এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • মেয়েবেলা

    বকলমে লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৭ মার্চ ২০১৯ | ৬৫১ বার পঠিত
  • ইন্দ-রানী

    একটি অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে কঠোর পুরুষতান্ত্রিক পরিকাঠামোয়, হাজার নিয়ম ও বাধা নিষেধের বেড়ার ভেতর যেমন মেয়েবেলা কাটতে পারে, তেমনি ছিল মেয়েটির ছোটবেলা। মেয়েবেলার কথা ভাবতে বসলে সত্যি বলতে তেমন আনন্দের কোন উপাখ্যান অথবা সুখস্মৃতি তার মনে পড়েনা-সেসব হয়ত ছিল কখনও কিন্তু এখন হাতড়ালে আর খুঁজে পাওয়া যায়না।

    সে যে একটি মেয়ে, এবং তা যে আসলে বেশ আলাদা রকম কিছু, সেই বোধের সর্ব প্রথম উপলব্ধি তার হয়েছিল পাঁচ বছর বয়েসেরও আগে। এক নিকট আত্মীয়া তাকে খওয়াতে বসে গল্পের ছলে বলেছিলেন “তুই ছেলে হলে বাড়ির সবাই তোকে আরো বেশী ভালবাসত”। কেমন অনুভূতি হয়েছিল সে কথা শুনে, আজ আর মনে পড়েনা তার, তবে প্রায় চার দশক পেরিয়েও সেই স্মৃতি এখনও সজীব থাকার অর্থ সেইসময় এই বাক্য নিশ্চয়ই এক শিশুর অবচেতনে গভীর দাগ কেটেছিল। এই “মেয়ে” হয়ে জন্মানোর অর্থ এরপর পায়ে পায়ে শৃঙ্খলা আর বাঁধনের মধ্যে বড় হতে হতে এবং কেবলই “না” শুনতে শুনতে বেশ শিখে নিয়েছিল সে। সাইকেল চালানো শিখবে? - না। সাইন্স ক্যাম্প করতে শহরের বাইরে যাবে? - না। ডাইরি লিখবে? - না, অসম্ভব! চুল ছোটো করে কাটবে? - না! শেষ পর্যন্ত কারোর কথা না শুনে একবার লম্বা চুল ছোটো করে কেটেই ফেলে সে। তার ফল স্বরূপ বাড়িতে তো বটেই, আত্মীয় মহলেও ছিছিক্কার পড়ে যায় – এত বেয়াদব এই মেয়ে! এত অবাধ্য!

    প্রথমবার যৌন হেনস্থার শিকার হয় মেয়েটি হাওড়া স্টেশনের ভিড়ে, যখন সে ক্লাস ফাইভ। তার কান্না, ভয়, অসহায়তা শোনার মত কেউ ছিলনা গোটা পৃথিবীতে। তারপর বহুবার বহু ভাবে বহু জায়গায় একই অভিজ্ঞতা হয়েছে, কখনওই কাউকে বলে উঠতে পারেনি। যখন সে ক্লাস সিক্স, পাবলিক বাসে স্কুলে যাওয়ার পথে তাকে আরো কিছু সহপাঠিনীর সাথে বয়েসে অনেক বড় কিছু পুরুষ দ্বারা বহুবার যৌন হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে। অফিস টাইমের ভিড়ের সু্যোগ সেই লোক গুলি পূর্ণ মাত্রায় নিয়েছে। অথচ নিজেদের ভেতর ফিসফাস ছাড়া সেই সদ্য কিশোরীরা বুঝে উঠতে পারেনি আর কি করতে পারত তারা। বাড়িতে বলা? অসম্ভব। এই সামান্য স্বাধীনতা টুকুও বন্ধ হয়ে যায় যদি? আর এইসব লজ্জার জিনিস বাড়িতে মুখ ফুটে বলবেই বা কি করে? মেয়েটির বেশ মনে আছে, বিভিন্ন বয়েসের পুরুষ তার বাড়ির পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাকে উত্ত্যক্ত করত প্রায়শই। কখনো অশালীন ভঙ্গী, কখনো কটুক্তি, এমন কি সময় বিশেষে শারীরিক নিপীড়নও। একবার বাড়ির লোকের চোখে পড়ে যাওয়াতে সমস্যার সমাধান হিসেবে তার জানলার ধারে পড়তে বসা বন্ধ হয়ে গেল। সাব্যস্ত হল, এইভাবে জানলার ধারে বসার অর্থ, পুরুষদের প্রলোভিত করা, তাদের অসৎ কাজে ইন্ধন যোগানো।

    মেয়েটির ঋতুস্রাব শুরু হওয়ার পর সমস্যা বাড়ল আরও। প্রথমবার তাকে মশারির আড়ালে রাখা হয়েছিল, যাতে কোনো পুরুষ যেন তাকে দেখতে না পায়। তারপর তাকে দিয়ে নানান শাস্ত্র সিদ্ধ আচার পালন করানো হল। এর মধ্যে ছিল গোমূত্র এবং গোবরের মিশ্রণ দিয়ে বানানো কোনো একটি পদার্থ খেতে বাধ্য করা। সেই সময় স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যাবহার এত ব্যাপক ছিলনা, টিভির বিজ্ঞাপন তাকে প্রায় নিষিদ্ধ বস্তু বানিয়েছিল। অত্যন্ত অস্বাস্থ্যকর কাপড়ের টুকরো ব্যাবহার, তাকে অপটু হাতে কেচে শুকিয়ে সকলের চোখের আড়ালে জুতোর বাক্স করে খাটের তলায় লুকিয়ে রাখতে গিয়ে ছত্রাকের সংক্রমণ, ঠিক মতন সামলাতে না পেরে এক সদ্য কিশোরীর সেই কাপড়ের টুকরো স্কুল যাতায়াতের রাস্তায় খুলে যাওয়া, তাই নিয়ে লজ্জা, ভয়, কান্না এরকম হাজারো বিড়ম্বনা আর অসুবিধায় জর্জরিত হতে হতে কেটেছে তার মেয়েবেলা। কেটেছে বলেই স্যানিটারি ন্যাপকিন প্রতিটি মেয়ে র হাতে পৌঁছনো এবং সেই বিষয়ে যাবতীয় ট্যাবু ভাঙা যে কতটা দরকারি, এ নিয়ে তার মনে কোনো সংশয় নেই।

    এত অবদমনের বিরুদ্ধে কোথাও মুখ খোলার নেই, কাউকে বলার নেই। তার কোনো নিজস্ব পরিসর নেই, কোনো গোপনিয়তার মালিকানা নেই। তার কিশোর বেলার প্রেমে পড়ার খবর পাড়ায় পাড়ায় চাউর হয়, বাড়ি বয়ে প্রায় অপরিচিত লোক এসে নালিশ জানিয়ে যায়, মানসিক নির্যাতন বাড়তে বাড়তে মেয়ের খাওয়া বন্ধ হয়, ঘুম মাথায় ওঠে, পড়াশোনা বন্ধ হতে বসে। একদিকে প্রায় উন্মাদ সেই প্রেমিকের অত্যাচার, আরেকদিকে বাড়ির সম্মান ভুলুন্ঠিত করার অপরাধে, প্রায় গৃহ বন্দি একঘরে হয়ে থাকা জীবন।

    এ কথা সত্যি যে এই দমন-পীড়ন এবং মানসিক চাপ এক কিশোরীকে প্রায় দিশেহারা, মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। তার সুদীর্ঘ অবসাদের ইতিহাসের বীজ যে সেই কোন ছোটবেলায় বোনা হয়ে গিয়েছিল, তা পরবর্তী কালে সে তার মনোবিদের কথায় নিশ্চিত ভাবে প্রমাণ পেয়েছে। একটি ছোটো মেয়ের মানসিক স্বাস্থ্য ভাল রাখা, তাকে হাসি খুশী খোলামেলা পরিবেশে বাড়তে দেওয়া তার পরবর্তী জীবনের ভালো থাকার এক আবশ্যিক শর্ত। পরিবার, পারিপার্শ্বিকের প্রভাব বড় সুদূরপ্রসারী - তা তার জীবন দিয়ে উপলব্ধি করেছে সে। তবু এ কথাও হয়ত ঠিক, এই মানসিক চাপ ছোটোবেলায় সহ্য করতে পেরেছিল বলেই হয়ত পরবর্তী জীবনের শত সহস্র ঝড়ঝাপটা এবং ক্রমাগত ব্যর্থতার সামনে বুক বেঁধে দাঁড়াবার সাহস পেয়েছে সে।

    জীবন থেমে থাকেনি। কখনো তসলিমা র কলাম আর কখনো সুমন চাটুজ্যের গান আঁকড়ে মেয়েটি কাটিয়ে ফেলে তার মেয়েবেলা। সমস্ত অন্যায়, অবদমন, অসাম্যের বিরদ্ধে বুকের ভিতর একরাশ ঘৃণা আর প্রতিবাদের আগুন জ্বালিয়ে বড় হয়ে যায় মেয়েটি।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৭ মার্চ ২০১৯ | ৬৫১ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ব্যাধিনী -
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে প্রতিক্রিয়া দিন