এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • একটি ঠেকের মৃত্যুরহস্য

    ন্যাড়া লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ৮২৩ বার পঠিত
  • এখন যেখানে সল্ট লেক সিটি সেন্টারের আইল্যান্ড - মানে যাকে গোলচক্করও বলা হয়, সাহেবরা বলে ট্র্যাফিক টার্ন-আউট, এবং এখন যার এক কোণে 'বল্লে বল্লে ধাবা', অন্য কোণে পি-এন্ড-টি কোয়ার্টার, তৃতীয় কোণে কল্যাণ জুয়েলার্স আর চতুর্থ কোণে গোল্ড'স জিম - সেই গোলচক্কর আশির দশকে ছিল আমাদের ঠেক। ৮৭-সালের ওয়ার্ল্ড কাপে পাকিস্তান হারবার পর এই অকুস্থলেই বাস থামিয়ে উদ্দাম নৃত্য প্রদর্শন করা হয়েছিল। 'সান্থাল টুইস্ট' না হলেও তার কাছাকাছি। তবে কেউই নেশা করেনি। এবং বাসে শর্মিলা ঠাকুরও ছিলনা, কাবেরী বোসও নয়।

    আজ থেকে তিরিশ বছর আগে এ অঞ্চল একেবারে নির্জন। পি-এন্ড-টি কোয়ার্টার ছিল। অন্যদিকে সিটি সেন্টারের ব্লক কমপ্লিট ধুধু, প্রচুর স্টোন চিপস স্তুপ করে রাখা ছিল। গোল্ড'স জিমের পেছনে সল্ট লেকের প্রথম সিনেমা হল 'শিবম'-এর কাজ চলছিল। সে কাজ আর শেষ হয়নি কোন এক ইনজাংকশনের ধাক্কায়। তার আধাখ্যাঁচড়া ধ্বংসাবশেষ এই কদিন আগেও দেখেছি। আর সেই শিবমের সামনে ছিল শংকরের চায়ের দোকান। এই গোলচক্করের আশপাশ দিয়ে গাড়ি চলত অল্পই। রাত আটটার পরে তো একেবারে নিঃঝুম। মাঝে মাঝে এস-১৪, শাটল-৯, যাদবপুর মিনি, ২২১, এস-২৩ আর ৩৯ক রুটের বাস যেত রাত এগারোটা অব্দি। গড়িয়া থেকে রাত দশটার শেষ এস-১৪ পি-এন্ড-টি পেরোত এগারোটা দশে। ব্যস।

    সল্ট লেকে কংগ্রেসের অধিবেশনের সময়ে ১৯৭২ না ৭৪ সালে ইন্দিরা গান্ধীর জন্যে একটি প্রাসাদোপম কুটির বানানো হয়েছিল। কীভাবে যেন ছোটবেলায় একবার সেই কুটিরে গাইডেড টুর নেবার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেই দেখেই প্রাসাদোপম শব্দের মানে শিখেছি। সে কুটির ফাঁকাই পড়ে থাকত। এদিকে তখন রাজ্যের মসনদে আমাদের সেই জনগণতান্ত্রিক বামফ্রন্ট সরকার আর জ্যোতি বসু তার মুখ্যমন্ত্রী। মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী আশির দশকে একসময়ে স্থির করলেন যে, রাজ্যশাসনের সুবিধের জন্যে তিনি সেই জনগণের কুটিরে আশ্রয় নেবেন। জ্যোতিবাবু ডোভার লেনের পৈতৃক বাড়িতেই থাকুন আর সল্ট লেকের প্রাসাদেই থাকুন, তাতে আমাদের মতন প্রলেতারিয়েতদের কী আর আসে যায়! কিন্তু এসে যায়, কর্তা, খুব এসে যায়। কারণ মুখ্যমন্ত্রীর কনভয় আমাদের সাধের ঠেকের পাশ দিয়ে প্রতিদিন সকালে যাবে আর সন্ধ্যেবেলা ফিরবে। সামনে লাল আলো জ্বালিয়ে পুলিশের গাড়ি। পেছনে পুলিশের ভ্যান। তাছাড়া অন্য সময়েও পুলিশ এই রাস্তায় টহল দিতে থাকবে।

    মুখ্যমন্ত্রীর কুটিরবাসের কোল্যাটারাল ড্যামেজে প্রথমেই গেল শংকরের ঝুপড়ি। জনগণেশের সরকার তো, তাই মুখ্যমন্ত্রীর যাতায়াতের পথে বেআইনি চায়ের দোকান থাকা খুবই গর্হিত ব্যাপার। জ্যোতিবাবু বা পার্টির এই ব্যাপারে কোন হাত ছিলনা বলেই মনে। পুলিশের কিছু মাঝারি-সাইজের কর্তার কাজ দেখানর বাড়াবাড়িতে শংকর তার ঝুপড়ি খোয়াল।

    এখানে ঝপ করে একটা অন্য গল্প বলে নিই। কলেজ স্ট্রিটে একবার খুব স্মার্ট অর্থাৎ ওপরচালাক এক ছোকরা বান্ধবীদের সামনে কী এক ক্যারদানি দেখাতে গিয়ে পুলিশ সার্জেন্টের হাতে ধরা পড়ে। যৌবনের যা ধর্ম, ছোকরা সার্জেন্টের মুখে মুখে কিছুক্ষণ চোপা করে শেষ পর্যন্ত এই বলে খাপ খোলে যে "আমার সঙ্গে বাঁ* লাগতে এসনা, এমন দেখাব না!" এমতাবস্থায় সার্জেন্টে যা বলার, তিনিও তাই বলেন, "কী দেখাবি, দেখা।"
    ছেলেটি - "দেখবে?"
    সার্জেন্ট - "বলছি তো দেখা।"
    ছেলেটি তখন নিজের বাঁ পা থেকে চপ্পল খুলে এক হাতে তুলে বলে, "এই চপ্পল তুললাম।" সার্জেন্ট বলল, "তারপর?" ছোকরা ডান পা থেকে চপ্পল খুলে অন্য হাতে নিয়ে বলল, "আরেকটা তুললাম, এখনও দেখতে চাও বাঁ*?" অকুতোভয় সার্জেন্ট তখনও মজা দেখার জন্যে উদগ্রীব। ছেলেটি তখন "এই দ্যাখ" বলে চপ্পল হাতে, বান্ধবীদের পেছনে ফেলে পাঁইপাঁই করে দৌড়ে শেয়ালদার দিকে ভীড়ে মিলিয়ে যায়।

    এই গল্পটা না জানলে আমাদের গোলচক্করের ঠেকটি ভেঙে যেত না। হল কি, পুলিশের গাড়ির টহল বেড়ে গেছিল খুবই। আর আমরা পুলিশের গাড়ি আসতে দেখলেই মাথা নাবিয়ে পিঁপড়ে পর্যবেক্ষণ করতাম বা আকাশের দিকে মুখ করে চিল দেখতাম যাতে পুলিশে আমাদের মুখ দেখতে না পায়। কেন করতাম, আজও জানি না। কেউই তো ফেরারি আসামী ছিলাম না। কেস-টেসও ছিলনা কারুর নামে। এরকম বেশ কিছুদিন চলার পরে আমাদের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। একদিন পুলিশের ভ্যান পাশ দিয়ে যাবার সময়ে ঠেকের একজন চেঁচিয়ে ভ্যান উদ্দেশ্য করে মোলায়েম কিছু গালাগাল দেয়। দেখা গেল ভ্যান কিছুদূর গিয়ে থেমে পড়েছে। এই অবস্থায় ঠেকের সবাইকারই কলেজ স্ট্রিটের গল্প মনে পড়ে যায় ও পত্রপাঠ হাতে চটি তুলে সব চোঁচাঁ দৌড় লাগায় বিভিন্ন দিকে। ভ্যানের একমাত্র যাত্রী, তার চালক ভ্যান থেকে হন্তদন্ত হয়ে নেবে একটা গাছের তলায় দাঁড়িয়ে হিসি করে, পাশে পিচিক করে থুতু ফেলে ধীরেসুস্থে একটা বিড়ি ধরিয়ে ভ্যান স্টার্ট করে চলে গেছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীর খবর। অপসৃয়মান আমাদের পলায়নপথের দিকে একটিবারের জন্যে চোখ তুলে বা অপাঙ্গেও চেয়ে দেখেনি। কিন্তু সেই যে আমাদের গোলচক্করের ঠেক উঠে গেল, আজ অব্দি আর সে ফিরে এলনা।

    পুলিশের হিসিতে ঠেকের মৃত্যুর ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসে সেই প্রথম। আশা করি, সেই শেষও।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ | ৮২৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • saikat | 342323.176.90078.195 (*) | ২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৬:৩৮61824
  • আমি তো শুনেছিলাম, পুলিশের সাথে ঝামেলায়, ঐ গোলচক্করের ঠেকের কোন ছেলে বা ছেলেদের পেছনে পুলিশ রুল ঢুকিয়ে মোচর দিয়েছিল। তারপরই ঠেকটি ভেঙে যায়
  • বিপ্লব রহমান | 340112.231.126712.74 (*) | ০১ অক্টোবর ২০১৮ ০৪:০০61825
  • জনগণতন্ত্রের সরকারের পুলিশ বলে কথা!
  • mila | 6767.193.345623.36 (*) | ০৩ অক্টোবর ২০১৮ ০২:৪৮61826
  • আহা সেই পি এন্ড টি কোয়ার্টার্স
  • শেখর | 2345.110.784512.120 (*) | ১২ অক্টোবর ২০১৮ ০২:২৫61827
  • স্মৃতি উস্কে দেওয়া মনোরম লেখা। ছোট্ট একটা তথ্যগত ভ্রান্তি চোখে পরল। জ্যোতিবাবুর পৈতৃক বাড়ি তো ডোভার লেনে নয়, হিন্দুস্তান পার্কে বলেই জানতাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে প্রতিক্রিয়া দিন