এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • সেদিন ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।

    Sushovan Patra লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ | ১৩৯৫ বার পঠিত
  • মিত্তির মশাই সকালে মেরি বিস্কুট চায়ে ডুবিয়ে আনন্দবাজার পড়েন। চিত্তরঞ্জন পার্কের অগ্নিমূল্য সবজি বাজারে ২টাকা বাঁচাতে দরদাম করেন। তারপর ধোঁয়া ওঠা ভাতে ঘি মেখে খেয়ে, হাতের গন্ধ শুকতে শুকতে অফিস বেরিয়ে পড়েন।
    মিত্তির মশাই’র সরকারী চাকরি আছে। ই.পি.এফ আছে; মেডিক্লেম আছে। একটা মিউচুয়াল ফান্ড আর দুটো এল.আই.সি আছে। ছুটির দিনে সর্ষে ইলিশের জোগাড় আছে।
    মিত্তির মশাই’র সেদিন বড্ড ভোগান্তি গেছে। পার্লামেন্ট স্ট্রিটে শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে আধ-ঘণ্টা ট্রাফিকে কেটেছে। অ্যাটেন্ডেন্স রেজিস্টারে সই করতে গিয়ে বড় বাবুর টিপ্পনী হজম করতে হয়েছে। আসন্ন প্রমোশনে সঙ্কট মোচনের কথা ভেবে রাতে তিনবার বেশি পাশ ফিরতে হয়েছে। মিত্তির মশাই তাই বেজায় চটেছেন। স্মগে ডোবা সান্ধ্য আড্ডায় খাকিয়ে বলেছেন
    - যতসব মিছিল-মিটিং। ডিসগাস্টিং পলিটিক্স। রবিবার কর, ছুটির দিন দেখে কর, আপিসের দিনগুলো বাদ দিয়ে কর। বলি, তোদের কাজ নেই বলে কি কারও নেই? সাধারণ মানুষের সুবিধা-অসুবিধাটা একবার ভাববি না ?
    ব্যাসিক্যালি মিত্তির মশাই ঠিকই বলেছেন। ১৩৫ কোটি ৫০ লক্ষ’র তামাম ভারতবর্ষে ৪৮.৭ কোটি শ্রমিকের, অনেকেরই হাতে ‘কাজ নেই’, পেটে ভাত নেই। অনেকেরই প্রতিদিন ‘রবিবার’, প্রতিদিনই ‘ছুটির দিন।’ সেদিক থেকে মিত্তির মশাই’রা ‘প্রিভিলেজড’। প্রিভিলেজড কারণ, মিত্তির মশাই’রা দেশের ‘শ্রমিক শ্রেণী’র, সেই ৩.৫৫% বিরল প্রজাতি যারা সরাসরি রাজ্য কিম্বা কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মচারী। অর্থনীতির পোশাকি ভাষায় যারা ‘অরগানাইজড সেক্টর’। যাদের মাস গেলে বেতনের নিশ্চয়তা আছে, চাকরি’র নিরাপত্তা আছে, ওভারটাইমে মজুরি আছে, সরকার ধার্য ছুটি আছে, শ্রম আইনে বোনাস আছে, ইনক্রিমেন্ট আছে, প্রভিডেন্ট ফান্ড আছে, প্রোমোশন আছে। সরকারী, আধা-সরকারী এবং বেসরকারি মিলিয়ে ভারতবর্ষে 'অরগানাইজড সেক্টর'র লাক্সারি উপভোগ করেন ৫.৬% শ্রমিক ¹। ‘ক্রিম অফ দি ক্রপ’।
    আর মিউনিসিপালিটির যে ঝাড়ুদারটা প্রতিদিন সকালে এঁটোকাঁটা ভর্তি ব্যাগটা ডাস্টবিন থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে, যে লোকটা স্কুলে-স্কুলে মিড ডে মিলের রান্না করছে, আপনার হবু স্টুডিও অ্যাপার্টমেন্টের স্বপ্নে যে রাজমিস্ত্রিটা একের পর এক ইট গাঁথছে, যে আশা-অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা সার্ভের জন্য বাড়ি বাড়ি ঘুরছে, যাঁদের প্রতিদিনের রক্ত জল করা পরিশ্রমে সভ্যতার পিরামিড আকাশে পাড়ি দিচ্ছে, ঝাঁ চকচকে স্মার্ট সিটির ইমারত গুলো ব্যাঙের ছাতার মত গজিয়ে উঠছে -দেশের সেই ৯৪.৬% শ্রমিকই আসলে ‘আন অরগানাইজড’। যাদের মাস গেলে ন্যূনতম বেতন নেই, চাকরি’র নিরাপত্তা নেই, ওভারটাইমে মজুরি নেই, সরকার ধার্য ছুটি নেই, শ্রম আইনে বোনাস নেই, ইনক্রিমেন্ট নেই, প্রভিডেন্ট ফান্ড নেই, প্রোমোশন নেই ² ।
    ১৯৫৭’তে অর্থনীতিবিদ গুলজারি লাল নন্দা’র নেতৃত্ব ১৫তম ইন্ডিয়ান লেবার কংগ্রেস বলেছিল –“শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি, চারজনের পরিবারের প্রতিজন কে প্রতিদিন ২৭০০ ক্যালরির ব্যালেন্স ডায়েট, পরিবার প্রতি বছরে ৬৫ মিটার কাপড়, সরকারি আবাসন প্রকল্পে প্রদত্ত এলাকার সংশ্লিষ্ট ঘর ভাড়া এবং জ্বালানি, বিদ্যুৎ সহ বিবিধ খরচা পুরোপুরি ভাবে বহন করার উপযুক্ত হওয়া প্রয়োজন ³ ।” ১৯৯২’এ সুপ্রিম কোর্ট এই ন্যূনতম মজুরির উপর আরও ২৫% ছেলেমেয়ের পড়াশুনা, চিকিৎসা, বিনোদন এবং উৎসবের জন্য সংযোজনার নির্দেশ দেয়। সব মিলিয়ে বর্তমান বাজার মূল্যে ন্যূনতম মজুরিটা প্রায় মাসিক ২৬,০০০ টাকা। বাস্তবে, এই ‘আচ্ছে দিনের’ রামরাজত্বেও যে ন্যূনতম মজুরিটুকু উপার্জন করেন দেশের মাত্র ৭% শ্রমিক। আর তুলনায় মাসিক ১০,০০০ টাকারও কম উপার্জন করা শ্রমিকের সংখ্যাটা ৬৮% ⁴ ।
    ১৯৮৭-২০১৫, যে ২৮ বছরে সেনসেক্স-নিফটি-জিডিপি’র ঊর্ধ্বগামী অর্থনীতিতে শ্রমিক’রা ২১০% নিট মূল্য সংযোজন করেছে, সেই ২৮ বছরেই শ্রমিক’দের নিট পারিশ্রমিক নাম মাত্র ১৪% বেড়েছে ⁵ । যে ২৮ বছরে ভারতবর্ষে বিলিয়নারির সংখ্যা ১ থেকে বেড়ে ১৩২ হয়েছে, সেই ২৮ বছরেই ১০০ টাকা উৎপাদন মূল্যে শ্রমিক'দের প্রাপ্য মজুরি কমতে কমতে ৯.৯ টাকায় ঠেকেছে ⁶ ⁷ ।
    শ্রমিক ও মালিকের মধ্যে উদ্বৃত্ত সম্পদ বণ্টনের এই বৈষম্য দেখে যখন চক্ষু চড়ক গাছ অক্সফামের মত আন্তর্জাতিক গরিবি গবেষক সংস্থার ⁸, ‘মার্কেট ফ্লেক্সিবিলিটি’র অজুহাতে যখন নতুন শ্রম আইনে মালিক শ্রেণীর হাত শক্ত করা হয়েছে ⁹, আই.এল.ও-র বুনিয়াদি শ্রমমান সম্পর্কিত ৪টি কনভেনশন কে যখন ডাস্টবিনে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে ¹⁰ , ৪৩তম শ্রম সম্মেলনের ‘ঠিকা শ্রমিক নিয়ন্ত্রণ ও বিলোপ’ আইনের সংশোধনী কে তুড়ি মেরে উড়িয়ে যখন স্থায়ী কাজে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ বেড়েছে ¹¹ -মিত্তির মশাই’দের টেবিল তখন ব্লেন্ডার্স প্রাইড আর চিকেন ললিপপে সেজেছে। যে আনন্দবাজার বিরাট কোহলির ফুটওয়ার্কে খুঁত খুঁজতে কফিন থেকে ডন ব্র্যাডম্যান কে তুলে আনে, যে অর্ণব গোস্বামীরা পদ্মাবতী নিয়ে রোজ প্রাইম টাইমে মাছের বাজার বানিয়ে ফেলে, যে জি-নিউজ নতুন দু-হাজারের নোটে জি.পি.এস চিপ বসিয়ে ফেলে, যে আজতকের ক্যামেরা মঙ্গলে গিয়ে জলের ছবি তুলে আনে; সেই কর্পোরেট মিডিয়ার লেন্সেই ৯৪.৬% শ্রমিক’দের দুর্দশার ছবি ধরা পড়েনা। সেই কর্পোরেট মিডিয়ার পাতাতেই নাকের ডগার শ্রমিক বিক্ষোভের খবর দু কলম জায়গা পায়না ¹² । পায়না, কারণ কর্পোরেট মিডিয়া শ্রমিক'দের স্বার্থের কথা বলে না। বলে মালিক’দের মুনাফার কথা। পায়না, কারণ কর্পোরেট মিডিয়া শ্রমিক'দের পয়সায় চলে না। চলে আম্বানি-আদানি'দের পয়সায়।
    তাই কর্পোরেট মিডিয়া কে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়েই, ৩ লক্ষ শ্রমিকের সমাবেশে উত্তাল হয়েছে দিল্লি। মুষ্টিবদ্ধ হাত আর তুমুল ইনকিলাবি শ্লোগানে ভেসেছে দিল্লি। গণহত্যা কারী মাস্টার মাইন্ড’দের দিল্লি কে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছে সফদারের গন্ধ মাখা দিল্লি। ধর্মীয় ভেদাভেদের পিণ্ডি চটকে লাল ঝাণ্ডার তলে হক আদায়ের শপথের সাক্ষী থেকেছে দিল্লি। শপথ, ১৮,০০০ টাকা ন্যূনতম মজুরির দাবী আদায়ের। শপথ, দাবী পূরণ না হলে অনির্দিষ্ট কালের ধর্মঘটের। শপথ, কারখানার'র গেটে তালা ঝুলিয়ে রক্ত চোষা মালিকের বিরুদ্ধে হাল্লা বোলের।
    সেদিন সকালে স্তব্ধ হবে সভ্যতা, থমকে যাবে চাকা। সেদিন সকালে সিক্সটি পয়েন্ট হেডিং-এ ছাপা হবে শ্রমিক’দেরই কথা। সেদিন সকালে প্রতিটা কুঁড়ি বারুদ গন্ধে মাতাল করেই ফুটবে। সেদিন সারা শহর উথাল পাথাল, ভীষণ রাগে যুদ্ধ হবে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৫ ডিসেম্বর ২০১৭ | ১৩৯৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন