এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • শ্রাবণধারা ও অন্য মেয়েটি

    শক্তি দত্ত রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৭ আগস্ট ২০২০ | ১৬৬০ বার পঠিত
  • মন্ত্রী

    শ্রাবণধারা দেববর্মা তিলছড়া স্কুলের মাঠে বক্তব্য রাখছিলেন। বয়স কম। গড়পরতা ট্রাইব্যালদের তুলনায় দীর্ঘাঙ্গী। লালচে হলুদ রঙ্ যেমন হয়ে থাকে। বড়খোপা, ঈষত্ পিঙ্গল কেশভার। শেষ বিকেলের আলো পড়ে চূর্ণকুন্তল যেন কপালের পাশে ঝিকিয়ে উঠছিল। গ্রীক দেবীর মতো মহিমাময়ী। অনাড়ম্বর যুক্তিসঙ্গত বক্তব্য। মিথ্যে আশার ফুলঝুরি নেই, বাস্তবের মাটিতে পা রেখে চলেন, বোঝা যাচ্ছে। নিঃসম্বল দিনমজুর বাপের কন্যা, উচ্চ মাধ্যমিক পাশ। প্রকৃতই সর্বহারার প্রতিনিধি, অর্থনৈতিক সামাজিক লিঙ্গবৈষ্যম - নানান শৃঙ্খল ভেঙে মেধা এবং কর্মক্ষমতাবলে সুসংগঠিত পার্টিতে মন্ত্রী হয়ে নিজের যোগ্যতা প্রমাণ করছেন। তিনি রাজ্যের বিস্ময়।

    তাঁর নিরাপত্তা রক্ষীদলে আছেন তাঁরই স্বামী। বসে আছেন একটু দূরে ব্যাজার মুখে। তাঁকে নিয়েও কৌতূহল কম নয়। পার্টির দূরদর্শী অভিভাবকরা দম্পতির মধ্যে বিশ্বাস যেন কোন মতেই চিড় না ধরে তাই নিরাপত্তারক্ষীদের অন্তর্ভুক্ত করেছেন স্বামীটিকে। স্বামীর অহং আহত হয়। মন্ত্রী ফুলমালা বা স্তবক সমন্বিত যে আপ্যায়ন পান - নিরাপত্তারক্ষী সেই বৃত্তের বাইরে। আগুন ধূমায়িত হয়।

    রাজ্যের নামকরা সাহিত্যিক এবং অধ্যক্ষ অন্তরা দেববর্মন কোলকাতার ত্রিপুরা ভবনে আছেন সরকারি কাজে। আছেন ওখানেই মন্ত্রী শ্রাবণধারা তাঁর স্বামী সহ। রাতের দিকে অসহায় লিঁয়াস অফিসারের তরফে বর্ষিয়সী অন্তরাদিকে জানানো হলো মন্ত্রী দুদিন অনাহারে আছেন। দাম্পত্যকলহে নির্যাতনের ছাপ পড়েছে। বয়োজ্যেষ্ঠা দিদি যদি সামলাতে পারেন। অন্যরা কি আর করবেন। দিদি পারলেন না।

    ক্রমশ এমন দাঁড়াল পার্টি কেলেঙ্কারি এড়াতে যোগ্যতা সম্পন্ন ব্যক্তিত্বময়ী শ্রাবণধারাকে ক্ষমতার বৃত্ত থেকে সরিয়ে দিল। বছরখানেকের মধ্যে দৃঢ়সংকল্প হার না মানা মেয়েটি নিশ্চিহ্ন মুছে গেল অধিকার, ক্ষমতা, জনমনের বৃত্ত থেকে। জনসাধারণ জানে না জুমের মাটি থেকে মাথা তুলে যে ক্ষমতাময়ী মন্ত্রী হয়েছিল সে কোন্ নিভৃতে কুটিরে সিদলের গোদক রান্না করছে। লাংগি মাদকতাময় করার সাধনায় বাধ্য হচ্ছে। হয়তো চাঁদের রাতে নাচতে গিয়ে গোপনে চোখের জল ফেলছে। সার্থক নাম ছিল তাঁর, শ্রাবণধারা।

    ~~~

    যমে নিলেও নিব, জামাইয়ে নিলেও নিব

    তখন আটের দশকের মাঝামাঝি বা শেষ। ভারতের উত্তরপূবের সাতবোন রাজ্যের একটি রাজ্য। শহরতলির বা গ্রামের স্কুল গুলি পুড়িয়ে দেবার একটা চক্র সক্রিয়। হতে পারে শাসকদলকে উত্যক্ত করা, হতে পারে দলেরই গোষ্ঠী দ্বন্দ্ব, অথবা বেকারত্বের জ্বালায় সরকারী বেতনপুষ্ট শিক্ষকদের প্রতি আক্রোশ চরিতার্থ করার বাসনা। শোনা যায় আগুন প্রথম দেখা যায় শিক্ষকদের সার্ভিসবুক যে ঘরে থাকে সেই ঘরে। প্রায়ই শহর থেকে বাসে করে স্কুলে আসার সময় শুনি গতরাতে ওমুক গঞ্জ কি তমুক ছড়ার স্কুলে আগুন লেগেছে। বেশিরভাগ টিনের চাল আর বাঁশ বা কাঠের ওপর প্লাস্টার করা স্কুল বাড়ি। দৃষ্টিশোভণ কিন্তু সহজ দাহ্য। একদিন দেখি বাসে একজন বয়স্ক মাষ্টারমশাই নীরবে চোখের জল ফেলছেন, স্কুল পুড়ে গেছে, পুড়ে গেছে তাঁর সার্ভিসবুক। সামনে রিটায়ারমেন্ট। একরকম একদিন স্কুলে যাওয়ার জন্য বাসে উঠে একটা জানালার ধারে সীট পেয়ে গুছিয়ে বসেছি তখনই শুনলাম আগের রাতে আমাদের স্কুলে আগুন লেগে অফিস ব্লকসহ অনেকখানি পুড়ে গেছে।

    তারপর শুরু হলো ছাত্র ছাত্রী আর শিক্ষকদের দুর্ভোগ। বারোশো ছাত্র ছাত্রী। দুই শিফটে ক্লাস ওয়ান থেকে টুয়েলভ ক্লাস। কি করে ক্লাস চালানো যায়। ঘরের সঙ্গে তো ফার্নিচার ও পুড়ে ছাই। ব্ল্যাকবোর্ড চেয়ার টেবিল। কোনো মতে ওপরের ক্লাস গুলো চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। ছোটদের কয়েকটা সেকশন একসঙ্গে করে সপ্তাহে দু'একদিন ক্লাস হয়। কখনো টানা ছুটি দিয়ে দিতে হয়। এরমধ্যেই টীচারদের ও মাঝেমধ্যে ছুটি ছাটা নিতে হয়। সুবিন্যস্ত পরিচালনা অসম্ভব হয়ে পড়েছে। একদিন এই পরিস্থিতিতে ক্লাস সেভেনের ক্লাস ডিসমিস করা হয়েছে বাধ্য হয়ে। রোগা লিকলিকে একটি মেয়ে, ঝকঝকে দুটি চোখ - বড়দিদিমণির কাছে এসে সটান দাঁড়িয়ে বললো, দিদিমণি আমাদের কয়েকটা ছালা দিন আর একটা দিদিমণি দিন। আমরা ছুটি নেবো না, ক্লাস করবো। তার ভঙ্গিতে দৃঢ় প্রত্যয়। আমরা কেউ হাসলাম কেউ অসহিষ্ণু মন্তব্য করলাম। মেয়েটি কিন্তু সত্যিই পড়া চালিয়ে যেতে চেয়েছিল।

    বছর দুয়েক পেরিয়ে গেছে। ওই ক্লাস সেভেনরা এবার নাইন। সবটা না হোক পোড়া স্কুলে দুএকটা খড়ো ঘর তৈরি করে সামাল দেওয়া গেছে। ওই মেয়েটি কিন্তু কদিন স্কুলে আসছে না। খেলা ধূলা পড়া নাটক আবৃত্তি সবকিছুতেই আগ্রহ, কি হোলো আসে না কেন? একদিন এক শীর্ণ ফর্সা মহিলা জীর্ণ পোষাক, চোখ দুটো একটু বেশি উজ্জ্বল, নাক টনটনে। কমনরুমে মেয়ের বিয়ের সাহায্য চাইতে এসেছেন। গ্রামের স্কুলে নিত্যই এদের আনাগোনা। জানা গেল পাত্রী আমাদের সেই মেয়েটি যার পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ছিল। আমরা বারবার বোঝাতে চাইলাম। আইনের কথা বললাম। লাভ হোলো না।

    মায়ের শেষ কথা, --- মাইয়া সন্তান। যমে নিলেও নিব, জামাইয়ে নিলেও নিব। অতএব।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৭ আগস্ট ২০২০ | ১৬৬০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ` | 73.106.235.66 | ২৭ আগস্ট ২০২০ ২০:২৫96706
  • /\
  • বিপ্লব রহমান | ২৭ আগস্ট ২০২০ ২১:৩৬96708
  • জামাইয়ের বাড়ি তো যমেরই বাড়ি। এতো বছর পরেও কিছু কি পাল্টায়? 

    আরও লেখ, শক্তি দি।     

  • Swati Ray | 117.194.41.91 | ২৯ আগস্ট ২০২০ ০২:০০96732
  • অনেকেই বলেন ইন্ডিভিজুয়াল নিয়ে ভাব , অত মেয়ে মেয়ে কর কেন ? এই সব পড়ে ভাবি কি জানি মেয়ে মেয়ে করে দেখাটা কি সত্যিই ভুল ?
  • শিবাংশু | ৩১ আগস্ট ২০২০ ১১:১৩96806
  • @ Swati Ray না, ভুল নয়। মেয়েদের গল্পই আমাদের ভূমির গল্প। যাপনের গল্প। বাকি যা কিছু আছে, সেগুলো ঐ
    গড়ে তোলা স্কুলবাড়ি যেন। একটা দেশলাই কাঠির বিক্রমেই শেষ হয়ে যায়।
  • রঞ্জন | 182.69.147.189 | ০২ সেপ্টেম্বর ২০২০ ১৬:৫৪96875
  • রামের গল্প অনেক শুনেছি।  এই শক্তিশালী কলমে ফুটে উঠছে সীতার গল্প। আমার নমস্কার।

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন