এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৩ জুন ২০১৪ | ১৪০০ বার পঠিত
  • ছত্তিসগড়ের আঁকিবুকি
    তোলা দাঈ বুলা্থে!

    না:, মানতেই হবে ভাগ্য বলে কিছু একটা আছে; নইলে এই বাজারে পাশ করতেই চাকরি! কয়জনের জোটে?আমি রায়পুরের বড়ইপাড়ার মনবোধি দেবাংগন, মাত্তর তিনমাস আগে আইটিআই থেকে ড্রাফটসম্যানের পরীক্ষা পাশ করেছি আর গতকাল পিয়ন এসে টেলিগ্রামটা দিয়ে গেল!
    কোরবা জেলার আদিবাসী এলাকায় কয়লার সন্ধান পাওয়া গেছে। বিশাল ভান্ডার। সেইখানে একটি আধা সরকারী সংস্থায় চাকরি। সার্ভে চলছে, ফিল্ড অফিসে কাজ। মাইনে আহামরি কিছু নয়।তবু মন্দ কি!
    খবরটা পরিচিত মহলে ছড়িয়ে পড়ল। পাড়াপড়শির দল ঝেঁটিয়ে এলেন শুভেচ্ছা জানাতে।
    ঃ কি গো মনবোধির মা! এত ভাল খবর, মিষ্টি কই?
    ঃ আচ্ছা, ছেলে তোমার কলেজেও যায় নি, ওই ছাতার আইটিআই না কি যেন, ওর থেকে একটা সার্টিফিকেট পেয়েছে। ওরকম তো অনেকেই পায়।তোমাদের ওপর মহলে চেনাজানা আছে বুঝি?
    ঃ এর আবার কথা কি! আজকাল ধরাকরা ছাড়া কিছু হয় নাকি? তবে ছেলের ও কিছু এলেম চাই।
    ঃ বেশ তো, দ্যাখো না, যদি আমার অকালকুষ্মান্ডটার জন্যে কিছু করতে পার। দুবছর হল কলেজের পাট চুকিয়ে ঘরে বসে আছে।
    হ্যাঁ, আমার ঘরের আবহাওয়া সত্যি পাল্টে গেছে।দুবছর পর রিটায়ারের সম্ভাবনায় বাবার কপালে পড়া ভাঁজগুলোর সংখ্যা কমেছে। বোন খুশি, দাদা নিশ্চয়ই এবার হারমোনিয়ামটা কিনে দেবে। আর মায়ের তো মাটিতে পা পড়ছে না!
    সত্যিই তো, পাড়ার বাকি ছোঁড়াগুলো না হয় কলেজে পড়েছে, তাতে ঘরের কী উবগারটা হয়েছে শুনি?
    মনবোধির পাপা না হয় কূষিদপ্তরের ক্লার্ক, আর ভগবান সিং ঠাকুর কালেক্টর অফিসের বড়বাবু, তাতে কি? জোটাক দেখি ছেলেটার জন্যে একটা ভাল চাকরি? উল্টে নিত্যিদিন পাড়ার কোন না কোন মেয়ের বাপের বাড়ি বয়ে নালিশ! ছেলেটা একেবারে বখে গেছে!
    আমার অবস্থা! চাকরি পাওয়ার প্রথম উচ্ছাস কেটে গিয়ে এখন কেমন যেন মুখের ভেতর একটা বোদা ভাব।এই রায়পুর শহরে বড় হয়েছি। এই জয়স্তম্ভ চৌক, সারদা টকিজ, গাস মেমোরিয়াল হলের গলি, কফি হাউস, গান্ধী উদ্যান, সব ছেড়ে যেতে হবে; তাও একটু একটু করে নয়, একদিনে!
    যেন আমার আত্মার সার্জারি হচ্ছে।
    আর আমার বন্ধুর দল! যাদের সঙ্গে দুবেলা বনোয়ারির পানঠেলায় দু এক খিলি মিঠিপাত্তি খেয়ে নতুন রিলিজ ফিলিম নিয়ে গলা ফাটিয়ে ,পাড়ার সেলুনে রাজ্যের কেচ্ছা শুনে, করপোরেশনের কাউন্সিলরের কাছে চাকরির উমেদারি করে, পাড়ার উঠতি ছমকছল্লোদের তুলনামূলক প্রোফাইল বানিয়ে এতদিন কেটেছে তারা সব ক্রমশঃ আঁখো সে দূর, দিলোঁ সে দূর হয়ে যাবে?
    আর কেমন হবে আমার অফিসটা? কম্পিউটার টেবিল, রিভলভিং চেয়ার? এসব কি ফিল্ড অফিসে হয়? আর আমার বস্! খুব কড়া? আমাকে শিখিয়ে পড়িয়ে নেবেন তো, আমি যে কিছুই জানি না!
    আচ্ছা, বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যাবার আগে মেয়েদেরও কি এমনই মনে হয়? রাত্তিরে ভালো করে ঘুম হচ্ছে না।
    ঘুম হচ্ছে না মাযেরও। ওনার সুপুত্তুরটি তো কখনো একগ্লাস জল গড়িয়ে খেত না, আর খাওয়া নিয়ে বড্ড বাছবিচার। ওই বিদেশ বিভুঁইয়ে ওর হাজার বায়নাক্কা কে সামলাবে?
    কে সামলাবে তা তো আমিও জানিনা। আর মাত্র কয়েকটা দিন।
    ক্যালেন্ডারে দাগ দিয়ে রাখা দিনটি এসেই গেল।
    প্যাসেঞ্জার ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছাড়ল। ধুতির খুঁট দিয়ে চশমার কাঁচ মুছতে থাকা বাবা আর হাসিমুখে হাত নাড়তে থাকা ছোটবোন ও দুইবন্ধুর চেহারা ক্রমশঃ মিলিয়ে গেল। আমি এবার একটু গুছিয়ে বসেছি।ছোট্ট বেডিং ও একটা সুটকেস বাংকের ওপর তুলে দিয়ে একটা জাসুসী নভেল বা রহস্যরোমাঞ্চ সিরিজ খুলে চোখ বোলাই কিন্তু মন লাগায় কার সাধ্যি!
    ছোট কামরাটিতে বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে ওঠা যাত্রীদের পোষাক, ভাষা সবই কেমন যেন। পুরুষদের মাথায় বড় টিকি, গায়ে নীল হলুদ জামা।কানে পেতলের কুন্ডল, খেটো ধূতি, হাতে মুঠো বাঁধানো ছোট লাঠি। এরা বোধহয় রাউত বা গয়লা। মেয়েদের চুড়ো করা চুল, উন্মুক্ত বাহুতে উল্কি আর নাকে নথ। এরা সবাই তামাকপাতা চিবুচ্ছে আর পিচ্ করে কামরার মধ্যেই থুতু ফেলছে।আলাপচারিতা চলছে আমার কানের অভ্যস্ত পর্দার থেকে একটু চড়ায়।
    কখন যে চোখ লেগে গেছে বুঝতে পারি নি।গাড়ির হ্যাঁচকায় চোখ খুলল। একটা স্টেশনে গাড়ি দাঁড়িয়েছে। লোকজন উঠছে, নামছে। ডিজেল বদলে কয়লার ইঞ্জিন। আওয়াজ বদলে গিয়ে এখন ঘ্যাঁচা ঘ্যাঁচা হুস্ হুস্।জানলা দিয়ে ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে আসছে কয়লার গুঁড়ো। চোখ মুছে গোটা কামরার ঝারি মারলাম। যাত্রীদের চেহারা পোশাক আশাক কিছু পাল্টেছে।
    পুরুষদের গালপাট্টা আরও বড়, মেয়েদের মাথার চুড়ো খোঁপা কেমন যেন ট্যারচা করে বসানো। কথাবার্তা একটু অনুনাসিক। হ্যাঁ, আদিবাসী এলাকায় এসে পড়েছি বটে।
    আমার গন্তব্য এ লাইনের অন্তিম স্টেশন, আরও একঘন্টা।কল্পনা করিঃ সেখানেও কি রাজকাপুরের বরসাত সিনেমার মত আমার প্রতীক্ষায় কোন আদিবাসী বালা দুহাত বাড়িয়ে দাঁড়িয়ে থাকবে? আজা মেরা বালমা, তেরা ইন্তেজার হ্যায়!


    হুস হুস করে ট্রেন থেমেছে , আর এগোবে না। কামরা খালি করে শেষ কজন যাত্রীর সঙ্গে আমিও নেমেছি। নভেম্বরের শেষ। দ্রুত সন্ধে ঘনিয়ে আসছে। বাকি যাত্রীর দল কখন সুট সুট করে অন্ধকার গাঁয়ের পথে মগলগয়ে গেছে।
    ছোট্ট স্টেশন। পাশে কয়লার স্তুপ।স্টেশনের ছোটবাবু বড়বাবু বলতে একজনই।
    না, আমার আসার টেলিগ্রাম পৌঁছয়নি। আর কোম্পানির ঠেক বা ক্যাম্প এখান থেকে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পায়ে হেঁটে পাক্কা তিন কিলোমিটার। হ্যাঁ, সল্যুশন আছে। একজন কুলি কিছু দক্ষিণার বিনিময়ে কাঁধের বাঁক বা কাঁওড়ে করে আমার মালপত্তর বয়ে নিয়ে যা্বে। ও রাস্তা চেনে, কাজেই চিন্তার কিছু নেই।
    কূষ্ঞপক্ষের রাত।অনভ্যস্ত পায়ে কুলির পেছন পেছন ঠোকর খেতে খেতে চলেছি।ও এড়িয়ে চলছে কাঁটাঝোপ, উইঢিবি, বাঁশের কোঁড়। ও বলল এইসময়ে সাপের ভয় কম।আমার টর্চের আলোয় দুএকবার দৌড়ে পালায় কোলিহা, মানে খেঁকশিয়াল, আর খরগোস।কিন্তু বাঁশঝাড়ে সরসর, একটা উঁচু ঢিবির ওপর বসে ওটা কী? খানিকটা কুমীরের মত, গায়ে বড় বড় আঁশ, মুখের থেকে চেরা জিভ বেরিয়ে লকলক করছে! একেবারে বাচ্চাদের কমিকস্ থেকে উঠে আসা ড্রাগনের মত।
    আমার হাত থেকে টর্চ পড়ে গেল। কুলিটা আমাকে ধরে ফেলেছে।
    ঃ কাবর ডরথস্ সাহাব? ঝন্ ডরাবে, উয়ো তো গোহিলা হাবে।
    গোহিলা? মানে গোধিকা? অন্ধকারে প্রথমবার দেখলে সবারই হার্টফেল হতে পারে।
    আর দশ কদম এগিয়ে ডানদিকে বেঁকতেই উজ্বল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল।তারকাঁটা আর লোহার খুঁটি দিয়ে ঘেরা অনেকটা জায়গা, মাঝখানে টিন ও এ্যাসবেসটসের ব্যারাক মত, আর আঙিনায় কিছু মেশিনপত্তর, লোহালক্কড়, এই নাকি আমার অফিস বা ক্যাম্প! মনটা দমে গেল।



    লোকটা বাঁকের থেকে সুটকেস আর বেডিং নামাচ্ছিল , এর মধ্যেই টিনের ছাউনি থেকে বেরিয়ে এসেছে এক যুবক-- জিনের প্যান্ট,হাফহাতা শার্ট আর গালে দিনকয়েকের না কামানো ঘন কালো দাড়ি। ভ্রূ কুঁচকে আমাকে দেখে হটাৎ হাসিমুখে দুহাত বাড়িয়ে দিল।
    -- আসুন, আসুন! আসতে আজ্ঞা হোক। বন কেটে বসত গড়ার এই কামারশালায় স্বাগত হে নতুন অতিথি! আপনি নিশ্চয়ই মনবোধি দেবাংগন?
    তশরীফ রাখিয়ে অউর শর্মাইয়ে মৎ। এই অধমকে সবাই চ্যাটার্জি বলে ডাকে, আপনিও তাই বলবেন।
    আরে কেশোদাদা! দেখো তো কউন আয়া হ্যায়? ভেতর থেকে পেট্রোম্যাক্স হাতে বেরিয়ে এসেছে জনৈক প্রৌঢ়, একহারা চেহারা, মাথায় আদ্দেক টাক, পরনে লুঙ্গি আর গেঞ্জি। মুখে হাসি। ব্যস্ত সমস্ত ভাব। বোঝা যায় যে রান্না করছিল।
    নভেম্বরের সন্ধ্যে, জঙ্গল। আমার একটু শীত শীত করছে। এদের দেখে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
    -- আর এই হল কেশোদাদা! আমাদের ফ্রেন্ড, ফিলজফার, কুক ও গাইড। ভাল কথা , আপনি সাবালক না নাবালক?
    -- মানে?
    -- এই জঙ্গলে দু'রকম ক্যাটেগরির কর্মচারি থাকে। যাদের চা বা দুধ ছাড়া অন্য কোন পানীয়ে অরুচি তারা হল নাবালক।
    আর যদি নাবালক হন তাহলে আমাকে চ্যাটার্জিদা বলে ডাকতে হবে!
    এবার আমার পালা।
    --- চ্যাটার্জিদা, আপনি নিশ্চয়ই সাবালক?
    -- রাইট য়ু আর!
    বলে হো-হো শব্দে হেসে ওঠে চ্যাটার্জি আর সামনের পাকুড় গাছ থেকে রাতচরা পাখির দল ডানা ঝাপটিয়ে ঊড়তে থাকে।
    কেশোদাদা ইতিমধ্যে আদা দিয়ে গরম চা নিয়ে এসেছে।
    টিনের চেয়ারে বসে আয়েস করে চায়ে চুমুক দিয়ে শুধোই-- আর কাউকে দেখছি না যে? এখানে ক'জন স্টাফ?
    চ্যাটার্জির মুখে হালকা হাসির আভাস।
    --স্কুলে পড়া আফ্রিকার ভূগোল মনে আছে? নায়াগ্রা জলপ্রপাত মনে আছে? নাইজার নদী?
    কিছু বুঝতে না পেরে দুদিকে মাথা নাড়ি।
    --- সেকন্ড কোশ্চেনঃ স্ট্যানলি ও লিভিংস্টোন ক'জন ছিল?
    --- দু'জন।
    --- আমরা ক'জন?
    ---দুজন?
    -- দেয়ার য়ু আর!
    অবাক বিস্ময়ে বলে উঠি-- মাত্র দু'জন? এই অফিসে--
    --- জল্লাদের সংখ্যা বেশি না হলেই ভালো।

    --- জল্লাদ? আমরা জল্লাদ? ইয়ে ক্যা বোল রহেঁ হ্যাঁয়, আপ?
    -- হ্যাঁ ভাই! আমরা হলাম সভ্যতার জল্লাদ।
    দেখ, এই এলাকাটা হল ভোরিয়া জনজাতির। চাষবাস করে বেশ ছিল। এখানে কয়লা পাওয়া গেছে। ব্যস্‌, আমাদের কোম্পানি তাঁবু গেড়েছে, ক্যাম্প বসিয়েছে। থিওডোলাইট-কম্পাস লেভেল মাপার যন্ত্র সব এসেছে। এসেছি আমরা চ্যাটার্জি ও মনবোধি।
    আমাদের কাজটা কী? সার্ভে করা , নকশা বানানো, স্থানীয় পাটোয়ারি রেকর্ড চেক করা। ক'টা গাছ, কয়টা কূয়ো, কার জমিতে কী সত্ব-- সব চেক করে নতুন রেকর্ড বানানো। আমরা জমির দাগ, খতেন সব দেখে কোথায় কয়লা খাদান , কোথায় হবে রেসিডেন্স, শপিং কম্প্লেক্স, স্টেডিয়াম, হাসপাতাল, কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়-- সব কিছুর নকশা তৈরি করব।
    এর পর আসবে সরকারি প্রশাসন, কয়লা খনির সাহেব্কুল আর রাজনৈতিক নেতার দল। জমির ক্ষতিপূরণের অংক নিয়ে কিছু আন্দোলন হবে, কন্ট্রাক্ট ব্রিজ খেলার মতন ইশারায় কোডে বিডিং হবে-- সিক্স ক্লাব, ওয়ান নো-ট্রাম্প এইসব।
    গরীব-গুর্বোর দল নামমাত্র টাকাপয়সা নিয়ে মাথা নোয়াবে। কেউ কেউ চাকরি পাবে। চৌকিদার, হেল্পার, গাড়ির ড্রাইভার।
    কেউ কেউ দোকান দেবে, চায়ের দোকান, মনিহারী, ভাতের দোকান, দেশি-বিদেশি মদের।অল্প কয়েকজন মেয়ে, ঘরের বউ-ঝিদের দল সাহেবদের বাড়িতে খাটতে যাবে। কেউ কেউ রাজমিস্ত্রির রেজা হবে, নয়তো ট্রাকের মাল খালাসের কামিন। চলে যাবে অন্য শহরে, হারিয়ে যাবে, ফিরবে না।
    --- বাকি লোকজন?
    -- বাকিরা? এখানে খাদান হলে আশপাশের দশ গাঁয়ের জমির দাম বেড়ে যাবে। ফলে সরকারি পয়সা দিয়ে অধিকাংশ মানুষই কোন জমি কিনতে পারবে না। খেয়ে দেয়ে বাবুয়ানি করে উড়িয়ে দেবে।
    আর বেশ কিছু লোক চলে যাবে অনেক দূরে আরও প্রত্যন্ত এলাকায়;-- যেখানে এখনো আছে জঙ্গল আর নদী, যেখানে কুমারী জমি এখনো সুলভ। সেখানে ঘর বাঁধবে, বসত গড়ে তুলবে। ফেলে আসা বাপ-পিতেমোর ভিটের কথা ভেবে সেই পুরনো নামই রাখবে-- যেমন নয়া বরপালী, চারপারা-২ এমনি।
    -- তারপর?যাবে
    --- তার আর পর নেই। কয়েক বছর পরে সেখানেও পৌঁছে যাবে সভ্যতার লোভী হাত। জমির নীচে পাওয়া যাবে কোন কুবেরের ভান্ডার। আবার সার্ভে হবে আর ওখানে যাবে কোন চ্যাটার্জিদা ও কোন মনবোধি। আবার ওদের তাড়াবো।
    এই হল আমাদের নিয়তি ব্রাদার!
    আরে অত ভাবলে কি চলে? আমার বকবকানিতে বেশি কান দিও না।
    ভেতরে চল। দু'ব্যান্ডের বুশ ট্রানজিস্টর আছে। কী শুনবে, বিবিধ ভারতী না রেডিও সিলোন?

    প্রথম রাত্তিরের ডিনার হল কেশোদাদার রাঁধা খিচুড়ি, পেঁয়াজি বড়া ও আমের আচার দিয়ে। একটু ঝাল-ঝাল, খেতে মন্দ নয়।
    খাওয়ার একটু আগে কেশোদাদা ভেতর থেকে একটা লম্বাগলা বোতলে সাদা তরল ও দুটো কাঁচের গেলাস এনে
    টেবিলে রাখ, সঙ্গে একটা প্লেটে আদা ও পেঁয়াজ কুচি। একটা বিজাতীয় ঝাঁঝালো গন্ধ নাকে এসে লাগল।
    -- কি ব্রাদার? একটু চলবে? লজ্জা কর না। নাঃ, তুমি দেখছি সত্যিই দুগ্ধপোষ্য, তাহলে আর জোর করব না।
    চলো কেশোদাদা, হম হী লোগ শ্রীগণেশ করেঁ।
    এর পর ওরা দুজনে শুরু কত্রে দিল। একটু পর পর দুজনেই ছোট গেলাসগুলো খালি করে ফেলে আর চ্যাটার্জি বলতে থাকে--- আনন্দম্‌ কেশোদাদা?
    উত্তর আসে-- আনন্দম্‌।
    এইভাবে কয়েকবার আনন্দসাগরে ডুব দিতে দিতে ওরা পাড়ে উঠল। কেশোদাদা খালি বোতল প্লেট-টেট সরিয়ে নিয়ে খেতে দিল।
    পাশাপাশি দুটো খাটিয়ায় আমরা দু'জন, কেশোদাদা রান্নাঘরে গুটিশুটি। জঙ্গলের আশ্চর্য মুখর নৈঃশব্দ আর কেমন একটা গন্ধে ঘুম আসতে দেরি হচ্ছিল। কিন্তু চ্যাটার্জি শুয়েছে কি নাক ডাকতে লেগেছে।
    মনে পড়ছে বাবা-মা-বোন-রায়পুর শহরের অলিগলি। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে কখন যে গাঢ় ঘুমে তলিয়ে গেছি টের পাইনি।
    স্বপ্ন দেখছিলাম একটা ছোট স্টেশন, সেখানে একটা দলছুট ইঞ্জিন শান্টিং করছে। প্ল্যাটফর্ম থেকে গ্যাংম্যান, কুলির দল প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে কিন্তু ইঞ্জিনটা বাগে আসছে না।
    হটাৎ ইঞ্জিনটা কানফাটা সিটি বাজাল! চমকে ধড়মড়িয়ে উঠে বসলাম। একি! সিটি যেন ঘরের মধ্যেই বেজেছে।
    পাশের খাট থেকে কম্বল সরিয়ে চ্যাটার্জিদা বলল- শো যা ইয়ার! ও কুছ নহীঁ; রওতাইন কাম করনে আয়ী হ্যায়, ইয়ে উসকা অ্যাটেন্ডেন্স লগানা হুয়া।

    ( কাজের মেয়েটি বাসনকোসন ধুতে, ঘর ঝাঁট দিতে এসেছে, এই আওয়াজ হল ওর অ্যাটেন্ডেন্স!)
    ধেত্তেরি বলে কম্বলে মাথা ঢেকে আবার শুয়ে পড়ি। কতক্ষণ কেটেছে জানিনা, আবার সেই সিটি!
    উঃ! আর তো পারা যায় না। একটানে মুখের থেকে কম্বল সরিয়ে ফেলে উঠে বসি।
    রোদ্দূরে ঘর ভেসে যাচ্ছে। সামনের ছোট্ট টুলে রাখা চায়ের কাপ থেকে ধোঁয়া উঠছে। চ্যাটার্জির হাতে আর একটা ধোঁয়া ওঠা কাপ, মুখে একটা মিচকে হাসি।
    --- ঘুম ভাঙল? ঘোড়া বেচে শুয়েছিলে যাহোক।
    --- এমন কানের গোড়ায় কুউক্‌ করে সিটি বাজলে ঘুমোয় কার বাবার সাধ্যি! ব্যাপারটা কী?
    --- বলেছি তো! উম্মেদ কুঁয়ের, আদিবাসী মেয়ে। জঙ্গলে কাঠ্কুটো-ডালপালা কুড়িয়ে বড় হয়েছে। কেউ দলছুট হয়ে হারিয়ে গেলে একজন আরেকজনকে এমনি করে 'কুউক' দিয়ে ডাকে। সেটাই অভ্যেস হয়ে গেছে। তাই প্রথমে একটা কুক- হল হাজিরি খাতায় টিপছাপ, পরেরটা হল ফিরে যাবার সময় ছুটির ভোঁ, এবার বুঝলে?
    হাড়ে হাড়ে বুঝেছি, বিশেষ করে এই অত্যাচার যখন রোজ সকালের রুটিন। কিন্তু, আদিবাসী মেয়ে, জঙ্গলে হারিয়ে গেলে কুক দেয়, তাই এখানেও কুক দেবে -- এ আমি মেনে নিতে পারি না। ঘরের মধ্যে বন বসানোর এই অদ্ভূত হিসেবের বিরুদ্ধে আমার শহুরে অন্তরাত্মা না -না করে ওঠে।
    একদিন মেয়েটাকে ধরে ফেললাম। সাতসকালে চ্যাটার্জি কোথায় পায়চারি করে বেড়াচ্ছে আর কেশোদাদা কেছে দু-মাইল দূরের জনপদে কেরোসিনের খোঁজে।
    মেয়েটা আমার সামনের টুলে চায়ের কাপ ঠক করে নামিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছিল-- ডাকলাম।
    --- এই শোন, সক্কালে অমন বিচ্ছিরি আওয়াজ করে আমার ঘুম ভাঙাবে না। মাথা ধরে যায়। হাজিরির জন্যে কেশোদাদাকে বললেই হবে; বুঝলে?
    কী বুঝল ভগবান জানে, খানিকক্ষণ ড্যাবড্যাবে চোখে তাকিয়ে থেকে চলে গেল।
    এই সুযোগে ওকে ভাল করে দেখলাম।
    ছোটখাট চেহারা, কালো কষ্টিপাথরে কোঁদা শরীর।এ দেশি সাধারণ শাড়ি বা লালরঙের লুগরা আঁটোসাঁটো করে পরা, তেলতেলে মুখে গোটা কয় ব্রণ; চাউনি আদৌ কালো হরিণ চোখ নয়, বরং গরুর মত।

    এইভাবেই দিন কাটতে লাগল। আস্তে আস্তে কাজের চাপ টের পাচ্ছি। যত দিন যাচ্ছে, সার্ভে এগুচ্ছে, ততই একটা চাপা উত্তেজনা।
    কোরবা থেকে জিপ গাড়ি আসে ধূলো উড়িয়ে। কোল মাইনসের সরকারি অফিসার। কলেক্টার অফিস থেকে পাটোয়ারি, রেভিনিউ অফিসার মানে তহশীলদার। নকশা দেখে, চেন নিয়ে জমি মাপে।
    মাঝে মাঝে কোসম গাছের নীচে কিছু চেয়ার টেবিল নিয়ে সামিয়ানা খাটিয়ে অস্থায়ী ক্যাম্প হয়। জমির মালিকানা সত্বে ফেরবদল হয়। মৃত মানুষদের নাম রেকর্ড থেকে কেটে দিয়ে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ কারো নামকে লম্বরদার বা মুখিয়া করা হয়। এটাকে বলে ফৌতি-উঠানা।
    কখনো জমির মাপের এদিক-ওদিক বা বাঁটোয়ারার রকমফের করার জন্যে কিছু খরচা-পানি করতে হয়।
    সমস্যা বাঁধে ভিনগাঁয়ে বিয়ে হওয়া মেয়েদের নাম রেকর্ড থেকে বাদ দেওয়া নিয়ে। কোত্থেকে মেয়ে-জামাই খবর পেয়ে যায়, অফিসে এসে খোঁজ নেয়, ঝগড়া বাঁধে, মীমাংসা হয়।
    আবার জমির ক্ষতিপূরণের রেট আলাদা। টিকরা জমি বা যেগুলো ঠিক ধানের ক্ষেত নয়, শুধু তরকারি, সর্ষে বা চিনেবাদাম হয় তার রেট কম। বহেরা জমিন বা ধানচাষের জমির রেট বেশি।
    অধিকাংশ জমিই একফসলী। কিন্তু যদি ক্ষেতের গায়ে একটা টিউকল, শ্যালো বা কূয়ো বা নালা বা পুকুর দেখানো যায় তাহলে রেট অনেক বেশি।
    আবার প্রত্যেক জমি পিছু রয়েছে একজনের কোম্পানীতে চাকরি দেওয়ার আশ্বাস।
    তা অনেকের থেকে কিছু টাকা দিয়ে শহুরে বাবুরা কিনে নিচ্ছেন একটুকরো জমি, যদি তাঁদের ছেলে চকরি পেয়ে যায়। তবে হ্যাঁ, জমিটির আয়তন অন্ততঃ ৫ একর হতে হবে।
    এই নিয়ে আস্তে আস্তে পাড়ার বা সমাজের মোড়লের দল ছাড়াও নতুন নতুন লিডার মাথা চাড়া দেয়; লোকেদের সবুজ বাগানের স্বপ্ন দেখায়। কিছু আন্দোলনের যাত্রাপালা হয়, শেষে সমঝোতা।
    আমরা আদার ব্যাপারী, তবু উত্তেজনার আঁচ পাই। বিশেষ করে চ্যাটার্জি। ও নিয়মিত গাঁয়ে যায়, সবার সঙ্গে অবাধে মেশে, ফেরে একেবারে হাতে তেঐরি শুদ্ধ মহুয়ার বোতল নিয়ে।
    শীত বাড়ছে। আমাকে বলে--- ডক্টরস্‌ ব্র্যান্ডির মত খেয়ে নাও ব্রাদার। রাতে একটা কম্বল কম নিলেও চলবে!
    না না করেও একদিন একটু চুমুক দিয়ে ফেলি। একটা উগ্র গন্ধ, ঝাঁঝালো কষটে তেতো-মিষ্টি স্বাদ!
    নাঃ, এ আমার পোষাবে না। কিন্তু একটু পরে শরীর বেশ গরম । মনে পড়ল মা'র কথা।
    বাবা কোনদিন চা ছাড়া কিছু ঠোঁটে ছোয়ান নি, বন্ধুবান্ধবদের অনুরোধেও না।
    মার দুটো চিঠি এসে পড়ে আছে এক সপ্তাহ হল। আগে সপ্তাহে তিনটে করে চিঠি আসত, উত্তর দিতাম। বোনের চিঠি থেকে জানলাম--হারমোনিয়াম এসেছে, গানের ক্লাসে নিয়মিত যাচ্ছে। কোন বন্ধুর চিঠি আসেনি। কিন্তু মায়ের চিঠিতে পাড়ার খবর থাকে নিয়মিত।
    ধীরে ধীরে আমার উত্তরের সংখ্যা কমতে কমতে এখন মাসে দুটো। মা তবুও সপ্তাহে দুটো করে চালিয়ে যাচ্ছেন। বাড়ি আসতে অনুরোধ।
    মাকে লিখি-- কাজের চাপ, নতুন চাকরি। এখন ছুটি পাবো না। একেবারে হোলির সময় সাতদিনের ছুটি নিয়ে বাড়ি যাব।
    এখন তীব্র শীত। বাউলে হাওয়ায় আম-জাম-বহেরা-শাল-পিয়ালের শুকনো পাতা ঘুর্ণি তোলে। অধিকাংশ গাছের শীর্ণ কাঠি কাঠি চেহারা।
    সকালে বিছানা ছাড়তে ইচ্ছে করে না। খাটিয়ায় বসেই কম্বল গায়ে দিয়ে আদা দেওয়া চা খাই। সবচেয়ে বিচ্ছিরি লাগে কাপড় কাচতে।
    কাজের মেয়েটি, মানে ওই উম্মেদ কুঁয়ের আমার কথা মেনে নিয়েছে। আর সক্কালে কুক্‌ দিয়ে আমাদের ঘুম ভাঙায় না। আমাকে বোধ্হয় একটু ভয় পায়।
    দুপুরের সময় খোলা জায়গায় মিঠে রোদ্দূরে টেবিল লাগিয়ে আমি আর চ্যাটার্জি কাজ করি। বড় আরাম। কিন্তু সূর্য ডুবতেই শীত যেন লাফিয়ে এসে ক্যাঁক করে চেপে ধরে।

    তারপর রাতের খাওয়া মানেই কেশোদাদার হাতের ফুলকা বা রুটির সঙ্গে কুঁদরু, গাঁওয়ার ফল্লির তরকারি, নয়তো বাইগন ভর্তা। কখনো খিচুড়ি-ডিমভাজা। রোববারে মুরগি।ভাত-ডাল- ফুলকপি-শাক হল দুপুরের বরাদ্দ।
    তবে আস্তে আস্তে রাত্তিরের খাবারের আগে দু'পেয়ালা মহুয়া অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গেছে। এখন আর চুমুক দেবার সময় মার মুখ মনে পড়ে না।
    রায়পুর শহর ধীরে ধীরে হারিয়ে যায়। আমার শরীরে চেতনায় শেকড় ছড়ায় এক আদিম অরণ্যের গন্ধ।
    সকাল বেলায় চা খেয়ে প্রকৃতির ডাকে একটা বড় মগ বা টিনের কৌটো করে জল নিয়ে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে যাই। আমি আর চ্যাটার্জি। কেশোদাদা ওসব পাট অনেক ভোরে চুকিয়ে দেয়।
    সাবধানে আলপথ ভেঙে একটা ডোলি বা ছোট ক্ষেতে ঢুকে উবুড় হয়ে বসি। আলের ধারে ইঁদুরের গর্ত। কখনো সাপের বিশাল খোলস। বড় সুন্দর, ভয় করে না। মাথার ওপর পাখ- পাখ্বালি টিঁউ-টিঁউ-চুঁই-চুঁই করে ডাকে। কেঁচোর দল মাটি তুলে তুলে ছোট ছোট গুলি পাকাতে ব্যস্ত। একটা আটপেয়ে বুকে হেঁটে যায়।
    যেতে আসতে ক্ষেতের মধ্যে কাটা ধানের শুকনো কুশের মত তীক্ষ্ণ গোড়া গুলো এড়িয়ে চলি। হাতের থেকে জলের মগ বা কৌটো কাত হলেই বিপদ। ধীরে ধীরে অল্প জলে ছোঁচানো বা হাতমাটি করা অভ্যেস করে ফেলেছি। রাত্তিরে খাবার পর আর বাইরে যাইনা। এঁটো থালার ওপর হাত ধুয়ে কুলকুচো করে ফেলি।
    নাঃ, মায়ের আদরের মনবোধি পুরো জংলি হয়ে গিয়েছে। এই জঙ্গল তাকে আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলছে।
    আহিস্তা! জনাব আহিস্তা!


    কাজের ঠেলায় কখন যে সোম গড়িয়ে শনি হয়ে তার খেয়াল থাকছে না।রাতের গালগল্প, কেশোদাদার গ্রাম্য কেচ্ছা, কিছুই আর মন টানে না। আজকাল চ্যাটার্জি ও আমি দুজনেই ক্লান্ত হয়ে পড়ি।খাওয়ার পর খাটিয়া, ঘরের কোণায় মাটির গোরসি বা মালসায় আগুন জ্বলে ধিকিধিকি। পাশের খাটে চ্যাটার্জি আর ঘরের কোণে কুকুরকুণ্ডলি হয়ে শোয়া কেশোদাদার নাক পা্ল্লা দিয়ে বাজে।ঝিঁঝিঁর ডাক আর দূরের জঙ্গলের নানারকম শব্দে অভ্যস্ত আমার ক্লান্ত স্নায়ু অসাড় হয়ে যায়।
    এসে গেছে ফেব্রুয়ারি মাস। মাঘের শীত বিদায় নিচ্ছে।থোকা থোকা লাল শিমূল ফুল।কোথায় একটা কোকিল ডাকে আজকাল।
    কেশোদাদা একটা টেলিগ্রাম এনে দেয়। চ্যাটার্জি তাতে একনজর বুলিয়েই হাতের ফাইলটা টেবিলে আছড়ে ফেলে। তারপর চেঁচিয়ে ওঠেঃ উঠো মুসাফির! বাঁধো গাঁঠরিয়া।
    ব্যাপারটা কি?
    ঃ এসেছে আদেশ, যাত্রা কর যাত্রীদল,
    বন্দরের কাল হল শেষ।
    ঃ এসব কী আগড়ম বাগড়ম?
    ঃ দূর ব্যাটা গোমুখ্যু! এটা বাংলা, টেগোর কী কবিতা।
    ঃ উসসে হমারা মতলব?
    ঃ আবে অকল কে অন্ধে! হেড অফিস সে ইয়ে জো টেলিগ্রাম আয়ী উসীকী বাতকর রহাঁ হুঁ।
    বলছে এখানের কাজ শেষ, আস্তানা গোটাও। আর দুমাসের মেয়াদ, ব্যস্।
    বেটা মনবোধি! ফাইনাল রিপোর্ট অউর এক্সপেন্স কা পক্কা হিসাব বনা লো। হোলি কে পহলে ঘর জানা হ্যায় কী নহীঁ? কেশোদাদা! কল গাঁও জা কর এক বড়িয়া মূর্গা লে আও।ফিস্টি হোগী।
    জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই। শিমূলের রং ঘন লাল। কোকিল ব্যাটা অবিশ্রান্ত ডেকে চলেছে।
    পরের দিন ভোরে চ্যাটার্জির ঠেলাঠেলিতে ঘুম ভেঙে গেল।
    চা হয়ে গেছে?
    না, না। চল্, আজ নদীতে চান করে আসি।এসে চা খাব। আমি বানাব। কেশো যাবে গাঁয়ে, মূর্গা কিনে আনতে।
    আমি যাব না। ঠান্ডা লেগে যাবে।
    দূর উজবুক্! একটু পরেই রোদ উঠবে। চান করে ফিরতে ফিরতে শীত কেটে যাবে। একবার আমার কথা শুনেই দ্যাখ।
    এই বাক্যবাগীশ বাঙালির সঙ্গে কথায় পেরে ওঠে কার সাধ্যি!
    আহিরণ নদী প্রায় এক কিলোমিটার দূর। আমরা পথ চলি, কথা বলি।জিজ্ঞেস করি, এখান থেকে তাঁবু তোলার পর আগামী ঠেক কোথায় হবে? অগলা তম্বু কহাঁ ডালেঙ্গে?
    সেটা একমাস পরে জানতে পারবো। হয়তো চিরিমিরি এলাকার কয়লাখনির পেছনদিকের জঙ্গলে।
    উফ্!
    উফ্ বললে হবে বেরাদর? বলেছিলাম না তুমি আর আমি হলাম সভ্যতার জল্লাদ!
    সত্যিই শীত কমে গেছে। এখন হল গুলাবি জাড়া, গোলাপি মিষ্টি শীত।গাছগুলোর যেন নতুন দাড়ি গজিয়েছে।বিশাল সব আমের গাছে মুকুল ধরেছে।
    ধানের আল ভেঙে গরুর গাড়ির চাকার দাগ ধরে তৈরি হয়েছে পায়ে চলার পথ, চলতি ভাষায় গাঢ়া রাবণ।শাল, সেগুন, কোসম, মহুয়া, বয়রা, ডুমুর আর আমের বন। কেমল একটা মাদক গন্ধ। অনেকদিন পর আমরা এমন সকালে বেরিয়েছি, কোন তাড়া নেই।এবার নদী এসে গেল।
    আমরা জলে নামার জন্যে একটা ঠিকঠাক জায়গা খুঁজছি। একটা জোড়া আমলকি আর অশ্বত্থ গাছের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ল নদীর বালি ঢাকা ঢাল, তারপর জলধারা বাঁক নিয়েছে।চমৎকার!
    জোড়া আমলকি গাছ পেরিয়ে এক পা বাড়িয়েছি কি আচমকা চ্যাটার্জি আমাকে এক হ্যাঁচকায় পেছনে টেনে এনে মুখে আঙুল দিয়ে কোন শব্দ করতে বারণ করল।ওর ইশারা বুঝে গাছের ফাঁক দিয়ে চোখ কুঁচকে তাকাই।
    ঠিক যেখানে বালির পাড় গিয়ে জলে মিশেছে সেখানে পাড়ের ওপর পড়ে আছে একটা লাল লুগরা বা দেহাতি শস্তা শাড়ি। পাশে একটা বনইমলির ছায়ায় নদীর জলে আবক্ষ নিমজ্জিত এক নারীমূর্তি।


    যেন কালো কষ্টিপাথরে কোঁদা এক অপরূপ ভাস্কর্য। প্রথম সূর্যের গোলাপী আভার ছটা তার বাম স্তনে, সুগঠিত কাঁধে। মুখের ভাঁজে এক অপার্থিব হাসির ইশারা। বনদেবী?
    হাওয়া দিচ্ছে না। গাছের পাতা নড়ছে না।সমগ্র চরাচর যেন মৌন হয়ে বন্দনা করছে এই প্রকৃতিকন্যাকে। আমাদের পা অবশ। কতক্ষণ ওইভাবে দাঁড়িয়ে আছি হুঁশ নেই।
    হটাৎ সুর কেটে গেল। মেয়েটি কি কিছু টের পেল? চমকে চারদিকে এক নজর বুলিয়ে সে দুহাতে জল সরিয়ে আরো গভীর জলে নেমে ডুব দিল। কুলকুচো করে জল ছেটাল।
    আমরা পা টিপে টিপে পিছিয়ে যাই। আরও এক পাশে আরেকটি ঘাট মত জায়গা খুঁজে নিয়ে স্নান সেরে ফেরার পথ ধরি।
    হ্যাঁ, শীত কমে গেছে।
    ফেরার পথে চোখে পড়ে একটা বুনো গাছের নীচে চারজন আদিবাসী মেয়ে , ঢিল ছুঁড়ে ছুঁড়ে কি যেন পাড়ছে।
    চ্যাটার্জির চোখ পড়তেই এক্ছুটে ওদের দলে ভিড়ে কি যেন বলল, অমনি মেয়ের দল শরীর নাচিয়ে হেসে উঠল।তারপর একটি মেয়ে টোপাকুলের মত কিছু ফল ওর হাতে দিল; মেয়েটির পরণে লাল লুগরা।
    ফিরে এসে আমার হাতে কয়েকটা ফল দিয়ে ও বলল-- খেয়ে দেখ, টক মিশ্টি। এগুলোকে বলে তেন্দু। এর পাতা দিয়ে বিড়ি তৈরি হয়।
    আমার কিছু ভাল লাগে না।

    আজ আমার এই গাঁয়ে শেষ দিন। কোনরকমে আজকের গোটা দিন , তারপরে রাত কাটলেই কোম্পানির জীপ আসবে কোরবা থেকে। মালপত্তর নিয়ে চলে যাব কোরবা। সেখান থেকে টাটা নাগপুর প্যাসেঞ্জার ধরে সোজা রায়পুর। স্টেশন থেকে কাছেই আমাদের পাড়া। আমার বাড়ি----বাবা-মা, ছোট বোন। উঃ, কতদিন বাদে মায়ের হাতের রান্না খাবো,-- দই দিয়ে কুমড়োর খাট্টা তরকারি। লাই-বড়ি ও বাইগন-ভর্তা। মা নিশ্চয় প্রথম দিন ভাত না রেঁধে পুরি-সব্জি বানাবে , আর লাল ভাজি বা চাওলাই ভাজি!
    পরের দিন সকাল হতেই বন্ধুবান্ধব। ওদের সিনেমা দেখাব, জয়স্তম্ভ চৌকের চা, তারপর কফি হাউসেও একদিন খাওয়াব।
    আচ্ছা, দুটো বাড়ি পরে যে দুর্গা কলেজের স্যামসন স্যারের মেয়েটি খুব ভাও খেত, সে কি এবার আমার দিকে চোখ পড়লে আগের মত ঠোঁট উলটে মুখ ফিরিয়ে নেবে? দেখতে হবে কি হয়। মজা মন্দ না।
    অনেক হল গাঁ-খেত-খলিহান -জঙ্গল। এবার শহর ডাকছে। মায়ের মুখটা বড্ড মনে পড়ছে।

    কিন্তু কালরাতের অমন ঝড়বৃষ্টির পর আজ আকাশের কেমন ময়লাটে চেহারা । হাওয়া বইছে না। সর্বত্র কেমন ক্লান্তির ছাপ। কেশোদাদা পর্য্যন্ত কথা বলছে নীচু স্বরে। হয়ত এই সাইট থেকে চলে যাবার পর ওর সঙ্গে আমাদের আর দেখা হবে না।
    আমি ও চ্যাটার্জি নিজেদের বাঁধাছাঁদায় গোটা দিনটা কাটিয়ে দিই। বিকেল চারটে নাগাদ পাতলা মেঘের ফাঁক দিয়ে রোদ উঠল। ফ্যাকাশে মরা রোদ।
    আমি আর চ্যাটার্জি ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম-- জঙ্গল পেরিয়ে নদীর দিক থেকে ঘুরে আসব, শেষবারের মত।
    মাটি নরম, কাদা বাঁচিয়ে পা ফেলছি। এখনো গাছের পাতা ভিজে। কোথাও কোথাও পাতলা ঝিরঝিরে জল্ধারা তিরতির করে বইছে, হারিয়ে যাচ্ছে কাছের কোন খানাখন্দে। খেয়াল করলে চোখে পড়বে ছোট ছোট মাছের পোনা, ব্যাঙাচির মত।
    সাবধানে পা ফেলছি। কেননা এই বৃষ্টিতে ডিম ফুটে বেরিয়ে এসেছে কেউটে সাপের ছোট ছোট বাচ্চা। লাফাচ্ছে তিড়িং তিড়িং। এদের স্থানীয় ভাষায় বলে ডোমহি। গায়ে পা পড়লে ছোবল দিতে কসুর করে না।
    আমরা কথা বলছি নিজেদের কথা ,অসমাপ্ত স্বপ্নের কথা। আগামী দিনের কথা।
    আজ আহিরণ নদীর পাশের জঙ্গলে এই অস্থায়ী ক্যাম্পে আমার শেষ দিন। একটা দিন আর একটা রাত। ব্যস্‌।
    কাল সকালে কোরবা থেকে কোম্পানির গাড়ি আসবে। তাতে বোঁচকা-বুঁচকি চাপিয়ে আমরা যাবো চাঁপা রেলস্টেশন।সেখান থেকে দুই বিপরীতগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চড়ে আমি ও চ্যাটার্জি নিজের নিজের ঘরে যাব; রায়পুর ও রায়গড়।দশদিনের ছুটি। তারপর নতুন সাইট।
    কিন্তু আজ সকালটা কেমন যেন গোমড়ামুখো। কাল সারারাত্তির বৃষ্টির পরে আকাশ মেঘলা, রোদ্দূর ওঠেনি। কাল সন্ধ্যের উদ্দাম ঝড়ের পরে হাওয়া থেমে গেছে।
    কেশোদাদার ও হাসি নেই, কথায় কথায় আর 'আনন্দম্‌ দাদা!' বলে উঠছে না। ও বুঝেছে হয়ত আমাদের আর কখনো দেখা হবে না।
    চা-জলখাবার খেয়ে আমরা বাঁধাছাঁদায় হাত লাগাই। আর ভবতে থাকি ঘরের কথা, আমার শহর রায়পুর। গ্রাম আর জঙ্গল ঢের হয়েছে। এবার ঘরে ফেরার পালা।
    রাত দশটা নাগাদ ট্রেন রায়্পুর স্টেশনে পৌঁছুবে। রিকশা করে বাড়ি খুব বেশি হলে পনের মিনিট। তারপর?
    মা নিশ্চয়ই ছেলের জন্যে আজ পুরি-সবজি রাঁধবে। আর লাই-বড়ি? আর মুংগা বা সজনে ডাঁটার তরকারি। তাতে একটু দই, আমের আচার। বোন হারমোনিয়ামে নতুন শেখা কিছু বাজিয়ে শোনাবে।
    বাবা চশমার কাঁচ ধুতির খুঁট দিয়ে সাফ করতে করতে একগাল হেসে বলবেন-- কতদিন থাকবি?
    তারপর কাল সকালে বাথরুম, শহুরে পায়খানা।
    বেলা বাড়লে আসবে বন্ধুর দল। এবার শুধু জয়স্তম্ভ মোড়ের কাঁচের গেলাসে চা খাইয়ে রেহাই পাব না, নিঘ্ঘাৎ কফি হাউসে খাওয়াতে হবে। আর রাজ টকিজে সিনেমা!
    এভাবেই বেলা গড়িয়ে যায়। বিকেল চারটে নাগাদ মেঘের ফাঁক দিয়ে একটু লজ্জা-লজ্জা রোদ উঠল। চ্যাটার্জি বলল-- চল রে মনবোধি! শেষ বারের মত জংগল থেকে বেড়িয়ে আসি। আহিরণ নদীকে স্যালুট
    মারতে হবে না?
    আমি হেসে ফেলি। আমার স্মৃতিতে চলকে ওঠে সেই এক শীতের সকালে নদীতে স্নান করতে গিয়ে আদিবাসী বনদেবীর দেখা পাওয়া।
    কেশোদাদা পেছন থ্কে ডেকে বলল-- সন্ধ্যের আগেই ফিরে এসো। আজকাল মহুয়ার গন্ধে ভালুক আসে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৩ জুন ২০১৪ | ১৪০০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সিকি | 135.19.34.86 (*) | ০৪ জুন ২০১৪ ১০:৪৮73415
  • জম্পেশ শুরুয়াত। আরো হোক।
  • ঐশিক | 24.140.33.186 (*) | ০৫ জুন ২০১৪ ০৬:১৭73416
  • রঞ্জনদা সাথে আছি, পরের পর্বের অপেক্ষায়
  • kaushik | 126.203.36.196 (*) | ০৫ জুন ২০১৪ ০৭:৪৯73417
  • রঞ্জন বাবু,

    বেশ লাগছে! অল্প চেনা জায়গা গুলো আরোও একবার ঘুরে আসি আপনার কলমে ভর করে :)
  • nina | 78.37.233.36 (*) | ০৫ জুন ২০১৪ ০৯:৪৭73418
  • সঙ্গে আছি
  • ranjan roy | 24.99.161.31 (*) | ১৯ জুন ২০১৪ ০৩:২৭73419

  • কাজ প্রায় শেষ।এর মধ্যে রায়পুর ও কোরবা থেকে সায়েবরা তিন দফায় এসে সরেজমিনে সব বুঝেসুঝে গিয়েছেন। আর দিন সাতেকের মধ্যে পাততাড়ি গোটাতে হবে। আগামী দিনের ডেরা? সম্ভবতঃ বাংগো নদীর পাড়ে সতরেঙ্গা অজগরবাহার প্রোজেক্ট এলাকায়।কাজটা নাকি বেশ বড়। তাই টিম বড় হবে, তবে আমি ও চ্যাটার্জি একসঙ্গেই থাকবো।তার আগে বাড়ি যাবো।
    কয়দিন হল রোজ রাত্তিরে বেড়াতে যাচ্ছি, চ্যাটার্জির কথামত পায়ে গামবুট, হাতে টর্চ। এ সময় নাকি সাপেদের ঘুম ভাঙে!চ্যাটার্জির হাতে আবার একটা বেঁটে লাঠি, অনেকটা এদেশের গয়লাদের মত।এতোল বেতোল হাওয়া। দূর গাঁয়ের গানবাজনা ঢোলকের আওয়াজ ঙেসে আসে।হাওয়ায় মহুয়া ঝরে টুপটাপ।আর মহুয়ার গন্ধে আসে হরিণের দল। দলে দলে নয়। হয় জোড়ায় জোড়ায়, নয় একা বিবাগী।
    মাটি থেকে ছয় বা সাত ফুট উঁচুতে জ্বলছে কারো সবুজ চোখ, বুঝে যাই সম্বর হরিণ গাছের ডাল থেকে কামড়ে খাচ্ছে মহুয়ার ফুল।আর হাঁটুর থেকে নীচে সবুজ চোখের মানে মাটিতে ঝরে পড়া মহুয়া একদম সাফাচট্! সকালে মহয়া কুড়োতে আসা মেয়েগুলোর কপাল খারাপ! আর ফুট তিনেক উঁচুতে পান্নার মত জ্বলা সবুজ চোখ?এগুলো কোটরি বা সাদা ছিট্ ছিট্ ছাগলের মত হরিণ।তবে রাত্তিরে ভয় করে গোরুর চোখ দেখলে, অন্ধকারে লালরঙা ভাঁটার মত জ্বলজ্বল করে।
    আর মাত্তর তিন দিন! আজকের রাতটা বাদ দিলে দুটো রাত্তির আর তিনটে দিন! তারপর বনবাস শেষ, ভাবা যায়? কাল থেকে বাঁধাছাঁদা শুরু করব, এখন তো ঘুমোই।
    কিন্তু মানুষ ভাবে এক হয় আর!কোন এক সামান্য ব্যাপারে আমার আর চ্যাটার্জির কথা কাটাকাটি শুরু হয়ে গেল।ব্যাপারটা এতই তুচ্ছ যে পরে চেষ্টা করেও মনে করা গেল না। কেশোদাদা হাতজোড় করে আমাদের থামতে বলল, কিন্তু চ্যাটার্জির সেই এক গোঁ!
    ঃ আমি শালা কারো খাই না পরি? কারো একপয়সার ধার ধারি নে! আমি কেন চুপ করব?
    কথাটা আমার গায়ে লেগে গেল।আমি তো বেশ কয়েকবার ধার নিয়েছি, তাও ওই চ্যাটার্জির কাছে; আমাকে বাড়িতে টাকা পাঠাতে হয় যে! শেষকালে আমি আর কথা না বাড়িয়ে খাটিয়া টেনে নিয়ে কেশোদাদার কাছে লাগিয়ে শুয়ে পড়লাম।
  • ranjan roy | 24.99.222.232 (*) | ২০ জুন ২০১৪ ০৭:০৯73420
  • পরের দিন সকালেও আমরা চা খেলাম চুপচাপ, নিজেদের মধ্যে একটা কথা না বলে। তবে আরেকজন তো ঠিক চুপ করে থাকতে পারে না। কেশোদাদাকে উঁচু গলায় নানা ফুট ফরমাস বা কাজের মেয়ে উম্মেদ কুঁয়েরকে আরেকবার চা বানাতে বলে আড় চোখে আমার দিকে তাকায়। আমি কোন দিকে না তাকিয়ে আমার বাক্স-প্যাঁটরা গুছোতে থাকি।
    পরশু দিন এখান থেকে বেরিয়ে রায়পুরের ট্রেন ধরবো।
    মাঝখানে চ্যাটার্জি কোথায় বেরিয়ে গেছল, দুপুরের খাওয়ার আগে ঠিক ফিরে এল।
    ভাত বেড়ে দিতে দিতে কেশোদাদা শোনাল যে আবহাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে গাঁয়ের লোকজনের মেজাজও চড়ছে।
    গাঁয়ে এখন নাকি দুটো দল। একটা পুরনো মোড়লের আর একটা নতুন চ্যাংড়াদের। নতুনের দল চাষের জমির ক্ষতিপূরণের জন্যে আরো উঁচু দর দাবি করছে।
    কাল নাকি নগৈখারের দিকে লোকজন কয়লা কোম্পানির জমিকাটা ডোজার মেশিন আটকে দিয়েছে। পুলিশ এসে ফিরে গেছে। সোমবার সবাইকে নিয়ে সমঝোতা বৈঠক হবার কথা ছিল। কিন্তু কোথাও জমির ক্ষতিপূরনের ঝগড়ায় মারামারিতে টাঙি চলেছে। একজনের আঙুল কাটা পড়েছে।
    খেয়েদেয়ে খাটিয়ায় গড়িয়ে খানিকটা সময় কাটল। একটু উশখুশ করছি এমন সময় চ্যাটার্জির হুকুম-- কেশোদাদা ! বড়িয়া কড়ি মিঠঠি চায় বনাও, হম দোনো থোড়া গাঁও ঘুমনে জায়েঙ্গে।
    তারপর আমার দিকে চোখ মেরে বলল--- চল না রে মনবোধি! আবার কবে এ গাঁয়ে আসা হবে কি না হবে? অব গুস্‌সা থুক দে ইয়ার! দোষটা আমারই। ম্যাঁয় হী গলত থা।
    আমিও হেসে ফেলি। বেরোনোর সময় কেশোদাদা হেঁকে বলল আমরা যেন গাঁয়ের দোকান থেকে কেরোসিন নিয়ে আসি, প্রায় ফুরিয়ে এসেছে। সকালে দোকান বন্ধ ছিল।
    মাত্র এক কিলোমিটার পায়ে হাঁটা পথ। তারপর শিমূল গাছের পাশে একটা চায়-পান-বিড়ি-সিগ্রেট আর বিস্কুটের দোকান। কিছু চাল-ডাল-নুন-তেলও পাওয়া যায়।
    এই সময়টা দোকানের সামনে চার গাঁয়ের লোকজন জড়ো হয়। গুলতানি কেনাকাটা গপশপ সবই চলে।
    চ্যাটার্জির আশা এখানে ফোটানো দুধের চা খেতে খেতে গাঁয়ের আসলি খবর পাওয়া যাবে।
    কিন্তু সে গুড়ে বালি!
    মোড়ের মাথায় লোকের ভিড় নেই। হৈচৈ কেনাকাটা কিচ্ছু নেই।
    দোকানের সামনে মাত্র জনাচারেক লোক বসে চা খাচ্ছে। আমরা গিয়ে দাঁড়াতেই রুক্ষ স্বরে প্রশ্ন হল-- ক্যা চাহিয়ে?
    আমরা মুখ চাওয়া চাওয়ি করে বলি-- দো কাপ কড়িমিঠি চায় অউর--।
    আমাদের কথা কেটে দোকানদার -- নহী মিলেগা, দুধ নহী হ্যায়।
    আমরা অবাক। চ্যাটার্জি আঙুল দেখিয়ে বলে--নেই মানে? ওই তো কড়াইয়ে ফুটছে!
    দোকানদার জবাব দেবার আগেই উপস্থিত চারজনের একজন বলে ওঠে-- ও দুধ আপনাদের জন্যে নয়।
    আমরা এবার কোন কথা না বলে গাঁয়ের ভেতরে পা বাড়াই।
    কি আশ্চর্য! গাঁয়ের ভেতরের ছোটখাটো দোকানগুলো ও আজ বন্ধ দেখছি যে! রাস্তাঘাটে জনমনিষ্যি নেই, শুধু ছোট বাচ্চারা খেলছে। পাতকুয়োর সামনে বালতি নাবিয়ে জল তুলতে থাকা বৌ-ঝিয়ের দল অন্যদিন চোখে চোখ পড়লে সলজ্জ হাসি হাসত বা কেউ কেউ সাহস করে 'রাম-রাম সাহাবমন!' বলত।
    আজ আমাদের দেখে কলসী-দড়ি-বালতি সব ফেলে দুদ্দাড় করে ছুটে পালাল।
    কিছু না বুঝে আমরা গাঁয়ের মোড়ল বা সরপঞ্চের বাড়ির দোরগোড়ায় গিয়ে দাঁড়ালাম।
  • ranjan roy | 24.96.109.44 (*) | ২১ জুন ২০১৪ ০৬:৫৬73422
  • সদর দরজা ভেজানো, সামনে দু-চারটে ন্যাংটোপুঁটো বাচ্চা খেলছে। আমরা গিয়ে দাঁড়াই, উস্‌খুশ্‌ করি।
    চ্যাটার্জি হাঁক পাড়ে--- কৈসে গা গোটিয়া, ঘর মা হবে কা?
    ( কি গো মোড়ল? ঘরে আছ নাকি?)
    কোন উত্তর নেই। বার দুয়েক হাঁক পেরে বিরক্ত হয়ে ওর দরজার কপাট থেকে ঝুলতে থাকা লোহার শেকল ধরে জোরে জোরে নাড়াই।
    হটাৎ দরজা খুলে যায়। দরজার ফ্রেমের মাঝে আধো ছায়ায় হেটো ধুতি আর পিরান পরা সমারুরাম গৌটিয়ার শুকনো কড়া চেহারা আমাদের চমকে দেয়।আরো চমকে দেয় ওর রস-কষহীন রুক্ষ কেজো প্রশ্নঃ
    --- কা বাত হ্যায়?
    আমি কি বলব ভেবে পাই না। এতদিন ওর দরজায় এলে এই গৌটিয়া আমাদের হাসিমুখে -- আওগা সাহাবমন! বৈঠো, বলে খাটিয়া টেনে এনে বসিয়েছে। কাঁসার বাটিতে কাঁসার ছোট গেলাস বসিয়ে চা দিয়েছে, তাতে এক চামচ ঘি! আর আজ?
    চ্যাটার্জি তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলে-- কা বাত হ্যায় গৌটিয়া? আজ খড়ে খড়ে বিদা করবে কা? চুঙ্গি-উঙ্গি পিলাইকে মন নাহি হাবয়?
    ( কী ব্যাপার মোড়ল? আজ দরজা থেকেই বিদেয় করবি নাকি ? বিড়ি- টিড়ি খাওয়াবি না?)
    সমারুরাম যেন ঘোরের থেকে জেগে ওঠে। একটু লজ্জা পায়। খাটিয়ার জন্যে বাড়ির ভেতর দিকে কাউকে হেঁকে বলে।
    তারপর বলে-- না, না! বিড়ি দেব না কেন? আসলে কি জান সাহেবরা? এতসব গন্ডগোলে মাথার ঠিক নেই আমার। এক ছেলে , এক মেয়ে। আমার
  • ranjan roy | 24.96.109.44 (*) | ২১ জুন ২০১৪ ০৬:৫৬73421
  • সদর দরজা ভেজানো, সামনে দু-চারটে ন্যাংটোপুঁটো বাচ্চা খেলছে। আমরা গিয়ে দাঁড়াই, উস্‌খুশ্‌ করি।
    চ্যাটার্জি হাঁক পাড়ে--- কৈসে গা গোটিয়া, ঘর মা হবে কা?
    ( কি গো মোড়ল? ঘরে আছ নাকি?)
    কোন উত্তর নেই। বার দুয়েক হাঁক পেরে বিরক্ত হয়ে ওর দরজার কপাট থেকে ঝুলতে থাকা লোহার শেকল ধরে জোরে জোরে নাড়াই।
    হটাৎ দরজা খুলে যায়। দরজার ফ্রেমের মাঝে আধো ছায়ায় হেটো ধুতি আর পিরান পরা সমারুরাম গৌটিয়ার শুকনো কড়া চেহারা আমাদের চমকে দেয়।আরো চমকে দেয় ওর রস-কষহীন রুক্ষ কেজো প্রশ্নঃ
    --- কা বাত হ্যায়?
    আমি কি বলব ভেবে পাই না। এতদিন ওর দরজায় এলে এই গৌটিয়া আমাদের হাসিমুখে -- আওগা সাহাবমন! বৈঠো, বলে খাটিয়া টেনে এনে বসিয়েছে। কাঁসার বাটিতে কাঁসার ছোট গেলাস বসিয়ে চা দিয়েছে, তাতে এক চামচ ঘি! আর আজ?
    চ্যাটার্জি তাড়াতাড়ি সামলে নিয়ে হাসিমুখে বলে-- কা বাত হ্যায় গৌটিয়া? আজ খড়ে খড়ে বিদা করবে কা? চুঙ্গি-উঙ্গি পিলাইকে মন নাহি হাবয়?
    ( কী ব্যাপার মোড়ল? আজ দরজা থেকেই বিদেয় করবি নাকি ? বিড়ি- টিড়ি খাওয়াবি না?)
    সমারুরাম যেন ঘোরের থেকে জেগে ওঠে। একটু লজ্জা পায়। খাটিয়ার জন্যে বাড়ির ভেতর দিকে কাউকে হেঁকে বলে।
    তারপর বলে-- না, না! বিড়ি দেব না কেন? আসলে কি জান সাহেবরা? এতসব গন্ডগোলে মাথার ঠিক নেই আমার। এক ছেলে , এক মেয়ে। আমার
  • ranjan roy | 24.96.109.44 (*) | ২১ জুন ২০১৪ ০৬:৫৮73423
  • ধেত্তেরি! মামুর কল দ্বৈতবাদী, কবে যে অদ্বৈতের মর্ম বুঝবে?
  • ranjan roy | 24.96.109.44 (*) | ২১ জুন ২০১৪ ০৭:২৯73424
  • আমার যে জমির টুকরো সরকার কয়লাখনির জন্যে নিচ্ছে তাতে দেবে একটা চাকরি। তা আমার জামাই জিদ ধরেছে ওই চাকরি আমার ছেলেকে নয় ওকে দিতে হবে। নইলে আমার মেয়েকে সরকারি কাগজে দস্তখত করতে দেবে না।
    এই নিয়ে শালা-ভাটোর মধ্যে কথা কাটাকাটি, বচসা; শেষে আমার ছেলে রাগের মাথায় ভগ্নিপতির ওপর মারলো টাঙির কোপ! মেয়েটা বেওয়া হতে হতে বেঁচে গেল। কিন্তু জামাইয়ের বাঁ-হাতের তিনটে আঙুল চলে গেছে। তো আমার ঘরের একজন হাসপাতালে, আর একজন হাজতে। আমি বুড়ো দৌড়ুচ্ছি গাঁ থেকে শহর, শহর থেকে গাঁ।
    জামিন হয় নি। আগামী সোমবার কেস আদালতে তুলবে; উকিলবাবু দু'হাজার নিয়েছে। সেদিন বেশ কয়টা নম্বরি নোট নিয়ে যেতে হবে।
    এবার ও ঘটি থেকে ঢক্ঢক করে জল খায়।
    আমরা মিনিট খানেক চুপ করে থাকি।
    অস্বস্তি এড়াতে চ্যাটার্জি মুখ খোলে।
    ---- বহোত বুরি বাত। কিন্তু আমাদের কী দোষ? আমরা কী করেছি?
    ফুঁসে ওঠে গৌটিয়া সমারুরাম।
    --- কী বললে? তোমাদের কোন দোষ নেই? তবে কার দোষ? কে করেছে এসব?
    --- আমি? কী করলাম?
    --- তুমি নিজে না, তোমরা! আমরা জানতাম জমি হল মায়ের মতন; ও আমাদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখে। জমি বেচতে নেই। তোমরা দেখালে লোভ,-- জমি দে, টাকা নে, চাকরি নে।
    আমরা ক্ষেতে চাকর রাখি, কামিয়া রাখি। নিজেরা গোমাতার সেবা করি, বাঢ়রাজা-বাররাণী-ঠাকুরদেব এর থানে মাথা ঠেকাই।
    আমরা কারো চাকর নই। এখন আমাদের ছেলেপুলেরা সরকারি অফিসে চৌকিদার হবে, পিয়ন হবে, চাপরাশি হবে!
    আমরা জানতাম সবাই মিলে একটা পরিবার। তোমরা সেখালে আপন আপন বাঁচ গে যাও। আমাদের হিসেবে বড় বা সিয়ান বা কর্তার কথাই শেষ কথা। তোমাদের প্রশ্রয়ে সেদিনের ছোঁড়াগুলো চোখ তুলে কথা বলে!
    জামাই ও ছেলে! কত ভাব-ভালবাসা! দুই ভাইয়ের মত। এখন সেই ছেলে জামাইয়ের ওপর টাঙি চালিয়ে দিল--- এর জন্যে তোমরা শহুরে বাবুরা দায়ী নও?
    শোন গো! আজকের চা তোলা রইল। আকাশের মতিগতি ভাল নয়। আঁধি আসছে মনে হয়। অব তুমন জলদি রেঙ্গ। লকর লকর লা ছোড়ব। উঠ, রেঙ্গ। নহী তো ফঁস জাও গে।
    ( এবার তোমরা গা তোল, পা চালাও। আমার বকবকানি শেষ। নইলে এখানেই আট্কা পড়ে যাবে।)
  • ranjan roy | 24.96.101.254 (*) | ২৩ জুন ২০১৪ ০৩:২৩73427
  • হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকে মাথা মুছে চায়ে চুমুক দিয়েছি কি বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকারে বেশিক্ষণ থাকতে হল না, কেশোদাদা নিপুণ হাতে হ্যাজাক জ্বেলে দিয়েছে।
    বাইরে শুরু হয়েছে তান্ডব। কালো মেঘের চাঁদোয়ার নীচে ভেসে বেড়াচ্ছে পেঁজা তুলোর মত জলভরা সাদা মেঘ। মাটি ডাকছে আকাশকে। আকাশ সাড়া দিয়েছে সে ডাকে। বিজলির জিভ দিয়ে চেটে দিচ্ছে ধরতীর শরীর, লালায় ভরিয়ে দিচ্ছে। আর ধরতী মুঠো করে খামচে ধরছে গাছপালা, নুইয়ে দিচ্ছে মাথা।
    ক্যাম্পের টিনের চালে বৃষ্টির চড়বড় চড়বড় যেন মাদলের বোল। আস্তে আস্তে চাল আর টিনের দেওয়াল ঠান্ডা হয়ে এল। বাইরে ঝড়ের দাপট কমেছে, কিন্তু বৃষ্টির জোর সেই একরকম। এর ওপর শুরু হয়েছে 'ওলে' বা শিলাবৃষ্টি।
    জানলা বন্ধ করতেই হল, নানারকম পোকামাকড় ঢুকছে। কানে আসছে অসংখ্য সোনাব্যাঙ ও ঝিঁঝির ঐকতান।
    কিছু করার নেই। এই আবহাওয়ায় ট্রানজিস্টারেও শুধু খড়খড়ানি।
    খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ি। আর দুটো দিন। আর একটা রাত্তির।
    শীত শীত করছে। গায়ে চাদর টেনে চালের ওপর বৃষ্টিধারার তবলা লহরা শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ি।
  • ranjan roy | 24.96.101.254 (*) | ২৩ জুন ২০১৪ ০৩:৪৪73428
  • বাররাজা-বাররাণীর থানের সামনে অগ্নিকুন্ড। মাঠের চারপাশে গাছের গায়ে গায়ে মশাল বাঁধা। অগ্নিকুন্ডের সামনে একটা উঁচু ঢিবির ওপর বসে আছেন বাররাণী। তার সামনে আমি আর চ্যাটার্জি পিছমোড়া করে বাঁধা।
    আদিবাসীদের ছোট ছোট দল ঘুরে ঘুরে নাচছে আর গাইছে--" তোলা দয়া লাগে না, তোলা মায়া লাগে না, তোলা দয়া লাগে--এ-এ-এ!"
    ( তোর দয়া হয় না গো, তোর মায়া হয় না গো!)
    বৈগা পুরুত মন্ত্র পড়ে আমাদের দুজনের গায়ে হলুদ চাল ছিটিয়ে দিল। অমনই মোড়লের ছেলে দুহাতে রামদা' উঁচু করে তুলল। আগে আমি না চ্যাটার্জি? ভয়ে চোখ বুজতেই বাররাণী খিল খিল করে হেসে উঠল। চমকে তাকিয়ে দেখি ওর পরণে লাল লুগরা আর কালোকোলো বোঁচা মুখে গোটা কয় ব্রণ।
    ঘুম ভেঙে গেল। বালিশ ঘামে ভিজে গেছে। বুকটা ধড়াস ধড়াস করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। খাটিয়া থেকে নেমে কুঁজোটা তুলে গলায় উপুড় করে দিই।
    বাইরে ভোর হচ্ছে।
  • ranjan roy | 24.99.0.86 (*) | ২৩ জুন ২০১৪ ০৮:০২73425

  • আমরা চুপচাপ বেরিয়ে আসি। চ্যাটার্জি সিগ্রেট ধরায়, তারপর একদলা থুতু ফেলে বলে-- না এলেই ভাল হত।
    তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে বলে--দূর্‌! মেঘ কোথায়? ওই যে এককোণে একটা ছোট্টমত? ওতে কিস্যু হবে না। মন খারাপ করিস নে মনবোধি! চল্‌, তোকে ওদের দেবতার থান দেখিয়ে নিয়ে যাই। ওখান থেকে আমাদের ক্যাম্পে ফেরার একটা শর্টকাট রাস্তা আছে।
    আমি কোন কথা না বলে ওর পেছন পেছন চলতে থাকি।
    গাঁয়ের বাইরে জঙ্গলের মধ্যে একটা বাঁশঝাড় এড়িয়ে খানিকটা সাফসুতরো জায়গা। বিশাল বটগাছ, বয়সের গাছপাথর নেই, অসংখ্য ঝুরি নেমেছে, উইয়ের ঢিবি।
    এইখানে বটের ছায়ায় গোবরলেপা একটু বেদি মতন, তাতে তিনখন্ড এবড়ো খেবড়ো পাথর-- একটা খানিকটা বাড়ির মশলা পেষা শিলনোড়ার মত। ওটার গায়ে সিঁদূর লেপা। আর সামনে কিছু হলুদ চাল, লংকা ও আদার টুকরো মত ছড়িয়ে রয়েছে।
    কিন্তু ওদের ভগবান কই?
    চ্যাটার্জি আমার অজ্ঞতায় হাসে।--- বলে এই তো তিনজন দেবদেবী। শিলনোড়ার মত দেখতে পাথরটাই বাঢ়রাণী, বাকি দুটো বাঢ়রাজা ও ঠাকুরদেব।
  • ranjan roy | 24.96.101.254 (*) | ২৩ জুন ২০১৪ ১২:১৫73426
  • হরি! হরি! এই তবে ওদের দেবস্থান, এমন সাদামাটা? একটার থেকে আর একটাকে আলাদা করে চেনাই মুশকিল।
    চ্যাটার্জি ধমকে ওঠে।
    --- ইয়ার্কি না। জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি দেখে আলাদা করে চিনতে পার? ব্যাপারটা আসলে বিশ্বাসের।
    ধানকাটার পরে এদের গাঁয়ে আসলে দেখতে পেতে ।
    --কী?
    -- বারোদিন ধরে বাঢ় উৎসব। চারদিকের দশটা গাঁয়ের লোকজন মিলে রোজ রাত্তিরে নাচ আর গান। শেষরাত্রে ভক্তদের শরীরে এক এক করে বাঢ়রাজা, বাঢ়রাণী ও ঠাকুরদেবের ভর হওয়া; তারপর পাঁঠা ও মুরগি বলি দিয়ে শান্তিজল।
    আমি ঠোঁট উল্টে বলি -- শুনলাম।এবার সত্যিই পা চালাতে হবে মনে হয়।
    আমরা খেয়াল করিনি-- ঈশানকোণে একটু আগে দেখা ছোট্ট কালির ফোঁটা কখন যেন আকাশের সাদা টেবিল ক্লথে ছড়িয়ে গেছে। দূর থেকে একটা গোঁ-গোঁ-সোঁ-সোঁ আওয়াজ। পাক খেয়ে আকাশে উঠে যাচ্ছে শুকনো পাতা ও লাল ধূলো।
    ---- সেরেছে! বড় করে আঁধি আসছে। মনবোধি, দৌড়ো।
    আমরা দৌড়োতে থাকি। একটু পরেই চারদিক অন্ধকার করে সেই ধূলোর ঝড় আমাদের গায়ে মাথায় আছড়ে পড়ে। কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি নে। চোখে মুখে বালি কিচকিচ করছে।
    ভাবছি কোথাও দাঁড়ালে হয়; তেষ্টায় গলা শুকিয়ে কাঠ। চ্যাটার্জি খিঁচিয়ে ওঠে-- থামিস না, সামনের দিকে দৌড়ো। আঁধি আমাদের পেছনে চলে যাবে। কিন্তু বৃষ্টি আসছে, তার আগে ক্যাম্পে পৌঁছতে হবে। বেশি দূর নয়।
    আমরা অন্ধের মত সামনে দৌড়ে চলি।
    হ্যাঁ, ওই আঁধি বা ধূলোর ঘুর্ণি আমাদের টপকে গাঁয়ের দিকে চলে গেছে। এখন সামনে দেখতে পাচ্ছি। ওই তো আমাদের ক্যাম্প! আর পঞ্চাশ গজ।
    ওয়েল্ডিং এর তীব্র ফুলকির মত এক আলোর রেখা ইস্পাতনীল আকাশটাকে ওপর থেকে নীচ অবদি ফালাফালা করে দিল। আর কড় কড় শব্দে বাজ।
    শেষ ল্যাপে চ্যাটার্জিকে হারিয়ে সোজা ক্যাম্পের ভেতরে ঢুকে দম নিলাম। ততক্ষনে বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি শুরু হয়েছে।
  • Ranjan Roy | 24.98.234.41 (*) | ২০ জুলাই ২০১৪ ০৮:০৪73429
  • ৯)আজ আহিরণ নদীর পাশের জঙ্গলে এই অস্থায়ী ক্যাম্পে আমার শেষ দিন। একটা দিন আর একটা রাত। ব্যস্‌।
    কাল সকালে কোরবা থেকে কোম্পানির গাড়ি আসবে। তাতে বোঁচকা-বুঁচকি চাপিয়ে আমরা যাবো চাঁপা রেলস্টেশন।সেখান থেকে দুই বিপরীতগামী প্যাসেঞ্জার ট্রেনে চড়ে আমি ও চ্যাটার্জি নিজের নিজের ঘরে যাব; রায়পুর ও রায়গড়।দশদিনের ছুটি। তারপর নতুন সাইট।
    কিন্তু আজ সকালটা কেমন যেন গোমড়ামুখো। কাল সারারাত্তির বৃষ্টির পরে আকাশ মেঘলা, রোদ্দূর ওঠেনি। কাল সন্ধ্যের উদ্দাম ঝড়ের পরে হাওয়া থেমে গেছে।
    কেশোদাদার ও হাসি নেই, কথায় কথায় আর 'আনন্দম্‌ দাদা!' বলে উঠছে না। ও বুঝেছে হয়ত আমাদের আর কখনো দেখা হবে না।
    চা-জলখাবার খেয়ে আমরা বাঁধাছাঁদায় হাত লাগাই। আর ভাবতে থাকি ঘরের কথা, আমার শহর রায়পুর। গ্রাম আর জঙ্গল ঢের হয়েছে। এবার ঘরে ফেরার পালা।
    রাত দশটা নাগাদ ট্রেন রায়্পুর স্টেশনে পৌঁছুবে। রিকশা করে বাড়ি খুব বেশি হলে পনের মিনিট। তারপর?
    মা নিশ্চয়ই ছেলের জন্যে আজ পুরি-সবজি রাঁধবে। আর লাই-বড়ি? আর মুংগা বা সজনে ডাঁটার তরকারি। তাতে একটু দই, আমের আচার। বোন হারমোনিয়ামে নতুন শেখা কিছু বাজিয়ে শোনাবে।
    বাবা চশমার কাঁচ ধুতির খুঁট দিয়ে সাফ করতে করতে একগাল হেসে বলবেন-- কতদিন থাকবি?
    তারপর কাল সকালে বাথরুম, শহুরে পায়খানা।
    বেলা বাড়লে আসবে বন্ধুর দল। এবার শুধু জয়স্তম্ভ মোড়ের কাঁচের গেলাসে চা খাইয়ে রেহাই পাব না, নিঘ্ঘাৎ কফি হাউসে খাওয়াতে হবে। আর রাজ টকিজে সিনেমা!
    এভাবেই বেলা গড়িয়ে যায়। বিকেল চারটে নাগাদ মেঘের ফাঁক দিয়ে একটু লজ্জা-লজ্জা রোদ উঠল। চ্যাটার্জি বলল-- চল রে মনবোধি! শেষ বারের মত জংগল থেকে বেড়িয়ে আসি। আহিরণ নদীকে স্যালুট
    মারতে হবে না?
    আমি হেসে ফেলি। আমার স্মৃতিতে চলকে ওঠে সেই এক শীতের সকালে নদীতে স্নান করতে গিয়ে আদিবাসী বনদেবীর দেখা পাওয়া।
    কেশোদাদা পেছন থেকে ডেকে বলল-- সন্ধ্যের আগেই ফিরে এসো। আজকাল মহুয়ার গন্ধে ভালুক আসে।
  • Ranjan Roy | 24.98.234.41 (*) | ২০ জুলাই ২০১৪ ০৮:৫১73430
  • আমি আর চ্যাটার্জি ক্যাম্প ছেড়ে বেরিয়ে পড়লাম-- জঙ্গল পেরিয়ে নদীর দিক থেকে ঘুরে আসব, শেষবারের মত।
    মাটি নরম, কাদা বাঁচিয়ে পা ফেলছি। এখনো গাছের পাতা ভিজে। কোথাও কোথাও পাতলা ঝিরঝিরে জল্ধারা তিরতির করে বইছে, হারিয়ে যাচ্ছে কাছের কোন খানাখন্দে। খেয়াল করলে চোখে পড়বে ছোট ছোট মাছের পোনা, ব্যাঙাচির মত।
    সাবধানে পা ফেলছি। কেননা এই বৃষ্টিতে ডিম ফুটে বেরিয়ে এসেছে কেউটে সাপের ছোট ছোট বাচ্চা। লাফাচ্ছে তিড়িং তিড়িং। এদের স্থানীয় ভাষায় বলে ডোমহি। গায়ে পা পড়লে ছোবল দিতে কসুর করে না।
    আমরা কথা বলছি নিজেদের কথা ,অসমাপ্ত স্বপ্নের কথা। আগামী দিনের কথা।
    একটা বড় আমলকী গাছের নীচে বেশ উঁচু উইয়ের ঢিবি। সেটার পাশ কাটিয়ে বিশাল বটগাছের দিকে এগোতেই আমাদের পা মাটিতে সেঁটে গেল।গাছের আড়াল থেকে আমাদের সামনে লাফিয়ে এসেছে একটি নেংটিপরা কুচকুচে হিলহিলে ছেলে, বিস্ফারিত চোখের মণি; দুহাতে ধরা একটি টাঙি, তার সাপের জিভের মত চেরা ফলা।
    হাঁফাতে হাঁফাতে ও চেঁচিয়ে উঠল--- এ সাহাবমন! মোর দাঈ লা দেখে হস কা?
    ( ও সাহেবরা! আমার মাকে দেখেছ কি?)

    চ্যাটার্জির মুখের ভেতরে জিভ যেন আঠা দিয়ে সাঁটা। কোনরকমে দুদিকে মাথা নাড়ে। হতাশ কিশোর নীচুগলায় বিড়বিড় করে।
    -- দেখিস নি! সেই সাতসকালে মা কাঠকুটো কুড়োতে বেরিয়েছে, এখনো ফেরেনি। কখন বাড়ি যাব, খিদে পেয়েছে যে!

    তারপরে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা।

    সেই মায়াবী আলোয় ওই কিশোর মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে ডুবন্ত সূর্যের দিকে মুখ করে টার্জানের মত দু'হাত মুখের কাছে নিয়ে কুক্‌ দিয়ে উঠল-- "দাঈ মোলা শুনথস্‌ ও-ও-ও-ও!"
    সেই ডাকে কেঁপে উঠল আকাশ-বাতাস-বনভূমি। গাছের ডাল থেকে ঝটপটিয়ে ডানা মেলে উড়ে গেল পাখির দল। সেই ডাকের অনুরণন ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল দলছুট মেঘেদের রাজ্যে।
    আমি এবার ভাল করে ছেলেটির দিকে তাকাই। মুখটা যেন চেনা চেনা লাগে!
    আরে, এই তো কিশোর ছত্তিশগড়! হাঁ করে গিলতে আসা শহুরে সভ্যতার চাপে দিশেহারা।
    --ঘরে ফেরার রাস্তা ভুলেছি মাগো! বড় ক্ষিদে পেয়েছে, আমার হাত ধর মা!
    (শেষ)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত মতামত দিন