এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বই

  • মিলান কুন্দেরার কবিতা

    Malay Roychoudhury লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বই | ১৫ অক্টোবর ২০২৩ | ৪১২ বার পঠিত
  • 103 | 104 | 105 | 106 | 107 | 110 | 113 | 114 | 119 | 120 | 121 | 123 | 124 | 124 | 125 | 125 | 126 | 127 | 127 | 128 | 129 | 131 | 133 | 134 | 135 | 136 | 138 | 139 | 140 | 141 | 143 | 144 | 145 | 147 | 148 | 149 | 149 | 150 | 151 | 152 | 153 | 154 | 155 | 156 | 157 | 158 | 159 | 160 | 161 | 162 | 163 | 164 | 165 | 167 | 168 | 169 | 170 | 171 | 172 | 173 | 174 | 175 | 176 | 176 | 177 | 178 | 179 | 180 | 181 | 182 | 183 | 184 | 185 | 186 | 187 | 188 | 189 | 190 | 191 | 192 | 192 | 193 | 194 | 195 | 196 | 198 | 199 | 200
    মিলান কুন্দেরার কবিতা : মলয় রায়চৌধুরী

    এক

    মিলান কুন্দেরার ( জন্ম ১৯২৯) সাহিত্যকর্ম আলোচনার সময়ে তাঁর কবিতার আলোচনা হয় না, কেননা কুন্দেরা চাননি যে তাঁর স্তালিনভক্তির সময়কার রচনাগুলো আবার প্রকাশিত হোক। তাঁর কাব্যগ্রন্হ প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালে। ‘মানুষ, একটি প্রশস্ত বাগান’ এবং আরও দুটি কবিতার বই কুন্দেরা লিখেছিলেন যখন উনি একজন ঘোর স্তালিনিস্ত কমিউনিস্ট কর্মী, কলকাতায় লোকে যাকে বলে ‘পার্টি করা’। ১৯৫৫ সালে প্রকাশিত দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ ‘দ্য লাস্ট মে’ উৎসর্গ করেন নাৎসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়া কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব জুলিয়াস ফুচিককে। আঠারো বছর বয়সে, তিনি চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। ১৯৮৪ সালে, তিনি বলেছিলেন যে ‘কমিউনিজম আমাকে স্ত্রাভিনস্কি, পিকাসো এবং পরাবাস্তববাদের মতোই বিমোহিত করেছিল’। মিলান কুন্দেরা সেই প্রজন্মের তরুণ চেকদের অন্তর্ভুক্ত যারা ১৯৪৮ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় কমিউনিজমের আগমনকে উৎসাহের সাথে গ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অনেকেই ১৯৬০-এর দশকের সংস্কারবাদী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, যা ১৯৬৮ সালের ‘প্রাগ বসন্তে’ পরিণত হয়েছিল। সেই গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরাজয়ের পর, তাঁরা ভিন্নমতাবলম্বী হয়ে ওঠেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মিলান কুন্দেরার মতন পশ্চিম ইউরোপে নির্বাসন বেছে নিয়েছিলেন।

    কেন এত চেকোস্লোভাক তাদের প্রথম যৌবনে দিকে স্তালিনবাদী কমিউনিজমকে এত প্রবলভাবে গ্রহণ করেছিল? জেদেনেক ম্লিনার, ১৯৬৮ সালের চেকোস্লোভাক কমিউনিস্ট পার্টি অ্যাকশন প্রোগ্রামের লেখক এবং ১৯৫০-এর দশকে মস্কোতে মিখাইল গর্বাচেভের এক সময়ের সহকর্মী, তাঁর স্মৃতিকথায় এটি স্পষ্টভাবে ব্যাখ্যা করেছেন :-

    "আমি ১৯৪৬ সালের বসন্তে কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলাম, তখন আমার বয়স ষোল বছরও হয়নি । এইভাবে আমি চেকোস্লোভাক কমিউনিস্টদের প্রজন্মের অন্তর্ভুক্ত যারা ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রায় বিশের কোঠায় ছিল, যখন কমিউনিস্ট সর্বগ্রাসী একনায়কত্ব নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছিল, আর আমার রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সেই প্রজন্মের প্রেক্ষিতে অদ্ভুত। আমার প্রজন্ম সেই সময়ের ঘূর্ণিঝড়ের ঘটনাগুলো নিয়ে রাজনীতি সম্পর্কে কিছুটা সচেতন হয়েছিল; একই সময়ে আমাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা তেমন ছিল না । আমাদের একমাত্র অভিজ্ঞতা ছিল যুদ্ধের বছরগুলো আর চেকোস্লোভাকিয়ার নাৎসি দখল, এবং এই সময়ে বলতে গেলে আমরা শিশু ছিলাম। এর প্রধান ফলাফলগুলির মধ্যে একটা ছিল বিশ্বকে কালো-সাদায় দেখা, একদিকে শত্রু আর অন্যদিকে তার প্রতিপক্ষ। ব্যাপারটা হয় এদিকে নয়তো ওদিকের মতন। কোনও মাঝামাঝি জায়গা ছিল না। এইভাবে আমাদের মগজে যে ভাবনা গড়ে ওঠে তা হল এই ধারণা যে বিজয় মানে একদিককে মান্যতা দেয়া আর অন্যটির ধ্বংস হওয়া। আমরা আমাদের আদিম মৌলবাদের মোকাবিলায় ব্যবহৃত যেকোনও যুক্তিকে কাপুরুষতা বলে মনে করতুম। আমরা ছিলুম যুদ্ধের সন্তান যারা আসলে কারো বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেনি কিন্তু আমাদের যুদ্ধকালীন মানসিকতাকে সেই প্রথম যুদ্ধোত্তর বছরগুলোয় বয়ে নিয়ে গেছি। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারির আগে আর তার পরে বেশ কয়েক বছর ধরে, আমাদের সমাজতন্ত্রের ধারণাটা স্তালিনবাদীদের পুরানো প্রজন্মের তুলনায় আরও বেশি আদিম এবং একতরফা ছিল, যারা অতোকিছু সত্ত্বেও, বছরের পর বছর ধরে স্তালিনবাদে ছোটখাটো সমন্বয় করেছিল।"

    সেই সময়ে চেকোস্লোভাকিয়ায় ম্লিন্যার এবং কুন্দেরা ছাড়াও আরও উল্লেখযোগ্য তরুণ স্তালিনবাদী ছিলেন, যেমন, লেখক এবং সাংবাদিক লুডভিক ভাকুলিক (জন্ম ১৯২৬), একজন উদ্যমী এবং সক্রিয় সাংবাদিক, যিনি আশেপাশের অনেকের মতো যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সাহায্য করেছিলেন তার সীমাবদ্ধতা আবিষ্কার করেন এবং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। ভাকুলিকের পরীক্ষামূলক উপন্যাস ‘সেকিরা’ (দ্য অ্যাক্স, ১৯৬৬) একটি "মোহভঙ্গের উপন্যাস", যা চেকোস্লোভাকদের কমিউনিজম নিয়ে পরীক্ষায় ১৯৬০এর দশকের দশকের গোড়ার দিকে হয়েছিল তা উপস্হাপন করে। পরবর্তীকালে, তাঁর অনেক সহকর্মীর মতো, ভাকুলিক ১৯৬৮ সালের প্রাগ বসন্তের সংস্কার আন্দোলনের একজন প্রধান নায়ক এবং ১৯৬৮ সালের আগস্টে ওয়ারশ চুক্তি আক্রমণের পরে একজন ভিন্নমতের লেখক হয়ে ওঠেন। কবি পাভেল কোহাউট, যিনি ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে বিশাল জনতার কাছে তাঁর রাজনৈতিক কবিতা আবৃত্তি করতেন, স্তালিনবাদের মূর্ত প্রতীক হয়ে ওঠেন। তিনিও ভাকুলিক এবং অন্যদের মতো একই পথ অনুসরণ করেছিলেন। ইহুদি লেখক ইভান ক্লিমা এবং আর্নোস্ট লুস্টিগ প্রাথমিকভাবে স্তালিনিবাদী কমিউনিজমের সমর্থক হয়ে ওঠেন কারণ তাঁরা ছিলেন শৈশবে নাৎসি বন্দী শিবিরে সময় কাটানোর মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার ফসল। লুস্টিগকে যখন প্রশ্ন করা হয় যে, ‘‘আপনি কীভাবে স্ট্যালিনবাদকে সমর্থন করতেন?” তখন তিনি শুধু মাথা নেড়ে একটা হতাশ অভিব্যক্তি প্রকাশ করেছিলেন, কারণ তিনি জানতেন যে "সেই অভিজ্ঞতা" যার নেই তার কাছে এরকম অবর্ণনীয় অভিজ্ঞতা ব্যাখ্যা করা যায় না।

    ফিলিপ রথকে দেয়া সাক্ষাৎকারে মিলান কুন্দেরা বলেছেন, “একনায়কতন্ত্র কেবলমাত্র নরক নয়, বরং একই সঙ্গে স্বর্গের স্বপ্ন – পৃথিবীর প্রাচীন কল্পনা যেখানে সবাই একই সাধারণ ইচ্ছা ও বিশ্বাস নিয়ে শান্তিতে বাসচ করবে। একজনের সঙ্গে আর একজনের কোনও গোপনতা থাকবে না। আঁদ্রে ব্রেতঁও এই স্বর্গের কথা কল্পনা করেন, যখন তিনি বলেন সেই কাচের বাড়ির কথা যেখানে তিনি বাস করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। যদি একনায়কতন্ত্র এই আর্কিটাইপগুলো ব্যবহার না করত – যেগুলো আমাদের চিত্তের ও সব ধর্মের গভীরে শেকড় গেড়ে আছে – তাহলে তা কখনই এত লোককে আকর্ষিত করতে পারত না, বিশেযত এর সাকার অভ্যূদ্যয়ের পপথম মপর্বে। যখনই স্বর্গের স্বপ্ন বাস্তব রূপ নিতে শুরু করল, তখন যেকোনো ভাবেই হোক, এখানে সেখানে কিছু লোক দেখা গেল যারা এর প্রতিবন্ধক হয়ে উঠল, সুতরাং স্বর্গের শাসকরা বাধ্য হল ইডেনের বাইরে একটা কয়েদখানা বানাতে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই কয়েদখানা বড়ো হতে থাকলো, যখন কিনা পাশের স্বর্গটি আরও ক্ষুদ্র ও জৌলুসবিহীন হতে থাকলো।”

    স্তালিনবাদী সময়ে রুশ সাম্রাজ্যবাদ যখন চেকোস্লোভাকিয়ায় মানুষের কণ্ঠরোধ করছে, যখন একজন ব্যক্তিমানুষ কী ভাববে বা কী লিখবে, তাও নিয়ন্ত্রণ করছে কমিউনিস্ট পার্টি, তখন মিলান কুন্দেরা মগজে তৈরি করতে আরম্ভ করলেন ব্যক্তি মানুষের প্রতিরোধ। তাঁর কবিতা স্তালিনবাদ থেকে ক্রমশ এগিয়ে গেছে ব্যক্তির স্বাধীনতার দিকে যার ফলে রাষ্ট্রযন্ত্রের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। ১৯৫০ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। যে যুবতীর সঙ্গে সেক্স করছিলেন তাকে বেফাঁস পার্টিবিরোধী কথা বলে ফ্যালেন। পরবর্তীকালে উপন্যাসে তিনি তাই লিখেছেন যে ভালোবাসা আর সেক্স সম্পূর্ণ আলাদা। ফলে, যেমন যৌনতাকে তিনি তাঁর উপন্যাসের এক প্রয়োজনীয় সন্দর্ভ করে তুলছেন ‘দ্য আনবেয়ারেবল লাইটনেস অফ বিইং’-এ, তেমনই রাজনীতি মিশে যাচ্ছে ধীরে ধীরে এই যৌনতার মধ্যেও। একদিকে তিনি ‘আইডেন্টিটি’, ‘ইগনোরেন্স’, ‘দ্য জোক’-ইত্যাদি উপন্যাসে তৈরি করেছেন শ্লেষাত্মক রাজনৈতিক সন্দর্ভ আর অন্যদিকে যৌনতার এক বিকল্প ভাষ্য যা অভিজ্ঞতা ছাড়া সম্ভব নয়। বেশির ভাগ অভিজ্ঞতা চেকোসলোভাকিয়ায় তাঁর কবিজীবন থেকে পাওয়া। The Unbearable Lightness of Being উপন্যাসে, টমাসের একাধিক নারীর সঙ্গে সঙ্গম সম্পর্কে কুন্দেরা বলেছেন, যৌনতার সঙ্গে ভালোবাসার কোনই সম্পর্ক নেই, এবং দ্বিতীয়ত, একজন মানুষকে সবচেয়ে ভালোভাবে চেনার, বা একজন মানুষের অতি নিগুঢ় "আই" বা "বিয়িং" কে চেনার সবচেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে তার সঙ্গে সঙ্গম। শীৎকার, সাবমিসিভনেস, এবং রাগমোচনের মুহূর্তে অস্ফূট সাড়া - ভিন্ন ভিন্ন নারী-পুরুষের একইরকম হয় না।

    দুই

    "কমিউনিস্টরা সর্বদা তাদের পার্টির জন্য সবচেয়ে আদর্শবাদী, সবচেয়ে সাহসী এবং সবচেয়ে উত্সাহী লোকদের নিয়োগ করার চেষ্টা করেছিল," বলেছেন হেদা কোভালিওভা, রুডলফ মার্গোলিয়াসের বিধবা স্ত্রী, যিনি কমিউনিস্ট বৈদেশিক বাণিজ্যমন্ত্রী ছিলেন, আর ১৯৫২ সালে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। প্রকৃতপক্ষে, কুন্ডেরা নিজেও ১৯৫০ এর দশকের গোড়ার দিকে তরুণ চেক কমিউনিস্টদের আদর্শবাদের এইভাবে প্রশংসা করেছিলেন:

    "সুতরাং কমিউনিস্টরা ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে রক্তপাত বা সহিংসতা ছাড়াই ক্ষমতা গ্রহণ করেছিল, আর জাতির প্রায় অর্ধেক তাকে উল্লসিত অভিবাদন করেছিল। এবং এখন দয়া করে মনে রাখবেন: যে অর্ধেক উল্লাস করেছিল, তারা তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি গতিশীল, আরও বুদ্ধিমান, আরও ভাল। হ্যাঁ। আপনি যা চান বলুন, কমিউনিস্টরা আরও বুদ্ধিমান ছিল। তাদের একটি প্রভাবশালী প্রোগ্রাম ছিল। একটি সম্পূর্ণ নতুন বিশ্বের পরিকল্পনা ছিল যেখানে সবাই সমান জায়গা পাবে। তারা দ্রুত তাদের স্বপ্ন, সকলের জন্য ন্যায়বিচারের সেই দীপ্তিকে বাস্তবায়ন করতে শুরু করে দিলো, সকলের জন্য এক স্বপ্নময় বিশ্ব। কিন্তু স্বপটা যেহেতু সকলের জন্য তাই যারা দেশত্যাগ করার চেষ্টা করেছিল তারা নিজেদের সেই স্বপ্নের অস্বীকারকারী হিসাবে পরিচিত হয়েছিল। বিদেশে যাওয়ার বদলে তাদের জেলে পুরে দেয়া হয়েছিল। আর তারপরে এই তরুণ, বুদ্ধিমান এবং র‌্যাডিক্যাল যুবকেরা হঠাৎ করেই এমন অদ্ভুত অভিজ্ঞতায় ভুগতে লাগল যে পৃথিবীতে এমন একটি কর্মকাণ্ড পাঠানো হয়েছে যা তার নিজস্ব নিয়মে চলা আরম্ভ করেছে, আর যে ধারণার উপর ভিত্তি করে কর্মকাণ্ড হবার কথা ছিল তাকে পাত্তা দেয়া হয়নি। যারা এই ধারণা তৈরি করেছিল তাদের বাদ দেয়া হয়েছে। সেই যুবক ও বুদ্ধিমান লোকেরা নিজেদের কাজকেই বর্জন করতে শুরু করল, তারা এটিকে অমান্য করতে শুরু করল, এটিকে তিরস্কার করতে লাগল, এটিকে অনুসরণ করা ছেড়ে দিল, এটিকে তাড়াবার জন্য উঠেপড়ে লাগল। আমি যদি সেই প্রতিভাধর এবং র‌্যাডিক্যাল প্রজন্মকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখি, তবে আমি তার নাম দেবো ‘ইন পারসুট অফ অ্যারান্ট অ্যাক্ট’।”

    এই সাহিত্যিক নির্যাস থেকে আর মিলান কুন্দেরার অন্যান্য অনেক রচনা থেকে, এটা স্পষ্ট যে, যেমন আরও অনেক চেকোস্লোভাক বুদ্ধিজীবী, যাঁরা ১৯৫০-এর দশকের গোড়ার দিকে স্তালিনবাদী ছিলেন, তাঁদের মতনই, কুন্দেরা গভীরভাবে আঘাত পেয়েছিলেন, একথা বিশ্বাস করে যে, কমিউনিস্ট ইউটোপিয়া সম্ভব।তিনি বুঝে গিয়েছিলেন যে তাঁদের প্রজন্মকে প্রতারিত করা হয়েছিল । আরেকজন প্রাক্তন কমিউনিস্ট, পেটর পিথার্ট, বহু বছর পরে তাঁর ভিন্নমত সম্পর্কে যুক্তি দিয়েছিলেন যে তাঁদের আদর্শকে স্তালিনবাদী শাসনের দ্বারা যৌবনে ব্যবহার করা হয়েছিল এই ভাবনার ফলে তাঁদের অপরাধবোধের অনুভূতি কমিউনিস্ট সংস্কার আন্দোলনের প্রধান অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল। ১৯৬০-এর দশকে চেকোস্লোভাকিয়া এবং ১৯৬৮ সালের ‘প্রাগ বসন্ত’ এই কমিউনিস্টদের জন্য ছিল একটি "আত্ম-শুদ্ধিকরণ প্ররোচনা"। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত মিলান কুন্দেরার মতামতের সঙ্গে একমত হয়ে পিথার্ট জানিয়েছেন যে, ১৯৬৮ সালের আগস্টের ওয়ারশ চুক্তি-ভিত্তিক আক্রমণ প্রাক্তন তরুণ স্স্তালিনবাদীদের অপরাধবোধ থেকে মুক্তি দিয়েছিল, যারা ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে সংস্কারবাদী কমিউনিস্ট ছিল আর বুঝতে পেরেছিল যে তাদের দেশকে সোভিয়েত উপনিবেশে পরিণত করতে তারাই কিনা সাহায্য করেছিল। স্তালিনবাদী কমিউনিজমকে সমর্থন করার জন্য কুন্দেরার নিজেকে যথেষ্ট বোকা মনে হয়েছিল। পরবর্তীকালে আর সেই অনুশোচনা তাঁকে ‘প্রতিবন্ধী মানবিক জ্ঞানের সম্পূর্ণ তত্ত্ব’ তৈরিতে সাহায্য করেছিল । শাসকদের হাত ফসকে বেরোনো কর্মকাণ্ডের অপ্রত্যাশিত পরিণতি থেকে মানবজীবনে যে কী ঘটতে পারে তা ভালোভাবে টের পেয়েছিলেন তিনি।এই থিমগুলো কুন্দেরার অনেক পরিণত লেখার কাজে পুনরাবৃত্তি হয়েছে। তাঁর অল্প বয়সের অভিজ্ঞতা তাঁর পরিণত সৃজনশীল লেখার জন্য একটি অপরিহার্য প্রেরণায় পরিণত হয়েছে, যার প্রধান উদ্দেশ্য হল মানুষের উপলব্ধির ঘাটতিগুলির বিরুদ্ধে সতর্ক থাকা। একই সময়ে, তিনি স্পষ্টতই স্তালিনবাদী কমিউনিজমের প্রতি তাঁর যৌবনের উদ্দীপনা সম্পর্কে পরে গভীরভাবে বিব্রত বোধ করেছেন আর বিভিন্ন উপায়ে তা আড়াল করার চেষ্টা করছেন। যেমন সেই সময়ে লেখা তাঁর কবিতা। বস্তুত কবিতা লেখাই ছেড়ে দিয়েছিলেন অনুতপ্ত কুন্দেরা।

    অস্বাভাবিকভাবে, অরওয়েলিয়ান মনোভাব প্রদর্শন করে, কুন্দেরা, চেক আভাঁ-গার্দ লেখক ভ্লাদিস্লাভ ভানচুরা উমেনি রোমানুর উপন্যাসগুলোর মার্কসবাদী সাহিত্য বিশ্লেষণকে "মুছে ফেলার" চেষ্টা করেছেন (সেই বিশ্লেষণ ১৯৬০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘দ্য আর্ট অফ দ্য নভেল’ নামে)। তার জায়গায় একই নামে একটি ভিন্ন প্রবন্ধ সংকলনে অন্তভূর্ক্ত করেছেন মিলান কুন্দেরা, ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত ‘দ্য আর্ট অফ দ্য নভেল’ বইতে। কমিউনিস্ট থাকাকালীন, কুন্দেরা তিন খণ্ড গীতিকবিতা রচনা ও প্রকাশ করেন। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে তাঁর পরবর্তী রচনাগুলোতে তিনি গীতিকবিতা এবং গীতিকার কবিদের আক্রমণ করেছেন। তিনি ‘হাস্যকর ভালোবাসা’ (Směšné lásky) প্রকাশের আগেকার তাঁর সমস্ত কাজের প্রকাশনা বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, এই যুক্তিতে যে সুরকারদের মতো, লেখকরা তাদের কাজগুলোর কোনটা প্রকাশ করা উচিত এবং কোনটা বন্ধ করা উচিত তা নির্ধারণ করার সম্পূর্ণ অধিকারী। যেহেতু তাঁর প্রাক ‘হাস্যকর ভালোবাসা’ (Směšné lásky) রচনাগুলো পশ্চিমা ভাষায় প্রকাশিত হয়নি, তাই কুন্দেরার সাহিত্যিক আত্মনির্মাণে তা বেশ ভালোভাবে কাজ করেছে। কুন্দেরার যুক্তি হলো, সম্পাদকদের লেখকের ব্যক্তিত্বকে সম্মান করা উচিত। এখানে, আরেকবার, একটি রাজনৈতিক প্রেরণা একটি ‘সাহিত্য তত্ত্ব সৃষ্টির’ অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে বলে মনে হয়। কুন্দেরা দাবী করেছেন যে একজন লেখক নিজের কাজকে কেমনভাবে ব্যবহার করেন তা নির্ধারণ করার অধিকার তার আছে। তিনি বলেছেন - “নান্দনিক ইচ্ছা শুধুমাত্র একজন লেখক যা লিখেছেন তার দ্বারা নির্ধারিত হয় না বরং তিনি যা মুছে দিয়েছেন তার দ্বারাও হয়। একটি অনুচ্ছেদ মুছে ফেলার জন্য এটি লেখার চেয়ে আরও বেশি প্রতিভা, জ্ঞান এবং সৃজনশীল শক্তির প্রয়োজন৷ তাই, লেখক যা মুছেছেন তাকে প্রকাশ করাটা হবে সেন্সর হিসাবে ধর্ষণ।’’

    কুন্দেরা তাঁর জীবন সম্পর্কে জনসাধারণের সামনে তুলে ধরার তথ্যও কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি সাংবাদিকদের অবিশ্বাস করতেন। তাঁর মৃত্যুর আগে পর্যন্ত , কুন্দেরার রচনাগুলোর পাশ্চাত্য সংস্করণে, "মান্যতাপ্রাপ্ত জীবনী" শুধুমাত্র একটি বাক্যে গুটোনো থাকতো : "মিলান কুন্দেরা ১৯২৯ সালে চেকোস্লোভাকিয়ায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং ১৯৭৫ সাল থেকে ফ্রান্সে বসবাস করছেন।" ব্রিটিশ লেখক ইয়ান ম্যাকইওয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে, কুন্দেরা বলেছিলেন: "আমরা ক্রমাগত আমাদের নিজস্ব জীবনী লিখি এবং ক্রমাগত বিষয়গুলিকে নতুন অর্থ দিই৷ এই অর্থে ইতিহাস পুনরুদ্ধার করা হয় — প্রকৃতপক্ষে, অরওয়েলিয়ান অর্থে - তা মোটেও অমানবিক নয়। উল্টে, এটি খুব মানবিক।"

    কুন্দেরা তার নিজের জীবনকে কিংবদন্তি হিসেবে বর্ণনা করেন। ফিলিপ রথকে দেয়া এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছেন: "তারপর তারা আমাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাসটিকেট করেছিল। আমি শ্রমিকদের সঙ্গে থাকতাম। সেই সময়ে, আমি একটা ছোট-শহরের ক্যাবারেতে জ্যাজব্যান্ডে ট্রাম্পেট বাজাতাম। আমি পিয়ানো আর ট্রাম্পেট বাজাতাম। তারপর আমি কবিতা লিখতে শুরু করি, আমি ছবি আঁকতে শুরু করি । এগুলো সবই বাজে তথ্য । আমার প্রথম কাজ যা উল্লেখ করার মতো মূল্যবান তা হলো একটা ছোট গল্প, সেটা আমার ত্রিশ বছর বয়সে লেখা, ‘হাস্যকর ভালোবাসা’ বইয়ের প্রথম গল্প। এই গল্প লেখা থেকেই আমার লেখক জীবন শুরু হয়। আমি তুলনামূলকভাবে অপরিচিত চেক বুদ্ধিজীবী হিসাবে আমার জীবনের অর্ধেক কাটিয়েছিলুম।"

    খ্যাতনামা নেতৃস্থানীয় চেক সাহিত্য সমালোচক মিলান ইয়ুংম্যান বলেছেন যে কুন্দেরার এই বিবৃতিগুলো বাস্তবতার বিকৃতি, ওগুলো স্রেফ কিৎশ। তিনি লিখেছেন, “১৯৫০ এবং ১৯৬০র দশকে যারা মিলান কুন্দেরাকে চিনতেন তাঁরা এই গল্পে তাঁকে চিনতে পারবেন না। তবে এই নির্বাচিত তুচ্ছ তথ্য সত্য হলেও, আত্মপ্রতিকৃতিটি এমনভাবে গড়া হয়েছে যে কুন্দেরার আসল চেহারা অদৃশ্য হয়ে গেছে। চেক ইতিহাসের বিগত কয়েক দশকের একজন নেতৃস্থানীয় বুদ্ধিজীবী হিসেবে কুন্দেরার ভাবমূর্তি তৈরি করার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই চাপা দেওয়া হয়েছে। কুন্ডেরার জন্য এটি বৈশিষ্ট্য যে তাঁর প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে তিনি প্রথমবার সাহিত্যে প্রবেশ করার মুহূর্ত থেকেই বেশ জনপ্রিয় এবং সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। এমনকি তার প্রথম কাব্যগ্রন্হ ‘মানুষ, একটি প্রশস্ত বাগান’ (Člověk, zahrada širá অর্থাৎ Man, a Wide Garden, ১৯৫৩) আবেগপূর্ণ বিতর্কের জন্ম দেয় এবং তাঁর তৃতীয় কবিতার সংকলন ‘স্বগতসংলাপ’ (Monology অর্থাৎ Monologues, ১৯৫৭) তৎকালীন চেক সাহিত্যের অঞ্চল জুড়ে ঝড়ের মতন ছড়িয়ে পড়েছিল। এই অতি সাধারণ কবিতাগুলো পড়ার সময় এখনকার পাঠক ভাবতে পারেন যে এগুলোতে এত উদ্দীপক কী ছিল আর কেনই বা কবিতাগুলো শিল্পের একটি ব্যতিক্রমী কাজের তকমা পেয়েছে। এথেকে কেবল প্রমাণ হয় যে সেই সময়ে চেক কবিতার মান কত করুণ ছিল। ১৯৫০-এর দশকের শেষের দিকে, কুন্দেরার নাম অত্যন্ত সুপরিচিত হয়ে উঠেছিল আর অনেক বয়স্ক এবং আরও উল্লেখযোগ্য লেখকদের আড়াল করে দিয়েছিল।তরুণ কবি শীঘ্রই বুঝে গিয়েছিলেন যে একজন সেলিব্রেটির মতো আচরণ করতে হলে কী করা দরকার , তিনি তরুণ সাহিত্যের একজন সুসন্তান হয়ে দেখা দিয়ে ছিলেন, তাঁর ভাগ্যনক্ষত্র স্থায়ীভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল এবং লেখক যা কিছু লিখছিলেন, তা কবিতা হোক বা সাংবাদিকতা, তাঁকে আরও বেশি সমাদরের সাথে স্বাগত জানানো হচ্ছিল। কুন্দেরা ছিলেন অনুপ্রেরণাদানকারী লেখকদের মধ্যে একজন, যারা তাদের সমালোচনামূলক মনোভাবের দ্বারা চেক সংস্কৃতিতে নতুন গতিশীলতা এনেছিলেন, ইতিহাস থেকে পাঠ গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন এবং দেখিয়েছিলেন যে সাহিত্যে কতটা বন্ধ্যা [স্টালিনবাদী] গোঁড়ামি ছিল এবং প্রয়োজন ছিল তার আগল ভেঙ্গে সাহিত্যকে নতুন বৈশিষ্ট্য দেওয়ার। ‘টেস্টামেন্টস বিট্রেড’-এ, ফ্রানৎস কাফকার রচনার আলোচনায়, কুন্দেরা বিংশ শতাব্দীর সাহিত্য সমালোচকদের দায়ী করেছিলন যে তাঁরা সাহিত্যিক কাজকে সাহিত্যের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে বিবেচনা না করে জীবনী প্রসঙ্গে উল্লেখ করে। যেহেতু স্তালিনবাদী কমিউনিজমের সাথে ঘনিষ্ঠতা কুন্দেরার জন্য এমন একটা আঘাতে পরিণত হয়েছে যে তিনি তাঁর বেশিরভাগ সাহিত্যকর্মে এই ট্রমাকে ব্যবহার করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন, তাই অবশ্যই কুন্দেরার পরিণত কাজগুলোকে তাঁর প্রাথমিক, স্তালিনবাদী লেখালিখির প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করা দরকারী অথচ কুন্দেরা সেগুলোকে চাপা দিতে কম কসুর করেন নি।

    তিন

    যদিও কুন্দেরার প্রথম কাব্যসংকলন ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, এই সংকলনে ১৯৪৯ সালের প্রথম দিকের কবিতাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে যখন লেখকের বয়স ছিল কুড়ি বছর। এইভাবে সংগ্রহটিকে বলা যেতে পারে তরুণ বয়সের কাজ। চেকোস্লোভাকিয়ার নতুন স্তালিনবাদী শাসনব্যবস্থা তরুণ প্রজন্মের অপরিণত এবং নমনীয় সদস্যদের শক্তি এবং উদ্দীপনাকে কতটা ব্যবহার করতে প্রস্তুত ছিল তা বইটার কবিতাগুলো পড়লে টের পাওয়া যায় বলে মনে হয়। স্পষ্টতই ১৯৪৮ সালে স্তালিনবাদী কমিউনিস্ট দখলের পরের সময়কালে তরুণ চেক কমিউনিস্টরা কতোটা প্রভাবিত হয়েছিল সেই অনুভূতি কুন্দেরা রা তাঁর পরিণত রচনায় এইভাবে আলোচনা করেছেন: "এটি ছিল নেশার মতন। আমরা মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করছিলুম এবং আমরা ঘটনাগুলোর বাঁকবদল করছিলুম। আমরা ভেবেছিলুম আমাদের হাত ইতিহাসের স্টিয়ারিং রয়েছে।"

    সম্ভবত বলা যেতে পারে যে ইউরোপ-আমেরিকায়, তার তরুণ সমর্থকদের আদর্শকে কাজে লাগানোর জন্য ওইভাবে উঠেপড়ে লাগতো না। যে প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদকরা তরুণ কুন্দেরার এই ক প্রচেষ্টা জমা দিয়েছিলেন, তাঁরা তাঁকে একপাশে নিয়ে গিয়ে অনুশীলনের সুপারিশ করতেন। অন্যদিকে, চেকোস্লোভাকিয়ায় স্তালিনবাদী শাসন প্রবর্তনের পর আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত সাহিত্যের মান এতটাই নেমে গিয়েছিল যে তরুণ কুন্দেরাকে পেশাদার এবং নিরপেক্ষ পরামর্শ দেওয়ার জন্য হয়তো সরকারী সাহিত্য বৃত্তে কেউ ছিল না। এবং, সম্ভবত, চেক সাহিত্যের সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে, তাঁর কবিতাগুলো সত্যিই ভাল মনে হয়েছিল। ’মানুষ, এক প্রশস্ত বাগান’ (Člověk, zahrada širá) - সংকলনের রিভিউগুলো সাহিত্যের ওপর সরকারি মানদণ্ড অত্যন্ত নিম্নমানের সাক্ষ্য দেয়।

    এছাড়াও আরও কিছু দিক বিবেচনা করার আছে। এখনকার আলোচকদের মতে, এই কবিতাগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের হওয়া সত্ত্বেও, সেকালের স্তালিনপন্হী সমালোচকদের দ্বারা এগুলি বিতর্কিত, উদ্দীপক, বিদ্রোহী এবং আইকনোক্লাস্টিক হিসাবে বিবেচিত হয়েছিল। তবে এটা আশ্চর্যের নয় যে ফ্রান্সে যাবার পর কুন্দেরা তাঁর কাব্যিক আত্মপ্রকাশের নিম্নমানের দ্বারা বিব্রত বোধ করতেন আর এই কবিতাগুলোতে একজন যুবক হিসাবে উপলব্ধির যে অভাব পাওয়া যায় সে সম্পর্কে সচেতন হন। এ এক এমন মনঃস্হিতি যা তিনি তাঁর পরবর্তী লেখায় বারবার তুলে ধরেছেন। কুন্দেরার ‘ইগনোরেন্স’ (২০০২), উপন্যাসে জোসেফ, একটি কাল্পনিক চরিত্র, নির্বাসন থেকে তার জন্মভূমি চেক প্রজাতন্ত্রে ফিরে যাবার পর, একটা ডায়েরি আবিষ্কার করে যা সে "কমিউনিজমের প্রাথমিক বছরগুলোতে" একজন যুবক হিসেবে লিখতো।

    তিনি যে ব্যক্তি ছিলেন তার দ্বারা তিনি আতঙ্কিত:

    "জোসেফ ভার্জিন ছেলেটাকে বোঝার চেষ্টা করে, নিজেকে তার চামড়া পরিয়ে রাখার প্রয়াস করে, কিন্তু সে তা করতে পারে না। সেই আবেগপ্রবণতা যা মর্ষকামের সাথে মিশ্রিত, পুরো ব্যাপারটা তার এখনকার রুচি আর তার প্রকৃতির সম্পূর্ণ বিপরীত। সে ডায়েরির একটা ফাঁকা পাতা ছিঁড়ে ফেলে, পেন্সিল নিয়ে, একটা বাক্য কপি করে, 'আমি তার দুঃখে আহ্লাদিত।' জোসেফ দীর্ঘ সময় ধরে দুটি হাতের লেখা নিয়ে চিন্তা করে : অনেক আগেকারটা কিছুটা আনাড়ি, কিন্তু অক্ষরগুলো আজকের মতো একই আকারের, যার সাদৃশ্য বেশ বিরক্তিকর, ব্যাপারটা তাকে বিরক্ত করে, হতবাক করে। কীভাবে এমন দুটি এলিয়েন, এমন দুই বিপরীত প্রাণীর, হাতের লেখা একই রকম হতে পারে? কী সেই সাধারণ অন্তরপ্রকৃতি যা তাকে এবং নাকের এই ছোট্ট পোঁটাকে এক করে তোলে?”

    একই রকম বিব্রতকর অনুভূতি, যখন নিজের অতীতের দিকে ফিরে তাকিয়ে, যা কুন্দেরার উপন্যাস (নিহা স্মিচু আ জাপোমনি) ‘দ্য বুক অফ লাফটার অ্যান্ড ফরগেটিং’ এর একটি প্রধান বিষয়বস্তু, যেখানে ভিন্নমতাবলম্বী মিরেক তার প্রেমপত্রগুলো পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করছে বিশ বছর আগে লেখা তার প্রথম প্রেমিকার কাছ থেকে, আর নিজের অতীত মুছে ফেলার চেষ্টায় সেগুলোকে আঁস্তাকুড়ের আবর্জনায় ফেলে দিতে চায় - কেননা সে চিঠিগুলোকে বেদনাদায়ক আর বিব্রতকর মনে করে। কুন্দেরা এখন তার তরুণ বয়সের কবিতা সম্পর্কে এরকমটাই অনুভব করেন। আবেগ, অনেকসময়ে অনুভূতিতে সীমাবদ্ধ, অবশ্যই তাঁর প্রথম দিকের কবিতাগুলোতে উপস্থিত । তবু, সমস্ত প্যাথোসের মধ্যে, ‘মানুষ, এক প্রশস্ত বাগান’ (Člověk, zahrada širá)-এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল কুন্দেরার আন্তরিকতা এবং সত্যে ওপর জোর দেওয়া। বইটা পোলেমিক, আনুষ্ঠানিক আর স্তালিনবাদী প্রোপোগাণ্ডার কবিতার সংকলন।

    কুন্দেরা ‘সৌকরোমা ড্রামাটা’ বা ‘ব্যক্তিগত নাটক’ শিরোনামের অংশের নীতিবাক্যে তাঁর পাঠকদের কাছে প্রচার করেছেন:

    “…সাধারণভাবে শান্তি সম্পর্কে,
    সাধারণভাবে কাজ সম্পর্কে
    সাধারণভাবে পার্টি সম্পর্কে,
    কবি, এই মামুলিপনা বাদ দাও!
    মানুষের কথা বলো!"

    (Polemické verše) অর্থাৎ ‘পোলেমিক কবিতা’-র প্রস্তাবনায় কুন্দেরা সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন, যদিও শেষ লাইনের ব্যাথোস ("মানুষ একটি অসীম বাগান") প্রায় পার্টির পোস্টার, কলকাতায় বামপন্হীদের দেয়াল লিখনের মতন:

    "আপনাকে ওরা পেরেক মেরে ঝোলাতে চায়
    ক্লিশের ক্রুশকাঠে,
    হাঁক পাড়ুন, চিৎকার করে বলুন: মানুষ
    একটি অন্তহীন বাগান!"

    সংকলনটি কুন্দেরার তিনটি "অভিপ্রায় ঘোষণা" দিয়ে শুরু হয়, তিনটি ছোট কবিতার মাধ্যমে, যেখানে কবি তাঁর দ্রোহের এবং প্রামাণিক, ব্যক্তিগত চিন্তাভাবনা প্রকাশ করার অধিকারকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন। চেক আলোচকদের মতে, কুন্দেরা তাঁর কবিতাকে সমসাময়িক আনুষ্ঠানিক কবিতার বিরুদ্ধে একটি বিতর্ক হিসেবে উপস্হাপন করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাঁর "বিদ্রোহ" পুরোপুরি বিশ্বাসযোগ্য ছিল না। সেই সময় থেকেই তিনি দোটানায় ভুগতে আরম্ভ করেন। চেক আলোচকদের মতে, তার রূপকগুলো আনাড়ি ("কবিতায় কৃমি") এবং আজকের পাঠক মনে করেন যে তাঁর কবিতাগুলোতে ব্যক্তিবাদী বিরোধের সীমা আছে। জারোস্লাভ হাশেক, যিনি ‘আইনের সীমার মধ্যে একটি পার্টি অফ মডারেট প্রগ্রেসের বিদ্রূপাত্মক প্রতিষ্ঠাতা’ বলেছেন যে, যা শাসকের অনুমোদিত নয় তাকে কুন্দেরা অতিক্রম করেননি। তার বিদ্রোহ পোশাকি। তিনি যত বিতর্কিত চিন্তাই প্রকাশ করুক না কেন, স্তালিন এবং কমিউনিজমের প্রতি তার উৎসাহী সমর্থন দ্বারা সেগুলোতে সর্বদা ভারসাম্যহীন বজায় রেখেছিলেন। জারোস্লাভ হাশেক বলেছেন যে, একজনকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে অনেক সত্যিকারের কবি যেমন জান জাহরাদনিচেক, ভ্যাক্লাভ রেনচ, জোসে পালিভেক স্তালিনের শ্রম শিবিরে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিলেন যখন কুন্দেরা ‘মানুষ, একটি প্রশস্ত বাগান’ প্রকাশ করেন:

    “কবি যাই বলুক না কেন সে নিজের সম্পর্কেই গায়।
    একজন কবি যে আন্তরিক নয়
    তার কবিতায় কৃমি থাকে।
    আমি কীবোর্ডে আমার গান বাজাই
    আমার দুর্দশার।
    আর তাই আমি যেভাবে গান করি সেভাবেই গাই।
    আমি অন্য কোনো উপায়ে এটা করব না।"

    কুন্দেরা কবিতাগুলোতে অনুমান করেছেন যে একজন সৃজনশীল শিল্পীকে অবশ্যই "ব্যক্তিমানুষের আত্মার গভীরে প্রবেশ করতে হবে"। তাঁর পরিচিতিমূলক কবিতাগুলোর আনুষ্ঠানিক দিকগুলো আদিম:

    “একজন ডুবুরি কবি
    মানুষের গভীরে ডুব দেয়
    তার জন্য একমাত্র উপায় হলো খুঁজে বের করা
    যুদ্ধে যাবার জন্য তার তলোয়ার।
    যারা মনগড়া কবি
    তাদের তলোয়ার শব্দের বাষ্প দিয়ে গড়া
    এমন কবিদের কবিতা টিকবে না
    এমনকি প্রথম হাতাহাতিও টিকবে না।"

    সমসাময়িক রাজনৈতিক মতামতের সাথে সামঞ্জস্য রেখে, কুন্দেরা কবিতা এবং সাহিত্যকে সাধারণভাবে একটি "সামরিক সংগ্রাম" হিসাবে দেখেছিলেন। তিনটি উত্সর্গীকৃত কবিতার শেষটিতে, তিনি নিজেকে উৎসাহিত করার আবেদন জানিয়েছেন, যাতে তিনি যুদ্ধে যোগ দেবার জন্য দেরি না করে ফেলেন।

    "ওহে, দ্রুত চলো,
    হৃদয়, তুমি আমার জ্যোতির্বিদ্যা ঘড়ি,
    যাতে যুদ্ধের এক সপ্তাহ পর
    আমার মাঠের তূরী না বেজে ওঠে!
    বুকের মধ্যে সংকুচিত আমার গান,
    তোমরা আমার পাঁজর ছিঁড়ে ফেলো,
    যাতে যুদ্ধ
    আমাকে ছাড়া জয়ী না হয় !”

    কবিতাগুলো আবেগগত ব্যক্তিত্বাদ, ব্যক্তিগত সমর্পণের দাবি, এবং সময়ের আদর্শগত অনুষঙ্গের একটি অদ্ভুত মিশ্রণ – এগুলো একই সাথে সঙ্গতিবাদী এবং অ-সঙ্গতিবাদী। কুন্দেরা রুক্ষ, কাটা-কাটা, অপ্রত্যাশিত, উত্তেজক, পথচলতি অভিব্যক্তি এবং রূপক ব্যবহার করেছেন। কবিতার লক্ষ্য স্পষ্টতই নজির তৈরি করা। কুন্দেরা বোঝাচ্ছেন যে তিনি একজন কমিউনিস্ট হিসেবে গর্বিত, "অন্য কোনও পথ থাকতে পারে না"। তিনি সাহিত্যের পরিশীলিত শব্দাবলী প্রয়োগের বদলে আবেগ জাগানো গ্রাম্য শব্দে জোর দেওয়ার জন্য কথোপকথন, প্রাচীন বা উপভাষা থেকে অভিব্যক্তি ব্যবহার করেছিলেন। এই ধরনের কিছু শৈলীগত অনিয়মকে সেই সময়ের সমালোচক ভাকলাভ ম্যুলার তীক্ষ্ণ সমালোচনা করেছিলেন : চেক সাহিত্যে স্তালিনবাদীদের নৈমিত্তিক, অনানুষ্ঠানিক, চিহ্নিত, অ-সাহিত্যিক ভাষা নিয়ে সমস্যা ছিল। ভাকলাভ ম্যুলার বলেছেন: “প্রতীকবাদী মালারমেস্কে সংজ্ঞা বলছে যে একটি কবিতার সৌন্দর্য নির্ভর করে আনন্দদায়কভাবে উত্তেজনাপূর্ণ বা ইন্দ্রিয়, আবেগ বা কল্পনাকে জাগিয়ে তোলার ক্রিয়ায় নিহিত ইঙ্গিতময়তায়, আর তা শব্দের আদর্শিক রূপগুলোকে মুছে ফেলার মাধ্যমে অর্জন করা হয়। এই বক্তব্য মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নন্দনতত্ত্বের নীতি অনুসারে ক্ষমার অযোগ্য নৈরাজ্য। স্তালিন নিজে মনে করতেন, ভাষা 'একটি মাধ্যম যা মানুষ যোগাযোগ করতে এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া অর্জনের জন্য ব্যবহার করে"। সুতরাং ভাষার সবসময় (এমনকি শিল্পের কাজে) একটি যোগাযোগমূলক ভূমিকা রয়েছে। তাই পাঠকের মগজে ঢোকার পথ খুঁজে বের করতে হলে প্রতিটি কবিতার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, প্রাথমিক চাহিদা যা অবশ্যই পূরণ করতে হবে, তা হলো আদর্শগত অস্পষ্টতা বর্জন।

    চার

    অল্পবয়সী হলেও, কুন্দেরা জানতেন কীভাবে মাঝে মাঝে একটা স্তবক লিখতে হয় যা বেশ সমসাময়িক। "সেই দিন ব্রনোতে" কবিতায় তিনি বেশ সফলভাবে একটি অলস, ভ্যাপসা, গ্রীষ্মের রবিবার বিকেলের পরিবেশকে তুলে ধরেছেন:

    “এবং একটি ট্রেন দূর থেকে ছুটে এল এবং আপনার মনে হল
    ছায়ায় কোথাও বসার জন্য বেঞ্চ খুঁজে পাওয়া।
    আপনার সামান্য অলস শরীরকে বিশ্রাম দিতে
    কিছু না ভেবে, আপনার আইসক্রিম চাটবার ইচ্ছা হলো"

    ১৯৫০ দশকের চেক সাহিত্য বিশেষজ্ঞ মিশাল বাউয়ার উল্লেখ করেছেন যে কুন্দেরার কবিতার শৈলী রাশিয়ান বিপ্লবী কবিতার অনুবাদ এবং স্তালিনবাদী যুগের চেক সংবাদপত্রের লিখনভঙ্গিমা দ্বারা প্রভাবিত । সেকালের কবিতার প্রেক্ষাপটে কুন্দেরার সাধারণ কবিতাগুলোকে, অতএব, মনে করা হতো অসাধারণ বিপ্লবী এবং বিদ্রোহী। সংকলনটি পাঁচটি পর্বে বিভাজিত। কুন্দেরার অনেক প্রধান থিম, যা তাঁর পরিণত কাজে বিকশিত হয়েছে, সেগুলো প্রথম যৌবনে লেখা কবিতার এই সংকলনে একটি গোপন ভাষ্যে উপস্থিত।

    প্রাথমিকভাবে (জেলেন্ মেহো ডোমোভা) অর্থাৎ ‘আমার বাড়ির সবুজ’ শিরোনামের প্রথম বিভাগে কুন্দেরা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার সাথে যুক্ত করেছেন স্তালিনবাদী মতাদর্শ এবং তাকে মানবিক করার চেষ্টা করেছেন। এই পদ্ধতিতে, উষ্ণ আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্ক এবং বাড়ির পরিবেশের ঘনিষ্ঠতা গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। কুন্দেরা তাঁর স্থানীয় মোরাভিয়া, ব্রনো শহর এবং এর বাসিন্দাদের সম্পর্কে লিখে মার্কসবাদকে আবেগগতভাবে মানবিক করার প্রয়াসে লিখেছিলেন, যে, তিনিও একজন "চেক সমষ্টির সদস্য", যাদের সঙ্গে তিনি একাত্ম অনুভব করেন। তিনি চেক পারিপার্শ্বিক পরিবেশকে শান্তি ও সান্ত্বনার প্রতীক হিসেবে উপস্হাপন করেছিলেন। কমিউনিজম হল সেই সময়কার কুন্দেরার জন্য সমস্ত প্রধান মূল্যবোধের গ্যারান্টি, যা আরামদায়ক, আনন্দদায়ক, এবং চেকদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়। যেমন, এই বিভাগের একটি কবিতায়, একজন বৃদ্ধ মহিলা নতুন স্তালিনবাদী শাসনের ফলে বেশ বিভ্রান্ত। তিনি কমিউনিস্ট যুগের রাজনৈতিক পরিভাষা বোঝেন না। কিন্তু কবিতার শেষে, তিনি খুশি, কারণ তাঁর নাতি, যার গলায় লাল স্কার্ফ, একজন তরুণ অগ্রগামী, তাঁকে জড়িয়ে তাঁর হাত ধরে। কুন্দেরা যুক্তি দেখান যে কমিউনিস্ট মতবাদ মানুষের কাছে আরও গ্রহণযোগ্য হবে যদি এটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং সামাজিক প্রক্রিয়ায় মানবিক সম্পর্কের পরিপ্রেক্ষিত যোগ করা হয়।

    “হায় ভগবান, ব্যাপারটা কেমন বোকামি
    পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় সময় গণনা!
    জীবন কি এর চেয়ে দ্রুত দূরে সরে যায় না
    এমনকি যখন তুমকি একে এক-এক বছর দিয়ে গোনো?
    কোন সে শিখা যাতে দুঃখ গলে যায়?
    ভাল, নিশ্চয়, প্রেমের শিখায় গলে যায় ।
    ছেলেটা বুড়িকে জড়িয়ে ধরে
    আর তাকে যেতে দিতে চায় না।
    ছেলেটা তার হাত ধরে। বুড়ি হঠাৎ খুশি
    আর মাঠে দুজনে মিলে আনন্দে গল্পগুজব করে।
    আর বুড়ি হঠাৎ ছেলেটার লাল স্কার্ফ পছন্দ করে,
    বুড়ি আর কোনো কিছুতেই বিরক্ত হয় না।"

    একইভাবে তিনি (Toho dne v Brně) অর্থাৎ ‘ব্রনোতে একটি দিন’ কবিতায় কমিউনিস্ট মতাদর্শকে মানবিক করেছেন, যেখানে একটি মনোরম, গরমের দিনে তাঁর অন্তরঙ্গ, পরিচিত পরিবেশে হাঁটতে হাঁটতে তিনি স্থানীয় এক ফ্ল্যাট থেকে একটি ছেলের কন্ঠে ‘ইনটারন্যাশানাল’ গানটি শুনতে পান।

    “ঠিক আছে, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমাদের অবশ্যই এগোতে হবে!
    দ্রুত, আমি আমার পদক্ষেপ দৃঢ করি আর বিশ্রাম নিই!
    আর আমি হাসছিলুম, ওহ, জীবন, আমি হাসছি
    আর ছেলেটি গান গাইতে থাকে, গাইতে থাকে, গাইতে থাকে।"

    ‘একটি খ্রিসমাস স্বীকারোক্তি’ (Vánoční vyznání) কবিতায় কুন্দেরা তাঁর বাড়ির নিরাপত্তা এবং বেঁধে-বেঁধে থাকাকে কমিউনিস্ট সমষ্টিবাদের সমতুল্য হিসেবে উপস্হাপন করেছেন। কবিতাটিতে তিনি ঐতিহাসিকভাবে শপথ করেছেন যে তিনি আর কখনও "ব্যক্তিবাদী" হবেন না:

    “আমি এখন জানি এটা রাষ্ট্রদ্রোহিতা
    নিজের মধ্যে নিজের মতো বেঁচে থাকা।
    এটা আমাকে ধাক্কা মেরে জাগায়!
    আমি বাড়িতে আছি!
    দুঃখ, আমাকে চূর্ণ, বিচূর্ণ করো !
    আমার কমরেডরা, আমি কখনই তোমাদের ছাড়া থাকব না
    তোমাদের ছাড়া আমি আর কোনো কাজ করব না।”

    এই থিমটি পরে কুন্দেরা পরিণত বয়সের উপন্যাস ‘দ্য জোক’-এ বিশ্লেষণ করেন। ‘দ্য জোক’-এর প্রধান দ্বন্দ্ব হলো এই চিন্তা যে স্তালিনবাদী শাসন মানুষকে ব্যক্তিবাদী হওয়ার অধিকার দিতে চায় না। ‘দ্য জোক’ উপন্যাসে কুন্দেরা লিখেছেন:

    “যারা আনন্দ করতে চায়নি তাদের সন্দেহ করা হয়েছে কেননা তারা আসলে শ্রমিক শ্রেণীর বিজয়ে বিলাপ করছে বা (তারা সমান অপরাধী) নিজেদের দুঃখকে ব্যক্তিগত স্তরে প্রকাশ করছে। আমি দাবি করেছিলুম যে আমার সহকর্মীরা আমাকে প্রমাণ করে দেখাক কেন আমি একজন ব্যক্তিবাদী। সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে তারা বলবে, 'কারণ তুমি একজন ব্যক্তির মতো আচরণ কর।” 'আমি কীভাবে প্রকাশ করব?' 'তোমার অদ্ভুত ধরনের হাসি আছে।' 'আর যদি প্রকাশ করি? এভাবেই তো আমি আমার আনন্দ প্রকাশ করি।' 'না, তুমি এমনভাবে হাসো যেন তুমি ব্যক্তিগতভাবে কেবল নিজের কথা ভাবছ।'

    ‘আমার বাড়ির সবুজ’ (Zeleň mého domova) কবিতায় কুন্দেরা তাঁর নতুন বান্ধবীকে তাঁর বাড়ি ব্রনো অঞ্চলের সৌন্দর্য এবং পরিপার্শ্বের কথা বলেছেন :

    'এটা আমার বাড়ি, আমার ছোট্ট হৃদয়'
    আমি বিড়বিড় করে বলবো,
    ' এবং যদি তুমি এটা পছন্দ না করো,
    আমি নিঃস্বের মতো তোমার সামনে দাঁড়াতাম
    কারণ আমার আত্মা,
    শোন প্রিয়তমা,
    বোনা হয়
    শুধুমাত্র এই পাহাড় এবং বাগানের ফিতে দিয়ে।"

    তিনি আশা করেন "তাঁর নারী" তাঁর এই মূল্যবোধগুলোকে মান্যতা দেবে :

    "আর তারপর, তুমি আমাকে জড়িয়ে ধরবে
    আর ক্রিকেট খেলা শুরু হবে
    আর বাঁধন যা আমার হৃদয়কে জাপটে ধরে
    ভেঙ্গে যাবে "

    সেই সময়ে কুন্দেরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেছিলেন যে পুরুষের "সংগ্রাম"-এ মহিলাদের ভূমিকা গৌণ। নারীর কেবল সহায়কের ভূমিকা পালন করা উচিত — নারীর উচিত পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্বাসগুলো সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করা। কুন্দেরা ফ্রান্সে যাবার পরও ব্রনোর সাথে খুব আবেগপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। কমিউনিজমের পতনের পরও থেকে তিনি লুকিয়ে নিজের শহরে বেড়াতে যেতেন। পরবর্তী বছরগুলোতে, তাঁর জন্মভূমির সাথে নিজের বন্ধন মানসিকভাবে অস্বীকারের মাধ্যমে নিজেকে পাঠক ও আলোচকদের সামনে তুলে ধরেছেন। যখন স্তালিনবিরোধী চেক সমালোচকরা ১৯৮০-এর দশকে ফ্রান্সে প্রকাশিত তাঁর উপন্যাসগুলো সম্পর্কে উদাসীন ছিল, তখন তিনি অত্যন্ত বিচলিত বোধ করেন আর সাম্যবাদের পতনের পর চেকোস্লোভাকিয়ায় এই উপন্যাসগুলো প্রকাশের অনুমতি দেননি।

    জীবনের নেতিবাচক দিকগুলো, যেমন তাঁর বন্ধুর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, কুন্দেরার অন্তরঙ্গ মোরাভিয় অভিজ্ঞতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, প্রাসঙ্গিক কবিতায় কুন্দেরা “না, ওহ, তুমি কালো মিছিল” লোকগানের কাব্যিকতা ব্যবহার করেছিলেন । আরামদায়ক, অন্তরঙ্গ এবং সান্ত্বনাদায়ক চেক কমিউনিস্ট সমাজে বসবাসের অভিজ্ঞতা, নাৎসি দখলের মর্মান্তিক স্মৃতি এবং সেইসাথে কোরিয়ান যুদ্ধের বর্তমান বিদেশী ভয়াবহতাকে হারিয়ে আর মুছে দিতে পারে। "Tři braši u pěti jabloní " ‘পাঁচটি আপেল গাছের কাছে তিনটি বন্ধু’ কবিতায় বাগানের মাটি খুঁড়ে শ্রমিকরা একটা মরচে-পড়া জার্মান বেয়নেট খুঁজে পায়৷ জিনিসটা বিগত, "পুঁজিবাদী" দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ট্রমার ক্ষতকে মনে করিয়ে দেয় :

    “হায় ভগবান, ও হঠাৎ অনুভব করে
    যে ধাতুখণ্ড ও হাতে ধরে আছে
    খাপ থেকে বের করা ধাতু ভেতরে ঢুকে যায়
    তুষার-সাদা মানুষের চামড়া ফুঁড়ে
    রক্তে জবজব করছে তার হাত
    আর পাঁজরের ফাটলে"

    মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিকতার সাথে সামঞ্জস্য রেখে, কুন্দেরা স্তালিনবাদের অধীনে সমসাময়িক পরিস্থিতির সুখী বাস্তবতার ওপর জোর দেওয়ার জন্য এই ইমেজগুলো ব্যবহার করেছিলেন। আর তা করার সময়, তিনি চেকদের কাছে পরিচিত লোকগানের ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করে তাঁর পরীক্ষিত নীতিটি ব্যবহার করেছিলেন:

    “তারপর সে তার বন্ধুদের দিকে তাকাল।
    বন্ধুরা তাকে দেখে হাসল।
    মাঠের পাঁচটা আপেল গাছে বসে
    ফিঞ্চ পাখিরা গান গাইতে লাগলো।”

    আবার, মার্কসবাদী দ্বান্দ্বিকতা ব্যবহার করে, বাড়িতে "সূর্যালোকের পরিস্থিতি"র সঙ্গে বিদেশের "মন্দ" অবস্হার বৈপরীত্য প্রকাশ করেছিলেন কুন্দেরা : মানুষ স্তালিনবাদের অধীনে সুখী জীবন উপভোগ করছে। স্পেনের একজন প্রাক্তন কমিউনিস্ট যোদ্ধা, যিনি এখন আরামে চেকোস্লোভাকিয়ায় তাঁর বাগানের দেখাশোনা করছেন, তিনি এই ভেবে বিমর্ষ যে কোরিয়ায় এখনও একটি নৃশংস যুদ্ধ চলছে। তবু বিদেশী মন্দের ভয়কে জয় করা যাবে আরামদায়ক, ঘরোয়া, যৌথ অভিজ্ঞতার ইতিবাচক প্রভাব দিয়ে ।

    “যুদ্ধ?
    ভয় পেও না, ছোট খুকি।
    পাহাড়ের কোলে কামানের নলে
    মরচে পড়ে গেছে
    একটা ছেলে বসে আছে তার ওপর,
    আর চিৎকার করে বলছে : হেঁইয়ো ঘোড়া!
    ছুটে চল ঘোড়া হেঁইয়ো।”

    কুন্দেরার পরবর্তী সাহিত্য ও সৃজনশীল বিকাশের কথা বিবেচনা করার সময় ‘ব্যক্তিগত নাটক’ পর্বটি উল্লেখযোগ্য। "এটা প্রেম নয়" কবিতায় কুন্দেরা নারী-পুরুষ সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কী হওয়া উচিত বলে মনে করেন তার একটি প্রাথমিক মনোভঙ্গী প্রকাশ করেছিলেন। পুরুষ, কুন্দেরার উপলব্ধিতে, একজন যোদ্ধা, আর নারীর উচিত তাকে সান্ত্বনা দেওয়া, তার কথা শোনা, তার কাজে তাকে সমর্থন করা এবং তার প্রতিটি প্রয়োজন মেটানো। "এটা প্রেম নয়" কবিতায় দলীয় কর্মকর্তার স্ত্রী স্পষ্টতই এই "আদর্শ" মেনে চলেন না । তাই পুরুষটি হতাশ কারণ নারীরা সহজাতভাবে বোকা এবং পুরুষের "সংগ্রাম" বুঝতে পারে না:

    "মা, তুমি আমাকে সেখানে পাবে না,
    স্মৃতির সেই গহ্বরে।
    এখানে আমি, সংগ্রামের মাঝখানে,
    ঝড়বৃষ্টি ঘিরে আছে আমাকে।
    মা আমার সাথে এসো,
    আমি কোথায় যাচ্ছি তা দেখো।
    পেছনে ফেরার স্বপ্ন দেখো না,
    আমার সাথে স্বপ্ন দ্যাখো,
    সামনে এগিয়ে যাবার স্বপ্ন !"

    “১৯৫০ এর দশকের গোড়ার দিকে একজন বান্ধবীর বিশ্বাসঘাতকতা কুন্দেরার জীবনের ভিত টলিয়ে দেয় । কুন্দেরার সাথে মনিকা গাজদোসোভা, একজন গোঁড়া কমিউনিস্ট যুবতীর সম্পর্ক ছিল। যুবতীটি ছিলেন স্লোভাক আর স্ক্রিপ্ট-লেখার বিষয়ে পড়তেন। এক রাতে যখন তাঁরা যৌনতায় লিপ্ত, কুন্দেরা সমাজতান্ত্রিক শক-কর্মীদের অঙ্গীকারের পরিকল্পনা সম্পর্কে অবমাননাকর কিছু মন্তব্য বেফাঁস বলে ফেলেছিলেন। আর যায় কোথায় ! যুবতীটি কর্তৃপক্ষের কাছে কুন্দেরার মতামত পৌঁছে দেন আর বিশ্ববিদ্যালয় কুন্দেরাকে রাস্টিকেট করতে চায়," একথা বলেছেন চলচ্চিত্র পরিচালক ভোজেচ জাসনি, কুন্ডেরার সঙ্গে যিনি ১৯৫০-এর দশকে প্রাগের ফিল্ম একাডেমিতে পড়তেন। ‘দ্য জোক’ উপন্যাসে কুন্দেরার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং আদর্শের মধ্যে দ্বন্দ্ব তুলে ধরা হয়েছে, যেখানে প্রধান চরিত্র লুডভিক জাহান তরুণ, মতাদর্শগত ভাবে অন্ধ স্তালিনবাদী মার্কেতাকে প্রণয় নিবেদন করার জন্য বৃথা চেষ্টা করে এবং যৌন হতাশা থেকে তাকে একটা ক্রুদ্ধ পোস্টকার্ড পাঠায় যা জানাজানি হবার ফলে কুন্দেরাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয় আর তাকে পেনাল ইউনিটে পাঠানো হয় যেখানে তাকে খনিতে কাজ করতে হতো।

    এই থিমকে একটু অন্যভাবে উপস্হাপন করেছেন ‘এডুয়ার্ড এবং ঈশ্বর’ গল্পে। এডুয়ার্ড নামের যুবক অ্যালিসকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা করছে, যে কিনা একজন ধর্মান্ধ ক্যাথলিক যুবতী। অ্যালিস মনে করে এডুয়ার্ড ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্মে বিশ্বাসের কারণে রাজনৈতিক শহীদ হয়ে গেছে । কিন্তু এডুয়ার্ড আগ্রহ হারিয়ে ফেলে কারণ তার অতিরঞ্জিত নকল ধার্মিকতা ছিল অ্যালিসকে ফুসলিয়ে বিছানায় তোলার জন্য কিন্তু দুজনের চূড়ান্ত যৌনমিলনের সময়ে নায়ক বুঝতে পারল যে মেয়েটা বিছানায় শীতল আর তার ছলচাতুরি করে অ্যালিসকে পাওয়া বিফল ।

    ফ্রান্সে যাবার পর ওলগা কার্লেসিলকে দেয়া সাক্ষাৎকারে কুন্দেরা বলেছিলেন, “যে বিপদটা আমাদের আশঙ্কিত করে, তা হল সর্বগ্রাসী রাজনৈতিক ক্ষমতা। খোমেইনি, মাও, স্তালিন – তাঁরা কি ডান অথবা বামপন্হী? সর্বগ্রাসিতা ( Totalitarianism ) ডান বা বাম কিছুই নয়, দুটোই তাঁদের সাম্রাজ্যের ভেতরেই বিলীন হতে থাকে। আমি কোনোদিনই ঈশ্বরবিশ্বাসী ছিলাম না, কিন্তু চেক ক্যাথলিকদের স্তালিনের সন্র্রাসে নিগৃহীত হতে দেখে তাদের জন্য আমি গভীর একাত্মতা বোধ করি। তাঁদের (আস্তিকদের) থেকে আমাদের বিচ্ছিন্নতা গড়ে উঠেছিল ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাসের প্রশ্নে। কিন্তু তা গৌণ হয়ে যায় এবং তাইই (মানে, ঈশ্বরবিশ্বাস) আবার আমাদের ঐক্যবদ্ধ করে। প্রাগে ওরা সোশ্যালিস্ট আর যাজকদের ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল।এভাবে ফাঁসিপ্রাপ্তদের ভাতৃত্ব গড়ে উঠেছিল। একারণে ডান ও বামের এককাট্টা লড়াই আমার কাছে সেকেলে মনে হয়, খুবই আঞ্চলিক মনে হয়। রাজনৈতিক জীবনে অংশগ্রহণ করাকে আমি ঘৃণা করি। যদিও রাজনীতি ব্যাপারটা প্রদর্শনী হিসেবে আমাকে মোহাবিষ্ট করে। প্রাচ্যে একটি ট্র্যাজিক ও মৃতকল্প প্রদর্শনী জার পাশ্চাত্যে বৌদ্ধিক দিক থেকে বন্ধ্যা ও কৌতুকসঞ্চারি প্রদর্শনী হিসেবে দেখি।”

    পাঁচ

    "পোলেমিক ভার্স" বিভাগে দুটি বেশ সাহসী, বিতর্কিত কবিতা রয়েছে, যেগুলো সম্ভবত কুন্দেরাকে সমস্যায় ফেলেছিল, যদিও তাদের অস্বাভাবিকতা আমাদের অবাক করে, যখন আমরা আজ সেগুলো বিশ্লেষণ করি। সম্ভবত এই কারণেই তাদের বাকি দুটি বিভাগে রাখা হয়েছে: From the Horizon of an Individual to the Horizon of All এবং The Grand March । কুন্দেরা গ্র্যাণ্ড মার্চের ধারণাকে ব্যঙ্গ করেছেন। সমষ্টিবাদের চাপ আর নাৎসিবাদের অধীনে এবং সমসাময়িক সময়ে "পশ্চিমা পুঁজিবাদের" অধীনে শ্রমিকদের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর পরিণত উপন্যাসে ফিরে ভেবেছেন কুন্দেরা। পোলেমিক ভার্সের কবিতাগুলোয় প্রায়শই লোকসঙ্গীত ব্যবহার করেছেন তাদের কালাতীত করার প্রয়াসে। এই কবিতাগুলোর মধ্যে একটি হল "ইটালস্কা (ইতালি থেকে)" যেখানে একজন নির্যাতিত ইতালীয় শ্রমিককে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছে আর জেলখানায় সে স্তালিনের স্বপ্ন দেখছে কেননা তা শ্রমিকটিকে শক্তি যোগাচ্ছে আর তাকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলছে। চেক আলোচকদের মতে, যুদ্ধের সময়কার চেক ‘সর্বহারা’কবি জিরি ওল্কার (১৯০০-১৯২৪), প্রভাব আছে এই পর্বের কবিতায়:

    “স্তালিনের সাথে দেখা করতে সেখানে উড়ে যাও,
    আমার স্বপ্ন, আমার পাখি,
    স্তালিনের সাথে দেখা করতে সেখানে উড়ে যাও,
    আমার আগুন-পাখি!
    স্তালিনের জমি
    আমাদের শক্তির কূপ।
    ওহ, পান করো, পাখি, পান করো
    সেই গভীর কূপ থেকে,
    আর তারপর নিজের জ্বলন্ত পালক দিয়ে
    আকাশ জ্বালিয়ে দাও!
    কোষগুলো খুলে গেলে,
    একজন শক্তিশালী, তরুণ কর্মী আবির্ভূত হবে।
    তার চোখের গভীর থেকে
    ক্রেমলিনের জানালার রশ্মি জ্বলে উঠবে।
    আমি তাকে দেখি, এখন সে সামনের সারিতে হাঁটছে
    পার্টি আবার ঢোল পিটিয়ে হরতাল শুরু করেছে
    বিক্ষোভের শ্লোগানে তার আওয়াজ শুনতে পাই
    অবন্তী পোপলো! - আবার, আরেকবার যুদ্ধ করতে!”

    পরবর্তীতে, কুন্ডেরা তার উপন্যাস ‘দ্য জোক’ এ ইতালীয় কমিউনিস্ট কর্মীদের প্রতি তাঁর প্রথম দিকের প্রশংসা প্রকাশ করেন আর হেলেনার চরিত্রটি তৈরি করে, একজন স্তালিনবাদী যার স্বামী তাকে ছেড়ে চলে গেছে এবং যিনি নিজেকে ১৯৬০-এর দশকের উদারপন্থী জগতে খুঁজে পান:

    "পাভেল ক্রাশের সময় আমার পাশে দাঁড়িয়েছিল, এবং আমি তাকে সাধারণ হাববে তার নিজস্ব কিছু চিৎকার করতে শুনেছি, অন্যরকম কিছু, এবং যখন আমি তার ঠোঁটের দিকে তাকালাম, আমি বুঝতে পারলাম সে গান গাইছে, বা বরং চিৎকার করছে, একটি গান, তিনি আমাদের তাকে শোনার এবং তার সাথে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, তিনি একটি ইতালীয় বিপ্লবী গান গাইছিলেন যা আমাদের রেপার্টরিতে ছিল এবং সেই সময়ে খুব জনপ্রিয় ছিল: অবন্তি পোপোলো, আ লা রিসকোসা, বান্দিয়েরা রোসা, বান্দিয়েরা রোসা… এটি ছিল পাভেল সব মিলিয়ে, একা একা মনের কাছে পৌঁছে তিনি কখনই সন্তুষ্ট ছিলেন না, তাকে আবেগের কাছে পেতে হয়েছিল, এটা কি চমৎকার ছিল না, আমি ভেবেছিলাম, একটি ইতালীয় বিপ্লবী গানের সাথে প্রাগের স্কোয়ারে ইতালীয় শ্রমিক আন্দোলনের নেতাকে অভিবাদন জানাচ্ছি, আমি টোগলিয়াত্তির জন্য আরও কিছু চেয়েছিলাম যেভাবে আমি ছিলাম সেভাবে সরানো হোক, তাই আমি যতটা সম্ভব জোরে পাভেলের সাথে যোগ দিয়েছিলাম, এবং অন্যরা আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিল এবং অন্যরা এবং অন্যরা, শেষ পর্যন্ত পুরো দলটি গান গাইছিল…"

    ‘বান্দিয়েরা রোসা’ ("লাল পতাকা" এর জন্য ইতালীয়), যাকে প্রায়শই শুরুর শব্দের পরে অবন্তি পোপোলোও বলা হয়; কমিউনিস্ট এবং সমাজতান্ত্রিক উৎসের ইতালীয় কর্মীদের একটি ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয় গান, ইতালীয় শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম বিখ্যাত গান। এটি লাল পতাকাকে মহিমান্বিত করে, সমাজতান্ত্রিক এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতীক গানটি ১৯০৮ সালে কার্লো তুজি লিখেছিলেন। ইতালিয় ভাষায় গানটা এরকম:

    অবন্তি পোপোলো, আল্লা রিসকোসা,
    বান্দিয়েরা রোসা, বান্দিয়েরা রোসা।
    অবন্তি পোপোলো, আল্লা রিসকোসা,
    বান্দিয়েরা রোসা ট্রিওনফেরা।
    বান্দিয়েরা রোসা ট্রিওনফেরা
    বান্দিয়েরা রোসা ট্রিওনফেরা
    বান্দিয়েরা রোসা ট্রিওনফেরা
    গানটা বাংলায় অনুবাদ করলে এরকম :
    এগিয়ে যাও মানুষ, মুক্তির দিকে
    লাল পতাকা, লাল পতাকা
    এগিয়ে যাও মানুষ, মুক্তির দিকে
    লাল পতাকা বিজয়ী হবে।
    লাল পতাকা বিজয়ী হবে,
    লাল পতাকা বিজয়ী হবে,
    লাল পতাকা বিজয়ী হবে।

    স্তালিনবাদমুক্ত জীবনে কুন্দেরা হেলেনাকে একটি ধ্বংসাত্মক, গীতিময় আবেগপ্রবণতার রূপক হিসাবে উপস্হাপন করেছেন। নিষ্ঠুর উপহাসের মাধ্যমে কুন্দেরা অতীতের এই বিশেষ ভূত থেকে নিজেকে মুক্ত করার জন্য অবশেষে হেলেনাকে এমন একটি দৃশ্যে ধ্বংস করেছিলেন যেখানে হেলেনা মনে করছে যে সে আত্মহত্যা করেছেন, কিন্তু আদপে সে নিজেকে জোলাপ নিয়ে অবিরাম হেগে চলেছে। করেছেন, তাই তিনি একটি অপ্রতিরোধ্য ডায়রিয়ায় ভুগছেন। দুটি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা লক্ষণীয় এবং যা স্পষ্টতই কুন্ডেরার প্রথম দিকের কবিতার সাথে সম্পর্কিত। হেলেনা যে দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয় সেই দৃশ্যে পাভেল জেমানেক "মৌলিক" হওয়ার জন্য কঠোর চেষ্টা করছেন, কিন্তু তার "মৌলিকতা" কঠোরভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত, এটি এক সীমাবদ্ধতা। "মৌলিকতা"-র পুরো খেলাটা ভণ্ডামির ছোবল। অন্য প্রতর্ক হলো: কুন্দেরা তরুণ স্তালিনবাদীদের প্রতিক্রিয়া দেখে আতঙ্কিত — তারা অস্বাভাবিকতার জন্য উৎসাহী। হেলেনার চরিত্র থেকে পাওয়া কুন্দেরার কাব্যিক প্রচেষ্টার সাথে সরাসরি যোগসূত্র রয়েছে বলে মনে হয়।

    "তুমি, কনস্ট্যান্টিন, কখনও বিশ্বাস করোনি" কবিতাটি কনস্ট্যান্টিন বিবলের স্মৃতিতে উত্সর্গীকৃত। এই কবিতায় স্তালিনবাদী কমিউনিজমের নিপীড়ক প্রবণতার বিরুদ্ধে কুন্দেরা প্রকাশ্যে প্রতিবাদ করেছেন:

    “তুমি, কনস্ট্যান্টিন, কখনও বিশ্বাস করোনি
    যে একজন কমিউনিস্ট তেমন লোক যে মানুষকে অপছন্দ করে,
    সেই ভয়ঙ্কর পুরোহিতরা,
    যারা নিজেদের মার্কসবাদে বন্দী করে রেখেছে ঠান্ডা দুর্গের মতো।
    তাদের স্লোগান এবং আদেশের হিমায়িত নিঃশ্বাসে
    তারা আনন্দের শিখা যা জ্বলতে শুরু করেছিল তা নিভিয়ে দিয়েছে।
    তারা সেইসব কবিতা আর ছবিতে শেকল বেঁধে দিয়েছে
    যাদের কেশর অবাধে বাতাসে উড়ছিলো।
    কেউ যদি সাম্যবাদে বেশি কিছু দেখতে পায়,
    তারা সাথে সাথে তাকে একটি বিপথগামীর খোলোসে পুরে দেবে।
    তুমি তা জানতে, কনস্ট্যান্টিন:
    জীবন আর কবিতার শত্রু এক।
    যারা সমাজতন্ত্রকে আতিথ্যহীন মরুভূমিতে পরিণত করতে চায়
    তারা প্রথমে কবিতার কোঁচকানো বিনুনিকে কেটে ফেলবে।"

    কনস্ট্যান্টিন বিবল (১৮৯৮ - ১৯৫১) ছিলেন একজন চেক আভাঁ-গার্দ কবি, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, যিনি চেকোস্লোভাকিয়ায় স্তালিনবাদী শাসনকে জোরালোভাবে সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু কাব্যিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন। ১৯৫১ সালের নভেম্বরে তিনি আত্মহত্যা করেন।

    আলোচক জেড, কে, স্লাবি মনে করেন যে "কুন্দেরার বিতর্কিত কবিতাগুলো, ১৯৫২ সালে যারা অন্যায়ভাবে অভিযুক্ত হয়েছিল, তাদের দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল এবং প্রশাসনের দ্বারা মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তাদের সমর্থনে আর প্রশাসনের বিরুদ্ধে লেখা। এমন এক সাহিত্যে যেখানে ভাষার মূল অর্থ প্রচারের কর্মকাণ্ডের ফলে পঙ্গু হয়ে গিয়েছিল। সেই সময়ের আরেক স্তালিনবাদী সমালোচক, জারোস্লাভ জানো, স্ল্যাবের ব্যাখ্যায় এবং কুন্ডেরার সমালোচনায় "সেই ভয়ঙ্কর যাজক,/যারা মার্কসবাদে নিজেদের ঠাণ্ডা দুর্গের মতো আটকে রেখেছে" সম্পর্কে সঠিকভাবে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন, আর হুমকি দিয়ে বলেছিলেন যে কবিতাটায়, "উচ্চতর, ব্যক্তিবাদী, এমনকি নৈরাজ্যবাদী না হলেও, দৃষ্টিভঙ্গির সামান্য ছায়া রয়েছে।"

    কুন্দেরার বিতর্কিত কবিতাগুলি তার পরিপক্ক সাহিত্যশৈলীর আরেকটি বৈশিষ্ট্যের পূর্বাভাস দেয়, যেমন উপন্যাসে আর প্রবন্ধে পাঠকদের কাছে বক্তৃতা দেওয়ার প্রবণতা।

    “কমরেডগণ, লোকটি তার পিঠে তুলে নিয়ে যাচ্ছে
    একটা বস্তা : দু:খ, সন্দেহ এবং খারাপ অভ্যাস
    সে কিন্তু নিজে থেকে শত্রু নয়।
    হয়তো এত ভারী বস্তা নিয়েও এমন একজন মানুষ
    আনন্দের সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করবে
    কমরেডগণ, যে মানুষ আনন্দের সাথে একা চড়াই পার হয়
    বন আর খেতের মধ্যে দিয়ে হেঁটে চলে যায়
    সে মোটেই একজন ব্যক্তিবাদী নয়।
    তার সমস্ত সমালোচকদের একত্রিত করার চেয়ে
    হয়তো এমন একাকী একজন লোক
    সমালোচনা করার জন্য, নিষ্ঠুর রাজদণ্ড নিয়ে অপেক্ষারত লোকেদের তুলনায়
    মানুষদের বেশি পছন্দ করে
    তার প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ অনুসরণ করুন
    আমরা আমাদের বন্ধুর প্রতিটি ছোট পদক্ষেপ দেখছি।
    অন্যথায় তারা ভীরু হয়ে পড়বে
    এবং তারা পিছিয়ে পড়বে।"

    কার্লোস ফুয়েন্তেসকে লেখা মিলান কুন্দেরার এই চিঠি থেকে সেই সময়ের আভাঁ-গার্দ সাহিত্য সম্পর্কে ধারণা হবে :

    প্রিয় কার্লোস,

    আজ আপনার জন্মদিন এবং এ বছর আমারও বার্ষিকী, ৭০-এ পা রাখার; আপনিও ৭০-এ পা রেখেছেন; আমরা, আজ থেকে ৩০ বছর আগে, প্রাগে, প্রথমবারের মতো দেখা করেছি। প্রাগে আপনি এসেছিলেন রুশ আগ্রাসনের মাত্র কয়েক মাস পর, এসেছিলেন হুলিও কোর্তাসার আর গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের সঙ্গে; এসেছিলেন আমাদের পক্ষে কথা বলতে, চেক লেখকদের জন্য আপনাদের উদ্বেগ প্রকাশ করতে।

    তার কয়েক বছর পর, প্রাগ ছেড়ে আমি ফ্রান্সে চলে আসি, তখন আপনি ফ্রান্সে মেক্সিকোর রাষ্ট্রদূত। এখানেই আবার আমাদের সাক্ষাৎ হয়, বারবার দেখা হয়, কথা হয়; আমরা বন্ধুর মতো সম্পর্কিত হয়ে পড়ি। আমি ছিলাম মানসিক যন্ত্রণায় দগ্ধ এক বিক্ষুব্ধ নির্বাসিত লেখক। তখন আপনি আমার মানসিক শক্তি জুগিয়েছেন, বিচক্ষণতার সঙ্গে আমাকে সমর্থন করেছেন এবং অন্যান্য চেক বন্ধুকেও সাহায্য করার চেষ্টা করেছেন। বহু বহু দিন আমার স্ত্রী ভেরা আর আমি মেক্সিকো দূতাবাসে আপনার অতিথি হয়েছি, একসঙ্গে আমরা রাত্রি যাপনও করেছি (তখন আমরা প্যারিসে থাকতাম না)। সকালের নাশতার টেবিলের আড্ডার কথা খুব মনে পড়ে কার্লোস, সেখানে আমরা রাজনীতি নিয়ে খুব কমই কথা বলেছি আর অবিরাম কথা বলেছি কেবল উপন্যাস নিয়ে, আর আমাদের সেসব কথা কোনো দিনও শেষ হয়নি!

    ঠিক তখনই কিন্তু আমি মধ্য ইউরোপ-সংক্রান্ত (সেন্ট্রাল ইউরোপ) ধ্যান-ধারণায় আচ্ছন্ন হতে শুরু করি, একটা ঘোর তৈরি হয়; বিষয়টি আমার নিজের জীবনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত (রাশিয়ার দখলদারিত্ব কিংবা অপহরণ) কিন্তু তার চেয়েও বড় কারণটি বোধ হয় এটিই যে, মধ্য ইউরোপীয় সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য কিংবা নির্দিষ্টতা, যা সেই মধ্যযুগ থেকে আজও অস্তিত্বমান। মধ্য ইউরোপ কোনো রাষ্ট্র নয়, একটা সংস্কৃতি কিংবা নিয়তি। একজন হাঙ্গেরিয়ান কিংবা একজন চেকের কাছে ইউরোপের কী অর্থ? হাজার বছর ধরে তাদের জাতিরা ইউরোপের রোমান ক্রিস্টিয়ানিটি-সমৃদ্ধ অংশে বাস করেছে। ইতিহাসের প্রতিটি পরতে তাদের অবদান আছে। তাদের কাছে ইউরোপের কোনো ভৌগোলিক অর্থ নেই, বরং ইউরোপ তাদের কাছে একটি আধ্যাত্মিক ধারণা। আর আমরা দিনের পর দিন এই নিয়ে কথা বলেছি, কীভাবে অসাধারণ এক মিল মধ্য ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার ভেতর, উভয়ই বারোকরীতির দ্বারা গভীরভাবে চিহ্নিত, একজন লেখকের জন্য যা ম্যাজিক্যাল এবং কল্পনাবিস্তারি স্বপ্নের জাল। অবশ্য ফরাসিদের কাছে তা বিজাতীয়। আমি প্রায়ই ভাবতাম যে ফ্রান্সে স্যুররিয়ালিজমের জন্ম কীভাবে সম্ভব হয়েছিল। আসলে স্যুররিয়ালিজম শিল্প হিসেবে নয়, আদর্শ হিসেবে জন্ম নিয়েছিল ফ্রান্সে। আমরা, আপনি আর আমি—বিশ্বের এ দুটি অঞ্চলের মধ্যে আরেকটি বিস্ময়কর মিল খুঁজে পেয়েছি: মধ্য ইউরোপ এবং লাতিন আমেরিকা বিশ শতকের উপন্যাসের ক্ষেত্রে একটি বিস্তৃত নির্ধারক ভূমিকা পালন করেছে—প্রুস্ত-পরবর্তী উপন্যাসে এবং সেই উপন্যাসের নতুন নন্দনতাত্ত্বিক আলো-হাওয়ায়। প্রথমত, দশের, বিশের এবং তিরিশের দশকে মধ্য ইউরোপে একটি অতি বিশিষ্ট প্রবাহ এসেছিল—কাফকা, মুসিল, ব্রখ এবং গোমব্রোভিজ; তারপর, ষাটের লাতিন আমেরিকায় আরেকটি অতি বিশিষ্ট প্রবাহ দেখা গিয়েছিল।

    শিল্পের আধুনিকতা আর উপন্যাস — আমি এ দুটি বিষয় নিয়েই বেশির ভাগ সময় ভেবেছি, নিজেকে গড়ে নিয়েছি। অনুগত থেকেছি। আভঁ-গার্দ চিন্তাভাবনা উপন্যাসের শিল্পকে সব সময়ই আধুনিকতার বাইরে এমন একটি জায়গায় নিয়ে গেছে, উপন্যাসকে এমন কিছু বিবেচনা করেছে, যার সময় অতিবাহিত হয়েছে; পরবর্তী সময়ে পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকে আভঁ-গার্দ যখন তাদের নিজস্ব ঔপন্যাসিক আধুনিকতা তৈরি এবং ঘোষণা করার চেষ্টা করেছিল, তখন তারা বিশুদ্ধ নেতিবাচকতার পথ অনুসরণ করেই এটি করেছিল: উপন্যাস, চরিত্র, প্লট, গল্প এবং (সম্ভব হলে) বিরাম চিহ্ন ছাড়া। ফলে উপন্যাসগুলো গর্ব করে নিজেদের অ্যান্টি-উপন্যাস হিসেবে ঘোষণা করেছে।

    বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক। আধুনিক কবিতা কিন্তু কখনোই নিজেকে কবিতাবিরোধী বলে দাবি করেনি। শার্ল বোদলেয়ারের হাত ধরে কাব্যিক আধুনিকতা (পোয়েটিক মডার্নিজম) আমূলভাবে কবিতার এসেন্সের কাছে যেতে চেয়েছে। কবিতা কেবল কবিতাই হবে।

    আমি এই নিয়ে কিছুটা ভেবেওছি। আধুনিক উপন্যাসকে আমি অ্যান্টি-উপন্যাস হিসেবে নয় বরং অতি উপন্যাস বা অত্যধিক উপন্যাস (আলট্রা নভেল) হিসেবে কল্পনা করেছি। অতি উপন্যাস সেই বিষয়ে মনোনিবেশ করে, যা শুধু উপন্যাস করতে পারে। অতি উপন্যাস জীবনের সমস্ত অবহেলিত এবং বিস্মৃত সম্ভাবনাগুলোকে পুনরুজ্জীবিত করে, উপন্যাসের শিল্প তার চার শতাব্দীর ইতহাসে যা করে এসেছে। বিস্মৃতির বিরুদ্ধে লড়েছে।

    ২৫ বছর আগে আপনার 'তেরা নস্ত্রা' পড়েছিলাম। হ্যাঁ, আমি একটি অতি উপন্যাসই পড়েছিলাম। আপনার বইটি প্রমাণ করেছে যে এই এই জিনিসগুলোর অস্তিত্ব আছে, এই এই জিনিসগুলো থাকতে পারে।

    আর তার ১৫ বছর পর আপনার 'ক্রিস্টোফার এখনো জন্মায়নি' উপন্যাসেও সেই একই জাদু খুঁজে পেয়েছি: সমস্ত আকর্ষণীয় সম্মোহন এবং নতুনত্বসহ উপন্যাসের দুর্দান্ত আধুনিকতা।

    উষ্ণ আলিঙ্গন, কার্লোস!

    মিলান কুন্দেরা
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    103 | 104 | 105 | 106 | 107 | 110 | 113 | 114 | 119 | 120 | 121 | 123 | 124 | 124 | 125 | 125 | 126 | 127 | 127 | 128 | 129 | 131 | 133 | 134 | 135 | 136 | 138 | 139 | 140 | 141 | 143 | 144 | 145 | 147 | 148 | 149 | 149 | 150 | 151 | 152 | 153 | 154 | 155 | 156 | 157 | 158 | 159 | 160 | 161 | 162 | 163 | 164 | 165 | 167 | 168 | 169 | 170 | 171 | 172 | 173 | 174 | 175 | 176 | 176 | 177 | 178 | 179 | 180 | 181 | 182 | 183 | 184 | 185 | 186 | 187 | 188 | 189 | 190 | 191 | 192 | 192 | 193 | 194 | 195 | 196 | 198 | 199 | 200
  • আলোচনা | ১৫ অক্টোবর ২০২৩ | ৪১২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন