয়ে গেছে। এবার কামিং টু দ্য পয়েন্ট ।


    মেয়েটা জিজ্ঞেস করলো, সি হর্স কোত্থেকে জোগাড় করলেন? ইজ ইট লিগাল টু কিপ আ সি হর্স? এ তো ভীষণ রেয়ার।


    - ইয়েস, ইফ ইট ইজ আ মেরিন অ্যাকুরিয়াম। 


    - লিগাল, ইল্লিগাল কে কীভাবে বিচার করে বলুন তো? 


    মেয়েটা মাথা চিৎ করে প্রশ্ন করল। ঘাড় ঘোরাচ্ছে।কিছু একটা অস্বস্তি হচ্ছে ওর ।ঈশান আন্দাজ করলেন।মনে হয় চেইন স্মোকার। ঈশানের চেম্বারে পেশেন্টের সামনে জলের গ্লাস থাকে।সেই পরিস্কার, স্বচ্ছ টলটলে জলের দিকে মন দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মেয়েটা ঈশানকে বলল,


    আই ওয়ান্ট টু গেট আউট অব আ টক্সিক রিলেশনশিপ।ক্যান ইউ হেল্প?এটা তো ইল্লিগাল কিছু না।অ্যাজ ফার অ্যাজ আই নো, আনএথিকালও না। আমি নিজেও খুব ন্যাম্বি প্যাম্বি সেন্টিমেন্টালও না। বাট আই ক্যান নট গেট রিড অব ইট।


    ঈশান মেয়েটিকে দেখছিল। সচেতন মেয়ে ।ডাক্তার যে ওকে দেখছে দিব্যি বুঝতে পারছে।


    - কতদিনের রিলেশন?


    - ইফ ইউ আস্ক কতদিন চিনি, তাহলে বলব সিন্স আ লঙ্গ টাইম।ছোটবেলা থেকে।মায়ের বন্ধুর ছেলে।আর রিলেশন এই ধরুন বছর পাঁচেক।


    - প্রেম ? কে প্রপোজ করেছিল?


    - ইজ দ্যাট রেলিভ্যান্ট ডক? প্রপোজ রক্তিম করেছিল।কিন্তু ঠিক ওরকম না।আমাদের দু বাড়ি থেকেই চেয়েছিল মানে চায় আমরা বিয়ে করি।কোর্টশিপ বলতে পারেন।


    - আর ইউ ফিজিক্যালি ইনভলভ্ড উইদ হিম?


    - ইয়েস। বছর চারেক হল।যখনই ছুটিতে বাড়ি আসি।এক হয় আমাদের বাড়িতে ।বা বাইরে কোথাও।


    - ওদের বাড়িতে?


    - না। বলে হাসল। 


    মেয়েটা হাসলে গালে টোল পড়ে। ডাক্তারের টোলটা পছন্দ হল। 


    - রিলেশন টক্সিক মনে হচ্ছে কেন? 


    মেয়েটা এবার ঢকঢক করে জল খাচ্ছে । 


    - গত দুবছর থেকে। আই ফাইন্ড হিম ন্যাস্টিলি ডমিনেটিং।ইরিটেটিং। এই বিয়েটা ভালো হবে না।


    - মারধোর'করে? হ্যাজ হি বিন অ্যাবিউজিভ?


    - হাতে মারে না।নো হাতাহাতি।মারলে আমিও মারতাম তো।


    ঈশান হাসলেন।বেশ লাগছে মেয়েটাকে।


    - তাহলে? কীভাবে ডমিনেট করেন? সেক্সুয়ালি?


    - নাহ্। পারে না।সেক্সুয়ালি উইক তো। প্যাসিভ


    ইম্পোটেন্ট নয় । ইনকমপিটেন্ট । আই অ্যাম সাপোসেড টু অ্যাক্টিভেট। সেটা প্রথম দিকে খারাপ লাগতো না।এখন বাজে লাগে। অ্যান্ড হি কিপস অন ব্লেমিং মি ফর হিজ ইনকেপাসিটি। 


    - ওহ।তবে তো ওর কাউনসেলিং দরকার। প্রয়োজন হলে ট্রিটমেন্ট ।


    মেয়েটা মুখ ব্যাঁকালো। তারপর এলিয়ে বসল ।


    - ওর কাউনসেলিং, ওর ট্রিটমেন্ট ও নিজে করাক। আই অ্যাম নট ইন্টেরেসটেড।


    - এটা তো ভুল চিন্তা।যদি কেসটা আপনার হত, মানে আপনি সেক্সুয়ালি দুর্বল আর উনি ছেড়ে যেতে চাইছেন, তাহলে কিন্তু আপনার ফেমিনিস্ট বন্ধুরা হা হা করে তেড়ে আসত।


    - ফাক ইট। আই অ্যাম নট আ ফেমিনিস্ট। অ্যান্ড আই অ্যাম নট লিভিং হিম ফর বিইংগ সেক্সুয়ালি উইক। ও একটা মেন্টাল কেস। আ মনস্টার।ওর জন্য আমি পর্ণওয়াইফ হতে পারব না।আফটার দ্য অ্যাক্ট ও কী করে জানেন? সিগারেট খেতে খেতে বলে যায় ওর প্রাক্তন প্রেমিকারা কে কত ভালো করে ওকে স্যাটিসফাই করেছে।ডোন্ট ইউ থিংক ইট ইজ অ্যাবোমিনেবল?


    ওর নাকের পাটা কাঁপছে।মাজা ত্বকে লাল রঙ একটা সুন্দর আভা তৈরি করে।কিন্তু ঈশান কখনোই পেশেন্টদের সঙ্গে ফ্লার্ট করেন না।


    - জয়েন্ট কাউনসেলিং করাতে পারেন কিন্তু ।খুব ভালো কাজ হয়। ইউ ক্যান ট্রাই।


    - আপনি কী আমাদের বিয়ে না দিয়ে ছাড়বেন না?আমার মায়ের মত? বলছি তো আমি বেরোতে চাই।


    - তাহলে বেরিয়ে যান।অসুবিধে কোথায়?


    - সেটা পারছি না বলেই তো এসেছি। বাড়ির চাপ আছে। দু বাড়িতেই জানে আমরা এনগেজড।বিয়েটা হচ্ছে।সেভাবেই মেলামেশা করছি। সেই চাপটা আমি সামলে নেব। বাবা উইল নট মাইন্ড। 


    - মা?


    - হয়ে যাবে।এখন নাহয় অসুস্থ । বাট আই ক্যান ট্যাকল হার।


    - তাহলে সমস্যা কোথায় মিস সেনগুপ্ত?


    - নৈঋতা। মিস বলবেন না।মিস, মিসেস এগুলো ডিসক্রিমেনেটরি । 


    মেয়েটা ফেমিনিস্ট । বোঝা গেল। ঈশান জলের গ্লাসে জল ঢেলে দিলেন।


    - বেশ নৈঋতা। সমস্যা কোথায় বলুন। মা, বাবাকে আপনি সামলে নিতে পারলে আর কী অসুবিধে?


    - অসুবিধে আমি নিজে। যখনই ব্রেক আপের কথা ভাবছি, তখন মনে হচ্ছে যে ওর সঙ্গে ফিজিক্যাল রিলেশন হয়েছে।গত চার বছর । 


    - বাট ইউ ওয়ের নট স্যাটিসফায়েড।


    - নো।নেভার। 


    - ডু ইউ রিগ্রেট লুজিং ভার্জিনিটি?


    -'আই ডোন্ট বিলিভ ইন ইট। কিন্তু জানেন তো, মনে হচ্ছে এতদিন মুখে বলেছি বিশ্বাস করি না।মানি না। বেরিয়ে আসবে ভাবলে তাহলে ওটা মনে হচ্ছে কেন? 


    - বলেছেন ওকে?


    - সামনাসামনি হলে বলতে পারছি না।আগে অনেক প্রিপেয়ার করছি নিজেকে। তবু ।পারছি না।চলো সব ঠিক আছে করে যাচ্ছি।আবার হার্ট হচ্ছি।


    - অন্য কাউকে কখনো ভালো লেগেছে? 


    নৈঋতা সেনগুপ্ত আবার জল খেল।সি হর্স ওঠা নামা করছে দেখল মন দিয়ে ।


    ঈশান মজুমদার লম্বা।দোহারা। সুস্নাত।ভদ্র।বাইরে থেকে দেখে কি কিছু বোঝা যায়? ঈশানের মুখে একটা লাবণ্য'আছে। ভেরি রেয়ার। 


    জলের গ্লাস ঠক করে টেবিলে নামিয়ে বলল,


    - আপনাকে তো বেশ ভালোই লাগছে।( চলছে)


    # করোনাকালীন ( দুই)


    পর্ব একুশ - লকডাউনে অনলাইন বশীকরণ


    বিকেলের রোদ খুব কড়া।অসহিষ্ণু ।এইসময় সবচেয়ে বাজে গরমটা পড়ে।প্রায় সন্ধে পর্যন্ত । শ্যামা কাজকর্ম সারতে সারতে বিকেল তিনটে বেজে যায় ।তখনি ঐ উচুক্কুরে গরম পড়ে। সবার দুপুরের খাওয়া শেষ হলে রান্নাঘর ধুয়ে মুছে সাফ করে শ্যামা সিরিয়াল দেখতে বসে।


    বাবলুর জন্মদিনের কেক এখনো ফ্রিজে অনেকটা রাখা আছে।টুপুর সেদিন সন্ধ্যায় কেন, রাতেও ফিরতে পারেনি। তবে কেক এসেছিল সময় মত।লুচি মাংসও' হয়েছিল। ভাগ্যিস হরপ্রীত এসেছিল।তাই একটু ঝলমলে হয়েছিল সন্ধেবেলাটা। সকালে যে এসেছিল বেড়াতে, বাবুদার বন্ধুর মা, তাকে অনেকবার বলেছিল শ্যামা । সন্ধে অবধি থেকে যাও। থাকেনি। আর থাকেই বা কী করে।নতুন মানুষ। ঐ পায়েসটুকু মুখে দিয়ে চলে গেল ঘন্টা খানিক বাদে। পুলিশের গাড়ি নিতে এসেছিল।বউটাকে বেশ লেগেছে।বাবলুর'জন্য দুশো টাকাও দিয়ে গেছে শ্যামার হাতে। আবার সঙ্গে  করে নিজের বানানো মিষ্টি এনেছিল। 


    শ্যামাদের বস্তিতে ঘটা করে জন্মদিন দেয় সব আজকাল ।ষাট পঁয়ষট্টিজন লোক খায়।ডিজে আসে।কেক , মাংস , ভাত খাওয়াতে গোটা মাসের মাইনে বেরিয়ে গেলে ওরা ধার নেয়। কিন্তু জন্মদিন দিতেই হবে ঘটা করে। 


    শ্যামার অত শখ নেই।তবে ছেলের মুখে পায়েস দিতে পেরেছে ।এতেই খুশি।টুপুর আসতে পারলো না বলে মনটা একটু খারাপ হয়েছিল।সেই তো ব্যবস্থা করতে বলেছে সব হাজার হোক। দাদা এসে বসেছিল কেক কাটার সময়।পায়েস মুখে দিয়েছে।বউদি আজ সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ বসেছিল। বাবলুর হাতে একশোটা করে টাকা ওরাও দিয়েছে। বউদিকে জোর করে শাড়ি পরিয়েছিল একটা সন্ধের স্নানের পরে। লাল লাড়ি।সবুজ পাড়ে।ভারি সুন্দর মানিয়েছিল বউদিকে কিন্তু।অনেকদিন বাদে চেহারাতে শ্রী এসেছিল একটা।শ্যামার বড় কষ্ট হয় মানুষটার জন্য।


    তার নিজের সংসার ভেঙেছে।ঘর ভেঙেছে।থাকার মধ্যে আছে শুধু ছেলেটা।আর এই মানুষটা দ্যাখো।বড় চাকরি করা বর আছে।স্কুল কলেজ পাশ ছেলে মেয়ে আছে তবু কেউ থেকেও নেই।এর চেয়ে দুর্গতি আছে আর?


    সেই সব কথাই বলছিল হরপ্রীতকে বসে বসে শ্যামা।অনেকদিন বাদে দেখা দুজনে।আগে কত এই ডাইনিং এ বসে টিভি দেখেছে দুজনে। হরপ্রীত বাবলুর জন্য'হাতে সেলাই করা জামা এনেছে।সেলাই মেশিনের তুরন্ত হাত ছোটে মেয়েটার।বকবক করে আর সেলাই করে।কেউ না থাকলে একাও বকে।লকডাউনে শুধু মাস্ক আর স্যানিটাইজার তৈরি করে বাড়িতে বাড়িতে সাপ্লাই দিয়েই অনেক টাকা কামিয়েছে । ছোটি মালকিনের হোম ডেলিভারি করেছে। তার সঙ্গে এখন ধরেছে সেলাই। করোনা হয়েছে বলে শপিং বন্ধ হয়নি।বড় ঘরের মেয়ে বউরা দিব্যি অনলাইনে জিনিস কিনছে। হরপ্রীত শাড়িতে ফলস লাগানো আর ব্লাউজ তৈরির অর্ডার নিচ্ছে ।অবাক হয়ে যায় শ্যামা।মেয়েটা রাত রাত জেগে কাজ করে আবার ভোরে উঠে যায় ।তবু চোখের নিচে এতটুকু কালি পড়ে না।


    একদিন বস্তিতে যেতে হবে।হরপ্রীতকে নিয়ে যাবে ওর সুবিধামত।জিনিসপত্র সব তো গেছে। যা আছে তাও বেহাল থাকবে।হরপ্রীত সঙ্গে থাকলে বুকে একটু বল আসে। ও মেয়ের কব্জির জোর আলাদা। 


    তারপর আছে আধার কার্ডের চিন্তা।খুব তো দশরথ সাউ বলেছিল , আধার কার্ড করে দেবে।আধার কার্ড ছাড়া প্যান কার্ড হবে না।প্যান না হলে ব্যাঙ্কে টাকা ঢুকবে না।যেই শাশুড়ি মরলো, শ্যামার করোনা ধরলো, আর কোনো পাত্তা নেই শালার। আসুক আবার মস্তি করতে কখনো।শ্যামা দেবে কথা শুনিয়ে।করোনা এসে বুঝিয়ে দিয়েছে কত ধানে কত চাল। শূয়ার। মনে মনে গাল পাড়ে শ্যামা।হরপ্রীতকে আরো দুটো লুচি ভেজে দেয়।সে মাংস খায় না।তাই আলুর দম করে রেখেছে তার জন্য।বেগুন ভাজা।সাপটে সুপটে গেল হরপ্রীত । বাঙালি রান্না খুব ভালোবাসে খেতে। এই মানুষটার সাচ্চা দিল আছে।বুঝে গেছে শ্যামা।


    চোখের সামনে মানুষ তৃপ্তি করে খেলে বড় শান্তি আসে। যেমন সুখন খেত। খাইয়ে সুখ ছিল। আতপচালে একটু ঘি ফেলে, কড়কড়ে করে শুকনো মরিচ ভেজে আলুসেদ্ধ মেখে দাও। তাও চেটেপুটে খাবে।আবার লুচি ঘুগনি সামনে ধরে দিলে সেও সোনামুখ করে খাবে চেয়ে আরো চারটে নেবে।


    আর এদের দ্যাখো। দাদার বলে সুগার আর কোলেস্টরেল নাকী। এটা খায় না।সেটা খায় না। হাজার বারণ। মেয়েটা তো আরেক ছিরি।স্যান্ডউইচ আর স্যালাড খেয়েই থাকে।শ্যামার দেখলেও গা গুলায় ।হ্যাঁ ।বউদি যখন ভালো ছিল , তখন খাওয়ার তরিবৎ ছিল। যেমন পরিপাটি রান্না, তেমন পরিপাটি খাওয়া । এই ভূতের বাড়িতে মন খারাপ লাগে শ্যামার । কিন্তু ভাবে, তবু তো আশ্রয়।ঐ ঝড়ের পর যে রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হয়নি, কালুর হাত থেকে বেঁচে ভদ্রমত শান্তিতে আছে, খাওয়া পরার অভাব নেই, এই কী কম বড় হল? জিভ কেটে নিজেই নিজের পাছাতে লাথি মারে । হরপ্রীতকে বলে, বেগুন ভাজি আর দুটো।


    বাবলু ঘুমিয়ে গেলে, দাদাকে গরম জল দিয়ে আসে ।গার্গল করবে। করোনাতে গার্গল করতে বলেছে।তারপর আদা কুচি দিয়ে খাবে গরমজল। আবার ল্যাপটপ নিয়ে বসবে। বউদির ছাড়া শাড়ি ভাঁজ করতে করতে মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল শ্যামা । ঘুমের ওষুধ ছাড়া নাকী ঘুম আসে না।বোঝো গেরো। এই যে শ্যামার এত অশান্তি গেল জীবনে, লোকটাই ভেগে গেল, কই শ্যামা তো ঘুমের ওষুধ খায়নি কখনো। শুয়ে কেঁদেছে।তারপর কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছে।ওষুধ খেতে হয়নি। মানুষটা কী ভালো হবে না, নাকী? সংসারটা এরকম বেহাল হয়ে থাকবে? বউদির খানকয় শাড়ি পরছে শ্যামা। ব্লাউজগুলো ঢলঢল করে অবশ্য।কিন্তু উপায় কী। 


    রাতে বাসন ধুয়ে তুলতে তুলতে কথাটা মনে হল শ্যামার । দাদার বাইরে কিছু একটা আছে। সে তো জানা কথা। কিন্তু সে তো সেন্টার থেকে বেরোনোর আগে ফোন নম্বর নিয়েছে! অতসী মা! ঠিক সময়ে অতসী মায়ের কথা মনে পড়েছে শ্যামার । পরস্ত্রী গমন ছুটিয়ে দিতে পারে মা।সেন্টারে বসে কত গালগল্প হয়েছে এসব! অতসী মা ধরে ধরে লক্ষণ দেখে বউদির মত পোড়া কপাল বউদের জন্য উর্বশী সিঁদূর আর সাবিত্রী তেল দেয় । ঐ সিঁদূর পরলে আর তেল মুখে মাখলে , স্বামী আর কোনো অন্য মেয়েছেলের দিকে ফিরে চাইবে না। উপোস রেখে পূর্ণিমার রাতে পরতে হবে । তাই করবে শ্যামা ।ফোন করবে অতসী মা' কে।দরকার হলে বউদিকে নিয়ে যাবে আশ্রমে। বউদির ভালো হয়ে ওঠা খুব দরকার।এত দেওয়া থোয়ার হাত মানুষটার! শ্যামা নইলে করবে কী!


    যে বউটা এসেছিল, তাকে চোখে ধরে আছে শ্যামার। কী সুন্দর কথাবার্তা । ওর মেয়ে বুঝি বাবুদার বন্ধু । শ্যামা ভাবে, হবেও বা প্রেম ট্রেম। এ বাড়িতে একটা বিয়ে লাগলেও ভালো । তাহলে যদি দাদার বাইরের মেয়েছেলের রোগটা ছোটে।সে মেয়েছেলেটাকে দেখার বড় সাধ শ্যামার ।


    অতসী মাকে ফোনে পেয়ে গেল শ্যামা । রাতের দিকে ফোন করা নিষেধ।মানে দশটার পরে। সাড়ে নটাতে ফোন লাগালো। মা তখন খাওয়া দাওয়ার পর পাউডার মাখে। একটু হাল্কা থাকে।


    শ্যামা যেতে চায় একদিন। তা লকডাউনে কী করে হবে? গাড়িঘোড়া তো বন্ধ! বউদির কেসটাতো বলতে হবে মা'কে।বউদির মেয়েকে আবার জানানো যাবে না।যে খেঁকুড়ে স্বভাব। 


    মায়ের গলার স্বরে তরল। ঘুমাতে যাবেন এবার। হঠাৎ মাথায় চড়াৎ করে বুদ্ধি এল শ্যামার । এখন সবাই ঐ অনলাইন না কী করে! দাদা করে, মেয়েটা করে। সব নাকী দেখা যায় । স্কুলের পড়ালেখাও অনলাইন। মাস্টারকে ফোনে দেখা যাবে। মাইনে পেলে একটা বড় ফোন কিনবে শ্যামা । ছেলেটা ফোনের অভাবে পড়তে পারছে না। 


    শ্যামার সেই আদ্দিকালের খুদে ফোন। তাই থেকেই আবার রিং লাগালো শ্যামা।


    - তুমি অনলাইন কথা বলো না মা।তারপর আশ্রম খুললে বউদিকে নিয়ে যাব। 


    অতসী মায়ের এই কথাটি মনে ধরেছিল। খবরের কাগজে বিজ্ঞাপনের পাতায় ও লিফলেটে পরের সপ্তাহেই ছোট করে বিজ্ঞাপন বেরোলো।


    অনলাইনে হারানো - প্রাপ্তি, স্বামী বশীকরণ ও সন্তানলাভের জন্য যোগাযোগ করুন।নিচে ফোন নম্বর আর অতসী মায়ের হাসি মুখের ছবি।


    শ্যামা বউদিকে ভয়ে ভয়ে একদিন কাগজটা দেখাল। দুটো কথা শোনা, বলা তো শুধু। এমনকী ক্ষতি ।যদি ভালো ফল পাওয়া যায় । মালবিকা কাগজটা ভাঁজ করে রেখে দিলেন। নার্ভের ওষুধ খেয়ে সকালের দিকে শরীর শিথিল লাগে। বেলা হলে কাটে শিথিলতা। শ্যামা বলল,, কথা বলবে বউদি?ডাক্তারকে কিন্তু বোলো না আবার।


    মালবিকা ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। 


    আশ্রম এখন বন্ধ ।লকডাউনে কেই বা আসবে। তাও মন্দির খোলা হয় সামান্য সময়ের জন্য।ধূপ ধুনো ভোগ এসব করতে ঘন্টা দেড়েক লাগে।জনা চার পাঁচ আশ্রমের লোক।মুখে মাস্ক।চারদিকে স্যানিটাইজার ছড়িয়ে দেয়।তারপর কাজ শুরু। অন্য সময়ে তিন চার ঘন্টা ধরে পুজো আরতি চলে।এখন সব শর্টে। মন্দিরের মধ্যে বিশাল শ্বেতপাথরের মূর্তি ।রাধামাধবের টিপিক্যাল পোজ।রাধার আজ হলুদ শাড়ি ।মাধবের সাদা। ফুল পাওয়া যাচ্ছে না লকডাউনে ।অন্যান্য সময় ভক্তরা রাশি রাশি ফুল দিয়ে যায় সকালেই। এখন আশ্রমের গাছে যা ফুল হয়, তাই দিয়ে পুজো চলছে।চন্দন দিয়ে বিগ্রহকে লেপাপোঁছা হলে বেশ মিস্টি গন্ধ বেরোয়।ঐরকম গন্ধ বেরোচ্ছে একটা। ঐ গন্ধে আপনি মন ভালো হয়।আশ্রমের একজন হারমোনিয়াম, আরেকজন শ্রীখোল নিয়ে রেডি। আরতির সময় নিয়মরক্ষে গাইবে।মার্জনা, অঙ্গবস্ত্র, মানে বিগ্রহকে চন্দন দিয়ে পরিস্কার করা, শাড়ি ধুতি পরানো হয়ে গেছে।পন্চপ্রদীপ রেডি।সলতে পরাচ্ছে এক এক করে। 


    অতসী মা এসব কিছুই করে না। তদারকিটুকু শুধু। আজ সে তাও করছিল না। সন্ধে হয়ে এসেছে। বিকেলের শেষ রঙ এখনি টুপ করে নিভে যাবে। যে আশ্রম এইসময়গুলো ভক্তের ভিড়ে ডগমগ করে, সেই আশ্রম ফাঁকা। দু তিনজন মাস্কবাঁধা অতিশয় ভক্ত অবশ্য হাজির হয়েই থাকেন , কিন্তু গুরুদেব তাদের জন্য আর নিচে নামেন না। লকডাউনে তিনি স্নানের পর, সন্ধ্যার পর ওপরেই থাকেন। এই যে আরতি হবে, গান হবে, সব তিনি দোতলার হলঘর থেকে শুনতে পান।সেখানেই প্রণাম করে নেন। তারপর তাঁর জন্য'কাঁচের বাটিতে ক্ষীর আসে তাতে আপেল, কলা, কিশমিশ, কাজু ছড়ানো। এই খেয়ে তিনি সিনেমা দেখতে বসেন। অনেকদিন বাদে সিনেমার নেশা হয়েছে।ভক্তসমাগম থাকলে এইসব সুযোগ কোথায়? ন' টার সময় তাঁর নৈশাহার। ততক্ষণ পর্যন্ত অতসী মা নিচে সব সামলে নেবেন। লকডাউনে গুরু ভক্তদের দর্শন দিচ্ছেন না।


    ভারি হয়ে আছে বাতাস। সামনে একটা মস্ত টগর গাছে সাদা সাদা টগর ফুটে আছে তারার মতন।ওপাশে সার বেঁধে নয়নতারা ।গাঁদা। গান শুরু হল। অতসী মা সাধারণত গানে যোগ দেন। তার গলাটাও মিষ্টি ।


    আজ তিনি কিছুই করছেন না। চুলটাও এলোমেলো।সেন্টারে চুলের বড় অযত্ন হয়েছে ।কন্ডিশনার, সিরাম কিছুই পড়েনি । এখন দোকানপাট বন্ধ।কোম্পানির লোক আসাও বন্ধ। এইসব জিনিস এমনিতে ভক্তরাই দিয়ে যান।অতসী মা খুব অন্যমনস্ক হয়ে আছেন। উর্বশী তেল আর সাবিত্রী সিঁদূর হুহু করে বিক্রি হয়। দিনে আট দশ হাজার কোনো ব্যাপার না। লকডাউনে সব গেছে। চার পাঁচশো মেরে কেটে।অনলাইন পরামর্শে রোজগার মোটামুটিভাবে । বেশির ভাগ বশীকরণ কেস।


    আজ অবশ্য সেই কারণে না।মায়ের মুখ ক্রমশ উদ্বেল। দুপুরের দিকে ফোন এসেছে গতজন্মের শ্বশুরঘর থেকে।সেই যে মেরে পাট করে দেওয়া বর ছিল, যার কোনো বউই কোনো সন্তান পেটে ধরতে পারেনি, সেই গতজন্মের স্বামী কোভিডে মরেছে। আর আশ্রমে এসে গুরুর কৃপায় অতসী মা যে ছেলে বিইয়েছিল, তাকে রোগে ধরেছে।সে ছেলে এখন হাসপাতালে।


    অতসী অতসী মা হবার পর থেকে তার আগের জন্ম আর নেই।তার ঘন কালো কোঁকড়ানো চুলে আঙুল বোলাতে বোলাতে গুরুবাবা বলেছিল।ঘাড়ে ঢেলে দিয়েছিল চার হাজার টাকা দামের সেন্ট।এখন অতসী মা আর সেন্ট বলে না।বলে পার্ফ্যুম।গুরুদেবের শয্যায় যাবার আগে ভাল মত স্নান করে, বিদেশী পার্ফ্যুম মেখে যেতে হয়। সে অতসী মা হোক কী নতুন কোনো সাধিকা হোক। অতসী মা ই তাদের ট্রেনিং দেয়। যেমন তাকে শিখিয়েছিল সতী মা। গত কয়বছরে শ্বশুরবাড়ির কথা ভেবেছে কখনো! এখন তার জন্য ভক্তরা ফরাসী গন্ধ এনে দেয়। ব্রাজিলের মূলতানি মাটি , ফেশিয়াল করবে বলে।


    তবু খবরটা পাবার পর থেকে বুকের ভেতরটা গুম মেরে আছে।কেমন যেন অস্বস্তি হচ্ছে ভেতরে।কী 


    যেন নেই মনে হচ্ছে। গুরুদেব কত শিখিয়েছে , এসব হল সংস্কার।মনকে সংস্কারের ওপরে রাখতে হবে। তবু গুমোট ভাবটা যাচ্ছে না। দুপুরে মাছটা খাবার পরে ফোন এসেছিল। এখন বাকি কটা দিন কী করবে গুরুদেবকে জিজ্ঞেস করতে হবে।


    অন্যমনস্ক ভাবেই চোখ তুলে অতসী মা দেখল গেটের কাছে দাঁড়িয়ে একটা রোগাটে, লম্বা , গালের হনু একটু উঁচু মেয়েছেলে দাঁড়িয়ে । পেছনেপ আরেকটা মেয়েমানুষ। গায়ে আঁচল টানা জয়া বচ্চনের কায়দায় । চিনতে পারল না তাকে।কিন্তু সামনের মেয়েটা চেনা।কোয়ারেন্টাইন সেন্টারের আলাপ। অতসী মা উৎসুক হয়ে তাকাল।ফোন করেছিল দুদিন আগে।শ্যামা ।


    ডাক্তারের চেম্বারে তিন নম্বর সিটিং নিচ্ছিল মেয়েটা।হাতে একটা মস্ত বিদেশি ঘড়ি।


    ডাক্তার বললেন, এমন কিছু কঠিন না। আপনি নিজেকে ফ্রি ভাবতে শুরু করুন। এমন তো না, রোজ আপনার ফিঁয়াসে মানে রক্তিমের সঙ্গে আপনাকে দেখা করতে হচ্ছে।আস্তে আস্তে গ্যাপটা বাড়ান। বুঝতে দিন অ্যাভয়েড করছেন। কী রিঅ্যাক্ট করে দেখুন।


    টেবল ল্যামপটা ভারি চমৎকার ।আফ্রিকান ডিজাইন। আলোটা গোল হয়ে জ্যামিতিক প্যাটার্ণে ছড়িয়ে পড়ছে। 


    মেয়েটা বলল, হুঁ। ও কী রিঅ্যাক্ট করছে সে নিয়ে আমি ভাববো কেন? হু ইজ হি?


    ডাক্তার একটা নিঃশ্বাস ফেললেন।


    - তাহলে তো অনেকটা কাজ হয়েই গেছে। আপনি বরং একটা প্রেমে পড়ার চেষ্টা করুন।


    আলোটা ভারি মোলায়েম।ডাক্তারের গলার স্বরের মতোই ।মেয়েটা চোখ তুলে তাকালো। আজ কাজল পড়েনি।বাসি কাজল লেগে আছে তবু।বলল,


    সেই চেষ্টাই তো করছি ।( চলছে)


    #করোনাকালীন (দুই)


    একুশ


    সী হর্স টি আয়তনে অতি ছোট। অবিকল ঘোড়ার প্যাটার্ন মুখ। নিম্নাংশ জলকন্যা। সাদাটে রঙ।নড়ে চড়ে কম। অক্টোপাস আছে ছোট একটা। সি উইডস। কাক চক্ষু নীল জল।ওষুধে অবশ্য। টুপুর মন দিয়ে অক্টোপাসটা দেখছিল। ঈশান সেক্রেটারিকে কিছু ডিক্টেট করছিলেন।সেক্রেটারি মেয়েটির নাম তন্দ্রা। মুখে মাস্ক আঁটা। কিন্তু বোঝা যায় তার চেহারা বেশ ধারালো।চোখ দুটো প্রখর।সরু করে ভ্রূ প্লাক করা। চওড়া কপাল টেনে চুল বাঁধার জন্য আরো প্রশস্ত দেখায়।ফর্সা।ফর্মাল স্কার্ট ও শার্ট পরাতে তাকে খুবই সপ্রতিভ দেখায়। ঈশানের চেম্বারটি বেশ বড়। তার এককোণে তন্দ্রার বসার জায়গা । কাউনসেলিং চলাকালীন সে বিভিন্ন নোট নিতে থাকে। মহিলা পেশেন্ট এলে অবশ্যই তাকে চেম্বারে থাকতে হয়।ঈশান এথিক্যালি এটা মেইনটেইন করেন।একবার এক পেশেন্ট খুব বাজে অ্যালিগেশন এনেছিল।অনেক ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে ঈশান সে ঝামেলার নিষ্পত্তি করেছেন। এমনকী পলিটিক্যাল কানেকশনও ।


    ঈশান হ্যাজ বিকাম কশাস অ্যান্ড কেয়ারফুল আফটার দ্যাট।যে কোনো মহিলা পেশেন্ট এলে তন্দ্রা এক মিনিটের জন্যেও বাইরে যায় না।


    তন্দ্রা টুপুরের মুখের দিকে তাকিয়ে একটু হাসল , যদিও মাস্কের নিচে মুখ ব্যাদান বোঝা কষ্ট। টুপুর চেম্বারে ঢুকেই মাস্ক খুলে ফেলে। আজ সে পরেছে একটা ব্রাউন টপ আর ঘন নীল লং স্কার্ট।কানে ঝোলা দুল।


    - রক্তিমের স্বভাব জানেন, খানিকটা অক্টোপাসের মত। আষ্টেপিষ্টে শুঁড়গুলো দিয়ে চেপে ধরে।দমবন্ধ আপনি অক্টোপুসি দেখেছেন?


    ঈশান রোগিণীর বিভিন্ন রেঞ্জের বোলিং প্যাটার্ণে অভ্যস্ত হয়েছেন।বাড়ির গোটা একতলা জুড়ে তাঁর চেম্বার। অ্যান্টিক চেয়ারের পাশে ছোট টিপয় ইত্যাদি তাঁর ঠাকুরদার আমলের নিলামে কেনা।দোতলায় তাঁর পারিবারিক বসবাস। মনস্তত্তবিদ হিসেবে বেশ নামডাক হয়েছে।অনেক নামজাদা টিভি চ্যানেলে তাঁকে পরামর্শ দিতে ডাকা হয়। বিষন্ন, অবসাদগ্রস্ত, ছিটিয়াল, সেয়ানা, বদমাশ বিভিন্ন প্রকৃতির রোগী নিয়ে কাজ করে তাঁর অভ্যেস আছে । নতুন পেশেন্টটি গোটা চারেক সিটিং নিয়েছে। আনপ্রেডিক্টিবিলিটি যাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাদের বেশি গুরুত্ব দিলে তারা পেয়ে বসে। ঈশান সেভাবেই কেস হ্যান্ডেল করছেন। তন্দ্রা রেগুলার নোট নিয়ে যাচ্ছে।


    - আমি জিরো জিরো সেভেনের ভক্ত নই।


    - ও। আই থট ইউ লাইক রজার মুর। 


    - কেন? আগে ভাগে এরকম ভেবে বসলেন কেন? ঈশান পুরোনো কথাবার্তাগুলোর'নোট স্ক্রোল করে দেখে নিচ্ছিলেন ।


    - আপনাকে দেখে মনে হল , মানে দ্যাট টাইপ।শ্যন কনোরি অ্যান্ড অল দ্যাট। আপনার পছন্দ।


    - আমাকে নিয়ে অত ভাববেন না। এর মধ্যে রক্তিম ফোন করেছিল?


    বাদুড় থরথর করে কাঁপল। সাপ হিসহিস করল।


    - করেছিল । শালা।বাস্টার্ড। 


    - কেন? এত রাগ কেন? 


    - বলছে আমি নাকি রিলিফের নামে ফুর্তি করছি। আমি নাকি টিমের ছেলেদের সঙ্গে রাত কাটাচ্ছি ।


    - বাহ্।গুড। এতে তো আপনার সুবিধাই হল।


    - ওয়াট ডু ইউ মিন?


    - সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে সুবিধে হবে না এতে?


    মাথা নাড়ল। কাঁধ পর্যন্ত ঝোলা দুল নেচে উঠল। 


    - এটাই তো সমস্যা। প্রচন্ড রাগ হচ্ছে ।গো টু হেল বলছি। কিন্তু বেরোতে পারছি না।মাইন্ডসেট।আবার ঠিক ঘুরে ফিরে ফোনের জন্য ওয়েট করছি আই রিগ্রেট দ্যাট হি হ্যাজ বিকাম আ হ্যাবিট।


    - অ্যান্ড হ্যাবিট ইজ ডেথ! 


    - বাহ্ ।আপনি বেকেট পড়েছেন!


    ডাক্তার কিছু না বলে উজ্জল চোখে পেশেন্টের দিকে তাকিয়ে থাকলেন।


    - কী জানেন তো।মারছে না।কিন্তু মিলছেও না।আমার বন্ধু বান্ধব, দাদা এরা অন্যরকম।রক্তিম হল গা বাঁচানো পার্টি। কাওয়ার্ড। সব ঝোল নিজের কোলে টেনে সরকারের ওপর সব দায় চাপিয়ে বসে থাকবে।


    - মানুষ তো আলাদা আলাদা হবেই নৈঋতা। সবাই তো এক মোল্ডে তৈরি নয়।


    - ওর মোল্ডটা আমার পোষাবে না।ইমপসিবল ।ন্যাস্টিলি সেল্ফ সেনটার্ড। 


    - আপনিও তাই । সবাই তাই। ভেবে দেখুন। আপনিও যা যা করছেন নিজের ইচ্ছেতে করছেন। অন্যের ইচ্ছেতে না। রক্তিম ইজ প্রোটেকটিভ অ্যাবাউট ইউ ইন হিজ ওন ওয়ে।


    - আপনি কী রক্তিমের সালিশি করতে বসেছেন? তাহলে আমি আসি।


    - আমি কম্প্রিহেনসিভ হতে বলছি।যাতে পরে আফশোস না হয়। 


    - হবে না। শুধু নিজের কনফ্লিক্টগুলো কাটানোর জন্য আপনার কাছে আসছি পয়সা খরচ করে।মাই পেরেন্টস ডু নট নো অ্যাবাউট ইট।নিজের কষ্ট তো ওভারকাম করতে হবে।


    ঈশান প্রথমদিনেই খেয়াল করেছেন। আজ প্রশ্ন।


    - হাতে এত কাটাকুটির দাগ কেন? ইনজুরি?


    - এগুলো? পায়েও আছে। ঝড়ের দিন আমাদের গ্লাস ডোরটা ভেঙে গেছিল তো।আমি আর বাবা হোল্ড করে রাখার চেষ্টা করছিলাম। 


    - ব্যথা আছে নিশ্চয়ই? খুব।


    - প্রথমে ভীষণ যন্ত্রণা ছিল।কমেছে। হিলিং।


    - মনের যন্ত্রণাও কমে যায় ।প্রথমে তীব্র থাকে।তারপর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কমে যায় ।


    - এগুলো বুকিশ নলেজ । মনের কষ্ট যায় না।ইউ অলসো নো দ্যাট ।


    ঈশান একটু উদাস বোধ করলেন।মেয়েটা বড্ড বুদ্ধি রাখে।


    - একটা ভাইরাস কত ফ্লেক্সিবল দেখুন ।কতবার মিউটেইট করছে।মানুষ পাল্টায় না।শালা।একরকম চিন্তাভাবনা নিয়ে জন্মায় ।ঐ নিয়েই মরে


    - আপনি তো ওর কাছের মানুষ।পাল্টানোর চেষ্টা করে দেখেছেন কখনো?


    - হাতিকে জাঙ্গিয়া পরানো যায় না।


    ডাক্তার আবার হাসি চাপলেন।


    - এই যে আমার মা।করোনার ভ্যাকসিন ম্যাজিকের মত এসে যাবে ভাবে। আরো অনেকেই ভাবে। কেন এরকম ইনসিপিড চিন্তা করে বলুন তো?একটু র্যাশনাল হলেই তো ব্যাপারটা বোঝা যায়!


    পকেট হাতড়াচ্ছে।সিগারেট খুঁজছে যেন।


    - আপনার গার্লফ্রেন্ড আছে?


    - ডাক্তারের পার্সোনাল লাইফ ডিজক্লোজড হয় না।


    - মনে হয় নেই।


    ডাক্তার হাসি চাপেন।


    - কেন? মুখে লেখা আছে?


    - ইওর' ফেস শোজ। ইউ নেভার ওয়েন্ট থ্রু স্টর্মি সিচুয়েশনস। কমপ্লিকেটেড সম্পর্কের মধ্যে দিয়ে যাননি কখনো আপনি।আমি নরকে আছি।


    - নরকদর্শন ভালো।অনেক কাজে দেয়। আর আপনি তো জ্ঞানপাপী।


    - একটা সিগারেট খাব?


    - নাহ্।নট অ্যালাউড ইন চেম্বার।


    - বাইরে থেকে খেয়ে আসি।খুব টেনশন হচ্ছে।


    - পরের পেশেন্ট বসে আছেন। আপনি বাইরে সিগারেট খেতে গেলে আমি কী করব?


    - আমার কথা ভাবতে পারেন।


    উঠে সোজা বেরিয়ে গেল। দরজা টানার সময় বলল, পাঁচ মিনিট। আসছি।টয়লেট গেলেও পাঁচ মিনিট লাগতো। ভাবুন।কেস স্টাডি হিসেবেই ভাবুন নাহয়!


    তন্দ্রা খুব মন দিয়ে ফাইল কপি করতে করতে মুচকি হাসল।


    শ্যামা মালবিকার চুল শ্যাম্পু করে কালার করে দিয়েছে।তারপর আবার শ্যাম্পু। হাত পায়ের নখ নিজেই কেটেছেন । শ্যামা বলল, একটু নেলপালিশ লাগাও?


    তাতে রাজি হননি।এরা কী ভাবছে তিনি পাগল হয়ে গেছেন? সেটা তো আদৌ নয়। ভেতর থেকে একটা অদ্ভূত বিষন্নতা কাজ করছে।সবকিছু অর্থহীন মনে হচ্ছে। মানে উদ্যম পাচ্ছেন না।এই কিছুদিন আগেও যে লাফিয়ে লাফিয়ে এটা ওটা করতেন, শ্যামাও ছিল না তখন, এখন সেই জোরটাই যেন নেই।কিছু ভালো লাগছে না।নইলে ত্রিদিবের ব্যাপার তো নতুন কিছু নয়।অনেকটাই ওভারলুক করেন।কিন্তু এখন সব কিছু তেতো লাগছে।এটাই সমস্যা । বন্ধুরা ফোন করলেও বিরক্ত লাগছে।সেই এক কথা।একই কথা।লকডাউন কবে উঠবে।ভাইরাস কবে যাবে। কবে ভ্যাকসিন আসবে। বিগ বাসকেটে কী কী পাওয়া যাচ্ছে। 


    শ্যামার বাড়ি ঝড়ে পড়ে গেছে।সব জিনিসপত্র শেষ।বুঝতে পারছেন যে প্রচন্ড ক্রাইসিসে আছে ও। কিন্তু কিছু করার মত মনের জোর পাচ্ছেন না।ক্রমাগত একটা অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছেন যেন। ডাক্তার ছেলেটি বেশ ভালো। খুব সুন্দর কথাবার্তা ।ওষুধও দেয়নি বেশি।যতক্ষণ ওর সঙ্গে কথা বলেন, ভালোই লাগে। তারপর আবার অবসাদ ফিরে আসে। ছাতে গিয়ে দেখলেন সব গাছ শেষ। কিছু ফিল করলেন না।এসব গাছ তাঁর হাতেই লাগানো। কত যত্নে তৈরি সব।খুব কষ্ট হবার কথা কিন্তু হচ্ছে না।ব্ল্যাংক লাগছে। 


    বাবু ফোন করেছিল। বারবার বলছে, মা থিংক পজিটিভ থিংক পজিটিভ ।


    মালবিকা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেন না যে থিংক পজিটিভ মানে কী। যা হবার, যেটা খারাপ হবার , সেটা তো হবেই। কেউ আটকাতে পারবে না সো হোয়াটস দ্য' পয়েন্ট ইন থিংকিং? 


    এই যে মেয়েটা এত বাইরে যাচ্ছে কোভিড সিচুয়েশনে, দেরি করে ফেরে, একআধদিন ফেরেই না, আগে হলে মালবিকা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় করতেন। তুমুল চেঁচামেচি হত। এখন কোনোকিছুই বলছেন না। বরং মেয়ে বলে বেরোচ্ছে।বা ফিরে ঘরে এসে বলে যাচ্ছে যে ফিরলাম মালবিকা মাথা ঝাঁকাচ্ছেন। ভেতর থেকে কোনো শব্দ উঠে আসছে না। 


    বাবুর বন্ধুর মা ফোন করেছিলেন আবার।কী যেন মেয়েটির নাম? অদ্রিজা না অদিতি? বেশ ভালো মহিলা।সফ্ট স্পোকেন। আগ বাড়িয়ে বেশি কথা বলেন না। আবার যখন টুকটাক বলেন , তখন শুনতে ভালো লাগে।ওঁকে আবার আসতে বলেছেন। বাবু ওদের বাড়িতে যায় । ওঁর সঙ্গে কথা বললে বাবুর গন্ধ পাওয়া যায় । 


    ডাক্তার বলেছে বই পড়তে।বই পড়ার নেশা তো ছিল।এখন তেমন করে কনসেনট্রেট করতে পারছেন না।পড়ছেন দু একপাতা। আবার রেখে দিচ্ছেন। শ্যামা খবরের কাগজ আর চা দিয়ে গেল। সকালে খবরের কাগজ ত্রিদিবের জিম্মাতে থাকে। আর মালবিকা তো এখন ঘুমাচ্ছেন অনেকক্ষণ । বশির ছেলেটা আসে কিনা মাছ দিতে কে জানে। শ্যামাকে জিজ্ঞেস করতে হবে।


    আদা আর গোলমরিচ দিয়ে চা করেছে শ্যামা। চুমুক দিয়ে কাগজ খুললেন মালবিকা।সবসময় এই দলাকচড়া কাগজই পড়তে হয় তাঁর। ফ্রেশ পান না।একসময় নতুন কাগজের পাতা খোলার নেশা ছিল।


    কাগজের প্রথম পাতায় হেডলাইন।


    সুশান্ত সিং রাজপুত কমিটেড সুইসাইড ইন হিজ মুম্বাই অ্যাপার্টমেন্ট । 


    মালবিকা চা খেতে খেতে ভাবছিলেন, কে ছেলেটা! কোনো ছবিতে দেখেছেন? মনে করতে পারছিলেন না। 


    টুপুর হয়তো বলতে পারবে।কে জানে!আহারে। কীই বা বয়েস।কাগজে ছবি দিয়েছে।ফুটফুটে ছেলেটা আত্মহত্যা করল! 


    তলার দিকে একটা ছোট খবর ছিল। আসামে ষোলোজন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন। কিন্তু ছোট খবর আর অত কার নজরে পড়ে! (চলছে)


    #করোনাকালীন (দুই)


    বাইশ


    ছোট টেবিলে একটা সাদা ধবধবে টেবিলক্লথ পাতা হয়েছে। মাঝখানে মস্ত মোমবাতি । ফ্যান বন্ধ করে এসি চালানো হয়েছে যাতে মোমবাতি নিভে না যায়। দেবরূপ তাই একটা হাল্কা জাম্পার পরে নিয়েছে। অদিতিই দিয়েছিল এই হালকা হলুদ রঙের জাম্পারটা বছর দুয়েক আগে।খুব সফ্ট।দেবরূপের পছন্দের রঙ। জানালা সব বন্ধ।অদিতি তাই পর্দা টেনে দিয়েছে।বেশ কিছু ফয়েলে মোড়া খাবার, ক্যাসারোল ছড়ানো কিচেন টেবিলের ওপর।জলের নতুন গ্লাস।রেড ওয়াইনের বোতলও আছে।রিভাটা কাসা রোসা।অদিতি ওয়াইন গ্লাসগুলো মুছে মুছে রাখছিলো।ফুলদানিতে গ্ল্যাডি। একটা ছোট সাইজের ব্ল্যাক ফরেস্ট কেক।দেবরূপ খুব মুগ্ধ দৃষ্টিতে সব কিছু দেখছে।এমনকি অদিতিকেও। এই সব অ্যারেন্জমেন্ট তার জন্যেই।অদিতি হঠাৎ সকালে ফোন করে বলেছে , আজ একটা ছোট্ট গেট ওয়েল পার্টি হবে।দেবরূপকে কিছুই করতে হয়নি। অদিতি তো আমাজন নারী । সে সমস্ত ব্যবস্থা করেছে। এই ব্যাপারে সে তার ছবি তৈরির মত মেটিকুলাস।সব ঠিকঠাক চাই।দেবরূপের মনে হয় এই একটা জায়গায় মালবিকার সঙ্গে অদিতির মিল আছে।অদিতিকে বললেই বলবে , মাদার ফিক্সেশন। বেডকাভার পাল্টে একটা ফ্লাওয়ারি প্রিন্টের চাদর পাতা হয়েছে। ঘরটা ঝলমল করছে তাতে। বাড়ির বাগান থেকে গ্ল্যাডিওলাস আর লিলি নিয়ে এসেছে।সেগুলি পুরোনো ওয়াইনের বোতলে, যাতে অদিতির হাতের কারুকার্য তাতে শোভা পাচ্ছে।


    ফ্রিডা কাহলোর মুখ আঁকা গ্লাসডোরটা ঝকঝকে করে মুছেছে কলিনস দিয়ে ।মোমবাতির আলোতে ঝকঝকে লাগছে সেটা। দেবরূপের মনে হচ্ছিল কলকাতার বাড়িতে ভেঙে যাওয়া গ্লাস ডোরের কথা। কী সাংঘাতিক সব কান্ড ঘটে গেছে! অথচ বাড়ি যাবার উপায় নেই। 


    কিন্তু আজকে কোনো নেগেটিভ থট নয়।অদিতি আগেই বলে রেখেছে। লেট আস সেলিব্রেট ইওর রিকভারি । হাল্কা মিউজিক চলছে সিস্টেমে। অদিতির হাঁটাচলাতে নাচ। রোজকার মত জিনস নয়। একটা ফ্লোয়িং স্কার্ট আর অফফ শোল্ডার টপ পরেছে। চুলটাও রোজকার মত টেনে বাঁধেনি।খোলা চুল।ওকে একদম পিক্সিদের মত দেখাচ্ছে। ভীষণ অ্যাট্রাকটিভ ।দীর্ঘ, দীর্ঘদিন বাদে দেবরূপ অদিতির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে আবার। ভেতরে উত্তেজনা কাজ করছে টগবগ করে। নিজে নিজের পিঠ চাপড়ে মনে মনে বলছে, দিস ইজ পজিটিভিটি। অদিতি ওর চেয়ারটাকে এক পাক ঘুরে টুক করে নাকে একটা চুমু খেয়ে গেল। দিস ইজ গোইং টু বি আ মেমোরেবল ইভনিং। যাস্ট পারফেক্ট । ডিনারে সসেজেস আছে। গার্লিক চিকেন।কিছুটা পর্ক। স্যান্ডউইচেস। রাশিয়ান স্যালাড । বিরিয়ানি। যে যেটা ভালোবাসে তাই খাবে। অদিতি ব্রাউন পেপার প্যাকেট থেকে স্যান্ডউইচ বের করতে করতে ঘড়ি দেখলো।


    দেবরূপ টেবিলে বসে গেছে। প্লেট নিয়েছে।


    - ইটস এইট থার্টি। চল খেতে দে। আই অ্যাম হাংরি। হোমমেড ক্যান্ডল লাইট ডিনার ফলোড বাই মুনলিট লাভমেকিং । জানালা খুলে দেখিস চাঁদ উঠেছে।


    অদিতি একটা প্লেটে ফ্রায়েড রাইস রাখছে ।পনির টিক্কা মশালা। 


    - করেছিস কী? এত কেন? এগুলো কে খাবে? ভেজ ডিশ আবার কেন করলে? 


    অদিতি চুলগুলো একটা ব্যাক ক্লিপ দিয়ে আটকাচ্ছে।


    - বি রিজনেবল। নিশান্ত আসবে তো।ওকে বলেছি। ও তো আর নন ভেজ খাবে না! 


    একটা পর্কের টুকরো মুখে ফেলেছিল দেবরূপ।


    পুরো বিস্বাদ লাগলো। বেসিনে গিয়ে ফেলে দিল থু থু করে।জল খেল খানিকটা। দরজা খুলে সোজা ব্যালকনি।


    - ওয়াঅট আর ইউ ডুইং দেব? এসি চালানো। অ্যান্ড ইউ ওপেন দ্য ডোর। কাম ইন।


    ও গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়ে ।নিচে অন্ধকার রাস্তা ।দু একটা বাইক ভীষণ স্পিডে বেরিয়ে যাচ্ছে। অদিতি পাশে গিয়ে দাঁড়াল।


    - ওয়াটস রঙ? এরকম করছিস কেন? 


    - ইউ নো দ্যাট প্রেটি ওয়েল। 


    - স্টপ বিইং চাইল্ডিশ। শোন। তোর পুরো ট্রিটমেন্টটা নিশান্ত একা হ্যান্ডল করেছে। অ্যাট হিজ ওন রিস্ক। অ্যান্ড হি ডিড ইট ওয়েল। সো পার্টিকুলার। হসপিটাল ডিউটির ফাঁকে দুবেলা এসেছে। আর ওকে বাদ দিয়ে আমরা দুজনে পার্টি করে নেব? 


    অনেকক্ষণ চুপ। তারপর বলল


    - আই থট ইট ওয়জ অল আওয়ার্স।


    - তাই তো। ইট ইজ অল আওয়ার্স। অ্যান্ড উই আর গ্রেটফুল টু দ্য ডক হু সেভড ইওর লাইফ। 


    - এনিবডি কুড হ্যাভ ডান দ্যাট।


    এবার ভীষণ রেগেছে অদিতি।চুল বাঁধছে শক্ত করে।


    - নাউ ইউ আর আনগ্রেটফুল। বাজে বকছিস।


    - ইয়েস আই অ্যাম। আমি চেয়েছিলাম আজ সন্ধেটা আমাদের দুজনের হবে। ওনলি টু অফ আস। তুই তার মধ্যে নিশান্তকে ডাকলি। ডিড ইউ কনসাল্ট মি? ইটস মাই প্লেস আফটার অল। তোর ইচ্ছে হলে ওকে বাইরে কোথাও এনটারটেইন কর!


    অদিতি অবাক হয়ে দেবরূপের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল।এই মানুষটাকে সে ভালোবেসেছিল?


    কী অনায়াসে বলল, মাই প্লেস! দিস ইজ মেল ইগো। অ্যাবোমিনেবল।


    - নো।আই ডিডন্ট। আই থট ইট ওয়জ পারফেক্ট।


    আমি ভাবিনি তুই এইভাবে রিঅ্যাক্ট করবি! ইউ আর মিন! এনি ওয়ে।এটা তোর ফ্ল্যাট ।আই অ্যাম সরি।অ্যান্ড ইউ আর ন্যাস্টি।


    একদৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকল দেবরূপ। তারপর কেটে কেটে বলল, ইয়েস ।আই অ্যাম। মে বি ইওর' ডক ইজ সুপারডক। কিন্তু আমি আজ অন্যরকম একটা সন্ধে চেয়েছিলাম। ইউ কুড হ্যাভ টোল্ড মি দ্যাট ইউ হ্যাভ ইনভাইটেড হিম। 


    এবার অদিতির কান্না পেল। কিন্তু সেটা সে প্রকাশ করতে চায় না।সোজা ঢুকে গেল ওয়াশরুমে। কাঁদবে অঝোরে। 


    পায়ে চপ্পল গলিয়ে, মাস্ক হাতে নিয়ে দেবরূপ দরজা খুলে লিফ্টে নিচে নামল। খোলা আকাশ চাই হাঁটবে।একলা।দম আটকে যাচ্ছে।


    দুমিনিট পর ড. নিশান্ত ঠাকরে ঘরে ঢুকে দেখল অদিতি বা দেবরূপ কেউ নেই।নো হোস্ট। টেবিলে একা একা জ্বলে যাচ্ছে মোমবাতি। স্তূপীকৃত খাদ্যবস্তু। এসি চলছে মৃদুমন্দ।


    নিশান্ত প্রচন্ড ক্ষুধার্ত ।হসপিটালে ভীষণ চাপ যাচ্ছে। কোনোমতে বাড়িতে গিয়ে স্নান করে পার্টি অ্যাটেন্ড করতে এসেছে। এখানে ফর্মাল হবার কোনো মানে নেই।প্লেটে ফ্রায়েডরাইস আছে।পনির টিক্কা নিয়ে সে প্লেটসহ বাইরে গিয়ে দাঁড়াল ব্যালকনিতে।


    মোমবাতি জ্বলে জ্বলে ছোট হয়ে গেছে।এসি বন্ধ করে জানালা খুলে দেওয়া হয়েছে। ফ্যান চলছে । কিচেন টেবিলে বেশ কিছু খাবার পড়ে আছে এখনো।টেবিলে প্লেট। ভালো করে খায়নি কেউই। একমাত্র নিশান্ত মন দিয়ে খেতে গেছে।সে স্বল্পাহারি।নিরামিশাষী।দেবরূপ ফিরে এসে নিশান্তকে জড়িয়ে ধরে গ্রিট করেছে। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে অদিতি দেখছে নিশান্ত ও দেবরূপ দুজনেই খেতে বসে গেছে। খুব মন দিয়ে খাচ্ছে এবং কোভিড সিচুয়েশন নিয়ে কথা বলে যাচ্ছে ওরা। মনেই হবে না দেবরূপ এত ঈর্ষা উদ্গীরণ করে গেছে নিশান্তের বিরুদ্ধে এই একটু আগে।এত অ্যাবসর্বড যেন ঘরে আর কেউ নেই।নিশান্ত অবশ্য' খাওয়া থামিয়ে হাই, ফ্যানটাসটিক ফুড হাবিজাবি বলে নিল। 


    ডিনার , গল্প শেষ করতে করতে দশটা বেজে গেছিল। নিশান্ত জিজ্ঞেস করেছিল অদিতিকে বাড়িতে লিফ্ট দেবে কিনা। অদিতি মাথা নেড়ে না বলেছে। গুড নাইট জানিয়ে নিশান্ত চলে যাবার পর দুজনের মধ্যে কথা হয়নি একটিও। অদিতি বাড়িতে বলে এসেছে আজ ফিরবে না। ফিরলে এক্সপ্ল্যানেশন দিতে হবে না।কিন্তু অকওয়ার্ড লাগবে। 


    দেবরূপ চিৎ হয়ে শুয়ে আছে বিছানাতে। একটা হাল্কা চাদর গায়ে । 


    অদিতি একটা চেয়ারে আধাশোয়া।


    রাত দুটো নাগাদ উঠে প্লেট তুললো। আধ খাওয়া চিকেনের টুকরো, সসেজ। ভাতের লেফ্ট ওভার। একটা বড় ব্রাউনপেপারের ব্যাগে ঢেলে নামিয়ে দিল ট্র্যাশবিনে। প্লেট ধুচ্ছে সিংকে। খুব আস্তে কলটা ছেড়েছে। যাতে জলের শব্দ কম হয়। এখানে থেকে গেলে সবসময় দেবরূপের পাজামা আর টি পরে নেয় ও। আজ চেঞ্জ করেনি। 


    দেবরূপ পাশ ফিরে শুল। কতদিন আউটডোর লাইফ নেই।সব যেন বদ্ধ।স্ট্যাগন্যান্ট ।


    শিবাজিনগরে লিটল ইটালি রেসটাওরান্ট ওদের খুব পছন্দ । কতদিন সেখানে গিয়ে মুখোমুখি বসা নেই।মাঝে মাঝে সাউথ ইন্ডিয়ান খাওয়াতে অদিতি ওকে সব্য রসাতে নিয়ে যায়।অথবা অ্যাটমসফিয়ার সিক্স। শুধু ওরা দুজন। কখনো কখনো মকরন্দ বা অতুল আর ওর গার্লফ্রেন্ড মোহিণীও যায় । তবে ওদের সবচেয়ে পছন্দ দোরাবজি অ্যান্ড সনস। পুরোনো রেস্তঁরা ।চারপ্রজন্ম ধরে এখানে দোরাবজিরা ব্যবসা করছেন।সেই মান্ধাতার আমলের ফরমাইকা বসানো টেবিল।প্ল্যাস্টিকের চেয়ার। দম বিরিয়ানি।মাটন পায়া।এই দোরাবজিতে মুখোমুখি বসেই ওরা একসঙ্গে ভবিষ্যত কাটানোর ডিসিশন নিয়েছিল।আজ নিশান্ত বলল সিনিয়র'দোরাবজি কোভিডে ভেন্টিলেশনে আছেন।ফেরার সম্ভাবনা নেই।ওদের দেখলেই হাত নাড়িয়ে একগাল হাসতেন ভদ্রলোক। এসব যেন গতজন্মের কথা! ওরা দুজনেই ফুডি। নানারকম খাবার খাওয়া, বানানো ওদের প্যাশন। আর খাবার তো শুধু খাবার নয়, একটা সংস্কৃতি। রসায়ন । আস্তে আস্তে ফুড কেমিস্ট্রির সঙ্গে মিশে গেল ওদের নিজস্ব রসায়ন ।


    অদিতি ভাবছিল সে কী করবে।দেবরূপকে এরকম জেলাস সে কখনো দেখেনি। অদিতি ফিল্মের কাজে এত ছেলেদের সঙ্গে মেশে।ওর ক্লাসমেটস, 'সিনেমাফটোগ্রাফার, টেকনিশিয়ানস। ইনস্টিটিউটের হাজারটা লোক। প্রেসের লোক।


    একসঙ্গে কাজে বেরিয়ে যায় সাত দশ দিনের জন্য। দেবরূপ হ্যাড অলওয়েজ বিন সো সাপোর্টিভ। 


    বাসন ধুয়ে আবার সোফাতে আধ শোয়া হল অদিতি।দি ইভনিং ওয়েন্ট রং।টোট্যালি। অথচ নিশান্তকে না ডাকলে সেটা ভীষণ অভদ্রতা হত।এটা তো দেবরূপের বোঝা উচিত ছিল! এত ইডিওটিক কেন!


    মাথার ওপর একটা হাত। দেবরূপ বলল, ঘুমাবি চল। কান্নায় গলা বুজে এল অদিতির।সত্যি সকাল থেকে দৈত্যের মত পরিশ্রম করেছে ও। নার্ভ একটা লিমিট পর্যন্ত সহ্য করে। তারপর ভেঙে পড়ে। অদিতি হাতটা কপালে চেপে ধরলো। 


    চাঁদের আলো সবসময় ঘরে ঢোকে না।কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না । এদের প্রেম এখনো ক্লান্তিকর সহাবস্থানে পুরোনো হয়নি। হয়তো হবেও না কখনো। প্রেমের বহুবর্ণে কখনো ঔদার্য, কখনো নীচতা, কখনো আত্মত্যাগ কখনো চরম স্বার্থপরতা , কখনো আকণ্ঠ ভালোবাসা কখনো তীব্র ঘৃণা , সব কাদামাটি খেলে।যে যাকে পারে তাকে ছোঁয়। কোভিডের দৌরাত্মির পর ওরা আজ সেই বহুবর্ণ সমুদ্রে ভাসতে শুরু করল। দেবরূপ দেখল , এই অদিতির শেষ নেই। সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো উথালপাতাল তার গতিময়তায় দেবরূপ অত্যাশ্চার্য। যেন অদিতিকে নতুন করে আবিষ্কার করছে। আর অদিতি প্রতিটি তরঙ্গের ওঠানামাতে যেন নির্মাণ করছে কোনো নতুন দেবরূপকে। পুণের এই ছোট্ট ফ্ল্যাট, নরম পর্দার উড়ান, ফুলছাপ বিছানার চাদর , এক অসম্পূর্ণ নৈশভোজ এমনি এক আশ্চর্য ভালোবাসাবাসির সাক্ষী হয়ে রইল।


    ভারি নির্মল একটা সকালে ঘুম ভাঙল তাদের। নিশ্চিন্ত। ভারহীন। বাড়িতে ফোন করতে হবে দুজনকেই। দেবরূপ ব্যালকনি থেকে কাগজ নিয়ে অদিতির হাতে দিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল।শুয়ে শুয়েই কাগজের ভাঁজ খুললো অদিতি।তারপরেই চিৎকার । 


    দেবরূপ ওয়াশরুম থেকেই জিজ্ঞেস করলো


    - কীরে! বাঘ এসেছে?


    - ও নো! দেব! দ্যাট সোনচিড়িয়া বয়, সুশান্ত সিং রাজপুত হ্যাজ কমিটেড সুইসাইড! ( চলছে)


    # করোনাকালীন (দুই)


    তেইশ


    মুমতাজ সকালে উঠে নাজমার ফ্ল্যাটের বারান্দাতে বসেছিলেন।পার্ক স্ট্রিটের এই ফ্ল্যাট বহু পুরোনো। বাইরে থেকে কোনো চকচকে ব্যাপার নেই।কিন্তু ভেতরে মার্বেল খচিত মেঝেতে সব অত্যাধুনিক গ্যাজেটস, গৃহশয্যা ইত্যাদি। কিছু বাঙালি ছাড়াও পাঞ্জাবী, গুজরাতি ও পার্শি পরিবার থাকেন এখানে।


    নাজমা ও আমজাদ ইনটিরিওর ডেকোরেটরকে দিয়ে বাড়ি সাজিয়েছেন। কিন্তু এই ব্যাপারটা মুমতাজের ঠিক ভালো লাগে না।মানে বেশির ভাগ ইনটিরিয়র ডেকোরেটর খুব আধুনিক নিয়ম মেনে এত কৃত্রিম একটা পরিবেশ তৈরি করে যে কালার স্কিম বা ডিজাইন ঠিক থাকে, পারফেক্ট প্ল্যানিং কিন্তু মুমতাজের মনে হয়, প্রাণ থাকে না।ভীষণ ফর্মুলেটেড। তিনি একটু নিজে হাতে কাজ করা পছন্দ করেন।কলকাতায় এসেছিলেন ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে কিছু কাজ করতে । সেই কাজ শুরু করতে না করতেই লকডাউন ।সাবিত্রী বাই ফুলের ওপর যে বইটি লেখার দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি , তার মেটিরিয়াল, রেফারেন্স ইত্যাদি দরকার।সব কাজই বন্ধ। খুব ছোটবেলাতে থেকেই যখনি মুর্শিদাবাদ এসেছেন, আম্মীর সঙ্গে কলকাতায় ছুটি কাটিয়েছেন। এবার এই অর্ধমৃত শহরকে দেখে ভীষণ বিষন্ন লাগছে। তাও অনেক লোকের মুখে মাস্ক নেই।দিব্যি ঘুরছে।


    নাজমা অবশ্য ভীষণ খুশি মুমতাজ আটকে যাওয়াতে। ছেলেরা বাইরে , বর ব্যস্ত।নাজমা একেবারে একা।মুমতাজ আসাতে তিনি হাঁপ ছেড়ে বেচেছেন।মুমতাজ মোড়া পেতে বসে বসে দেখছিলেন। কী ফাঁকা রাস্তা! এই রাস্তা লোকে গমগম করে। বারান্দায় যেখানে বসে আছেন সেখান থেকে দেখা যায় একটি লোক শসা বিক্রি করে।আর কাঁচা পেয়ারা। নুন মাখিয়ে খবরের কাগজে দেয়।তার একটু দুরে দাঁড়িয়ে বিক্রি করে বাদাম। কাঁচা ছোলা। পানের দোকানটার ঠিক পাশেই।সব।সব বন্ধ ।এই লোকগুলো কী করে দিন গুজরান করছে কে জানে! 


    অন্যান্য বার কলকাতায় এলে তিনি আর নাজমা টানা রিক্সাতে নিউমার্কেট চলে যান।যদিও হাতে টানা রিক্সা খুব অমানবিক তবু কলকাতার কিছু কিছু এলাকাতে টুং টাং ঘন্টা বাজিয়ে টানা রিক্সা চলে । সে লোকগুলো এই লকডাউনে কী করছে কে জানে। দুই বন্ধু হগমার্কেট দিয়ে ঢুকে যান।প্রথমেই সোজা নাহুমসে গিয়ে কুকিজ কিনে ফেলেন । মাছের প্যাটিটা খেতেই হবে। কেক নিয়ে নেন বড়সড় দেখে।তারপর দুই বন্ধু মিলে নিউমার্কেট চষে ফেলেন ।নাইটি থেকে শুরু করে চিকণের কাজ করা চুড়িদার পিস, ড্রাই ফ্রুট, চিনে দোকানের জুতো সব কিনেকেটে, আমিনিয়াতে খেয়ে বাড়িতে ফেরেন ।এইবার সেই নিউমার্কেট খাঁখাঁ করছে ।রাস্তার হকাররা নেই। এদের সব দিন চলছে কী করে  সেই বা কে জানে।কত লোক সবজি বিক্রি করছে এখন।তারা আগে কখনো সবজি বেচেনি।শিক্ষিত ছেলেরাও সবজি বেচছে এ পাড়াতে। বাচ্চাগুলো পর্যন্ত বাইরে বেরোতে পারছে না। এগারোটা থেকে মুমতাজ অনলাইন ক্লাস নেবেন। ইউ জি সি গাইড লাইন ফলো করে টেস্টগুলো হয়ে চলেছে। কিন্তু তার আগে অনেক কাজ বাকি। বাড়িতে ফোন করতে হবে। অচ্যুত আর দুই মেয়ের সঙ্গে সকালে একবার , বিকেলে একবার নিয়মিত কথা না বললে শান্তি পান না। গতকাল মালবিকার বাড়িতে গিয়ে খুব খারাপ লাগেনি আবার খুব ভালোও লাগেনি।মহিলা এত ডিপ্রেশনে আছেন যে বাড়ির পরিবেশটা থমথমে হয়ে আছে। 


    ত্রিদিব বেশ কর্ডিয়াল। দেবরূপের বোনটিকেও বেশ ভালো লেগেছে মুমতাজের কিন্তু সব মিলিয়ে কোথায় একটা খুঁতখুঁতে ব্যাপার আছে। মনটা সায় দিচ্ছে না।হয়তো অদিতি দেবরূপ কেউ কলকাতায় থাকবে না আদৌ।তবু দেবরূপ একমাত্র ছেলে। এক ছেলের কাছে বাবা মায়ের অনেক প্রত্যাশা থাকে। মুমতাজ নিজের মেয়েকে চেনেন। সে খুব একটা লাইফ স্টাইল পাল্টানোর পাত্রী নয়। যাক গে। এখন এইসব ভেবে লাভ নেই। মালবিকার সুস্থ হয়ে ওঠা জরুরি।তারপর ভাবা যাবে। লকডাউন উঠে যাক।


    আপাতত মুমতাজ ফোনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। নাজমা ব্রেকফাস্ট টেবল সাজিয়ে ডাকাডাকি করছেন।আমজাদ বেরিয়ে যাবার আগে তিনজনে একসঙ্গে বসে ব্রেকফাস্ট করবেন।অচ্যুত ফোনে বাড়ির সব খুঁটিনাটি খবর দেন। বার্বি প্রচুর রান্নাবান্না করছে কিন্তু বাবল্স খুব একটা বাড়িতে থাকতে পারছে না।মুমতাজ বড় মেয়েকে নিয়ে একরকম টেনশন করেন।ছোটটাকে নিয়ে আরেকটা। এরকম টেনশন করতে করতেই পঞ্চাশ হয়ে গেল। অনেক ভেবে দেখেছেন, বছর কুড়ি বয়স অবধি টেনশন ফ্রি জীবন কাটিয়েছেন । অচ্যুতের সঙ্গে প্রেমটা যখন হয়েই গেল , তখন থেকে টেনশন শুরু হল। শ্বশুরবাড়ির কেউ বিয়ে মেনে নেয়নি। বাপের বাড়িতে প্রচুর ঝামেলা হয়েছে। সব ছেড়ে পুণে এসে বাসা বেঁধেছেন।তবু অনেকদিন মনের মধ্যে অশান্তি ছিল।কাউকে দুঃখ দিয়ে নিজে ভালো থাকা কঠিন কাজ।নিজের আব্বুজান একটু অসুস্থ হলে আম্মী এমন করে বলতেন যে মুমতাজের বিয়েটাই অসুস্থতার কারণ। আবার আম্মীর কিছু হলে তো আব্বু জানাতেনই না।প্রথমদিকে অভিমান এতটাই গুরুতর ছিল। অচ্যুতের বাড়িতেও এক অবস্থা।বিয়ের একবছর বাদেই অচ্যুতের'বাবা মারা গেলেন।সারা পরিবার বিয়েটাকে দুষল।অচ্যুতের মা অসুস্থ হলেন ।বিয়ের দোষ।এই ইমোশনাল ব্ল্যাকমেলিং একধরনের অপরাধ ।মুমতাজ এত সাফার করেছেন যে মেয়েকে আর ঐ ঝামেলাতে ফেলতে ইচ্ছে হয় না।কিন্তু কোনো উপায় তো নেই। 


    তাঁর নিজের ক্ষেত্রে অচ্যুত চিরকাল বিশাল ঢাল হয়েছিলেন। আশ্চর্য মানুষ।এত অনমনীয় নিজস্ব মতবাদের জায়গায় । মুমতাজের গায়ে এতটুকু আঁচ লাগতে দেননি।


    তিরুভানন্তপুরমে অচ্যুতের পৈত্রিক বাড়িতে কখনো যাননি মুমতাজ ।এ নিয়ে অচ্যুত কোনোদিন কোনো জোরজবরদস্তি করেননি। এটা অনিবার্য ছিল যে অচ্যুতের পরিবার মুমতাজকে গ্রহণ করতে পারবেন না।তাই নিয়ে অশান্তি করার কোনো মানেও নেই, অচ্যুত এটাই মনে করেছেন ।


    দেবরূপ অতটা পারবে বলে মুমতাজের মনে হয়না।ও ছেলে নরম ধাঁচের।যতবার এসেছে বাড়িতে, খুব ভালো করে ওকে স্টাডি করেছেন মুমতাজ। তাঁর সচরাচর মানুষ চিনতে ভুল হয়।


    নাজমা এবার বকছেন। টোস্ট মিইয়ে যাচ্ছে। মুমতাজ তাড়াতাড়ি অচ্যুতকে আপাতত ফোন রাখতে বলে ব্রেকফাস্ট নিতে গেলেন। এরা খুব ভারী জলখাবারের ব্যবস্থা করে। আজ নাজমা টোস্ট , অমলেটের সঙ্গে পাস্তাও রেখেছেন। দুধ । মুমতাজ একেবারেই দুধ খেতে পারেন না। আর ক্লাসের আগে ভরপেট খানও না। নাজমা বললেন


    - তোর টেনশন করা রোগ আর গেল না ।খা তো।বাড়িতে সব ঠিক থাকবে।


    মুমতাজ মাখন বা মার্জারিন অ্যাভয়েড করেন।দুটো শুকনো টোস্টের মধ্যে অমলেট ভরে কামড় দিলেন। দুধ খাবেন না।তাই ওঁর জন্য কফি।


    - হাউ ওয়ের সেনগুপ্তাজ?


    প্রশ্নটা আপাত নিরীহ।কিন্তু মুমতাজ সেন্স করলেন এর অনেক লেয়ারস আছে। বিশেষ কিছু বলা ঠিক হবে না। মাথা নেড়ে কাটিয়ে দিলেন। ফাইন।


    অদিতি আর দেবরূপের কথা কাউকেই বলেননি। নাজমা কিছুই জানেননা। কিন্তু লকডাউন যদি কনটিনিউ করে আর তাঁকে কলকাতাতে থাকতেই হয়, তাহলে আরো দু একবার ওদের বাড়িতে যেতে হবে।আরো কিছু কথাবার্তা ।আর একটু খোঁজখবর। সেটা বুদ্ধি করে ম্যানেজ করতে হবে।যাতে নাজমা টের না পান কিছু।এমনিতে খুব ভালো।মানে মুমতাজের অ্যাসাম্পশনে নাজমা বা মালবিকারা রেডি ব্রেবোর্ণ বা শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা করেন।ফলে একটা অভিজাত সংস্কৃতির ছোঁয়া তাঁদের মধ্যে থাকে।লিবারেল ছাপ থাকে।এমনিতে অবশ্যই এঁরা উদার'মনস্ক। শ্বশুর শাশুড়ি যেমনি হোক সেবা যত্ন করেন।নিজে করতে না পারলেও লোক রেখে দেন। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল বেশ জানেন। দুটো গেয়ে বা নেচেও দিতে পারেন। পোশাক নিয়ে কোনো রিজার্ভেশন নেই।সবেতেই স্বচ্ছন্দ। আড্ডা মারতে পারেন।বই ভালবাসেন।ঋতুপর্ণর ছবি অ্যানালিসিস করে দিতে পারেন।কিন্তু বিয়ের ব্যাপারে পাল্টি ঘর চাই। এই একটা ব্যাপারে এঁরা ট্র্যাডিশনাল, কনসারভেটিভ শব্দ ব্যবহার করতে ভালোবাসেন।রিচুয়ালস ভালোবাসেন।মুমতাজ কফির মাগটা টেনে নিলেন ।আমজাদ পুলিশি পোশাক পরেই খেতে বসেছেন।বাঁ হাতে খবরের কাগজ।মুখ দিয়ে একটা চুক চুক শব্দ করলেন।ইয়ে ক্যা হো রহা ভাই, আজকালকা বাচ্চোকো?


    নাজমা টোস্টে মাখন মাখাতে মাখাতে চোখ তুললেন ।ভ্রূ তে প্রশ্নবোধক চিহ্ন। 


    মুমতাজও তাকিয়েকেন কফির মাগের ওপর 


    আমজাদ কাগজ পড়তে পড়তে বললেন, উও যো এক হিরো থা না, সুশান্ত সিং।সুইসাইড করেছে! সাচ আ পিটি!


    মুমতাজের মনে পড়ল। ব্যোমকেশ দেখেছিলেন।মেয়েরাই দেখিয়েছিল।দুটো স্টোরি পাঞ্চ করে।আহা! সো স্যাড!এখনকার ছেলেপুলে বাপ মায়ের কথা ভাবেই না।শুধু নিজেরটুকু।


    নাজমা চলচ্চিত্রের তারকাদের সম্পর্কে প্রচন্ড কৌতূহলী ।তাড়াতাড়ি উঠে টেলিভিশন খুলে দিলেন।লিভিং রুমে বিশাল চুয়ান্ন ইন্চির এল ই ডি স্টিথিওফোনিক শব্দে বেজে উঠল। । সাদা পোশাক কালো চশমাতে শোভিত সিনে ও টিভি তারকারা এক এক করে একটি বহুতলে ঢুকছেন বেরোচ্ছেন। নাজমা প্রচন্ড এক্সাইটেড।ফলের রস নিয়ে টিভির সামনে বসে পড়েছেন।


    মুমতাজের ওদিকে আগ্রহ নেই।প্রচুর আত্মহত্যার খবর হচ্ছে লকডাউনে ।খুব বেদনাদায়ক কিন্তু আপাতত তাঁর মাথায় অন্য'চিন্তা। কবে বাড়িতে ফিরতে পারবেন বুঝতেই পারছেন না।দেবরূপের বাড়িতে গিয়ে তেমন স্বস্তিও পাননি।কাউকে কিছু বলতে পারছেন না।একমাত্র অচ্যুতের সঙ্গেই ফ্রিলি কথা বলা যায় এইবিষয়ে।কিন্তু নাজমার উপস্থিতিতে সেটা সম্ভব না। আর টেক্সট করে সব হয় না।আরো কনফিউজিং হয়ে যাবে সব।


    ওদিকে অনলাইন ক্লাসে ছেলেমেয়েদের মেটিরিয়াল দিতে হবে।ডাউনলোড হয়নি সব।


    মুমতাজের ভেতরে কেমন একটা উৎকন্ঠা হচ্ছে । বাবল্সের জন্য। প্রথম সন্তান। মেয়েকে তিনি খুব শক্তপোক্ত তৈরি করেছেন তুলনায় বার্বি অনেক সফট।কিন্তু যেমন হোক, যত বড় হোক, সন্তানের জন্য চিন্তা কখনোই পিছন ছাড়ে না।


    এই মুহূর্তে, একটি চমৎকার আলোকোজ্জ্বল সকালে, পূর্ণ ব্রেকফাস্ট টেবলে বসে মমতাজ তাঁর মেয়েদুটির জন্য অসম্ভব কাতরতা বোধ করলেন।কাউকে বলতে পারছেন না।


    এক জীবনে মানুষকে যে কত রকম টেনশন সহ্য করতে হয়! 


    জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে ভেবেছেন, এই শেষ।আর এরপর চিন্তা নেই। কিন্তু নুডলসের অন্তহীন পাকের মত একাধিক টেনশনের কনটিনিউইটি আর পেছন ছাড়লো না।সন্তানের জন্য'এই ব্যাকুলতা কী একধরনের পজেসিভনেস? মুমতাজ বারবার নিজেকে সংযত করতে চাইছেন। ওরা অ্যাডাল্ট।ঠিক নিজেদেরটা নিজেরা বুঝে নেবে।


    খুব ছোটবেলায় মুমতাজের একটা পোষা বেড়াল ছিল। সে একবার হারিয়ে যায় ।দিন তিনেক খোঁজ ছিল না।মুমতাজ তখন বেবি ফ্রক পরেন। আব্বুজানের সঙ্গে রেকর্ডিং স্টুডিও যান। কতবার আশাতাই তাঁর' গাল টিপে আদর করেছেন। সেই বেড়াল হারানোর সময় তাঁর কী কান্না। কেউ থামাতে পারে না। তিনদিন বাদে সে নিজেই ল্যাজ দুলিয়ে ফিরে এল।তখন কী খুশি । আজ যেন সেই বেড়াল হারিয়ে যাবার মতন কেমন একটা খালি খালি বোধ হচ্ছে তাঁর। কী যেন হারিয়ে যেতে চলেছে।কী যেন হারিয়ে যাবে। নিজেও ভালো করে বুঝতে পারছেন না।কেবল একটা তীব্র বিষাদ।( চলছে)


    #করোনাকালীন (দুই)


    তেইশ


    করুণা সাহা ফোন করেছিল। ওর সঙ্গে ওর'বোন মিনতি।এই দুটি বোন ওদের অঞ্চলে মোটামুটি শিক্ষিত মানে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ। ফোন আছে। এবং কথাবার্তা বলতেও পারে। গতদু' দিন ধরে জাহির জ্বরে পড়ে আছে। তাই টুপুরকে ফোন করেছে। মেধাকেও করেছে বলল। ওদের বক্তব্য সরকারী তরফে যতটা ত্রাণ দেওয়া হয়েছে , তার সবটা আম্ফানে বাড়িঘর ভেঙে যাওয়া মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না।মাঝে কিছু ঘাপলা হচ্ছে ।জিনিসপত্র বিশেষ করে ত্রিপল , চাল এসব সরে যাচ্ছে। আয়লা, বুলবুলের সময়েও এসব হয়েছিল।নতুন কিছু না।কিন্তু এইবার মানুষ একেবারে পথে বসে গেছে।ত্রাণ না পেলে ভিক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই।কাজেই এইসব ঘাপলা বন্ধ হওয়া দরকার। টুপুর জানে এখানে নাক গলানো অসম্ভব ।মেধা ও জানে। কিন্তু মেয়েদুটো কথা বলতে চাইছে বারবার। জাহির সুস্থ নেই। ওরা কী যাবে না? অন্তত গিয়ে শুনতে পারে সমস্যাটা সামনাসামনি । মেধা পরিস্কার বলল, দেখো এতে পলিটিকাল ধান্দাবাজি আছে। একদম কিচ্ছু করা যাবে না। আমরা বাইরে থেকে যেটুকু করছি তাই বা আরেকটু বেশি জিনিস পাঠানোর দায়িত্ব নিতে পারি।উই ক্যান গো ফর সাম মোর ক্রাউড ফান্ডিং। আই ক্যান আস্ক মাই পাপা ফর সাম মোর ডোনেশন। কিন্তু লোক্যাল মাস্তানদের সঙ্গে লাগতে যেও না।দ্যাট উড বি দ্য মোস্ট আনওয়াইজ থিংগ। আমাদের হয়তো কিছু হবে না।কিন্তু ঐ মেয়েদুটো বিপদে পড়বে।


    মেধা ইজ অ্যাবসলিউটলি রাইট।টুপুর নিজেও জানে যে এই লোক্যাল ডনরা কত ভয়ানক হতে পারে ।পঞ্চায়েত টঞ্চায়েত সব এদের হাতে। আর্মসের অভাব নেই।টুপুরদের মত যারা ক্রাউড ফান্ডিং করে ত্রাণ নিয়ে যায় তাদের এরা মশা মাছিও মনে করে না।


    কিন্তু মেয়েদুটোর সঙ্গে একবার দেখা করতে তো ক্ষতি নেই।দলের সবাই এখন আবার জনক্যান্টিন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।আর ব্যাপারটা কাজেও দিচ্ছে খুব। আম্ফানের পর জনক্যান্টিনের ডিম্যান্ড অনেক বেড়ে গেছে।


    জাহিরকে একবার জানানো উচিত। ও সমস্ত ব্যবস্থা করে।ওদিকের লোকজনের সঙ্গে ওর ওঠাবসা। ফোন তুললেন ইলিনা আন্টি।গলাতে ভীষণ টেনশন। আমি একা একা আর পারছি না রে বাবা। জাহির বিছানা থেকে উঠতে পারছে না।


    বোঝাই যাচ্ছে ।জাহিরের বাবা মারা যাবার পর থেকে ঐ বাড়িতে মা ছেলে আর এক পেল্লায় অ্যালসেশিয়ান ।জাহির অসুস্থ হয়ে পড়লে সব অচল ।এমনকি কুকুরটির দেখাশোনাও ইলিনা সবটা পারেন না।জাহির ঘুমিয়ে আছে।অনেক ধকল যাচ্ছে ওর ওপর দিয়ে ।উদয়াস্ত পরিশ্রম করে ছেলেটা। 


    মেধা অবশেষে রাজি হল। মেধা সরকার ইনডাসট্রিয়ালিস্ট অশোক সরকারের মেয়ে । প্রচুর হোল্ড ওর বাবার। কাজেই মেধা রিস্ক নিতে পারে। একেবারে মোমপালিশ করা গাত্রবর্ণ । মেধা কখনোই সাজে না।লম্বা চুলটা টেনে একটা খোঁপা ঘাড়ের কাছে। জিনস আর শার্ট। ওর বোন চন্দ্রমল্লিকার মোমপালিশ আরো ভালো।মেধার তাও কিছুটা রোদে পোড়া ।তবে ওরা দুই বোনই ভীষণ সিম্পল।কোনো চালিয়াতি নেই।লোকদেখানো কিছু নেই। ওদের লিভিং রুমে গ্র্যান্ড পিয়ানো আছে। অকশনে কেনা নয়।ওর'ঠাকুরদার আমলের। মেধা ইজ সিরিয়াস।ওর সঙ্গে যাওয়া যায় ।ও'চুপচাপ কাজ করে।কম্যান্ড করে না।কমেন্টও না।


    ফোন করল একবার ডাক্তারকে।


    ডাক্তার অবশ্য ফোন ধরেন না।সেক্রেটারি ধরে। তন্দ্রা ফোনটা ইশানকে দিল।


    - সরি ডক। পরশু ডেটটা ক্যানসেল করতে হবে। যেতে পারব না।


    - ওকে। এটা তো তন্দ্রাকে বলে দিলেই হত।শি ম্যানেজেস অল দি অ্যাপয়েন্টমেন্টস।


    ডাক্তারের গলাটা কী একটু ফর্মাল মনে হল? রাগ রাগ? 


    - না মানে একটা রিলিফ ওয়ার্কে যাচ্ছি। সেইজন্য যেতে পারব না।


    - আই নিড নো এক্সপ্ল্যানেশন । প্রয়োজন আপনার।কাউনসেলিং চাই আপনার । সো ইউ ডিসাইড। প্লিজ ইনফর্ম তন্দ্রা। ইউ নো হার নাম্বার ।


    রেখে দিল কট করে। খুব রাগ হল।ন্যাস্টি মেল শভিনিজম। সব ছেলেগুলো বেসিক্যালি এক। একটু ভালভাবে কথা বলতে পারতো। টুপুর পা দিয়ে চেয়ারটা ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল।


    কোনো কারনে কাজে অকৃতকার্য হলে , কিছু ব্যর্থতা এলে, সে যত সামান্যই হোক যার ওপর রাগ হচ্ছে তাকে কিছুই বলা যায় না।করাও যায় না।কিন্তু রাগ বা ক্ষোভ প্রকাশের একটা জায়গা দরকার হয় মানসিক ভার লাঘব করার জন্য।সেটার শ্রেষ্ঠ এবং সহজতম উপায় হচ্ছে মা।মায়ের ওপর রাগ ঝাল ঝেড়ে নাও।এমন কথা বলো যাতে ভদ্রমহিলার গায়ে বিছুটিপাতার ছিটে লাগে। টুপুর এতদিন তাই করে এসেছে।যার ওপর রাগ হয়েছে, বিরক্ত হয়েছে, সব ঝাল এসে পড়েছে মালবিকার ওপর।এমনকী যখন খড়্গপুরে চলে গেছে , তখনো।তখনো রাগ হলে ফোন করে মা' কে চোটপাট।অথবা ফোন না ধরা।না করা।ধরলে মেজাজ দেখানো।


    এই প্রথম মালবিকা যেন সরে গেছেন।তাঁকে এখন কিছুই বলা যাবে না।বললেও কিছু হবে না।একটা নিজস্ব আবর্তের মধ্যে ঢুকে আছেন তিনি। কেউ তাঁকে সেখানে স্পর্শ করতে পারছে না।শ্যামার সঙ্গে টুকটাক কথা বলছেন এখন। তাও খুব কম।


    এই যে করুণাদের ব্যাপারটা , এটা কারুর সঙ্গে ডিসকাস করা দরকার।জাহির জ্বরে।মেধা কাজটুকু করতে পারে। ভাবে না অত।ইনফ্লুয়েন্স খাটিয়ে ডোনেশন আনতে পারে।অবশ্য সেটাও খুব দরকারি ।দলের বাকি ছেলেরা মূলত শ্রম দিতে পারে ।কিন্তু বুদ্ধি করে কোনো মেচুওর ডিসিশন নিতে পারে না।বাড়িতে কেউ নেই।ত্রিদিব নিজের কাজ নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন।ঠাঁট বাঁট বজায় রাখতে গেলে এখন কোম্পানিকে বহুত সার্ভিস দিতে হবে। 


    সে কার কাছে যাবে? একটা ওয়াইজ ডিসিশনের জন্য ? দাদা অত দূর থেকে কিছুই বলতে পারবে না।ও এই সিচুয়েশনের কিছু জানে না।থিওরেটিকালি বোঝে মাত্র। তাই ভেবেছিল ঈশানকে যদি বলা যায় ।যদি কিছু সাজেশচন পাওয়া যায় । কট করে ফোনটা রেখে দিল। কী ভেবেছে কী? টুপুর ওর সঙ্গে ফ্লার্ট করছে? প্রেমে পড়েছে? মাই ফুট! ডিয়ার জিন্দগি ফর্মূলা নৈঋতা সেনগুপ্তর জন্য নয়। ডাক্তারকে এটা বুঝিয়ে দিতে হবে পরে।


    ফ্রিজ খুলে দেখলো খাবার মত কিছু নেই।শ্যামাদি ওইবেলা রুটি ফুটি করে। বললে এখনি করে দেবে কিন্তু এই ভরবিকেলে একটু আগে ভাত খেয়ে শুয়েছে।এখন বিরক্ত করতে ইচ্ছে হল না। ল্যাদ খেয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মা সুস্থ থাকলে এর মধ্যে কতবার বেডকাভার পাল্টানো হত। জংলা ছাপের চাদরটা ওর পছন্দ।বেশ একটা আদিম অরণ্য ব্যাপার আছে। রক্তিম ফোন করলো। দু' বার রিং হবার পরে ধরলো ও। কিছু একটা করতে হবে।


    ওপর থেকে টিকটিকি দেখল , মেয়েটা রোগা হয়েছে।কালোও হয়েছে। সবমিলিয়ে একটু স্নিগ্ধ হয়েছে আগের থেকে। রক্তিম ফোনেও জোরে কথা বলে। খুব বাজে লাগে টুপুরের ।লাউসি টেইস্ট।


    - খোঁজ নেই কেন? কী করে বেড়াচ্ছিস?


    -'যা করি। ফ্লার্ট করছি।নাচছি।গাইছি।


    - বি সিরিয়াস। শোন , তোর এই ফালতু ব্যাপার গুলো ছাড়।মেচুওর হ। যা করছিস সেসব করে কিছু হবে না। তোরা ভাবছিস যে তোরা দারুণ কিছু করছিস? রং।কিচ্ছু না।ওদের নিড কখনো ফুরোবে না। এভারলাস্টিং পভার্টি।গভমেন্ট যা করার করছে।করছে তো। পি এম এসে দেখে গেছে।ন্যাশনাল ডিজাস্টার ডিক্লেয়ার করেছে।ফান্ড আসবে।কাজ হবে।তুই এত অ্যাক্টিভিজম করবি কেন? তোর কেরিয়ার নেই? সংসার করবি না? না রোদে পুড়ে ট্যান হবি?


    একনাগাড়ে এতটা বকে গেল।কতটা গাড়ল হলে এটা করতে পারে! অ্যান্ড মা এক্সপেক্টস দ্যাট শি উইল ম্যারি দিস গাই! ও চুপ করে আছে।


    - আর তোর ঐ যে বন্ধু জাহির, ওটা আরেকটা গান্ডু। শালা পাকিস্তানের স্পাই...


    - দিস ইজ গেটিং টু মাচ।চুপ কর রক্তিম।যা জানিস না তাই নিয়ে কথা বলিস না।


    ভারতীয় ছেলে। ভাবী বউ দাবড়ানি দিলে গায়ে লাগে।রক্তিম তিক্ততর হল। 


    - শুয়েছিস ওর সঙ্গে? এত টান কেন? 


    - শুয়েছি। ক্যাম্পে গিয়ে পাশাপাশি কয়েকজন। কনোটেশনটা পাল্টা।শোবার মত একটা স্নিগ্ধ জিনিসকে সেক্সের সঙ্গে গুলিয়ে দিবি না।কিপ ইওর ডার্টি মাইন্ড ইন ইওর ডার্টি পকেট।


    টুপুর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। কেন এই গাধাটাকে সহ্য'করছে এত এত দিন ধরে? ইজ ইট সো ইম্পরট্যান্ট টু হ্যাভ আ বয়ফ্রেন্ড? না।এখন মনে হয় একদম না। বাট লুকিং ব্যাক।পাঁচ বছর আগে ছিল। তখন ভীষণ দরকারি ছিল একজন বয়ফ্রেন্ড থাকা। প্রযুক্তার আছে। দীপমালার আছে। সৌমিতার আছে। তার কেন থাকবে না! বন্ধু মহলে তখন অফফ পিরিয়ডে এইভাবেই কথা চলে। শোন! ওর একজন আছে! সেটা তখন শিহরণ জাগাচ্ছে। ভীষণ ভীষণ রোমাঞ্চ । ঠিক তখন ছুটিতে এসে দেখল রক্তিম ফিরেছে জার্মানি থেকে। দেখতে ভাল। স্মার্ট। ভাল রোজগার করছে। মা আর রত্নামাসি কথা পেড়ে ফেলল।অ্যান্ড শি এগ্রিড! এখন ভাবলে ওর অবাক লাগে! সেটা কী অন্য কেউ ছিল যে রক্তিমের সঙ্গে ডেটে যাবার আগে একঘন্টা ধরে পোশাক বাছত? রক্তিমের পছন্দের পোশাক পরতো? তারপর এল উদ্দাম আকর্ষণ । এখন বোঝে সেটাও ঝোঁকের মাথায় হয়েছিল। কনসেনশুয়াল ।ইয়েস।রক্তিম নেভার ফোর্সড হার বাট ক্রিয়েটেড সিচুয়েশনস ভেরি ম্যানিপুলেটিভলি। যাতে টুপুর ধরা পড়ে যায়। আর টুপুর? যে তখন বন্ধুদের কাছে " আমারো একজন আছে" বলার জন্য ব্যস্ত, মায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার জন্য এক পায়ে খাড়া অথচ মাতৃ নির্ধারিত পাত্রের সঙ্গেই ডেট করছে , সে ভাবল সাহসী হতে হবে।বোল্ড।শারীরিক । গোইং ফিজিক্যাল মিনস গোইং স্টেডি। মা ক্ষেপে উঠেছিল জেনে। বিয়ে পর্যন্ত ওয়েইট করতে পারলে না? ইউ আর মাই ডটার! 


    ও তো এটাই চেয়েছিল।মা দুঃখ পাবে। রেগে যাবে।


    সেটা সাকসেসফুল।কিন্তু নিজে ক্ষয়ে গেছে।


    তারপর অভ্যেস।যখনি ফিরেছে।যখনি রক্তিম খড়গপুর গেছে। দীঘা ঘুরে এসেছে দুজনে। এখন ও জানে এসব কিছু না। রক্তিমের কাছে ওদের শারীরিক সম্পর্ক একটা ম্যানিপুলেশন। যাতে টুপুর বেরিয়ে যেতে না পারে। আফটার অল, শি ইজ এজুকেটেড, গ্ল্যামারাস, স্মার্ট । বউ হিসেবে প্রেজেন্টেবল।পয়সাওয়ালা পরিবার।সব ক্যালকুলেশন পরিস্কার ।এই পরিস্কার বড় নোংরা।


    সন্ধে নেমে আসা শান্ত বাড়িতে কোনো সাড়াশব্দ নেই। টুপুর জানতে চাইছে।অনবরত নিজেকে খুঁচিয়ে। ও বুঝতে পারছে যে ও কোনোদিনই রক্তিম সম্পর্কে শারীরিক ভাবে আগ্রহী ছিল না। মানসিক ভাবেও না।ইট ওয়জ সিম্পলি আ ক্রেজ। হুইচ ইজ নাউ ওভার। বাট ইট হ্যাপেন্ড।


    টিকটিকি শব্দ করে উঠল।


    - আর ইউ গ্রোন আপ? আর ইউ মেচুওর?


    - সেরেছে।তুমি আবার ইংরেজি ধরলে কবে? খালি তো বাংলা বাংলা করতে?


    টিকটিকি হি হি করে হাসল।


    - ল্যাংগুয়েজ ইজ ইনফেকশাস। তুমি ইনফেক্ট করেছো আমাকে।আ বিগ হিউজ ভাইরাস।এখন আমিও আধা খ্যাচড়া ভাষা বলি। যেটা বলছিলাম সেটা হচ্ছে যে রক্তিমকে খুলে "না"বলবে কবে?যেটা করছো সেটা ছেলেমানুষি ।


    - খুব তাড়াতাড়ি ।


    - দেরি কোরো না।নাহলে জটিলতা বাড়বে। ও তো এক্সপেক্ট করছে।


    - এক্সপেক্ট করছে না।ধরেই নিয়েছে যে বিয়ে হচ্ছে।


    দাঁড়াও। রোদেখালি থেকে ফিরেই বলব। আর দেরী করবো না।


    - গুড।গুড ডিসিশন।


    টিকটিকি জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো।


    উঠে পড়লো ও।সত্যি ।আর ডিসিশন নেবার জন্য বাইরের কারুর ওপর ভরসা করার দিন নেই।সময়ও নেই। নো অ্যাডভাইস সিকিং।নিজের ডিসিশন নিজে নিতে হবে। পরশু রোদেখালি। এটাই প্রকৃত বড় হয়ে ওঠা হয়তো। কেমন একটা মন খারাপ।এই লকডাউন ।এই মূত্যুমিছিল। টিভি খুললে এক হয় খবরে আতংক।সেরে উঠছে।ছড়াচ্ছে।সেরে উঠছে ছড়াচ্ছে। রেল বন্ধ। নাহয় সিরিয়ালের প্যানপ্যানানি ।শ্যামা বুঁদ হয়ে দ্যাখে।কিছুই বলে না টুপুর।আছে , এই অনেক। বাবা তো নিজের মত থাকে।লোকটাকে আশ্চর্য হয়ে দ্যাখে ও।কী করে ফ্যামিলি লাইফের পাশাপাশি একটা স্টেডি গার্লফ্রেন্ড মেইনটেইন করে যাচ্ছে। এমন করে পাশ কাটিয়ে চলে যে মায়ের কিচ্ছু করার থাকে না।


    টুপুর এইরকম জীবন চায় না।কখনো না।সে মায়ের জায়গায় থাকলে কবে বেরিয়ে যেত! ভেবে নিজেই হাসল।রক্তিমের কাছ থেকেই বেরোতে হিমশিম খাচ্ছে ও।আর এই সংসার।মায়া।ছেলে মেয়ে ।কী করবে মা! পুওর থিং।এক একেক সময় কষ্টও হয় মায়ের জন্য।


    এইসময় ঈশান মজুমদারের সঙ্গে কথা বলতে পারলে অনেকটা ফ্রি লাগত।যে সব হার্ড হিটিং প্রশ্নগুলো করে , তার উত্তর দিলে মাথার জ্যামগুলো ছেড়ে যায় ।কিন্তু খড়ুসটা যেভাবে ফোন রেখে দিল, তাতে আজ অন্তত কথা বলার কোনো স্কোপ থাকল না।


    একটা লিম্বোর' মধ্যে ভাসতে ভাসতে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল টুপুর। ইরফান এলেন না।(চলছে)


    #করোনাকালীন (দুই)


    পর্ব  চব্বিশ 


    এইসব জায়গার সঙ্গে পরিচিতি হচ্ছে ওর। নোণা জলে ভেসে যাওয়া কৃষিজমি থেকে পচা, আঁশটে গন্ধ উঠে এলে ওরা টের পাচ্ছে যে এখনো ওরা কোভিড পজিটিভ হয়নি।করুণা আর ওর বোন ।সঙ্গে দু তিনটি ছেলেও আছে।ওরাই নিয়ে যাচ্ছে ইন্টিরিওরে। জাহির জানলে হয়তো রেগে যেতো।কী দরকার তোদের একা অত রিস্ক নেবার? যদি কিছু বিপদে পড়তিস? 


    আসলে মেয়েদের এখনো সবাই আগে মেয়েই দেখে।মানে মেয়ে শরীর।টুপুর নিজেও বুঝেছে কিছুদিন এসে।এই ধরনের পরিশ্রমের সঙ্গে অভ্যস্ত'নয় শরীর। জিম করুক আর যাই করুক।অথচ করুণা কী সাবলীল।ওর হয়তো চারবেলা খাওয়াই জোটে না ঠিকমত। করুণা ওদের নিয়ে এসে বসিয়েছে রমেশ মন্ডলের বাড়ি ।রমেশবাবুর বয়স বিরানব্বই ।ব্রিটিশ আমল দেখেছেন।কংগ্রেস আমল দেখেছেন।সিপি আই এম জমানা দেখেছেন।তারপর এই তূণমূল।কিন্তু বাপের জন্মেও এমন ঝড় দেখেননি।স্কুলবাড়ির বারান্দায় 'বসেছিল ওরা। করুণা চোখের ইশারায় বললো


    - বলো। সবাই জানে যত ত্রাণ সরকারি তরফে দেওয়া হচ্ছে, তত মানুষের ঘরে আসছে না।ওদিকে মাথার ওপরে খড়ের ছাউনি, ত্রিপল সব হাওয়া ।ভাগচাষির কাজ করেন বেশ কয়েকজন ।তাঁদের মধ্যে একজন নিবারণ সাঁতরা।চৈত্রমাসে জমিমালিকদের টাকা দিয়ে দিয়েছেন।এবার কী হবে আর জানেন না।হাতে কোন টাকা নেই আমন ধানের চাষ করবেন ভেবেছিলেন। এদের মুখের দিকে তাকালে অবাক হতে হয়। কী সামান্য আহারে, কত খারাপ অবস্থায় মানুষ বেঁচে থাকতে পারে তার' জলজ্যান্ত উদাহরণ। 


    করুণার বাবা কালিপদ সাহা ধান চাষ বাদ দিয়ে পোল্ট্রির ব্যবসা শুরু করেছিলেন।কনট্র্যাক্টের কাজ।পোল্ট্রি মিট কর্পোরেশনে।কোম্পানির কাছ থেকে মুরগির বাচ্চা কিনতে হবে। তারপর তাকে খাইয়ে দাইয়ে মোটাসোটা করে বিক্রি করো।ভাল লাভ এই ব্যবসাতে ।


    ঝড়ে অনেক চেষ্টা করেছিলেন মুরগীগুলোকে বাঁচানোর। দড়ি দিয়ে বেঁধে।দুহাজার মুরগী বাঁচানো গেছে।হাজার দেড়েক ভেসে গেছে জলে।প্রায় লাখ দেড়েক টাকা লস। এখন যেসব মুরগি আছে , কেউ ভালো করে খাচ্ছে না।ফলে ওজন কম।কিনবে কে?


    এর মধ্যে অসুখ বিসুখ আছে।জ্বর জারি, পেটের অসুখ। বাচ্চাগুলোকে দেখলে ভয় করে রীতিমতো । রোগা ।হাড়গিলে।ওদিকে পেট ঠেলে বেরিয়ে আছে। ইনফ্যাক্ট দেখে ভয় লাগে টুপুরের। এরা কী করে বাঁচবে।এবং তারপর যে প্রশ্নটা ওকে হন্ট করতে থাকে।এরা বেঁচে থেকে কী করবে? পড়াশুনা দূরের কথা, খেতেই তো পাবে না ভালো করে।


    অথচ ওরা ক্রমাগত অনটনের কথা বলে যাচ্ছে।সরকারি ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না, সেই নিয়ে নালিশ করছে। সম্ভবত ওদের ধারণা হয়েছে যে টুপুর, মেধা বা সৌগতদের সরকারি স্তরে হাত আছে।বা পঞ্চায়েতে প্রবল ইনফ্লুয়েন্স । হয়তো ওদের চেহারা পত্র' বা যে পরিমাণ ত্রাণ আগের দুবার এনেছিল সেসব থেকেই ওদের এই বিশ্বাস জন্মেছে।কেউ কেউ অবশ্য'দূরে দাঁড়িয়ে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। মানে এ ব্যাপারে যে কোনো সুরাহা হবে না সেটা ওরা জানে। বেশি ঘাঁটতে গেলে জানে মেরে দেবে। এই করুণা মেয়েটির জন্য বেশ ভয় হচ্ছে টুপুরের।


    একটা জিনিস এই করোনা পরিস্থিতিতে ও খেয়াল করেছে ।এই যে রিলিফ দিতে আসা, এতে বেশির ভাগ উচ্চ মধ্যবিত্ত বা ধনী পরিবারের ছেলেমেয়েরা আসছে। একেবারে মধ্যবিত্ত বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে অপেক্ষাকৃত কম সংখ্যক ছেলেরা এসেছে। মেয়ে তো আরো কম। সেটার অবশ্য কারণ আছে। তারা ব্যক্তিগত পরিসর নিয়ে এত ব্যস্ত, নিজেদের অভাব অনটন যে রিলিফ দিতে আসাটা ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মত ব্যাপার।


    মালদা থেকে কয়েকটি ছেলেমেয়ে এসেছে।দেখেই বোঝা যায় এরা মধ্যবিত্ত বাড়ির ছেলেমেয়ে । এরাও ক্রাউড ফান্ডিং করে রিলিফ মেটিরিয়াল এনেছে।কী এনার্জি! খাওয়া বলতে চা আর মুড়ি। একটা বাতাসাও নেই।নিজেরাই জিনিস বইছে পিঠে । শুকনো জামাকাপড়, চাল, সয়াবিন অনেকটা এনেছে এরা।অন্তত কিছু এলাকাতে চার পাঁচ দিন চলে যাবে।


    এখানে বিদ্যুত আসার কোনো নাম নেই। নেটওয়ার্ক মাঝে মাঝে থাকছে।মাঝে মাঝে নেই। আজ মা কিচেনে গেছিল এতদিন বাদে।এটা শ্যামার ক্রেডিট। লেখাপড়া জানে না।কিন্তু বুঝদার খুব। কেমন করে মালবিকাকে বলল, তেল কইয়ের মশলাগুলো একটু দেখাও তো। কতটা মৌরী কতটা কী। ভালো ।টুপুরের ভালো লেগেছে।এটা যদি স্ট্র্যাটেজি হয় তো টুপি খুলতেই হবে।অনেকটা নিশ্চিন্তে বেরোতে পারছে শ্যামা থাকাতে।বাবা। বাবা ল্যাপটপে ডুবে থাকবে।মা' কে ওষুধ দেবে সময়মত।কিন্তু অবসাদ থেকে টেনে তোলার চেষ্টা করবে না। ওইখানে সম্পর্কটা ফাঁকের। টুপুর এখন স্পষ্ট বোঝে।টুয়েলভের পর বাড়িতে এত দীর্ঘদিন থাকেনি। খুব জোর সেমিস্টারের ফাঁকে দশ, বারোদিন।তখন এসেও নিজের খেয়ালে মত্ত থাকত। রক্তিম।বন্ধু বান্ধব ।


    এখন চোখে পড়ছে।মা বিছানায় লুটিয়ে ঘুমালে বাবার খুব একটা অসুবিধে নেই।কাজ হয়ে গেলে হি উইল চ্যাট উইদ হিজ ফ্রেইন্ডস।অর গার্লফ্রেন্ড। শ্যামা ঠিক উল্টো ।মালবিকাকে ছোট ছোট কাজে ইনভল্ভ করার চেষ্টা করছে। জীবনে ফিরে আসার টুকরো টুকরো ছবি তৈরি হচ্ছে বাড়িতে ।দ্যাট ইজ গুড।খুব সামান্য হলেও ইমপ্রুভমেন্ট ।আর ডাক্তার কাউনসেলিংটাও মন্দ করছে না।বেশ ইনটেলিজেন্টলি হ্যান্ডল করে।দ্যাট হ্যাজ টু বি অ্যানোলেজড। 


    একটা ভেসে যাওয়া পুকুরের পাশে দাঁড়িয়ে সিগারেট ধরালো টুপুর।জাহির থাকলে চেঁচামেচি করত। ও আমার যেখানে যেমন সেখানে তেমন এইসব বিশ্বাস করে।


    সৌগত পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । এই ছেলেটা একেবারে একটা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে। খুব খাটতে পারে।কথা বলে টুকটাক।


    -খাবে সিগারেট? টুপুর মুক্তহস্ত।


    - নাহ্ ।খাই না।


    - তুমি আগে অনেকবার এসেছো এদিকে ।না?


    সৌগত হাসল। নাহ্। অনেক আর কোথায় ।


    ছেলেটা লাজুক হলেও কথা বলতে জানে।ওরা কাদার রাস্তাতে হেঁটে যাচ্ছিল।


    - এই যে ভেসে যাওয়া পুকুর' দেখছো, এখানে ট্যাংরা, গুলশে, তেলাপিয়া ছাড়লে তিন থেকে ছ'মাসের মধ্যে দারুণ মাছ হবে।


    - তাহলে তো ইজি।কাজ শুরু করে দিক ওরা।


    সৌগত দাঁড়িয়ে পড়ল।


    - না না।ব্যাপারটা অত সোজা না। আগে পাম্প, স্লাজ পাম্প এসব দিয়ে নোণা জল আর কাদা বের করতে হবে।তারপর চূণ টুন দিয়ে ট্রিট করে , বর্ষাকালে বৃষ্টির জল ভরে, তারপর।পুকুরের ধার উঁচু করতে হবে।


    - তুমি তো বেশ খবর রাখো। 


    - এমনি সময়েও আসি তো।জাহির, আমি, তন্ময় । আসা যাওয়া লেগেই আছে।ঐ দ্যাখো, ঐ যে গাছ জ্বলে গেছে।ওটা কী বলতো,? অসোটিক ইমব্যালান্স।ক্লোরাইড টক্সিসিটি হয়ে গেছে।বাতাসে সল্ট স্প্রে আর ড্রাই এরোসল থাকলে এরকম হয়। আসলে এখানে খুব সায়েন্টিফিক্যালি কাজ হয়নি কখনো ।জানো। কোনো জমানাতেই হয়নি।আমার কাকা চেন্নাইতে সোয়ামিনাথন ইনস্টিটিউটে কাজ করেন ।উনিও এসেছেন এখানে। বলছিলেন সব রকম গাছ এই অঞ্চলে চলবে না।প্রচুর ভুলভাল গাছ লাগানো হয়েছে।


    - মানে? 


    - এই যে ম্যানগ্রোভ কেটে কেটে জনবসতি হয়েছে , তাতে মাটিটার ক্ষতি হয়েছে তো।সব গাছ সব জায়গার জন্য না।এখানে ম্যানগ্রোভের সঙ্গে ধরো কাজু, নিম, কাঁটাবাঁশ , তাল, নারকেল, ঝাউ, রিঠা এইসব গাছ লাগানো দরকার । এসব গাছ লোণা হাওয়া আর ঝড় দুটোকেই সামলাতে পারে। চেন্নাইতে ওরা করছে তো।


    এখানে কিছুই অরগানাইজড ওয়েতে হচ্ছে না।


    - কেন? টুপুর মাস্ক খুলে ফেলেছে ।এখানে পর্যাপ্ত খোলা বাতাস। নিঃশ্বাস নিচ্ছে প্রাণভরে। পচা গন্ধ অনেকটা কম। 


    - আরে বাগদা আর ভেনামি চিংড়ি চাষ করে করে মাটিটার বারোটা বাজিয়ে দিচ্ছে। ঐ দুটো চাষ খুব হারমফুল এখানকার জন্য।কিন্তু এরা তো ইমিডিয়েট মুনাফাই দেখবে।না? লং রানে যে ক্ষতি হবে সেটা বুঝছে না বলেই তো ঝড়ে এত ক্ষতি হচ্ছে।এখানে আইডিয়াল হল কাঁকড়া চাষ।খুব তাড়াতাড়ি বড় হবে। দামটাও ভালো।


    দাঁড়িয়ে পড়েছে টুপুর। কাদাতে আটকে যাওয়া স্যান্ডালটা ঠিক করছে।লং রান। লং রানে রক্তিমের সঙ্গে সম্পর্কটা কেমন হবে ভাবছে টুপুর।এক একটা শব্দ কী যেন করে দেয় ।


    বেশ ঘ্যাম একটা ওয়েডিং পার্টি হবে।টুপুর দেখতে পাচ্ছে।বাবা বিস্তর খরচ করবে।সোমনাথ হল টল ভাড়া নিয়ে নেবে হয়তো।থাইল্যান্ডে হানিমুন।বা মরিশাসে।রক্তিম ঐরকম সব প্ল্যান করে আরকি। তারপর দু তিন বছর বাদে বিদেশ। এভরিথিং উইল ডিপেন্ড অন হিজ কেরিয়ার। তার নিজের কী হবে? রক্তিম অম্লানবদনে বলেছে, যেখানে যাবো সেখানে কিছু একটা তোর ঠিক জুটে যাবে।আই আইটিয়ানরা বসে থাকে না।


    মানে টুপুরের সেকেন্ডারি স্টেটাস হবে। লং রানে আপাতত এটাই ক্যালকুলেট করা যাচ্ছে। কিন্তু সেটা কী তার খুব ভালো লাগবে? ফ্রিডম ইন এক্সচেঞ্জ অব লাক্সুরিয়াস স্লেভারি? 


    পা দিয়ে একটা কাদার ঢেলাকে লাথি মারল টুপুর।বললো, নো।


    সৌগত অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকাল।


    - কী হল?


    - ও নাথিং।নাথিং মাচ। যাস্ট আ লাম্প অব ক্লে।সৌগত হঠাৎ একটু জোরে বলল, আরে ঐ দ্যাখো , ঐ গাছটা চেনো? অমলতাস!


    টুপুর গাছ অত চেনে না।মালবিকা বাগান করেন বটে । ওর মাথাব্যথা নেই। 


    নেটওয়ার্ক ফিরেছে ।প্রতিমুহূর্তে সতর্ক থাকতে হচ্ছে।রক্তিম ফোন করতে পারে ।


    দূরে নদী দেখা যাচ্ছে।সৌগত আঙুল তুলে বললো, ঐ দ্যাখো, বিদ্যাধরী। 


    - তোমার বাড়ি কোথায় সৌগত?


    আচমকা বিষয় পাল্টে যাওয়াতে সৌগত ওর মুখের দিকে অবাক হয়ে তাকাল। নদীর দিকে যাচ্ছে ওরা।


    - টালা। তোমার তো সল্ট লেক?


    মাথা নাড়ল টুপুর। কে কে আছে বাড়িতে ।


    - বাবা, মা, বোন। এই দ্যাখো।এটা কী গাছ বলোতো? 


    - জানি না। টুপুর রোদের তাপে ঘামছে।বেগুনিবর্ণ ধারন করছে ক্রমশ। ছাতা আনতে হত।


    - তুমি খুব ঘামছো নৈঋতা। এটা গরাণ গাছ।এই অঞ্চলে গরান গাছ সবচেয়ে উপযুক্ত ।অথচ একদম কমে গেছে, জানো তো? 


    টুপুর সৌগতকে দেখল। একটুও ঘামেনি। বেশ ইনফরমেশন রাখে তো ছেলেটা! 


    ফোন এল তখনি। ঈশান মজুমদারের চেম্বার থেকে তন্দ্রা ফোন করেছে।


    ম্যাডাম। আপনার ক্যানসেল করা ডেটটা এই সপ্তাহের মধ্যেই নিয়ে নিতে হবে। নেক্সট উইক চেম্বার উইল বি ক্লোজড। 


    করুণা কখন চলে এসেছে পেছন পেছন। 


    - চলেন দিদি।চা খাবেন। 


    - আবার চা করতে গেছো কেন এর মধ্যে?


    - লিকার চা তো। চিনিও তো খান না আপনেরা।


    ফিরছে ওরা স্কুল বাড়ির দিকে। কাদার ভেঙে আর নোণা জল পার হয়ে।সৌগত আগে চলেছে। ওরা একটু পেছনে।


    করুণা মৃদুস্বরে বলল, স্যানিটারি ন্যাপকিন আরো বেশি করে আনবেন দিদি।একটা প্যাকেটে কিছু হয় না। আর মেয়েমানুষদের বাথরুম নাই।খুব অসুবিধা হয়ে গেছে।


    ও দাঁড়িয়ে পড়েছে ।চারদিকে শুধু জলে ডোবা মাঠ আর কাদা বিবর্ণ গাছ।


    জানো ইরফান। আই ফেল্ট সো অড। আমাদের বেঁচে থাকা একটা বোকা বোকা অর্থহীন অনুভূতির সমষ্টি। বেসিক রিকোয়ারমেন্টস আর অলসো ডিসক্রিমিনেটেড ।কেমন নিকৃষ্ট মনে হচ্ছে নিজেদের। আই ফিল সাফৌকেটেড।( চলছে)


    #করোনাকালীন (দুই)


    পঁচিশ


    ঘুমের মধ্যে খাবি খাচ্ছে ও ।যেন লবণাক্ত জল ঢুকে যাচ্ছে ভেতরে।আর ছটফট করতে করতে ও টের পাচ্ছে ওর ভেতরের মিষ্টি জলকণাগুলি ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।মিষ্টত্ব নিজেও বিসর্জন দিয়েছে ও। কষটে নোণা জল আকণ্ঠ পান করেছে ।বাকি যেটুকু মিষ্টত্ব ছিল, সব ধুয়ে মুছে যাচ্ছে। এসি চলছে কুড়িতে ।তবু ও ঘামছে।একটা বন্যপ্রাণীর মত পালাচ্ছে।কোনো বসতি নেই ওর।কোনো ঠাঁই নেই। ও কেবল পালাচ্ছে দ্বীপের গভীরতর অঞ্চলে পালাচ্ছে।ঘন অন্ধকারে পালাচ্ছে ।


    একেবারে ঘেমেনেয়ে উঠে বসল।এসি আঠারোতে নামল।তারপর বন্ধ করে দিল । চাদর ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে।জানালাগুলো খুলে দিল হাট করে।বাগানের খানিকটা ওর জানালার সামনে পড়ে।ঝড়ে লাট হয়ে গেছিল সব।শ্যামা একটু পদে এনেছে।অন্তত ভাঙা ডালগুলো ফেলে দিয়েছে।হাত পায়ের কাটা দাগগুলো স্পষ্ট এখনো।তবে ব্যথা কমে এসেছে। দাগগুলোর ওপর আঙুল বোলালে একটা তীব্র শিরশিরে ব্যথা । ও বারবার তাই করছে এবং ভাবছে ইজ দিস ম্যাসোকিজম? 


    ইরফান বললেন, না।


    - কব আয়ে আপ? ভুল গায়ে রাস্তা।


    ইরফান গলা ছেড়ে হাসলেন। 


    - কাজ হচ্ছে ভালো? উও যো যাতে হো।সুন্দরবন? 


    - যাচ্ছি ইরফান।কাজ হচ্ছে কিনা বলতে পারব না।আমরা কেবল কিছু রিলিফ মেটিরিয়াল নিয়ে ইভাকুয়েশন সেন্টারগুলোতে পৌঁছে দিচ্ছি।ঘর তো আর কারু নেই। ঐ ব্লক অফিস আর স্কুলবাড়ি জুড়ে আছে সব।কতজন রাস্তায় আছে।সেন্টারে জায়গা নেই।


    ইরফান বেশ উত্তেজিত হলেন। চোখ বড়বড়।


    - ওড়িশামে দো তিন মাইলকে অন্দর এক এক ইভাকুয়েশন সেন্টার হ্যায় ।সব পিলারকে উপর বানাতা। পানি কুছ বিগড় নেই সকতা তব।


    ওয়ার্লড ব্যাঙ্কসে মিলা রূপাইয়া।আগর সাইক্লোন আনেকা ফোরকাস্ট হোতা হ্যায়, তো পুরেকে পুরে গাঁও চলে আতে হ্যায় সেন্টারমে। সব গভমেন্টকি তরফসে। খানাওয়ানা।পঞ্চায়েত দেখভাল করতা হ্যায় । শুটিং কিয়া থা একবার ইভাকুয়েশন সেন্টারমে। ফিশারম্যানকা রোল নিভায়া।


    টিকটিকি এসে বসেছে পাশে। বহুদিন বাদে এই মধ্যরাত। ওরা তিনজন পাশাপাশি।মুখোমুখি। 


    ইরফান সহর্ষে কথা বলছেন।একটু যেন নির্ভার।


    - আমাদের এখানে অত কিছু ব্যবস্থা নেই। মানুষ বড় কষ্টে ।


    টিকটিকি সায় দিলে। এখানেও এখানেও। 


    - ইয়ে তো হোনাহি থা। দেখো একসও সত্তর পঁচাতর সাল পহলে ইংরাজ আয়া থা আউর ইয়ে সুন্দরবন ইজারামে লে লিয়া। মেদনীপুরসে আদমি লায়া। খুলনা , যশোরসে ফ্যামলি লায়া। ম্যানগ্রোভ সাফ কর দিয়ে বিলকুল।জংলি জানওয়ারোকো হটা দিয়া আপনি জাগোসে। ড্যাম বানা দিয়া নদীকে বরাবর। মগর মিট্টিকা বনায়া। সাইক্লোন ক্যা, উও তো ফুল মুন টাইডকো সামহাল নহি সাকতা। 


    চোখ বন্ধ করে বসে ভাবছে।তিন হাজার পাঁচশ কিলোমিটারের বাঁধ।সৌগত বলছিল। সাধারণ।খুব সাধারণ একটা শার্ট পরনে। ততোধিক সাধারণ প্যান্ট।বোঝা যায় রেডিমেড।ওরা যাবার পর স্কুলবাড়িতে সবাই হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছিল। আশ্চর্য ।ঐ ভাবে আছে।অত কষ্ট। অথচ মুখে হাসি। বলছে শরবত' বানায়ে দিই ।তেতে পুড়ে আইসো। খাও। নিজেরা খেতে পায়না।ওদের শরবত দিয়েছে। গাছ থেকে লেবু পেড়ে এনেছে।চিনি? চিনি কোথায় পাবে? 


    ঐ যে তোমরা দিসো ঐতে হইয়া যাবে।গ্লাসে লেবু চিনি জল ধরে দিয়েছে হাসিমুখে।


    এত প্রাণশক্তি কোথা থেকে পায় এরা! 


    পঞ্চায়েত প্রধান বলছিলেন, সবচেয়ে বেশি ভেঙেছে গরাণ গাছ। জেটি, উডেন ট্রেইল, ওয়াচ টাওয়ার ভেঙেছে।আয়লার পরে নাকি হল্যান্ড থেকে বিশেষজ্ঞর দল এসেছিলেন।আয়লার টাস্ক ফোর্স ।প্রায় পাঁচ হাজার বত্রিশ কোটির গল্প। জমি নিয়ে , শক্ত মাটির ভিত তৈরি করে, তার ওপর পলিপ্রপিলিন শিট ফেলে, ব্রিক সিমেন্ট পিচিং করতে হবে।তবে উঁচু বাঁধ হবে । 


    সৌগত ফিসফিস করে ওর কানে বলেছিল, দেখেছো। মাতব্বর একেবারে।পলিপ্রপোলিনের পুরো কনসেপ্টটা ভুল।রিকনস্ট্রাকশন কমিটির একজন ইনডিপেনডেন্ট মেম্বার তো অবজেকশন দিয়েছেন। নদীর ধারে পলিপ্রপোলিন শিট চলবেই না।এর জন্য বাঁশের চাটাই বা ন্যাচরাল ফরেস্ট ওয়াল তৈরি করতে হয়। কিন্তু এইসব কথা বেশি বলা যাবে না।অনেক মাতব্বর আছে।জীবন, জীবিকা, রাজনীতি সব ঘেঁটে আছে।সেচ আর পঞ্চায়েতে রেগুলার বাজেট।ভাঙবে ।আবার টাকা ঢালবে ।আবার তৈরি হবে।


    মাথাটা ধরে গেল। চেঁচিয়ে বলল, শ্যামাদি, একটু কফি দিয়ে যাবে?


    ঘরের দরজা খোলা। শ্যামা শুনতে পেয়েছে।কফির কড়া গন্ধে যদি মাথা একটু হাল্কা হয়।ইরফান গুনগুন করে একটা গান গাইছেন।


    - শুটিং মিস করো ইরফান?


    ইরফান সেই হাসিটা হাসলেন।আন্তরিক।উদাস।


    - জরুর।শুটিং মিস করি। নাথিং মোর দ্যান দ্যাট।বলিউড ডিডনট ইনভাইট মি টু দ্য বিগ পার্টিজ।


    - কেন?


    - আপনা আপনা আন্দাজ হোতা হ্যায় ভাই।ওখানে সব পার্টির আলাদা আলাদা সার্কল আছে।বিজনেস আছে। স্ট্র্যাটেজি আছে। ছোড়ো।আই ডিডনট এনজয় দেম ইফ ওয়ানস ইন আ ব্লু মুন আই ওয়জ কল্ড। আই রাদার এনজয়েড মাই এন এস ডি স্টাফ। 


    - সবার দ্বারা সবকিছু হয় না।তাই না?


    - নহি। যেটা হবে সেটা নিজে বুঝে নিতে হবে।


    - আমার দ্বারা রক্তিমের সঙ্গে সংসার করা হবে না।বুঝলে?


    - শোচ লিয়া?


    - বিলকুল। হাতের পুতুল করে রাখবে। ভার্বাল অ্যাবিউজ করার টেনডেন্সি আছে এখনি।মনে হয় ইন ফিউচার দ্যাট উইল টার্ণ টু ফিজিক্যাল অ্যাবিউজ। আই রিফিউজ টু বি আ ভিক্টিম। 


    -গুড।বাতা দো উসে।


    - বলবো। এখন আড়াল দিচ্ছি।নদী বাঁধের সামনে শুনেছি নেচারাল সাকসেশন দিতে হয়।


    ইরফান হা হা করে হাসলেন।বহুদিন বাদে হা হা করে হাসি শুনল ও। ত্রিদিব কখনো হা হা করে হাসেন না। হাসেন। পরিমিত।মেপে।দেবরূপ শান্ত হাসে। বিচক্ষণ । হা হা করে হাসে জাহির। ঈশান মজুমদার কী কখনো হা হা করে হাসে? কে জানে! ইরফানের হাসির মধ্যে একটা নিষ্কলঙ্ক চাঁদের আলো আছে । হালকা মনে হল অনেকটাই নিজেকে। 


    ভিয়েতনাম ।নেদারল্যান্ড। ওরা কোস্টাল ডাইক বানায়।নদীর সামনে ম্যানগ্রোভ হল স্বাভাবিক সাকসেশন।সল্ট টলারেন্ট সাকসেশন। তারপর একটা প্রাকৃতিক সূত্র অনুসারে গাছ লাগাতে হয়।প্রথমে ধানীঘাস।তারপর বানিঘাস।খলসে।গোলপাতা।কেওড়া।গর্জন।গরিয়া।কাঁকড়া।ধুঁধুল।পশুর। শেষে সুন্দরী।


    জানো ইরফান।যদি জাহিরদের সঙ্গে না যেতাম, যদি করুণা সাহা, নিবারণ সাঁতরা, জালালদের সঙ্গে কথা না বলতাম, যদি হলুদপাতা না দেখে আমার চোখ জ্বলে না যেতো, তাহলে আমি অরণ্যের প্রাচীরের কথা জানতে পারতাম না।ওরা নোণাসহনশীল ধান রুইবার কথা ভাবছে।পুকুরপাড় উঁচু করে জাল দিয়ে মাছ চাষ করার কথা ভাবছে।টালার পেছনে হাওয়াই স্যান্ডাল পরা সৌগত দাসের সঙ্গে কথা না বললে আমি এইসব কিছুই জানতে পারতাম না ইরফান।


    ওর চোখ দিয়ে ঝরঝর করে জল পড়ছে।বাচ্চাগুলো কী রুগ্ন। শীর্ণ। মেয়েগুলো পরণে দুটোর বেশি কাপড় নেই । আমরা গেলে কী হাসি ওদের মুখে।চা করে দিতে চাইছে ঐ স্কুল বাড়িতে আধপেটা খেয়ে থেকে।এদের আমি আগে কখনো দেখিনি ইরফান।


    জাহির ফোন করেছে?


    - করুণা ফোন করেছিল? গিয়েছিলি?


    - গেছিলাম। তোর শরীর কেমন আছে রে? কোভিড টেস্ট করিয়েছিস।


    জাহির ওর স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে হা হা করে হাসল।


    - শোন।টেস্ট করালে পজিটিভ আসবে। ডোন্ট ওরি। আই উইল বিট দ্য'ফিভার।


    - পাগলামি করিস না ভিকি। কাকিমা কিন্তু বাড়িতে একা। তোর সিরিয়াস কিছু হলে, কী হবে বলতো?


    - নাথিং সিরিয়াস উইল হ্যাপেন। অক্সিজেন ইনটেক ভাল আছে।আই হ্যাভ চেকড।তোকে যেটা বলছি সেটা শোন। নিজেরা নিজেরা আর যাস না এখন।


    - হোয়াট ডু ইউ মিন বাই নিজেরা নিজেরা? তুই কী আমাদের সেভিয়ার?


    - ইউ ডোন্ট নো দ্য লোকাল মাস্তানস। একদম যাবি না।


    - আর করুণা?


    - কিছু কিছু ব্যাপারে চুপ করে থাকতেই হয়। ওখানে আমরা কিস্যু করতে পারবো না।মাঝখান থেকে যেটুকু ত্রাণ নিয়ে যাচ্ছি তাও আর'হবে না।


    - এটা তুই বলছিস, ভিকি?


    একটা লম্বা শ্বাস এল ওপার থেকে।


    - বলছি।যাস না।প্লিজ ।


    টুপুর ফোন রেখে দিল ।বাগানে একটা রঙ্গন গাছে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন ইরফান। জানালার কার্নিশ থেকে দু চোখে অপার বিস্ময় নিয়ে উঁকি দিচ্ছে টিকটিকি। মিহি রাতের আলোতে বিপর্যস্ত বাগানও কেমন অপার্থিব দেখায়।নিজেকে গোছাতে কত সময় লাগে!কেউ কী আদৌ নিজেকে মনের মত করে গুছিয়ে নিতে পারে? আর মন তো পাল্টাতে থাকে। গত কয়েক বছরে মন চরকি পাক খেয়েছে। 


    - ইরফান , আমি একটু মনকে শান্ত করতে চাই। আই অ্যাম ভেরি রেস্টলেস।যা করি, মন শান্ত' হয় না। তুমি কিন্তু আবার মেডিটেট করতে বোলো না।এসব দিয়ে আমার হবে না। আই অ্যাম নট দ্যাট টাইপ।


    - যব শান্ত হোনা হ্যায়, তো হো যাওগে।ফিকর মত করো। জিন্দগি কো বহনে দো। 


    - অ্যান্ড মাই ডিসিশন? টু রিজেক্ট রক্তিম?


    কী মিষ্টি করে হাসলেন ইরফান।সামনে এসে কপাল থেকে সরিয়ে দিলেন অবাধ্য চুলের গুচ্ছ। 


    - দেখো। রিজেক্ট এক শব্দ হ্যায়। কাউকে রিজেক্ট করলেই সে মন থেকে চলে যায় না। সময় নাও। আস্ক ইওরসেল্ফ। তোমাদের কালচারাল ব্যাকগ্রাউন্ড । সোশ্যাল সিকিউরিটি ।এসব নিয়ে ভাবো। শোচো।


    - ভেবেছি। আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি আ রেপ্লিকা অব মাই মাদার। লেট মি এক্সপেরিমেন্ট উইদ মাইসেল্ফ। 


    ইরফান সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন। 


    টিকটিকি বলল, "পালট " বলবে?


    ও হাসল। 


    না। 


    কিছুই ফিরে আসে না। না ঝড়।না আবেগ। না অনুভূতি।অন্য'কোনো ঝড় আসে।অন্য আবেগ। অন্য অনুভূতি।একটা ইকোলজিক্যাল ট্র্যাজেডি ঘটে গেছে। তার অতি সামান্য কিছু দেখেছে ও। এরপর হয়তো আরো বড় কিছু ঘটবে, যেভাবে এগোচ্ছে পৃথিবী।যেসব গাছ নিজেদের প্রাণ দিয়ে মানুষকে বাঁচিয়েছে, তারা মাটিতে মিশে গেছে। আর ফিরবে না।এ সব হিউম্যান কসড ডিসাস্টার।টিকটিকি বলল, কী ভাবছ? 


    ও ঘাড় নাড়ল। চকচক করে উঠল চুল। 


    কিছুদিন আগে পড়ছিল অমিতাভ ঘোষের দ্য হাংরি টাইড।হেনরি পিডিংটন নামে এক সাহেবের কথা আছে।সে ঝড় বড় ভালোবাসতো। যেমন করে মানুষ পাহাড় বা তারাদের ভালোবাসে তেমন করে নয়। যেমন করে সে ভালোবাসে বই কিংবা সঙ্গীত।প্রিয় লেখকের জন্য বা সঙ্গীতকারের জন্য যে ভক্তি থাকে, সেই ভক্তি ছিল তার।সে ঝড় পড়তো, বুঝত, তাদের জানতে চাইত।এত ভালোবাসতো তাদের যে নতুন একটা নাম দিয়ে ফেলল।সাইক্লোন।


    তাদের বাড়িতে খুব শিগগিরই একটা সাইক্লোন আসতে চলেছে ।সিক্সথ সেন্স বলছে। কিছুই আর আগের মত হয়ে ফিরবে না।হাজারবার " পালট" বললেও না। কোনোদিনই না। কে আনল এত বদল? করোনা? না আম্ফান? (চলছে)


    # করোনাকালীন ( দুই)


    ছাব্বিশ 


    বাড়িটা অনেক অন্যরকম মানে পরিস্কার মনে হচ্ছে। নাকী এতদিন বাড়ির বাইরে থাকার ফলে চেনা জায়গা নতুন লাগছে! আসলে পলি নিজের হাতে সমস্ত বাড়ি পরিচ্ছন্ন করে চলেছেন।নার্সারির কাজ এখন বন্ধ আপাতত। শুধু বেসিক মেইনটেইনান্স। সেটা জয়সন ও বেরিল নামে দুটি ছেলে একবেলা এসে করে চলে যায়। পলি এতদিন বাড়ি থেকে বাইরেই যাননি।অনিলের সম্পূর্ণ তত্ত্বাবধান, বাচ্চাদের দেখভাল করার পর যা সময় পেয়েছেন, বাড়ির পেছনে দিয়েছেন।


    বেশ কিছু ইনডোর প্ল্যান্ট পাল্টানো হয়েছে।ভেলভেটের মত ঝকঝক করছে পাতাগুলি ।সেরামিকের বাছাই করা পটে গাছগুলি রাখা। অনিল তার সামনে সাবাই ঘাসের একটি মাদুর বিছিয়ে প্রাণায়াম করতে বসলেন। 


    কোভিড নাইন্টিন তাঁকে অসম্ভব দুর্বল করে দিয়েছে। পলি যত্নের ত্রুটি রাখেননি, বরং বলা যায় যত্নের ওভারডোজ হয়েছে।


    কিন্তু মনের মধ্যে কীটদংশন করলে , বাইরের যত্নে কিছুই হয় না। অনিল একটা ব্রিদিং এক্সারসাইজ করছেন। শ্বাস টেনে ধরে রেখেছেন প্রায় তিরিশ থেকে চল্লিশ সেকেন্ড। এটা যদি অনায়াসে করা যায়, তাহলে ধরে নেওয়া যায় ফুসফুস অনেকটাই ভালো আছে। প্রথমে একটু অসুবিধে হচ্ছিল কিন্তু এখন তিনি অনেকটাই সহজভাবে শ্বাস টেনে রাখতে পারছেন। এটা করলে আর কিছু না হোক, কনফিডেন্স পাওয়া যায় কিছুটা।অনিলের এখন কনফিডেন্স বড় দরকার। পলিকে কিছুতেই কিছু বলা যাবে না।কখনোই না।


    এই মে মাসে কেরালাতে সেকেন্ড ওয়েভ অ্যাটাক ফিরে এসেছে এবং এটা একেবারেই আশাতীত।নুহ যেভাবে কাজ করেছিলেন এবং যেভাবে ট্র্যাকিং চলছিল তাতে কেউ ভাবেনি যে সেকেন্ড ওয়েভ এত ভয়াবহ, এত মারাত্মক হবে।মার্চ মাস থেকেই এখানকার হেল্থ কেয়ার ওয়ার্কাররা ঘরে ঘরে সাইকো সোশাল সাপোর্ট দিয়ে চলেছে।প্রায় সওয়া দুশো কর্মী ওভার টেলিফোন কাউনসেলিং করে চলেছেন।এই ধরনের টেলিফোনিক কাউনসেলিং ভারতবর্ষে এক অভিনব প্রয়াস।এই বছর আতাকুল পোঙ্গাল কীভাবে হবে সেই নিয়েও সরকারি তরফে বিশদ চিন্তাভাবনা ছিল।মেয়েদের এই ধর্মাচরণের জন্য তিরুভানন্তপুরমে মন্দির খুলে দেওয়া হয় ঠিক কিন্তু সরকারের তরফে বারবার বলা হয়েছিল যাতে বেশিরভাগ মানুষ বাড়িতে বসে পোঙ্গাল উদযাপন করেন।


    এরপরে আবার ব্রেক দ্য চেইন নামে একটি প্রোগ্রাম রাখা হয়।একটি গণ হস্ত প্রক্খালন প্রজেক্ট ।রেল স্টেশনে, বাস স্ট্যান্ডে ও বিভিন্ন পাবলিক স্পেসে, জলের ব্যবস্থা ও হাত ধোবার জন্য'লিকুইড সাবান রাখা হয়েছিল।সমুদ্র সেতু অ্যাপ পর্যন্ত চালু করা হয়েছে।তবু শেষরক্ষা হয়নি।ভাইরাস দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে ফিরে এসেছে রোল মডেল হিসেবে ভূষিত হওয়া রাজ্যতে।


    অনিলের টেনশন হচ্ছে পলিকে নিয়ে ।তাদের বাড়িটি যদিও একটি নিরিবিলি জায়গায় এবং মনুষ্য বসতি কম এই এলাকাতে, কিন্তু পলি তাঁর পরিচর্যা করেছেন, জিনিসপত্র নাড়াঘাঁটা।পুরো আটাশদিন এই কাজগুলো পলি নিজের হাতে করেছেন। তারপর আবার আরো অদ্ভূত কান্ড।প্রথমে হু বলেছিল যে ভাইরাসটি ড্রপলেট বাহিত।এখন আবার শোনা যাচ্ছে যে সে নাকী বায়ুবাহিতও বটে।


    অনিল বুঝতে পারছেন যে তিনি প্রাণায়াম করছেন বটে কিন্তু সেটা তেমন এফেক্টিভ হচ্ছে না।কারণ কনসেনট্রেশন আসছে না।বিক্ষিপ্ত মন এখান থেকে ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে ।অনিল নিজেই খাবি খাচ্ছেন নিজের মধ্যে। 


    তাঁর ব্যবসা মুম্বাই বেসড। ভারতীয় কাপড়জামার , টেক্সটাইলের একটা বিশাল চাহিদা আছে ইউনাইটেড আরবস এমিরেটস এ। লকডাউনে সমস্ত বন্ধ হলেও একটা ভরসা যে দুবাইতে এখনো প্রচুর টেক্সটাইল স্টোর করা আছে। আপাতত ছ' মাস ও'যদি এক্সপোর্ট বন্ধ থাকে , ওদিকে সাপ্লাই দিতে অসুবিধে হবে না। কিন্তু গুজরাত ও মুম্বাই থেকে টেলররা সব চলে গেছে যে যার বাড়ি। পায়ে হেঁটে।শ্রমিক ট্রেনে। এরা এখনি ফিরতে পারবে না।ততদিন প্রোডাকশন বন্ধ থাকবে। এদিকে অনলাইন বাণিজ্য ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অনিল এবং তাঁর পার্টনারেরা গতকাল একটি গুগুলমিটে ঠিক করেছেন যে তাঁরাও এবার অনলাইন মার্কেটিং ধরবেন। টেক্সটাইলের চাহিদা কখনোই কম নয়।হোলসেল টার্গেট হবে প্রথমে।তারপর লোক্যাল কারিগররা, যারা বাড়িতে বসেই কাজ করতে পারবেন, তাদের কনট্যাক্ট করে রেডিমেড গারমেন্টসের দিকটা ধরা হবে।এর মধ্যে কোম্পানি বেশ কিছু ইয়ং ট্রেইনিকে ছেঁটে দিয়েছে। যে কজন আছে তাদের নিয়ে মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি ঠিক করা হবে এই সপ্তাহেই। এখন আর এক্সপোর্ট শুধু দুবাইতে নয়, ভারতের মধ্যেও অনলাইন ব্যবসা শুরু করবেন তাঁরা।অনলাইন ইজ দ্য থিংগ ।দুবাইতে নন অয়েল ইকোনমি, প্রাইভেট সেক্টর খুব মার খাবে না।এখন যদিও খুব টাইট মার্জিন, কিন্তু আউটপুটে লাভ আছে।নতুন কাজ শুরু করা যাবে।


    পলি এলেন কিচেন থেকে।বেশ রোগা হয়ে গেছেন তিনি। কলার বোনস স্পষ্ট। এত পরিশ্রম করছেন যে নিজের যত্নের সময় পাচ্ছেন না। চোখের নিচে কালি ।অনিলের খুব কষ্ট হল পলির দিকে তাকিয়ে বাচ্চারা অনলাইনে ক্লাস করছে ল্যাপটপে আর ডেস্কটপে। ইউনিফর্ম পরেছে। অনিল ম্যাটটা রোল করে বেতের চেয়ারে গিয়ে বসলেন।পলি স্যুপ আর টোস্ট রেখেছে । এখনো যতটা সম্ভব ব্লান্ট খাবার খাচ্ছেন তিনি। পাশের চেয়ারে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বসলেন পলি। একটা গোলাপি লং স্কার্ট। সাদা টপ। রোগা হয়ে বয়সটা অনেক কম মনে হচ্ছে কিন্তু মুখে ক্লান্তির ছাপ। অনিল পলির হাতের ওপর হাত রাখলেন । পলি খুব প্যাশনেট ভাবে তাঁর হাতটি জড়িয়ে মুখের কাছে নিয়ে বললেন, অনিল, লেটস গো ফর আ ওয়াক ইন দি ইভনিং। খুব সাফোকেটিং লাগছে।কতদিন বাড়ির বাইরে যাইনি। যাবে?


    অনিল স্ত্রীর কোঁকড়ানো চুলে ভরা মাথাটা নেড়ে বললেন, যাবো।


    চেঙ্গালাতে সব চার্চ বন্ধ মানে মাস বন্ধ।এখানে অনেক পুরোনো একটা চার্চ আছে যেখানে ল্যাটিন মতে প্রার্থনা হয়।সিরিয়ান মতে নয়।চোদ্দশো আটানব্বইয়ে ভাস্কো দি গামা এখানে এসে দেখলেন গোলমরিচ, দারচিনি আর এলাচের সুগন্ধ ভরা এক স্বর্গরাজ্য।আরো দুবছর বাদে মানে পনেরোশো খ্রিস্টাব্দে পেড্রোজ আলভারেজ কাব্রাল যখন কেরালাতে এলেন, ওঁর সঙ্গে এলেন আটজন ফ্রানসিস্কান যাজক, আটজন চ্যাপলেইন। এই দেশের মৌসুমী জলবায়ু, সূর্যস্নাত শ্যামলিমা, নদী, ঝর্ণা, লেক, ব্যাকওয়াটার, নারকেলগাছ সব মিলে জায়গাটা চমৎকার পছন্দ হয়ে যায় তাদের।একদিকে ওয়েস্টার্ন ঘাটের গভীর , ঘন জঙ্গল ।অন্যদিকে আরবসাগরের সাদা দুগ্ধফেননিভ সমুদ্রতট।


    ঐরকম একটা লাতিন মতাবলম্বী চার্চ আছে অনিলের বাড়ির থেকে হাঁটা পথ দূরত্বেই।পিছনেই জঙ্গল ।ঘন্টাখানেক হেঁটে ফাদার লরেন্সের চার্চ যেখানে লাতিন মতে উপাসনা হয়।যদিও এখানে সবাই ক্যাথলিক তবু উপাসনারীতি আলাদা।অনিল খুব ছোটবেলাতেও এই চার্চে চলে আসতেন।মাটির মেঝে ছিল তখন।গোবর দিয়ে চমৎকার করে নিকোনো।বড় বড় ডেঁয়ো পিঁপড়ে ঘুরে বেড়াতো। পাহাড়ের নিচে একটা গোরস্থান কূপ আছে।সেখানে গোর না দেওয়া হাড়, মাথার খুলি সব জড়ো'করে রাখা থাকত। ছোটবেলাতে অনিল ও তার বন্ধুরা এসে দৌড়ে ঐ কূপের দিকে যেতেন। দেখতেন মড়ার'মাথার'খুলি। একটুও ভয় করতো না। এখন ? অসম্ভব । 


    সেই পুরোনো চার্চের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন অনিল ও পলি। বিকেলে বাচ্চারা বাগানে খেলছে।ওঁরা দুজন হাঁটতে হাঁটতে এসেছেন ফাদার লরেন্সে র চার্চে।এখন অবশ্য মেঝে পাকা হয়েছে।


    অনেক অনেক দিন বাদে এই জনশূন্য চার্চের সামনে দাঁড়িয়ে কেমন অসহায় বোধ করছেন অনিল। অনিল টমাস। 


    চেঙ্গালাতে একটা বিশ্বাস আছে, শুধু চেঙ্গালাতে কেন, গোটা কেরালাতেই বলা যায়, আপোসল টমাস নিজে এসে এখানে একটি সম্প্রদায়কে বাপটাইজ করেছিলেন । সেইজন্য কেরলে টমাসের ছড়াছড়ি । কোথায় নেই! বেকারি, গয়নার দোকান, দাঁতের ডাক্তারের হোর্ডিং, রিয়েল এসটেট।সর্বত্র 'টমাস নামটি পাওয়া যাবে! 


    এখানে দাঁড়িয়ে অনিল ছোটবেলায় ফিরে গেছেন।পলি ঘুরে ঘুরে বাগানটি দেখছেন।এখানে রাবার প্ল্যানটেশনের শ্রমিকদের ম্যাস হয়।ফাদার লরেন্স কী সুন্দর করে বাও করতেন টুপি খুলে। সে সামনে ছেলে বুড়ো যেই থাক না কেন। মাস । কাইরির গান হত। একজন মানুষ একটা ভাঙা হারমোনিয়াম নিয়ে গাইতেন।কী অপূর্ব গলা! একটা মেকশিফ্ট অল্টার ছিল।পুরোনো কাঠের ডেস্ক, ছেঁড়া সাদা কাপড় দিয়ে ঢাকা।


    কাইরি এলিসন।এখনো তাঁর কথা মনে পড়লে অনিলের সেই গমগমে গলায় গান মনে পড়ে।লর্ড হ্যাভ মার্সি।লর্ড হ্যাভ মার্সি।


    এই গানটা গ্রিক ভাষাতে গাওয়া হত।তারপর ইংরিজি। পলির পেছন পেছন একটা কুকুর ঘুরছে। অনিলের মনে পড়ছে তাঁর ঠাকুমার কথা।সাতাশি বছর বয়সে তিনি কনফেশানে গেছিলেন।বারবার কনফেশান বক্স থেকে মাথা বের করে যাজককে জিজ্ঞেস করছিলেন, ফাদার, আমি কী কোনো পাপ স্বীকার করতে ভুলে গেছি? 


    কেন যে এত মৃত লোকেদের কথা মনে পড়ছে আজ? পলি চলে গেছেন চার্চের পিছন দিকে।কুকুরটি সঙ্গে সঙ্গে ঘুরছে। 


    এই চার্চের বারান্দায় ভোর চারটের সময় বৃদ্ধ মানুষদের ঘুমিয়ে থাকতে দেখা যায় । সকাল সাড়ে পাঁচটার প্রার্থনা যাতে বাদ না যায়, সেইজন্য তাঁরা প্রায় রাত থাকতে দূর দূরান্তের গ্রাম থেকে চলে আসেন এখানে।বারান্দাতে ঘুমিয়ে পড়েন।ধর্মবিশ্বাস মানুষকে দিয়ে কত কিছু করায়।


    এখানে সেইন্ট সিবাস্টিয়ানের স্ট্যাচু আছে। কৈশোর এই মূর্তি ঘাড়ে নিয়ে অনিল ও তাঁর বন্ধুরা দৌড়াতেন।ধূপ জ্বলতো। সঙ্গে যাজক থাকতেন।হিন্দু বাড়িগুলিও সানন্দে দরজা খুলে দিত মোমবাতি জ্বালিয়ে ।স্বাগত সেইন্ট সিবাস্টিয়ান।


    সেইন্ট সিবাস্টিয়ান রোগ , ব্যাধি দূর করে দেন।সর্বরোগনিবারক। যাজক সব বাড়িতে বাড়িতে পূত পবিত্র জল ছিটিয়ে দিচ্ছেন। ঘন্টা বাজছে।ধূপের পবিত্র গন্ধ! হে সেইন্ট সিবাস্টিয়ান। দয়া করো প্রভু! আমার রোগ দূর করো। আমাকে ব্যাধিমুক্ত করো।নিজের অজান্তেই কখন হাঁটু মুড়ে, হাত জোড় করে বসে পড়েছেন অনিল!


    কেরলের খৃষ্টানের কাছে চার্চ হল আত্মিক মুক্তির স্থান।ঐ যে বিশপরা আসছেন সেজগুজে। এখানে সবাই খুব জাঁকজমক, আড়ম্বর ভালোবাসে।গভীর জঙ্গলের সামনে সেই আড়ম্বর কিন্তু দৃষ্টিকটু হয় না। তার মধ্যে আত্মার কান্না থাকে যে! 


    হে সেইন্ট সিবাস্টিয়ান। আমাকে নিরাময় দাও প্রভু।অনিলের দু চোখ দিয়ে হু হু করে জল পড়ছে। আমি বাঁচতে চাই।বাচ্চাদের জন্য, পলির জন্য, এই প্রিয় গ্রামে সবুজের মধ্যে হেঁটে বেড়ানোর জন্য আমি বাঁচতে চাই!


    যখন বিশপরা সেজেগুজে আসতেন, মনে হত কোনো মধ্যযুগীয় সভা বসেছে ।গ্লোরি টু দ্য গড! প্রভু প্রাণ দাও। কোনো কোনো বিশপকে তো অমন সাজগোজ করা অবস্থাতেই সিংহাসনে বসিয়ে সমাধিস্থ করা হত! হিন্দুরাও ভিড় করে আসতো দেখতে। আয়াপ্পা। জঙ্গলের প্রাচীন দেবতা। আয়াপ্পাকে গান গেয়ে ঘুম পাড়াতেন সঙ্গীতশিল্পী যেসুদাস। যিশুর দাস তিনি । কী মধুর কন্ঠ। গান গেয়ে হিন্দু দেবতাকে ঘুম দিচ্ছেন। জঙ্গল থেকে গান ভেসে আসছে ।কী সুর! কী মূর্ছনা! 


    আমাকে বেঁচে থাকতে দিও প্রভু।অনিল কাঁদতে কাঁদতে মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন।


    পিঠের ওপর দুটো নরম হাত।পলি। নরম হাত দুটো শক্ত করে টেনে তুলছে অনিলকে। 


    - ওঠো। যাস্ট গেট আপ। বসো এখানে। আমাকে বলো কী হয়েছে। প্রথমে ভাবতাম কোভিডের জন্য টেনশন।নাউ দ্যাট ইউ হ্যাভ ওন দ্য ব্যাটল, এখন কী? আমি অনেকদিন থেকে দেখছি তুমি কিছু একটা লুকাচ্ছ। ইউ আর হাইডিং সামথিংগ ফ্রম মি। আমাকে জানতেই হবে।বলো কী হয়েছে। 


    অনিলের শরীরে শক্তি এখনো ফিরে আসেনি। কোভিড অনেকটাই ধ্বংস করেছে কোষগুলিকে।


    সমস্ত শক্তি শরীর মন দিয়ে সম্মিলিত করছেন বাক কে। আর পারছেন না। যেসুদাসের সুরেলা গান ভেসে আসছে যেন। অনিল চোখ মুছছেন।


    - পলি, আই হ্যাভ আ নুডল অন মাই লাংস। ইট মে বি কারসিনোমাস! ( চলছে)


    করোনাকালীন (দুই)


    সাতাশ


    রাতের একটা নিজস্ব গন্ধ থাকে। দিনের বেলা সেই গন্ধ পাওয়া যায় না। হতে পারে রাস্তার গন্ধ।অথবা ঘাসের গন্ধ । অথবা কোনো বেড়ালের নিঃশব্দ হাঁটাহাটির গন্ধ। ভাত উথলানোর'গন্ধ বা রুটি বেলার। আবর্জনার গন্ধও হতে পারে।এইসব গন্ধ মনের ওপর তীব্র অভিঘাত আনে। বিশেষ করে কোনো পার্টিকুলার দিনে। যেদিন কোনো খুব ভালো খবর থাকে। বা খুব খারাপ খবর।আজকের রাতটার সঙ্গে জড়িয়ে আছে চাঁপা ফুলের মিষ্টি গন্ধ, যেটা পলির অনেক অনেকদিন মনে ছিল। দোতলার ব্যালকনির ঠিক মুখোমুখি বাগানের মধ্যে দীঘল চাঁপা গাছ। 


    পলি আর অনিল বারান্দায় বসে আছেন পাশাপাশি।বাচ্চারা ডিনারের পর ঘুমিয়ে পড়েছে।সকাল থেকে অনলাইন ক্লাস।ভোরে উঠতে হয় ওদের।পলিকে ব্রেকফাস্ট রেডি রাখতে হয়। আটটা থেকে টানা ক্লাস। চোখের ওপর স্ট্রেইন পড়ছে ওদের।মেয়ে বলছিল চোখে ব্যথা। পলি ভাবছিলেন একদিন আই স্পেশ্যালিস্টের সঙ্গে অ্যাপয়ন্টমেন্ট করলে হয়।খুব তাড়াতাড়িই যাবেন ভাবছিলেন। বিকেলের পর সব প্ল্যান কেমন তালগোল পাকিয়ে গেল। পড়ে আছে ডাল ভেজানো। মশলা তুলে দিয়েছেন ফ্রিজে।আভিয়াল বানাবেন ভেবেছিলেন।মিষ্টি কুমড়ো, সজনে ডাঁটা, কলা, পেঁপে সব কেটে রাখা ছিল। অনিল আভিয়াল খুব পছন্দ করেন । সব সব্জি ছোট ছোট স্টিলের বাটিতে করে ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখেছেন।দইটাও তুলে দিয়েছেন। নিজেদের জন্য দুপুরের ইডলি। ছেলেমেয়েদেরও ইডলি খাইয়ে শুতে পাঠিয়ে দিয়েছেন। তারা খুব অবাক হয়েছে। আউটহাউস থেকে অনিল বাড়িতে ফেরার পর সারা দিন জুড়ে একটা উৎসব উৎসব ব্যাপার চলে।আজ হঠাত্ করে সব যেন নিভে গেছে।নালুকেতু অন্ধকার ।পলি প্রদীপ জ্বালাননি। অথবা ভুলে গেছেন।কিন্তু পলির ছেলেমেয়ে খুব বাধ্য।বিশেষ করে দুবাই থেকে ফিরেও অনিলের এতদিন আউটহাউসে থাকা তাদের ছোট্ট বয়সেও পরিণত করে দিয়েছে।পলি তাদের কোভিড নাইন্টিনের সবরকম দিক যতটা পারা যায় গুছিয়ে বলেছেন, মানে ছোটদের যতটা বলা যায় । ওরা বিশেষ কিছু না বলে নিজের নিজের গল্পের বই নিয়ে শুতে চলে গেছে। রিংগো একটু ঘ্যান ঘ্যান করতে যাচ্ছিল কিন্তু তার ছোট্ট দিদিটি বড় কড়া। সে ভাইকে গল্প বলার লোভ দেখিয়ে শুতে নিয়ে গেছে । পলি এই অভ্যেস ওদের করিয়ে দিয়েছেন। আফটার স্কুল নো নেট কানেকশন। 


    বেশ হাওয়া দিচ্ছে।ভারি হাওয়ায় ফিরে ফিরে আসছে চাঁপা ফুলের গন্ধ। এই মুহূর্ত খুবই রোম্যান্টিক হতে পারত। পলি একটা পিচ রঙের সরু জরিপাড় চান্দেরি পরে মাথায় দিতেন ফুলের মালা।অনিল বলে উঠতেন, এমবামড ডার্কনেস! হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে থাকা হাত। এসব কিছুই হল না। শুধু ফুলের গন্ধ থেকে গেল এই রাত আর এই দুঃস্বপ্নযাপনের সঙ্গে । পলির অনেকদিন মনে ছিল।এই রাত। এই পাশাপাশি বসে থাকা।


    অনিল চোখ বন্ধ করে বসেছিলেন । একটু হালকা লাগছে তাঁর।পলির অধিকার আছে সমস্তটা জানার।বড় ভুল করেছিলেন তিনি।


    এতদিন ধরে একা যে ভার বহন করেছেন তা বড় কাহিল করেছে তাঁকে ভেতরে ভেতরে।বুকের ভেতরে একটু হালকা ভাব যেন। অনিল চোখ খুললেন। তাকালেন পলির দিকে।পলি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে অন্ধকারে।সোজা বসে আছেন।যেন চোখের পাতা পড়ছে না।ভেতরে টেনে নিচ্ছেন সমস্ত অন্ধকার।গাঢ়। বেদনাময়। বললেন,


    - আমি কোনো কথা শুনবো না।লিভ এভরিথিং টু মি।আমরা মুম্বাই যাচ্ছি। কোকিলাবেন। 


    আই উইল ডু দ্য বুকিং অ্যান্ড অ্যারেন্জ অল অ্যাপয়েন্টমেন্টস। 


    অনিল ক্লান্ত।যেন ফুরিয়ে গেছেন অনেকটাই।


    - পলি! ইটস লকডাউন!


    - আমরা মেডিক্যাল গ্রাউন্ডে যাব। দেয়ার মাস্ট বি সাম ওয়ে আউট।


    - শোনো। আমি মুরুগনকে নিয়ে যাই বরং।আই উইল আস্ক দেবরূপ টু জয়েন।হি ইজ ভেরি এফিশিয়েন্ট। তুমি বাচ্চাদের নিয়ে বাড়িতে থাকো।এভরিথিং উইল বি ডান ইন টাইম।


    - নো। আই হ্যাভ ডিসাইডেড এভরিথিং আদারওয়াইজ । মা এসে এখানে থাকবে বাচ্চাদের নিয়ে । এমিলি থাকবে।মুরুগন উইল টেক কেয়ার অব দেম । আমরা দুজন যাবো। অব কোর্স ইউ ক্যান আস্ক দেবরূপ টু জয়েন। দ্যাট ইজ ওয়াইজ। আমি রাতেই নেটে বসছি। অ্যাপয়েন্টমেন্ট চাই।


    - আর ইউ ক্রেজি পলি? কীভাবে যাব। অল ফ্লাইটস আর ক্লোজড। মুম্বাইতে হোটেলস আর ক্লোজড।


    পলির শিরদাঁড়া ব্যথা করছে ।টনটন করছে।একটু পিঠ ভিতরের দিকে বেঁকিয়ে, শ্বাস নিলেন। বললেন, থাকার একটা কিছু ব্যবস্থা হয়েই যাবে। সো মেনি গেস্ট হাউসেস আর দেয়ার।তোমার পার্টনারেরা রয়েছে।টেল দেম টু অ্যারেন্জ আ রুম। দরকার হলে বাই কার যাবো। বাট উই হ্যাভ টু গো। 


    পলির গলাতে কেমন একটা অদ্ভুত প্রত্যয়।অনিলের গা শিরশির করে উঠল। তাহলে কী ভালোও কিছু হতে পারে? ইজ ইট পসিবল? 


    পলি মাথা রাখলেন অনিলের কাঁধে। শোনো। আমি আগে কোকিলাবেনে কথা বলি। দরকার হলে গাড়িতে যাব। তুমি পারবে । পারতেই হবে।কিন্তু তার আগে , যাবার আগে আমরা একবার কুরিসুমালা আশ্রমে যাবো।প্লিজ। খুব তাড়াতাড়ি ।কাল ।বা পরশুই। আই ওয়ান্ট টু অফার মাই প্রেয়ারস। 


    কুরিসিমালা আশ্রম চেঙ্গালা থেকে চার পাঁচ ঘন্টার পথ। এরিথুপেটা শহরের প্রান্তে আশ্রমটি। এরিথুপেটা একটি মুসলমান অধ্যুষিত শহর। এই আশ্রমটি সেখানে বেশ ভালোভাবেই চলছে।শহরের একটু বাইরে। অতি নির্জন জায়গায় পাহাড়ের কোলে।চারদিকে কেবল সবুজ ঘাস আর ঘাস। বাতাস বয়ে যায় ঘাসের ওপর দিয়ে । শব্দহীন এই সবুজসাম্রাজ্যে একটি মেডিটেশন সেন্টার আছে।ভোরবেলা চারটের সময় কুয়াশাতে ঢাকা পড়ে যায় যখন চারদিক, তখন সেখানে ধ্যান শুরু হয়। যদি কোনো শব্দ শ্রুতিগোচর হয়, তবে তা হল গরুর গলার ঘন্টাধ্বনি। 


    কুরিসিমালা আশ্রম যাবার কথা শুনে কয়েক সেকেন্ডের জন্য হলেও অনিল আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে উঠলেন।সেই লঙ ড্রাইভ! সেই সবুজ ঘাসের দেশ।শুধু চোখ জুড়িয়ে যাওয়া সবুজ। তারপরেই বুক ধ্বক করে উঠল। এই কী শেষবার! পলি? 


    পলি শান্ত । চুপ করে বসে আছেন কাঁধে মাথা রেখে।গলার কাছে ঠেলে আসছে কান্না। কিন্তু এখন একফোঁটা চোখের জলও নির্গত হতে দেওয়া যাবে না। অনিল উইল বি ব্রোকন।


    পলি জানেন।তিনি জানেন যে খুব কঠিন দিন সামনে।মুম্বাইতে হু হু করে সংক্রমণ বেড়ে যাচ্ছে। খুব রিস্ক হবে এই সময় যাওয়া ।কিন্তু তার থেকেও খারাপ হবে নুডলটার ডায়াগনোসিস ফেলে রাখা। যদি খারাপ কিছুই হয়, ট্রিটমেন্ট শুভ বি স্টার্টেড অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল। তার পরের কথা আর পলি ভাবতে পারছেন না। ঐ আগুনের মধ্যে লাফ দিয়ে পড়ার আগে একবার কুরিসিমালা যেতে চান। একবার।


    উনিশশো পঞ্চান্ন । বেলজিয়াম থেকে এসেছিলেন জন। আর ফরাসী দেশ থেকে এসেছিলেন অ্যাবে মোনাহনিন। লে সঁস। কেরলে খৃষ্টধর্ম প্রচারে এসেছিলেন । মিলে গেল ভারতীয় দর্শন।


    জাকারিয়া মার আথানাসিয়স।তিরুভালার বিশপ।ভারতবর্ষের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলের সমান্তরাল সহ্যা পর্বতমালার ঠিক কেন্দ্রে খৃষ্টান সাধুদের জন্য এই আশ্রমটি তৈরি করেছিলেন। উনিশশোসাতান্ন সালের নভেম্বর মাসে খৃষ্টাধর্মাবলম্বী কিছু সাধু, যাঁরা হিন্দু আধ্যাত্মিকতাতেও বিশ্বাস করেন, তাঁরা গড়ে তুলেছিলেন এই কুরিসিমালা আশ্রম।


    অষ্টআশি একর জমি দিয়েছিলেন জাকারিয়া ।শুধু অনাবিল ঘাসজমি।সহ্যাদ্রির কোলে।নীলাভ সবুজ পাহাড়। চারদিকে শুধু নির্জনতা।নৈঃশব্দ্য ।


    সাইলেন্স। নিঃশব্দ।পলি খুঁজছেন।হাত বাড়াচ্ছেন মনে মনে।একটি আশ্বাসের হাত। তাঁদের বাড়িতে যখনি কোন অতিথি বন্ধু এসেছেন, অনিল ও পলি তাদের নিয়ে ব্যাকওয়াটার বা কোভলম বেড়াতে যাননি। নিয়ে গেছেন কুরিসিমালা। ওখানে ঢোকামাত্র একটা অদ্ভূত শক্তিশালী শান্তি।পলি চোখ বুজে ভাবছেন। তাঁর ভাবনা তরঙ্গায়িত হচ্ছে অনিলের মধ্যে।মাউন্ট অব ট্রানসফিগারেশন।প্রভু যিশু ভালবাসতেন পর্বতের কন্দর। বিশ্রাম করতে যেতেন পাহাড়ের কোলে।প্রত্যেকটি যুদ্ধের পরেই বিশ্রাম প্রয়োজন।পলি জানেন, আরো বড় যুদ্ধ শুরু হতে যাচ্ছে।সিনাই পর্বতের চূড়ায় মোজেস শুনেছিলেন ঈশ্বরের বাণী। সৃষ্টির গান।ছোটবেলা থেকে বাইবেলে পড়েছেন।পিটার বলেছিলেন মাউন্ট ট্যাবরে গিয়ে " ইট ইজ গুড টু বি হিয়ার।" পলি ঐ অনুভূতিটুকু আসন্ন যুদ্ধের জন্য নিজের মধ্যে সংগ্রহ করতে চান।তাছাড়া একটা লং ড্রাইভে বোঝা যাবে অনিল মুম্বাই যাত্রার ধকল কতটা নিতে পারবেন। কিন্তু যেতে তো হবেই। 


    অনিলের চুলের চেনা গন্ধ বহুদিন বাদে নাকে আসছে ।পলি চাইছেন।আপ্রাণ চাইছেন একটি অনন্ত ভালোলাগাকে নিজের মধ্যে ধারণ করতে।ছড়িয়ে দিতে।তা নইলে সামনের জার্নি বড় কঠিন হয়ে যাবে।তিক্ত। পলি কিছুতেই সেটা হতে দেবেন না।


    শৈশব থেকে কুরিসিমালা আশ্রমে যাতায়াত তাঁর।ফ্রান্সিস আচার্য বড় স্নেহ করেন। মোট কুড়ি জন সেবক।তার বেশি অনুমতি প্রাপ্ত নয়। তাঁদের এখানে থাকার একটিই শর্ত। ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দ সব ত্যাগ করতে হবে।বাড়ির সঙ্গে কোনো সংশ্রব থাকবে না। 


    পলির একবার সেখানে যাওয়া বড় দরকার।শক্তি চাই।অনেক শক্তি।কুরিসিমালার সঙ্গে বহির্জগতের কোনো সম্পর্ক নেই। কোভিড নাইন্টিন স্পর্শ করেনি আশ্রমের ঘাসজমি। প্রকৃতি অনাবিল ওখানে।


    অনিল বললেন,ইজ ইট পসিবল টু গো দেয়ার ডিউরিং লকডাউন ? ওরা অ্যালাউ করবেন?


    - আই উইল টক টু ফ্রান্সিস স্যর। বোথ অফ আস আর নেগেটিভ। সার্টিফিকেট আছে।


    পলির মামা আশ্রমের একজন সাধু।কিন্তু এঁরা ব্যক্তিজীবনের কারু সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না।পলির সঙ্গে কথা বলেন , যেন কোনো অপরিচিত আপনজন। কাছাকাছি প্রায় একশোটি পরিবার আছে যাদের পেশা গো পালন।কথায় বলে কুরিসিমালাতে বয়ে যায় মধু আর দুধ। পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে গাছে মধুর আবাস। আর দৈনিক সাড়ে এগারোশো লিটার দুধ উৎপন্ন করে আশ্রমের সহায়তা করে ঐ গো পালক পরিবার গুলি। 


    সাধুদের গোত্রটি সিসটারসিয়ান সম্প্রদায়ের । এঁরা সারাদিন মাঠে কৃষিকাজ করেন।আশ্রমের নিয়ম। ব্রেড লেবার। নিজের খাদ্যটুকু নিজে উপার্জন করো। পাঁচ ঘন্টা জমিতে কাজ। রন্ধন। আশ্রম পরিস্কার । অতিথিদের ক্ষেত্রেও একই নিয়ম। কোনো খাদ্য অপচয় করা চলবে না। নিজের অংশ থেকে কিছু দিতে হবে দরিদ্রকে ।


    অনিলের পজিটিভ ধরা পড়ার পর থেকে পলি অনেক ভেবেছেন এই কোভিড সিচুয়েশন নিয়ে ।চুপচাপ কাজ করে গেছেন আর ভেবেছেন।তাঁদের একটা ফিনানশিয়াল সেট ব্যাক হয়েছে বৈকী। কিন্তু খাওয়া পরার অভাব নেই। ইমিডিয়েট চিন্তার কিছু নেই। বাট মেনি হ্যাভ লস্ট এভরিথিং ।একটা ভাইরাস পৃথিবীকে বাড়িতে বসিয়ে দিয়েছে। মানুষ কী বড় বেশি কলুষিত করেনি প্রকৃতিকে? পলির মুম্বাই ভালো লাগে না এখন। দম বন্ধ হয়ে আসে। নভি মুম্বাই ইজ বেটার। তবু যেতে হবে। হসপিটালে শ্বাসরোধ করে অপেক্ষা ।


    তার আগে অক্সিজেন চাই। দীর্ঘদিন টেনশন, আতংক আর রোগ নিরাময় করতে করতে প্রিয় গৃহকোণটিও অসহনীয় লাগে। 


    পলি একবার ঐ প্রার্থনা আর কৃষি কাজের স্বর্গরাজ্যে যেতে চান। সাধকরা সারাদিন গান গেয়ে যান ওখানে। পাঠাভ্যাসের আলাদা সময় আছে।লাইব্রেরি। সন্ধ্যায় গান। এই পৃথিবীকে ভালো রাখো প্রভু। পৃথিবীর মঙ্গল করো। 


    আশ্রমের মূল কথা আনন্দ থেকে আনন্দের দিকে যাত্রা । মন শক্ত করছেন পলি। যাই হোক।অনিলের ও নিজের সমস্ত দিনগুলি আনন্দে ভরিয়ে রাখবেন তিনি। হাসপাতালে বসেও যেন মনে হয় " ইট ইজ গুড টু বি হিয়ার।" 


    অনিলের নিরাময় কামনা শুধু নয়। প্রাণ ভরে জগতের নিরাময় চাইতে হবে। ফ্রান্সিস আচার্য দেবেন না থাকতে?দুদিন।যাস্ট টু ডে'জ।


    উঠে গেলেন পলি। অনিল একা বসে। অন্ধকারে। পলি বাথরুমে গিয়ে কল খুলে দিয়েছেন। জল পড়ছে শব্দ করে। 


    হাউ হাউ করে কাঁদছেন পলি। মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে শব্দ। কথা।যে কথা পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ বলে তার নিজস্ব ভাষাতে। যখন মারণরোগ আসে বা বিপর্যয় ।


    আমার সঙ্গেই এইসব কেন হতে হল হে ঈশ্বর? কেন আমার সঙ্গেই?( চলছে)


    # করোনাকালীন (দুই)


    আটাশ


    অনেক গভীর জলের নিচে তলিয়ে গেলে শরীর যেমন হালকা পালকের মত ওপরে নিচে ডাইনে বাঁয়ে ভাসে, ঐ যেমন ফিল্মে দেখায়, মালবিকা ঐরকম ভাসছিলেন।।যেন শরীরে কোনো ভার নেই।মনেও। অ্যাকুয়ারিয়ামে ভেসে বেড়াচ্ছিল লাল মাছ নীল মাছ।বলল, দ্যাখ ।আমাদের মতো এও ভেসে বেড়াচ্ছে। এ কোন অ্যাকুয়ারিয়ামে তিনি? নিজের বাড়ির না ডাক্তারের? সি হর্স একজায়গায় দাঁড়িয়ে দেখছিল। তার মাথার ওপর দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ঈশান মজুমদারের উজ্জ্বল দুটো চোখ। চশমা। বাচ্চা ছেলে। কত আর বয়স হবে।দেবরূপের মত বা সামান্য ছোট বড়।


    আপনি ঘামছেন কেন মালবিকা? টেনশন হচ্ছে? আশ্চর্য ।জলের তলাতেও তো ঘামছেন মালবিকা।


    ঈশান কী জলের মধ্যে না বাইরে? বোঝা যায় না।


    আপনার কী থেরাপি চলছে জানেন তো? জানেন।তন্দ্রা নোট করে।কগনিটিভ বিহেভিয়ারিয়াল থেরাপি। ঈশান বুঝিয়ে দিয়েছে। নেগেটিভের অল্টারনেটিভ ভাবতে হবে।মেয়ে বেয়াদপি করে। কেন? কী মনে হয় ?শী হেটস ইউ? এসেছে তো আপনাকে নিয়ে ।বাইরে বসে আছে। আপনার জন্যে বসে আছে।শী গিভস ইমপরট্যান্স টু ইউ।


    অক্টোপাসটা কখন পেছন দিকে চলে এসেছে।একটা একটা করে শুঁড় দিয়ে জড়িয়ে নিচ্ছে মালবিকাকে। অক্টোপাসের বাহুতে আন্দোলিত তিনি। এ পর্যন্ত বারোটা সিটিং হয়ে গেছে।


    মা । সাদা শাড়ি সোনালি পাড়। মায়ের কাছে গিয়ে আছড়ে পরছেন। মা, ত্রিদিব হ্যাজ অ্যান আফেয়ার। না। অনেক মেয়ে টেয়ে না।একজন। হি ইজ উইক অ্যাবাউট হার। রেগুলার যায় ।


    মা মালবিকাকে বুকে জড়িয়ে কাঁদছেন। ঠিক হয়ে যাবে। সব ঠিক হয়ে যাবে। দুদিনের নেশা কেটে যাবে দেখিস।


    না মা! এ নেশা যাবে না। ওরা সম্পর্কিত। ফিজিক্যালি।মালবিকার চোখের জলে অ্যাকুয়ারিয়ামে উথালপাতাল ।


    মা অত বোঝেন না। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকেন। এখন কার কাছে কাঁদব আমি ডক? টু হুম শ্যাল আই কনফাইড? কেউ তো থাকল না আমার। নিঃসাড়ে চলে গেল।টের পেলাম না।


    লাল মাছ এসে দেখছে।কেমন করে অক্টোপাস জড়িয়ে নেয়। সাদা , শীতল স্পর্শ। কাঁপছেন।


    মা কী কোনো সলিউশন দিতে পেরেছিলেন? বলুন? 


    না। বলেছে মানিয়ে নিতে। আই ট্রায়েড মাই বেস্ট টু প্লিজ হিম।টু মেক হিম হ্যাপি ।আই ওয়ান্টেড আ হ্যাপি হোম।আই কুডন্ট।নেভার কমপ্লেইনড।যা করে বাইরে, আই ট্রাই টু ওভারলুক।


    - হ্যাপি হোম বলে কিছু হয়না মালবিকা।ডাক্তার একটা নিঃশ্বাস ফেলল জোরে।


    আপনি বিকল্প দেখুন। হ্যাঁ ।বলা তো দরকার।যদি মা না থাকেন তবে নেক্সট কে? কে হতে পারে? আপনার মেয়ে? 


    মেয়ে? মালবিকা আতংকিত'চোখে তাকান। ও নো ডক। শি হেটস মি। 


    - কেন ঘেন্না করে জানেন? আপনার মেয়ে ইনটেলিজেন্ট । আপনি যে আপনার স্বামীর ব্যভিচার দিব্যি হজম করে হাসিমুখে তাকে তেল কই খাওয়ান, ছুটির দিন মাটন দো পেঁয়াজা নিজের হাতে করেন স্বামী ভালবাসেন বলে। এগুলো আপনার মেয়ে সহ্য করতে পারে না। আপনার স্বামী তাঁর গার্লফ্রেন্ডের সঙ্গে সময় কাটাতে গেলে আপনি লেডিস ক্লাবে যান। মেয়ে এটা ঘেন্না করে। ফেস দ্য রিয়ালিটি।আপনি একটু ঘুরে দাঁড়ান।ডিপ্রাইভ দিস ম্যান। আপনার ডিগনিটি নেই?


    অক্টোপাসটা খেয়ে নিচ্ছে মালবিকাকে। করুণ কালো চোখ।


    কী করবো আমি? আমি তো চেষ্টা করি। ফেরাতে।


    ডাক্তার উজ্জ্বলতর চোখে হাসলেন ।


    - চেষ্টা করবেন না।প্লিজ। ট্রাই অ্যান অলটারনেটিভ। এত যে খুশি করতে চেয়েছেন শাশুড়িকে, পেরেছেন? এত আয়োজন ত্রিদিবের জন্য। কিছু লাভ হয়েছে? 


    করবেন না। যাস্ট ইগনোর হিম। মেয়েকে কনফাইড করুন।শি ইজ মেচুওর এনাফ। একটু ক্রেজি। বাট শার্প। বুঝবে।বেটার বুঝবে।দ্যান ইওর মাদার। মালবিকা । নেগেটিভের অল্টারনেটিভ খুঁজুন। দেখবেন , বেরিয়ে আসছেন।


    বেরিয়ে আসছেন যেন। গুহামুখ থেকে। অক্টোপাসের মুখগহ্বরের উষ্মা মেখে জলে গা ভাসাচ্ছেন । ঈশান, আমি পারবো তো? 


    লাল মাছ, নীল মাছ বলল, পারবে।পারবে।


    হরপ্রীত খাটতে খাটতে বেশ রোগা হয়ে গেছে। কিন্তু মেয়েটা পরিশ্রম করতে ভালোবাসে। এই যে দৌড়ে দৌড়ে হোম ডেলিভারি করে বেড়ায়, এ কী কম ধকল নাকি! কিছু পাত্তা টাত্তা দেয় না। শ্যামার চিন্তা হয় ওর'জন্য। যেদিন এই বাড়িতে আসে,আগে ওকে বাথরুমে ঢোকায়। প্রায় স্নান করে বের হয় হরপ্রীত। এক সেট জামাকাপড় নিয়ে আসে ট্যাঁকে করে।ও না এলে শ্যামার মুশকিল হয়ে যেত। কথা বলার লোক নেই। অবশ্য লিভিং রুমের টিভিটা দুপুর থেকে চালিয়ে রাখে শ্যামা। টিভি চললে মনে হয় বাড়িতে মানুষজন কেউ আছে । হরপ্রীত অ্যান্ড্রয়েড ফোন কিনে ফেলেছে।শ্যামাকে নানান জিনিস দেখায়। একদিন এক রাণীকে দেখালো। বিলেতের রাণী বলে।হরপ্রীত একটু আধটু ইংরিজি পড়তে পারে।রাণী বুড়ি মানুষ। সাদা চুল। কিন্তু হলুদ জামার সঙ্গে ম্যাচিং হলুদ মাস্ক। সবুজ জামার সঙ্গে সবুজ। গোলাপি জামার সঙ্গে গোলাপি। হরপ্রীতের মালকিন তো ডিজাইনার মাস্ক বানাতে শুরু করেই দিয়েছে। আর রাণীর এই ম্যাচিং মাস্কটাও দিব্যি।বানালে ভালো বিক্রি হবে।


    যেদিন দুপুরে আসবে হরপ্রীত, শ্যামা দুমুঠো চাল ওর জন্য বেশি নেয়। টুপুর বেরিয়ে যায় নটার মধ্যে। থাকলেও ঘরে দরজা দিয়ে থাকে।দাদা দোতলার ঘরে।বউদি শোবার ঘরে। ডাইনিং এ খেতেও নামে না কেউ। ঘরে ঘরে খাবার দিয়ে দেয় শ্যামা । বশির এসেছিল অনেকদিন বাদে। ছোট মাছ দিয়ে গেছে।টাটকা ট্যাংরা আর মৌরলা।আচ্ছা করে ঝালমরিচ দিয়ে ট্যাংরাচচ্চড়ি বেঁধেছে শ্যামা । কালো বেগুন আর আলু সরু করে কেটেছে।বড়ি দিয়েছে ভেজে। মৌরলার টক রেঁধেছে। পালং শাক দিয়ে একটা রসা। তাতে পেঁপে, আলু, লাউ দিয়েছে ডুমো ডুমো করে কেটে। একটু পাঁচফোড়ন। কাঁচালঙ্কা । হরপ্রীত মাছ খাবে না। রসাটা খাবে।মুগ ডাল ছিটিয়ে লাউ রেঁধেছে। এতে একটু বেশি মিষ্টি দিলে স্বাদ খোলে। বউদিকে দেখে শিখেছে। নামানোর'সময় একহাতা দুধ। যে মানুষ এসব তারিয়ে তারিয়ে খেত , সে এখন কিছুই খেয়াল করে না। যা দেয়, ফেলে ছড়িয়ে দুটো খায়।ছাতে নিয়ে গেলেও গুম হয়ে বসে থাকে।মেয়ে আর বরটাও পারে বাপু। নিজেদের কাজ নিয়ে মত্ত। অবশ্য সুখন গেছে পর থেকে শ্যামা আর কোনো পুরুষমানুষকেই ভরসা করে না। তারপর যদি আবার ঘাড়ে অন্য'মেয়েছেলে থাকে তবে তো কথাই নেই। 


    সে যা হোক, ছাতের বাগান অনেক সাফ করেছে শ্যামা।ন্যাড়া লাগছে।কিন্তু পরিস্কার হয়েছে।জঞ্জাল নেই। বস্তিতে যেতে হবে একদিন। কী হাল হল দেখতে হবে।সেজন্য হরপ্রীতকে ডেকেছিল দুপুরে।একা যাবে না। সঙ্গে নিয়ে যাবে। 


    ত্রিদিব লাঞ্চ করেন বারোটাতে। তারপর কাজ। ফাঁকা একতলাতে টিভির শব্দ। বাবলু ঘুমায়।কখনো জেগে টিভি দ্যাখে। হোম ডেলিভারি সেরে বাড়ি ঢুকতে দেড়টা বেজে গেল।এসেই বাথরুমে ঢুকল হরপ্রীত । একেবারে মাথায় শ্যাম্পু ঘষে বেরোল । 


    দুই সখী বসেছে মুখোমুখি ।সুশান্ত রাজপুত কেন আত্মহত্যা করলো সেই নিয়ে সকাতর আলোচনা।কঙ্গনা যা বলছে সব ঠিক, হরপ্রীতের মতে। 


    ট্যাংরার চচ্চড়ি খেয়ে টকাশ টকাশ শব্দ করছে শ্যামা । গতকালের মুসুরডালে গন্ধলেবু। মালবিকা আজ ব্রেকফাস্ট খেয়ে ঘুমাচ্ছেন। দুপুরে খাননি।ডাক্তার নাকি বলেছে ঘুমালে না ডাকতে।যখন উঠবে , উঠবে।শ্যামা জীবনে এমন ধারা ব্যামো দেখেনি। সুখন যখন গেছে, চিৎকার করে গাল পেড়ে , কেঁদেছে। শাপশাপান্ত'করেছে সুখন আর জুহিকে। তারপর আবার কলপাড়ে স্নান করে ডগডগে করে সিঁথিতে সিঁদূর দিয়ে পুঁইডাঁটা , বড়ি বেগুনের ঝোল কিংবা সর্ষে বেগুন দিয়ে একথালা ভাত খেয়েছে।খাওয়ার ওপর রাগ করতে নেই।


    খেতে খেতে হরপ্রীত ফোনের সব কারুকার্য শ্যামাকে চেনাচ্ছিল। সিনেমা ফোনেই দেখা যাবে।নেটফ্লিক্স বলে কী লাগিয়েছে ফোনে হরপ্রীত । অনেক নাকি সিনেমা। এ ফোনে আবার খবর ও আসে। কোথায় কে মরল।কার ছেলে হল। শিল্পা শেঠি ব্যায়াম দেখায়। ট্যাংরার লেজটা ধরে বাকিটা মুখের মধ্যে পুরে গোটা মাছের মাংসটা সুরুৎ করে টেনে হাঁ করে ফোন দেখে শ্যামা। 


    একটা নতুন সিনেমা রিলিজ হয়েছে।এখন আর হলে যেতে হবে না। ফোনে বসেই দেখো। বুলবুল। শ্যামা আর হরপ্রীত খেতে খেতে বুলবুল দেখে। হায় রে মেয়েমানুষের কপাল।যেমন বাচ্চা মেয়ের পোড়া কপাল, তেমনি বৌদিটার। স্বামী তো স্বামী সেও আবার পাগল।কিন্তু বুলবুলকে যখন পাগলটা অমনভাবে রেপ করলো, শ্যামার ওয়াক এল। হরপ্রীতকে বললো , বন্ধ কর। আর দেখবো না। 


    হরপ্রীত অবশ্য শুনল না। দেখেই যাচ্ছে। শেষে শ্যামা মুখ ধুয়ে এসে বসল। বুলবুল চুরেইল হয়ে যাওয়াতে শ্যামা ও হরপ্রীত দুজনেই বেশ পুলকিত । লে বুলবুল। মার ডাল সালোকো। 


    সিনেমা দেখা শেষ হলে মেয়েমানুষের জীবন নিয়ে শ্যামা ও হরপ্রীত গভীর আলোচনাতে ডুবে যায় । কে জানে সুখন এতদিনে জুহিকে ছেড়ে অন্য কোথাও গেছে কিনা।শ্যামা ভাবে কোনটা বেশি কষ্ট। বর ছেড়ে যাওয়া না রেপ হয়ে যাওয়া ।কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে সুখিরাণীকে মনে পড়ে।শরীরে বাইশটা সেলাই।সুখিরাণীরা চুরেইল হয়ে প্রতিশোধ নিতে পারে না।হরপ্রীত ফোনে দেখায়। উত্তরপ্রদেশে মেয়ে রেপ হয়েছে। মুরশিদাবাদে। দিনাজপুরে। কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে। অ্যাম্বুলেন্সে।কোথাও ছাড় নেই।হরপ্রীত ভরপেট খেয়ে সালোয়ারের দড়ি ঢিলা করে। এখানে কোনো শরম নেই ।কেউ আসবে না। শ্যামা সিংকে বাসন নামিয়ে এসে বসে। ভেজা চুল খুলে দেয়।


    - তা হলে ঐ যে লকডাউনে শুরুতে ফাঁসি হল চারটার, তাতে তো কিছুই হল না রে? রোজ তো রেপ হচ্ছে। শ্যামার হাত চিরুণীর মত তার চুলের গভীরে।


    - উও নির্ভয়া কা রেপিস্টস। বাপরে! কিতনে সাল বাদ ফাঁসি হুয়া। পর হুয়া তো সহী! 


    মনে আছে শ্যামার । তখন লকডাউন শুরু হয়েছে সবে।বউদি তখন ঝরঝরে।ছেলেগুলোর ফাঁসি আজ হবে আর কাল হবে করে খালি পিছায়। কী রেগে যেতো বউদি। এদের সঙ্গে সঙ্গে ফাঁসি দেয় না কেন? বলতো।


    - সহী বাত। তবহি ফাঁসি দেনা চাহিয়ে। 


    - একটার নাকি বয়স কম। সেলাই মেশিন দিয়ে কোথায় কোন ধাবাতে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। শালা বড় হয়ে আবার রেপ করবে তো।


    হরপ্রীত মাথা নাড়ল । অনেকটা বেশি খেয়ে ফেলেছে। কুর্তাটা তুলে দিয়েছে পেটের ওপর। মসৃণ নির্মেদ পেট। শ্যামার গা শিরশির করে ওঠে। কেউ নেই কোথাও । তবু বলে


    - এ। কুর্তা নামা। ঠিকসে বৈঠ।


    হরপ্রীতের চোখে ঘুম ঘুম ভাব । ভোর চারটের থেকে উঠে খাটে । 


    - রেপিস্টকো ফাঁসি হোনা চাহিয়ে। উ নির্ভয়া কেসবহত দের লাগা দিয়া। মরদো কা ক্যা হ্যায়। এক কো ছোড় কর আউর। আওরত ফাঁস যাতে হ্যায়। ইয়ে নির্ভয়া কবকে মর চুকি।আউর কিস হালাতমে মর চুকি। আউর ইয়ে শালোকো জিন্দা রাখ দিয়া জেলকি রোটি তোড়নেকে লিয়ে। হারামি। 


    হরপ্রীত ক্রোধে ফোঁস ফোঁস করে।


    কিতনে সারে রেপ হো চুকা নির্ভয়া কে বাদ। উও হায়দেরাবাদকা ডক্টর। উসে তো জিন্দা জ্বালা দিয়া।আউর বহত ভি হু


    শ্যামা ভেজা কাপড় দিয়ে মেঝে মোছে। এঁটো সরায় আর ভাবে, সত্যি, এই মেয়েগুলো কেউ বুলবুল হল না।চুরেইল হয়ে ঘাড় মটকালো না। মেয়েমানুষ খালি ভয়ে মরে। বাপের ভয়। দাদার ভয়।আর বিয়ে হলে তো ভয়ই ভয়।না মারলো তো ছেড়ে গেল! চোদ্দবছর সংসার করেছে।হেডমিস্ত্রি মদ খেয়ে ফিরলে বাড়িতেও রেপ হয় শ্যামা জানে। চুল গড়িয়ে জল পড়ে। হরপ্রীত ঘুম ঘুম চোখে বলে- ইসি লিয়ে আজকাল আওরত আওরতসে শাদী কর লেতা হ্যায়। কমসে কম শাদীমে তো রেপ নহি হোগা। শ্যামা চমকে হরপ্রীতকে দেখে।এসব কী বলছে ছুঁড়ি! শ্যামা কিছু কিছু শুনেছে বটে কিন্তু কানে নেয়নি।মনে তো দূরের কথা। 


    - কী বলছিস রে আবোলতাবোল? মেয়েতে মেয়েতে বিয়ে হয়ে কী করবে শুনি?


    হরপ্রীত একটা ইঙ্গিতপূর্ণ হাসি হাসল।বলল, 


    চল, তুই আমি শাদী করেনি। তারপর দেখি কী করা যায়! 


    তারপর খিলখিল হাসিতে ফেটে পড়ল ।শ্যামাও হাসল বটে।তবে তার কথাগুলো শুনতে একটু বাধোবাধো ঠেকল। হরপ্রীত আজকাল মহা অসভ্য হয়েছে।চুরেইল কোথাকার।


    টিভি খুলল শ্যামা ।দুপুরের সিরিয়াল দেখবে। 


    - তোদের খাওয়া হয়ে গেছে? কী রেঁধেছিস আজ?


    চমকে ভূত দেখছে শ্যামা । কতদিন বাদে মালবিকা নিজে থেকে উঠে ডাইনিং টেবলে এসেছেন! ঢোলা কাফতান না। শাড়ি পরেছেন গুছিয়ে । চুল টেনে বাঁধা। শ্যামা নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না! 


    - খিদে পেয়েছে শ্যামা । চেয়ার টেনে বসেছেন। 


    - সিরিয়াল দেখছিস? একটু নিউজটা দে। 


    হরপ্রীত হাঁ করে দেখছে। ঘুম চটকে গেছে। মালবিকা রোগা হয়েছেন কিছুটা। চোখ বসে গেছে। তবে মুখে চোখে জল দিয়ে এসেছেন বলে একটা সতেজ, টাটকা ভাব। 


    শ্যামা দৌড়ে প্লেট সাজাচ্ছে।ভাত বসাচ্ছে চুড়ো করে। চচ্চড়ি অনেকটাই ছিল। বাটিতে দিয়েছে। ডাল। লেবু ।টক। 


    কতদিন পর টেবলে বসে খাচ্ছেন মালবিকা । 


    - টকটা খেয়ে দেখো বউদি। খুব মুখ খুলছে। 


    মালবিকা আঙুল চেটে খাচ্ছেন। ভীষণআনন্দ হচ্ছে শ্যামার । হরপ্রীত মেঝেতে শুয়ে গেছে একটা কুশন টেনে। পুরোনো দিনের মত সব। 


    ত্রিদিব নামলেন দোতলা থেকে।বেরোচ্ছেন।গাড়ির চাবি নিলেন। মেরুন টি শার্ট ঠেলে মধ্যপ্রদেশ বেরিয়ে আছে। মালবিকার কাছে এসে দাঁড়ালেন। 


    মায়ের মৃত্যুর পর আছ প্রথম। মালবিকা খুব শান্ত।পরিচ্ছন্ন । নিজে খাচ্ছেন। 


    - বেরোচ্ছি একটু। বুঝলে? 


    ত্রিদিবের গা থেকে অ ডি কলোনের তাজা গন্ধ।অপেক্ষা করছেন। 


    মালবিকা ফিরে তাকালেন না। ডালের বাটি টেনে নিচ্ছেন। 


    - আসছি আমি! 


    ত্রিদিব অপেক্ষমান। মালবিকা বারান্দায় এসে দাঁড়াবেন তাঁর বেরোনোর সময় । সানগ্লাস চোখে বেরোচ্ছেন ত্রিদিব ।


    উঠলেন না।খেতে খেতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ জানালেন।


    - শ্যামা । আরেকটু চচ্চড়ি দে।


    যেন ত্রিদিব বলে কেউ দাঁড়িয়ে নেই ওখানে। কখনো ছিল না। থাকবেও না। (চলছে)


    #করোনাকালীন (দুই)


    উনত্রিশ 


    রীণা যোশী তার প্রথম ও প্রাক্তন বিবাহসূত্রে যোশী। কিন্তু ডিভোর্সের পরেও সে স্বামীর পদবি ব্যবহার করে। বাড়ি ভাড়া নিতে গিয়ে বা আরো বিভিন্ন কাজে সে দেখেছে যে রীণা ঘোষের চেয়ে রীণা যোশী ভারে এবং ধারে কাটে বেশি।একটা অভিজাত উচ্চবর্ণ স্টেটাস লেগে থাকে, যেটা সামান্য হলেও হেল্পফুল।


    রীণাকে দেখতে অনেকটাই পাওলি দামের মত। কালো।দীঘল। অত্যন্ত আকর্ষক এবং যৌন আবেদনময়ী চেহারা নিয়ে একটি ডিভোর্সি মেয়ে বাঙালি সমাজে খুবই মুখরোচক বিষয়। তার ওপর আবার সে বিজ্ঞাপন সংস্থাতে মোটামুটি ভালো মাইনের চাকরি করে। কারু ওপর নির্ভরশীল না। একসময় সে টেবলটেনিস খেলেছে রাজ্যস্তর পর্যন্ত এখনো সময় পেলে সে ক্লাবে খেলতে যায় ।ছেলের তিনজন প্রাইভেট টিউটর। হেরিটেজ স্কুলে ভর্তি করেছে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ।মোটমাট তার একটা এইম আছে।কেউ যেন তাকে বেচারা না বলতে পারে।বেচারা শব্দটাকে রীণা ঘেন্না করে।উনিশ বছর বয়সে রীণা বিয়ে করেছিল ধর্মানন্দ যোশীকে।বিজনেসম্যান ।দেখতে গোপাল গোপাল ভাল।পুরোপুরি ভেজ। যে রীণাকে পাড়া এবং কলেজশুদ্ধ ছেলে ঘাড় ফিরিয়ে ঘুরে দেখত, ধর্মানন্দ যোশীর মা, সেই রীণাকে পছন্দ করলেন না।পাওলি দাম তাঁর সৌন্দর্য ধারণার মধ্যে পড়েন না। ঘরকি বহু হবে গোরি গোরি।গোলগাল।রীণাকে ধর্মানন্দের মা দায়সারা বরণ করলেন।তাতে রীণার কিছুই যেত আসতো না।সমস্যা হল যে সে ভেবেছিল ধর্মানন্দের অনেক টাকা, সে নিজের মত থাকতে পারবে।বিদেশ ট্যুর করবে বরের সঙ্গে।নিজের বুটিক খুলবে ।বাস্তবে দেখলো ব্যবসা ধর্মানন্দের বাবার হাতে এবং তিনি সবাইকে একটা মাসোহারা দেন।এই ব্যবস্থা রীণার মত একটি স্বাধীনচেতা মেয়ের ভালো না লাগাই স্বাভাবিক । সে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে শ্বশুর শাশুড়িকে রাজি করিয়ে অ্যাকাউন্টেন্সিতে গ্রাজুয়েশন কমপ্লিট করলো।কম্প্যুটারে ডিপ্লোমা কোর্স করলো।তাতে অবশ্য শ্বশুর খুশি হলেন কারণ ব্যবসার কাজে অনেকটা সুবিধা হবে। রীণা র ওপর যোশী অ্যান্ড কোম্পানির অ্যাকাউন্টস দেখার ভার পড়লো কিন্তু কোনো মাসোহারা ছাড়া। এ ছাড়াও ধর্মানন্দদের মহাদেবী বলে একটা কাপড়ের গদি আছে।


    এর মধ্যে রীণা বাড়িতে ঘোমটা দিয়ে থেকেছে, তিজ উৎসব থেকে করোয়া চওথ সব পালন করেছে, শ্রাবণমাসে হাতে সবুজ চুড়ি পরেছে।হনুমানচালিশা পাঠ পর্যন্ত করেছে এবং শ্বশুরশাশুড়ির পরকাল উদ্ধারের জন্য একটি পুত্রসন্তানের জন্মও দিয়ে ফেলেছে।তবু বরকে নিয়ে তার আলাদা বেড়াতে যাবার স্বাধীনতা নেই, রাত আটটার পর বাইরে থাকা যাবে না, রাতের সম্পূর্ণ রান্না অর্থাৎ বাড়ির আটজন অ্যাডাল্ট, শ্বশুর, শাশুড়ি, বর, দুই দেওর, ননদ , এক খুড়শ্বশুরের এবং সে নিজে, এত জনের রুটি সবজি বানাবার দায়িত্ব তার।বিয়ের আগে রীণা ভেবেছিল সম্পন্ন ব্যবসায়ী পরিবারে বিয়েটা আরামের হবে কিন্তু কাজে দেখা গেল আলাদা। এটাও সে ভেবেছিল বরকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাবে।কিন্তু ধর্মানন্দ সে প্রস্তাব উড়িয়ে দিল এবং রীণা প্রতিমুহূর্তে দমবন্ধ বোধ করতে লাগল।একে তার মাছ ভাত খাওয়া পেট।সম্পূর্ণ আলাদা বিবাহ পূর্ব লাইফ স্টাইল একেবারে বস্তাচাপা ।তার ওপর হাতে টাকাপয়সা নেই। ধর্মানন্দ বেশির ভাগ সময় জয়পুরের গদিতে। কলেজ জীবনে জিনস টপ পরা রীণা ঘোমটা টানা বহুর ভূমিকা, হাজারো নিয়ম, ছোঁয়া মানতে মানতে প্রায় পাগল হয়ে উঠল।


    মারধোরের কোনো কেস হয়নি কিন্তু ধর্মানন্দ একজন বিশুদ্ধ দুধ সবজি মাখনভোজি মাতৃভক্ত মানুষ।রীণার এই নিপাট ভক্ত বরকে দেখে আরো বিবমিষা হতে লাগল। যতদিন কলকাতায় থাকে সকাল সন্ধ্যা একঘন্টা ধরে বরের হনুমানচালিশা পাঠ রিনা তিন বছর সহ্য করে ডিভোর্স চাইল। ততদিনে সে একটি ভালো চাকরি জুটিয়েছে।গ্রাফিক ডিজাইনের ওপর একটি কোর্সও করেছে। তার রেজাল্ট ভালো এবং তুখোড় মেয়ে হিসেবে অফিসে সে নাম কিনে ফেলেছে ।


    ধর্মানন্দ ডিভোর্স দিয়ে দিল এবং এতে সবচেয়ে খুশি হলেন তার মা প্রভাবতী যোশি। তাঁর বরাবর সন্দেহ ছিল যে এই বউ বাইরে থেকে মছলি, মাস খেয়ে আসে। ডিভোর্সের পর তিনি বাড়ি রঙ করালেন, স্বস্ত্যয়ন করালেন পুরোহিত ডেকে এবং পরের বছর ধর্মানন্দের বিয়ে হল ইন্দোরের সুশীলাকুমারীর সঙ্গে । এ বাড়িতে রীণার কোনো চিহ্ন থাকল না।রীণা একটা ভালো অ্যালিমনি পায় কারণ সে ধর্মানন্দের ছেলে মানুষ করছে।অন্তত এইটা তার যুক্তি ।


    রীণা বাপের বাড়ির সঙ্গেও যোগাযোগ কম রাখে। জোর করে বিয়ে করেছিল বাপ মা' র মতের বাইরে, এটা সে ভোলে না।কেউ যাতে তাকে কোনোরকম কথা শোনাতে না পারে , সেইজন্য সে বাপের বাড়ির কোনো সুযোগসুবিধাও নিল না, নির্ভরও করলো না।বরং পুজোতে এটা ওটা সে ই দেয় ।ফ্ল্যাটটি নিয়েছে সে ছোট।ওয়ান রুম। ফ্যামিলিটা বিদেশে থাকে। দুটো পাশাপাশি ফ্ল্যাট কিনে রেখেছে। তাইওয়ান থেকে এলে নিজেরা বড়টাতে থাকে।ছোটটাতে রীণা। অফিসের জয়তীদি তাকে ফ্ল্যাটটা খুঁজে দিয়েছে গল্ফগ্রীনে।


    সুন্দরী এবং বিবাহবিচ্ছিন্না হলে যত রকম উপদ্রব সহ্য করতে হয়, অফিসে সহকর্মী থেকে শুরু করে পাড়ার হুলো বেড়াল সবাই অভিভাবকত্ব ফলাতে চেষ্টা করে, রীণা সে সব সয়েছে। কাউকে পাত্তা দেয়নি, কারণ সে জানে এরা তার সঙ্গে আলগা ফুর্তি করতে চাইবে। ঐ ভাবে জীবন নষ্টকরার জন্য রীণা ধর্মানন্দকে ছেড়ে আসেনি। সে ভালো কেরিয়ার করতে চায়। ছেলেকে মানুষ করতে চায়।


    কিন্তু ত্রিদিবের সঙ্গে স্পেন্সারে মাসকাবারি জিনিস কিনতে গিয়ে দেখা হয়ে সব হিসেব গন্ডগোল হয়ে গেল।


    পুরোনো পাড়া।পুরোনো মানুষজন।পুরোনো দিন।এইসব নিয়ে আড্ডা মারতে, ঘন্টার পর ঘন্টা আলাপ করতে কার না ভালো লাগে ।তার ওপর ত্রিদিব এক জন দায়িত্ববান পুরুষ, ঘরসংসার করেন, ভালো চাকরি। এ তো ছোঁকছোঁক করা ইতর পার্টি না যে রীণা গাল দিয়ে ভাগিয়ে দেবে! 


    কাজেই সিসিডি। তারপর আজ পিটার ক্যাট।একটু সিজলার খাবো।তারপর ওর্লডর্ফ। একদিন হায়াট।ছোটমাসির বিয়েতে সেই যে কী মজা হয়েছিল। রীণা প্রথম শাড়ি পরেছিল আর ত্রিদিব পরিবেশন করার আগেই গোটা দশেক রাবড়ি শেষ এই থেকে শুরু করে পুরনো পাড়ার পেয়ারাগাছ, অশোকদের বাড়ি ভেঙে ফ্ল্যাট, গীতা কাকীমার বাত , পুরোনো পাড়ার মুদির দোকান এইসব করতে করতে গল্পের জায়গা হল রীণার ফ্ল্যাট । তারপর ববির জন্মদিন। ত্রিদিব ছাড়া কে আসবে। একদিন খেয়ে যাও। কই মাছ রেঁধেছি। আজ মুরগী রোস্ট। তারপর সিনেমা।রীণার ডোভার লেন শুনতে এত ভালো লাগে।কে যাবে সঙ্গে ।আজকাল কেউ ক্ল্যাসিক্যাল শুনতেই চায় না। ত্রিদিব দুর্বল হতে লাগলেন। রীণা ভীষণ উত্তেজিত। তাকে উত্যক্ত করা ছিনে জোঁকগুলো কেবল তাকে নারীদেহ ভাবত। ত্রিদিব তাকে একটি বাচ্চা মেয়ের মত ট্রিট করেন। খুকী হয়ে যেতে ভীষণ ভালো লাগে রীণার। অনেক চাপ কমে। হোক না ঘন্টা দুই।এইভাবে দিন গেছে। গ্যাসে খিচুড়ি চাপিয়ে রীণা নেচেছে। ত্রিদিব স্পেলবাউন্ড।এ কী যৌবন ফিরে এল! দশমীর নাচ মনে আছে রীণা? 


    মালবিকা সংসার নিয়ে ব্যস্ত।স্কুল। কুড়ি বছরের পুরনো বর নিয়ে টেনশন কেই বা করে। ত্রিদিব সুযোগ পেয়ে গেলেন। অবাক হয়ে দেখলেন তিনি ভালো থাকছেন রীণার কাছে গিয়ে । হি ফেল্ট ফ্রি ।আনইনহিবিটেড। মালবিকা ভীষণ ব্যস্ত ছেলেকে পুণে নিয়ে যেতে।সিমবায়োসিস।মেয়ের এইচ এস। সময় গড়ালে দেখাশোনা, শরীর অভ্যেস হয়ে যায় । ত্রিদিব রীণার প্রেমে পড়েছেন কীনা জানেন না কিন্তু রীণা তাঁর অভ্যেস হয়ে গেছে।এবং তিনি রীণার।


    বাড়িটা তিনতলা।হলুদ রঙের।একটা ওল্ড কলকাতা চার্ম আছে। নিচে কিছু গাছ আছে স্বল্পপরিসরে।একটা কোলাপসিবল গেট।রীণা তিনতলায়। দড়ি দিয়ে কোল্যাপসিবলের চাবি নামিয়ে দেয়।এটাই সিস্টেম।


    আজ ফোনে কোনো সাড়াশব্দ নেই। ফ্ল্যাটে 


    রীণার' নেমপ্লেট নেই।শুধু বেল।


    রীণা এসে দরজা খুলে দিল। চোখ টকটকে লাল।চুল এলোমেলো। 


    ত্রিদিব ঢুকতে গিয়ে থমকে গেলেন।


    - তোর কী জ্বর এসেছে নাকী? 


    - দেখে বুঝতে পারছো না? কাল থেকে ধুম জ্বর।উঠতে পারছি না।তাই তো ফোন করলাম তোমাকে।


    রিনার পাশের ফ্ল্যাট বন্ধ থাকে।ওঁরা দু তিন বছরে একবার আসেন। নিচে দুটো ফ্ল্যাটে একটা কাপল আইটি তে আছে। আরেকটাতে দুটি মেয়ে থাকে।চাকরি করে বা পড়ে । নিচে বাড়িওয়ালা উইদ ফ্যামিলি। রীনা কারুর সঙ্গেই খুব একটা মেশে না। ত্রিদিব আসেন বলে আরো সতর্ক থাকে।বাড়িওয়ালা দরজা জানালা বন্ধ করেই থাকেন।তথাপি ক্যাপ ও মাস্ক পরে ত্রিদিব নিজেকে বেশি নিরাপদ বোধ করলেন।


    রীণা একটু ঝাঁঝালো। 


    - দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।ভেতরে এসো।


    প্রাণের মায়া ভীষণ নিষ্ঠুর ব্যাপার। শৈশব, বন্ধুত্ব, প্রেম, যৌনতা, অভ্যেস সব বাপ বাপ করে পালিয়ে যায় ।ত্রিদিব খোঁচা খাওয়া শজারুর মত তটস্থ।


    - জ্বরের মধ্যে আমাকে ডেকে খুব সেনসিবল কাজ করলি রীণা?


    - তুমি ছাড়া আর কাকে ডাকব বলো তো? 


    - বাজে বকিস না রীণা। এমনি সময় আলাদা কথা। এখন এই কোভিডের সময় জ্বর মানে বুঝিস?


    ত্রিদিব জুতো খুলছেন না। রীণা লক্ষ্য করছে।


    ওর' ফ্ল্যাটটা ছোট হলেও সাজানো। একটা রট আয়রনের সোফা। ঘন নীল গদিতে লাল আর হলুদ কুশন। একটা লোয়ার সিটিং রেখেছে। ত্রিদিব এসে সাধারণত প্রথমে ওখানেই মৌজ করে বসেন।একগাদা কুশনে আয়েস করে। ওপেন কিচেনটা ছোট্ট । বেডরুমে হলুদ পর্দা। কালো অ্যাপ্লিক করা। রীনা কোন ডাইনিং টেবল রাখেনি। 


    ওর চোখ ছলছল করছে।তাকাতে কষ্ট হচ্ছে বোঝা যায় ।একটা লাল ম্যাক্সি পরে আছে রীণা। গলার কাছে কাঁথার কাজ। একটা সোনালি চেইন। চুল খোলা। কোভিড কাল না হলে ত্রিদিবকে উত্তেজিত করার জন্য যথেষ্ট। 


    - কত জ্বর দেখেছিস? কাশি আছে? শ্বাসকষ্ট?


    - তুমি কী কর্পোরেশনের লোক নাকি গো? ওখানে দাঁড়িয়েই কথা বলবে? ভেতরে আসবে না?


    ত্রিদিব ঈষৎ দমবন্ধ বোধ করছেন। মাস্ক খোলেননি। মাথাতেও প্ল্যাস্টিকের ক্যাপ । 


    - ফ্ল্যাটে কাউকে বলেছিস?


    - তুমি তো জানো কারো সঙ্গে তেমন মিশি না।কেন মিশি না তাও জানো। কাকে বলব? 


    - ওষুধ এনেছিস?


    - তুমি ভেতরে এসো।


    রীণার পেছন থেকে ববি উঁকি দিল।পাঁচ বছরের টোবাটোবা মুখ। ধর্মানন্দের মত ধবধবে রঙ। ত্রিদিব যখন আসেন ববি টিউটরের বাড়িতে বা সুইমিং ক্লাসে থাকে। এখন সেইসব কিছুই নেই।


    - শোন রীণা। পাগলামি করে লাভ নেই। আমি আর ভেতরে ঢুকছি না। ওষুধ লাগলে বল, আমি এনে দিচ্ছি।


    - ওষুধ হোম ডেলিভারি দেয় তিরুদা। আমি প্যারাসিটামল খেয়েছি। অ্যাজিথ্রোমাইসিন । সেজন্য তোমাকে ডাকিনি ।


    - কোভিড টেস্ট করাবি না? 


    - আমার ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছে। 


    - কী করে জানলি? তুই ডাক্তার নাকী? কোভিড টেস্ট করতেই হবে। 


    - করতে হবে না। জ্বর বেশি হলে আমার ছেলেটাকে কে দেখবে তিরুদা? 


    রীণার নাকের পাটা কাঁপছে থির থির করে।ওর চমৎকার ফিগার আজ একটু কৃশ। 


    - তোর জ্বর।ওষুধ খেয়েছিস। সো হোয়াই ডিড ইউ কল মি? আমাকে ডাকলি কেন?


    - কথা বলার জন্য। প্যানিক অ্যাটাক হচ্ছিল। খুব ভয় লাগছিল ছেলেটার জন্য। 


    ববি ত্রিদিবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। হাসেনি আজ একবারও । চুলটা ফ্রিন্জ করে কাটা।একটা হলুদ শার্ট পরে আছে মিকি মাউস আঁকা।


    জোরে একটা নিঃশ্বাস ফেললেন ত্রিদিব। আজ কাগজে পড়েছেন ডাক্তারের মৃত্যু । দুশোজন ডাক্তার ইতিমধ্যে মারা গেছেন কোভিডে। নিজের পাড়াতে তিনজন। ঘামছেন।মুখ মুছলেন রুমালে। মাস্ক পরলে চশমা কেমন ঝাপসা হয়ে যায় ।


    মাথাটা কেমন করছে।প্রেশার ফ্লাকচুয়েট করছে বোধহয় । ত্রিদিব ঘাড় ঘোরালেন এদিক ওদিক।


    - রেস্ট নে রীণা। খাবার দাবার আছে? ববি খেয়েছে?


    - হোম ডেলিভারি নিয়েছি। বিগ বাস্কেট আছে। আমার একটু কথা বলা দরকার ছিল তিরুদা। হাঁপিয়ে যাচ্ছি।তুমি একটু বোসো।দশমিনিট।


    রীণার পিছনে বেডরুমের হলুদের ওপর কালো অ্যাপ্লিক করা পর্দা উড়ছে। ওর বেডরুমটা ভারি মায়াময় । খুব নরম একধরনের সুজনি পাতা থাকে খাটে। এত সফট যে হাতপা একেবারে ডুবে যায় ।মাথার কাছে একটা ইনফিউসারে ল্যাভেন্ডার বা টি ট্রি এসেনশিয়াল অয়েল থাকে সঙ্গকে সুরভিত করার জন্য।রীণা বেসন দিয়ে বেগুণী বা পেঁয়াজি ভেজে আনে তুখোড় ।তখন ওকে যা লাগে না! ত্রিদিব লকডাউনের ক্লান্তি ও উপবাস কাটাতে একটা মুচমুচে বিকেল ও সন্ধ্যাকে মরীচিকার মত এষণা করে ছুটে এসেছিলেন।


    খুব ক্লান্ত, হেরে যাওয়া চোখে তাকালেন ত্রিদিব ।


    - আজ না। তুই শুয়ে থাক। ফোনে কথা হবে। আসি আজ। আমারও শরীরটা ভালো নেই রে।পারলে তোর মা' কে একটা ফোন কর। ববির জন্য।(চলছে)


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ | ২৬৩৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন