এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • ফটো

    শক্তি দত্ত রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০৭ আগস্ট ২০২৩ | ৩৯০ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • নিখিল নূতন বৌদিকে জিজ্ঞেস করেই ফেলল, 'এই ফটোটা কতোদিন টিঁকব বৌদি'?

    স্নিগ্ধা বসে আছে দক্ষিণমুখী বারান্দায়। ছাঁচতলায় দু'চারটে লিলি ফুটেছে। সুগন্ধ হাওয়ায়। স্নিগ্ধার মন যে ফুলের সুগন্ধে মেতে আছে তা নয়। নূতন জীবনের মাধুরী ঘিরে আছে। চোখে পড়ছে দেওয়ালে ঝোলানো তাদের দুজনের ছবিটি। বিশেষ কিছুই নয়। স্টুডিওতে গিয়ে তুলিয়েছে একটা - যেমন সব দম্পতিই নতুন বিয়ের পর তোলে। আগেকার দিনে বালিকা বধূ চেয়ারে বসে থাকত। বরটি কোঁচানো ধুতিপাঞ্জাবি পরে পাশে নায়কোচিত ভঙ্গিতে দাঁড়াত। এরা পাশাপাশি। বেশ হয়েছে ছবিটা। হাসি পেল স্নিগ্ধার। রামানুজ প্রথম আপত্তি করেছিল। গতানুগতিকে তার মন নেই। প্রসঙ্গত গল্প করেছিল, ওর এক স্যরের বৌ তুলনামূলকভাবে স্যরের চেয়ে বেঁটে হওয়ায় ভদ্রমহিলাকে টিপয়ের ওপর ভারি দুটো বই পেতে বসানো হয়েছিল। ইত্যাদি। স্নিগ্ধা জেদ ধরায় ফটো তোলা এবং ঝোলানো হয়েছে। বেশ লাগছে কিন্তু। স্নিগ্ধা খুশি হল মনে মনে। নূতন বাড়িতে নিজের একটা ইচ্ছা পূর্ণ হল তো। আজকে এবাড়িতে নতুন বৌ হয়ে আসার পঁচিশ দিন। রামানুজ আজকেই প্রথম অফিসে গেছে। ফেরার সময় হল- স্নিগ্ধা হাতমুখ ধুয়ে এবেলা একটু পরিপাটি হয়ে নেবে।

    নিখিলের প্রশ্নে চিন্তার প্রবাহ ছিঁড়ে গেল। স্নিগ্ধা একটু অবাক। বুঝি বিরক্তও। এ আবার কেমন কৌতূহল! তবু রূঢ় না হয়ে উত্তর দিল- টিঁকবে বোধহয়, - অনেকদিন টিঁকবে।

    নিখিল জেলখানার কয়েদি। মাঝেমাঝে কারাধ্যক্ষ্যের কোয়ার্টারে এদের ডিউটি পড়ে।। অবশ্য ভাল রেকর্ড থাকলে। তবে সবার ভাল লাগে না বাড়ির ডিউটি করতে। নিখিলের খারাপ লাগে না। বেশ কিছুক্ষণ জেলের বাইরে গৃহ পরিবেশে থাকা যায়। এখন আবার সাহেবের ছেলের বিয়ে। উৎসবের পরিবেশ। এ এক অপরিচিত জগতের টুকরো, স্নিগ্ধার কৌতুহল হয়, ঠিক ভয় না, কিন্তু একধরনের বিরাগও হয় - এই চারদিকে সর্বক্ষণ ঘিরে  থাকা এইসব মানুষদের আধো অন্ধকার অতীতের কথা ভেবে।

    নিখিল অন্ধরমহলের খাস পরিচারক, এ বাড়ির সবাই নিখিলকে চোখে চোখে রাখে। সে সুযোগ পেলেই নূতন বৌয়ের ঘরের আশেপাশে ঘুরঘুর করে। কতো জিনিসপত্র উপহারসামগ্রী।

    স্নিগ্ধার তত্ত্বাবধানের দায়িত্বে আছে ননদ রূপা। তার কাছে শোনা হয়ে গেছে কয়েদিদের মধ্যে খুনীদের একটু কম সন্দেহের চোখে দেখা হয়। নিতান্ত পেশাদার খুনী না হলে তারা হয়তো উত্তেজনার মূহুর্তে অপরাধ করে ফেলে কিন্তু স্বভাব অপরাধী হয় না। চোররা সবচেয়ে খারাপ। ডাকাতরা মাঝারি। নিখিল আবার ঠিক চোরডাকাত কিছুই নয়। ফরেস্টে কাঠ চুরির কেসে ফেঁসে গেছে। কোন কাঠমাফিয়ার হয়ে জেল খাটতে রাজি হয়েছিল, অর্থের বিনিময়ে। মায়ের অসুখ। টাকার খুব দরকার। ভেবেছিল কিছুদিন কয়েদ খেটে ছাড়া পেয়ে যাবে। তারপর যা হয়, মামলাই উঠছে না।...

    স্নিগ্ধা তখন অতো জানতে পারেনি। এবাড়িতে আসার দুদিন পরই নিখিল যা কান্ড বাধিয়েছিল! সকালবেলা স্নিগ্ধার চা খাওয়া হয়েছে। জলখাবার তখনো কেউ দেয়নি, অথচ একটু খিদে পায়নি তাও না, নিখিলকে একটা ডাব কাটতে দেওয়া হয়েছিল তার থেকে একটা কেটে কাঁচের গ্লাসে করে নতুন বৌদিকে এনে দিয়েছে। একটু দন্ধ লাগলেও স্নিগ্ধা খেয়ে নিয়েছে। নূতন শ্বশুরবাড়ি বলে কথা। একটু পরে মাসিশাশুড়ি এসেছেন কাঁচের গ্লাসে ডাবের জল আর লুচি মিষ্টি নিয়ে। স্নিগ্ধার কাছে নিখিলের কীর্তি শুনে সেটা কর্তব্যজ্ঞানে দিদিকে জানিয়েছেন। গৃহকর্ত্রী তো নিখিলের স্পর্ধা দেখে রেগে আগুন। নিখিল তো নূতন বৌকে খাবার দিতেই পারে না। কত বড় সাহস! তার রেমিশন কাটা থেকে শুরু করে সব শাস্তিবিধান হয়ে গেল। যাই হোক পরে অবশ্য কিছুই হয়নি। তার উদাস উদাস খ্যাপাটে স্বভাব নিয়ে কর্তাগিন্নির সুনজরেই থেকে গেল।

    তখন বাড়ির রাঁধুনি মাসী বাসন্তী। দায়িত্বশীল, সদাসতর্ক। রাঁধেবাড়ে। চা জলখাবারের জোগান দেয় সাধ্যমত। মাঝে মাঝে চোপা করে, আর নয়তো মনমরা হয়ে ঘুরে বেড়ায়। মাঝেমাঝে নিখিল আর বাসন্তী রান্নাঘরের সিঁড়িতে বসে গুজগুজ ফুসফুস করে, হাসে। আসলে ওরা একটু গল্পগুজব করে। মনের কথা, বাড়ির কথা বলে। মালিকপক্ষের তা পছন্দ হয় না। এত কি কথা নিখিলের সঙ্গে বাসন্তীর। বাসন্তীরও কি সুখের কথা ভাঁড়ারে আছে? গরীবের মেয়ে, গরীবের বৌ। বর জঙ্গলে গিয়ে লাকড়ি কাটতো। তেঁতুল, কুর্চি, কনক, বয়রার কাঠ কেটে ভার বেঁধে বিক্রি করত। গ্যাস আসেনি তখন। ভালো কাঠের জ্বালানির খুব চাহিদা। একটু ন্যালাখ্যাবলা লোকটা। তুলসীমালা গলায় আখড়ায় গিয়ে কীর্তন গাইতো। একতারা ছিল একটা। লোক খারাপ ছিল না। মেয়েও হয়েছিল একটা। বাসন্তী মানিয়েও নিয়েছিল। উঠোন ঝাঁট দিত। ঘুঁটে বেচত। সংসার তো চলে যাচ্ছিল। একদিন কেন কে জানে লোকটা বৈরাগী হয়ে বাড়িছাড়া হয়ে গেল। তারপর থেকে তো বাসন্তী রাঁধুনিবৃত্তি করে চালাচ্ছে। বাসন্তীও একদিন জিজ্ঞাসা করে এই ফটোটা তুলতে কত টাকা লেগেছে। স্নিগ্ধার এবারও একটু বিরক্তি আসে। অহেতুক কৌতূহল ভালো লাগে না। তবু সে রূঢ় হতে পারে না। বলে সম্ভাব্য একটা দাম।
    স্নিগ্ধাকে চলে যেতে হয়েছে স্বল্পমেয়াদের রোগে। পায়ে পায়ে পঞ্চাশ বছর সংসার করে বিদায় নিয়েছে স্নিগ্ধা।
    রামানুজ পায়ে পায়ে পঁচাত্তরে পা দিয়েছে। বেলা যায়। অতীত ভিড় করে আসে, নিখিল, বাসন্তীদের ছবি নিয়ে কৌতুহল, স্নিগ্ধার বিস্ময় মেশানো বিরক্তি মনে পড়ে, কত রকমের অতীত, কত মানুষের।

    রহস্যভেদ হয়েছিল পরে। অন্যের হয়ে জেলখাটার পেছনে শুধু মায়ের অসুখ ছিল না। ভালোবাসার মেয়েটিকে বিয়ে করেছিল ক'দিন আগে, সংসারের সুরাহার পথ খুঁজছিলো একটু, কাঠ চোরাচালান চক্রের ফাঁদে পড়ে যায়। জেলে আসার আগে চৈত্র সংক্রান্তির মেলায় গিয়ে জয়ার সঙ্গে ছবি তুলেছিল, জেলে যাওয়ার আগে সেই ছবির ডেলিভারি নেওয়া হয়নি, জয়ার হাতে ক'টা টাকা দিয়ে এসেছিল। নিখিল দাদা বৌদির ছবির দিকে তাকিয়ে উদাস হয়ে যেত, হাতের ঝাড়ন মন্থর হয়ে পড়তো।
    বাড়ির ডিউটি পাল্টে দেওয়ার অনুরোধ করে জেলখানার সব্জি খেতে চলে যাওয়ার পর বাসন্তী বলেছিল এইসব গল্প। বাসন্তীর কাছে বিয়েতে পাওয়া নমস্কারীর যে টাকা ছিল তাতে একটা ছবি তোলা হয়ে যেত, হয়তো লোকটার চেহারা মনে থাকতো।

    দিনের পরে দিন কেটে গেছে। ছোট শহরের জেলখানার পাথুরে পাঁচিল আর তার এদিক ওদিক কতগুলি মানুষের সুখদুঃখ এখন অতীতের কল্পনা মনে হয়। বাসস্থান পালটে গেছে, শহর পাল্টে গেছে। 

    পশ্চিমের রোদ এসে পড়ে রামানুজ স্নিগ্ধার সাদা কালো ছবিতে, রোদের বিভ্রমে যেন পাশে দেখা যায় নিখিল আর জয়া, বাসন্তী আর তার বিবাগী প্রেমাস্পদটিকে। বিকেলের শূন্যতা ভরে ওঠে ভালোবাসার গল্পগুলি দিয়ে।
     
    ****
    (পীরবতীর নাকছাবি ও অন্যান্য বইয়ে প্রকাশিত)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০৭ আগস্ট ২০২৩ | ৩৯০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • বিপ্লব রহমান | ১৭ আগস্ট ২০২৩ ০৭:২৫522549
  • অপূর্ব মায়াময় প্রেম! 
    অনেক দিন পরে লিখলে দিদি! শুভ heart
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন