এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • কেস জন্ডিস

    Sutapa Das লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১১ এপ্রিল ২০১৯ | ১৫১৫ বার পঠিত
  • অর্ধশতাব্দীর দোড়গোড়ায় এসে বড় অঙ্কের ইনসিয়োরেন্স করতে গিয়ে টেলিফোনিক মেডিক্যাল চেকআপের চক্করে মেয়েবেলার অভিজ্ঞতা স্মৃতির নিস্তরঙ্গ পুকুরে বড় মাছের মত ঘাই মেরে উঠলো।

    দুপুরবেলায় স্কুলের ব্যস্ত সময়ে সুদূর মুম্বাই থেকে এক ডক্টর ম্যাডামের কল। তাঁর 33তম প্রশ্নটির উত্তরে বলতে হলো তেরো বছরে একবার জন্ডিস হয়েছিল আমার, তারপরে মগজের ভাঁজ থেকে যে ক্যালাইডোস্কোপিক ছবি উঠে আসতে থাকলো তাতে কথোপকথন না থামাতে পারলে হিংলিশে আর বেশীক্ষন টানা যেতনা। মন ততক্ষনে আসন্নপ্রসবার শরীরের মত শব্দে ছবিতে ভারী হতে শুরু করেছে, ম্যাডামজীর এক প্রশ্নের উত্তরে তাই বলতে হলো, 1982 তে জন্ডিস হয়ে যাবার পর লিভার ফাংশন টেস্ট ডক্টররা অর্ডার করতেন না বলে হয়নি, আর অন্য কোন জ্ঞাতব্য আছে কি তাঁর? অবশেষে বিদায়জ্ঞাপন ও ক্ষান্তি।

    যে সময় জন্ডিস ধরা পড়ে, সে সময় আমি সদ্য স্কুল পাল্টেছি, সেভেন থেকে এইটে উঠে রাষ্ট্রীয় বালিকা বিদ্যালয় ছেড়ে শিলিগুড়ি বালিকাদের সঙ্গে পড়বো বলে অ্যাডমিশন টেস্ট দিয়েছি (ভাগ্যিস আর টি ই বাবুরা ছিলেন না তখন, যোগ্যতা প্রমাণ করে বিদ্যালয়ে ভর্তি হতে 'সুকুমারমতি' দের মোটেও মানসিক চাপ হতনা সে আমলে, বরং সেটিই স্বাভাবিক ছিল) । সে ধান ভানতে শিবের গীত থাক, জন্ডিসে ফিরি।
    মামাবাড়ী বিরাট একান্নবর্তী পরিবার তখন, পাঁচমামা তিনমামী, দাদু দিদা, খলবলে গোটাচার তুতো ভাইবোন, মাসী তার মেয়েসহ অবস্হিতা, 24*7 সব সামাল দেওয়া সহায়ক নাগিন্দার ভাই, দুইখান অ্যালশেসিয়ান হলো পরিবার। জুটলাম গিয়ে আমি , যার মা সেবাড়ীর বড় মেয়ে , অসময়ে লোকান্তরিতা। তো, ভর্তি পরীক্ষা দেবার পরই জ্বর, নামতে চায় না ঠ্যাঁটা রকম, সাথে বমিভাব কখনো বমি হয়ও, নিস্তেজ পান্ডুবর্ণ মেয়েটিকে বড়মামী নিয়ে গেলেন সেই থানামোড়ের মৃদুল ডাক্তারবাবুর কাছে, যার কথা আগে লিখেছিলাম, লাল/রানী রঙা তরল ওষুধের শিশিতে খাঁজ কেটে কাগজ মার্কা দিয়ে দিতেন, তিন চার বার খেলে মোটামুটি পেটছাড়া থেকে জ্বর সব পালাতো। পরীক্ষা টরীক্ষার বিশেষ বালাই ততকালে ছিলো না। তো, তিনদিন লাল ওষুধে জ্বর না ছাড়ায় রক্তপরীক্ষা , রক্ত দেবার ভয় সাহসীমুখোশে ঢেকে সে পর্বশেষে কনফার্ম হল কেস জন্ডিস। এরপর আসল গল্প।

    আমার দাদু, মায়ের বাবা, প্রবল পরাক্রমী এক পুরুষসিংহ, বরিশালী নিয়ম মেনে রাতে ছোট বাইরে করতে যেতেন না, ঘরে রাখা থাকতো গামলা, পোলাপান যারা দাদু কি মাগো (দিদিমা)র বিছানায় শুতো , তারাও সক্কলে রাতে সেই গামলায় রাতভোর জলবিয়োগ করতো। পরপ্রভাতে দাদুর নৈমিত্তিক কাজ ছিলো সেখানি পরিষ্কার করে ফেলা। তো এহেন দাদু স্বপ্নাদিষ্ট ছিলেন জন্ডিসের ওষুধের। কোন পয়সা নিতেন না, একটি ওষধি দিতেন বিশেষভাবে খেতে, রোগ পালালে মা বিষহরির পুজো দিতে বলতেন পাড়ার কোন কালীবাড়ীতে। এবার তিনি কেন ডাক্তারের রেগনির্নয় মানবেন? বাড়ীর লোকের ক্ষেত্রে তার নির্নয়পদ্ধতি ছিল বড়ই বিচিত্র!
    সারারাতের ভরা গামলায় জন্ডিস সন্দেহ করা হচ্ছে যার, তাকে জলবিয়োগ করতে হবে, যদি সম্পূর্ন হলুদ করে ফেলতে পারে শেষজনের হিসু, অন্য লক্ষনগুলির উপস্হিতি সাপেক্ষে তবে অবশ্যই তার কেস জন্ডিস! এমনকি হসপিটাল থেকেও অনেকে আসতো ওষুধ খেতে, মাসে বারো থেকে পনেরো জন তো বটেই,সে ওষুধের প্রস্তুতিপ্রক্রিয়া বলছি পরে। দাদু কিনা ছবি হয়েছেন 1984 তে, আর লাঠির বাড়ি খাবার ভয় নাই, নিঃশঙ্কচিত্তে সে গূঢ়তথ্য জনসমক্ষে আনাই যায়।

    আমার হিসুটেস্ট হয়ে যাবার পর , এক কেজি গরুর কাঁচাদুধ ফেলে রেখে দই জমানো হল জানুয়ারীর শীতে। বাড়ীতেই ছিলো কতক গরু, মাগোকেও কখনো সখনো গরু দুইতে দেখেছি সর্ষের তেলের বাটি পাশে নিয়ে দুই হাঁটুর মধ্যে বালতি ধরে বসে, তবে কালে ভদ্রে গোয়ালা না এলে। একটা অদ্ভুত ছন্দ দুধ বালতিতে পড়বার, নাহ্ সে এখন থাক। দই তো জমলো, সে সংবাদ দাদু পেয়ে পরের সকালে উঠেই হাত দাঁ নিয়ে গুটিগুটি রওনা শুঁড়বাড়ীর বাগানে, যাদের বাড়ীর চন্দ্রিমা পরে আমার স্কুল যাবার সঙ্গী ছিল টানা তিনটি বছর। খানিক যায় আর পিছু ফিরে চায়, কেউ পিছু নিলো কি না দেখে। যে গাছের ডালটি কেটে ভেতরের ছালটি কুচি করে কেটে বাটতে দেবে শিল নোড়ায়, সেটি স্বপ্নাদেশ সুতরাং গুপ্ত রাখা বাঞ্ছনীয়। এদিকে বাড়ীর লোক যে ও তল্লাটের বাকল ছাড়া গাছগুলি দেখতে দেখতে চিনে গিয়েছিল বিশেষ গাছটিকে, সে তথ্য সম্ভবত দাদুর ভান্ডারে ছিলো না। সে যাক, সেই ছালে প্রস্তুত অদ্ভুত কাষায় মন্ড, কলাপাতায় দই দিয়ে মেখে খেতে হল , পাশে বড় চামচ নিয়ে বসলে বাচ্চাদের কাছে যমস্বরূপা বড়মামী , যাতে বমি করে ফেললে আবার চালান করে দেওয়া যায় মুখে। চ্যাঁচামেচি কান্নাকাটি করে সে তো পেটে গেল!আধঘন্টা চিপ করে শুয়ে থাকা যাতে উঠে না আসে, আর সারাদিনে খাওয়া শুধু দই!

    আশি শতাংশের এতেই সেরে যেত, কিন্তু আমি কিনা ঘাড়ে একজোড়া বিশেষ হাড় নিয়ে জন্মানো ঘাড়ট্যারা অনন্যা, আমি পড়লাম বাকী কুড়ি শতাংশে। তিনদিন পর আবার 'মূত্রবিসর্জন টেস্ট, আবার ছাল আর দই .... অবশেষে রোগমুক্তি ঘোষনা হল মূত্র ও রক্ত দুই পরীক্ষাতেই!আর ক্ষিদে যেন দিনদশেক না খেতে পারাকে পুষিয়ে নিলো, অমৃতসম কচ্ছপের ডিম, মাংস সব খেয়েছি সেরে ওঠার মাসখানেকের মধ্যেই!

    জেনে নিয়েছিলাম ঐ ওষধি, উত্তরবাংলায় যত্রতত্র বেড়ে ওঠা সে বেড়া দেবার গাছের ভেতরের ছালের আশ্চর্য গুণ। নিজেও খাইয়েছি নিয়ম মেনে অন্যকে, ফলও পেয়েছি।সেরে উঠে সাতদিনের দিন বিয়ের পিঁড়ি আসীন হয়েছে মাসী, এমন ওষুধের মহিমা!

    চলে গেছেন দাদু, বলেছি ওষধিগাছ নিয়ে যারা নাড়াচাড়া করেন তাদের অনেককে, কিন্তু গাছটা নিয়ে কাজ হয়েছে শুনিনি। দইয়ের সঙ্গে কি বিক্রিয়ায় যকৃত অত দ্রুত রোগমুক্ত হয় তাও অজানা রয়ে গেল।

    তখন আমরা লিভার ফাংশন টেস্টের নামও শুনিনি, শিলিগুড়ির মত বর্ধিষ্ণু শহরে হোত কি না তাও জানা নেই।

    তবে সেবার বাড়ীর মনসা পুজোয় আমার সেরে ওঠায় পুজো দেওয়া হয়েছিল নাম করে, মনে আছে।

    আজ আর ভীড় করে আসেনা লোক, জন্ডিস নাকি সেরে ওঠে ন্যাবার মালায় নয়তো ডাক্তারী বিধি মেনে বিশ্রাম আর পথ্যে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১১ এপ্রিল ২০১৯ | ১৫১৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু মতামত দিন