এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • পরনিন্দা পরচর্চা ও ভাষার জন্ম

    Tathagata Dasmjumder লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৬ জুন ২০১৬ | ২৪৭৩ বার পঠিত
  • পিনপিসি খুব নিন্দনীয় জিনিস, পিএনপিসি যে করে তার পেছনে আমরা পিএনপিসি করে থাকি যে ওমুক খুব পিএনপিসি করে। ভারতীয় সোপ অপেরাগুলি মূলত পিএনপিসির আখড়া বলে শিক্ষিত সমাজের চক্ষুশূল ( যদিও দুর্জনে ও টিআরপি বলে যে অনেকেই আড়ালে দেখে থাকেন)। পিএনপিসি না থাকলে, পরচর্চা না হলে আদর্শ সমাজ গড়ে উঠতে বেশি সময় লাগবেনা এই দাবী অনেকেই করেন। কিন্তু, পিএনপিসি কি সত্যিই এত খারাপ?
    ১৯৯৬ সালে ব্রিটিশ নৃতত্ত্ববিদ রবিন ডানবারের একটি বই প্রকাশিত হয়, নাম "Grooming, Gossip and the Evolution of Language"। তাঁর মতে শিম্পাঞ্জী সমাজের এই সামাজিক রূপচর্চা যা সম্ভবত মানুষের পূর্বপুরুষদের মধ্যেও ছিল, সেটাই বিবর্তিত হয়ে ভাষার রূপ নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ভাষার উদ্ভবের সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল গসিপ বা পরনিন্দা পরচর্চা।
    আশ্চর্য লাগছেনা শুনে? কিন্তু এই প্রকল্পটি কিন্তু বেশ কিছু প্রমাণের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে।
    প্রাইমেটদের মস্তিষ্কের আয়তনের সাথে তাদের গোষ্ঠীর আকারের একটা গভীর সম্পর্ক লক্ষ্য করা গেছে। মানে, মস্তিষ্কের আয়তন যত বাড়বে, গোষ্ঠীর আকারও ততই বাড়বে। কারণটা আর কিছুই না, বড় গোষ্ঠীকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য বুদ্ধিবৃত্তি তথা সামাজিক স্কিল অনেক বেশি দরকারী হয়ে পড়ে, সেখানেই বড় মস্তিষ্কটি কাজে আসে।
    শিম্পাঞ্জীদের এক একটি গোষ্ঠীতে ৫০-৫৫ জনের বেশি সদস্য সাধারণত থাকেনা। এবারে ৫০-৫৫ জন সদস্যের একটি গোষ্ঠীকে যদি সংঘবদ্ধ থাকতে হয় তাহলে পারস্পরিক সম্পর্কগুলোকে ঝালিয়ে নেবার জন্য উকুন বাছা ও পিঠ চুলকানোর দরকার হয়। মানেটা এরকম, আমি তোমার পিঠ চুলকাবো, তুমিও আমার পিঠ চুলকাবে, বিপদ এলে আমি তোমাকে সাহায্য করব, তুমিও আমাকে সাহায্য কোর।
    এবারে আসা যাক মানুষের কথায়, মানুষের মস্তিষ্কের আয়তন যা, তাতে একটি গোষ্ঠীতে ১৫০-২০০ সদস্য থাকতে পারে। এত বড় গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে পিঠ চুলকানোটা খুব সমস্যাজনক হয়ে পড়ে আরকি। শেম্পাঞ্জিরা দিনের প্রায় ২২ শতাংশ সময় এই পুঠ চুলকোতেই কাটিয়ে দেয়। মানুষের ক্ষেত্রে ১৫০-২০০ জনের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ় করার জন্য যদি পিঠ চুলকানোই একমাত্র উপায় হত তাহলে দিনের প্রায় ৪২ শতাংশ সময় পিঠ চুলকোতেই ব্যয় করতে হত। এবারে আদিম মানুষের দিনের ৪২ শতাংশ সময় পিঠ চুলকোতে চলে গেলে খাদ্য সংগ্রহই বা হবে কখন আর অস্ত্র তৈরিই বা হবে কখন? তাহলে উপায়? ডানবার সাহেবের মত হল ফিজিকাল গ্রুমিংএর পরিবর্তে ভোকাল গ্রুমিং।
    ফিজিকাল গ্রুমিং বা পিঠ চুলকানোর ফলে আমাদের শরীরে কিছু ন্যাচারাল ওপিয়েটের (এন্ডরফিনস) ক্ষরণ হয় যেগুলো আমাদের সুখানুভূতি দেয়, ঠিক সেরকম ওপিয়েটের ক্ষরণ হয় হাস্যময় মুখ দেখলে। হোমো হ্যাবিলিস ও হোমো রুডলফেনসিসদের সময় থেকেই মানুষের গোষ্ঠীর আকার এতটাই বড় হয়ে যাচ্ছিল যে (তখনও দেড়শ না হলেও, একশর কাছাকাছি) ফিজিকাল গ্রুমিং বা পিঠ চুলকানোর জন্য ত্রিশ শতাংশের বেশি সময় দেবার প্রয়োজন হয়ে পড়ছিল। ডানবারের মতে ঠিক এসময় থেকেই পিঠ চুলকোনোর স্থান নিতে শুরু করে ভোকাল গ্রুমিং। প্রাইমেটদের মধ্যে পরস্পরের সাথে সংযোগের জন্য নানারকম আওয়াজ (contact calls) করার প্রবণতা দেখা যায়, এতে দুটো সুবিধা,
    এক) পিঠ চুলকানোর মত সময়সাধ্য নয়
    দুই) একসাথে অনেককে জানানো যায়
    একেই ডানবার সাহেব বলছেন grooming at a distance। প্রথমদিকের এই ভোকাল গ্রুমিং সম্ভবত ঠিক ভাষা হিসেবে গড়ে ওঠেনি, বরং তা ছিল সঙ্গীতের মত (গেলাদা বাঁদররা অনেকটা এরকম যৌথ সঙ্গীত করে থাকে) যা কিছুটা হলেও ফিজিকাল গ্রুমিংএর জন্য কিছুটা হলেও সময় কমিয়ে দেয় কারণ এধরণের সাংগীতিক কার্য্যে একসাথে অনেকের সাথে বন্ডিং তৈরি করতে পারে অনেক কম সময় ব্যয় করে।
    এবারে কথা হল গসিপ বা পিএনপিসি এল কিকরে এর থেকে? মানবমস্তিষ্কের আকার যত বাড়তে লাগল, গোষ্ঠীর আকারও তত বাড়ল, এবারে এত বড় গোষ্ঠীকে সংহত রাখার জন্য আরো এফিশিয়েন্ট সোশ্যাল গ্রুমিংএর দরকার হয়ে পড়ল। সেখানেই পিএনপিসির প্রবেশ। বড় আকারের মস্তিষ্ক মানে শিশুর মস্তিষ্কের আকারও বড়, সেকারণেই মানবশিশু জন্মের পরে একেবারে অসহায় থাকে, বছরখানেক বয়সের আগে হাঁটতে পর্যন্ত সক্ষম হয়না। এরকম পরিস্থিতিতে মায়েদেরকে শিশুকে দেখাশোনার জন্য অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হত, যার ফলে অনেকটা সময় তাঁদের একজায়গায় কাটাবার দরকার হয়ে পড়ে আর সেই সাথে জরুরী হয়ে পড়ে অন্য মায়েদের সাথে সম্পর্ক জোরদার করার। আর সম্পর্ক জোরদার করার জন্য দরকার ভোকাল গ্রুমিং। যা ছিল সাংগীতিক শব্দ, ধীরে ধীরে তাতে আসতে শুরু করল সামাজিক তথ্যের আদানপ্রদান, আর তা হল হাসিঠাট্টার ছলে (যার ফলে ওপিএট ক্ষরণ বেড়ে সুখানুভূতি তৈরি হয়)। ও বেশি গাছপালার খবর রাখে, এ ভাল শিকার করে, ওর বাচ্চাটা খুব দুর্বল, ওর পার্টনার ওর খুব যত্ন নেয়। এইরকমের দৈনন্দিন তথ্যের আদানপ্রদানই জন্ম দেয় প্রথম গসিপ বা পিএনপিসির। এই পিএনপিসি কিন্তু syntactic language যা আমরা ব্যবহার করি সেরকম ছিলনা, বরং সেখানে একটা শব্দ হয়ত একটু পুরো ঘটনার বর্ণনা করত। এই পিএনপিসি মায়েদের থেকে সঞ্চালিত হয় সন্তানদের মধ্যে, যার থেকে ধীরে ধীরে ভাষার জন্ম।
    ডানবার সাহেবের এই তত্ত্ব নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে, অনেক মতবিরোধ। কিন্তু এই প্রথম কেউ পিএনপিসিকে তাচ্ছিল্য না করে মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার একটা প্রধান কারণ হিসেবে দেখেছেন।
    যাঁরা তার পরেও পিএনপিসি বা গসিপকে তাচ্ছিল্য করতে চান, তাঁদের জন্য একটা ছোট তথ্য দি, বড় বড় গম্ভীর সেমিনারে পর্যন্ত মাত্র পঁচিশ শতাংশ সময় আসল কাজে ব্যয় হয়, বাকিটা সময়? গসিপ আর পিএনপিসি চলে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৬ জুন ২০১৬ | ২৪৭৩ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ভুল - Tathagata Dasmjumder
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শান্তনু কুমার দাশ | 11.39.57.10 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ০১:৫৪55083
  • দারুন লেখা । এইভাবে আরো এগোনো যায়না? মানে গোষ্ঠী তো জাতীয়তার মিনিয়েচার । জাতীয়তা ধর্মীয় ভাষাগত বা অঞ্চলভিত্তিক সম্প্রদায় ইত্যাদির বিবর্তন বা মেকানিসম নিয়ে আরো চর্চা করা যেতে পারে । অনেক সমস্যার সমাধান সূত্র বেরোতে পারে ।
  • Abhyu | 138.192.7.51 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ০৫:২৯55084
  • অতি ভালো লেখা। শেষটা তো বটেই!
  • ranjan roy | 24.98.209.127 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ০৬:১৪55085
  • সিমপ্লি অসাঃ)))
  • d | 144.159.168.72 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ১২:২৭55081
  • বোঝো!
  • sinfaut | 11.39.13.24 (*) | ১৬ জুন ২০১৬ ১২:৫১55082
  • দারুন।
  • Tathagata Dasmjumder | 37.63.189.63 (*) | ২০ জুন ২০১৬ ০৮:২৪55086
  • ধন্যবাদ যাঁরা পড়েছেন, তবে ডানবারের গসিপ থিওরির রেফ্যুটেশন নিয়ে এখানে আলোচনা হলে ভাল লাগবে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। বুদ্ধি করে প্রতিক্রিয়া দিন