এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বিকেলের রাঙা গল্প

    Parthasarathi Giri লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ | ২৬২০ বার পঠিত
  • বিকেলের রাঙা গল্প
    *****************

    একটা উধাও হাইওয়ের পাশে একটা ডোবা। ডোবার পাড়ে একটা ঝাঁকড়া শিরিষ গাছ। ছায়া পড়েছে জলে। এক টুকরো জল ঘিরে একটি ইকোসিস্টেম।

    জল দেখলে, বিশেষত কাদামাখা ঘোলাজল দেখলে আমার কানকো খলবল করে ওঠে। পায়ের নখের ধার বরাবর, কানের লতির নিচে সুড়সুড় করে শিরিষ-ফুল-ভাসা ডোবা দেখলে। মাঝে মাঝে স্থির জল তিরতির করে কেঁপে উঠছে। মনে হয় ফিসফিস নাকি বিড়বিড়; ডোবার ঘরে আমার খলসে বউয়ের গা ভারি হয়েছে বলে গজগজ করে?

    পুরুষজাতটাই তো বজ্জাত। বলিনি আমি? কতবার করে বাবাকে বললুম, ওগো আমাকে যার তার হাতে তুলে দিওনি। আমারে বুঝবেনে। সেই তুলে দিল, আর দিল কিনা এমন আলা পাষণ্ডের ওপর।

    জলের ওপরে একটি শিরিষ ফুলের পাশে আরেকটি ঝরে পড়া ফুল এসে শুয়ে পড়ে। ছোট ছোট কদম ফুলের মতো সুখ জলের গায়ে গায়ে আঁকা। হলদে সাদা রেণুগুলো সর সর করে ছড়ায় আর সরকি পোকারা ছোঁয়াছুঁয়ি খেলে যায়। হালকা শীত শীত রোদ ছলকাচ্ছে কি খলসে বউয়ের মুখরা ঠোঁটে?

    একবার ফিরেও দেখে না গা বউটা মরল কি বাঁচল!

    আমি জলের পাড়ে বসে ডোবার ভেতর নিজের ছোট ছোট হাড়, কেঁচো, মাংসের টুকরো, নাকের পোঁটা, হৃৎপিণ্ডের দ্রুম দ্রুম ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিচ্ছিলাম, একটা বিকেল হাইওয়ের পাশে বসতে পেয়েছি বলে।

    সাইকেলের ক্রিং ক্রিং বেল কানে এলে দেখি কেরিয়ারে হেন্ডেলিয়ামের হাঁড়ি দড়ি দিয়ে বাঁধা। আলপথ বেয়ে সাইকেলটা উঠে আসছে সওয়ারি নিয়ে।

    হ্যাঁ গো চাচা, এ গাঁয়ের নাম কী?
    খলিসাডুবি।
    তোমার নাম কী?
    খলিল শেখ।
    কোথায় যাও?
    রানিবানির খালে জাল পড়েছে। আজ সারাদিন জল খালি হবে।
    মানে?
    পুরা মাছ ধরা হবে। নিলাম হবে।
    ও।
    রানিবানি রানিবানি রানিবানি। আমি গাঁয়ের নামটা বিড়বিড় করতে থাকি। কী সুন্দর অর্থহীন নাম। অযথা, তবুও বাঙ্ময়।

    আমার গায়ের আঁশে একটা ছোট্ট পোকা উড়ে এসে বসেছে, নাকি জলের কেঁউট? আমি টোকা মেরে ফেলে দিলাম। ফের সেটি পিঠের আঁশে খুদে খুদে ঢুকে গেল। আমার কানকো চুলকে উঠল। আমি মুখ হাঁ করতে দু চারটে ছটা বুদবুদ হাওয়ায় উড়ে গেল। একটা দুর্গা টুনটুনি বোধহয় ইউফো ভেবে ঠোঁট খুঁটে বুদবুদ ভেঙে দিয়ে ফুড়ুৎ করে পালায়।

    ডোবার ছায়াজলে ঘাই দিচ্ছে সতের শো বৃত্তান্তের মালাকর।

    ও খলসে বউ, এখনও তোমার জিভে এত ভিয়েন? সেই যে সেই ডিম পাড়ার মরশুমে, জলের ওপর জল তার ওপরে জল, তার ওপরে তোমার ড্যাবডেবে ডাগর চোখে চোখ ছুঁয়ে বলছিলাম, ওগো কষ্ট হবে, তার চেয়ে চলো এই খোঁদলের পাঁক ছেড়ে পরের বাদলায় দত্তবাড়ির পুষ্কুরিণীতে যাই। ওখানে জলের মাটিভরা কত্তো পোকা থাকবে'খন, জলের ওপরে বাতাস গাছের শরীরের বাকল ডোকলার গুঁড়া এনে ফেললে দুজনে গাল ভরে খাব। তা তুমি গেলে?

    গেলে? গেলে? বলি এ সংসার ছেড়ে যাবটা কেন শুনি? খলসে বউ হনহন করে ইদিক উদিক না জানি কত টুকিটাকি কাজে দৌড়োদৌড়ি করতে করতে হাঁফিয়ে কথা বলছে।

    জলের তলায় অজস্র রঙিন বলের মতো পোকা, মাছ, লাল যুগান্তর, সবুজ পতাকার ওপর রক্তের ছিটে, সব উতল হয়ে ঘুরে ঘুরে যেন ত্রুবাদুর। বুড়বুড়ির ঝিলিকে কেলে কাঁকড়ার হাসি, কুচো চিংড়ির নখরা। চ্যাং মাছের ছানারা ডাংগুলি খেলছে। তাদের এখন হো হো অকারণ হাসি।

    আমার খলসে বউয়ের চোখে জল নাকি? হ্যাঁ, জলের ভেতর জল।
    চোখে জল কেন গো সই? ভুল দেখছি না তো?
    খলসে বউ পেট উল্টিয়ে দেখায়, তুমি কী বুঝবে পেটে ধরার সুখ কষ্ট দম। তুমি তো চিরকাল পাখনা নেড়ে নেড়ে কীর্তন গেয়ে, কপালে রসকলি পরে পরের উঠোনে রাত ভোর করে এলে। আমারে তুমি কখনও ভালবাসো নাই। এদিকে এই পাঁচ গতরের সংসার ঠেলে ঠেলে আমার যে হাড়মাস কালি হল, বলি চোখে দেখতে পাও?

    যুগের পাতা উল্টিয়ে যাচ্ছে হাইওয়ের পাশে। এই সব হাইওয়ে কতদূর গেছে এ গাঁ ফেলে? অনেক দূর? হুই যে ম্লান চাঁদ দেখা যায়, অত দূর গেছে? পথ গা ভাঙে চড়চড় করে বিটুমেন অ্যাসফল্টের নিচে।

    আমি এবং আমার খলসে বউয়ের কথা শুনে হাইওয়ে খ্যা খ্যা করে হাসল। যে যত পায়, তার তত খাঁই বেশি।

    অমন করে বোলো না দীর্ঘতনু।
    বলবনি? তুমি যে ওরে চোখে হারাও, আমার পাড়ে বসে ছিলিম একদিন ছুঁড়ে দিচ্ছিলে মনে আছে? বলছিলে, নেশা করে হেথা হোথা আমার শরীরে আর শোবেনিকো। বউটারে এবার নজর দিতে লাগে। সে বিহনে কোথা যেতে পারো তুমি?

    জলের ওপর অজস্র মাংসের মতো, আলোর ফুলকির মতো শিরিষ ফুল ভাসে নিশ্চিন্তে। কে কাকে ঠাঁই দেয় বা কেড়ে নেয়? ঠাঁই নিয়ে নিয়েছে ফুলেরা জলের গায়ে গায়ে।

    খলসে বউ জলতলে ঠোঁট মেলে একটা পূর্ণ ঘাই দিল। কী অপরূপ রূপখানি আমার সখীর! ডাগর ডাগর চোখে সৃষ্টির সমূহ কাজল মাখা। পাখনা নেড়ে নেড়ে সেই তার পোঁদদোলানি চলন। পেট ভরা ডিম। জলের ওপর অজস্র কুচকাওয়াজ যেন শুনতে পাচ্ছি। লঙ মার্চ। দূর্গপ্রাচীর হড়হড় করে ভেঙে পড়ছে। কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বেজে উঠেছে হাজার বিউগলে। রক্তের রেণু ঘিরে কাচের পুঁতির মতো ডিম ফুটে বেরিয়েছে বলে সাদা সাদা পাখিরা ঠোঁটে ঘাস নিয়ে অভিবাদন জানাতে এসেছে আঁতুড়ের উঠোনে। এ তো আমাদেরই সব ছানাপোনা গো খলসে বউ!

    তবে চলো কাদাজলে ভেসে যাই। এই ডোবা আমাদের। এই সব পোকাদের ওপর আমাদের অধিকার। এই সব ক্রীড়াময়, এই ক্ষুধা খাদ্য বাসস্থান আমাদের। এ জল আমার তোমার। এই সব যত যুগ যুগান্ত যুগান্তর সব আমরা এই হাইওয়ের পাশে বসে বসে হেঁটে হেঁটে সাঁতরে সাঁতরে খাব। তুমি মুখ করলে এই মুখপোড়া হাইওয়েকে দুচারটে গালি মেরে চুমা খেয়ে রাগ হাল্কা করব বটে, কিন্তু যে-সুর লক্ষ কণ্ঠকে জুড়ে দেয় উড্ডীন লাল নিশানে আঁশে পালকে, তাকে হারাই কেমনে!

    জলের নিচে ডাগর চোখের ঠোঁট বুড়বুড়ি কেটে উঠল, ইনকিলাব...
    আমি ডোবার পাড়ে পদপূরণ করলাম, জিন্দাবাদ।

    বিকেলের রাঙা সূর্য এসেছে পশ্চিম দিগন্তরেখায়।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৩ ডিসেম্বর ২০১৮ | ২৬২০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • I | 785612.41.672312.97 (*) | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:৪৮65203
  • আহ, ভাষা, ভাষা! এরকম মাটিমাখা বাংলাভাষা কী যে সুখ দেয়! কী যে হিংসে দেয়!
  • i | 452312.169.90023.66 (*) | ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ১১:৪৯65204
  • উৎসব স্পেশালের গল্পটির মত এ এলেখাতেও শেষ লাইন নিয়ে আমার প্রবল আপত্তি রইল। শেষ লাইনটি মুছে দিতে ইচ্ছে হয়।
  • সুকি | 7845.15.676712.21 (*) | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০১:৪২65205
  • ভালো লাগল খুব
  • নাহার তৃণা | 89900.227.90012.5 (*) | ২৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৫:২২65206
  • চমৎকার ভাষা বুনটের আটসাট গল্প।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন