এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • মন্টু অমিতাভ সরকার

    Kallol Lahiri লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২০ এপ্রিল ২০১৭ | ১৪৫২ বার পঠিত
  • পর্ব-১

    মন্টু ছুটছিল।
    যেভাবে সাধারণ মানুষ বাস ধরার জন্যে ছোটে তেমনটা নয়।
    মন্টু ছুটছিল।
    যেভাবে ফাস্ট বোলার নিমেষে ছুটে আসে সামনে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থাকা প্রতিপক্ষের পেছনের তিনটে উইকেটকে ফেলে দিতে তেমনটা নয়।
    মন্টু ছুটছিল।
    যেভাবে সাইকেল চালানো মেয়েটার হাতে প্রথম প্রেমের চিঠিটা ধরিয়ে দিতে হয় তেমনটা নয়।
    মন্টু ছুটছিল।
    ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে সিরিয়াস পেশেন্টকে ভর্তি করানোর জন্য যেভাবে ডাক্তারের সন্ধানে দৌড় দিতে হয় তেমটা নয়।
    আসলে মন্টু ছুটছিল পেছন থেকে ঠিক পিঠ বরাবার এগিয়ে আসা বুলেটটাকে এড়াতে। হৃৎপিন্ডটাকে এফাল ওফাল করার আগে পর্যন্ত মন্টু ছুটছিল। আর তার মনে পড়ে যাচ্ছিল...
    আদিগন্ত একটা ধান ক্ষেত।
    তালগাছে একটা হুতুম পেঁচার বাসা।
    বিশ্বকর্মা পুজোয় একতে ঘুড়ির মার কাট্টা প্যাঁচ।
    চ্যাটচেটে ঘেমো দুপুরে নুন শোয়ের দুটো টিকিট।
    বাবার হাত ধরে প্রথম সমুদ্রের জলের নোনা স্বাদ।
    নীল জলে মাখামাখি।

    মন্টু নীল জলের ঢেউয়ে স্নান করছিল। তার চার পাশে ভরে উঠছিল লাল রঙের একটা নিশান। আসলে মন্টু একটা সুইমিং পুলের মধ্যে ভেসে বেড়াচ্ছিল। তার চারপাশের স্বচ্ছ স্ফটিক নীল সাদা জল লাল হয়ে উঠছিল তারই ফুসফুস বিদীর্ন রক্তে।

    ঠিক সেই সময় মন্টু স্বপ্ন দেখতে চাইছিল বাঁচার। ঘ্রাণ নিচ্ছিল রক্তের। শ্বাস নালী ভর্তি হয়ে উঠছিল গর্ভস্থ থাকার সময়ে মুখের মধ্যে জমে থাকা নবজাতকের শ্লেষায়। আসলে মন্টু জন্ম নিচ্ছিল একটা পেয়ারা গাছের নীচে। ধাত্রী মা চেপে ধরেছিল কিছুটা বেরিয়ে আসা তার মাথার অংশটা। আর সেই কবেকার, কোন যুগের পৃথিবীর গভীর রক্তের উচাটন থেকে...গর্ভের অন্তর্লীন অন্ধকার জগত থেকে আস্তে আস্তে একটু একটু করে মন্টুর সামনে উঁকি দিচ্ছিল রাতের আঁধারে তারায় ভরা এক আকাশ। মন্টু চমৎকার একটা চিৎকার করেছিল।

    বুলেটটা ঠিক তার পিঠ বরাবর গেঁথে যাওয়ার পর।চ
    প্রথম প্রেমের চিঠির উত্তর আসার পর...
    জীবনে প্রথম ব্ল্যাক টিকিটে সিনেমা দেখার আনন্দে...।
    শরীরে প্রথম যৌন অনুভূতি আবিষ্কারের মুহূর্তে।
    একটা শহরের রাজা হওয়ার পর।

    সেই চিৎকারের রেশ ছড়িয়ে পড়ছিল এক দামী সংবাদ পত্রের অফিসে। পৃথিবীর চারপাশে ঘূর্ণায়মান স্যাটেলাইটের মধ্যস্থতায়। আরো জটিল বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক দৃশ্য ও শব্দ তরঙ্গের মাধ্যমে ছোট্ট একটা ভিডিয়ো টেপে...এক সাংবাদিকের ক্যামেরা থেকে।

    “নীলাভ আপনি শুনতে পাচ্ছেন কী? আমি দাঁড়িয়ে আছি শহরের এক ফাইভস্টার হোটেলের চোদ্দ তলার সুইমিং পুলের ধারে...। নীলাভ আপনি দেখতে পাচ্ছেন কি? আমার সামনে জলের ওপরে চিৎ হয়ে ভাসছে এই শহরের মোস্ট ওয়ান্টেড ক্রিমিনাল মন্টু...ওরফে অমিতাভ...ওরফে সরকার...”।

    নীলাভ ঠিক শুনতে পাচ্ছিল কিনা বুঝতে পারছিলো না ওরা কেউ। নীলাভ ঠিক দেখতে পাচ্ছিল কিনা ঠাহর করতে পারছিলো না ওরা কেউ। ওরা আরো তাড়ায় ছিল আকাশের মাঝামাঝি হাল্কা বাতাসের স্তরটাকে ধরার জন্যে। ওখানে ওদের উড়তে সুবিধে হয়। ওখানে উড়লে বাইপাসের পাশে কিম্বা রাজারহাটের দিকে এখোনো জেগে থাকা দু-একটা মরা ক্ষেতের সন্ধান পাওয়া যায়। ছোট ছোট ইদুর গুলো এখোনো খাবারের সন্ধানে মরা ক্ষেতের মাঝে হা-হুতাশ করতে বেরোলে সেই হাল্কা বাতাসের স্তর থেকে সহজেই উড়ে এসে ছোঁ-মারা যায়। ভোরের অনেক আগে বাসায় ফেরা যায়, যে বাসা তাদের দিয়েছে এক নাগরিক লাঞ্ছনা। গাছের বদলে দশতলার চিলে কোঠার এক ফাঁকা কোঠর। যে কোঠর বানানো হয়েছে মন্টুরই সাপ্লাই করা ইঁট, বালি, সিমেন্টে। তাই সত্যিই সেই ভুতুম পেঁচার দলটার একটুও অবকাশ ছিল না মন্টুর দিকে ফিরে দেখার। যদিও সবচেয়ে কাছের দূরত্ত্বে ছিল তারাই। জন্মের সময়ে...রাজা হওয়ার দিন গুলোতে...মৃত্যুর পরেও।

    মন্টু তখোনো জানতো না মাতৃ গর্ভের ওম থেকে বেরিয়ে এসে সে এক তারায় ভরা আকাশ দেখতে পাবে। মন্টু তখোনো জানতো না গভীর রাতের অন্ধকারে গাছের সবুজ পাতাকে দেখায় কালো। মন্টু তখোনো জানতো না তার জন্মানোর কিছুক্ষণ পরেই আকাশবানী কোলকাতা থেকে খবর পড়বেন বরুণ মজুমদার। মন্টু তখোনো জানতো না সে এক ঐতিহাসিক সময়ের সাক্ষী। মন্টু তখোনো জানতো না স্বাধীনতার আঠাশ বছর পরে দেশে এই প্রথম জারী হচ্ছে জরুরী অবস্থা। মন্টু তখোনো জানতো না এই নতুন জন্ম তাকে ফিরে দেখতে হবে আরো অনেক বছর পরে কোনো এক পাঁচতারা হোটেলের সুইমিং পুলে। তারই ফুসফুসের রক্তেভেজা নীল-সাদা স্ফটিক জলে।

    মন্টু ওরফে অমিতাভ ওরফে সরকার এখন একটা ফাইল। সেই হলদেটে ক্ষয়াটে ফাইলটা পড়ে আছে তেত্রিশ নম্বর টেবিলের দুই নাম্বার ড্রয়ারে। ওই ফাইলটা খোলা হবে না আর কোনোদিন। খোলা হবে না কারণ ওই ফাইল না খোলার জন্য অনেক নোটের তাড়া জমা পড়েছে বিভিন্ন দফতরে। অনেক লোকের মুখ বন্ধ করা হয়েছে গুম করে, না করে, অনিশ্চয়তার অন্ধকার দেখিয়ে। যে ক্যামেরা সেদিন সেই তারায় ভরা আকাশে সুইমিং পুলের রক্তে ভেজা জলে মন্টুর চিৎ হয়ে সাঁতার কাটার ছবি তুলেছিল; আজ, এখন এই মুহূর্তে সে শহরে একটা শ্যুটিং এর মহরত তুলতে ব্যাস্ত। রাস্তায় তিল ধারণের জায়গা নেই। জ্যাম জটে শহর নাজেহাল। নতুন সরকার কলকাতাকে প্রোমোট করছেন। তাই উড়ে এসে জুড়ে বসলে কলকাতায় সব ফ্রি। কলকাতার নগর...রাস্তাঘাট...কলকাতার ঝাঁ চকচকে কর্পোরেট জীবন...কলকাতার রসগোল্লা...কালীঘাট...মাদার টেরেসা...সত্যজিৎ... বাস স্ট্যান্ড...সবটাই এখন ছবির ফ্রেম। বোম্বের পরিচালক হাত দিয়ে দিয়ে ক্যামেরার সেই অদৃশ্য ফ্রেমটাকেই নিরূপণ করার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু কোথা থেকে তার হাত গলে যে মন্টু ঢুকে পড়ল তিনি নিজেও বুঝতে পারলেন না।

    আর ঠিক সেই সময়ে সাদা পর্দায় ভেসে উঠলো অমিতাভ।
    একটা ভাঙা সিনেমা হল।
    একটা লু লাগা দুপুর...।
    মিঠাই বরফ...।

    পরিচালক চিৎকার করে বলে উঠলেন এ্যাকশান। রাস্তার ধারে ভিড়ে ঠাসা জনতা দেখলো ঝাঁ-চকচকে শহরের ফিটফাট রাস্তায় সাইকেল চালাচ্ছেন অমিতাভ। যে রাস্তার ইঁট...বালী...সিমেন্ট...পিচ...খোয়া...সাপ্লাই করেছিল মন্টু...।
    যে একদিন স্বপ্ন দেখেছিল সে হবে এই শহরের ‘মন্টু ওরফে অমিতাভ ওরফে সরকার’...।

    (পরের সপ্তাহে...)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২০ এপ্রিল ২০১৭ | ১৪৫২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • pi | 57.29.243.26 (*) | ২৩ এপ্রিল ২০১৭ ০৪:১৬59507
  • অন্যরকম।
    পরের পর্বের অপেক্ষায় ...
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। সুচিন্তিত প্রতিক্রিয়া দিন