এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • সেকেলে ভোট আর একেলে ভোট

    শক্তি দত্তরায় করভৌমিক লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৫ এপ্রিল ২০১৯ | ১৩২২ বার পঠিত
  • টিভি চালাই। খবর দেখি। একদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী বিচিত্র সব শিরোভূষন শিরোধার্য করে এদিক ওদিক ঘুরে লাফিয়ে লাফিয়ে চিত্কার করে অন্যের অকর্মণ্যতা প্রচার করছেন। কখন কোন জাদুবলে ভারতের গৌরব সেনাবাহিনীকে নিজের দলের প্রচারের হাতিয়ার করে উঁচিয়ে ধরছেন। এক এক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী আঙুল উঁচিয়ে সমান চিত্কারে পাল্লা দিচ্ছেন। কে কত গর্জনশীল তার ওপর ভোট নির্ভর করছে। বিরোধী মানেই দেশদ্রোহী এটা আগে বিশেষ কেউ শেখায়নি। এবারে শিখলাম। আগে গ্রামগঞ্জের মহিলারা প্রার্থী মহিলাদের দেখতেন মোটামুটি নিজেদের একজন হিসেবে। তাঁরা চৈত্রের দুপুরে লাল সিল্ক পরে গ্ল্যামার ছড়ানো সুদূরিকা ছিলেন না। একাত্তরে উদয়পুরের খিলপাড়ার মাঠে হেলিকপ্টার থেকে নেমেছিলেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী। হারুর মা বিকেলে বাসন মাজতে এসে বলেছিল, আকাশ থিক্যা নামছইন দুর্গা ঠাকরাইনর লাখান এক বেটি। আকাশ থন নামলা তবু মাথার কাপড়খান সরেনা। ঐতিহ্য এক মৃত বস্তু হলেও সাধারণ মানুষ কিছু হলেও শ্রদ্ধা করে। বর্ষিয়সী নায়িকা চোখ মেরে তা ধুলোয় ছুঁড়ে কী আল্হাদীপনা। ভোটে দাঁড়াবেন কি অথবা জিতলেও দেশ হয়তো যে তিমিরে সেই তিমিরেই থাকবে তবু প্রিয়ঙ্কার শোভন উপস্থিতি বেশ লাগছে। হাসিটি মধুর মর্যাদাব্যঞ্জক। বিভিন্ন সংস্কৃতি, ধর্ম এক রক্তে বহমান। আমার আর সেই প্রিয়দর্শিনীর রাজনৈতিক মত মেলে না, তাঁর অনুসৃত নীতির প্রতি বিরাগ আছে। জরুরি অবস্থার বিভীষিকা চাক্ষুষ করেছি। তবু ইন্দিরা গান্ধীর নাতনী, এতো সুন্দর মেয়ে, সাজে চলনে এতো সুরুচি আর পরিমিতিবোধ, মনে হয় আরো একটু দেখি।

    প্রচার ছেড়ে চলে এলাম রূপ বর্ণনায়, মেনেই নিন দুর্বলতাটুকু। প্রচারের ধরন আর পরিকল্পনায় অনেক সময় আসল ইস্যু, রাজনৈতিক অবস্থানভাবনা থেকে বিচ্যূতি ঘটে যায়। আগরতলায় একজন আদ্যন্ত সৎ প্রাচীন গান্ধীবাদী নির্দল প্রার্থী ছিলেন, লোকে বলতো সাধুভাই - তাঁর জীবনযাত্রা ও প্রকৃতির কারনেই এই নাম। পিচবোর্ডের রঙীন ঘোড়া চেপে ভোট চেয়ে বেড়াতেন। ছোটদের ভোটাধিকার থাকলে উনি জিততে পারতেন। বড়রা তাঁকে ভোট দেয়না। প্রতিবার জামানত বাজেয়াপ্ত হয়। দুটি ভোট নাকি পান, একটা নিজের একটা পতিপ্রাণা স্ত্রীর।
    বোধহয় জনতাদলের মিছিল সেটা, সামনে সুসজ্জিত দুই হাতী। এজেন্ডা প্রতিশ্রুতির রূপায়ন হবে কিনা কে জানে। কত লোক হাতী দেখে খুশী হয়ে ভোট দিয়ে দেয়।
    এরই মধ্যে দুচারজন প্রার্থী রাজপথের ধূলায় অবতীর্ণ হন রাজবাড়ির রহস্যে ঘেরা অন্দরমহল থেকে। তাঁরা রূপে আভিজাত্যে অচেনা। চিরদিনের পথের ধুলায় তাঁরা চেনা চেনা নন। ভোটের সময়ে বাঁশের কুটিরে তাঁদের পায়ের ধুলো পড়ে। এক খিলি পান এগিয়ে দিয়ে সধবাদের কপালে সিঁদুর পরিয়ে দেন। বৌ ঝিয়ারিরা রাজলক্ষ্মীদের কি আর দেবেন নিজের মূল্যবান ভোটটা দিয়ে দেন।

    আমার বোধহয় তখন বছর নয়েক বয়স, আগরতলার কংগ্রেস ভবনের কাছাকাছি বাড়ি ছিলো। তখনকার ভোটে অত মারপিট, ফ্লেক্স, কাটআউট, গালাগালির সমারোহ না থাকলে ও আয়োজন বেশ ভালো রকমই ছিল। সর্বত্র নেহরু আর গান্ধীর ছবি। চারিদিকে জোড়া বলদ - তবে এখনকার গরুর দাপটের চেয়ে তখন বলদের দাপট কম ছিল। মাথায় গান্ধীটুপি কংগ্রেস সমর্থকদের মিছিলই ছিল লম্বা। শ্লোগান উঠতো ভোট দিন ভোট দিন জোড়াবলদে ভোট দিন। শচীন্দ্র লাল সিংহ আর ঊমেশ লাল সিংহ দুই ভাই স্বাধীনতা সংগ্রামী, জেল খেটেছেন। দুজনেই ভোটপ্রার্থী। দুষ্টু ছেলে রাস্তার পাশে মুখ লুকিয়ে চেঁচিয়ে বলে, জোড়া বলদের দুই সিং ঊমেশ সিং আর শচীন সিং। মিছিল মারমুখী হয়না, হেসে হেসে এগিয়ে চলে। ক্যমুনিস্ট পার্টির মিছিল যায় দুপুর বেলা। বেশিরভাগ পাহাড়ের মানুষ, বাঙালি ও বিস্তর। মাথায় লাল ফেট্টি। সকালের ছেলেগুলোই রব তোলে কংগ্রেসকে দিলে ভুট (বলা বাহুল্য কথাটা ভোট) ভবিষ্যতে হবে সুখ /ক্যমুনিস্টরে দিলে ভুট/ পাইবেন একটা ছিড়া কুট (ছেঁড়া কোট) ক্যমুনিস্টরাও হেসে ফেলে হেঁটে চলেন। যে যার ভোট মনোমত প্রার্থীকে দেন। খুনোখুনি হয় না। মাইকে গান বাজে, দাদাঠাকুরের লেখা ভোটেরো লাগিয়া ভিখারী সাজিনু। নানা দল নানা শ্লোগান, প্রতিশ্লোগান, প্রতীক চিহ্নের বৈচিত্র। হ্যারিকেন, সাইকেল, গোলাপফুল, হাতী সব প্রতীক নিয়েই ছড়া বাঁধা হয়। নকুলদানা জল বাতাসা বিলোনো এগুলো হালের ব্যাপার। কংগ্রেসেরই তখন অনেক বোলবোলাও। ঐ পার্টির ভূপেন কাকুরা গান, একজাতি এক প্রান একতা/ জাগে নব ভারতের জনতা। বেশ ভালো কথা। তারপরই স্বতন্ত্রের সত্ত্বা নাই/ নির্দলের পাত্তা নাই। পড়া ফেলে রাস্তার পাশে যাই, কারা বলে হ্যারিকেনের তেল নাই / গোলাপ ফুলের গন্ধ নাই।

    প্রিসাইডিং, পোলিং অফিসাররা জীপগাড়িতে, মুড়ির টিন বাসে আর হাতির পিঠে কর্তব্য পালন করতে যান পাহাড়ে গ্রামে শহরের বুথে। হাতে হ্যারিকেনের সঙ্গে মুরগী। রাতের পরোটার সঙ্গে মাংস। মণিপুরী, ত্রিপুরী, মিজো, হালাম কুকী জমাতিয়া নোয়াতিয়া ভোটাররা কোন গ্রাম কাকে ভোট দেবে আলোচনা করে ঠিক করে নিজের গোষ্ঠীর পোষাকে সেজেগুজে সকালে বেরিয়ে পড়েন। দলীয় প্রতিনিধিরা প্রতিদ্বন্দী হলেও কৌটো খুলে জর্দা পান দেয়া নেয়াতে কিছু আপত্তি নেই।

    মেয়েদের ভোটের ডিউটি করা নিয়ে ইতিউতি আলোচনা দেখি। একবারই পোলিং ডিউটি করেছিলাম, তখন ভোটে পিকনিকের মেজাজ। ১৯৭১, দেশের অবস্থা খুব শান্ত নয়, সদ্য অনেক রক্তপাত ও প্রতিভাবান তরুণ তরুণীদের প্রাণহানি তখনো স্মৃতি হয়ে যায়নি, কোন কোন দেওয়ালে লাল কালিতে লেখা তখনও পড়া যায় জামজুরির অত্যাচারী জোতদার এলফুজ খতম। এসডিও অফিস যে কয়েকটি অতি অল্পবয়সী শহরে নবাগত মহিলা শিক্ষককে পোলিং ডিউটি দিয়েছেন স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠরা মেনে নিতে পারেননি। রক্ষণশীলতার সঙ্গে সংগত সহানুভূতি ও কারণ ছিলো। একে তো আগের রাত থেকেই বুথে উপস্থিত থাকা নিয়ম। আমাদের সে ব্যাপারে ছাড় দেয়া হয়েছিল। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে বুথে পৌঁছতে হবে। টয়লেট ইত্যাদি কোনো সুব্যবস্থা ছাড়া পুরুষ সহকর্মী এবং পার্টি এজেন্ট ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের লোকজন, তাদের মধ্যে কাজ করতে হবে। তখনকার দিনে সহৃদয় অভিভাবকের মতো বড়রা চাননি আমাদের ও রকম ডিউটি পড়ুক। তার ওপর আবার প্রিসাইডিং অফিসার ছিলেন একজন প্রবাসী বিহারী অল্প বয়সী স্মার্ট ইঞ্জিনিয়ার। মুখরোচক আলোচনার সুযোগও ছিলো। জায়গাটা মুসলমান প্রধান টিলাবাজার। উত্তর ত্রিপুরার ছোট গ্রাম। আমি আর ভদ্রা কিন্তু উত্তেজনায়, নূতন অভিজ্ঞতার স্বাদ পেতেই চাইছিলাম। ভোটের দিন অন্ধকার থাকতে স্নান সেরে ডিউটিতে গেলাম। গ্রামের বর্ষিয়সী মহিলারা বুথে ঢোকার আগেই আমাদের জানিয়ে দিলেন, তাঁরা বুথের বাইরে থাকবেন। পালা করে আমাদের খেয়াল রাখবেন। টয়লেটের সমস্যা অনিবার্যই ছিল। অন্য অসুবিধা গায়ে লাগাইনি। দুপুরবেলা ভিড় কমে গেলে সুস্বাদু পরোটা মাংস কে সাপ্লাই করেছিল মনে নেই। ভদ্রা মাংসাহারী ছিল না, দইচিঁড়া, কৈলাশহরের বিখ্যাত মর্তমান কলা দিয়ে ফলার করল। অশান্তি কিছু হয়েছে বলে মনে পড়ে না তবে প্রিসাইডিং অফিসার এক বৃদ্ধার ফটো আর চেহারার অমিল নিয়ে কথা বলায় মহিলা চটেমটে ভদ্রলোকের মাথার ওপর নিজের কালো ছাতাটা সজোরে মেলে ধরেছিলেন। এজেন্টরা একজোট হয়ে বিবাদ মিটিয়ে দিয়েছিলেন। সবাই চেয়েছেন নির্বিঘ্নে ভোট হোক। আমরা খুশি, যা হোক একটু কিছু হোলো তো?

    এরপর কাউন্টিং এর ডিউটিতেও দেখা গেল বেশ কিছু মহিলাকে যুক্ত করা হয়েছে। প্রায় সবাই নবনিযুক্ত শিক্ষক। কমনরুমের বড়দিদিরা বোঝালেন, আমাদের মেডিক্যাল সার্টিফিকেট দিয়ে অব্যাহতি চাওয়া উচিত। রুদ্ধদ্বার কক্ষে ভোট গণনা হয় কিনা। আলোচনা চলতে লাগলো কোন অফিসারের টেবিলে কার ডিউটি পড়লো। ছোট্ট রক্ষণশীল শহরের আলোচ্য বিষয়ের অভাব পুষিয়ে নিতে হবে তো। এক টেবিলে প্রধান গণনাকারীর অধীনে তিনজন থাকে। কক্ষ রুদ্ধদ্বার। তবে শ'তিনেক মহিলা এবং পুরুষ একসঙ্গে কাজ করবে। রাত হয়ে যাবে কিন্তু ভয় করবে কেন? আমরা নূতন কাজের আহ্বান খুশি হয়ে গ্রহণ করলাম। ভালো স্ন্যাক্সের ব্যবস্থা, ভালো চা, উপাদেয় লাঞ্চ ডিনার। আমরা খুব খুশি। আমার আবার রিকাউন্টিং এর ডিউটিতেও ডাক পড়েছিল।

    কয়েক বছর পর আবার পোলিং ডিউটির ডাক এসেছিল। আমি মহিলা তাই আমার অনেক জুনিয়র ত্রিদিবকে প্রিসাইডিং অফিসার করে আমাকে ফার্স্ট পোলিং অফিসার করা হয়েছিল। এক্ষেত্রেও আমার দায়িত্ব লাঘব করার সদিচ্ছাই কার্যকর ছিল। কিন্তু আমি খুব গাঁইগুঁই করেছিলাম। তবে সেবার শেষ অবধি আমাকে ভোটের ডিউটি করতে হয়নি। ভালোই হয়েছিলো। তখন আমি দুই শিশু সন্তানের মা।ছেলেদের কষ্ট হোতো। মেয়েদের বাড়তি কিছু অসুবিধা তো থাকবেই। অস্বীকার করে লাভ নেই ।

    অবশ্যই এখন পরিস্থিতি অন্যরকম। তখন সবটাই পিকনিকের মেজাজ। আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে মহকুমা শহর চিন্তিত ছিল - তার সবটাই কিন্তু সংকীর্ণতা নয়। আমাদের জন্য সহানুভূতিশীল ছিলেন তাঁরা; মেয়েদের সুরক্ষার কথা ভেবেছিলেন। এখন অবশ্য আমার ছাত্রীরা পোলিং ডিউটিতে পড়লে খুব শঙ্কিত থাকবো। মনে হয় যাদের স্ত্রী, বৌমা বা মেয়ে চাকুরিরতা সবাই শঙ্কিত হবেন। উপার্জনশীল মেয়েদের এখনও সংখ্যা তুলনায় কম, সংগ্রাম দুএকটি সুবিধাভোগী পরিবার ছাড়া বেশি। পুরুষরাও নিরাপত্তা পাচ্ছেন না সেখানে সরকার মেয়েদের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত কি ভাবে কি, করবেন। আমি বলবো কর্মীদের যথাযথ সুরক্ষা এবং বীমার ব্যবস্থা না করে পোলিং এর নামে আতঙ্কের যাত্রায় না পাঠানো হয়।

    নাগরিক সুরক্ষা, সরকারী কর্মচারীদের সুরক্ষার জন্যে জনমত কিভাবে কে গড়ে তুলবে জানা নেই। জনমত গড়ে তোলার জন্যে সংগঠন দরকার, কর্মসূচি দরকার। কোন দলের নেতারা তা নিয়ে বোঝা কঠিন, রাজনীতিতে, ভোটযুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তো থাকবেই, গালাগালির সঙ্গে রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দিতার যোগ থাকতে পারে তবে কয়েকযুগ আগে তা অন্তরালে থাকতো, সামাজিক সৌজন্যে আঘাত পড়তো না। এখন সভাসমিতিতে অশ্রাব্য অশ্লীল গালাগালি টিভি চ্যানেল খুললেই শুনছি। আর ফেসবুকে তো রাজনৈতিক মতামত মানেই পরস্পরকে চোর ছ্যাঁচোড় বলার অধিকার প্রয়োগ করা। পরবর্তী প্রজন্ম শিখছে বড়দের থেকে। গুরুমারা বিদ্যেই শিখছে। জাত তুলে কথা বলা, ধর্ম নিয়ে গর্জন, ভিন্নমতাবলম্বীর সম্মানহানি কিছুতেই পরোয়া নেই। ভোটের লাগিয়া ভিখারী শুধু নয় ডাকাত, গুণ্ডা, ছ্যাবলা, গরু, হনুমান মান যা কিছু সাজতে রাজি। শুধু ভোট যুদ্ধ শুরুর আগেই বলি দিতে হবে ভদ্রতা বোধের বালাইটাকে। দুঃখ হয় আমাদের মহাকাব্যের নবদূর্বাদলশ্যাম নরোত্তম নায়কের পরিণতিতে। রাম তো জানতাম মানুষই। দেবতা জ্ঞানে অনেকেই পুজো করেন। তা তো হয়ই। দেবতারে প্রিয় করি প্রিয়েরে দেবতা। তুলসীদাস, কৃত্তিবাস এই রাজকুমারটিকে দিব্যি মঙ্গলপরশন রাজারাম করে এঁকেছেন। গরীবগুর্বো চাষী ভাই, ভোজপুরী দারোয়ানজীরা সকাল সন্ধ্যা ভালোবেসে রামগান গাইতেন। রামপুর, রামনগর, রামকুটিরের ছড়াছড়ি দেশে এমনকি অন্য দেশে। এই ভক্তিমান সরল মানুষগুলি কৌশল্যার বনবাসী ছেলেটিকে চিনলেও অযোধ্যার রামমন্দির নিয়ে মাথা ঘামায়নি। মন্দির যেখানে হোক করে নিলেই হয়। রঘুবীর শিলা দিব্যি পুজো পাচ্ছেন কামারপুকুরে আরো কতোখানে।
    সেদিন রামনবমী ছিলো - রামের জন্মদিন। ভয়ংকরদর্শন ওই ভক্তদের কী বসন, কী অঙ্গসজ্জা। রামভক্ত ভোটভিক্ষু। গেরুয়া যাকে বলছে সেই কাপড়খান ক্যাটক্যাটে কমলা। বৈরাগ্যের রঙে রক্তের ছিটে দিয়ে বীররসের বদলে বিভৎস রসের প্রকোপ ঘটেছে। নাকে মুখে গায়ে বীভৎস আঁকিবুকি। কপালে ডাকাতের মতো ফেট্টি। হাতে ঘূর্ণায়মান লাঠি, তলোয়ার। এরা নাকি রামভক্ত। রামায়ণ ভুলিয়ে দিয়েছে ভারতবাসীকে। হায় বাল্মীকি আদি কবি, আপনার শোক লিপ্ত শ্লোক, হায় তুলসীদাস, হায় কৃত্তিবাস। রামনবমীতে এমন লড়াই চাওয়া মিছিল এই অঞ্চলের নয়। গ্রামীন ভারতের আদরের রামলালা বৈশাখের তপ্ত সকালে কেমন একলা বসে আছেন রামদাস ঠাকুরের ছোট পূজাঘরে।
    আপনার নাম শুনলেই স্বার্থান্বেষী মিথ্যেবাদী কিছু হিংসুটে মারকুটে লোককে মনে পড়ে কেন আজকাল, এ বড় পরিতাপের বিষয়।

    ~~~
    সে যাই হোক, ত্রিপুরায় নির্বাচনী পিকনিক শেষ হলো আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে - শুরু হোল নির্বাচনী সন্ত্রাস। সুস্থ গণতন্ত্রের জয়গান পরিহাসে পরিণত হয়ে গেল। নব্বুই এর দশকে ভোট আর সন্ত্রাস গ্রামে পাহাড়ে সমার্থক হয়ে গেল - আদর্শহীন ক্ষমতালোভী বন্দুকের নল হয়ে উঠলো ক্ষমতার উৎস। ভোটাররা বেঁচে বর্তে প্রান হাতে করে সাধের ভোটটি দিতে গিয়ে দেখছেন দয়া করে আগেই কেউ ভোটটি দিয়ে গেছে। কাউন্টিং চলার সময়ে এতো কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যেই হলের বাইরে খুনের ঘটনা ঘটল। আর প্রচার চলাকালীন তো কথাই নেই। গ্রামের বৌরা দুগ্ধপোষ্য শিশুদের নিয়ে শাল জারুলের বনে বন্য শুয়োর, নেকড়ে হাতি চিতাবাঘের ভয় ভুলে রাত কাটাতে বাধ্য হোলো। আর পোলিং অফিসার, সেক্টর অফিসার, অবজার্ভারদের অভিজ্ঞতা তাঁদের নিজেদের জবানিতেই শোনা ভালো। আমার স্বামীর কাছে তাঁর ও তাঁকে যাঁরা রিপোর্ট করতেন সেই অফিসারদের কিছু ভয়ংকর অভিজ্ঞতা এবং অসহায়তার বিবরণ শুনেছি কিন্তু সে কথা বিনা প্রমাণে কি করে বলি।

    অতীত মোহময় বটে তবে ভারতের গণতন্ত্র পূর্ণ কলুষমুক্ত অতীতেও ছিলনা - এই মুহূর্তে আরো অনেক কিছুর সঙ্গে মনে পড়লো হাজার হাজার চা শ্রমিকদের দীর্ঘদিন ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যাওয়ার কথা। তবু মনে হয়, তখনও শিক্ষিত সামাজিক পরিসরে ভদ্রতার আবরণটা অবশিষ্ট ছিল। গ্রামের গঞ্জের চায়ের চায়ের দোকানে বসে হাটে বাজারে হুল্লোড় করে কি মিছিলের শ্লোগানে নেতা নেত্রীর কালোহাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও ধ্বনি উঠতো বটে, বলা হোতো বটে গলি গলিমে শোর হ্যায় ওমুক নেতা চোর হ্যায় তবুও প্রার্থীরা সভা করার সময়ে পরষ্পরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করলেও একটা সীমারেখা অতিক্রম করতেন না। নিজের গুণকীর্তন তা তো করতে হবে, করতেন। ক্রমে দেখছি যে যতো কু কথায় পারঙ্গম তাঁর মীটিঙে তত জমকালো। তারপর কেউ মন্ত্রী কেউ বিধায়ক কেউ বিরোধী নেতা নেত্রী হবেন। কিন্তু এই ভারতের মহামানবের সভ্যতার গায়ে অভব্যতার কালো ছাপ, ছাপ্পা ভোটের,ধাপ্পাবাজির, মিথ্যা প্রতিশ্রুতির দুর্গন্ধ কোনোদিন দূর করা যাবে কি?

    লেখা শুরু করেছিলাম হালকা মেজাজে, ছোটবেলার দেখা ভোটের প্রচারের মজা মেশানো গান আর শ্লোগান নিয়ে। আস্তে আস্তে কখন পৌঁছে গেলাম ভোটের ডিউটি আর নির্বাচনী সন্ত্রাস নিয়ে আক্ষেপ আর হতাশায়। ভাবলাম আলাপচারি বিলাপে শেষ হয়ে গেল।

    আজ পঁচিশে এপ্রিল। সকালের খবরের কাগজ খুলেই প্রথম পাতার খবর --ডোমকলের গৃহবধূ আনসূরা বিবি নিজের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রয়োগ করে ঘরে ফিরতেই স্বামী তাহাসেন শেখের প্রশ্ন, কাকে ভোটটা দিলে? আনসূরা খোলা মনে সত্যি কথা বলতেই স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির লোকেরা বেধড়ক পিটিয়ে মুখে এসিড ঢেলে দিয়েছে। অপরাধ আনসূরা পরিবারের মনোমতো দলকে ভোট দেয়নি। মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজে মরণের সঙ্গে লড়ছে গ্রামীণ বধূটি। ডাক্তাররা বলছেন, তার শ্বাসনালি ক্ষত বিক্ষত হয়ে জ্বলে গেছে।

    পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের শ্বাসনালি নিরাময় করার ক্ষমতা আমাদের রাষ্ট্রীয় "হস্তী"দের আছে তো?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৫ এপ্রিল ২০১৯ | ১৩২২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • Tim | 013412.126.562323.237 (*) | ২৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৬:৩৯47967
  • লেখাটা ভালো লাগলো। এরকম প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাপ্রসূত বিবরণ খুব দরকারি ।
  • খাতাঞ্চী | 232312.167.013412.178 (*) | ২৫ এপ্রিল ২০১৯ ০৭:০৭47966
  • .
  • b | 562312.20.2389.164 (*) | ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ০৮:৩৩47968
  • "আজকালকার গরুদের তুলনায় সেকালের বলদের দাপট কম ছিলো"
    এই লাইনটা পড়ে হেসেই চলেছি।
  • pi | 7845.29.450123.210 (*) | ২৮ এপ্রিল ২০১৯ ১২:১৭47969
  • ঃ))
  • স্বপন কুমার ভট্টাচার্য | 27.56.13.173 | ১১ অক্টোবর ২০২০ ২১:২৫98295
  • লেখাটা অসাধারন। খুব ভাল লাগল। দুই একটি সংযোজন:- ইন্দিরা গান্ধী উদয়পুরে প্রথম এসেছিলেন ১৯৭২ সালের ৭ ই মার্চ। একাত্তর সালে নয়। সভাটি হয়েছিল রাজারবাগ মাঠে, খিলপাড়া নয়। এলফুস নিহত হয়েছিলেন মহারাণী গ্রামে। জামজুড়ি নয়।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন