এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • হু ওয়াজ নজরুল ?

    Sushovan Patra লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ | ১৪৪১ বার পঠিত
  • - হু ওয়াজ নজরুল মামমাম?
    - সাচ অ্যা শেম তাতাই! ইউ ডোন্ট ইভেন নো নজরুল তাতাই? হি ওয়াজে গ্রেট বেঙ্গলি পোয়েট, রাইটার অ্যান্ড মিউজিসিয়ান। উই অল রেড হিস পোয়েম ইন আওয়ার চাইল্ডহুড।
    দিল্লী মেট্রো তে আড়ি পেতে শোনা এই কথোপকথনের মত, গত পাঁচ বছরে আরও গণ্ডা খানেক উদাহরণে ঋদ্ধ হয়ে নিশ্চিত হয়েছি যে, দিল্লীর কনটেম্পোরারি বাঙালি বাপ-মা’রা কদাচিৎ ব্যতিক্রম ছাড়া আর ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বাংলায় কথা বলেন না। আজকাল তো শুনছি কলকাতাতেও বলেন না। গ্লোবালাইজেশনের দুনিয়ায় ক্লাস টু’র বাচ্চা'দের ইংরেজিতে ঢেকুর তোলাটাও নাকি আবশ্যিক। আমরা নেহাতই ওল্ড ফ্যাশানড তাই ক্লাস এইটে প্যাসিভ ভয়েস কে অ্যাক্টিভ করলে ইংরেজি মাস্টার ভালোবেসে একটা চুইনগাম চিবোতে দিতেন। আবেশের বন্ধুদের ইন্টার্ভিউ দেখতে গিয়ে খেয়াল করলাম, কি ঝরঝরে ইংরেজি। কি কেতাদুরস্ত উচ্চারণভঙ্গি। মুখ ফসকেও একটা বাংলা বেরল না। এরা আমার-আপনার মত সাদামাটা বাঙালি নয়, এরা ‘বং’। কলোনিয়াল কালচারের সম্পৃক্ততায় মাতৃভাষা কে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলার প্রবল চেষ্টা এই ‘বং জেনারেশনে’র ট্রেন্ডিং ফ্যাশন। আর অযথা আমেরিকান এসেন্টে ইংরেজি বলাটা এলিটিজম।
    যে ধরনের এলিটিজম আপনি ধরবো ধরবো করবেন কিন্তু ধরতে পারবেন না সেটা 'সোশ্যাল স্ট্যাটাস'। যেমন ধরুন, আইফোন সেভেন। কিম্বা ধরুন, মহারাষ্ট্রের বিজেপি বিধায়কের বৌ'কে জন্মদিনে গিফট করা ৩.৫ কোটির ল্যাম্বোরগিনির গাড়ি। আবার যে ধরনের এলিটিজম আপনার কষ্টকল্পনা'তেও বিলাসিতা সেটা হল 'গ্ল্যামার'। যেমন ধরুন, ফিতুর সিনেমায় চিনার পাতার রঙে ক্যাটরিনা কাইফের চুল রাঙিয়ে দিতে ৫৫ লাখের বাজেট। কিম্বা বিরাট কোহলির প্রতিদিনের ১০ লক্ষ টাকার প্যাকেজ। এই 'সোশ্যাল স্ট্যাটাস' আর 'গ্ল্যামার'র ককটেল যদি সময় মত বগল দাবা করতে পারেন তাহলে আপনি 'সেলিব্রেটি'। আর এদেশের সেলিব্রেটি সত্ত্বা হল দায়িত্ব-কর্তব্য, আইন-প্রশাসন -সবকিছু ফাঁকি দেবার এলিটিজম।
    সংসদের দু-কক্ষ মিলিয়ে সাংসদ'দের উপস্থিতির গড় ৮০.৫%। আর সেলিব্রেটি সাংসদ'দের কিরণ খের ছাড়া বাকি সবার উপস্থিত ৭৫%'র কম। গত চার বছরে অভিনেত্রী রেখার রাজ্যসভায় উপস্থিতি ৫%। বিতর্কে অংশগ্রহণ শূন্য। প্রশ্ন উত্থাপনও শূন্য। এম.এল.এ ফাটাকেষ্টর রুপালি পর্দায় ডায়লগ বাজি করে সততার রুশ বিপ্লব নামিয়ে ফেলা মিঠুন চক্রবর্তীর উপস্থিতি ১০%। কেন্ট আরও'র বিজ্ঞাপনে গোটা দেশের মানুষকে বিশুদ্ধ জল সরবরাহকারী হেমা মালিনীর উপস্থিতি ৩৭%। 'ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান' নিয়ে দেব লোকসভাতে বাংলায় মুখ খুলেছেন ঐ একবারই। আর তাতেই ভাষা আন্দোলনের মর্মন্তুদ ও গৌরবোজ্জ্বল স্মৃতি রোমন্থনের সাব-অলট্রানিসমের আবেগে ধুয়ে গেছে তাঁর মুখে লেগে থাকা লোকসভায় মাত্র ৯% উপস্থিতি'র চুনকালি। সংসদে এনারা সাবডিসাইজড ক্যান্টিনে খাবার খেতে আর শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে হাই তুলতে মোট দুবার মুখ খুললেও, আমাদের ট্যাক্সের টাকা চটকে, মাসের শেষে সাংসদ হবার সমস্ত সুযোগ সুবিধা উদরস্থ করতে কোন কসুরই করেন না। আসলে এদেশে সেলিব্রেটি’দের সাংসদ হওয়া তে কোন দায়বদ্ধতা নেই। আছে একধরনের এলিটিজম। সংসদীয় এলিটিজম।
    ‘ভারতরত্ন’ লতা মঙ্গেশকার ২০০১'এ মুম্বাইয়ের পেদ্দার রোডে তাঁর বিলাসবহুল বাড়ির উল্টো দিকে একটি ফ্লাইওভারের নির্মাণ পরিকল্পনার তীব্র বিরোধিতা করে প্রয়োজনে দেশ ছেড়ে পাকাপাকি দুবাইয়ের বাসিন্দা হবার হুমকি দেন। তড়িঘড়ি ফ্লাইওভার নির্মাণ পরিকল্পনার স্থগিতাদেশ ঘোষণা করে মুম্বাই মিউনিসিপালিটি কর্পোরেশন। আজ অবধি আর শুরু হয়নি সে নির্মাণ। আরেক ‘ভারতরত্ন’ শচীন তেন্ডুলকার, ২০০৩’এ ডন ব্র্যাডম্যানের ২৯'টি সেঞ্চুরির রেকর্ড টপকে, মাইকেল শুম্যাখার কাছ থেকে ইটালিয়ান ফেরারী স্পোর্টস কার উপহার পেয়েই সরকারের কাছে ১.১৩ কোটি টাকা আমদানি শুল্ক ছাড় দেবার অনুরোধ করেন। ২০১১'তে বান্দ্রার ৮০ কোটির অট্টালিকায় আইন বহিৰ্ভূত নির্মাণের অভিযোগও ওঠে লিটিল-মাস্টারের বিরুদ্ধে। আর কিছুদিন আগেও মুসৌরি তে DRDO'র নো-কন্সট্রাকশন জোনে তাঁর বিজনেস পার্টনার সঞ্জয় নারঙ্গর বিরুদ্ধে যে বে-আইনি নির্মাণের অভিযোগ উঠেছিলো, শচীন নিজে মনোহর পারিকরের সাথে দেখা করে তার মধ্যস্থতা করেন। আসলে এদেশের ম্যাচো ম্যানরা থাম্পস আপের বোতলে তুফানি চুমুক দিয়ে হরিণ মেরে, ফুটপাতে গাড়ি চালান। রাতের অন্ধকারে, মানুষ মেরে, প্রধানমন্ত্রীর সাথে নিঃসংকোচে ঘুড়ি ওড়ান। আর এদেশের মুন্নাভাই'রা ঘরে বে-আইনি অস্ত্র রাখার গুরুতর অপরাধ অভিযুক্ত হয়েও বরাদ্দ মেয়াদের আগেই জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। এলিটিজম কি আর শুধু মোকাম্বো'র রেস্টুরেন্টে? এলিটিজম তো এদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে।
    মোকাম্বো'র ঘটনার প্রায় সমান্তরালেই পালিত হল 'ওনাম'। পৌরাণিক বিশ্বাসে, মালায়ালি দলিত রাজা মহাবলীর রাজত্বে নাকি সবার ছিল সমানাধিকার, সব প্রজারা ছিলেন বেজায় খুশি। মহাবলীর প্রতিপত্তিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে, ছলে বলে কৌশলে তাঁকে পরাস্ত করে, নরকে পাঠিয়ে দেন বামনা অবতারে মর্ত্যে অবতীর্ণ বিষ্ণু। গোটা কেরালা যখন এবার 'ওনাম' উপলক্ষে এই মহাবলীর পুনরাবির্ভাব উদযাপনে ব্যস্ত, ঠিক তখনই বামনা অবতারের কল্পিত চিত্র টুইটারে পোস্ট করে 'বামনা জয়ন্তী' পালন করলেন বিজেপি প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ। রাজনীতি ও সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মের সংমিশ্রণে শ্যামলা বর্ণের দলিত রাজার উপর গোরা ব্রাহ্মণ্যবাদের এলিটিজম।
    আসলে কি জানেন, এলিটিজম আমাদের সমাজে, আমাদের রাজনীতি তে। এলিটিজম আমাদের রক্তে। সোশ্যাল মিডিয়া ঝড় তুলে আমার ভেতরের এলিটিজমের ভিসুভিয়াস'টাকে যদি চিরতরে ঘুম পাড়িয়ে দেওয়া যেত, তো বেশ হত। জোমেটো তে রেটিং দিয়েই যদি দেশের সব এলিটিজম এক লহমায় ঝেড়ে ফেলা যেত, তো বেশ হত। কিন্তু কি করবেন বলুন, দিনের শেষে আমরাও তো 'ভদ্রলোক'। আমরা সকালবেলা আনন্দবাজার পড়ি।সন্ধ্যে বেলা অফিস ফেরত মায়ের বাতের ব্যথার ওষুধ কিনি। আর রাতে ফোর্ড আইকনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পরের দিন সকাল বেলায় ভাতের থালায় পালং শাকের অপেক্ষা করি। তাই প্রাণহীন মোকাম্বো’ও এলিটিজম প্র্যাকটিস করে। তাই প্রাণহীন মোকাম্বোর স্টাফ হাউসের এলিটিজম নিশ্চিত করে। কারণ আমরাই এলিটিজম কে ধাওয়া করি। আমরাই এলিটিজম আগলে রাখি। আমরাই মনের মণিকোঠায় এলিটিজমের আকাঙ্ক্ষা কে সযত্নে লালন পালন করি ...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ | ১৪৪১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • cm | 127.247.99.27 (*) | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০১:১৪51764
  • উপযুক্ত উপস্থিতি না থাকলে কলেজে/বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় বসা যায় না তাহলে যথেষ্ট উপস্থিতি না থাকলে এদের সাংসদের পদ খোয়া যাবেনা কেন?
  • ranjan roy | 132.162.177.26 (*) | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০২:০৯51765
  • দরকারি লেখা, সঠিক প্রেক্ষিতে।
  • Babulal | 174.100.41.2 (*) | ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৭:২৪51763
  • অসাধারণ লেখা।
  • PT | 213.110.242.4 (*) | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৪:৩০51768
  • "আসলে এদেশে সেলিব্রেটি’দের সাংসদ হওয়া তে কোন দায়বদ্ধতা নেই।"
    যারা এদের ভোট দিয়ে দিল্লী পাঠায় তাদের নিজেদের ভোটটির প্রতি কোন দায়বদ্ধতা আছে?
  • Nirupam Sarkar | 84.92.34.53 (*) | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৫:৫০51769
  • খুব ভালো লিখেছেন। আমি মনে করি, ৩৪ বছর বাম সরকারের শিখ্শা ব্যবস্থা এর জন্যো দায়ি। আপনি কি করেন?
  • ranjan roy | 132.162.175.132 (*) | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৫:৫৪51770
  • দিল্লি বা সর্বভারতীয় এলিটিসিজমের মধ্যে বাম সরকারের শিক্ষা ব্যব্স্থা কেং করে এলো?
    আর ইংরেজিনবীশ হওয়া তো একটা অ্যাসপেক্ট মাত্র, লেখাটার আসল তীর তো এলিটিসিজমের দিকে।
    লতা মঙ্গেশকর, সচিন, সলমান এরা বাম সরকারের শিক্ষা ব্যব্স্থায় পড়াশুনো করেছিলেন নাকি?
  • PT | 213.110.242.4 (*) | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৫:৫৬51771
  • রেখা-জয়া-হেমা-চিরন্জিবী-আজারুদ্দিন ইত্যাদিদের দিল্লীর দরবারে যাওয়ার জন্যেও কি ৩৪ দায়ী?
  • ছোটোলোক | 198.155.168.109 (*) | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০৬:৪৮51766
  • পড়লাম। ভাল লেগেছে।
  • অনামী | 170.62.7.250 (*) | ২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১০:১২51767
  • একদম! বুলস আই!
  • Sushovan Patra | 206.1.105.91 (*) | ২৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ১০:৫০51772
  • এলিটিজম বামপন্থী'দের মধ্যেও আছে। আমার নিজের মধ্যেও আছে। লেখাতে সেকথাও অস্বীকার করা হয়নি। ৩৪ বছরে এলিটিজম দূর করা একটা সমাজ যদি বাংলা'তে গড়া যেত ভালোই হত। সেদিক দিয়ে কিছু দায় অবশ্যই বর্তায়। কিন্তু সামাজিক পরিস্থিতি, গোটা দেশের এবং বিশ্বের আর্থিক অবস্থার কথা অবহেলা করে যদি ৩৪ বছরের উপর দায় ঝেড়েই অবস্থার পরিবর্তন হত তবে ভালোই হত ।
    তবে একটা কথা , আর যাই হোক সাংসদ দের সংসদে উপস্থিতি, প্রশ্ন উত্থাপন এবং বিতর্ক অংশগ্রহন নিয়ে বামপন্থী'দের বিরুদ্ধে কথা বলার জায়গা বিশেষ নেই। ৩৪ বছরের আগেও কিংবা পরেও।
  • রৌহিন | 37.63.187.176 (*) | ০১ অক্টোবর ২০১৬ ১১:২৭51773
  • বস্তুত ভাবছিলাম, এই যে ডোনাল্ড ট্রাম্পের এত বাড়বাড়ন্ত, গ্রীসের অর্থনৈতিক সঙ্কট কিম্বা রিয়াল মাদ্রিদ হেরে গেল, এর জন্য কি ৩৪ বছরই দায়ী নয়? ভামেরা কী বলেন?
  • Sushovan Patra | 55.125.63.46 (*) | ০৬ মে ২০১৭ ০১:১৯51774
  • আইজাক স্যার বলেছেন, ‘বাইরের থেকে বল প্রয়োগ না করলে, স্থির বস্তু চিরকাল স্থির এবং গতিশীল বস্তু চিরকাল গতিশীল থাকবে’। আর বাজারে না খাটিয়ে, ব্যবসা তে না লাগিয়ে ঘরে পুঁতে কিম্বা তোয়ালা মুড়ে লুকিয়ে রাখলে কালো টাকাও চিরকাল কালোই থাকবে। স্থিরই থাকবে। ধারে, ভারে তো বাড়বেই না, বরং মুদ্রাস্ফীতির কালগর্ভে আজকের ষোলআনা দু'দিন পরে বারো আনা হয়েও আপনার কপালে নাচতে পারে। আজ থেকে দেড়শো বছর আগে অর্থনীতির এই মৌলিক সত্যটা অনুধাবন করেই ঐ দাড়িওয়ালা বুড়োটা লিখেছিলেন, ‘পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজি জমিয়ে নয় বরং বাজারে খাটিয়েই মুনফা লাভ হয়।’ এই জন্যই দেশের কালো টাকার বেশির ভাগটা আজ সিনেমার চিত্রনাট্যের শেষ দৃশ্যের রহস্য উন্মোচনের জন্য কোন ভিলেনের ঘরের নিচে লোকানো নেই। বরং আছে একেবারে আপনার চোখের সামনে। আছে রিয়েল এস্টেট বিজনেসের ইটে, আছে সিমেন্ট গাঁথা অট্টালিকা সেজে, আছে নিউক্লিয়ার ডিলের আস্থা ভোটে বিরোধী সাংসদ কিনে সরকার বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে, আছে বাংলার মানুষের নির্বাচিত পঞ্চায়েত ভেঙ্গে দেবার শাসক দলের ব্রহ্মাস্ত্র হয়ে, আছে নেত্রীর আঁকা ছবি ১ কোটি ৮৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে পার্টি তহবিলে পৌঁছে দেবার কৌশল হয়ে, আর আছে ‘হাওলা’র মত কতশত চ্যানেলে ঘুরে বিদেশের ব্যাঙ্কে জমা হয়ে।
    কালো টাকা মানে শুধু লুকানো টাকার জমে থাকা ভাণ্ডার নয়। কালো টাকা মানে যেকোনো কর ফাঁকি। কালো টাকা মানে যেকোনো অনুমোদিত সীমার বাইরে লেনদেন। ঐ যে মেজিয়ার কয়লা খাদানে ১০০টন কয়লা তুলে খাতায় কলমে ৮০টনের হিসেব দেখালেন -কালো টাকা। পুলিশ কে ঘুষ দিয়ে নদী থেকে দু গাড়ি বালি বেশী তুললেন -কালো টাকা। কালীঘাটের জাগ্রত দেবী কে সন্তুষ্ট রাখতে ভাইদের তোলা দিলেন -কালো টাকা। পার্টি ফান্ডের ১লক্ষর অনুদানে কুড়ি হাজারের রশিদ কাটলেন –ওটাও কালো টাকা। আসলে কালো টাকায় কোন কালো দাগ নেই, আইডেন্টিটি ফিকেশন মার্ক নেই। তাই আপনি হয়ত কালো টাকা দেখছেন প্রতিদিন, হাতেও নিচ্ছেন প্রতিদিন, কিন্তু চিনতে পারছেন না।
    আনুমানিক ভাবে, ওয়ার্ল্ড ব্যাঙ্ক রিপোর্ট এবং কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রকের ৮ তারিখের প্রেস বিবৃতি অনুসারে দেশের মোট কালো টাকা পরিমাণ দেশের জি.ডি.পি‘র এক চতুর্থাংশের সমান। অর্থাৎ ২০১৫’র পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের জি.ডি.পি যদি হয় ১২৬.৫ ট্রিলিয়ন, তাহলে ঐ সরল ত্রৈরাশিকেই কালো টাকা ৩৫ লক্ষ কোটি। এখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কের ২০১৫-১৬’র বার্ষিক রিপোর্ট অনুযায়ী বাজারে নগদ ৫০০ টাকার নোট রয়েছে ১৬৫০ কোটি। আর ১০০০ টাকার নোট ৬৭০ কোটি। যার সম্মিলিত অর্থমূল্য ১৭ লক্ষ কোটির একটু বেশী। সেই টাকারও এক চতুর্থাংশ কালো টাকা ধরে সহজ হিসেবে কষলে, এই নোট বাতিল করার সিদ্ধান্তে সর্বোচ্চ ৪ লক্ষ ২৫ হাজার কোটির কালো টাকা উদ্ধার হতে পারে। আবার ৫০০ বা ১০০০ টাকার নোটের মাধ্যমে বাজার থেকে তুলে নেওয়া অর্থের সম পরিমাণ অর্থ ২০০০ টাকার বা ৫০০ টাকার নতুন নোট ছেপে বদলে ফেলার খরচাও প্রায় ১২ হাজার কোটি। সুতরাং, সবের ধন নীলমণি হয়ে পড়ে রইলো আনুমানিক ৪ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি। যা দেশের মোট কালো টাকার মাত্র ১৩%। বাকি ৮৭% কিন্তু যেমন ছিল তেমনই রইলো। রইলো ২৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কে বৃহৎ কর্পোরেট'দের বকেয়া ১.১৪ লক্ষ কোটি টাকার অনাদায়ী ঋণে, রইলো রেভেনিউ ফোরগেনে’র নামে প্রতিবছর বিগ বিজনেস হাউসগুলোকে ছাড় দেওয়া কর্পোরেট ট্যাক্সে, রইলো আর্থিক কারচুপি করে লন্ডনে বসে থাকা বিজয় মালিয়া, ললিত মোদী’দের পকেটে, আর রইলো সুইস ব্যাঙ্কের অ্যাকাউন্টে।
    এই সত্যিটা প্রধানমন্ত্রীও বিলক্ষণ জানেন। আর জানেন বলেই, ২০১৩’তে গোয়ার বিলাসবহুল হোটেলে বিজেপি’র পার্লামেন্টারি বোর্ডের মিটিং-এ প্রধানমন্ত্রী পদের মনোনয়ন পেয়েই তিনি টুইট করেছিলেন “দেশের একটা বাচ্চা ছেলেও জানে কালো টাকা আছে সুইস ব্যাঙ্কে। আমাদের কি সেটা ফিরিয়ে আনা উচিত নয়?” প্রধানমন্ত্রী বিলক্ষণ এটাও জানেন যে শুধু নোট বাতিলের সিদ্ধান্তে সেই সুইস ব্যাঙ্কের এক ছটাক টাকাও দেশে ফিরে আসবে না। দীর্ঘসময়ের প্রেক্ষাপটে কালো টাকার রমরমাও ম্লান হবে না। আসলে নোট বাতিল তো ১৯৪৬’এ কিম্বা ১৯৭৮’র জানুয়ারি'তেও হয়েছিল। কিন্তু কালো টাকা’র এই বাড়বাড়ন্ত থামেনি। বরং অর্থনীতির বেহাল অবস্থার খেসারৎ চুকিয়ে পরের সাধারণ নির্বাচনে গো-হারা হয়েছিলো মুরাজি দেশাই’র জনতা সরকার।
    তবুও বেশ হয়েছে নোট গুলো সব বাতিল হয়েছে। আমাদের দু-একদিনের কষ্টে যদি দেশের প্রাসাদসম কালো টাকার কিঞ্চিতও ফিরে আসে, তাহলে না হয় তাই আচ্ছা। গোরু তে ৮০% মানুষের জিন খোঁজা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী একদিন যদি জাল নোটের ব্যাপারীদের খুঁজতে বসেন, তাহলে তাই আচ্ছা। ‘মন্দির ওহি বানায়েঙ্গে’র চ্যাংড়ামি করা হিন্দু নেতা, আর তিন তালাকের সমর্থনে ভাষণবাজি করা মৌলবি গুলো যদি একদিন ব্যাঙ্কের লাইনে গা ঘেঁষে রিকুইসিট ফর্ম ভরেন, তো তাই আচ্ছা। অ্যালিস্টার কুকের টিমের বিরুদ্ধে জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিশোধে উদ্যত গোটা দেশবাসী একদিন যদি রাজনৈতিক দল গুলোর আয়ের উৎস জানতে চেয়ে বসে, তাহলে তাই আচ্ছা। কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শত নামজপা ছেড়ে একদিন যদি নিতাই মেলায় অর্থনীতির তর্কের তুফান ওঠে, তো তাই আচ্ছা। কালো টাকার ‘হ্যাভ আর হ্যাভ নটসে' দেশটা যদি একদিন আড়াআড়ি ভেঙ্গে পড়ে, তাহলে তাই আচ্ছা। মানুষ যদি ভাবতে শেখে ধর্মের বিভেদ নয় তাঁদের এক সুতোয় বেঁধেছে তাঁদেরই পেটের খিদে, তাহলে তাই আচ্ছা। এই সংখ্যালঘু শাসকদের সঙ্গে সংখ্যাগুরু শোষিত মানুষ গুলোর একদিন...একদিন যদি ‘ভীষণ রাগে যুদ্ধ বাঁধে’, তাহলে না হয় তাই আচ্ছা। সেদিন নাজিবরা আর ২৮ দিন ধরে নিখোঁজ থাকবেনা সেনোরিটা, সেদিন হয়ত নোট বাতিলের সিদ্ধান্তের প্যানিকে প্রত্যন্ত গ্রামের তীর্থরাজিরা আর মরবে না সেনোরিটা , সেদিন হয়ত “বড়ে বড়ে দেশো ম্যা অ্যাসি ছোটি ছোটি বাত” আর একটাও হবে না সেনোরিটা…
  • Sushovan Patra | 55.125.63.46 (*) | ০৬ মে ২০১৭ ০১:২৪51775
  • ভুল করে আগের লেখাতে কমেন্ট হিসেবে পরের লেখাটা দেওয়া হয়ে গেছে। দুঃখিত।
  • ৩৪ | 206.54.55.10 (*) | ০৬ মে ২০১৭ ০৩:০১51776
  • হু ওয়াজ বামফ্রন্ট?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। না ঘাবড়ে মতামত দিন