এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • বৃষ্টি ও অনিশ্চিত স্বপ্নের শহর

    সায়ন্তন চৌধুরী লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০৫ এপ্রিল ২০২০ | ১৯৫১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • বালাসাহেব মারা যাবার বছরখানেক পরে বোম্বে এসেছি। সন্ধ্যের ঝোঁকে রাস্তার আলোগুলো জ্বলে উঠেছে; আলো ফেটে রঙ নাবছে, রঙ থেকে ঝিনচ্যাক রঙ। নীরজ ড্রাইভারের সিট থেকে ধমকে উঠল — তুমলোগ শালে — শব্দগুলো থেবড়ে থেবড়ে আমার কানে এসে ঢুকছিল। মণি পাশ থেকে বিড়বিড় করছিল — সব বরফ হয়ে যাচ্ছে ইয়ার, মাথা পুরো এসি হয়ে গ্যাছে। ও বসেছিল নিধি আর আমার মাঝখানে লেগস্পেসে পাদুটোকে যতটা সম্ভব টানটান করে গাড়ির সিটে পাছাটা কেৎরে; মুখে একটা টুপি ফেলে রেখেছিল। নিধি চুপচাপ আলগা চোখে তাকিয়ে ছিল জানলার বাইরে। সামনে নীরজের পাশে বসে প্রিয়া উঁচুগলায় হেসে উঠল; ওর গার্লফ্রেন্ড। এই মেয়েটাকে আমি আগে চিনতাম না। নিধি আর মণির সঙ্গেও দেখলাম প্রিয়ার প্রথম আলাপ হল। নীরজ শালা জীবনে কিছু একটা করবে, দেখিস — মণির বিছানায় চিত হয়ে শুয়ে জয়েন্ট ফুঁকতে ফুঁকতে আজকে দুপুরেই বলছিলাম ওকে। মণি আমার জিগরি দোস্ত; এমনিতে চুতিয়া টাইপের, কিন্তু ছেলে ভালো। ওর ফ্ল্যাটেই উঠেছিলাম; কতবছর পরে বোম্বে এলাম আমি? লাস্ট, শহর ছেড়ে যাই — বান্দ্রা-ওরলি সি লিংকটা খোলেনি তখনও। হুড়হুড় করে পালটে যাচ্ছে সাউথ বোম্বের স্কাইলাইন; দিনতিনেক আগে রাত্রিবেলা যখন একটা বিরক্তিকর শ্লথতায় ফিশপ্লেট জয়েন্টগুলো ঠুকতে ঠুকতে এক্সপ্রেস ট্রেনটা টার্মিনাসে ঢুকছিল, অদ্ভুত শূন্যতার ঘোরে বসেছিলাম আমি, যার জন্যে সম্ভবতঃ আমার জ্বোরো মস্তিষ্কই আংশিক দায়ী ছিল আর দায়ী কামরার ঘোলাটে আলোটা। বেশিরভাগ যাত্রী নামবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে বসেছিল জ্যান্ত লাশের মতন; যদিও তাদের নিঃশ্বাসের শব্দ, নাকটানা, গলা খাঁকরে নেবার উদ্যোগ এবং তারপর গলা খাঁকরানির আওয়াজ, আর সবচেয়ে স্পষ্ট ও ভয়ানক যেটা: আমার উল্টোদিকের সিটে একজন জেদী মায়ের সঙ্গে তার অত্যন্ত অবাধ্য বাচ্চাটির তীব্র চেঁচামিচি পরিস্থিতিটাকে অসহ্য একঘেয়ে করে তুলেছিল। ট্রেনটা ক্রমাগত ট্র্যাক চেঞ্জ করতে করতে লাল সিগন্যাল জ্বলা পোস্টগুলোর পাশ দিয়ে এগোচ্ছিল একটা ধূর্ত শামুকের মতন আর অন্ধকারে বাঁকা লাইনগুলোর গায়ে পিছলে পিছলে যাওয়া টুকরো টুকরো ফ্লুরোসেন্ট উদ্ভাসের পিছনে আমি দেখতে পেলাম আলোঝলমলে প্ল্যাটফর্ম; রাতের মায়াবী শহর নিজেকে উন্মুক্ত করছিল ক্রমশ, ডাইনিপোড়া আলোয় স্ট্রিপটিজ। প্রায় পাঁচবছর পরে আমি এখানে ফিরলাম, যেটা সত্যি বলতে কোনো দুরুহ কাজ ছিল না; অথচ এটাও ঠিক যে একই শহরে দুবার ফেরা যায়না, বালাসাহেবের মৃত্যুর পর প্রথমবার বোম্বে ফিরতে ফিরতে ভাবছিলাম আমি, কেননা শহর পাল্টে যায় আমাদের চোখের পলকে। পুরোনো দিনের গল্প করছিলাম মণির সঙ্গে; প্রায়ই তো পুনে যাই কাজে — মণি বলছিল জয়েন্ট রোল করতে করতে — নীরজের সঙ্গে দেখাই হয়না, নিধির সঙ্গেও বোধহয় দেড়বছর পরে দেখা হবে আজকে, অথচ তিনজনেই বোম্বেতে থাকি। তুই থাক একটু ভাই, আমি সিগারেট কিনে আনি। মণি জামা গলিয়ে বেরিয়ে গেল, দরজা লাগিয়ে ফিরে এসে শুলাম। মণির এককামরার ফ্ল্যাটটা ধুলোয় ভর্তি; চুনকাম-করা দেয়ালের গায়ে হ্যাঙ্গারে জামাকাপড়গুলো ঝুলছে। জানলার পর্দা টানা, ঠিক ঘুম পাচ্ছিল না, ঘোর-ঘোর লাগছিল; আলোআঁধারিতে উপুড়-করা ফোনটায় পিংক ফ্লয়েড বাজছিল। বিকেলের দিকে নীরজ আসবে গাড়ি নিয়ে, আমি হাত বাড়িয়ে ইউটিউবে স্যাড বলিউড সংস সার্চ মারতে যাচ্ছিলাম। এইসময় দরজায় ঠকঠক। যাঃ শালা, মণি এত তাড়াতাড়ি ফিরে এল? ধড়মড় করে উঠতে গিয়ে মেঝেতে পায়ের কাছে রাখা সবুজ বঙটা উল্টে গেল। সেটাকে সোজা করে দরজা খুললাম। নিধি।
     
     
    নিধিকে আমি ছোটবেলা থেকে চিনি। নাগপাড়ায় গুলমোহর চওলে আমাদের কয়েকটা ঘর পরেই ওরা থাকত। নিধির বাবা হিন্দুস্তান লিভারের সাবানের ফ্যাক্টরিতে চাকরি করত। এলাকায় লোকটার সামান্য পরিচয় ছিল ইউনিয়নের নেতা হিসেবে। নব্বইয়ের গোড়ার দিকে একদিন বর্ষার রাতে মোড়ের মাথায় ইরানী রেস্তোরাঁটার সামনে সেনার গুন্ডারা নিধির বাবাকে ড্রেনের ঘোলাটে জলে ফেলে বেধড়ক পিটিয়েছিল। ততদিনে — সত্তরের দশকে রাস্তায় বাল ঠাকরের পাশাপাশি দত্তা সামান্ত, জর্জ ফার্নান্ডেজ, নামদেও ধাসাল, জে ভি পওয়ার ইত্যাদি যেসব রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীসমূহ ছিল, তারা সরে গিয়ে শিবসেনার পথ পরিস্কার হয়ে গেছে। বোম্বে পালটে যাচ্ছে দ্রুত, যার মূলে দুটো ঘটনা — এক, বিরানব্বইয়ের রায়ট আর দুই, ইকোনমিক লিবারালাইজেশন। সাতানব্বই সালের গোড়ায় দত্তা সামান্ত খুন হলেন; তদ্দিনে মণির সাথে আমার আলাপ হয়ে গেছে ইস্কুলে। কবিতা জিনিসটা আমরা তখন টেক্সটবইয়ে পড়তাম। একদিন টিফিনবেলায় দেখলাম মণি খুব নিবিষ্টভাবে সাভারকরের 'পরত মাত্রুভূমিলা' কবিতাটা বই থেকে ছিঁড়ল; তারপর বল পাকিয়ে ঘরের কোণে ছুঁড়ে গম্ভীরভাবে ঠোঁট বেঁকিয়ে আমাকে বলেছিল — সেলুলার জেলে ফেরত পাঠিয়ে দিলাম। — মানে? — পেট্রিয়টিক কবিতাগুলো প্যাথেটিক — বলে খাতা বের করে আমায় ওর একটা লেখা পড়ে শুনিয়েছিল। একটাও মেটাফর আমার মনে নেই, কিন্তু এটা মনে আছে যে কবিতাটার বিষয় ছিল প্রেম আর তাতে মেয়েদের বুক সম্বন্ধে কবির কিছুটা বাড়তি উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছিল। এরপরের বছরগুলোতে মণি ও আমি মারাঠী সাহিত্যিকদের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠি এবং খুঁজে খুঁজে সমসাময়িক লেখাগুলো পড়তে থাকি; কিছু কিছু ইংরেজি লেখাও পড়ি। দিলীপ চিত্রে, অরুণ কোলাতকার, নামদেও ধাসাল, মনোহর ওক পেরিয়ে এসে বোম্বেতে তখন লিটল ম্যাগের একটা নতুন ধারা তৈরী হচ্ছে। নতুন কবিতা বেরিয়ে আসছে নব্বইয়ের লিবারালাইজেশন আর গ্লোবালাইজেশনে পাল্টে যাওয়া একটা দেশের বিজনেস ক্যাপিটালের পেটের ভেতর থেকে, যে শহরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে জাল বুনে চলেছে দাউদ ইব্রাহিম থেকে হিন্দু-হৃদয়সম্রাট বালাসাহেব, সকলেই। — বালাসাহেব মারা যাবার পর বোম্বে পুরো থমথমে হয়ে গেছিল — নিধি অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে বলল। জানি — বললাম আমি — খবরে দেখেছিলাম। নিধি আমার দিকে একটু স্থিরচোখে তাকিয়ে — আই ফেল্ট লোনলি দ্যাট ডে; অদ্ভুতভাবেই। প্রত্যেকটা শহরে লোকের একা হয়ে যাবার তরিকা ডিফারেন্ট। — কথাটা বেশ পোয়েটিক। লিখিস তুই এখনও? নিধি টম ওয়েটস চালিয়েছিল। ওয়াল্টজিং মাটিল্ডা। ভারী গলাটা ঘুরপাক খাচ্ছিল ঘরের ভেতর; মণি আসতে দেরী করছে, আমি ভাবলাম। নিধি অন্যমনস্কভাবে বলল — সেদিন দুপুরবেলা আমার খুব পেটের যন্ত্রণা হচ্ছিল। পিরিয়ডস। আমি শুয়েছিলাম ফাঁকা ঘরে; কোনো দুর্বোধ্য কারণে নিজেকে হেল্পলেস লাগছিল। খবরে বলছিল সারা শহর থেমে গেছে। ফিউনারেলে যোগ দিয়েছিল পনেরো লক্ষ লোক। ওয়ান পয়েন্ট ফাইভ মিলিয়ন পিপল। — অস্বাভাবিক কিছু তো নয় — আমি বললাম — অন্যরকম হলেই অস্বাভাবিক হতো।
    — আমার মণিকে কল করতে ইচ্ছে করছিল। করেছিলাম। ফোনে পেলাম না।
    — আমাকে করতে পারতিস একবার।
    — কেন?
    আমি চুপ করে রইলাম; কারণ কথায় কথা বাড়বে। মণি কিছুক্ষণ পরে ফিরে এল। মদ এনেছি ভাই — একগাল হেসে বলল।
    — নীরজ এলে হাসপাতালে যাব আমরা, খেয়াল আছে? — নিধি।
    — আরে ইয়ার দু'পেগ মেরে দোবো টুক করে। হাসপাতালে তো আর ডাক্তার আমাদের চেক করবে না।
    তর্কাতর্কির পর স্মার্নফের বোতলটা খোলা হয়েছিল। একটু একটু করে কখন যে অনেকটা খাওয়া হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। নীরজ গাড়ি চালাতে চালাতে ফের বিরক্তস্বরে বলল — তোদের কোনো কান্ডজ্ঞান নেই। এই অবস্থায় হাসপাতালে গেলে সিকিউরিটি ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে।

    নেশা হলে পৃথিবীটা কেমন দূরে চলে যায়; একটা টানেলের ভেতর ঘুরপাক খেতে খেতে স্লো-মো আওয়াজগুলো যেন ইউস্টেচিয়ান টিউবের গন্ডগোল পেরিয়ে পেরিয়ে ঢোকে আর আলোগুলো — সোডিয়াম ভেপারের ভূতুড়ে খুনেহলুদ আলো, সামনে চারচাকার টেল ল্যাম্পের তীক্ষ্ম হুঁশিয়ারি আলো, হলদে-কালো অটোর ইন্ডিকেটর, জ্যাম বাঁধাবে বলে যে খ্যাজাব্যাজা বাসটা হুড়মুড়িয়ে এগিয়ে গেল, তার কানা হেডলাইটের আলো, ট্রাফিক সিগন্যালের লাল-সবুজ আলো, তেকোণা স্টপ সাইনে ধাক্কা মেরে ফিরে আসা ফ্যাকাশে আলো, মসৃণ পিচে আছাড় খেয়ে লাফিয়ে ওঠা চাবুক আলো, রাস্তার পাশে দোকানের নাম-লেখা নরম নিয়ন আলো, দোকানের ভেতর থেকে ছিটকেপড়া বুড়ো ফ্লুরোসেন্ট, খাড়াই ফ্ল্যাটবাড়ির গায়ে ফোকলা দাঁতের ফাঁকে ফ্যাটফ্যাটে সাদা আলো, আরো উঁচুতে টাওয়ারের গালে বিপ-বিপ সংকেত, আরো আরো উঁচুতে যেসব প্লেনেরা নামবে ও এখনও নামতে পারেনি তাদের চক্কর-কাটা আলো, মেঘের গায়ে শহর ওপচানো ফোয়ারা প্রতিফলন — সবকিছু ঘেঁটে ঘেঁটে নকটার্নাল অবসাদে ফোকাস থেকে খসে পড়ে। নীরজের সাথে যেদিন আমার পরিচয় হয়, সেই অন্ধকার হয়ে আসা বিকেলটায় খুব বৃষ্টি পড়ছিল। আমরা বসেছিলাম আন্ধেরির একটা সস্তা ক্যাফেতে। কাছেই একটা স্টুডিওয় কোনো মারাঠী ফিল্মে নিধির ড্যান্স এক্সট্রার অডিশন ছিল, সেই প্রথমদিকের কয়েকটা অডিশনে আমি ওর সঙ্গে যেতাম; বাবার স্কুটারটা চালাতাম আমি। নীরজ কী যেন করত একটা, ছোটখাটো টেকনিশিয়ান ছিল বোধহয়। সেদিন নীরজের সঙ্গে আমার আলাপ করিয়ে দেয় নিধি। বড় বড় ফোঁটায় জল পড়তে শুরু করলে নীরজই ক্যাফেটায় গিয়ে বসার প্রস্তাব তুলেছিল। বৃষ্টি থামার জন্যে অপেক্ষা করতে করতে আমরা তিনজনে সেদিন গল্প করেছিলাম অনেকক্ষণ। নীরজ কথায় কথায় বলেছিল — সিনেমার লাইনটা পুরো ফালতু হয়ে গেছে ইয়ার। কেবল ব্যবসা আর ব্যবসা। তারপর ধীরে ধীরে শুনিয়েছিল ওর কমপয়সায় ছবি বানানোর প্ল্যান। মুখের সিগারেটটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে জলে-ভেজা রাস্তা, অপসৃয়মান গাড়ি আর মোটরসাইকেলগুলো, এবং হাইরাইজের গা বেয়ে উড়ে যাওয়া অবেলার ছাইরঙ দেখতে দেখতে নিধির দিকে তাকিয়ে হেসেছিল — কিছু তো একটা করতেই হবে, তাই না? নিধির ব্যাপারটা আমি জানতাম। একটা সাদা সি-সাইড বাংলোয় শ্যূট করার কথা ভাবত সে একদিন, যেরকম বড়ো বড়ো স্টারেরা করে থাকে। তখনও নিধি ফেড-আপ হয়ে গিয়ে এসকর্টের কাজটা নেয়নি। মণি সেদিন ছিল না আমাদের সঙ্গে। মণি আর আমি তখনও নানারকম ধান্দাবাজি করে বেড়াচ্ছি। চালচুলোর ঠিক নেই। বিভিন্ন আলফাল জিনিসের দালালি করে বেড়াতাম। মণির রোখ চেপেছে তখন একটা লিটল ম্যাগ বার করবার। নীরজের সঙ্গে দেখা হবার কয়েকমাস পরে প্রথম বেরিয়েছিল আমাদের ম্যাগাজিনটা। মণি সম্পাদক; আমি ম্যাটারগুলো প্রেসে বয়ে নিয়ে যেতাম, নিধি প্রুফ দেখত। নিধি খুব ভিসেরাল কবিতা লিখত; মণির মাথায় কিছুদিন বীট জেনারেশন চেপেছিল। গ্রেগরি করসোর মতো গাঁজা, ট্যাবলেট খেয়ে টানা প্রোজপোয়েম লিখে যেত কোনো ভাবনাচিন্তা না করে, মাঝে মাঝে নিধিকে আর আমাকে জ্ঞান দিত। নীরজ কখনও কখনও ইলাস্ট্রেশনে সাহায্য করত। বেশিদিন চলেনি ব্যাপারটা; বছরখানেক বাদেই আমাদের ধৈর্য ফুরিয়ে যায়। আমার একটা উপন্যাস লেখবার শখ হয়েছিল, সেটা আর শেষ হয়নি। উপন্যাসটা ছিল বিরানব্বই সালের দাঙ্গার ওপর, একটা লোকের কাপড়ের দোকান ছিল, একদিন সে দাঙ্গার মধ্যে হারিয়ে গেল; দোকানে গিয়ে আর বাড়ি ফিরল না। লোকটার ছেলে তার মায়ের সঙ্গে থানায় থানায় ঘুরে বেড়ায়, মর্গে শোয়ানো সারি সারি রক্তমাখা বেওয়ারিশ লাশ দেখতে যায়। লোকটাকে তারা খুঁজে পায়না; লোকটা আর ফিরে আসেনা। লোকটার রঙচটা স্কুটার ঘরের একপাশে দাঁড় করানো থাকে।

    সূর্য ডুবে গেছে বেশ কিছুক্ষণ হলো; আরবসাগরের ওপারে আকাশের কিনারা বরাবর ঢিমে-লাল ফ্র্যাগমেন্টেড পট্টিটা ক্রমশ জুড়িয়ে আসছে শ্লেট-রঙা ঠান্ডা প্রলেপে। জানুয়ারীর সমুদ্রে সোনালী-কালো ঢেউ; লোকজন ভিড় করেছে মেরিন ড্রাইভের প্রমেনেডে। কুইনস নেকলেস বরাবর জ্বলে উঠেছে রাস্তার হলুদ আলোগুলো আর অজস্র গাড়ির হেডলাইট; দূরে নরিম্যান পয়েন্টে ঝলমল করছে ট্রাইডেন্ট হোটেলটা। নীরজ ভি এন রোডে টার্ন নিতে নিতে বলল — হাসপাতাল যাওয়া ক্যানসেল, চল কোথাও গিয়ে বসি। মণি খাড়া হয়ে টুপিটা মাথায় চাপাল — কোলাবার দিকে চ। গোকুল। — বারে? — হাসপাতালে যাচ্ছি না বললি তো? কোনো উত্তর না দিয়ে ফ্লোরা ফাউন্টেনের কাছে এসে নীরজ এম জি রোড ধরল। তিরানব্বইয়ের ব্লাস্টে প্রথম বোমাটা ফেটেছিল স্টক এক্সচেঞ্জের বেসমেন্টে রাখা একটা গাড়িতে। অ্যালকোহল-ভেজা রাতে এসব দুমদাম মনে পড়ে যায়; আসলে কিছুই মনে পড়ে না, একটা অস্বচ্ছ মাকড়সা কেবল মগজের অলিগলি বেয়ে বারবার যাতায়াত করে। এরকম রাতগুলোর কোনো লিনিয়ার স্মৃতি আমাদের ডিস্কে থাকে না; পরে রিকল করার চেষ্টা করলে মাথার ভেতর বোকা সিল্যুয়েট ভেঙে দিয়ে ধাঁধা-আলো জ্বলে ওঠে। অন্ধকারে ওয়েটার ককটেল নামিয়ে রাখল টেবিলে। চুমুক দিচ্ছিলাম আমরা। নীরজ বলছিল ওর ব্যবসার কথা। কম্পিউটার পার্টস স্মাগল হয়ে আসে কাতার থেকে, দুবাই থেকে; ওর মতো ছোটবড় সাপ্লায়ারের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে শহরে।
    — কারবারটা ছোটো রাখতে হয় নজরে পড়তে না চাইলে। চ্যালেঞ্জ আছে ইয়ার।
    তারপর আমাকে বলল — তুই তো পালিয়ে গেলি বোম্বে ছেড়ে। হাসলাম। — দেরাদুন? — মুসৌরি। একটা হোটেলে কাজ পেয়ে চলে যাই। সিনসিনারি পছন্দ নয় — নীলচে পাহাড়, ধূসর খাদ অথবা কুয়াশা, কোনোটাই টানে না আমায়; আমার যা নূন্যতম দরকার, তা হল একটা সিগারেট, যেটা সবসময় সহজলভ্য নয়। মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে, হোটেল থেকে একটু দূরে দিনমজুরদের কয়েকটা ঝুপড়িবস্তি আছে, ওখানে গিয়ে মদ খেয়ে শুয়ে থাকি। সেদিন ঘুমিয়ে গেছিলাম আর বৃষ্টির ছাঁটে মুখটা ভিজে যাচ্ছিল আমার; উঠে হোটেলে ফিরে জাভেরি বাজারে ব্লাস্টের খবরটা পেয়েছিলাম। মণিকে ফোন করেছিলাম রাতে। তারপর কি ভেবে নিধির নম্বরটা ট্রাই করলাম; প্রায় দেড়-দু'বছর পরে। কেমন আছিস? ঠিক আছি। ব্যাস। বার থেকে বেরিয়ে আমরা হাঁটছিলাম ফুটপাত ধরে; পিছনে বড়ে মিয়া, সামনে বাগদাদী। একটু এগিয়েই লিওপোল্ড ক্যাফেটা, যেখানে দুহাজার আটে অ্যাটাক হয়েছিল। মণি বলল — চল ভাই, আজ ফুল মস্তি হোক। আলোগুলো কাঁপতে শুরু করেছে, গোল গোল ঘুরতে ঘুরতে জিগজ্যাগ লাইন তৈরি হয়ে ছিটকে যাচ্ছে, ক্যামেরায় আউট অফ ফোকাস ছবির মতো ঝাপসাটে ব্যাকগ্রাউন্ড কেটে বেরিয়ে আসছে রঙ ও রেখাগুলি। এই যে জাঁকালো প্রজাপতির মতো শহর, এর নীচে আছে একটা পোকায়-কাটা পৃথিবী। বোম্বের তলপেটে জমে থাকা সেই অন্ধকার নামদেও ধাসালের চেয়ে বেশি আর কেউ চিনত না। ভুলেই গেছি আমরা কবে প্রথম ধাসালের কবিতা পড়ি, কিন্তু পড়ার পরে খুব একটা সময় লাগেনি ধাসালের কলমের জোর টের পেতে। আমরা কেউই ধাসালের মতো লিখতে চাইনি, কিন্তু ঐ এসথেটিকসের প্রভাব এড়ানোর ক্ষমতা আমাদের কারুরই ছিল না। বিরানব্বইয়ের রায়ট বোম্বেকে পাল্টে দিয়েছে। কসমোপলিট্যান শহরজুড়ে তৈরি হয়েছে ঘেটো। সাতানব্বই সালে নামদেও সামনায় লিখতে শুরু করেন; পরে আরএসএসের পত্রিকাতেও লেখেন। ততদিনে মণি আর আমি লোয়ার পারেলে একটা কলসেন্টারে ঢুকেছি। মণি ইস্কুলের পরেই পড়াশোনা চুকিয়ে দিয়েছিল। আমি কমার্স নিয়ে টেনেটুনে এগিয়েছিলাম কিছুদূর। একটা কম্পিউটারের ট্রেনিং নিই। ওটা কাজে দিয়েছিল। ব্যাপারটা ঠিক লিগ্যাল ছিল না, বুঝতে পেরেছিলাম আমরা; আইনের ধূসর এলাকায় চলতে থাকা একটা স্ক্যাম। টেক সাপোর্ট। একটা ভাঙাচোরা বিল্ডিংয়ের দোতলায় কতকগুলো ময়লা হলদেটে ডেস্কটপের সামনে বসে আমরা কাজ করতাম। আরও পরে মণিকে ওরা একটা নতুন স্ক্যামে নিয়েছিল, পেনিস এনলার্জমেন্টের। আমার ওটায় যোগ দেবার ইচ্ছে ছিল, কেননা ওটায় ক্লায়েন্টের ইগোর ওপর ডিপেন্ড করে একটা ইন্টারেস্টিং কথার খেলা খেলতে হতো। কিন্তু ওরা আমায় নেয়নি, কারণ স্ক্রিপ্টের বাইরে গিয়ে ইমপ্রোভাইজ করার দরকার পড়ত আর ভাষার ওপর মণির দখল ছিল আমার চেয়ে বেশি।

    মণির ডিরেকশন অনুযায়ী এম জি রোড ধরে ফ্লোরা ফাউন্টেনে সার সার বইয়ের দোকানের কাছে ফিরে এসে, যেখানে রেগুলার আওয়ার্সে একটা অর্জি চলে — শেক্সপীয়ারের ওপর টলস্টয়, টলস্টয়ের ওপর ফ্রয়েড, ফ্রয়েডের ওপর সার্ত্রে — সেই দোকানগুলো পেরিয়ে আমরা চললাম ধোবিতালাওয়ের দিকে; মেট্রো সিনেমা ক্রস করে বাঁদিকে ঢুকে এঁকেবেঁকে কিছুদূর গিয়ে ডি ওয়াই মার্গে একটা পুরোনোমত বিল্ডিংয়ের সামনে থামলাম। গ্রাউন্ড ফ্লোরটা পার্কিংয়ের জন্যে; আমরা লিফটে চেপে তিনতলায় উঠে গেলাম। লিফট থেকে বেরিয়ে একটা ফ্লিকারিং টিউবলাইট জ্বলা হলওয়ের শেষ মাথায় চোখে পড়ল বেগুনি নিয়ন অক্ষরগুলো — পার্পল রেন ড্যান্স পাব। ঢুকলাম ভেতরে। মোটামুটি ভিড়। আমরা কোণার একটা টেবিলে বসলাম। ডিস্কোবলের রঙবেরঙের ডটগুলো মেঝেতে, দেয়ালের গায়ে পোকার মতো উড়ে বেড়াচ্ছিল। ফলস সিলিঙয়ে কয়েকটা রঙীন এলইডি লাইট আর জটিল নকশার প্যাটার্ন। প্রথমেই যেটা চোখে পড়ে, সেটা হলো দেয়ালগুলোয় ফ্রেনেল ল্যান্টার্নের ছড়ানো পার্পল ক্যানভাসে রোব পোয়ান্তের মসৃণ মুভমেন্ট। নীল-সবুজ স্ট্রোব লাইটের ফ্ল্যাশিংয়ের সঙ্গে সঙ্গে কেশার মিউজিকের বিটগুলো নিখুঁতভাবে মিশে যাচ্ছিল আর অ্যামবিয়েন্সটা কমপ্লিট করছিল বাতাসে ভাসমান ভেপারের ওপর গড়িয়ে পড়া হেজ ল্যাম্পের লাল-হলুদ আলোগুলোর স্ক্যাটারিং এফেক্ট। ফ্লোরে ভিড় বাড়ছে ক্রমশ; পঁচিশ-তিরিশ বছরের তরুণ-তরুণীদের সুঠাম শরীর দুলছে ঘোরের ভেতর, নীরজ আর প্রিয়া ওদিকে এগোলো। কখন যেন প্রিয়া কথায় কথায় জিগ্যেস করেছিল — ইন্দিরা গান্ধী কেন নামদেও ধাসালের এগেনস্টে সব চার্জ তুলে নিয়েছিলেন? নামদেও এমার্জেন্সী সাপোর্ট করেছিলেন — নীরজ জবাব দিয়েছিল। মিসেস গান্ধী তাঁর সাথে কথা বলে ইমপ্রেসড হয়েছিলেন এবং দলিত প্যান্থারের বিরুদ্ধে সব চার্জ উইথড্র করে নেন; নইলে নামদেও অ্যারেস্ট হতেন। টেক ইট অফ; ডিজে ট্র্যাক পাল্টাল, পরেরটা ক্যানড হীট, জ্যামিরোকোয়াই। উল্লসিত চিৎকারকে স্বাগত জানাল হঠাৎ-উজ্জ্বল আলোর বন্যা। — হেই ম্যান — একটি নাইজেরীয় যুবক আমার দিকে এগিয়ে এলো — ডু ইউ ওয়ান্ট সামথিং? আমি থতমত খেলাম দেখে মণি তাড়াতাড়ি এসে ছেলেটার পিঠে হাত রাখল; অ্যাসিড অর চার্লি? — ছেলেটা পালটা ওর কাঁধে হাত রেখে বলল দূরে সরে যেতে যেতে। — ছয়ই ডিসেম্বর — ড্রিংকসে শেষ চুমুক মেরে নিধি আমার দিকে ঝুঁকে একটু গলা তুলে বলল — আম্বেদকরের ডেথ অ্যানিভার্সারি। ওর মাথাটা নেশায় নড়ছে অল্প-অল্প; চোখেমুখে হাসতে হাসতে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। খেয়াল করলাম নাচের বৃত্তে নিধি ধীরে ধীরে মিশে যেতে লাগল; প্রথমে একা, পরে একজন চশমাপরা যুবকের সাথে, হাত রাখল কোমরে। সত্তরের দশকে নামদেও ছিলেন বালাসাহেবের কট্টর সমালোচক। পাবলিক মিটিংয়ে তিনি নিজেকে মার্ক্সিস্ট বলে ঘোষণা করেছিলেন, ফলে দলিত প্যান্থারের আম্বেদকরপন্থী নেতাদের সঙ্গে তাঁর জোরালো কনফ্লিক্ট তৈরি হয়। শেষে ১৯৭৭ সালে দলিত প্যান্থার ভেঙে যায়। মুসৌরিতে বৃষ্টি পড়লে আমার বোম্বের কথা মনে পড়ে; হোটেলের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ল্যান্ডিংয়ের জানলা দিয়ে ধোঁয়া-ধোঁয়া আকাশ আর ডীপ সবুজ পাহাড়ী ল্যান্ডস্কেপ দেখি। লুকিয়ে সিগারেট টানতে টানতে খাদের ধারে সেই ব্ল্যু পাইন গাছটার দিকে তাকিয়ে থাকি, যেখানে আমাদের হোটেলের একটা কাপল হানিমুনে এসে সুইসাইড করেছিল। পাইনের নীডলগুলিতে জলের দানা থিরথির করে কাঁপে; স্পেসিফিক্যালি কারোর কথা ভাবিনা এইসময়। নিধির কথাও ভাবিনা। কেবল বৃষ্টির ভেতর বোম্বের ট্রাফিকের ক্যাকোফোনি মিস করি। হাঁটু অব্দি জল জমেছিল সেই বর্ষার বিকেলটায়; স্কুটারটা হাঁটিয়ে হাঁটিয়ে জল ঠেলে ঠেলে এগোচ্ছি নিধি আর আমি পাশাপাশি। একটা হলুদ-কালো ট্যাক্সি প্রকাণ্ড ঢেউ তুলে দিয়ে চলে গেল। নিধির হাতে কালোরঙের ছাতা; আমার ছাতাটা বাড়িতে পড়ে। রাস্তার পাশে দোকানের নীল প্লাস্টিকের ছাউনি খুলে জলে ভাসছে। একটা সবজীওয়ালার ঠেলাগাড়ি শোয়ানো রয়েছে পেট উল্টে। লোকে দাবনা অব্দি প্যান্ট গুটিয়ে জল ভাঙছিল। নিধি থমকে দাঁড়াল; তারপর রাস্তাটা ক্রস করল। স্কুটারসুদ্ধু আমাকে পেরোতে হবে। দুদিক দেখছিলাম, একটা ডাম্পার আসছে। ফাঁক পেলাম না, এদিকেই হাঁটতে লাগলাম। নিধি ওদিকের ফুটপাতে হাঁটছিল, সমান্তরালে।

    কনজিউম করার আধঘন্টা-চল্লিশ মিনিট পরে মলির এফেক্টটা টের পাচ্ছিলাম। ধীরে ধীরে আনক্যানি অনুভূতিটা মাথার ভেতরে চারিয়ে যাচ্ছিল। ঠান্ডা-ঠান্ডা লাগছিল। আলোর প্রতি কনশাসনেস বাড়ছে আর রঙের হরেকরকমের সাররিয়েল শেডগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। মণি হাসছিল; ও হাত নাড়লে ট্রেসারস ফুটে উঠছিল। চোখের সামনে ক্যালাইডোস্কোপ তৈরি হচ্ছে ক্রমে। অদ্ভুত অদ্ভুত জ্যামিতিক শেপ ডিসটর্টেড হয়ে ভেঙে যাচ্ছে; নীলচে সাদা ফ্র্যাক্টাল প্যাটার্ন দেখতে পাচ্ছি আর জলের মতো গ্লব গ্লব মিউজিকটা একটা ডিলেইড ভাইব ছুঁড়ে দিচ্ছিল। বাবরির ঘটনার পরে নামদেও একটা কবিতা লেখেন তীব্র প্রতিবাদ করে। তখন হিন্দুত্ববাদীদের প্রচন্ড সমালোচনা করতেন তিনি। এলোমেলো মনে পড়ছে এসব। মণি হঠাৎ দু'হাত ছড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল — মুম্বাই ফর মুম্বাইকরস ভাই; দিয়ে হাসিতে ফেটে পড়ল। হাসির আওয়াজে ভয় পেয়ে একটা রোগা বেড়াল ভেলপুরিওয়ালার রেখে যাওয়া দ্বিশঙ্কু কাঠের স্ট্যান্ডের আড়ালে সুড়ুৎ করে ঢুকে গেল। রাত দেড়টা বাজছিল; উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটছিলাম আমরা চার্চগেট স্টেশনের দিকে। দুহাজার ছয়ে যখন চার্চগেট থেকে আউটবাউন্ড সাতটা ট্রেনে পরপর ব্লাস্ট হয়, তখন স্লিপার সেল শব্দটা প্রথম ঢোকে আমার ডিকশনারিতে। মণি ইতস্তত করে বলেছিল — যে কেউ হতে পারে; ফুটপাতের ধারে দাঁড়িয়ে লাল গেঞ্জীপরা যে লোকটা মোবাইলে কথা বলছে, পানের দোকানে যে লোকটা সিগারেট কিনে টাকা দিতে গিয়ে দু'বার পয়সা গুনল, যে লোকটা ইলেকট্রনিক্সের দোকানের সামনে টুলে বসে নাক খুঁটছে, যে লোকটা সেলুনে টেবিলফ্যানের হাওয়া খেতে খেতে একবার পকেটচিরুনি বের করে আয়নায় চুল ঠিক করে নিল — এদের মধ্যে যে কেউ হতে পারে স্লিপার সেল। একটা পরিত্যক্ত কনস্ট্রাকশন এরিয়া, একটা ফেলে যাওয়া ব্যাগ, ঘন্টার পর ঘন্টা রোদে দাঁড় করিয়ে রাখা আরোহীহীন স্কুটার — এর যেকোনোটা থেকে পরের বিস্ফোরণের সংকেত মিলে যেতে পারে। অতএব সন্দেহ আর আতঙ্ক। ড্যান্স পাবটা থেকে বেরিয়ে আমরা হাঁটছিলাম মলির এক্সপিরিয়েন্সটা ফীল করার জন্যে; গোল মসজিদটা পেরোনোর সময় নিধি অকারণে হাসতে হাসতে বলল — হাসপাতালের কাছে চলে এসেছি। — হোপফুলি ঢুকতে দেবে এখন। কী রে নীরজ? — আলবাত দেবে। প্যারালাল রাস্তাগুলো ধরে এগোচ্ছি। প্যারালাল লাইনগুলো কখনও মেলেনা; সেদিন রাস্তাটা পেরিয়ে ওর কাছে পৌঁছলে নিধি হঠাৎ আমার দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলেছিল — তুই আর আমার সঙ্গে যাবি না। কোনো কারণ বলেনি; আমিও জিগ্যেস করিনি কেন। বন্ধ লিবার্টি সিনেমার সামনে এসে আমরা কিন্তু অবাক হয়ে গেলাম। উল্টোদিকেই বোম্বে হসপিটালটা থাকার কথা; অথচ কোথাও যেন ভ্যানিশ হয়ে গেছে সেটা। হাজারবার খুঁজেও হাসপাতালটা পেলাম না আমরা, মনে হচ্ছিল স্বপ্ন দেখছি, ঘুমের ভেতর হেঁটে বেড়াচ্ছি রাস্তায়; একটা সিপিয়া কালারের ডাইনোসর বোম্বে শহরের মাঝরাতের দৃশ্যগুলিকে ফ্রেম বাই ফ্রেম ফুটিয়ে তুলছিল রোটোস্কোপে। শেষে কাঁধ ঝাঁকিয়ে আস্তে আস্তে চার্চগেটের দিকে যেতে লাগলাম। একসময় এসে পৌঁছলাম মেরিন ড্রাইভে। সমুদ্রের ঠান্ডা হাওয়ায় একটু শীত-শীত লাগছিল আমার। টের পেলাম ভেতরে ভেতরে জ্বরটা রয়েছে এখনও, যেটা নিয়ে বোম্বে এসেছিলাম; দুহাজার আটের অ্যাটাকের পর স্ক্যাম সেন্টারটা বন্ধ হয়ে যায় রেইডের ভয়ে। একদিন চুপচাপ শহর ছেড়ে চলে যাই আমি; কোনো ঝুটঝামেলা চাইনা আমার। কাওয়ার্ড, এসকেপিস্ট — নিধি বলেছিল। কংক্রিটের পাঁচিলটার ওদিকে সারি সারি টেট্রাপডে ঢেউগুলো আছড়ে পড়ে সাদা সাদা ফেনায় ভাঙছিল; ওই পাথরগুলোয় অনেক কাপল চুমু খেতে গিয়ে তলিয়ে গিয়েছে। নিধির দিকে তাকালাম; ও তাকিয়ে আছে ব্রেকারস পেরিয়ে দূরে মালাবার হিলসের দিকে। আমাদের পিছনে কুইনস নেকলেস জ্বলছে; রাত তিনটের বোম্বে শহর লেথোলজিকায় আক্রান্ত। আর এখানে ফিরব না আমি, আমার লা বেল ডাম সঁ মের্সির কাছে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০৫ এপ্রিল ২০২০ | ১৯৫১ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন