এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ধিন-তা-ধিনা, পাকা নোনা - এ ডিটেকটিভ স্টোরি - ২০১০

    Ranjan Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৭ মে ২০১৬ | ১৭৪১ বার পঠিত
  • ধিন-তা-ধিনা, পাকা নোনা—A Detective Story.
    -----------------------------
    ( ডিঃ কোন রাজনৈতিক দল বা ব্যক্তিকে আহত করা উদ্দেশ্য নহে, কোন চরিত্রের সঙ্গে মিল প্রতীত হইলে উহা নেহাৎই কাকতালীয়।)

    ১)
    মহাশিবরাত্রির সকাল। রায়পুর শহরের ফুলচৌক থেকে আর গাড়ি এগুতে পারছে না। বিশাল ট্র্যাফিক জ্যাম। পাঁচটাকা ভাড়ার সওয়ারি অটোতে মাঝবয়েসি ভদ্রলোক খিঁচিয়ে ওঠেন।
    --- কি মুশকিল! আমাকে রোগীর খাবার নিয়ে সরকারী হাসপাতাল যেতে হবে। পেশেন্ট সার্জিক্যাল ওয়ার্ডে, আজ জেনারেল ওয়ার্ডে দেবে। তার আগে আমাকে বিল ক্লিয়ার করতে হবে। আর আমি গেলে তবে তো রাত্তিরের ডিউটি করা বন্ধুটি রিলিফ পেয়ে বাড়ি যাবে। এইটুকু রাস্তা যেতে আর কতক্ষণ লাগাবে?
    এবার টিউটোরিয়ালের জন্যে বেরুনো দেখনসুন্দরী মেয়েটি বলে
    -- আমিও আধা ঘন্টা লেট্‌। কি যে করি?
    এবার রোগাটে টাকমাথা আধবুড়ো মারাঠি ভদ্রলোক বকের মত গলা লম্বা করে অটো ড্রাইভারকে বলেন--- কি হল? কিছু বুঝতে পারলে?
    --- মহাশিবরাত্রি কা জুলুস হ্যায় কাকা, শঙ্কর সেনা কা। টাইম তো থোড়া লগেগা জী।
    রোগীর বাড়ির ভদ্রলোক এবার খিঁচিয়ে ওঠেন-- আগে জানলে কে তোমার অটো তে চড়ত? অন্য কোন রাস্তা দিয়ে ঘুরিয়ে নিয়ে যেতে পারো না!
    ড্রাইভার নির্লিপ্ত ভাব দেখায়।
    --কি করে জানেন না মশায়? শঙ্কর সেনার যে মহাশিবরাত্রির দিন বিশাল ভব্য জুলুস বেরুবে সেটা তো গোটা শহর জানে। এতো প্রতিবছরের ব্যাপার। কৌন সী নয়ী বাত! কিন্তু এবার তো আগে থেকেই বড় বড় হোর্ডিং লাগিয়ে শহরবাসীকে জানানো হয়েছে।
    ফুলচৌক, জয়স্তম্ভ চৌক, শাস্ত্রী চৌক কোথায় নয়?তাতে সর্বাধিনায়ক বিক্রম সোলাংকী ছাড়াও নগর অধিনায়ক রাকেশ ডোডেজা, জেলা অধিনায়ক রমেশ বহল সবার ফোটো লাগানো হয়েছে।
    আর শহরের সব গলির থেকেই মিছিল আসছে, মিলবে রজবান্ধা ময়দানে। সেখানে বিক্রমজী অ্যাড্রেস করবেন। ওঁর জীবনের একটাই মিশন। সনাতন হিন্দু ধর্মের রক্ষ।
    টাকমাথা ভদ্রলোক হেসে ফেলেন
    --- ওরে বাবা! যা লম্বা একখান লেকচার দিলি ভাই! তুইও কি শঙ্করসেনার সদস্য।
    --- আমরা সমস্ত অটো ড্রাইভাররাই সদস্য। বিক্রমজী আমাদের ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট যে!
    শঙ্কর সেনার নাম শুনে রোগীর খাবার নিয়েযাওয়া ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ খাদে নেমে যায়। তবু বিড়বিড়ানি থামে না।

    সেটা টের পেয়ে অটো ড্রাইভারের গলাতেও জাগে অনুরোধের সুর।
    --- আজ একটু কষ্ট করুন, স্যারজী! বছরে একটা তো দিন। কোন ক্ষতি হবে না আপনর। শঙ্করজী আছেন। বাবা ভোলেনাথের ওপর ভরসা রাখুন। সব ঠিক হয়ে যাবে। ব্যস্‌, আর দশ মিনিট।
    এবার মারাঠি ভদ্রলোকের মুখে একটু মুচকি হাসি ফোটে।
    -- হ্যাঁ, হ্যাঁ, আর দশ মিনিট অপেক্ষা করতে পারবেন না? আমি যে সেই কবে থেকেঅপেক্ষা করছি। কত বছর যেন!
    --- মানে? কাকাজী, এসব কি বলছেন? কয়েকবছর অপেক্ষা?
    --- যেতে দাও। ও কিছু না। বুড়ো মানুষের সব কথা ধরতে নেই। ওরা অপেক্ষা করে থাকা ছাড়া আর কিইবা করতে পারে!
    এবার পাশের একটা মোটরসাইকেল জিলিপির কায়দায় ভীড়ের ভেতরে ঢুকে ট্যারা হয়ে দাঁড়াল। অটো ড্রাইভার খিস্তি করতে গিয়ে থেমে গেল। চালক ছেলেটির হাতে শঙ্করসেনার আর্মব্যান্ড বাঁধা।
    -- আরে ভাইয়া! কহাঁসে! সব ঠিক হ্যায় না?
    -- হাঁ, হাঁ,সব ঠিক হ্যায়। পাঠানলোগ মুহর্‌রমকে জুলুস মেঁ আখাড়া সে আদমী লাকর খুব তলোয়ারবাজী আর লাঠি কা প্যাঁয়তরা
    দিখায়া থা না? অব উন সবকী পুঁ সরক গয়ী। আরে উন্‌কী বাত ছোঁড়ো। ত্রিশুল পার্টি কে লোগ ভী নহী শোচে থে ইয়ে প্রোগ্রাম অ্যায়সা সাকসেস হোগী। ইসবার আগলা চুনাও মেঁ হমলোগোকো জ্যাদা সীট দেনা পড়েগা।

    ডানদিকের বড়ইপাড়া গলি থেকে আরেকটা মিছিল এসে রাস্তা কে আরো ভারাক্রান্ত করে । মারাঠি ভদ্রলোক অটো থেকে নেমে একটু এগিয়ে ইয়ে হাসিমুখে ওই মিছিলটি দেখতে থাকেন।
    কী আশ্চর্য্য! সামনে সব চোদ্দো-পনেরো বা আরো ছোট ছোট ছেলের দল। তারা নাচছে ত্রিশূল নিয়ে।
    কিন্তু এ যে ওয়েল্ডিং করা ভারি রড দিয়ে তৈরি বিশাল ত্রিশূল। প্রায় দশ ফুট লম্বা। এই ত্রিশূল সোজা করে তুলে ধরে কার বাবার সাধ্যি! তাই তারা অন্ততঃ ছ'জন মিলে আড়া আড়িতে ধরেছে। আর নাচছে বিলম্বিত লয়ে। ছন্দটা হলঃ
    "" ধিনতা ধিনা, পাকা নোনা''।
    ধিনতা-ধিনা,--- ওরা লাফিয়ে দুই স্টেপ এগিয়ে যাচ্ছে।
    পাকা- নোনা,----- আবার দুই স্টেপ পিছিয়ে আসছে। ফলে মিছিল আর এগুচ্ছে না।
    উনি মুগ্‌ধ হয়ে নাচ দেখতে থাকেন। ঠোঁটের মধ্যে এক চিলতে হাসি।

    ২)
    মাস দুই পরের এক সকাল। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহ।আজ সমস্ত অফিস, স্কুল-কলেজ ছুটি। আজ যে রামনবমী। "' মর্য্যাদা পুরুষোত্তম ''রামচন্দ্রের জন্মদিন। সারা শহর জুড়ে রঙিন কাগজের মালা। বড় বড় পোস্টার। আজ শঙ্কর সেনা ও ত্রিশূল পার্টি সবারই বিশাল মিছিল বেরিয়েছে। মোড়ে মোড়ে পটকা ফাটছে। কোন কোন জায়গায় স্টল থেকে মিছিলযাত্রীদের লেবুর শরবত বা শিকঞ্জী পানি খাওয়ানো হচ্ছে। একটি মোড়ে কোন মুসলিম সম্প্রদায়ের তরফ থেকেও স্টল লাগানো হয়েছে। তার সামনে একটি ব্যানারে লেখা আছে- "" রাম হলেন সারা ভারতের অস্মিতার প্রতীক''।
    মিছিলে কিছু লোক খোলা ত্রিশূল ও তলোয়ার নিয়ে নাচতে নাচতে চলেছে। চলছে নকল যুদ্ধ ও তলোয়ার বাজীর মহড়া। সামনে ব্যানার-- হনুমান আখাড়া।
    শ্লোগান উঠছে-- মন্দির বানানা হমারা কাম-- জয় শ্রীরাম, জয় শ্রীরাম।
    যো হিন্দুহিত কা বাত করেগা, ওহি দেশ মেঁ রাজ করেগা।
    তুম মানো ইয়া না মানো , হম মন্দির ওহীঁ বানায়েঙ্গে।
    হম সৌগন্ধ রাম কী খাতে হ্যায়, মন্দির ওহিঁ বানায়েঙ্গে।
    একটা-দুটো চ্যাংড়া ছোঁড়া সব মিছিলেই থাকে। এখানেও ওমনি দুজন হটাৎ চেঁচিয়ে উঠল।--- মুসলমানোঁ কা দো হী স্থান,
    পাকিস্তান ইয়া কব্রিস্তান।

    কয়েকজন হেসে ফেললো। কিন্তু তিনজন সিনিয়র ভলান্টিয়ার এসে ওদের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে চুপ করতে বল্লো।
    ---- এখন ওসব স্লোগান চলবে না। সামনে ইলেকশান।

    তাঁতিয়াপাড়াটা হল খানদানি মারাঠি পাড়া। এখান থেকে পায়ে হাঁটা দূরে মহারাষ্ট্র মন্ডল। আর মোড়ের থেকে দু'কদম পায়ে হাঁটলেই স্বয়ংসেবক দলের জেলা অফিস, একটি নতুন রং করা পুরনো বাড়িতে। তার তিনটি বাড়ি পরে একটি ঘিঞ্জি দোতলাবাড়ির চিলেকোঠা মত ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছেন আমাদের পূর্ব পরিচিত সেই আধবুড়ো মারাঠি ভদ্রলোকটি। আজকে পোস্ট আফিস থেকে কিছু পয়সা তোলার ছিল।তবে আজ তো সব ছুটি। তাই ভদ্রলোকটি বেরোন নি।
    খবরের কাগজ পড়া হলে ভদ্রলোকটি ভাল করে দাড়ি কামালেন। মাঝে মাঝে গুন গুন করে গান গাইছিলেন-- সরফরোসী কী তমন্না অব হমারে দিলমেঁ হ্যায়। দেখনা হ্যাঁয় জোর কিতনা বাজু-এ-কাতিল মেঁ হ্যাঁয়!

    ৩)
    বিক্রম শোলাংকি আজ খুশ মেজাজে। রামনবমীর র্যানলি সুপার-ডুপার সাকসেস। সন্ধ্যের দিকে ফোন এসেছিল সত্তাধারী ত্রিশূল পার্টির এক ম্যানেজারের। সে বাস্তুঘুঘুটি আবার মুখ্যমন্ত্রীর খাসম্‌খাস। কিছু ফিলার দিল। আগামী নির্বাচনে শংকর সেনা আর ওই পার্টির কোন প্রত্যক্ষ নির্বাচনী সমঝোতা হবে না। কিন্তু রায়পুর (উত্তর) সীটটিতে সোলাংকি দাঁড়ালে ওরা ডামি ক্যান্ডিডেট দেবে। ততদিন গোটাচারেক আই পি সির কেস গুলো ঠান্ডা বস্তায় রাখা হবে।
    মার দিয়া কেল্লা! এম এল এ হয়ে গেলে তখন বাকি কেস গুলোকেও দেখে নেয়া যাবে। তবে ওরা রবীন্দ্র পান্ডে মার্ডার কেসে কোন হস্তক্ষেপ করবে না। কারণ রবীন্দ্র পান্ডের শ্বশুর আবার ত্রিশূল পার্টির ফান্ড ম্যানেজার।
    শালা! না করুক গে'! উসকি মা কী--!
    ফলে আকবর হোটেলে রাতের ডিনার সারতে সারতে চেলা-চামুন্ডাদের অভয়দান করে বাড়ি যেতে বল্লেন। রয়ে গেল শুধু ঘনিষ্ঠতম দু'জন। রাকেশ ডোডেজা আর রমেশ বহল। নগর অধ্যক্ষ আর জেলা অধ্যক্ষ।
    রাত্তির প্রায় বারোটা বাজে। টেবিলের ওপর খালি বোতল জমছে একের পর এক।
    হটাৎ ডোডেজার গলায় হুংকার শোনা গেল--- আর বিরিয়ানি নেই কেন? বেয়ারা গুলো কি ভ্যারেন্ডা ভাজছে?
    রমেশ বহলের আওয়াজ উদারার উপরে যায় না।
    বলল--- মালিক কো বুলাও।
    মালিক কাঁপতে কাঁপতে এসে হাত জোড় করে বললো-- আজ আমার মিস্ত্রি একটু আগে বাড়ি চলে গেছে। কাল ভাল বিরিয়ানি খাইয়ে দেব। ভোলেবাবা কী কসম।
    --- কেন? তোর মিস্ত্রিকে ছুটি দিলি কেন? আমাদের যখন খাওয়া হয় নি তুই ওকে বাড়ি যেতে দিলি কেন? কাল সকালে তোর দোকান তুলে কুমারী নদীতে ফেলে দিলে খুশি হবি? কাল ঠেকে যেন তোর ওই মিস্ত্রি আকবর হোটেলে না আসে।
    ---- সরকার! আপকী ইচ্ছা মেরে সর-আঁখো পর। লেকিন উসকে বেটা বিমার হ্যায়।
    হটাৎ বিক্রম হেসে ফেলেন। চ্যালাদের বলেন--হয়েছে, হয়েছে। এবারের মত ছেড়ে দে। ঠিকই তো বলছে, ছেলের অসুখ হলে কি আর করা যাবে। চল, সবাই উঠি। কাল হাইকোর্টের জজের বাড়িতে লোক পাঠাতে হবে। শুয়ার কে অউলাদ বড্ডো বেশি চাইছে। কিন্তু চিড়িয়া একবার দানা খেয়েছে। কাজ করবে।
    হোটেলের শাটার বন্ধ হওয়া শুরু হয়। এবার চাকরবাকররা খেতে বসবে।
    টেবিলগুলো প্রায় খালি, কিন্তু একটি টেবিলে একজন আধবুড়ো মারাঠি ভদ্রলোক ধীরে ধীরে খেয়ে চলেছেন। মালিক জানে ওই ভদ্রলোক কাছেই থাকেন। গত দু'বছর ধরে নিয়মিত এখানেই একটু রাতের দিকে আসেন।
    বেয়ারা গিয়ে বলে -কাকা, একটু তাড়াতাড়ি করুন।
    বিক্রম আজ দিলদরিয়া। বলেন-- অ্যাই, বুড়ো মানুষকে তাড়া দিস না তো, গলায় লাগবে। কাকা, আপনি কোথায় থাকেন?
    আরে, ও তো আমার বাড়ির কাছে চলুন, আপনাকে আমি পৌঁছে দেব।

    সাদা হাঁসের মত ইনোভা গাড়িটাতে উঠতে ভদ্রলোকটি খুব ইতস্ততঃ করছিলেন। সেই দেখে ডোডেজা আর রমেশ বহল হেসে গড়িয়ে পড়ে।
    --"" আরে আংকল! ইস গাড়িমেঁ বসকে সাথ সফর করনে কে লিয়ে রায়পুর কে লোগ ক্যা না ক্যা করনে কো তৈয়ার হ্যায়! অউর এক হ্যায় আপ, যো----''।
    ওদের ঠেলাঠেলির চোটে বিব্রত মারাঠি ""আপলা মানুস'' হাতের কালো হ্যান্ডব্যাগটি নিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসতে গেলেন তো বিক্রম মানবেনই না!
    -- আপ হমারে আংকল হ্যাঁয়। আপ কহাঁ ওহাঁ ছোটেলোগো কে সাথ----। আপ তো ইহাঁ মেরে বাজুমেঁ--।
    কথা গুলো একটু জড়িয়ে আসছে। ড্রিংকের মাত্রাটা মনে হয় একটু বেশি হয়ে গেছে।
    -- বস, আমাদের গাড়িতে আজ আপনাকে ছেড়ে দিয়ে আসি?
    রমেশ অনুরোধ করে।
    --- আরে না না, তোরা বাড়ি যা! চিন্তার কিছু নেই। সব ঠিক ঠাক চল রহা হ্যায়। ড্রাইভার আছে।আরে,সবচেয়ে বড় কথা আজ সঙ্গে আংকল আছে।
    বিক্রম হাসিতে ফেটে পড়েন। সঙ্গে সঙ্গে দুই শাগরেদ মাতালের অশ্লীল হাসি হেসে ওঠে।

    --- ক্যা বাত বস্, আজ তো আংকল সাথ হ্যায়!
    গাড়ি তাঁতিয়াপাড়ার মোড় ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে গেলে উনি বলেন-- আমাকে এখানেই নামিয়ে দিন। একটু গলির মধ্যে , গাড়ি ঢুকবে না। আমি ওটুকু হেঁটে যাবো। রাত্তিরের হাওয়াটা ভাল লাগছে, ধন্যবাদ! জয় শ্রীরাম!
    -- আরে আংকল, আমারও কেমন গুমোট লাগছে। এখান থেকে আমারও বাড়ি খুব কাছে। আমি বরং আপনার সঙ্গে একটু হাঁটি। অ্যাই, গাড়ি নিয়ে যা! মাজীকে বলবি দশ মিনিটের মধ্যে পায়দল চলে পৌঁছচ্চি। যেন কোন চিন্তা না করে।
    --- লেকিন বস্,---।
    -- চোপ বে! কোঈ লেকিন-উকিন নেহি। জ্যায়সা বোল রহা হুঁ, অ্যায়সা হী কর্‌, ভূতনীকে!
    এবার দুজনে হাঁটতে থাকেন। একজন বছর চল্লিশের অমিতাচারী ক্ষমতাশালী মাতাল , আর অন্যজন সারাজীবন সম্ভবতঃ কলম পিষে ক্ষয়ে যাওয়া প্রৌঢ় এক মারাঠী।
    কিছু কথ বলতে হবে তাই উনি বলেন-- আপনি আজকে খুব খুশি না!
    মাতাল চমকে ওঠেন!-- আপনি কি করে জানলেন?
    -- আপনার চোখ মুখ বলছে। তাছাড়া আপনাদের কথাবার্তা খানিক কানে আসছিল। আপনি এবার ভোটে দাঁড়াবেন।
    --- আংকল! আপনার ভোট পাবো তো!
    -- নিশ্চিন্ত থাকুন!
    -- ব্যস্‌,আপনি আমার সঙ্গে আছেন , আমি নিশ্চয়ই জিতবো।
    -- সে আর বলতে!
    -- কিন্তু, কি জানেন, কেউ কেউ অন্যের ভালো দেখতে পারে না। আমাকে হিংসে করে।
    --- কে? আপনার আবার দুশমন কে?

    -- এই দেখুন না, অ্যাডভোকেট তিওয়ারির শ্বশুরবাড়ির লোকজন।
    --- কিন্তু তিওয়ারি তো পাঁচ বছর আগে খুন হয়ে যায়।
    --- হ্যাঁ, আংকল! তবু গত নির্বাচনে ত্রিশূল পার্টি জেতার পর ওর শ্বশুরবাড়ির লোকজন মুখ্যমন্ত্রীকে ধরাকরা করে। আমাকে অ্যারেস্ট করা হয়। আমি নাকি ওকে খুন করিয়েছি। আর ওদের পেয়ারের এক ব্রাহ্মণ এস পি। সে আমাকে হাতকড়া পরিয়ে খোলা গাড়িতে চড়িয়ে জয়স্তম্ভ চৌক অব্দি লাথ-মুক্কা - বেল্ট দিয়ে মারতে মারতে নিয়ে যায়। সাত মাস জামানত হয় নি। শেষে হাইকোর্টে বেইল পাই। সত্যি কথা বলবো? হারামজাদা জজ, রন্ডীর বাচ্চা, আমার থেকে দশ পেটি নিয়েছে।
    --- আপনি তো ওকে মার্ডার করেন নি। তবে?
    -- আরে, সেই সময় আমি ৫৫ কিলোমিটার দূরে মহাসমুন্দে মুম্বাই থেকে আসা এক বি গ্রেড নায়িকাকে দিয়ে আমার নতুন বার-কাম-হোটেলের উদ্‌ঘাটন করাচ্ছিলাম। তাতে শহরের প্রেস হাজির ছিল। তাই তো বেইল পেলাম।
    -- তাহলে আপনাকে জড়ালো কি করে?
    -- আর বলবেন না! ঐ তিওয়ারি উকিল, আমার ছোটবেলার বন্ধু, একদম লংগোটিয়া। কিন্তু সেদিন নগর অধ্যক্ষ ডোডেজার ফোন এল। বস্‌,চারদিন আগে দুটো ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলে আমাদের ঘুংঘরু বারে ড্রিংক করে পয়সা না দিয়ে যাচ্ছিল। ম্যানেজার রাস্তা আটকালে ওকে গাল দেয়। তখন আমাদের স্টাফ ওদের রাম ধুনাই দেয়। তারপর ওরা হোস্টেল থেকে কিছু ছেলে নিয়ে আসে। ওরা হকিস্টিক দিয়ে আমাদের ম্যানেজারকে বেদম মারে। ও এখন হাসপাতালে । তারপর ওরা প্রচূর ভাঙ্‌চুর করে।
    আজ ওদের একটাকে আমাদের ছেলেরা সুভাষ কলোনীতে দেখতে পেয়ে তাড়া করে। কিন্তু ও দৌড়ে আপনার বন্ধু তিওয়ারি উকিলের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ওনাকে বোঝাই যে ছেলেটাকে আমাদের হাতে তুলে দিন। বসের নির্দেশ। তা উনি বল্লেন-- ও আমার আশ্রিত। আজকে আমার জন্মদিন। আমি আজ আশ্রিতকে তার দুশমনের হাতে তুলে দেব না। ও পরে নিজে থেকে বেরিয়ে গেলে তখন তোমরা ওকে কিকরবে সে আমি দেখতে যাবো না। কিন্তু আমার বাড়ির ভেতর কেউ ঢুকবে না।
    কি করা যায় বস্?
    --- আমার সঙ্গে মোবাইলে কথা বলিয়ে দে।
    -- তাই তো বল্লাম, তা ওর সেই এককথা। কারো সঙ্গে কথাটথা বলবে না। কিন্তু ওকে ছেড়ে দেবে না।
    -- এককাজ কর। তোরা জনা চল্লিশ যা'। দু'ঘন্টা টাইম। সদর থানা থেকে কেউ আসবে না। সেটা আমি দেখছি। দরজা ভেঙে ওর বাড়িতে ঢোক। তলোয়ার দিয়ে দুটোকেই কেটে ফ্যাল্।
    -- বস্‌! তিওয়ারি উকিল যে আপনার বন্ধু।
    --- কোন শালা বলে? যে আমার ইজ্জত নিয়ে খেলে, আমার কথার কোন ভাও দেয় না- সে কিসের বন্ধু? কেটে ফেল্।
    যাকগে, আংকল! আপনিআমার কাকা। এসব কথা আবার কাউকে বলতে যাবেন না। ওই কেসটা খতম না হওয়া অব্দি, মানে হাইকোর্ট আমাকে নির্দোষ ঘোষণা না করা অব্দি আমার ইলেকশনে দাঁড়ানো বেশ চাপ। সেসব হয়ে যাবে। শংকর ভগবান তাঁর সেবক কে রক্ষা করবেন।
    এবার ফাঁকা মাঠ। কোণায় একটা ডাস্টবিন। তারপর রাস্তাটা বাঁক নিয়েছে। ঘরদোর গুলো একটু এগিয়ে গিয়ে।
    -- আচ্ছা! এবার আমি চলি। আপনারো তো আর একটু।
    --- কিন্তু আপনার বাড়ি কই? এখানে তো ফাঁকা মাঠ।
    -- কথা বলতে বলতে পেছনে ছেড়ে এসেছি। ফিরতে হবে।
    এবার ভদ্রলোক একটু পেছন ফিরে হ্যান্ডব্যাগের চেন খুলতে থাকেন।
    -- কি হল আংকল?
    -- মোবাইলটা বের করছি। মনে হয় গিন্নি চিন্তা করছেন।
    -- যান্‌, যান্‌ আংকল। হাঃ-হাঃ-হাঃ! আপনি আমার সঙ্গে রয়েছেন, বিক্রম শোলাংকির সঙ্গে। কোঈ ভি আপকা বাল বাঁকা নহী কর সকতা।
    কিন্তু মোবাইলের শেপটা এমন কেন?আংকল, এটা কোন কোম্পানীর?
    প্রশ্নটা শোলাংকির গলাতেই রয়ে গেল। সাইলেন্সার লাগানো স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেন রিভলবার থেকে প্রায় বুকে ঠেকিয়ে দুই বার ট্রিগার টেপা হয়ে গেছে।
    বিক্রম কিছু বোঝার আগেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েছেন। শরীরকে আড়াল করেছে একটি গুলমোহরের গাছ। রাস্তায় কেউ নেই। খানিকক্ষণ পরে বিক্রমের সাফারি স্যুটের পকেট থেকে মোবইলের রিং বেজে উঠল। তারপর বাজতেই থাকল। একটু পরে থামতে না থামতেই আরো একটি ফোন।দূর থেকে আসা একটি প্রাইভেট গাড়ি দ্রুতবেগে খালি জায়গাটা পেরিয়ে গেল।
    মাত্র চারশ' মিটার দূরে বিক্রমের প্রসাদোপম বাড়িতে পোষা জার্মান শেফার্ডটি কেন যেন আকাশের দিকে মুখ তুলে বিচ্ছিরি গুঙিয়ে উঠল। গাড়ির ড্রাইভার তাকে ধমকে উঠলো।
    -- আবে! চুপ হো যা! সাহাব আভী আনে ওয়ালে।

    ৪)
    সাতসকালে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে আপাতকালীন বৈঠক। কনফারেন্স টেবিলকে ঘিরে অতিরিক্ত ডিজি, আই জি, ডিআইজি, জেলা এস পি, সিটি এস পি , ডি আইজি ইন্টেলিজেন্স, ডি এস পি ( ক্রাইম) সবাই বসে উশখুশ করছেন। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত ঘরের বন্ধ দরজার ওপাশে বারান্দায় চেয়ার লাগিয়ে কয়েকজন ডি এস পি, ; কোতায়ালি থানার টি আই, দক্ষিণ রায়পুর জোনের অতিরিক্ত এস পি সবাই আদেশের প্রতীক্ষায়।
    কনফারেন্স রুমে টেবিলের মাথায় ডিজিপি'র চেয়ারটাই শুধু খালি। উনি আসলেই মীটিং শুরু হবে। উনি এখন মুখ্যমন্ত্রীর চেম্বারে। সবাই জানে মুখ্যমন্ত্রী এখন ওনার ক্লাস নিচ্ছেন।
    সবাই রুমাল দিয়ে মুখ মুছছেন আর নীচু গলায় ফিস্‌ফিস্‌ করছেন।
    সবার ভেতরে একটা চাপা উত্তেজন। এত বড় একটা ঘটনা ঘটে গেল--- কার কার ওপরে যে --।
    কিস্‌ কিস্‌ পর গাজ গিরেগা? সারে পুলিশ ব্যবস্থা কী নাকামিয়াবি কা ঠিকরা কিসকে সর পর ফোড়া যায়েগা!
    পুলিশি ব্যবস্থার ব্যর্থতা বটেই!
    মাঝরাতে শংকর সেনার আইকন সোলাংকি মার্ডার হলেন। তারপর ঘন্টাদুইয়ের মধ্যে মোদহাপাড়ার মুসলিম মহল্লায় হামলা হয়। ছটা বাড়িতে আগুন লাগে, তিনজন মারা যায়। এদের মধ্যে সাট্টাবাজ ইয়াসিন পুরনো হিস্ট্রিশীটার। শংকরসেনার ও একজন মারা গেছে। আম্বেদকর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অন্ততঃ চল্লিশজন আহত, যাদের মধ্যে বারোজনের অবস্থা আশংকাজনক। তাদের মধ্যে একজন আবার সোলাংকিজী'র ড্রাইভার। ওকে হাসপাতালে কড়া পুলিশ পাহারায় রাখা হয়েছে।
    শংকরসেনা গোটা রাজ্যাব্যাপী বন্ধ ডেকেছে, আবার পুলিশ প্রশাসন রায়পুর শহরে চব্বিশঘন্টার কার্ফিউ ঘোষণা করেছে। সকাল থেকে বিভিন্ন মোহল্লায় পুলিশভ্যান মাইক থেকে কার্ফিউয়ের ঘোষণা করে চলেছে। সেইযে সেবার ইন্দিরাজী দেহরক্ষীদের হাতে মারা গেলেন তখন রায়পুর শহর প্রথমবার কারফিউয়ের নাম শুনেছিল। ফলটা হয়েছিল মারাত্মক।
    ছেলেমেয়ে-বুড়োবুড়ি সবাই দলে দলে ঘর ছেড়ে রাস্তায় ভিড় জমিয়েছিল---- কারফিউ কি জিনিস, সে কেমন দেখতে , সেটা জানতে।
    পুলিশ বুঝিয়ে সুঝিয়ে হার মেনে কারফিউ তুলে একশ'চুয়াল্লিশ ধারা জারি করল, তখন কিছু কাজ হল।
    দুইদশকে অনেক কিছু পালটে গেছে। বর্তমান প্রজন্ম জানে কারফিউ কী, একশ' চুয়াল্লিশ কী।
    কিন্তু সাতসকালে ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই একী! খবরের কাগজগুলো আধসেদ্ধ খবর দিয়েছে।
    এতগুলো খুন? কে কাকে, কেন! বন্ধ না কারফিউ, কোনটা মানবো?
    এই অবস্থায় যা হয়, গুজবের বাজার গরম। লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল যে মুসলিম আতংকবাদীদের হাতে শঙ্করসেনা প্রমুখ বিক্রম সোলাংকী মারা গেছেন। মুম্বাইতে ঠাকরে-আড়বানী এরা অনেকদিন ধরেই টারগেট। কিন্তু ওঁরা তো জেড সিকিউরিটি পেয়েছেন। কিন্তু ছত্তিশগড়ী নেতাটির কোন সরকারী সুরক্ষা ব্যবস্থা ছিল না। তাই তিনি সফট টারগেট ছিলেন।
    -- আসলে বেইমানী করেছে ওনার ড্রাইভার। এতদিনের সব সতর্কতা ভুলে ওই রাত্তিরে বাড়ির একটু আগে একা রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। ওর দেয়া খবরেই তো আততায়ীরা এসে রাস্তায় অ্যামবুশ করেছে।

    বিশাল ওভ্যাল টেবিলের মাথার দিকের খালি চেয়ারের হেলান দেয়ার জায়গাটায় একটি শ্বেতশুভ্র তোয়ালে রাখা, - নার্সিংহোমে সদ্যোজাত শিশুদের নার্সরা যেধরনের তোয়ালেতে মুড়ে আত্মীয় স্বজন দের দেখাতে আনে।
    সবাই উস্‌খুস্‌ করছিল আর ঘড়ি দেখছিল। এমন সময় একজন ইন্সপেক্টর দ্রুতপায়ে এসে কয়েকটি ফোল্ডার ঐ চেয়ারের সামনে টেবিলের ওপর রেখে হুড়মুড়িয়ে কেটে গেল। তক্ষুণি একজন সাদা পোষাকের পিয়ন এসে ঠান্ডা মিনারেল ওয়াটারের বোতল নিয়ে রেখে এল। সবাই নড়েচড়ে বসল,-- আয়েগা,আনেওয়ালা! আয়েগা।
    এবার একজন কাঁচাপাকা চুলের চেক বুশশার্ট পরা ব্যক্তি মাপা পায়ে এসে সংযুক্ত পরিবারের কর্তার আসনে বসলেন। তাঁর পেছন পেছন আসা টাকমাথা বেঁটে ভদ্রপুরুষের জন্যে তাঁর পাশেই একটি চেয়ার রাখা হল।
    কোন ভণিতা না করে ছত্তিশগড় রাজ্যের ডিজিপি শ্রী ভুবনমোহন সাক্সেনা বলা শুরু করলেন।
    ---- সি এম স্যার রাজ্য পুলিশের পার্ফর্ম্যান্স, ডেডিকেশন, সেন অফ রেসপন্সিবিলিটি সব নিয়ে অত্যন্ত নারাজ। উনি বল্লেন-- আপনার পুলিশ বিভাগ নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে। এর বিরুদ্ধে বলার মত কোন তথ্য আমার হাতে নেই। কাজেই আমি প্রটেস্ট করতে পারিনি।
    কাল শংকরসেনার মুখিয়া বিক্রম সোলাংকি মার্ডার হয়েছে, মাঝরাতে। তার একঘন্টার মধ্যেই রায়পুরের মুসলিম বসতি মোদহাপাড়ায় হামলা হয়। তিনজন মারা যায়। তাদের মধ্যে একজন ইলিয়াস হিস্ট্রি শীটর। শংকরসেনার এক কর্মী রায়কোয়াড়ও মারা গেছে।
    আহত জনাচল্লিশ, তদের মধ্যে একজন সোলাংকির ড্রাইভার।
    সকাল থেকে কোন নতুন ঘটনা ঘটেনি। কারণ, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন আজ সন্ধ্যে অব্দি কারফিউ জারি করে রেখেছে।
    বাকিটা ইন ডিটেইলস্‌ ইন্টেলিজেন্স ব্যুরোচীফ পার্থসারথি বলবেন।

    সবার চোখ এখন মধ্যপ্রদেশ ক্যাডার থেকে সদ্য ইন্‌টেলিজেন্সের দায়িত্বে আসা টাকমাথা ইষৎ পৃথুল ভদ্রলোকটির দিকে।
    মিনারেল ওয়াটারের বোতলে একটু চুমুক দিয়ে গলা খাঁকরে উনি বলতে লাগলেন।
    ---- কালকে রামনবমীর সফল শক্তি প্রদর্শনের পর বিক্রম সোলাংকি একটু ওভার কনফিডেন্ট ছিলেন। ফলে দুই সাগরেদের সঙ্গে আকবর হোটেলে নিত্যনৈমিত্তিক ডিনার পর্ব সারার পর উনি সঙ্গীদের সাবধানবাণী উপেক্ষা করে ড্রাইভারের সঙ্গে গাড়ি করে বাড়ির জন্যে রওয়ানা দেন। আবার বাড়ি থেকে কয়েকশ' মিটার আগে উনি গাড়ি থেকে নেমে পড়ে পায়ে হেঁটে বাড়ি যাবেন বলে জিদ করেন। ড্রাইভারকে হাঁকিয়ে দেন। আধাঘন্টা কেটে যাওয়ার পরও উনি বাড়ি না ফিরলে শ্রীমতী সোলাংকি চিন্তিত হয়ে রাকেশ ডোডেজাকে ফোন করেন।

    এবার আই জি ( রায়পুর) বলেন--- সরি টু ইন্টার্ভেন। গাড়িতে ড্রাইভার ছিল না , আর উনি একা নেমে ছিলেন --এটা কি কারেক্ট রিপোর্ট?
    ------ বলছি, সবই গুছিয়ে বলছি।

    ৫)
    ইতিমধ্যে ডোডেজা এবং বহল, শংকরসেনার নগর ও জেলা অধ্যক্ষ, সোলাংকিজির মোবাইলে ফোন করেছে। কিন্তু রিং বেজে গেছে। কেউ ফোন তোলে নি।
    তাই তারা শ্রীমতী সোলাংকিকে শুধু এইটুকু বলে --- ভাবীজি, হম লোগ দশ মিনট মেঁ পহুঁচ রহে হ্যাঁয়।

    পৌঁছে গিয়ে ওরা সোজা ড্রাইভারকে ধরে।
    --- বস্‌ কে খালিরাস্তায় একা নামিয়ে এলি কেন? মাঝরাত্তিরে?
    ---- উনি খুব জিদ্‌ করছিলেন, আর একা নয় ওই আংকলও ছিলেন।
    ---- কোন আংকল? ওই হাড়হাভাতে বুড়ো? আরে ও তো দুধভাত। হোটেলে নিয়মিত খেতে আসে, ব্যস্‌। তুই ওকে কতটুকু জানিস্‌? ওর ভরসায় বস্‌ কে ছেড়ে বাড়ি ছেড়ে এলি?

    ড্রাইভারকে চাকরিতে লাগিয়েছিল রমেশ বহল নিজে, ওদের পাড়ার ছেলে।
    ও হিমশীতল গলায় বলে।-- গাড়িতে ওঠ, স্টার্ট কর। ব্যাক করে যেখানে বসকে নামিয়েছিলি সেইদিকে চল্‌। আর রাস্তার দু'দিকে নজর রাখ। আজ বস্‌ একটু বেশিমাত্রায় লগী মেঁ থেঁ।
    ওরা তিনজন রওয়ানা দিল ফিরতি পথে। না , কোথাও বসের চিহ্ন নেই। ওদের মনটা কুডাক ডাকতে লাগলো। এভাবে প্রায় আকবর হোটেলের কাছে পৌঁছে গিয়ে রমেশ বহল বিরক্তিতে মাথা নাড়লো।
    বল্লো-- উঁহু, এভাবে হবে না, গাড়ি আবার ব্যাক কর। ঠিক কোনখানটায় বসকে নামিয়েছিলি সেখানে আমাদের নামিয়ে দে'। খোঁজাটা আবার ওইখান থেকেই শুরু করতে হবে।

    রাত দেড়টার পর রাস্তা ফাঁকা। শুনশান রোড। কোন মানবের দেখা নেই। কিন্তু বাঁকের মুখে ঝাঁকড়াচুলো গাছটার নীচে কেউ শুয়ে আছে না?
    রমেশ দৌড়তে থাকে। শুয়ে থাকা শরীরটার কাছে গিয়ে ডাকে?
    --- বস্‌, উঠো ব্যস্‌, হমলোগ আগয়ে। আরে এ ক্যা হাল বনায়ে রাকখে আপনে?
    নাঃ, বসের মদ্যপানের মাত্রা আজ একটু বেশি হয়ে গেছে।
    তারপরই ও নিজের হাতের দিকে আর বসের শরীরে দিকে তাকায়। আর আতংকে ভরা ফাঁকা আওয়াজে চেঁচায়।
    ---- আরে ডোডেজাজী! জলদি আও। ছাতি মেঁ গোলী লগি হ্যাঁয়।
    এবার ডোডেজাও দেখতে পায়। ধূলোর মধ্যে পড়ে থাকা বসের বুকের ওপর দুটো ছ্যাঁদা। রক্ত জমাট বাঁধা শুরু করেছে। কিন্তু তার আগে অনেকখানি রক্ত চুঁইয়ে পড়ে চারপাশের ধূলো ভিজিয়ে দিয়েছে। কিন্তু রক্তের গন্ধে ছুটে আসছে গাছ ও আশপাশের উইঢিবি থেকে বেরিয়ে আসা লাল ও ডেঁয়ো পিঁপড়ের দল।
    ওরা তৎক্ষণাৎ বডি গাড়িতে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ""মেকাহারা'' হাসপাতাল রিপোর্টে লেখে ব্রৌঘ্ত দেঅদ ''।

    অতিরিক্ত ডি আই জি মুখ খুল্লেন--- পোস্ট মর্টেম রিপোর্ট কি বলছে? আর ব্যালিস্টিক রিপোর্ট?
    ---- দেখুন, ফাইনাল পি এম রিপোর্ট বেলা এগারোটা নাগাদ পাওয়া যাবে। তবে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে। পয়েন্ট ৩২ ক্যালিবারের। ক্ষতের চারপাশে পোড়া দাগ। একটি গুলি বাঁদিকের ফুসফুস কে ফুটো করে পেছনের গাছে ধসেছে। আর একটি একটু ওপরে তেরচা হয়ে কলার বোনের কাছে আটকে আছে।
    ব্যালিস্টিক রিপোর্ট? আগ্নেয়াস্ত্রটি এখনো পাওয়া যায় নি। তবে মনে হয় স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেন। এগুলো কয়দশক আগে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীতে ব্যবহার হত। আজকাল হয় না।
    গোটা হল হটাৎ নিস্তব্ধ। এই হত্যায় পুলিশি রিভলবার? তবে কি পুলিশবাহিনীর লোক ইনভলড্?
    এবার ডি জি পি বল্লেন-- মুখ্যমন্ত্রীকে বোঝাতে পারিনি যে আজকাল আমাদের ফোর্স ওইসব সেকেলে হাতিয়ার ব্যবহার করে না। ওগুলো অস্ত্রের চোরাবাজারে কিনতে পাওয়া যায়।
    আই জি বল্লেন-- ওর ড্রাইভার কেন হাসপাতালে?
    ডিজিপি বিরক্ত মুখে তাকালেন।
    -- আপনি কাল রাত্তিরে কোথায় ছিলেন?
    --- সারাদিন রায়পুর শহরেই ছিলাম। শংকর সেনার শৌর্য্য প্রদর্শন , থুড়ি মিছিল, ভাল ভাবে মিটে গেলে রাত্তিরে ভিলাইয়ে বোনের বাড়ি গেছলাম, নেহরুনগরে। আপনার জন্যে হেড কোয়ার্টার ছাড়ার পোস্ট ফ্যাক্টো অনুমতি চেয়ে ফ্যাক্স করেছিলাম।
    --- তা' এতবড় ঘটনার পর মিটিংয়ে আসার আগে নিজের এস পি'র থেকে ব্রিফিং না নিয়েই এসেছেন?
    আই জি'র অপ্রস্তুত ভাব দেখে এস পি হড়বড়িয়ে বল্লেন--- স্যার, উনি এসে আমাকে কল করেছিলেন, কিন্তু আমার ফোন এনগেজড্ ছিল। আমি বলছি-- হাসপাতাল থেকে বডি সেনা কার্য্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে নগর অধ্যক্ষ ডোডেজা সৈনিকদের নির্দেশ দিয়ে মুসলমান পাড়ায় হামলা করায়। আর জেলা অধ্যক্ষ রমেশ বহল ড্রাইভারকে একটি ছোট কামরায় দরজা বন্ধ করে বেধড়ক ঠ্যাঙায়। ওর সন্দেহ এটা সুপারি নেয়া কিলারদের কাজ। আর তাদের সঙ্গে যোগসাজশেই ড্রাইভার ওই নির্জন জায়গাটিতে গাড়ি থামিয়ে সোলাংকিকে একলা নামিয়ে দেয়।
    ও এখন হাসপাতালে। কলার বোন ভেঙেছে, আঙুলগুলো থ্যাঁতলানো। পেটে ও মুখে ভাল চোট পেয়েছে। প্রথমে বেল্ট, তারপর হকিস্টিক দিয়ে মারা হয়েছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি, তবে ডাক্তারের ওপিনিয়ন হল---- বেঁচে যাবে।
    অ্যাডিশনাল এস পি বলেন-- পুলিশ পাহারা লাগানো হয়েছে। ও আমাদের ইম্পর্ট্যান্ট ক্লু!
    --- ইম্পর্ট্যান্ট ক্লু! আপ কল রাতকো কহাঁ থেঁ, জনাব?
    ডিজিপি'র গলায় তিক্ত ব্যঙ্গ ঝরে পরে।
    --- আমি স্যার রাত্তিরে ভাটাপাড়া গিয়েছিলাম। মানে সব কিছু তো ঠিকঠাকই ছিল। কে জানতো যে এমনি একটা----।
    --- হ্যাঁ, ভাটাপাড়া যেতেই পারেন। নিশ্চয়ই ভাইঝি বা বোনপো'র অন্নপ্রাশন, নয় পৈতে, নয় বিয়ের এনগেজমেন্ট! কি, ঠিক বলছি না?
    নাঃ, সি এম কিছু ভুল বলেন নি। আপনাদের গোটা ডিপার্টমেন্ট নাকে তেল দিয়ে ঘুমুচ্ছে!
    সবাই চুপ। কিন্তু সবার মনে একই চিন্তা। ডিজিপি সায়েবের "" আপনাদের'' ডিপার্টমেন্ট না বলে "" আমাদের'' ডিপার্টমেন্ট বলা উচিৎ ছিল।
    উনি নিজেই কাল শহরে ছিলেন না। রায়গড়ে কবি সম্মেলন শুনতে গিয়েছিলেন। সেই নিয়ে যে সি এম খুব খুশি ন'ন, এটা আমলারা সবাই জেনে গেছে।

    -- সেই মারাঠি ভদ্রলোককে ইন্টারোগেট করা হয়েছে কি?
    প্রশ্ন করেছেন মাওবাদী বিরোধী অভিযানের ভারপ্রাপ্ত অতিরিক্ত ডিজি রাজশেখর।
    টাকমাথা ভদ্রলোক উত্তর দিলেন-- হ্যাঁ, করা হয়েছে বৈকি! টি আই, (সিভিল লাইনস্‌) এবং এস পি( রায়পুর) শুরুতে, তারপরে আমি।
    --- আমি জানতে চাইছি উনি ওনার বাড়ির কাছে তাঁতিয়াপাড়ার মোড়ে না নেমে আরো এগিয়ে ওই শুনসান মাঠের পাশে নামলেন কেন?
    --- এই একই প্রশ্ন আমিও করেছি। উনি বললেন যে সোলাংকিজী অনেক কথা বলছিলেন। যেমন উনি আসন্ন নির্বাচনে দাঁড়াতে চান। ওনার জেতার সম্ভাবনা কি রকম, কি ধরণের ভোট পাবেন, এইসব। এর মাঝে বাধা দেয়া অভদ্রতা হত, তাই একটু এগিয়ে নামতে হল, এই মাত্র।
    ----- ওনার ঘর সার্চ করা হয়েছিল?
    আই জি'র প্রশ্ন শুনে ডিজিপি ভুবনমোহন মুখ বাঁকালেন। কিন্তু উনি কিছু বলার আগেই তড়িঘড়ি জবাব এলো এস পি রায়পুরের কাছ থেকে।
    -----আমি নিজে গিয়েছিলাম স্যার। সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায় নি।

    ৬)
    একটি পুরনো বাড়ির দোতলায় টালির ছাওয়া ঘর। দুটো জানলা, একটা দরজা। সামনে একফালি ব্যালকনি। ঘরের মধ্যে নেয়ারের খাট। জানলার পাশের দেয়ালে পেরেক থেকে ঝুলছে একটি আয়না।একটি পুরনো আলমারি। তাতে জামা কাপড়, কিছু কাগজপত্র, ব্যাংক আর পোস্টাপিসের দুটো পাসবই। উল্টো দেয়ালে একটি টেবিলে কিছু বইপত্তর, লেখার সরঞ্জাম। পাশে শস্তা কাঠের র্যাটকে কিছু বই। পাটিগণিত, অ্যালজেব্রা, নেসফিল্ডের গ্রামার। আবার শেকসপীয়র, প্যালগ্রেভের গোল্ডেন ট্রেজারি। পু ল দেশপান্ডের নাটক। কিছু মারাঠি, ইংরেজি পত্রিকা। সার্চ করা হল বিছানার তলা, বাথরুম, তোষকের ভাঁজ। টেবিলের সংলগ্ন ড্রয়ারে দাড়ি কামাবার সরঞ্জাম, কিছু পেনের রিফিল, একটা এক্সার্সাইজ খাতা, দুটো বড়সাইজের ম্যাগনেট ও একটা বড় আতসকাঁচ। পাওয়ার বেড়েছে, ছোট অক্ষর পড়তে লাগে।

    নাঃ, সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া যায় নি।

    কাজের মধ্যে পাড়ার বাচ্চাদের নামমাত্র পারিশ্রমিকে ইংরেজি ও অংক পড়ান। রাত্তিরে একটু দূরে আকবর হোটেলে খেতে যান। তারপর পায়ে হেঁটে বাড়ি ফিরেন।
    মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেটি একটি দুর্ঘটনায় মারা যায়। স্ত্রী তারপর থেকেই ডিপ্রেসনের শিকার। পান্ধারপুরে বাপের বাড়িতে থাকেন।
    নাঃ, সন্দেহজনক কিছুই পাওয়া গেল না।

    মিটিং শেষ হল তিনজনের একটি কমিটি বানিয়ে যার সদস্য হলেন ইন্টেলিজেন্সের ব্যুরো চিফ মিঃ পার্থসারথি, অতিরিক্ত ডি জিপি রাজশেখর আর চেয়ারম্যান অবশ্যই রাজ্যের ডি জি শ্রী ভুবনমোহন। সাতদিনের মধ্যে কমিটি গোপন রিপোর্ট পেশ করবে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে। সামনে নির্বাচন। এর বেশি সময় কমিটিকে দেয়া যাবেনা-- ওনার স্পষ্ট আদেশ।
    সাতদিন পরে রিপোর্ট হাতে নিয়ে বৈঠকের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রীর মেজাজ খারাপ হয়ে গেল।
    --- এটা কি? তদন্ত রিপোর্ট না প্রোব্যাবিলিটির অংক? আমি জানতে চাইছিলাম খুনটি কে করেছে? আপনাদের লিস্টি হিসেবে অন্ততঃ চারজন সম্ভাব্য খুনী! ইয়ার্কি পেয়েছেন! না পারলে রিটায়ারমেন্ট নিয়ে নিন।
    ( এটা ডিজিকে)।
    আর মিঃ পার্থসারথি, আপনাকে এম পি'র পুলিশ ট্রেনিং স্কুল থেকে লিয়েন এ এনে কি লাভ হল?
    খানিকক্ষণ পরে গুস্‌সা কমলে সি এম ব্লাডপ্রেসারের বড়ি খেয়ে দুগ্লাস জল খেয়ে গুম হয়ে দু' মিনিট বসে থাকলেন। জোরে জোরে নিঃশ্বাস নিলেন। তারপর বল্লেন-- ও কে, এই অর্থহীন রিপোর্টের থেকে কোন গুঢ় অর্থ বেরোয় কি না দেখি! ভুবনমোহনজী, আমাকে সাহায্য করুন।
    ---- দেখুন, স্যার!। রিপোর্ট বলছে প্রায় বুকে ঠেকিয়ে করা পয়েন্ট ৩৮ ক্যালিবারের দুটো গুলিতে ভিকটিমের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয়েছে। হাতিয়ার পাওয়া যায় নি।
    আমাদের দেখতে হবে কারা ওই সময় সোলাংকিকে গুলি করার অবস্থায় ছিল। আর তাদের মোটিভ কি হতে পারে? এবার লিস্টটা দেখুন।

    বিকাশ রঞ্জনেকর; ৭০ বছরের মারাঠি ভদ্রলোক। সম্ভবতঃ উনিই সোলাংকিকে শেষবার জীবিত অবস্থায় দেখেন। উনি সোলাংকিকে গুলি করবার জন্যে সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন।
    কিন্তু কেন? কোন স্পষ্ট মোটিভ নেই। কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নেই। আর মাত্র সেই রাতেই উনি সোলাংকির কাছাকাছি আসতে পেরেছিলেন। তাও ঘটনাচক্রে।
    সোলাংকির ড্রাইভার। ওর কথায় মাতাল সোলাংকিকে ও রাস্তায় নামিয়ে দিয়ে সোজা বাড়ি গেল কেন? কেন ডোডেজা বা বহলকে মোবাইলে জানালো না? কে বলতে পারে ও একটু পরেই ফিরে এসে নিজে সোলাংকিকে মেরেছে কি না! অথবা কোন উগ্র মুসলিম গ্রুপের সুপারি দেয়া লোক ওর যোগসাজসে কাম ফতে করেছে! আমাদের মতে ও হল একনম্বর সন্দেহভাজন লোক।
    রমেশ বহল। শংকর সেনার জেলা অধ্যক্ষ। অত্যন্ত উচাকাঙ্ক্ষী। নুমেরো উনো হতে চায়। যদি সোলাংকি আগামী নির্বাচনে টেকনিক্যাল কারণে দাঁড়াতে না পারে তাহলে শংকরসেনার রায়পুর কেন্দ্রে ওর প্রার্থী হওয়া প্রায় নিশ্চিত।
    আমাদের কাছে খবর আছে যে গতসপ্তাহে হাইকোর্টের জজকে রবীন্দ্রপান্ডে মার্ডার কেসে সোলাংকিকে পয়সা নিয়ে ছেড়ে দিলে জজের কাম তামাম হবে বলে যেসব উড়ো ধমকি এসেছে তার পেছনেসম্ভবতঃ এই রমেশ বহল।আর সোলংকির ড্রাইভার হল রমেশের পাড়ার ছেলে।

    ডোডেজা। শংকর সেনার প্রভাবশালী রায়পুর ইউনিটের অদ্যক্ষ। পুরো নেট ওয়ার্ক ওর নিয়ন্ত্রণে। তড়িঘড়ি দাংগা লাগানোর প্ল্যানটা ওর। হয়তো বহলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে কান্ডটি করিয়েছে। মোটিভ? সেই ক্ষমতার লোভ।
    কোন অজ্ঞাত উগ্রবাদী নেট ওয়র্ক, ঝোপ বুঝে কোপ মারতে চাইছে।

    ৭)
    বিকাশ রঞ্জনেকরের দোতলার চিলেকোঠায় আবার টিউশন শুরু হয়েছে। শুরুতে পাড়ার লোকে খুব অবাক হয়েছিল। এই নিরীহ লোকটিকে এরা পাঁচ বছর ধরে চেনে। শুরুতে পাড়ার মমতা ভোজনালয়ে খেতে যেত। গত দু'বছর ধরে একটু দূরের আকবর হোটেলে খেতে যায়, তাও রাত্তিরে। দুপুরে ঘরেই কিছু ভাতে ভাত ফুটিয়ে আচার দিয়ে খেয়ে নেয়, বোধহয়। পোস্টাপিসে মাঝে মধ্যে যায়। কখনও সখনও মহারাষ্ট্র ব্যাংকে।
    কারও সাতে নেই, পাঁচে নেই , এমন লোককে পুলিশ কেন নিয়ে গেল?
    পরে বুঝলো সামান্য জিগ্যেসবাদ-খানাতল্লাসী। ওনার সঙ্গেই সোলাংকিজী রাত্তিরে পায়চারি করছিলেন যে! যাহোক, কলিযুগে কখনও সখনও সত্যের জয় হয়। এবার হয়েছে, ওনাকে ছেড়ে দিয়েছে।

    আজ রাত্তিরে বিকাশের ঘুম আসছে না। আকবর হোটেলে আজ আবার খাবার সময় পাশের টেবিলে প্রয়াত সোলাংকিজীর দুই সাগরেদ। সেই ডোডেজা আর বহল। সঙ্গে কিছু নতুন চেলা-চামুন্ডা। টুকরো টাকরা কথাবার্তা যা কানে আসছে তাথেকে বুঝলেন যে সন্তানহীন সোলাংকিজীর সাম্রাজ্যের ভাগ-বাঁটোয়ারা শুরু হয়ে গেছে।
    মহাসমুন্দ শহরের নাইটিংগেল বার ও রায়পুর শহরের দুটো ইউনিয়ন, পনেরোটা দোকান একটি গাড়ি পেয়েছে ডোডেজা আর্ভিলাই রোডের ওপর থ্রি-স্টার হোটেল, চারটে লজ, আকবর হোটেল ও সোলাংকিজীর বাড়ির দোতলার ভাগ পেয়েছে রমেশ বহল।
    বিধবা পত্নীর কপালে জুটেছে বসত বাড়ির নীচের অংশ, ওই অলুক্ষুণে গাড়ি আর ২৫ লাখ টাকা। ওনার ভাই এসে দিদির প্রাপ্য অংশ বুঝে নিয়ে ব্যাংকে টাকা ফিকস্‌ড করে দিয়েছে। তবে নিঃসন্তান দিদির সমস্ত ফিকস্‌ড ডিপোজিটে নিজের ছেলেকে নমিনি করতে ভোলেনি।
    যাকগে, মাসে যা সুদ পাওয়া যাবে তা মন্দ নয়। নিজের বাড়ি গাড়ি থাকা একজন বিধবার খাইখরচের জন্যে যথেষ্ট। কিন্তু বিকাশের কানে আসছিল এই ভাগাভাগিতে তিনপক্ষের কেউই খুব সন্তুষ্ট নয়।
    বেরুনোর সময় কাউন্টারে পেমেন্ট করে মৌরি নিয়ে মুখে ঢালার সময় মুখোমুখি হয়ে গেলেন শংকর সেনার টপ অর্ডারের। উনি নমস্কার করে বল্লেন-- সব কুশল-মঙ্গল তো?
    আশ্চর্য! এরা কেউই ঠিক করে জবাব দিল না। একটু যেন তাড়াহুড়ো করে বেরিয়ে গেল।
    কাউন্টারে ট্রানজিস্টরে বাজছে পাকিস্তান রেডিওতে মেহদী হাসান।
    - "" কিঁউ মুঝসে খফা হো গয়ে অয় জানে তমন্না। ভিগি হুয়ি মৌসম কে মজা কিঁউ নহীঁ লেতে?''
    ঘুম আসছে না। উঠে গিয়ে চোখে মুখে জলের ছিটে দিলেন। তারপর লো ভল্যুমে ট্রানজিস্টরে একটি স্টেশন খুললেন।
    রেডিও পুণের ঘোষক জানাচ্ছেন এখন আপনারা শুনবেন মারাঠী নাট্যসংগীতের প্রোগ্রাম। খানিকক্ষণের মধ্যেই ছোট্ট ঘরটিতে খেলা করতে লাগলো সরস্বতী রাণের রেওয়াজি গলায় একটি বহু পুরণো নাট্যসংগীত। বিকাশ চমকে উঠলেন। এই গানটি শুভদার বড় প্রিয় ছিল। নিজেও ভাল গাইতো। পুণের সারদা সংগীতকলা বিদ্যাপীঠের ভাল ছাত্রী ছিল। সেই কলেজের বার্ষিক উৎসবের সময় গান শুনতে গিয়েই তো পরিচয়। বিকাশ তখন পুণের ফার্গুসন কলেজে পদার্থবিদ্যার ফাইনাল ইয়ারের ছাত্র। সে'সময় সারদা সংগীতকলা বিদ্যাপীঠের অ্যানুয়াল ফাংশন শোনা পুণের কলেজের ছাত্রদের মধ্যে একটা ক্রেজ ছিল। তারপর অনেক কিছু।
    বাপ-মার অমতে বিয়ে। জীবনসংগ্রাম। চাকরি পাওয়া এবং খোয়া।
    সেই সব দিনে বিকাশ শুভদাকে শোনাতেন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা।
    ""আমরা দু'জনা স্বর্গ-খেলনা গড়িব না ধরণীতে''।
    শুভদার বড় ভাল লেগেছিলো কথা গুলি।
    ও শোনাতো একটি গজল।
    "" ম্যাঁয় দেখুঁ তো দুনিয়া তুমে ক্যায়সে সতাতী হ্যায়! তুম আপনী রঞ্জ-ও-গম, আপনী পরেশানী মুঝে দে দো''।
    ( দেখবো তো এই জগৎ তোমায় কি করে গো ব্যথা দেয়! তোমার যত জ্বালা-যন্ত্রণা সব আমাকে দাও।)
    কোলকাতায় ট্রান্সফার নিলেন। শুভদা শিখলো কিছু বাংলা গান। গাইতো--
    "" পাড়ি দিতে নদী হাল ভাঙে যদি শূণ্য পালের কাছি, মৃত্যুর মুখে দাঁড়ায়ে জানিব তুমি আছ আমি আছি।''
    কিন্তু কোথায় যেন আস্তে আস্তে ফাটল ধরছিল। ক্রমশঃ সেই ফাটল বাড়তে লাগল। দুজনার জগৎ ধীরে ধীরে আলাদা হতে লাগল।
    কোলকাতায় এসে কখন যেন বিকাশ বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পরলেন।
    শুভদার ছোট ভাই পুণেতে শংকর সেনার ছাত্রনেতা। শুভদা নিজে ভগিনী মন্ডলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।
    প্রথম দিকে এগুলো নিয়ে হাসাহাসি হত। কিন্তু একদিন বিকাশ বল্লেন- শিবজীকে নিয়ে তোমরা বড় বাড়াবাড়ি কর। উনি একটি কৌমের প্রতিনিধি ছিলেন। আদৌ স্বতন্ত্র ভারতের জন্যে লড়াই করেন নি, করেছিলেন নিজের জাগীর এর জন্যে।
    শুভদা রবীন্দ্রনাথের "" শিবাজী উৎসব'' থেকে কোট করলেন-- "" এক ধর্মরাজ্য পাশে খন্ডচ্ছিন্ন-বিক্ষিপ্ত ভারত বেঁধে দিব আমি''।
    বিকাশ তখকার মত চুপ করলেও খোঁচা দিতে ছাড়েন নি। শেষে শুভদাকে খুশি করতে কোলকাতা ছেড়ে মুম্বাই ট্রান্সফার নিলেন।
    ততদিনে ছেলে হয়েছে মিলিন্দ।
    মুম্বাইতে এসে সম্পর্কের মধ্যে তিক্ততা বাড়তে লাগলো। শুভদার ওপর তার বড় ভাইয়ের প্রভাব যেন ম্যাজিকের মত কাজ করতো। ও তখন কামগার সেনার বড় নেতা। দিদিকেও নিয়ে গেল শংকর সেনার মহিলা শাখায়।
    বিকাশ বিচলিত।
    -- তোমার কি মাথা খারাপ হল? তুমি একজন লেখাপড়া শেখা সুক্ষ্ম অনুভূতি সম্পন্ন সংবেদনশীল মহিলা। কি করে ও'রকম কম্যুনাল অর্গানাইজেশনে যোগ দিলে?
    ---- কম্যুনাল কাকে বলছ? তোমার পার্টি কেরালায় মুসলিম লীগের সংগে হাত মেলায় নি? আসলে তোমরা বামপন্থীরা হচ্ছ স্যুডো! মাইনরিটি কে তেল লাগানো তোমাদের নীতি।
    শেষে ছোট মিলিন্দ এসে বলতো-- তোমরা চুপ করবে? আচ্ছা, তোমরা এত কী নিয়ে ঝগড়া কর? আয়ে দিন? আমি তো কিস্যু বুঝতে পারি না।
    -- সব আমার কপালের দোষ। আর দোষ হল তোর বাবার কোলকাতার আপব্রিংগিং এর। আমার আগেই বোঝা উচিৎ ছিল। ভাই ঠিকই বলতো--- তেলে জলে মিশ খায় না।
    এবার বিকাশ রেডিওর নব ঘুরিয়ে কোলকাতা ধরলেন।
    চেনা গান--- ""কার মিলন চাও বিরহী!''
    উঠে গিয়ে কাঠের আলমারি থেকে বের করলেন একটি পাতা আলগা হয়ে যাওয়া পুরনো অ্যালবাম। হলদে হয়ে যাওয়া কিছু সাদাকালো ফোটোগ্রাফ, গোটা কয়েক রঙিন ফোটো।
    একটি হলদেটে ছবিতে শুভদা কলেজের দিনে, দুই বেণী করা, মারাঠি কায়দায় কোঁচা দিয়ে শাড়ি পরে হাসছে। বিয়ের দুটো ছবি, এখনো মনে হয় সেদিনের কথা। আর মিলিন্দ, শুভদার কোলে, হাসপাতাল থেকে এসে। ওর মুখেভাত, মামা খাইয়ে দিচ্ছে। স্কুলের পোষাকে, মায়ের হাত ধরে। তার পরের পাতা গুলো খালি।
    আজ থেকে দশবছর আগে, ঠিক এই দিনে, মিলিন্দকে হারিয়েছেন, মুম্বাই শহরে একটি দুর্ঘটনায়।
    তার দু'বছর পরে শুভদা সরে গেলেন- বরাবরের মত।

    ৮)
    রাজ্য ইন্টেলিজেন্সের সরকারি অফিসটি সিভিল লাইন্স পাড়ায়। কিন্তু ওখানে খালি স্ট্রিকটলি অফিসিয়াল মিটিংগুলো হয়। আসল অফিসটি বৃটিশ ঐতিহ্য মেনে নতুন গড়ে ওঠা মহাবীর রিজেন্সির ভেতরে একটি সাদামাটা দোতলা বাড়িতে। একতলায় একটি ছোট সাইন বোর্ড, তাতে লেখা সমাচার এজেন্সি। গেটে কোন চৌকিদার নেই।
    কিন্তু অতিসাধারণ দেখতে জনা ছয়েক কর্মচারী আছে যাদের দেখলে প্রথম নজরে ঠাকুর,চাকর বা
    মালি বলে ভুল হতে পারে।
    পার্থসারথির বেশির ভাগ সময় এখানেই কাটে।
    গত সাত মাসেও বিক্রম সোলাংকি খুনের কোন কিনারা হয় নি। চিফ মিনিস্টার একটাই কথা বলেন। ---- আমার রেজাল্ট চাই, রেজাল্ট! খালি শুকনো কথায় চিঁড়ে ভিজবে না।

    দোতলার একটি কামরায় এসি চলছে, কিন্তু পার্থসারথি স্বস্তি বোধ করছেন না। নাঃ, র কোর্স করে দুমাসে ওজন কমেছে মাত্তর তিন কেজি, কোমরের বেড় দু'ইঞ্চি। ওরা যে বলেছিল-
    ছ'কেজি কমবে আর ন্যাদাপেট ও চার ইঞ্চি কমবে! টাকা তো নিয়েছে একগাদা। ডেপুটি মিঃ পটেরিয়া ঠাট্টা করে বলেছেন-- স্যার , আপনার ছ'কেজি মাংস কমাতে ওরা যা টাকা নিচ্ছে সে হিসেবে
    আপনার মাংস পাঁঠা, খাসি বা মুরগীর চেয়ে কত বেশি দামি তা হিসেব করেছেন?
    কথাটা মন্দ বলেনি। তবে ওরা বলেছিল - দেখিয়ে,
    মোটাপা কম কর্‌না লাইফ স্টাইল কা সওয়াল
    হ্যায়। সির্ফ ব্যায়াম হী নহী, ভোজন হী নহী,
    টেন্‌শন ভী কম হোনা হ্যায়।
    এই পেশায় শালার টেনশন কোত্থ্‌থেকে কম হবে?
    এখন উনি আর পটেরিয়া টেবিলের ওপর বিছিয়ে রেখেছেন একগাদা ফাইল আর কিছু কাগজ। আলোচনার মাঝে কখনো কাগজে আঁকিবুকি
    কাটছেন। কখনো বিরক্তিতে হাত ঝেড়ে উঠে পায়চারি করছেন বা ইনস্ট্যান্ট কফি খাচ্ছেন।
    -- হ্যাঁ , যদি ড্রাইভার কাজটি করে থাকে তাহলে প্রশ্ন ওঠে ও রিভলবারটি পেল কোথায়? আর যদি ধরে নেই বাইরে থেকে কেউ দিয়েছে, তাহলে ভাবতে হচ্ছে ব্যাটা লুকিয়ে রেখেছিল কোথায়? ধরে নিলাম হোটেলে যখন খাওয়া দাওয়া চলছিল ?
    -- হ্যাঁ,ও তো রাস্তায় গাড়িতে বসেছিল। তখন কেউ ইজিলি সাপ্লাই দিতে পারে। বাঁধা দ্রাইভার । গাড়ির মধ্যের কম্পার্টমেন্টে লুকিয়ে রাখলেও কেউ সন্দেহ করবে না।
    -- সে বেশ! কাজ হয়ে গেলে হাতিয়ার কোথায় সরালো? বাইরে কোথাও ফেললো? ধর খারুন নদীতে?
    --- না, স্যার! ঘটনার আন্দাজ কুড়ি মিনিটের মধ্যে যখন ডোডেজাদের ফোন এল তখন ও বাংলোতেই ছিল। খারুন নদী গিয়ে এত কম সময়ে ফিরে আসা সম্ভব নয়।
    --- ওর কামরাও তো ভালো করে সার্চ করা হয়েছে।
    --- স্যার, ও কিন্তু আর্থিক কষ্টে আছে।
    সোলাংকির চ্যালা চামুন্ডারা ওকে পেঁদিয়ে লাট করার পর ওকে কেউ চাকরি দিচ্ছে না। ফলে ও তখতপুরে শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে ক্ষেতে কাজ করছে। আর লোক্যাল থানায় নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছে।
    --- তাহলে পেশাদার কোন এক বা একাধিক লোকের কাজ? সুপারি কিলার্স্‌? তুমি কি বল? কিন্তু সোলাংকি যে ওই নির্জন মাঠের কাছে নেমে পায়ে হাঁটবে সেটা তো মৃত্যুর পাঁচ
    মিনিট আগে ও নিজেও জানতো না। ভাড়াটে লোক কি করে জানবে?
    -- হয়তো সেদিন ওকে গাড়ি নিয়ে ফলো করে ছিল। সুযোগ পেয়ে গেল।
    --- অথবা, ড্রাইভার মিথ্যে কথা বলছে। হত্যাকারীরা রোজকার বাড়ি ফেরার রাস্তায় ওৎ
    পেতে ছিল।
    --- তাহলে ড্রাইভার আজ এত মাস পরেও আর্থিক কষ্টে কেন? তখতপুরে ছোটখাট দোকান খুলে বসতো না? যারা এই কাজ করিয়েছে তারা কোন অ্যাডভান্স দেয় নি ?
    নাঃ, নতুন করে ভাব। ওই মারাঠি? আপলা মানুস? ও শস্ত্রটি কোথায় রাখবে?
    --- স্যার, ওর তো কোন মোটিভ দেখা যাচ্ছে না।
    --- ধ্যাত্তেরি! মোটিভ পরে দেখা যাবে। তুমি আমি ওকে কতটুকু চিনি? আগে মোডাস
    অপারেন্ডি কি হতে পারে ভাব!
    -- না, স্যার! বাত কুছ জম্‌ নহী রহা। ও লোকটিই বা কি করে জানবে যে সেদিন সোলাংকি
    ওকে হটাৎ গায়ে পড়ে লিফট্‌ দিতে চাইবে?
    রোজই তো আকবর হোটেলে খায়, আর ওখানেই সোলাংকিদের রাতের আড্ডা। কই, বাকি দিন তো ওকে কেউ লিফট দেয় নি!
    হটাৎ পার্থসারথি লাফিয়ে উঠলেন।
    -- আরে হ্যাঁ, ওই আকবর হোটেলে ক্যামেরা ফিট করা আছে না? আমি এস পি কে বলেছিলাম ওই হোটেলের ঘটনার দিন থেকে আগের একমাসের সন্ধ্যে ছ'টার থেকে হোটেল বন্ধ হওয়া অব্দি তোলা ফিল্মের কপি আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে। গত কাল সেগুলো এসে গেছে। চল, পাশের প্রোজেকশন রুমে গিয়ে সেগুলো ভাল করে দেখি।

    দুজনে উঠে প্রোজেকশন রুমে গিয়ে ভাল করে ১৫ দিনের ফিল্ম দেখলেন। কখনো ফার্স্ট ফরওয়ার্ড করে, কখনো স্লো মোশনে। কখন যে ছ'ঘন্টা গড়িয়ে গেছে খেয়াল নেই। ইতিমধ্যে দুবার সম্ভর বড়া একবার ইডলি আর অন্ততঃ চারবার কফি এসেছে।
    শেষে ক্লান্ত হয়ে বল্লেন-- সেই ত্থোড় বড়ি খাড়া আর খাড়া বড়ি থোড়! দ্যুৎ, নিকুচি করেছে। বাকিটা কাল দেখব।
    --- হ্যাঁ, স্যার! সেই ওদের তিনজনে বা কখনও চারজনের বিশেষ টেবিলে বসা, মদ খাওয়া, বড় বড় বাকতাল্লা মারা। সেই মারাঠি বিকাশ বাবুর এককোণায় বসে ধীরে ধীরে রুটি চিবুনো বা কখনো পত্রিকা পড়া। আর কখনো ওদের চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়ে ওদের দিকে বড় বড় চোখে দেখা।
    হ্যাঁ, পনের দিনের মধ্যে দু'বার অন্য কাস্টমারের সঙ্গে হাতাহাতির ছবিও আছে। ওই যে স্যার ধমতরী থেকে দরকারী কাজে রায়পুরে আসা বাপ-ছেলেকে ওরা ওদের রোজকার টেবিল খালি করেনি বলে বেদম পিটেছিল, মনে আছে? ওই যে যেটায় ওরা প্রথমে পুলিশে শিকায়ত করেও পরে ভয় পেয়ে উইথড্র করেছিল? আরে যা ফুটেজ্‌ আমাদের হাতে এসেছে তাতে শঙ্কর সেনার হোমরাচোমরাদের কনভিক্‌শন হয়ে যাবে।
    কিন্তু পার্থসারথি কিছু অন্যমনস্ক। পটেরিয়ার সাজেশন হাত নেড়ে মাছি তাড়ানোর মত করে উড়িয়ে দিলেন।
    --- শোন, আমরা এখানে শঙ্কর সেনাদের বুক করতে আসিনি। আমাদের দায়িত্ব হল সোলাংকির আততায়ীদের খুঁজে বের করা।
    হ্যাঁ, এটুকু বলতে পারি এই ফুটেজ দেখা একেবারে ফালতু যায় নি।
    ---- আপনার মাথায় কিছু এসেছে। নেকস্ট স্টেপ কি হবে?
    --- কুমীর গভীর জলে আছে, ঘাপটি মেরে। খেলিয়ে তুলতে হবে।
    --- মানে?
    -- আরে, তোমার বিলাসপুরে তখতপুরের কাছে এক গাঁয়ে খুব চালাক মানুষখেকো এক কুমীরের কথা মনে পড়ছে? যাকে বনবিভাগের গানম্যান গিয়েও মারতে পারছিল না? যে দিনের বেলায় কখনও ভেসে উঠতো না? কিন্তু মাঝরাত্তিরে উঠে হাওয়ায় ফুসফুস ভরে নিয়ে আবার জলের তলায় লুকিয়ে পড়তো?
    টোপ দিতে হবে। দেখা যাক, যদি গেলে!
    চল, কালকে রমেশ বহলের বাড়ি গিয়ে চা খাব। ওকে খবর দাও যাতে সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ বাড়িতেই থাকে।

    ৯)
    রমেশ বহল ভাগের টুকরোয় প্রাপ্ত বিক্রম সোলাংকির প্যালেসিয়াল বাড়ির দোতলায় শিফ্ট করে গেছেন। বাড়ির সাইড গেট দিয়ে এ¾ট্রান্স্।
    সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতেই সোনালী রঙের গোল্ডেন রিট্রিভার ""ঘাঁউ'' করে সম্বর্ধনা দিল।
    কোসার পাঞ্জাবী-কুর্তায় রমেশকে মানিয়েছিল বেশ। সামনের বিশাল ব্যালকনিতে বেতের
    সোফাসেট। তবে কফি টেবিলটি কাঁচের।
    চা এল খাস পাঞ্জাবী দা,অনেকটা মালাইওলা দুধ দিয়ে তাতে আবার দারচিনি-লবঙ্গ দেয়া।
    প্রশ্ন করছিলেন মিঃ পটেরিয়া।
    --- আপনার মনের অবস্থা বুঝতে পারছি। আপনি এখনো বসের ওই রকম ডেথকে মেনে নিতে পারেন নি।
    রমেশজী মাথা নাড়েন।
    --- আচ্ছা, ওই ড্রাইভারটি তো আপনারই পাড়ার।
    ---- উঃ, ওই এককথা আমাকে কতবার জিগ্যেস করা হবে?
    --- আপনি নিশ্চয়ই চান যে আপনার বসের মার্ডারার ধরা পড়ুক।
    --- তাতে আপনার কোন সন্দেহ আছে?
    --- তাহলে আশা করব যে আপনি আমাদের সঙ্গে সব রকম সহযোগিতা করবেন।
    --- করছি না কি? কিন্তু ড্রইভার যে আমার পাড়ার ছেলে, ওকে যে কিছু মাস আগে আমিই চাকরিতে ঢুকিয়ে ছিলাম এটা আপানা দের আগে ওই ঘটনার দিন থেকে অন্ততঃ একশ'জন জিগ্যেস করেছে। প্রেস, চ্যানেল, এস পি, স্টেশন অফিসার কে নয়? আখবারে ও প্রকাশিত হয়েছে, আপনারা সব জেনে বুঝে ঐ একটা বেতুকী কোশ্চেন দিয়ে শুরু করবেন তারপর আবার আরোপ লাগাবেন যে আমি সহযোগিতা করছি না। আরে বাবা! হম ভি তো ইনশান হ্যায়, হ্যায় কি নহী-- আপলোগহী বাতাইয়ে।
    হাত তুললেন মিঃ পার্থসারথি।
    --- ও কে; আমি অন্য প্রশ্ন করবো। আপনি কেন চান?
    -- কী চাই?
    --- মানে?
    -- মানে খুব স্পষ্ট! উনি মারা গেলে আপনার ষোল আনা লাভ। বেঁচে থাকলে বেশ কিছু
    লোকসান।
    --- আপনার জায়গায় দুসরা কেউ এই কথা বল্লে আমি তার---। অপনি কি জানেন উনি না থাকলে আমি আজ কি করতাম? ইউনিভার্সিটির সামনে পানঠেলা চালাতাম। খুব বেশি হলে ক্যান্টিনের ঠিকে নিতাম। আজ আমি যদ্দূর যা হয়েছি, জেনে রাখবেন বসেরই দয়ায়।
    --- আমিও তো তাই বলছি।
    আচ্ছা! আপনি কি মনে করেন? ওই কান্ডে ড্রাইভারটির কোন হাত থাকতে পারে?
    --- নাঃ, ও বেওকুফ, কিন্তু ইমানদার,বেইমান নয়।
    --- আপনি নিশ্চিত? যে টাকা দিয়ে ওকে কেনা যাবে না?
    --- শও প্রতিশত। এতটুকু খোঁট থাকলে ওকে আমি বসের গাড়ি চালাতে দিতাম না।
    ---- তা অমন ইমানদার লোকটিকে আপনি মেরে তাড়ালেন কেন? এমনিতেই তো
    আজকাল ইমানদারির বাজারভাও কম।

    --- তাড়ালাম এই জন্যে যে ওর বেওকুফিতেই বসের জান গেছে।
    বস আমার নিডর, সাচ্চা হিম্মতওয়ালা, একদম বাহাদুর। কিন্তু সেদিন ড্রিংক একটু বেশি হয়ে গেছিল। ড্রাইভারের উচিৎ ছিল একটু দূর থেকে বসকে কভার করা, আর নয়তো আমাদের রিং করে জানানো যে বস জিদ করে পায়দল চলছেন।
    --- আজকাল ও কি করছে, কেমন আছে--
    তার খোঁজ নিয়েছেন? নাকি ইমানদার ছেলেটিকে শংকরজী বা রামজীর ভরসায় ছেড়ে দিয়েছেন? চাকরি কেড়ে নিলেন তারপর আর কোন দায়িত্ব নিলেন না? এর চেয়ে ওকে চাকরিতে না
    লাগালেই পারতেন?
    --- না, না, আমি উতনা স্বার্থী, খুদগর্জ বুরা আদমী নঈ। আমি ওর একটা নিয়মিত
    মাসোহারার বন্দোবস্ত করে দিয়েছি। কিন্তু এসব কথা আর কাউকে জানাবেন না। সেনার মধ্যেও অনেকে আমাকে ভুল বুঝতে পারে।
    এবার গরজে উঠেছেন মিঃ পটেরিয়া।
    -- আপ উস্‌সে ভি বুরা হ্যায়। চালাকি করে নিজের হাতে মেরেধরে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে পুলিশ ও মিডিয়ার নজর ওর থেকে সরিয়ে নিয়েছেন। তারপর ও যা অমূল্য সার্ভিসটি দিয়েছে তার জন্যে তাকে আর্থিক পুরস্কার ও দিচ্ছেন। ও ইমানদার তো বটেই তবে কার জন্যে সেইটাই ভাবার বিষয়।
    রাগে ও ভয়ে বহলের মুখে খানিকক্ষণ কথা ফুটল না।
    একটু পরে নীচু স্বরে বললো--- আপলোগ ক্যা মুঝকো আভি গিরফতার করেঙ্গে?
    পর্থসারথি ধীরে ধীরে মাথা নাড়লেন।
    এখন ওসব কিছুই করছি না। আমরা শুধু চাই যে আপনি আমাদের সঙ্গে আরও একটু সক্রিয় সহযোগিতা করুন।

    ১০)
    শনিবার রাত্তিরে আকবর হোটেলে খেতে গিয়ে বিকাশ একটু অবাক হলেন। রোজ যে বেয়ারাটি ওনার জন্যে রোটি-সব্জি-আচার-কড়ী-পাঁপড় নিয়ে আসে সে আজ এলো খালি হাতে, তোয়ালেতে হাত মুছতে মুছতে।
    কাছে এসে নীচু গলায় বললো-- আপকো উনলোগ বুলারহে।
    --- কৌন লোগ?
    -- মালিক লোগ!
    ওর ইশারা অনুযায়ী ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন কোণের ঐ বিশিষ্ট টেবিল থেকে হাত নেড়ে ইশারা করছেন রমেশ বহল।
    আর বেশ হাসি হাসি মুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে ডোডেজা ও তার জনাকয়েক সাঙ্গপাঙ্গ।
    বিকাশ মনে মনে ভাবলেন-- কি আপদ! কায়লা? ফালতু কা লফড়া!
    তারপর ধীরপায়ে ওদের টেবিলের কাছে দাঁড়াতেই রমেশ বল্লেন-- আংকল! আমরা , মানে এই
    হোটেলের পেট্রনরা ঠিক করেছি আপনার রাত্তিরের খাওয়াটা ফ্রি করে দেব।
    -- কেন? ফ্রি কেন?
    -- কাকাজী, আপনি আমাদের সম্মানিত ক্লায়েন্ট। গত দু'বছর ধরে নিয়মিত আসেন। অন্য কোথাও যান না। বুজুর্গ আদমী। কোন লফড়া নেই, কোন হল্লা-গুল্লা নেই, দারু-আরু কা চক্কর নহীঁ, না কোঈ লফড়া! কোন বেয়ারাকে গাল-মন্দ করেন নি। ম্যানেজারের কাছে কোন কমপ্লেন করেন নি।
    --- ভালো লোক আরো আছে। আমাকেই কেন? আর ফ্রি তে আমি খাই না। আমাকে সম্মান করলে ফ্রি তে খাওয়ানোর বাত ছোড় দীজিয়ে।
    এবার মুখ খুললেন ডোডেজা।
    --আংকল ! বাত আউর ভী হ্যায়। আমাদের বিছড়ে হুয়ে বসের সম্মানে আমরা একজন
    ক্লায়েন্টকে আজীবন ফ্রি এন্টারটেইন করতে চাই।আপনি বুজুর্গবার, তায় বসের
    অন্তিমদিনে আপনি আর আমরা তো একসঙ্গেই ছিলাম।
    ইসীলিয়ে আপকো চুনা গয়া।
    কিন্তু বিকাশ আস্তে আস্তে দুদিকে মাথা নাড়েন।
    বহল বললেন--- ঠিক আংকল! কোঈ জবরদস্তি নহীঁ। আপ পহলে জ্যায়সা হী খানা খায়েঙ্গে। পর কাল ইতওয়ার কী রাত শরদ পূর্ণিমা হ্যায়। হম আপ একসাথ খানা খায়েঙ্গে--- ইহাঁ। আপকো বসকী তেরহী মেঁ বুলানা থা, হমেঁ চুক হো গয়া থা। পর কালকী প্রোগ্রাম কে লিয়ে আপ মান জাঈয়ে। বসকী আত্মা কো শান্তি মিলেগী।

    রোববার রাত্তিরে খাওয়াটা ভালই হল। কিন্তু বিকাশ অল্পই খেলেন। ওদের অনুরোধ-উপরোধে সবই একটু একটু ছুঁলেন।
    তারপর রমেশ বহল বল্লেন-- চলুন, আংকল! আপনাকে আপনার বাড়ির কাছে রাস্তার ওপর নামিয়ে দেব। আরে আমি তো আজকাল বসের পুরনো বাড়ির দোতলায় থাকি। আপনার গলি তো পথেই পড়ে। আমার কোন অসুবিধা হবে না।
    এবার বিকাশ আর কথা বাড়ালেন না। পরিচয় অনেক সহজ হয়ে গিয়েছে। তাই কালো ফোলিও ব্যাগটি হতে নিয়ে বহলের পাশে বসলেন।
    গাড়ি স্টার্ট হওয়ার পর রমেশ সম্ভবতঃবাড়িতে একটি ফোন করলেন। -- আর কুড়ি মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে যাব।
    গাড়ি চলছে। রমেশ আজ বিশেষ ড্রিংক করেন নি। গল্প শুরু করলেন।
    -- আংকল,ইহাঁ আপকে ঘর মেঁ কোঈ নহী হ্যায় ক্যা?
    -- ছিল। সবই ছিল। ছেলে মুম্বাইতে রেল দুর্ঘটনায় মারা যায়। তার দু'বছর পর ছেলের মা, ক্যানসারে। এখন আমি একা।
    রমেশ মুখ দিয়ে চুক চুক আওয়াজ করে বললেন--- সরি আংকল! আপনাকে এইসব কথা মনে করিয়ে তকলিফ দেয়ার জন্যে।
    ভগবান কেন যে ভাল লোকদের বেশি কষ্ট দেন! প্রভূ কী লীলা সমঝনা--।আরে, আপনার পাড়া তো পেরিয়ে গেছে। ব্যাক করবো?
    -- না, না! আমাকে এই মাঠের পাশে নামিয়ে দিন। আমি হেঁটে চলে যাবো। আমার হাঁটতে ভালো লাগে।
    --- ঠিক হ্যায়, আংকল! আমারও হাঁটতে ভাল লাগে। আমারও বাড়ি বেশি দূর নয়। আমিও আজ হেঁটেই যাব।
    নতুন ড্রাইভার মৃদু প্রতিবাদ করতেই রমেশের মুখ দিয়ে কিছু চোস্ত পাঞ্জাবী গালি বেরিয়ে এল। ড্রাইভার আর কথা না বাড়িয়ে সোজা স্টার্ট নিয়ে বেরিয়ে গেল।
    বড় অশত্থ গাছটার নীচে দুজনে বিদায় নিলেন।
    -- ওকে, আংকল! বায়! এবার তো আমরা উল্টো দিকে যাব।কাল রাত্তিরে আবার দেখা হবে।
    বিকাশ মাথা নেড়ে পেছন ফিরে কালো ব্যাগটির জিপ টানলেন।
    কিন্তু জিপ পুরো খুলে যাওয়ার আগেই গাছের ছায়ার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসেছে তিন
    ছায়ামূর্তি। দুজনের হাতে উদ্যত রিভলবার।
    -- ব্যাগটা ফেলে দিন। আর হাত মাথার ওপর!
    কম্যান্ডিং গলার স্বরটি মিঃ পটেরিয়ার। তৃতীয় ব্যক্তিটি সিভিল লাইনস্‌ থানার এ এস আই। হতভম্ব বিকাশের হাত থেকে ব্যাগ মাটিতে পড়তেই ঝাঁপিয়ে তুলে নিয়ে পটেরিয়ার হাতে তুলে দিয়েছে, আর মুচড়ে ধরেছে বিকাশের হাত। বিকাশ কঁকিয়ে উঠলেন।
    --- ইয়ে ক্যা হো রহাঁ হ্যায়? আপ সব কৌন?
    কেউ উত্তর দেবার প্রয়োজন মন এ করলেন না। সবার চোখ পটেরিয়ার হাতে আসা কালো ব্যাগটির দিকে।
    ব্যাগ থেকে এক এক করে বেরুলো ব্যাংকের পাস বুক। পোস্টাপিসের পাস বুক। রাহুল
    সাংকৃত্যায়নের" দর্শন- দিগ্‌দর্শন''। আর একটি ছোট পানের ডিবে।
    বিমুঢ় পটেরিয়া খালি বল্লেন-- আপনি পান খান? কবে থেকে?
    --- ইদানীং ধরেছি। দাঁতের ডাক্তারের পরামর্শে। ক্যালসিয়ামের জন্যে।

    ১১)
    রায়পুরের এস পি অফিস, বেলা বারোটা। চশমা চোখে ফর্সা হ্যান্ডসাম এস পি মিঃধাওলিয়া গদি আঁটা চেয়ারে বসে সিভিল লাইনস্‌ থানার টি আইয়ের থেকে ইদানীং কালে পুলিশবিভাগের অপদস্থহওয়ার সবচেয়ে রসালো গল্পটি শুনছেন আর তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছেন।
    --- নাঃ, দেখলেন তো! পটেরিয়াকে সাসপেন্ড না করে করলো আমার এ এস আই কে! কত্তাদের একচোখোমিটা দেখুন!
    কারণটা কি? না এ এস আই যে ঐ বুড়োর হাত মুচড়ে ধরেছিল, মানে গায়ে হাত দিয়েছিল! আরে পটেরিয়া যে বুড়োকে পিস্তল দেখিয়েছিল,তারবেলা? ও গরীব বেচারা তো পটেরিয়া সাবকা আদেশ পালন হী কর রহা থা!
    --গরীব কী লুগাই, জগত কী ভৌজাই!
    ( গরীবের বৌ, সক্কলের বৌদি!)
    --- আরে আসল খিলাড়ি হল ওই ব্যাটা তেঁতুল, ওই পার্থসারথি। নিজের চামচাটাকে ঠিক বাঁচিয়ে নিয়ে গেল।
    গত মাসের মিটিংয়ে পার্থসারথি যে তেতো কমেন্টটি করেছিলেন সেটা আজও ধাওলিয়া
    ভুলতে পারেন নি।
    --যাকগে, মরুকগে। তারপর কি হল, সেটা বল! বড়সায়েবদের ব্যাপারই আলাদা! কেউ ক্রাইসিস এর সময় কবিসম্মেলনে দোহারকি দেবেন, কেউ মাসতুতো বোনের পিসতুতো ননদের আইবুড়ো ভাতে গিন্নিকে নিয়ে যাবেন, তাতে কোন দোষ নেই! আর আমাদের বাড়িতে ডেলিভারি হলেও---।
    --- যা বলেছেন স্যার! সে রাত্তিরে তো হতভম্ব পটেরিয়া গাড়িতে করে ভাউকে বাড়ি অব্দি ছেড়ে এল। বল্লো-- ভুল হয়ে গেছে। আর ইশারা করলো এনিয়ে আর কিছু না করতে! কিন্তু
    নতুন বেরুনো "" নঈ দুনিয়া'' পত্রিকার সিটি রিপোর্টার ভেতরের পাতায় কালকে বের করেছে "" আসলী খুনীকো পকড়নে মেঁ নাকাম পুলিশ অব নির্দোষ বুজুর্গবার কো এনকাউন্টার করনে কী ফিরাক মেঁ''। এই দেখুন কাটিং!
    --- কই দেখি! কিন্তু ওই বুড়ো ভাউয়ের স্টেটমেন্ট কই?
    --- সেটাই তো আশ্চর্য্যের! বিকাশভাউ রিপোর্টারের উৎসাহে ঠান্ডা জল ঢেলে দিয়েছে। বলেছে -পুলিশও মানুষ। ওদের জেনুইন মিস্টেক হয়েছে। আমার কোন শিকায়ৎ নেই। আমি মানবাধিকার বা কোন অধিকারে যেতে চাইনে!
    -- তারপর!
    --- তারপর শুনেছি ওই " এভার প্রেগন্যান্ট, নেভার ডেলিভারড্‌' পার্থসারথি নিজে ভাউয়ের বাড়ি গেসলো।
    -- সে তো যাবেই! আসলে ওই চুতিয়া প্ল্যানটা তো ওরই! বেশ হয়েছে, সি এম এর কাছে কড়কানি খেয়েছে। বড় বড় কতা! হল তো?
    -- ""চৌবেজি গয়ে থে ছব্বেজি বননে, লৌট আয়ে দুবেজি বনকর''।
    --- এটা ভাল বলেছো তো! কিন্তু পার্থসারথি আর বিকাশভাউয়ের মধ্যে কি বাক্যালাপ হল কিছু জানতে পারলে?
    -- না স্যার! আর বাক্যালাপ কি হবে, বারবার সরি বলা ছাড়া? তবে ব্যাটা ঘন্টাখানেক ওখানে বসে ছিল।
    -- এক ঘন্টা! পক্কা মালুম? জরা পতা লাগাও।

    ১২)
    ভর দুপুরে পার্থসারথি আর পটেরিয়া এসেছেন বিকাশ রঞ্জনেকরের বাড়িতে। ওঁরা সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার জন্যে বিশেষ অনুতপ্ত। ওনাদের খাটে আর একটি পুরনো কাঠের চেয়ারে বসিয়ে বিকাশ গেলেন ছাদে। কি ব্যাপার! না, কলের জল আসার সময় হয়েছে। ওপরে গিয়ে জলের ট্যাংকের ভালভ্‌ খুলে দিতে হবে। যেহেতু ছাদের চিলেকোঠাসম ঘরে বিকাশ একা থাকেন, ফলে দিনে দুবার ভালভ্‌ খোলা আর বন্ধ করার অঘোষিত দায়িত্ব ওনার কাঁধে এসে পড়েছে, প্রত্যেকবার আউটলেটের ভালভ্‌ বন্ধ করে ইনলেটের ভালভ্‌ খুলতে হয়। পটেরিয়ান কখন ছাদে
    পৌঁছেচেন বিকাশ টের পান নি। লোহার ঢাকনা খুলে একটি পেনসিল টর্চ দিয়ে উনি উবু হয়ে কিছু দেখছিলেন, সম্বিৎ ফিরলো ঘাড়ের কাছে পটেরিয়ার কথায়।
    --- কি দেখছেন ভাউ, আমি একটু দেখতে পারি!
    -- কেন নয়? দেখছি জলের লেভেল। আপনিও দেখুন!
    এবার বিকাশ হেসে এগিয়ে দিলেন ওই পেনসিল টর্চ।
    --দেখে নিন কোন অস্ত্র লুকনো আছে কি না! আমি যদি অপরাধী হই এমন অবভিয়াস জায়গায় লুকিয়ে রাখবো কেন? আপনাদের সিভিল লইনস্‌ থানার পুলিশ আগেই দেখে গেছে। তবু আপনিও দেখুন।
    পটেরিয়ার কাটাঘায়ে নুনের ছিটে পড়লো।
    -- আরে না না, আমি এমনিই জিগ্যেস করছিলাম। আসলে আমার বস্‌ অনেকক্ষণ বসে আছেন কি না! আরো দু'এক জায়গায় যাওয়ার আছে। আপনার কাজ হয়ে গেলে চলে আসুন।

    খাটের ওপর বসে পা দোলাচ্ছেন পটেরিয়া। একটু অস্থির অস্থির ভাব। পার্থসারথি বসেছেন টেবিলের সামনে চেয়ারটিতে। আর বিকাশভাউ গেছেন ঘুপচি রান্নাঘরে লাল চা বানিয়ে আনতে।
    পটেরিয়া হটাৎ উত্তেজিত। একদৃষ্টে দেখছেন কিঞ্চিৎ অগোছালো ঘরের চারদিক। আধময়লা মশারিটি পেছনের দিকে গুটিয়ে রাখা।
    সামনের দেয়ালে একটি পেরেক থেকে ঝুলছে মশারির দড়ি টাঙানোর জন্যে টোয়াইন সুতোর তৈরি ফাঁস। কিন্তু চতুর্থ কোণাটি? দেয়ালে কোন পেরেক বা হুক নেই কেন?
    আরে! জানলার লোহার শিক থেকে ঝুলছে মশারি টাঙানোর জন্যে ফঁস বাঁধা দড়ি। কিন্তু এই ভাবে মশারি টাঙানোতে সিমেট্রির অভাব। মশারিটা টাঙানো হলে আয়তক্ষেত্র না হয়ে ট্র্যাপিজিয়ম হয়ে যাবে না? কেন এমনি হবে? অংক নিয়ে স্নাতক হওয়া পটেরিয়ার ব্যাপারটা ভালো লাগছে না।

    -- স্যার! একটু ভাবুন। জানলাটি দেখেছেন? এই জানলাটি খুলছে ওদিকের বিশাল তিনতলা
    মারোয়াড়ি বাড়ির পেছনের বন্ধ দেয়ালের সরু গলিতে। এখানে সবাই ময়লা ফেলে, অন্য কোন বাড়ির জানলা এদিকে খোলে না। কপাট খুললে সামনে শেঠ বাজোরিয়াদের ছাইরঙা নিশ্ছিদ্র দেয়াল। কাজেই কেউ যদি নীচের কার্ণিশে কোন জিনিস এই জানলার গরাদের ফাঁক দিয়ে সুতো বেঁধে নামিয়ে দেয় তো কেউ দেখতে পাবে না।
    -- তারপর?
    --- ধরুন স্যার, মশারির সুতো দিয়ে নামিয়ে দিল। তারপর ব্লেড দিয়ে সুতোটা কেটে দিল!
    -- তা বেশ , আমরা খুঁজছি একটি স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেন রিভলবার, বেশ ভারি। পরে দরকার মত তুলবে কি করে? এই প্রশ্নটার উত্তর দাও।
    এক যদি ওয়ানস্‌ ফর অল্ হয়। কিন্তু ওখানে ফেলে রাখাটাও বিপদ। আর যদি ওখান থেকে তুলতে চায়? তাহলে? এদিকটা ভেবেছো?
    --- ভেবেছি স্যার!
    পটেরিয়া এবার কঠিন প্রশ্নের উত্তর জানা ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের মত গর্বিত হাসি হাসেন।
    -- উত্তর আপনার সামনেই আছে ,স্যার!
    -- আমার সামনে?
    -- হ্যাঁ স্যার! টেবিলের ওপর জ্যামিতির বই আর নেসফিল্ডের গ্রামারের পাশে আতসকাঁচ আর একটি হর্স শু' ম্যাগনেট দেখুন। সূতোয় ম্যাগনেট বেঁধে ঝুলিয়ে দিয়ে ঐ রিভলবারটিকে টেনে তোলা যাবে না?
    পটেরিয়া উঠে হর্স শ্যু ম্যাগনেটটি নিয়ে জানলার কাছে গিয়ে শিকের থেকে সুতোর ফাঁস খুলে ম্যাগনেটের গায়ে বাঁধতে লাগলেন।
    ---""উৎসাহে কী না হয়, কী না হয় চেষ্টায়?''
    পটেরিয়া চমকে পেছন ফিরলেন।
    দরজায় হাসিমুখে দাঁড়িয়ে বিকাশ, হাতে একটি স্টিলের থালা। তাতে তিনটি ধূমায়িত কাঁচের গ্লাসে লাল চা'।

    --- মানে?
    --- এটি একটি পপুলার বাংলা কবিতার লাইন।
    হিন্দিতে এর মানে "" লগে রহো মুন্নাভাই''। কোলকাতায় চাকরি করার সময় যখন বাংলা শেখার চেষ্টা করতাম তখন বাঙালী বন্ধুরা বলতো। সে যাকগে, আপনার উৎসাহকে দাদ দিতেই হয়! পর আপ ফিজিক্স ক্লাস ঠিকসে নহীঁ কিয়ে ভাইজী!
    ম্যাগনেট বাঁধা সুতো দিয়ে কার্নিশ থেকে কিছু টেনে তুলতে গেলে ম্যাগনেটিক ফিল্ড যে আপওয়ার্ড ফোর্স লাগাবে জিনিসটির ভর, মানে ম্গ তার বিপরীতে ডাউনওয়ার্ড ফোর্স দিয়ে তাকে নীচে টানবে। তবু এক্সপেরিমেন্ট করে দেখুন। হাতে নাতে করার মজাই আলাদা।

    বেলুন চুপসে যাওয়া মুখ করে জানলার কাছ থেকে ফিরে এলেন পটেরিয়া। তারপর যেন কিছুই হয় নি-- এমনি ভাব করে টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখা থালার ওপর থেকে একটি কাঁচের গ্লাস তুলে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। কিন্তু সদ্য তৈরি চা' অনুমানের চেয়ে বেশি গরম ছিল।

    -- নাঃ, থিওরিতে আরো গলদ আছে।
    মুখ খুলেছেন পার্থসারথি। ওঁর চোখে একটু দুষ্টুমি ভরা হাসি।
    --- জানলা থেকে কার্নিশের হাইট? সেটাও ভাবা দরকার। অতক্ষণ ম্যাগনেটিক ফিল্ড অ্যাকটিভ
    থাকবে? এই সাইজের ম্যাগনেটে?
    বিকাশভাউয়ের চোখও হাসছে। কিন্তু গরম চায়ে মুখ পুড়িয়ে পটেরিয়ার মেজাজ একটু তিরিক্ষি।

    -- আচ্ছা, আপনার সায়েন্সে যখন এত টনটনে জ্ঞান তাহলে অন্য সব ব্যাপারে আপনি এত ব্যাক্‌ ডেটেড্‌ কেন?
    --- মানে?
    -- এই ধরুন আপনি টোয়েন্টিফার্স্ট সেঞ্চুরিতে পৌঁছেও মোবাইল রাখেন না। অধিকাংশ সময়
    পায়ে হেঁটে ঘুরে বেড়ান। এটিএম রাখেন না। মাঝে মধ্যে আপনার নামে মানি অর্ডার আসে।
    -- ওরে বাবা! আপনারা তো আমার ওপর রিসার্চ করে ফেলেছেন। তাহলে শুনুন-।-
    মুম্বাইয়ে একটি রেল দুর্ঘটনায় ছেলে মারা যাওয়ার পর থেকে আমার স্ত্রী ডিপ্রেসনে ভুগতে থাকেন। ডাক্তারের পরামর্শে ওঁকে ওর বচপন কা জগহ্‌ এই রায়পুর শহরে নিয়ে আসি। উনি আসলে এখানকার বামন রাও লাখে ওয়ার্ডে জন্মেছিলেন। সাপ্রে স্কুলে পড়েছেন। তারপর ওঁর বাবা ট্রান্সফার হওয়ায় পুণে গিয়ে কলেজে পড়েন। এখানে এসে ওঁর অবস্থার উন্নতি হচ্ছিল।
    কিন্তু দু'বছরের মাথায় ধরা পড়ল ক্যান্সার।

    বিকাশ চুপ করলেন। ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেন জানলার কাছে। সুতোয় বাঁধা ম্যাগনেট তখনও গরাদ থেকে ঝুলছে। খানিকক্ষণ সুতোটা ধরে দোলালেন। তারপর যেন নিজেকেই বলতে
    থাকলেন।
    --- শুভদা চলে যাবার পর কিছুই ভাল লাগছিল না। কোলকাতার জোনাল অফিসে পদত্যাগ পত্র পাঠালাম। চলে এলাম এই রায়পুরে, যেখানে শুভদা বড় হয়েছিল, যেখানে শেষ ক'টি বছর
    কাটিয়েছিল। ওর ইচ্ছে ছিল সেরে উঠে একটা অন্যরকম স্কুল খুলবে, রায়পুর শহরে। কথা দিয়েছিলাম। কিন্তু ওর চিকিৎসায় আমার সারাজীবনের সঞ্চয় প্রায় শেষ। অফিস থেকে ঝড়তি-পড়তি যা পেলাম মহারাষ্ট্র ব্যাংকে রাখলাম। কিছু পোস্ট অফিসে। সুদ যা পাই তাতে একজন বুড়োর খরচা চলে, কিন্তু স্কুল চলে না। তাই টিউশন করি।
    কোলকাতা অফিসে সহকর্মীরা মিলে একটি থ্রিফট ফন্ড খুলেছিলাম। তার ডিভিডেন্ড/সুদ
    সামান্য যা হয় ওখানেরেকজন ক্লার্ক আমাকে পাঠিয়ে দেয়। ও সেকেলে লোক। ইলেকট্রনিক ব্যবস্থার চেয়ে মনি অর্ডারে স্বস্তি বোধ করে।

    মিনিটখানেক সবাই চুপ। পটেরিয়া জিভে আর দাঁতে চুক চুক শব্দ করে বল্লেন-- আজ
    তাহলে উঠি?
    পার্থসারথি এতক্ষণ টেবিলের ওপর ফেলে রাখা জমা খরচের হিসেব আর এলোমেলো করে রাখা বইপত্তর একটু যেন অলস ভঙ্গিতে দেখছিলেন।এবার হলদে হয়েযাওয়া পুরনো খবরের কাগজের মলাট দেয়াএকটি চটি বই হাতে নিয়ে বল্লেন-- এই বইটি কি আমি ক'দিনের জন্যে নিয়ে যেতে পারি?
    --- এ তো বাংলা কবিতার বই, সুকান্ত ভট্টাচার্য্যের ""ছাড়পত্র''! এ নিয়ে আপনি কী করবেন?
    --- আমার গিন্নি বাঙালী, তায় কবিতার ভক্ত।
    বিকাশ একটু অবাক হয়ে পার্থসারথিকে দেখলেন।
    -- বেশ তো, নিয়ে যান।

    ফেরার পথে পটেরিয়া বল্লেন-- স্যর, আমরা একচক্ষু হরিণের মত শুধু একদিকেই তাকিয়ে আছি। মানলাম, শোলাংকিকে হত্যার সবচেয়ে বেশি সুযোগ ওই মিটমিটে শয়তান ভাউয়েরই ছিল। কিন্তু আরেকজনের সবচেয়ে স্ট্রং মোটিভ রয়েছে, তার দিকে আমরা নজরই দিচ্ছি না।
    --- কে সে?
    --- কেন, অ্যাডভোকেট তিওয়ারির শ্বশুরবাড়ির লোকজন! শ্বশুর মালদার পার্টি, রুলিং পার্টিতেও ভাল হোল্ড। ওর জামাইকে শোলাংকির নির্দেশে শংকর পার্টির ক্যাডাররা ওরই ঘরে ঢুকে কুপিয়ে মারল। ওর মেয়ে বিধবা হল। অনেক চেষ্টা চরিত্র করে ও সবকটাকে জেলে পুরলো। কিন্তু আটমাসের মাথায় ওরা একে একে জামিন নিয়ে বেরিয়ে এল।
    আর রায়পুর শহরে বাইরে থেকে সুপারি দিয়ে খল্লাস করা তো নতুন নয়, স্যার!
    পার্থসারথি কি একটু অন্যমনস্ক?
    -- স্যার! ওকে একটু তিওয়ারির শ্বশুরকে কি আমরা একটু কালটিভেট করব না?
    --- হ্যাঁ, কাল দুপুর একটায়। আমি পি এইচ কিউ থেকে ফেরার পরে।
    ---- সকালে নয়?
    --- সকালে আমাকে কটা মেসেজ পাঠাতে হবে, আর কোলকাতায় দু-এক জনের সঙ্গে কথা বলতে হবে।
    পটেরিয়া একটু ঠোঁট ওলটালেন।

    ১৩)
    রিং রোড ধরে অনেকটা এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে গাড়ি ঘোরালে ভি আই পি রোডের শুরু। চওড়া মসৃণ পাকা রাস্তা সোজা গিয়েছে মানা এয়ারপোর্ট অব্দি। রাস্তা ফাঁকাই থাকে, শুধু ফ্লাইট ধরতে ব্যস্ত যাত্রীদের গাড়ি গুলো সাঁ সাঁ করে চলে যায়। রাস্তার দুধারে সারি সারি গুলমোহর, স্যুবাবুল ইত্যাদি গাছের ছায়াঘন পরিবেশ। মাঝে মাঝে একটি দুটি ফার্ম হাউস, বড় বড় বিজনেস হাউসের বোর্ড লাগানো।
    আর আছে আজকালকার হাই- ভোল্টেজ কিছু যোগগুরু-বাবাজিদের প্রাসাদোপম আশ্রম।
    বেলা দুটোর সময় একটি সাদা প্যালেসিয়াল বাড়ির সামনে ইন্টেলিজেন্স বিভাগের মারুতি জিপসী এসে থামলো।
    পটেরিয়া এগিয়ে গিয়ে সিকিউরিটির গোর্খা প্রহরীকে আইডেনটিটি কার্ড দেখালেন। আর
    পার্থসারথি এগিয়ে গিয়ে সোনার বিভ্রম জাগানো হলদে মেটালিক অক্ষরে লেখা ফলকটি পড়তে লাগলেন।
    বাড়ির নাম হোয়াইট হাউস। গেট ও দীর্ঘ মোরম ঢালা পথের শেষে সুন্দর বাড়িটি আপাসমস্তক দামী সাদা রঙে মোড়া। হোয়াইট হাউসই বটে!
    ডানদিকের ফলকে ক্যালিওগ্রাফিক অক্ষরে লেখা
    " সুষমা ত্রিবেদী, অক্ষয় ত্রিবেদী''।
    খানিকক্ষণ ইন্টারকমে কথা বলে গার্ড গেট খুলে দিল। সরকারি জিপসী সোজা পাথরকুচি বিছানো পথ ধরে বাড়ির সামনে পোর্টিকোর নীচে দাঁড়াল।
    সাদা সার্ট প্যান্ট পরা একজন লোক ওঁদের ভেতরে নিয়ে গিয়ে বিশাল ড্রইংরুমে বসাল। এল ঠান্ডা জল, আর কোকাকোলা।
    পার্থসারথি দেখছিলেন দেয়ালে টাঙানো ছবিগুলো। একটা হুসেনের অর্জুন, মোটা ব্রাশের কাজ। আরেকটায় ভিভান সুন্দরম এর বড় সাইজের তেলরঙের কাজ। জ্বলন্ত বাড়ির থেকে বাইরে বেরিয়ে রাস্তায় দাঁড়ানো দিশাহীন মেয়েটি। এবার একটু এগুতেই অবনীন্দ্রনাথের সিন্দবাদ আর নন্দলাল বসুর কংকালসার শিব অন্নপূর্ণার দ্বারে।
    গলা খাঁকারি শুনে পেছন ফিরে যাকে দেখলেন তার জন্যে এরা বিশেষ প্রস্তুত ছিলেন না।
    পাঁচফুটি হাইটের একজন প্রৌঢ় ভদ্রলোক ,আদ্দির তৈরি সাদা শার্ট আর পাজামা পরা। ফর্সা
    মানুষটির হাতে নবগ্রহ আংটি আর গলায় রুদ্রাক্ষের মালা। বেশ বড় বড় দুই চোখে পলক পড়ে না।

    --আপনিই শ্রীমান অক্ষয় ত্রিবেদী?
    --- তাতে আপনার কী?
    -- আপনার কী মানে? আমরা ইন্টেলিজেন্স ডিপার্টমেন্ট থেকে এসেছি। ইনি চীফ, মিঃ
    পার্থসারথি। আমি পটেরিয়া। আমরা বিক্রম সোলাংকি কেসটার ব্যাপারে আপনাদের কো -অপারেশন চাই।
    -- কো অপারেশন? হাঃ-হাঃ-হাঃ! কো অপারেশনের মানে জানেন আপনারা? " হোয়েন উওম্যান কুউ'জ অ্যান্ড ম্যান অপারেটস্‌'' --- এই হল আপনার ছাতার কো অপারেশন! ডেফিনিশন তো শিখলেন। এবার বলুন কেমনিধারা কো অপারেশন চাই আপনদের?
    পুলিশ আর শংকর সেনার কো অপারেশন? না পুলিশ আর মাফিয়ার কো অপারেশন?

    অক্ষয় ত্রিবেদী বিড়বিড় করতে থাকেন।
    -- হুঁঃ, শালে পুলিস কে কুত্তে! পতা নহীঁ ক্যায়সে অন্দর ঘুস গয়ে। হমারে দিন হোতা তো বাহর সে হী খদেড় দেতেঁ। সব বেইমান! সব নেতাও কে ফেঁকে গয়ে রোটি কে টুকড়োঁ সে পালনেওয়ালে!
    পটেরিয়ার কোথায় যেন একটা কিছু ছিঁড়ে যায়। হটাৎ লাফিয়ে ধরে ফেলেন ত্রিবেদীর কুর্তার কলার।
    -- তেরী ইয়ে মজাল! তব সে শুন রহা হুঁ তেরি বকর্‌। মাদর্--!
    ঝাঁকাতে থাকেন আর চেঁচান-- বোল্‌, আউর বোলেগা পুলিস কে কুত্তে! আউর কুত্তে বোলেগা?

    আচমকা এই অভাবিত হামলায় অক্ষয় হতভম্ব, পলকহীন চোখ দুটো আরও বড়বড়। মুখে বাক্যি নেই। কিন্তু প্যাসেজের থেকে ভেসে এল এক চিৎকার।
    --- আরে , বড়ে মালিক পর হাত উঠায়া কুত্তে নে।আবে জলদি আ !
    নিমেষের মধ্যে হলঘরের দুপাশের দুটি বন্ধ দরজা খুলে যায় আর দৌড়ে ঢোকে জনা
    পাঁচেক মুশ্‌কো জোয়ান, দুজনের হাতে লাঠি। কিন্তু ঢুকেই ওরা থমকে যায়।
    কারণ টেবিলের ওপাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়েছেন পার্থসারথি, হাতে ছোট একটি রিভলবার।
    প্রথমেই ধমকালেন পটেরিয়াকে।
    --- ছোড়ো ইনকো, জলদি --ছোড়ো! দিমাগ তো ঠিক হ্যায়?
    --লেকিন স্যার?
    -- কৈ লেকিন-একিন নেহি। জ্যায়সা বোল রহা হুঁ, অ্যায়সা কিয়া করো।
    ইতিমধ্যে দৌড়ে ঘরে এসেছেন আরেকজন। অক্ষয়ের সঙ্গে চেহারায় মিল আছে, তবে একটু চাপা রঙ। তবে গেঞ্জি গায়ে গলায় সোনার চেন পরণে দামী চপ্পল।
    --- আরে, ইয়েসব ক্যা হো রহা হ্যায়?
    উনি জড়িয়ে ধরলেন অক্ষয়কে।
    --- ভাইয়া শান্ত হো যাইয়ে, সব ঠিক হো যায়েগা। ম্যাঁয় হুঁ না!
    মাপ করবেন সায়েবরা। আমার দাদার মাথা একটু খারাপ; সেই ওনার মেয়ে বিধবা হল তখন থেকেই। আসলে আমাদের জামাই অ্যাডভোকেট তিওয়ারি ওনার জুনিয়র ছিল। ট্যালেন্টেড উকিল। বিয়েটা উনিই ঠিক করেছিলেন।
    বিক্রম সোলাংকি যখন জামানতে ছাড়া পেল আর কেসের ডেট পাল্টাতে লাগলো, সাক্ষীরা ও কাজেকম্মে শহরের বাইরে। আর এই মামলার সঙ্গে যুক্ত থাকতে চাইল না, তখন দাদার মাথা পুরোপুরি খারাপ হল। পুলিশ দেখলেই ক্ষেপে যান। চিকিৎসা চলছে।
    একটু অপেক্ষা করুন, ভাইয়া কে শুইয়ে দিয়ে আমি আসছি।

    --চলিয়ে ভাইয়া! আস্থা চ্যানেল মেঁ আপকা সুধাংশু মহারাজকা প্রবচন শুরু হো গয়ে। জলদি চলিয়ে। আপনর বসুন। পাইক-বরকন্দাজের দল আবার বন্ধ দরজার পেছনে অদৃশ্য হয়ে গেল।
    উনি ফিরে এসে বল্লেন আমি সঞ্জয় ত্রিপাঠি।দাদা অসুস্থ হওয়ার পর থেকে আমাদের সব কাজকম্ম আমিই দেখি।
    আপনারা কি জানতে চাইছেন? বিক্রমের খুনটা কে করেছে?
    আরে মশাই! ও তো কোন মহাপুরুষ ছিল না। অনেক দুশমন বানিয়েছিল। আন্ডারওয়ার্ল্ডের
    লোকের শেষ এই ভাবেই হয়। কিছু মনে করবেন না, একটু জ্ঞান দিচ্ছি।
    আপনারা দেখুন ওর মৃত্যুতে কার কার লাভ,তাহলেই বুঝতে পারবেন।
    না মশাই, আমরা কেন মারতে যাবো? আমাদের কী লাভ, বলুন।
    ভাইঝির বিধবা হওয়ার বদলা নেয়া? দুর মশাই!
    ও তো মরে পার পেয়ে গেল। হিন্দুদের একাংশের চোখে ও শহীদ।
    আজ ও নেই, তাই বলছি। আমরা ওকে এত শজে ছাড়তাম না। কাউকে ভাড়াটে আততায়ী লাগিয়ে মেরে ফেলা খুব সহজ কাজ। ওই সুপারি না কি যেন বলে আজকাল!
    আমরা চেয়েছিলাম ওকে তিলে তিলে দগে্‌ধ দগে্‌ধ মারতে, ওর বিজনেস এম্পায়ার নষ্ট করে দিতে। সব গুড় গোবর হয়ে গেল।

    ১৪)
    বেলা ন'টা হবে। বিকাশ রঞ্জনেকর আজ একটু তাড়াতাড়ি স্নান করেছেন। ঘর ভাল করে ঝাঁট দেয়া, তাক টেবিল সব খালি। মোট তিনটে লাগেজ হয়েছে। রান্নাঘরে কিছু পুরনো বাসন, কিছু পুরনো বাতিল জামাকাপড় পরে আছে। বাড়ি ভাড়া, বিজলী বিল, জলের ট্যাক্সো উনি চুকিয়ে দিয়েছেন। ট্রানজিস্টর বাজছে, বিকাশ গুনগুন করতে করতে গোছগাছ শেষ করছেন।
    পাসবুক রেলের টিকেট সব বারবার করে চেক করে নিলেন।
    গতকালই ট্রেনের টিকেট কেটে এনেছেন, মুম্বাই মেলে জেনারেল ডিব্বা। আপন মনে হাসলেন।
    তারপর কুলুঙ্গী থেকে ছোট খাট মাঝবয়সী ব্যক্তিসম্পন্না এক নারীর ছবি বের করে খবরের কাগজে মুড়ে টিনের তোরঙ্গে রাখতে গিয়ে থেমে গেলেন।
    ফিস্‌ফিস্‌ করে বল্লেন- শুভদা আমাকে মাপ কর, আর পারছি না।

    গতকাল একটি মানি অর্ডার এসেছে। ১২০০ টাকা,কোলকাতা থেকে।
    তার নীচের অংশে লেখা-- ডিভিদেন্দ ফোর ২০০৯ রেমিত্তেদ।অইদ অস্ত ওমন।
    পোস্টম্যানকে রসিদ দস্তখত করে দেয়ার পর বিকাশভাউ ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করলেন।
    মেসেজের টুকরো টা আবার ভাল করে পড়ে কুচি কুচি করে ছিঁড়ে পায়খানার প্যানে ফেলে খুব জল ঢাললেন।
    অত্যন্ত সিম্পল কোডে মেসেজটি লেখা। বিকাশ জানেন। যে বাক্যটির প্রত্যেকটি শব্দ ক্যাপিটালে লেখা সেটিই মেসেজ। কিন্তু প্রত্যেক শব্দের খালি প্রথম দুটো অক্ষর নিতে হবে।
    তাহলে মেসেজটি দাঁড়াল-- অ-অ-ও। অর্থাৎ ""পালাও''?
    তারপর উনি চা বানিয়ে বসে চুমুক দিতে দিতে ভাবতে লাগলেন। কতক্ষণ সময় আছে? ট্রানজিস্টরে রেডিও পুণেতে বাজছে লতার গলায় মেছুনিদের গান।-- "'ডোলকারা, মি ডোলকারা-''। আধঘন্টা কাটলো। উনি বেরিয়ে পড়লেন মহারাষ্ট্র ব্যাংকের পাড়ায়। সেখান থেকে রেল স্টেশনের বুকিং কাউন্টার হয়ে বিজলী অফিস, তারপর বাড়িওয়ালার ঘর। উনি বাড়িতে ছিলেন না। ওনার স্ত্রীকে দু'মাসের অগ্রিম ভাড়া দিয়ে বল্লেন-- দু'মাসের জন্যে ঘুরতে যাচ্ছি। কয়েকটি বিয়ের তারিখ আছে। চাবিটা রাখুন, ঘরদোর একটু মাঝে মাঝে সাফসুতরো করিয়ে রাখবেন।
    এসব পালা গতকালই চুকিয়ে দেয়া গেছে।
    আজ বেলা এগারোটায় ট্রেন। ট্রানজিস্টর বাজছে। আরেকবার চা বানিয়ে নিয়ে নেয়ারের খাটে আরাম করে বসে গান শুনতে লাগলেন।
    এদিক ওদিক ঘোরাতে ঘোরাতে লেগে গেল কোলকাতা ক'। অতুলপ্রসাদের এই গানটি
    বিকাশরঞ্জনের চেনা।
    "" ফুরায়ে এল যে বেলা, সাঙ্গ করি ভবের খেলা, তুমি কর নিঠুর লীলা আমার প্রাণে লাগে ডর।''
    আর নয়, সময় এগিয়ে এসেছে উঠতে হবে। বিকাশ ট্রানজিস্টর বন্ধ করে টেবিলের ওপর রেখে গোটা ঘরটা একবার জরিপ করে নিলেন। তারপর জানলা- দরজা বন্ধ করে ছিটকিনি গুলো লাগাতে লাগলেন। এবার অল্প কটি লাগেজ বের করে তালা লাগিয়ে নীচে নামতে হবে। তারপর একটি অটো রিকশা ধরে দশ মিনিটে রায়পুর স্টেশন।
    তালা- চাবিটা কোথায়? হ্যাঁ, দেয়ালে একটি পেরেকের থেকে ঝুলছে। বিকাশ তালা খুলে হাতে নিয়ে পেছন ফিরলেন।
    কিন্তু দরজায় কারো ছায়া পড়েছে।
    জগিং এর পোশাকে কপাট ঠেলে ভেতরে ঢুকেছেন পার্থসারথি। জ্বেলে দিয়েছেন ঘরের সুইচ্।
    --- আরে, আপনি দেখছি বেশ ব্যস্ত। কোথায় ভাবলাম ছুটির দিনে আপনার সঙ্গে একটু গল্প করবো, আপনার হাতের চা খাব আর ঐ বাঙালী কবির বইটিও আপনাকে ফেরৎ দিয়ে যাব, কিন্তু আপনি তো সব গোছগাছ করে কোথাও যাচ্ছেন!কোথায়?
    -- হ্যাঁ, তা পুণে যেতে হচ্ছে। শালার বাড়ি থেকে খবর এসেছে।
    --- পুণে না কোলকাতা? টিকিট কোথাকার কেটেছেন ভাউ?
    --- কোলকাতা কেন? আমার শালা থাকেন পুণেতে।
    -- ঠিকই বলেছেন, আমারই ভুল। তা আপনার শালার কাছ থেকে জরুরী মেসেজ এল কিভাবে? টেলিগ্রাম এসেছে না কি?
    মানে, আপনার তো কোন ফোন নেই, মোবাইলও না। তাই বলছি - টেলিগ্রামটা একবার দেখান না।

    গোটা দরজাটা আগলে দাঁড়িয়েছেন পার্থসারথি। বেঁটে খাটো পেট বেড়িয়ে থাকা মানুষটা হটাৎ যেন লম্বা হয়ে গেছেন।
    হাসিমুখে বল্লেন-- কি হল? দেখান মশাই টেলিগ্রামটা! নাকি কোন দূত এসেছিল খবর দিতে?
    গোটা ঘরটা নিঃস্তব্ধ। বিকাশ রঞ্জনেকর একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন পার্থসারথির দিকে, চোখের পলক পড়ছে না, প্রায় এক মিনিট। এবার বিকাশ চোখ নামালেন, একটু যেন শ্বাস ছাড়লেন। তারপর খুব শান্ত গলায় বল্লেন-- ভেতরে আসুন, বসুন।
    পার্থসারথি চেয়ারে বসেছেন।
    -- এবার বলুন, কি বলতে চান।
    -- বলতে চাই ভাউ, এবার আপনার খেল খতম। ইয়ে বাজি আপনে হারা হ্যায়। আপনার সব পাত্তি শেষ, এখন তুরুপের তাস আমাদের হাতে।
    গত সপ্তাহে মুখ্যমন্ত্রী আমাদের তদন্ত শেষ করার জন্যে সাতদিন সময় দিয়েছিলেন, আমরা না পারলে কেস সিবিআইয়ের কাছে যাবে। এখনো দুদিন বাকি।কিন্তু আমার হিসেবে শোলাংকি মার্ডার কেস এবার শেষ। আজ আমি ফাইনাল রিপোর্ট ডিজিকে সাবমিট করবো। কাল উনি মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে জমা দেবেন।
    বিকাশ হাসলেন।--- তাই নাকি! আপনাকে অভিনন্দন। তাহলে রায়পুর শহরের কেষ্টুবিষ্টুরা এবার নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমোতে পারবেন। কি বলেন? আর আপনার প্রোমোশন, তাই তো!
    -- যা বলেছেন!
    -- একটা কথা জিগ্যেস করতে পারি? একটু-আধটু কানুন আমিও জানি। কোর্টে মার্ডার প্রুভ করতে হলে তিনটে এলিমেন্ট চাই।
    এক, ডেড বডি; দুই, হাতিয়ার; তিন, মোটিভ্।
    এই কেসে তো কেবল ডেড বডিই পাওয় গেছে, না হাতিয়ার, না মোটিভ। কোর্টে চালান পুট আপ করবেন কিসের ভিত্তিতে?
    ---- নহী জনাব! ধূপ মেঁ বাল অ্যায়সে হী নহী পকায়া! সব পাওয়া গেছে। হাতিয়ার, মোটিভ-- সব।

    -- আসলে আপনারা আমাদের যতটা বোকা বা ইন এফিশিয়েন্ট মনে করেন আমরা কি সত্যিই তাই?
    গত পনেরো দিন ধরে তিনজন সাসপেক্টের পেছনে লোক লাগানো আছে। আপনাদের প্রতিটি খুঁটিনাটি, চালচলন সবই আমাদের নখদর্পণে।
    কাল যখন খবর পেলাম যে আপনি ব্যাংক হয়ে রেলস্টেশনের বুকিং কাউন্টার থেকে টিকিট কেটেচেন তখনি বুঝলান যে অব চিড়িয়া পিঁজরে সে উড়নেয়ালে।
    এবার বলুন, আপনি কোলকাতা যাচ্ছেন কেন?
    -- আমি কোলকাতাই যাচ্ছি কে বল্লো?
    --- দূর মশাই! কাল যখন টিকিট কাটছিলেন তখন লাইনে থিক দুজনের পেছনে দাঁড়ানো লোকটিই আমার লোক।
    ও আপনার বুকিং ক্লার্ককে বলা কথা শুনেছে, আর কাউন্টারের ওপর দিসে্‌প্‌ল বোর্ডে অপনার তারিখ ট্রেনের নম্বর সবই দেখেছে।
    -- বাঃ, আমি কোলকাতা অফিসে চাকরি করেছি, বন্ধুবান্ধব আছে। যাচ্ছি তো কি হয়েছে? এতে আপনি কি পেলেন? মোটিভ না হাতিয়ার?
    রঞ্জনেকরের গলায় বিদ্রূপ।
    --- তারপর আমি নিজে গেলাম ব্যাংক ম্যানেজারের চেম্বারে,ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড অনুযায়ী প্রপার অর্ডার নিয়ে। দেখলাম সমস্ত অ্যাকাউন্ট থেকে নমিনাল ব্যালান্স রেখে সব টাকাপয়সা তুলে নিয়েছেন।
    --- বেশ, তার থেকে কি প্রমাণ হল?
    -- আগে সবটা শুনুন। ম্যানেজারকে বল্লাম আপনার অ্যাকাউন্ট ওপেনিং ফর্মটা দেখাতে। ইচ্ছে ছিল দেখবো ই®¾ট্রাডাকটরি রেফারেন্স কে দিয়েছে, টাকা কবে কিভাবে এসেছে।
    তখন পেলাম কেঁচো খুঁড়তে সাপ।
    আপনার অ্যাকাউন্টটি এসেছে কোলকাতা শাখা থেকে ট্রান্সফার হয়ে। তাতে গ্রাহকের নাম ছিল
    " বিকাশরঞ্জন কর'। কিন্তু আপনি নামটা বদলে করলেন
    " বিকাশ রঞ্জনেকর'। সঙ্গে ডকুমেন্ট অ্যাটাচ্‌ড করেছেন কোলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টের একটি এফিডেভিট।
    "" আমি বিকাশরঞ্জন কর, পিতা প্রভাসরঞ্জন কর, সাকিন পায়রাডাঙ্গা, রাণাঘাট, আজি হইতে
    বিকাশ রঞ্জনেকর নামে পরিচিত হইব''।
    অর্থাৎ আপনি বাঙ্গালী, এখানে মরাঠি সেজে আছেন।
    --- তাহলে আমাকে খুনী নয়, ইমপস্টার হওয়ার অভিযোগে গ্রেফতার করছেন?
    --- আপাততঃ।
    ---পুলিশ স্কুলে আপনাদের ব্যাচকে ল' বোধহয় ভাল করে পড়ায়নি। কেউ এফিডেভিট করে পদবি বদলালে কি করে আইনের চোখে ইমপোস্টার হয়?
    -- পদবি বদলানো আর বাঙালী থেকে মারাঠি হওয়া কি এক হল?
    -- কেন নয়? যদি মারাঠি মেয়ে বাঙালী বিয়ে করে পদবী বদলে বাঙালী হতে পারে , তাহলে
    বাঙালী পুরুষ মারাঠি বিয়ে করে পদবী বদলে মারাঠি সারনেম নিলে কেন অপরাধ হবে?
    --- হবে না। কিন্তু আপনি আপনার স্ত্রীর পদবি তো নেন নি। ওনার মেডেন নেম তো শুভদা
    ঘাটগে। তাহলে?
    --- সংবিধানে কোথায় আছে যে কেউ নিজের কমিউনিটি বদলাতে পারবে না? করলে ক্রিমিনাল অফেন্স হবে?
    -- নেই। কিন্তু কেউ যদি এই কাজটা কোন ক্রিমিনাল ইন্টেনশন থেকে করে?
    -- আচ্ছা! কী সেই ইনটেনশন? শুনি একবার।
    --- শংকর সেনার আইকন চিফ বিক্রম সোলাংকিকে ঠান্ডা মাথায় খুন করা।
    --- পাগল হয়েছেন! আমি কেন খুন করতে যাবো ওই লোকটাকে? ও আমার কোন পাকা ধানে মই দিয়েছে? রায়পুর শহরে আসার আগে আমি ওর নামও শুনিনি।
    --- হ্যাঁ, আসার পরেই শুনেছেন। কিন্তু নাম পরিচয় ভাঁড়িয়ে বহুদিন পরিকল্পনা করে সুযোগ বুঝে কাজটি করেছেন। ইট'জ আ কোল্ড- ব্লাডেড মার্ডার!
    --- দূর মশাই! আমার মোটিভ কী? আসা করি ইন্টেনশন আর মোটিভের তফাৎ আপনার জানা
    আছে।
    ---আছে বৈকি! মোটিভ তো আপনিই খুলাসা করবেন, শ্রীমুখে। তবে আমি খানিকটা
    আন্দাজ করেছি। সূত্র পেয়েছি আপনার ওই বাংলা কবিতার বইটি থেকে। কি যেন নাম?
    হ্যাঁ, ""ছাড়পত্র''।
    -- ওফ্! খোদা পাহাড়, নিকলা চুহা!
    কবিতার বই থেকে খুনের মোটিভ! ইয়ার্কির একটা সীমা আছে।
    --- একটি কবিতায় লাল পেন্সিলে মোটা করে আন্ডারলাইন করেছেন " এ পৃথিবীকে শিশুদের বাসযোগ্য করে যাবো আমি,'' আর "" প্রাণপণে দুইহাতে সরাবো জঞ্জাল''। পাশে মার্জিনে
    ক্যাপিটাল অক্ষরে লিখেছেন ""মিশন''।
    --- ধেত্তেরি! ওটা কবি সুকান্তের মিশন,আমার নয়। বাংলা বোঝেন না, স্ত্রীর ব্যাখ্যা শুনে কবিতা থেকে খুনী সনাক্ত করছেন? ট্যাক্সের পয়সায় সরকার কেন যে আপনাদের মত লোক পোষে!
    রাস্তা ছাড়ুন, আমাকে ট্রেন ধরতে হবে!
    --- এক মিনিট! কে বল্লো আমি বাংলা জানিনা? শান্তিনিকেতন থেকে সোশিওলজিতে অনার্স করেছি। তারপর আই পি এস পরীক্ষা দিয়ে এই চাকরিতে এসেছি।
    --- শান্তিনিকেতনে পড়ে পুলিশের চাকরি!ভাগ্যিস কবিগুরু বেঁচে নেই!
    ---শুনুন বিকাশভাউ, থুড়ি বিকাশ কর! আমিও আপনাদের রাজ্যে পড়ার সময় বাম রাজনীতির টাচে এসেছিলাম। কিন্তু গোটা সিস্টেম করাপ্ট, এ আমি মানিনা। আমি দেখাতে চাই এর মধ্যেও অনেস্টলি ভাল কাজ করা যায়।
    --- বেশ, অনেস্টলি কাজ করুন। সন্দেহের বশে বয়স্ক লোককে হ্যারাস না করে ট্রেন ধরতে দিন। মোটিভ নিয়ে অন্ধকারে ঢিল ছুঁড়ছেন, হাতিয়ার পান নি! খালি অনর্গল কথা বলে চলেছেন।
    -- হাতিয়ার এখনো হাতে না পাই, ওর খোঁজ তো পেয়ে গেছি। খালি আপনি একটু কোঅপারেট করুন।
    --- মানে?
    --পুলিশ ঠিক ভগবান নয়। হাতিয়ার আপনি বাড়িতে কোথায় রেখেছিলেন,আমরা জানিনা।
    হয়তো টালির চালের মধ্যে গোটা কয় টালি সরিয়ে; হয়তো জলের ট্যাংকির মধ্যে ঢাকনার পাশে ঢাকা সারফেসের মধ্যে ওয়েল্ডিং করা কোন ক্ল্যাম্পে ফাঁসিয়ে। কিন্তু আজ ওই রিভলবারটি কোথায় আছে আমি জানি।

    -- তাই নাকি? তা এখন কোথায় আছে, বলুন! তবে তো সাহায্য করার কথা ভাববো।
    --- আছে আপনার লকারে। গতকাল টিকিট কাটার আগে আপনি ব্যাংকে গিয়েছিলেন। লকার খুলেছিলেন। মানে খুব স্পষ্ট। সিক্রেট প্লেস থেকে ওটাকে বের করে লকারে রেখেছেন। আমাদের ট্রেস করতে সময় লেগেছে এইজন্যে যে লকারটি আছে আপনার স্ত্রীর নামে, কিন্তু আপনাকে অপারেট করার পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি দেয়া আছে।
    এইখানে আপনি আরো একটি বে-আইনি কাজ করেচেন। আপনার স্ত্রী মারা গেছেন ক্যান্সারে, এই খবরটি আপনি ব্যাংককে দেন নি। ওনার মৃত্যুতে ওই পাওয়ার অফ অ্যাটর্নি
    ইনভ্যালিড হয়ে গেছে।
    --- আপনি ঠিক জানেন যে আমার স্ত্রীর নামের লকারটিতে একটি রিভলবার রাখা আছে?
    -- সার্টেনলি! এক কাজ করুন। আমার মোবাইলে ব্যাংককে কল করে বলুন আমি আর আপনি পাঁচমিনিটে ব্যাংকে পৌঁছুচ্চি। উনি যেন ওনার চাবি নিয়ে তৈরি থাকেন। লকার খোলা হলে যদি রিভলবার না পাওয়া যায় আমি নিজে আপনাকে ট্রেনে তুলে গিয়ে আসবো। আর আপনার নাম সন্দেহের তালিকা থেকে কেটে দেব। রাজি?
    পুরো এক মিনিট দুজনেই একে অপরের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলেন।
    তারপর বিকাশ মুচকি হেসে বল্লেন—আমি রাজি। কল করুন ব্যাংক কে! কি হল? লাগান নম্বর।

    এবার পার্থসারথির চোখে চোখ রেখে তাকানোর পালা।
    তিরিশ সেকন্ড কাটলো। উনি হেসে উঠলেন। তারপর দ্রুত পায়ে এসে তিনটে লাগেজকে আড়াল করে বিকাশের সামনে এসে দাঁড়ালেন।
    --- মিঃ কর! আপনি ধরা পড়ে গেছেন।
    তারমানে যন্তরটি লকারে নেই। অর্থাৎ অ্যাদ্দিন লকারেই ছিল, বাড়িতে নয়। তাহলে কাল আপনি লকার খুলেছিলেন ওটাকে রাখতে নয়, ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসতে।
    ওটা এখন আপনার কাস্টডিতেই আছে। এখন যদি আপনার এই তিনটে লাগেজ সার্চ করি তাহলে কোন একটাতে ঠিক পেয়ে যাবো।
    আমার শর্ত আগের মতই। যদি লাগেজ সার্চ করে না পাই তবে আপনি ফ্রি। আর আপনার কাছে মাপ চেয়ে আমি নিজের গাড়িতে আপনাকে স্টেশনে পৌঁছে দেব। কি, রাজি?

    খাটিয়ায় বসে পড়েছেন বিকাশরঞ্জন কর, অ্যালিয়াস বিকাশ রঞ্জনেকর।
    দুহাতের তালুতে মুখ গোঁজা, থরথর করে কাঁপছে শরীর।
    ভাঙা ভাঙা অস্পষ্ট স্বরে বললেন-- কী করে,--- কী করে বুঝলেন?

    ---প্রথম থেকেই একটা ব্যাপার আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। হোটেলের ক্যামেরায় দেখছি প্রায় প্রতিদিন আপনি একই সময়ে ওই আকবর হোটেলে একটু রাতে খেতে আসেন। প্রায় প্রত্যেকবার শঙ্কর সেনাদের মোচ্ছবের সময় ওদের কাছাকাছি টেবিলে অনেকক্ষণ ধরে বসে থাকেন। ওরা টেবিল ছেড়ে ওঠার সময় আপনি উঠে পড়েন। আর ক্লোজ আপে ধরা পড়েছে আপনার চোখে অপরিসীম ঘৃণা।
    ঘৃণা খুব বড় মোটিভ ফোর্স, ভালোবাসার চেয়েও বেশি। আর সবচেয়ে ভাল সুযোগ আপনারই ছিল। একটা কথা বলুন তো। আপনি তো আর জানতেন না যে ওই দিন সোলাংকি আপনাকে
    গাড়িতে লিফট দেবে। তাহলে সেদিন আপনার হাতব্যাগে রিভলবার কী করে ছিল?
    আমার অনুমান আপনি বহুদিন ধরে সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। রোজ সঙ্গে করে অস্ত্রটি এনে খেতে বসতেন। কি, ঠিক বলছি তো?
    বিকাশ মাথা নামালেন।
    -- কেন এই কাজ করলেন? মানুষ মারতে আপনার হাত কাঁপলো না?
    ধীরে ধীরে মুখ তুললেন বিকাশ।
    -- মানুষ মারিনি তো! আরশোলা মেরেছি।
    শুভদারও আরশোলা নিয়ে ঘেন্না ছিল খুব। কিন্তু মারতে ভয় পেত, আমাকেই মারতে হত।
    -- শুভদা তো আর পাশে নেই। তবে কার আদেশে আরশোলা মারার কথা ভাবলেন?
    --- নিজের।
    --- আর আপনার ওই আরশোলা মারার ফলে যে ছয়জন নিরপরাধ মুসলিম মারা গেল?
    তাদের জন্যে ভাবেন নি! তাদের জন্যে আপনার কোন দায়িত্ব নেই? নাকি অন্যদের মত কোল্যাটারাল ড্যামেজ ধরে নিয়ে নিজের বিবেককে চোখ মারবেন!
    শুনুন। আমরা কোলকাতা পুলিশের সহায়তায় যা জানতে পেরেছি তা হল আপনি পুণেতে শুভদা ঘাটগে কে বিয়ে করার পর স্বেচ্ছায় ট্রান্সফার নিয়ে কোলকাতা অফিসে আসেন। ইউনিয়নে সক্রিয় ছিলেন। অন্য অতিবাম ঘেঁষা রাজনীতিতেও জড়িয়ে পড়ছিলেন। এই নিয়ে শুভদার সঙ্গে আপনার টেনশন হতে থাকে। তারপর ছেলে হলে শুভদার চাপে আপনি মুম্বাই চলে যান। সেখানে আপনার শ্যালক শঙ্কর সেনা জয়েন করতে আপনাকে চাপ দিতে থাকে। তিক্ততা বাড়তে থাকে।
    এমন সময় একটি ঘটনা ঘটে। মামাবাড়ি পুণে থেকে মুম্বাই আসার সময় টেররিস্টদের বোম ব্লাস্টে নিহতদের তালিকায় আপনার ছেলের নাম উঠলে আপনার স্ত্রী ডিপ্রেশনের শিকার হয়ে যান।
    বাকিটা আপনি বলেছেন। কিন্তু এইসব থেকে আপনার এই বয়সে সোলাংকিকে মার্ডারের
    মোটিভ এখনও অস্পষ্ট।

    --- ভাইয়ের প্রভাবে স্ত্রীর মাইনরিটি বিদ্বেষ বাড়তে লাগলো। আমাকে উল্টো বোঝাতে লাগলো আমাদের একমাত্র সন্তানের মৃত্যুর জন্যে আমার বামপন্থী রাজনীতির মাইনরিটি তোষণই
    দায়ী।
    আমি যত বলি ওটি একটি দুর্ঘটনা; নিহতদের তালিকায় মুসলিম নামও আছে-- ও ততই
    ফুঁসে ওঠে। রোজ ঝগড়া, রোজ ঝগড়া।
    আমার কী যে হল!
    একদিন ধৈর্য্য হারিয়ে চড় মেরে বসলাম। ও অবাক হয়ে আমাকে দেখল। আমি মাপ চাইলাম। অনেক কিছু বোঝালাম। কিন্তু ও কোন কথা বললো না। অফিস থেকে এসে দেখি ভাইয়ের বাড়ি চলে গেছে, ফ্ল্যাটের চাবি কেয়ারটেকার এর কাছে দিয়ে। তারপর শালার ফোন এল। ও মানসিক ভারসাম্য পুরোপুরি হারিয়ে ফেলেছে।
    আমি গিয়ে ডাকতারের সঙ্গে কথা বলে ওকে রায়পুরে নিয়ে এলাম।সেসব কথা আগেই বলেছি।
    যা বলিনি তা হল ওই মানসিক ভারসাম্যহীন স্ত্রীর সঙ্গে একটি বছর রায়পুরে বড় আনন্দে কাটিয়েছি। ওর সব কাজ আমি করে দিতাম। স্নান করানো, কাপড় বদলানো সব।
    ও বলতো--- ছেলে মুম্বাইয়ে পড়াশুনো করছে। পরীক্ষা হয়ে গেলে বাড়ি আসবে।
    এমন সময় ওর জরায়ুতে ক্যান্সার ধরা পড়লো। ফলে ওকে আবার মুম্বাইয়ে শালার কাছে ছাড়তে হল। চিকিৎসার খরচা আমি পাঠাতাম। কিন্তু লোক্যাল গার্জিয়ান আমার
    শালা। সে তখন শংকর সেনার টিকিটে কউন্সিলর।

    শুভদা বাঁচলো না। কিন্তু আমি যখন পৌঁছুলাম দাহকার্য্য আগেই শেষ। আমাকে ওর ভাই এবং ওর বন্ধুবান্ধবরা প্রায় গলাধাক্কা দিয়ে তাড়াল।
    ফিরে এলাম রায়পুরে, শুধু একটি চিন্তা মাথায় ঘুরছে।আপনি ঠিকই বলেছেন।
    ওই ছাড়পত্র বইটিতে পরের দিকে আরেকটি কবিতার লাইনে দাগ দেয়া আছে। আপনি
    খেয়াল করেন নি।
    "" প্রিয়াকে আমার কেড়েছিস তোরা,
    ভেঙেছিস ঘরবাড়ি।
    সেকথা কি আমি জীবনেমরণে
    কখনো ভুলতে পারি!''

    আমরা তিনজন একটা গ্রুপ গড়ে নিলাম।আমাদের কোন দল নেই। নাম নেই। কিন্তু আমরা নিজেদের মনে করি সভ্যতার মেথর।
    আমাদের কাজ সামান্য কিছু আরশোলা, কেন্নো এদের দুর করা। হিট স্প্রে বলতে পারেন।

    -- এবার আমি বলছি, এখন আপনারা আর তিন জন নেই, মাত্র দু'জন। একজন হার্ট
    অ্যাটাকে সম্প্রতি মারা গিয়েছে। আর কোলকাতা থেকে যে আপনাকে টাকাপয়সা এবং অস্ত্র সাপ্লাই করতো সে এখন ফেরার। কাজেই আপনি এখন পুরনো নামে কোলকাতায় ফিরে জনসমুদ্রে হারিয়ে যেতে চান। অথবা উত্তরবঙ্গ বা রাঢ় বাংলার কোন গ্রামে ছোটখাট টিউশন করে সময় কাটাবেন। কি, ঠিক ধরেছি কিনা!
    বিকাশ মাথা নাড়েন।
    -- তবে একটা কথা। ওই কোল্যাটার্যা ল ড্যামেজ যে এমন হবে ভাবিনি। নিহতদের মধ্যে মোদহাপাড়ার রফিক যে আমার ছাত্র!
    তাই দল ভেঙে দিচ্ছি। বাকি জীবনটা--।
    -- দেখুন, আপনার সামনে দুটো পথ খোলা; আপাততঃ আর্মস্‌ অ্যাক্টে আপনাকে গ্রেফতার করা। জেলে আপনি নিরাপদেই থাকবেন। বাইরে থাকলে শংকর সেনারা আপনাকে ছিঁড়ে ফেলবে।
    কোর্টে কেস উঠলে অন্ততঃ দশবছর সশ্রম কারাদন্ড নিশ্চিত।
    --- আর দুসরা রাস্তা?
    ---সেটা হল আপনি এক্ষুনি গিয়ে কোলকাতার ট্রেন ধরুন।
    আপনার পজেশনে হত্যায় প্রযুক্ত হাতিয়ার না পাওয়া গেলে আপনার ওপর কোন চার্জ ফ্রেম করা যায় না। আমি আপনার ব্যাগ ছুঁয়ে দেখব না।
    রিপোর্ট দেব --সোলাংকির মৃত্যুতে যে দু'জন প্রত্যক্ষ ভাবে লাভবান হয়েছে তাদেরি কেউ সম্ভবতঃ দোষী।
    -- এরকম করার জন্যে আপনার মোটিভ কী?
    পার্থসারথি উঠে দাঁড়ালেন। দরজার দিকে যেতে যেতে খানিকটা যেন নিজের মনে বল্লেন--- আমিও মাঝেমধ্যে আরশোলা মারতে চাই। কিন্তু সাহসে কুলোয় না।

    ১৪)
    বেলা প্রায় দুটো। পার্থসারথি নিজের অফিসে বসে কম্প্যুটরে রিপোর্ট টাইপ করছেন। লেখা
    প্রায় শেষ। শেষ প্যারাগ্রাফে রাজ্যপুলিশের জন্যে কিছু রেকমেন্ডেশন দিয়ে রিপোর্ট ক্লোজ করবেন। তারপর আগামী মাস থেকে ওনার পেরেন্ট অর্গানাইজেশন মধ্যপ্রদেশ পুলিশের হেড কোয়ার্টার ভোপালে ফিরে যাবেন।
    এমন সময় টেবিলে রাখা ফোন বেজে উঠল।
    --- স্যার! আপনি এতক্ষণ কোথায় ছিলেন? সেই জগিং করতে বেরিয়ে আর ফেরেন নি। মোবাইল বন্ধ রেখেছিলেন কেন?
    এদিকে মামলা একদম হলিউড-জলিগুড। আপনিই ঠিক। একটু আগে সোলাংকির আততায়ী ধরা পড়েছে। এখন এস পি অফিসে পুছতাছ চলছে। আপনি শিগ্গির চলে আসুন। সবাই আপনাকে খুঁজছে।
    আরে, আপনি ওই মারাঠি কড়িভাউয়ের পেছনে লোক লাগিয়ে রাখতে বলেছিলেন না? তো হারামি কে পিল্লে ট্রেনে করে পালাচ্চিল। আমাদের লোক সন্দেহের বশে ওকে বলে
    লাগেজ খুলে দেখাতে। তখন আমার লোক ওকে জোর করে প্ল্যাটফর্মে নামায়। আপনাকে আর আমাকে ফোন করে। কিন্তু আপনার মোবইল বন্ধ ছিল আর তখনো আপনি অফিসে আসেন নি।
    তাই আমি এস পি অফিসে নিয়ে গিয়ে সার্চ করি। দু'নম্বর স্যুটকেসে কাপড়ের ভাঁজে ছিল ওটা। সেই ৩৮ ক্যালিবারের স্মিথ অ্যান্ড ওয়েসেন।
    এখন প্রেস কনফারেন্স হবে।
    সবাই আপনাকে চাইছে, আপনিই ঠিক, স্যার।
    ( সমাপ্ত)
    ্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌্‌
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৭ মে ২০১৬ | ১৭৪১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • avi | 113.24.86.115 (*) | ২৩ মে ২০১৬ ১১:৩৩54077
  • এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম প্রায়। এটা জাস্ট দারুণ হয়েছে। শেষের কিকটাও অসাধারণ লাগল। এরকম পলিটিকোথ্রিলার বাংলায় পড়েছি কি? আরো লিখতে থাকুন, একদম থামবেন না প্লিজ।
    হ্যাঁ, প্রাথমিকভাবে একটা ছোট পয়েন্ট মনে হল, টেকনিক্যাল ডিটেল। রিভলভারে সম্ভবত সাইলেন্সার লাগানো যায় না। পিস্তলের সাথে এটা একটা তফাৎ। একটু চেক করে নেব অবিশ্যি।
  • Debabrata Chakrabarty | 212.142.91.37 (*) | ২৪ মে ২০১৬ ০৬:০৯54081
  • রঞ্জন দা দারুন , প্রথমটা মোবাইলে পড়ছিলাম , শেষের দিকে এসে ব্যাটারি শেষ , আবার বাড়িতে এসে ল্যাপটপে পড়লাম । ছোট খাট দু একটা ত্রুটি বিচ্যুতি অন্যরা যেমত বলেছেন ওপরে বাদ দিলে এক কোথায় দারুন । আইনে ভরসা রাখুন টা বাদ দিলেও হত আরকি - জেনারেল কম্পার্ট্মমেন্টে ওইরকম বোঁচকা বুঁচকি নিয়ে ট্রাভেল করলে সার্চ হতে পারে , হয় এবং অনেক সময় মুঙ্গের থেকে কোলকাতায় অস্ত্র পাচার কারিরা ঐ সূত্রে ধরাও পরে । কিন্তু দারুন - আরও লিখুন ।
  • ranjan roy | 192.69.1.202 (*) | ২৪ মে ২০১৬ ০৯:২৫54078
  • হ্যাঁ, এটা ঠিক বলেছেন।
    ২০১০ এ লেখার সময় এই পাতাতেইএকজন গুরু ( আমাদের অস্ত্র বিশেষজ্ঞ) ভুলটা ধরিয়ে দিয়েছিলেন। আমার উচিত ছিল খেরোর খাতায় তোলার আগে শুধরে নেয়া।
  • phutki | 202.193.164.9 (*) | ২৪ মে ২০১৬ ১০:২৫54079
  • রঞ্জনদা, পাঠক হিসেবে একটা কথা মনে হল পড়ে। বলেই ফেলি, হ্যাঁ? সর্বনামের একটু বেশি আধিক্য।

    " তারপর ওরা হোস্টেল থেকে কিছু ছেলে নিয়ে আসে। ওরা হকিস্টিক দিয়ে আমাদের ম্যানেজারকে বেদম মারে। ও এখন হাসপাতালে । তারপর ওরা প্রচূর ভাঙ্‌চুর করে।
    আজ ওদের একটাকে আমাদের ছেলেরা সুভাষ কলোনীতে দেখতে পেয়ে তাড়া করে। কিন্তু ও দৌড়ে আপনার বন্ধু তিওয়ারি উকিলের বাড়িতে ঢুকে পড়ে। ওনাকে বোঝাই যে ছেলেটাকে আমাদের হাতে তুলে দিন। বসের নির্দেশ। তা উনি বল্লেন-- ও আমার আশ্রিত। আজকে আমার জন্মদিন। আমি আজ আশ্রিতকে তার দুশমনের হাতে তুলে দেব না। ও পরে নিজে থেকে বেরিয়ে গেলে তখন তোমরা ওকে কিকরবে সে আমি দেখতে যাবো না। কিন্তু আমার বাড়ির ভেতর কেউ ঢুকবে না।"

    আমাকে বেশ কয়েকবার পড়ে এই "ও" গুলোকে আলাদা করতে হল। যদিও এটা একটা চরিত্রের উক্তি, কিন্তু খুব মন দিয়ে পড়ে বুঝতে হল।
  • Ranjan Roy | 192.68.36.61 (*) | ২৪ মে ২০১৬ ১১:২৯54080
  • ফুটকি,
    ঠিকই বলেছেন।
    আসলে চল্লিশ বছর পরে বাংলা লিখতে গিয়ে কনফিডেন্স কমে গেছল। হোঁচট খাচ্ছিলাম। তখন আমার এক লেখক বন্ধু বললেন-- বাংলা ও ইংরেজিতে সর্বনামের ব্যবহার বেশি; হিন্দিতে নামপদের ব্যবহার।
    তা আমি বোধহয় বছর ছয়েক আগে গুরুর টইয়ে গল্পটি লেখার সময় সর্বনাম নিয়ে একটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিলাম। শুধরে নেব।
    আসলে খেরোর খাতায় তোলার সময়েই শুধরে নেওয়া উচিত ছিল।
    আপনি যে বলেছেন--'আমাকে বেশ কয়েকবার পড়ে এই "ও" গুলোকে আলাদা করতে হল। যদিও এটা একটা চরিত্রের উক্তি, কিন্তু খুব মন দিয়ে পড়ে বুঝতে হল।'

    --এইটা হল আসল কথা। এই 'ও' গুলোকে সহজে রিলেট করা যাচ্ছে , কি যাচ্ছে না, এই সূত্র মেনে আগামীতে এডিট করে নেব।
    অনেক ধন্যবাদ!
  • Ranjan Roy | 192.69.126.230 (*) | ২৫ মে ২০১৬ ১১:৪৫54082
  • সবাইকে ধন্যবাদ!
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন