এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • পাত্থর

    শক্তি দত্তরায় লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮ | ১৩৩৮ বার পঠিত
  • পাউলুস, এ পাউলুস ছোড়া এখানে কী করছিস বটেক? সুরিয়া বুড়ির তীক্ষ্ম মিষ্টি ডাক উড়ে যায় হাওয়ায়। বুড়ি হাতের কালচে দাগ ধরা ধাতব খাড়ু বাজিয়ে হাত ঝামরে ঝামরে কলাকুচি নদীতে কাপড় কাচছে। আধখানা বাংলা সাবানের সাদা গোল্লায় ফেনা তুলছে। নদীর কিনারে বন্যার জলে কোন মন্দিরের পাঠের সিঁড়িটা ভেসে এসে ইকরা গাছের ঝোপে আটকে গেছিল। ওটাই কাপড় কাচার পাট। এখানে বাগানের ধোপাও কাপড় কাচে। ওর মধ্যেই খোদাই করা কোন ঠাকুর - হাতে একটা চাকা, একটা পদ্মফুলের কলি - কোন ঠাকুর কে জানে, তবে দয়ামায়া আছে। এই যে কলাকুচি বস্তির সব কাপড় আছড়ে আছড়ে কাচে সবাই - দেবতা কিন্তু পাপ দেয় না। কোথায় কাচত না হলে এরা? দুপাড়ে শুধু কাদা মাটি, বড় বড় ঘাস, কাঁটাগাছ। তা মানে না তা নয়। কাচার আগে কপালে হাত ঠেকায়, কাচা হয়ে গেলে স্নান করে। দুটি লালপাতিয়ার লাল সাদা পাপড়ি ছিঁড়ে ঠাকুরের নূপুর পরা পাথরের পায়ে দেয়। নমন করে। বুঝতে চেষ্টা করে ঠাকুরটো গাবরু না ডেকা? অর্থাৎ স্ত্রী দেবতা না পুরুষ দেবতা। জলে হাওয়ায় খোলা আকাশের নীচে বানের জলে ভেসে আসা ঠাকুরকে দেখে বোঝা যায় না কিছু। পাথরের প্রাচীন দেহ ক্ষয়ে গেছে। মনসা পূজার দিনে সবাই যখন পিদিম জ্বলা কলার ভেলা ভাসায় তখন এই ঠাকুরকেও কলা চাল বাতাসা নৈবেদ্য দেয়। গরীব মানুষ, যে যা পারে। ঘিরে ঘিরে ছিনিমিনি ভাষায় কী গান গায়, নাচে, ধূপবাতি দেয়। ছোটমোট একটা মেলাও বসে। দেবতা খুশিই হন। অনেক সময়ে উঠতি ছেলে মেয়েরা এই পাথরে পা ঝুলিয়ে বসে গল্পগাছা করে। দেবতা সহ্য করেন, শাপমান্যি করেন না। যেতে যেতে মেয়েটি ফিরে চায়, দুহাত কপালে ঠেকায়। সুরিয়া বুড়ির মুখে একটু হাসি - পুরনো ঠাকুর নূতন দিনের ছোড়াছুঁড়িকে কি একটু আস্কারা না দিয়ে পারেন! বুড়ি আবার চ্যাঁচায় - এ পাউলুস, পাউলুস রে-এ-এ-এ।

    পাউলুসের বয়ে গেছে বুড়ির ডাকে সাড়া দিতে। হ্যাঁ, মা-টা যেবার মরলো সেবার বুড়িটা খুব মরম করে ওকে চালভাজা, ফলটা, মিঠাইটা খেতে দিত। কাঁচা পেয়ারা খেয়ে পেট খারাপ হলে কাঁথাকানি ধুয়েও দিত। কিন্তু এখন ওর বুড়ির বকবকানি শুনলে হবেনা। তেকোনা জালে নদীর খোঁদলে লুকিয়ে থাকা দুয়েকটা কাঠুয়া যদি ধরতে পারে, বড়জুলির হাটে বিক্রি করে কটা টাকা পেলে ঢেকিয়াজুলি যাবে সিনেমা দেখতে। একা নয়, হ্যাঁ হ্যাঁ, সঙ্গে কেউ যাবে বইকি , সেকথা এখন থাক। পাউলুস পেছন ফিরে দেখে বুড়ি স্নান সেরে পাত্থর দেবতাকে ফুল চড়িয়ে এক বালতি কাপড় নিয়ে কাত হয়ে হাঁটছে আর সামনে দূর্জেনের বড় বিটিটা গান গাইতে গাইতে চলেছে - কুটি কুটি চায়ের পাতা বিলি বিলি বিলি - - - .। কী গান, কী হাঁটার ছিরি! পাউলুস আবার জালের দিকে মন দেয়। এবার কটা ছটফটে ভাঙ্গন মাছ উঠেছে জালে - মায়াভরে পাউলুস দ্রুত হাঁটে। এ নানী - নানী - নানী - টুকুস দাঁড়া , মাছ কটা লিয়ে যা - এ নানী -।

    মাছ কটা সোমারীর হাতে, কাপড়ের বালতি নিয়ে বুড়ি লালমাটি আর পাথরের পথে কষ্টে হাঁটে। জলছেঁড়া সূর্য্যিটা বড় তাপ ছাড়ছে, কপালটা ঘামছে, অথচ এখনই ডুবচান দিয়ে উঠল। বড়রাস্তায় উঠতেই ট্র্যাক্টর চালিয়ে থামল চাবাগানের নার্সারির রোজারিও। একপ্যাকেট ডঙ্কা আগরবাতি হাতে দিয়ে বলল - একটা মোমও দিল - মৌসী, মেরীজুনের নামে পাত্থরঠাকুরের কাছে একটু প্রে কোর। রোজারিও তেজপুরের চার্চে যায় ফি-রোববার। ওর ঘরে যীশুবাবার ক্রুশবেঁধা ছবি। আহা, ভগবানের এত দুখ, তো মানুষের হবে না কেনে! রোজারিওর দুঃখও সুরিয়া জানে। ওর মেয়েদুটি খুব ধলা। একটা বারো একটা চৌদ্দ। মিসামারির ম্যাথুসাহাব ফৌজিসাহাব - সেও খিরিস্তান। লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়া দিব বলে কোচিন না কই নিয়া গেল। গরিব রোজারিও বলে এংলোইন্ডিয়ান সাহেবের জাত। মেয়ে দুটি ভালো খাবে পরবে বলে দিয়ে দিল। এখন শুনছে জুন নাকি লুকিয়ে চিঠি পাঠিয়েছে তারা দুই বহিন বহুত খারাপ আছে। গরিব সাহেব রোজারিও এখন চার্চে মোম দেয়, উদালগুড়ি পীরের মাজারেও মোম দেয়। এই চারহাত ভগবানকে মোম ধূপকাঠি দিতে চায় বুড়ির হাতে। হ্যাঁ, সুরিয়া কালকে গোলাপফুলের মত মেয়েদুটির নাম করে দিয়ে দেবে বৈকি ঠাকুরের কাছে। এটা চা বাগান - কার নানা পরনানা কোন জাত কোন গেরাম কোন জেলা থেকে কোন আড়কাঠির সঙ্গে এখানে ওখানে এসে পড়েছিল তারা জানেনা। তাদের সন্তান সন্ততিরা সবাই কুলি। এখন অবশ্য কুলি বলেনা, লেবার বলে। তারা এত জাতজন্মের খোঁজ রাখেনা। ঘামে শ্রমে হাঁড়িয়ার ঠেকে ওঠাবসা একসঙ্গে। তাদের দেবদেবীরাও একাকার। পাতি তোলে বাগানে নিড়ানি দেয়, চাঘরে ডায়নামো চলে, ড্রায়ারের আগুন গরম তাতে খাটে। দুপুরে একই পাত্র থেকে লাল চাহাপানি খায়। ওদের বামুন শুদ্দুর নাই, ওসব আছে বাবু কোয়ার্টারে। ডাক্তারবাবু বামুন, চাঘরবাবু শুদ্দুর, বাগানবাবু বড়গোঁহাই। তাদের খাওয়া ছোঁয়া ঠাকুরদেবতায় একটু আধটু নিয়ম নিষেধ আছে। বেচারী রোজারিও একুল ওকুল কোন কুলেরই নয়।

    সোমারী কাজ করে ম্যানেজারের বাংলোতে। এরা বলে বাংলা। ম্যানেজারের মালি দূর্জেন। সোমারী শুনেছে ম্যানেজার ধরচৌধুরীসাহেব আর থাকবে না, চলে যাবে শিলচর। বাঙালি মালিক বাগান বেচে দিয়েছে কোন শর্মাজির কাছে। দিল্লিওয়ালা না কি বম্বেওয়ালা, তবে বাঙ্গালি না। তারা নূতন ম্যানেজার আনবে - কী নাম, বাপরে - হনুমানপ্রাসাদ ত্রিপাঠি । কী জানি কেমন হবে মেজাজ কেমন হবে দিল দেমাক। বাগানের বাবুমহলও শঙ্কিত। ব্রিটিশ মালিকানার অত্যাচারজর্জরিত শ্রমিক মাঝের বছরগুলোয় একটু হাঁপ ছেড়েছিল। এখন আবার কী হয় কে জানে। ফিসফাস চাপা টেনশন চলতেই থাকে। রাজা পাল্টায় - প্রজার ভাগ্য কতটুকু পাল্টায়? তবু ঊনিশবিশ সাতসতের চিন্তা তো হয়ই। ইংরেজ মালিকের দয়ার গল্প, আবার অমানুষিক অত্যাচারের গল্প - যেমন রাতদুপুরে হরজুর ঠাকুমার বোনকে সাহেব ম্যানেজার জর্জ ওয়ালার ডেকে পাঠিয়েছিল তার বাংলায়, যেতে চায়নি, শেষ পর্যন্ত যায়নি। তার জন্যে তার বাপ ভাইকে ভাদ্দুরে গরমে রোদে আর বৃষ্টিতে পাতিঘরের ছাদে দিনভর হাত পিছমোড়া করে বেঁধে রেখেছিল সাহেব। বাপটার ঘাড় ঝুলে পড়েছিল বিকেলের আগেই, জিভ বের করে জল চেয়েছিল, পায়নি। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে খুঁটিতে বাঁধা অবস্থাতেই মরে গিয়েছিল। আর ভাইটা? দিনভর সুয্যির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে আধাকানা হয়ে গিয়েছিল। জীবনভর চোখে প্রায় দেখতে পায়নি। হরজু তার বৌকে শুয়োরের মাংস কেটেকুটে দিতে দিতে পুরনো গল্প আবার শোনায়। আজাদি হল, কেউ বলল এইবার দিন পাল্টাবে। চা মাজদুর ইউনিয়ন হলো, তা পুরোটা কি পাল্টালো? বাবুদের বাড়ি বেগার খাটা, গালি অপমান সব দুখ কি আর দূর হলো? তবু চলছিল একরকম। এখন আবার কোন পালা শুরু হয় কে জানে! ফিসফাস আলোচনা চলতে থাকে। পাত্থরদেবতা নাহারগাছের তলায় শুয়ে শুয়ে এসব দুঃখের কথা নীরবে শোনেন। সইবার ক্ষমতা দেন। রইতে গেলে সইতে হয়।

    বস্তিতে সুবলমাস্টার আজকে তুলসীদাস পড়বেন। তিনি আসেন মাঝে মাঝে, সুর করে রামায়ণ গান শোনান। ভোজপুরী টান, গলাটি মিঠে মিঠে। শুনতে সকলেই ভালোবাসে। পয়সা টাকার খাই নেই, একটা পিদিম একটা ধূপতি আর একটা কাপড়ঢাকা জলচৌকি হলেই খুশি। আজকে আবার আসরের তোড়জোড় শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাগানের একমাত্র পুরুতঠাকুরের আগমন পুরো লেবারবস্তির মেয়ে মরদকে সন্দিহান করে তুললো। মাঝেমাঝে পুরুত একটু লাগে বৈকি। একটু আধটু ধর্মাচরণ। নাবাল আসামে কে না মনসা মাইকে ভয় পায়। দুধ কলা পদ্মফুল সব নিজেরাই জোগাড় করে, মন্তরটা কি আর পড়তে পারে বামুন ছাড়া? তখন এঁকে ডাকে এরা। ইনি তুচ্ছতাচ্ছিল্য তুই তোকারি করেন। খাই এঁরও বেশি নয়। কিন্তু লেবাররা হদ্দ গরিব। তায় তলবের বেশিটাই যায় হাঁড়িয়ার নেশায়। এরা পুরুতঠাকুরকে এড়িয়ে চলে।

    হরিশ্চন্দ্র চক্রবর্তী অপেক্ষা করেছেন কখন আসর বসে। তুলসীদাস শোনার সময় তার নেই। তিনি তাঁর কথাটুকু বলেই বিদায় নিতে চান। থাকেন একটু দূরে, ঘোষপাড়ার কাছে। একঘর বামুন, ঘোষপাড়ার বাঙালিরা তাঁকে দিয়ে শনিপুজো লক্ষ্মীপুজো করায়; সস্তা শাড়ি ধুতি নারকেলটা দক্ষিণাটা দেয়। অসমিয়া গৃহস্থরা নিজেদের ব্রাহ্মণকেই ডাকে। রিফ্যুজি বামুনের কদর করেনা তারা। তবে হ্যাঁ, ওঁর যজমান বাগানের ম্যানেজারবাবুর মা। শনি সত্যনারায়ণ লক্ষীপুজো সবেতে মোটা দক্ষিণা দান ব্রাহ্মণভোজন - ওঁর দয়াতেই হরিশচন্দ্রের চলে মোটামুটি। বছরে একটা দিন অশিক্ষিত কুলিদের পাত্থরঠাকুরের পায়েও দুটি জবাফুল বেলপাতা দেন। অংবং করেন, এরা চাঁদা তুলে দক্ষিণা দেয়।

    সুবল আসনে বসার আগেই বামুনঠাকুর কিছু বলতে চান। সুবল আপত্তি কি আর করতে পারেন! হরজু সর্দার আর সুরিয়াবুড়ি ছেলেছোকরাদের ধমকান। চুপ যা, থাম। ঠাকুরমশাই কী বলে শোন। অল্পবয়সি ছোঁড়াছুঁড়িগুলো তুলসীদাসেও মন নাই। বড়রা পাঠ শুরু হলে ঢুলবে আর এরা পাতিঘরের ছাদে উঠে নাচাগানা শুরু করবে। এখন সবার বকাঝকা খেয়ে থামল।
    পুরুতঠাকুরের বক্তব্য হল তিনি ম্যানেজারের বাড়ি থেকে শুনে এসেছেন হনুমানপ্রসাদ ত্রিপাঠি নামে নতুন ম্যানেজার এই রোগাপটকা বেঁটে মছলিখোর বামুনকে দিয়ে পূজাপাঠ করবেন না। তেজপুর থেকে পশ্চিমা পুরুত আসছে, লম্বা চওড়া টকটকে রং সংস্কৃত জানা পাশ করা পুরুত। এতদিনে হরিশচন্দ্রের ভাত উঠল বলে। পুরনো ম্যানেজারবাবু আজকেই জানিয়ে দিয়েছেন আগাম খবর। এখন এ তো এক পুরুত ভাত মারছে অন্য পুরুতের - এতে সোমারী, দুরজেন, পাউলুসদের কী? রোজারিওরই বা কী? আছে, আছে কথা। বাংলার বিরাট চৌহদ্দিতে নতুন পুরুতের কোয়ার্টার হবে। আর হবে মন্দির। পাত্থরঠাকুরকে তুলে নিয়ে যাবে মন্দিরে।
    শহুরে কটা বাবু আর দিদি এসেছিল না সেদিন লিপস্টিক মাখা চুড়িদার পরা? পাত্থরদেবতাকে ওরা নাকি বলেছে বিষ্ণুদেবতা। চার হাত, হাতে পদ্ম। নূতন মালিকের মতে এই দেবতাকে মন্দিরে না রাখলে পাপ হবে। নাকি হয়েও চলছে পাপ, বারো জাতির ছোঁয়া লাগছে। কাপড় কাচছে, পাথরে চড়ে বসছে। এ চলতে দেবেনা। প্রবীণ শ্রমিক নারী পুরুষ দাদা পরদাদার আমল থেকে এই বাগানে কাজ করছে। এই ঠাকুর তাদের সাপের কামড়, বন্যা, ম্যালেরিয়া তাবৎ উৎপাতে ভরসা। এরা এই দেবতার অধিকার ছেড়ে দেবে? কেন দেবে? টাকা আছে বলে দেবতাকে কিনে নেবে? হয় নাকি?
    আজকে তুলসীদাসে কারো যেন তেমন মন বসল না। সুবল মাস্টারও বেশিক্ষণ পাঠ করল না। শুক্লা দশমীর চাঁদ মাঝ আকাশে ওঠার আগেই আসর ভাঙল। সবচেয়ে মাথাঠান্ডা মংলুসর্দার সবাইকে বোঝাল - দেখাই যাক না কী হয়।

    ফিসফাস চলছে। ওদিকে বাংলোর বাগানের ওপাশে ইঁট দিয়ে টালির চালার মন্দির উঠছে ওদিকে ইকরার বেড়ায় সিমেন্ট প্লাস্টার দিয়ে পুরুতের কোয়ার্টার। গরীব রোগা টাকমাথা হরিশচন্দ্র চক্রবর্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে। পুববাংলার গরীব বামুন, ভিটেটুকু ছাড়া আর কীইবা ছিল! তাওতো ছেড়ে আসতে হয়েছিল শূন্য হাতে। এপারে এসে ক'দিন থিতু হয়েছিল, এখন আবার এই বাগানের কুঁড়ে ছেড়ে কোথায় খুঁজবে নতুন জীবিকা নতুন আশ্রয়! বুদ্ধিও কষে। সন্ধ্যায় সকালে লেবারবস্তির বুড়ো জোয়ান সর্দারদের তাতায় - এতদিনের ঠাকুরকে কেন তোদের থেকে ছিনিয়ে নেবে? তোদের কোন সম্মান নাই? হলই বা মালিক। এটা আজাদ দেশ কি না? এক মংলুই ত্রস্ত। বলে - কী করব? হামরা কি উয়াদের সঙ্গে লড়ে পারি? সুরিয়াবুড়ি রেগে আঙ্গুল নাড়ে - কেনে পারব না, পারতে হবেক। পাউলুসও বলে, আলবাত পারব। মালিক একলা কি করবে, আমরা এতজন। লড়ব হামি সব। দিব না দেবতারে।

    একদিন হাতি নিয়ে এল লোকজন। ভারী পাথর, কবেকার কোন পাথুরে দেবালয় থেকে ভেসে আসা খিলান, হয়তো বানরাজার প্রাসাদেরই ভাঙা অংশ কি ভরলী মন্দিরের। হাতি দিয়ে শিকল বেঁধেই হয়ত টেনে তোলা হবে।

    মন্দির প্রতিষ্ঠার আয়োজন চলে। উত্তেজনায় তলায় তলায় বাড়ে। আশেপাশে টিউলিপ, বেলসিড়ি, সিরাজুলি চাবাগানের লেবাররাও কানাঘুষো খবর পায়। সহানুভূতি সবারই। গরীবের পাত্থরঠাকুর কোন দিল্লিওলা শৰ্মার কথায় সিমেন্টের কুঠুরিতে বন্দি হবেন। কালাকুচি নদীর তীরে নাহার গাছের তলায় তাঁর এতদিনের বাস। শূন্য গাছতলায় তারা কার কাছে দুটি লালপাতিয়া ফুল, দুটি চিনিচাম্পা কলা আর আগরবাত্তি দিয়ে সুখদুঃখের কথা বলবে। জেদি পরিশ্রমী মানুষগুলির আঁতে বড় লেগেছে। হতে দিবেক নাই এই জুলুম।

    নূতন মালিক মহাবীর শর্মার আসামে আরো তিনটি চাবাগান, গুয়াহাটির এডভোকেট লাখোটিয়া তার আইনি পরামর্শদাতা। সরকারের ওপরমহলে লোক আছে, ব্যবসা চালাতে গেলে না থাকলে চলে না, তায় চা বাগানের ব্যবসা। শর্মাজি খবর রাখছেন, তৈরিও হচ্ছেন। এইসব আগে বন্ধ করতে হয়।

    সারা অঞ্চল জুড়ে ফাগুয়ার ধূম। রাজবংশীরা ঠোঁটে পুঁইবিচির রং মেখে রাধাকৃষ্ণ সেজে একে অপরকে রং দেয়। শ্রমিকরা হাঁড়িয়া খেয়ে উদ্দাম হোলি খেলে। সমাজ - নিয়ম - বাবুভায়া কারোর পরোয়া করে না - চারদিকে হোলি হ্যায়।

    আজকের শুভদিনে পাত্থরঠাকুরকে শুদ্ধ করবেন বলিষ্ঠ ফর্সা লম্বা নতুন পুরোহিত। ছোট মানুষের সঙ্গে থেকে ঠাকুর অশুদ্ধ হয়েছেন যে। অভিষেক হবে দেবতার। দুই সহকারী প্রকাণ্ড পেতলের থালায় নারিয়েল চন্দন চাল কুমকুম নিয়ে প্রস্তুত। বাজনদার এসে গেছে। হরিশচন্দ্র পাউলুসকে বলে - তোরা ছেড়ে দিবি পাত্থরঠাকুরকে? না না, কভি নেহি। পাউলুস, তার মামাতো ভাই সিরাজুলির বুধনও গলা তোলে নেহি নেহি। সোমারী বলে হামিরা কি পারবো উয়াদের সাথে? পারতে হবেক। সুরিয়াবুড়ি হরজু সব একমত। দেবতার অধিকার ছিনিয়ে নিতে দেওয়া হবে না।

    পাত্থরঠাকুরকে ঘিরে ভীড় জমে যায় কলাকুচির ঘনঝোপে ঘেরা নাহার গাছের তলে। শেষরাত থেকে জমা হয় বাগানের লেবার। নারী পুরুষ গাবরু ডেকা। নাই ছাড়বো মোদের দেবতা মোরা নাই ছাড়বো।

    মাঠে হাঁড়িয়ার বড় পাত্র, মাটির গামলায় রং পিচকারি। উতসবের আনন্দ আর প্রতিরোধের উত্তেজনার উন্মাদনা ছড়ায়, বাবুপাড়া শঙ্কিত। পুলিশকে খবর দেওয়াই ছিল।

    পুলিশের গাড়ি পৌঁছতে উত্তেজিত মানুষগুলি পাগল হয়ে ওঠে । পুলিশ মাইক বাজিয়ে কীসব ভাল কথা বলতে চায়। উৎসব, হাঁড়িয়া, অধিকারের দাবিতে আচ্ছন্ন মানুষগুলির মিলিত আবেগ ফুঁসে ওঠে - - ঢিল ছোঁড়ে - পুলিশ শূন্যে গুলি ছোঁড়ে। তির ধনুক লাঠি বল্লম টাঙ্গি বেরিয়ে আসে লেবারবস্তির বঞ্চনাপীড়িত অন্ধকার থেকে। সোমারী সুরিয়াবুড়ি দূর্জেন হরজু মংলুসর্দার চেঁচিয়ে ওঠে - নাই দিবা - হামাদের দেবতা হামিরা নাই ছোড়ব। মশাল জ্বলে ওঠে হাত থেকে হাতে।

    পুলিশ গুলি চালায়। সোমারী আঁকড়ে ধরে পড়ন্ত পাউলুসকে।

    হরিশচন্দ্র চাঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে কোলাহল শোনেন। ফাগুয়ার চাঁদ পশ্চিমের আকাশে ঢলে পড়েছে। পাউলুস পাত্থরঠাকুরের দিকে পা কালাকুচির জলে মাথা রেখে ঝুলছে - সোমারীর আর্তনাদ ভাসে - না না, তুই যাবি না, যেতে দিব না তুকে। নাই ছোড়বো।

    লালপাতিয়ার গাছ ঢলে ঢলে পড়ে নদীর জলের লালে। পাথরের দেবতার শয্যা বেয়ে মানুষের রক্ত গড়ায়, ঠাকুর শুয়ে থাকেন কালও যেমন ছিলেন। আর্তনাদ, গর্জন আছড়ে পরে আকাশ জুড়ে, নাই ছোড়ব। খরস্রোতা নদীর ওপারে উৎসবের চাঁদ ডুবে যায়।

    দাউদাউ আগুন, সেই আগুনের আভায় লাল আকাশ দেখা যায় সিরাজুলি, বেলসিরি, টিউলিপ চাবাগানের শ্রমিক বস্তি থেকে। কলাকুচি নদীর রক্তমেশা স্রোত বয়ে চলে অন্য ঘাটের দিকে।


    ২০১৭ গুরুচণ্ডা৯ পুজোস্পেশাল ইবুকে প্রকাশিত।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ০৮ ডিসেম্বর ২০১৮ | ১৩৩৮ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dd | 90045.207.1256.4 (*) | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৫২85649
  • চমৎকার।

    যদিও শেষটা প্রেডিক্টেবল।

    আরো ভালে লাগে যখন গুচর পাতায় দেখিই এদানী বহুগল্পই শহুরে ফ্ল্যাটবাড়ীর চৌহদ্দি পার হয়ে এরকম সমাজের ওদোল খোঁদল আর সেখানকার মানুষদের নিয়ে লেখা হচ্ছে ।
  • প্রতিভা | 671212.72.123412.88 (*) | ০৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ১২:৪৫85650
  • খুব ভাল লাগল।
  • Titir | 892312.210.780112.26 (*) | ১৯ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৫:৫৫85651
  • বড় কাছ থেকে দেখা জীবন উঠে এসেছে এই লেখায়।
  • Du | 7845.184.8912.41 (*) | ২০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৫:১২85652
  • এই লেখাটা সেরা গল্প সংকলনে পড়ছি মনে হচ্ছিল।
  • শঙ্খ | 2345.110.454512.139 (*) | ২০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৫:৩৫85653
  • অসাধারণ!
  • r2h | 2405:201:8005:9947:d4d6:1602:e03d:9c56 | ০৩ এপ্রিল ২০২২ ০০:৪০505942
  • এইটা ২০১৭ থেকে মাথায় গজগজ করছিল, আবার মায়ের লেখা বলে বলতে বাধো বাধো ঠেকছিলোঃ)।
    আজ অন্যত্র ফেসবুকে অন্য কমেন্টের সূত্রে লিখলাম, তাই এখানেও পোস্ট করে দিইঃ

    "পাত্থর গল্পটা আমারও খুব ইন্টারেস্টিং লেগেছিল।
    ...
    চা বাগানের শ্রমিক মালিক সংঘর্ষ, তার মূলে এক দেব মূর্তি, সেই দেবতার লোকায়ত ও "সর্বহারা"র সুখদুঃখের সঙ্গী হয়ে পড়া, আর তাঁর শুদ্ধিকরন নিয়ে মালিকপক্ষের সঙ্গে সংঘর্ষ, রিলিজিয়ন আফিম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গে "নিপীড়িতের দীর্ঘশ্বাস, হৃদয়হীন জগতের হৃদয়, প্রাণহীন অবস্থার প্রাণ", এই জিনিসটা আলগোছে তুলে ধরা চমকপ্রদ লেগেছিল। ছিন্নমূল হেলাফেলার বাঙালী পুরুতঠাকুরের পার্শ্বচরিত্রও।
    ..."
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন