— হিলবার্টের হোটেল ব্যাপারটা কী জানো? — এলিভেটর থেকে বেরিয়ে লোকটা আমায় জিগ্যেস করল — যেসমস্ত জিনিস মানুষ কেবল তার স্বপ্নে কল্পনা করতে পারে, তার প্রত্যেকটা এই মস্তি সেন্টারে পাওয়া যায়। প্রতিটা ফ্লোর ভর্তি হয়ে আছে হরেকরকম জিনিসে।
যে ফ্লোরটায় আমরা হাঁটছিলাম তার চারদিকে কাঁচের দেয়াল, ওপারে সূর্যাস্ত। অনেক নীচে মেঘগুলো সবকিছু ঝাপসা করে রেখেছে। — মস্তি সেন্টার হচ্ছে হিলবার্টের শপিংমল অথবা তার সবচেয়ে কাছাকাছি বস্তু যা ওরা বানাতে পেরেছে। কেউ জানেনা এ বাড়িটা কততলা। কিংবা শুধু ওরা জানে। — লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে শেয়ালের মত ধূর্ত ধূসর মুখে হাসল — পাল্টে যাবে তোমার জীবন এইবার। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার সে উচ্চারণ করল বাক্যটা।
মাসখানেক আগে কোনো ধোঁয়াটে সন্ধ্যেয় রাস্তার ধার ঘেঁষে সোডিয়াম ভেপার ল্যাম্পের মিয়ানো আলোর নীচে ট্যাক্সিটা দাঁড় করিয়ে আমি পেচ্ছাপ করতে নেমেছিলাম। পানের পিক ও গুটখার দাগলাগা একটা ভাঙা পাঁচিলের গায়ে পেচ্ছাপ সেরে একদলা থুতু ফেলে গাড়িটার কাছে ফিরে এসে একবার বনেটটা খুলে দেখব কিনা ভাবছি, ইঞ্জিনের আওয়াজটা একটু গড়বড় ঠেকছিল চালানোর সময়, তখনই লোকটা অন্ধকারের ভেতর থেকে হঠাৎ উদয় হয়েছিল যেন। মুখ থেকে সিগারেটটা নামিয়ে হিলহিলে সাপের মতন ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিল — তোমাকেই খুঁজছিলাম! ধোঁয়ার ফণাটা ক্রমে ল্যাম্পপোস্টের আলো বেয়ে উঠে যাচ্ছে দেখতে দেখতে আমি জিগ্যেস করলাম — কোনদিকে?
— কোনো দিকে নয় হে, যাবার আর কোনো দিক নেই এই শহরে। — হেসে উঠে ভাঙা পাঁচিলটার গায়ে পোস্টারগুলো দেখতে দেখতে — প্লাস এইসব ভুতুড়ে ব্যাপার চলছে। দেখেছ কীরকম ভূতের গল্পের আসর বসিয়েছে?
আমি আড়চোখে তাকালাম পোষ্টারগুলোর দিকে। গায়ে কাঁটা দেওয়া ভূতের গল্পের শো বসছে শহরের একটা প্রেক্ষাগৃহে, সময় ও টিকিটের দাম জানিয়ে তারই বিজ্ঞাপন।
আমি বললাম — ট্যাক্সি দরকার নেই তো আমাকে খুঁজছিলেন কেন?
— কারণ আছে। শোনো। এই যে সকাল থেকে সন্ধ্যে অব্দি রঙচটা ঢরঢরে একটা ট্যাক্সি নিয়ে শহর চষে বেড়াও, এই জীবনটা পাল্টে ফেলো এইবার। মস্তি সেন্টার চেনো? চলে এসো ওখানে। যেকোনো দিন। এই যে, আমার কার্ডটা রাখো।
— আপনি কে বলুন তো?
— তোমার মতোই একজন লোক, যাকে আমারই মতো কেউ একজন এরকম কোনো সন্ধ্যেতে জীবন বদলে ফেলার প্রস্তাব দিয়েছিল। আমরা ফিরে ফিরে আসি হে। অবতার বলতে পারো।
— পাল্টে যাবে তোমার জীবন এইবার। ওরা বদলে দেবে সবকিছু। — বলে লোকটা চলে গেছিল, মিলিয়ে গেছিল হঠাৎই। আমি আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম একবার। এই শহরের আকাশ অনেকদিন ধরে আর পুরোপুরি কালো হয়না, লালচে অন্ধকার মুখে গ্যাঁজলা তুলে শুয়ে থাকে সারারাত।
— এরকম মস্তি সেন্টার প্রতিটা শহরের মাঝখানে একটা করে — এখন লোকটার গলার আওয়াজে আমার হুঁশ ফিরল — আর এগুলো একে অন্যের সঙ্গে স্কাইওয়ে দিয়ে জোড়া। ইস্পাতের কাঠামোর ওপর বানানো ঝুলন্ত রাস্তা। আকাশ চিরে চলে গেছে একটা মস্তি সেন্টার থেকে অন্য মস্তি সেন্টারের দিকে। ঐদিকে তাকাও।
লোকটা এইবার আমাকে ফ্লোরের অন্যদিকের কাঁচের দেয়ালটার কাছে নিয়ে গিয়ে দেখালো একটা কালো রাস্তা নেকলেসের মত ঝুলে রয়েছে আকাশের গলায়, আকাশ ফুঁড়ে হারিয়ে গেছে কোথাও।
— এখানে একটা খেলা হয়। ওরা ব্যবস্থা করেছে। রেসিং।
বিয়ের পর শবনমকে নিয়ে যখন প্রথম এসে ঢুকেছিলাম ছোট্টো নোংরা গলিটায়, প্রথম যে কথাটা বলেছিলাম সেটা হচ্ছে — ভেবোনা, কয়েকবছরের মধ্যে বেরিয়ে যাব এই গলিটা ছেড়ে, একটু টাকা জমুক হাতে। শবনম হেসে ফেলেছিল কপালের ওপর এসে পড়া এলোমেলো চুলগুলো বেঁধে নিতে নিতে আর তারপর চোদ্দোখানা বছর কেটে গেল, অথচ আমাদের গলিটা ছেড়ে বেরোনো হলনা। দমবন্ধ করা বাড়িটায় আমরা রয়ে গেলাম, এই ঘুপচি ঘরে মেয়ে জন্মাল, ছেলে হল আমাদের। তবুও আমরা বেরোতে পারলাম না গলিটা ছেড়ে। শবনম আশ্চর্যরকমভাবে গুছিয়ে নিয়েছিল সংসারটা শহরের এই বিচ্ছিরি আবর্জনাভর্তি একটুকরো নরকের মতো গলিটার ভেতরেই, অথচ আমি পারলাম না; ওর মতো ধৈর্য আমার নেই, ছিল না কোনোদিনই।
অসুস্থ পায়রার মতো আমরা চারজন অন্ধকার ঐ গলিটার ভেতর; সারাদিন সিনেমাহলে, স্টেডিয়ামে, মস্তি সেন্টারে, ফুডকোর্টে ট্যাক্সি নিয়ে ঘুরে ঘুরেও আমার গলিটা ছেড়ে বেরোনোর মত টাকা জোগাড় হলনা। তারপর শবনম পা পিছলে পড়ে গেল একদিন। সেদিন রাত্তিরবেলা আমি ঘরে ফিরে শুনেছিলাম শবনমের কোমরে লেগেছে, কোমর থেকে পা অব্দি অবশ। শুয়েছিল বিছানায়। আমায় দেখে লজ্জিতভাবে হেসেছিল। গত ছ'বছর ধরে সে ওরকমভাবেই হাসে আমায় দেখলে। নিজেকে নিয়ে দারুণ বিব্রত হয়ে বেঁচে আছে সে শয্যাশায়ী অবস্থায়।
— স্রেফ মাটির বদলে আকাশে রেস — লোকটা হাসল — এর ফলে যেটা হয় সেটা হচ্ছে খেলোয়াড়রা আর শুধু দৌড়ায় না, পরস্পরকে ঠেলে ফেলে দেবার চেষ্টা করে ধাক্কা মেরে। বুঝতেই পারছ, সবাই ট্র্যাকের মাঝখানে থাকতে চায় —
— কিন্তু — আমি বললাম, আমায় বাধা দিয়ে সে — ভাবছ সবাই একসাথে ধাক্কাধাক্কি করা থামালেই পারে, কাউকেই মরতে হয়না তাহলে, হে হে — চোখ টিপল — প্রিজনার'স ডাইলেমা সহজ জিনিস নয় হে!
বিড়বিড় করে বললাম — এইভাবে যেকোনো দিন মরে যাবার ভয় নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে একেবারে মরে যাওয়াই ভালো।
লোকটা শুনতে পেয়ে — ওরাও তাই ভেবেছিল। কিন্তু একজনও মরেনি, আজ পর্যন্ত একজনও তার স্টিয়ারিঙটা স্বেচ্ছায় ঘুরিয়ে দেয়নি ট্র্যাকের কিনারার দিকে; অথচ এরা সকলেই মরতে চেয়েছিল প্রমাণ আছে। সাইকিয়াট্রিস্টদের রিপোর্ট বলছে খেলোয়াড়রা সবচেয়ে বেশী আত্মহত্যাপ্রবণ থাকে রেসের আগেরদিন রাতে।
— একজনও সুইসাইড করেনি? — আমি অবাক হয়ে জিগ্যেস করলাম।
— একজনও না।
— কারা দ্যাখে এই খেলা?
— সারা পৃথিবীর লোক — মস্তি সেন্টারের ভেতরে লাগানো বড়বড় টিভি স্ক্রিনগুলোর দিকে আঙুল তুলে সে যোগ করল — বিশ্বাস কর, দুএকজন অন্ততঃ ছিটকে না পড়লে দর্শকেরা প্রচণ্ড হতাশ হয়।
হাড়হিমকরা ভূতের গল্পের সেই শো-টার সেদিনই শেষদিন ছিল। ছেলেটা আর মেয়েটা দারুণ জেদ ধরেছিল সকাল থেকেই। একবার দেখতে যাবেই। অবশেষে আমি রাজী হলাম, হুকে ঝোলানো জামাটার পকেট থেকে আমি কয়েকটা নোট বের করে দিলাম ওদের — এরমধ্যেই যা কিছু, আর একটা পয়সাও নয়। আমার হাত থেকে নোটগুলো প্রায় কেড়ে নিয়ে দৌড়ে চলে গেল খুশীমুখে। আমি ঘড়ি দেখলাম, ছ'টা বাজে। সাড়ে ছ'টা থেকে সাড়ে সাতটা, একঘন্টার শো। আমি আস্তে আস্তে গিয়ে ঢুকলাম শবনমের ঘরে। শবনম শুয়ে আছে সেই একই অসহায় ভঙ্গীতে, যেন এভাবেই হাজার বছর। আমায় দেখে জিগ্যেস করল — পায়ের আওয়াজ পেলাম, ছেলেমেয়েদুটো গেল কোথাও? আমি বললাম — হ্যাঁ, ভাইবোনে গেল, ভূতের গল্প শুনতে।
— ভূতের গল্প? — ফিকে হাসল।
— তোমায় ওষুধটা দিই এবার?
— দেবে? — বিতৃষ্ণায় একবার চোখ বুজল সে — দাও।
আমি ওষুধটা এগিয়ে দিলাম। আমার অন্যহাতে এককাপ জল। দিলাম তাকে। খেল সে। তারপর অবসন্নভাবে পাশ ফিরে শুল। বালিশে ছড়ানো তার চুলগুলো। আমি কাপটা মেঝেতে নামিয়ে রেখে পকেট থেকে কোঁকড়ানো প্লাস্টিকের ব্যাগটা বের করলাম। ধীরে ধীরে সেটা পড়িয়ে দিলাম ওর মাথার চারপাশে। মুঠো করে চেপে ধরলাম গলাটা। একটু একটু করে নীল হয়ে গেল ওর মুখ। একটু একটু করে ক্লান্ত হয়ে মরে গেল। শেষদিকে এত হাপরের মতো টান দিয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার চেষ্টা করছিল যে ধরে রাখা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিল। প্লাস্টিকের ভেতর ঘাই মারতে মারতে আলোড়নটা থেমে যেতেই আমি আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালাম। বেরিয়ে এলাম বাড়ি থেকে। ট্যাক্সিটা স্টার্ট দিতে দিতে দেখলাম ঘড়ির কাঁটা সবে সাতটা ছুঁইছুঁই। সবকিছু সময়মাফিক হয়েছে। গলির মুখে পড়ে থাকা একটা জঞ্জালভর্তি ড্রামে ধাক্কা মেরে সেটাকে উল্টে দিয়ে আমি গাড়িটা নিয়ে বেশ জোরেই বেরিয়ে এলাম গলিটা থেকে — আঃ, চিরজীবনের মত মুক্তি! শবনমের থেকে, সবকিছুর থেকে। অনেক অনেকদিন পর গাড়ি চালাতে ভালো লাগছিল আমার।
জীবনটা পাল্টে ফেললাম আমি। ঝুঁকির খেলা হোক, কিন্তু অঢেল আরামে থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা রেসারদের। ওরা সবদিকে খেয়াল রাখে। মেঘগুলোর অনেক নীচে ঐ ধোঁয়া আর জঞ্জালে নষ্ট হয়ে যাওয়া শহরটার সঙ্গে কোনো তুলনাই হয়না। প্রায় এক পৃথিবীব্যাপী মাধ্যাকর্ষণ কাটিয়ে উঠে এসেছি আমি এইখানে; এত উঁচুতে কোনোদিন উঠিনি আগে, যদিনা মানুষ ঈশ্বরের সন্তান একথা সত্যি হয়। এখন হাতে এত পয়সা যে ওড়ানোর জন্যে লোক কম পড়ে যায়। মস্তি সেন্টারে চমৎকার কাটছিল দিনগুলো, কেবল একটা সমস্যা হল। এখানে বৃষ্টি হয়না, কারণ আমরা রয়েছি মেঘেদের চেয়েও উঁচুতে। ফলে খটখটে রাতগুলোতে সবকটা নক্ষত্রকে দেখা যায়, যতগুলো মানুষের চোখে ধরে। আঃ, এমনকি জানলার শেড নামিয়ে দেওয়ার পরেও নক্ষত্রগুলো ফুটে থাকছে মাথার ভেতরে।
হুইসেলের তীব্র আওয়াজটা হতেই বুঝলাম রেসটা শুরু হয়ে গেল। অবেলার চুনখসা আলো পিছলে পিছলে যাচ্ছে স্ট্রীমলাইনড গাড়িগুলোর গায়ে। অ্যাক্সিলারেটরে সর্বশক্তি দিয়ে চাপ দিলাম। এক-একজনকে পিছনে ফেলে দৌড়চ্ছি। সামনে কেবল তিনজন আর, সামান্য ব্যবধান। তৃতীয়জনের গাড়ির পিছনের বাঁ কোণে একটা ধাক্কা মারলাম, গাড়িটা প্রায় নব্বই ডিগ্রী ঘুরে টাল সামলাতে সামলাতে বেরিয়ে গেল ট্র্যাক ছেড়ে। তারপর দ্বিতীয়জনকে পেরিয়ে যেতে সে নিজেই আক্রমণাত্মকভাবে ধাক্কা মারতে চাইল আমায়। চট করে পাশ কাটাতেই হুড়মুড় করে গিয়ে পড়ল প্রথমজনের ঘাড়ে; দুজনেই বেসামাল হয়ে গেল। প্রথম গাড়িটা স্কাইওয়ে ছেড়ে পড়ে যেতে যেতে ড্রাইভারটা চেষ্টা করল দরজা খুলে বেরিয়ে আসতে। তারপর সবসুদ্ধ পড়ে গেল নীচে। এখন আমার সামনে আর কেউ নেই, কিচ্ছু নেই। আর সাত সেকেন্ডের মধ্যেই এই রেসটা জিতে যাব আমি। সাত সেকেন্ড যথেষ্ট সময় আমার কাছে স্টিয়ারিঙটা ট্র্যাকের কিনারার দিকে ঘুরিয়ে দেবার জন্যে। শূন্যের মধ্যে দিয়ে পড়তে পড়তে মেঘের কুয়াশায় আমার ভাবনাগুলো সম্পূর্ণ আবছা হয়ে যাবার আগে — ছেলেমেয়েদুটো কি বাড়ি ফিরেছিল সেদিন? — কেবল একবার সচেতন হয়ে উঠলাম আমি — ভয় পেয়েছিল বিছানার কাছে গিয়ে এলানো চুলের রাশি দেখে? ওরা জানে। বোধহয় ওরা সব জানে। শুনেছি বীভৎস ভূতের গল্প শুনে দর্শক যখন ভয় পায়, পর্দার আড়াল থেকে ওরা টুকে রাখে ভয়গুলো। নিঃশব্দে।