এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  ইতিহাস  শনিবারবেলা

  • পূর্ব ইউরোপের ডায়েরি – স্লোভেনিয়া ৩

    হীরেন সিংহরায়
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১০৫১ বার পঠিত | রেটিং ৫ (৪ জন)
  • স্বতন্ত্রতার প্রথম পথিক - স্লোভেনিয়া


    স্বতন্ত্রতার প্রথম পথিক

    “আমার দেশ একটা, হরফ দুটো, ধর্ম তিনটে, ভাষা চারটে, জাতি পাঁচটা, প্রজাতন্ত্র ছ-টা।”
    —ইওসেপ ব্রজ টিটো


    সাভা নদী কেবল ক্রোয়েশিয়া ও সার্বিয়ার সীমান্ত নির্দেশ করে না। তার দুই তীরে দুটো ধর্ম, দুটো আলাদা হরফ। স্লোভেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া পশ্চিম ইউরোপের ঘরের মানুষ – ক্যাথলিক, ল্যাটিন হরফে লেখে। ক্রোয়েশিয়া ভেনিসের ডিউককে দু-হাত, অটোমান সুলতানকে সাত হাত দূরে সরিয়ে রেখেছিল। স্লোভেনিয়া প্রায় সাতশ’ বছর ব্যাভেরিয়ান অস্ট্রিয়ান ক্যাথলিক রাজাদের অনুগত থেকেছে—রাষ্ট্র বিপ্লবের সন্ধান তেমন মেলেনি। সার্বিয়া, বসনিয়া, মাসিদোনিয়া, মন্টিনিগ্রো পাঁচশ’ বছর অটোমান সুলতানকে খাজনা দিয়েছে। জোর করে অল্পবয়সী ছেলেদের ধর্মান্তরিত করে সৈন্যবাহিনীতে পাঠানো হয়েছে (ইয়ানুসারি) কিন্তু ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করার সামগ্রিক চাপ ছিল না। মাঝে মাঝেই স্বাধীনতার সংগ্রাম করেছে সে রাজার বিরুদ্ধে।

    তাহলে এই নানা জাতি, নানা মত, নানা পরিধানের মানুষজন দু-দু-বার এক পতাকার তলায় সমবেত হলেন কেন? ১৯১৮ সালে এক রাজার আহ্বানে, ১৯৪৫ সালে এক সাম্যবাদী নেতার কাস্তে হাতুড়ি তারার ছত্রছায়ায়?

    ১৯৪১-৪৫ সালে চরম দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট ক্রোয়াট উস্তাশে নৃশংসতায় নাৎসি জার্মানিকে হার মানিয়ে সার্ব, ইহুদি বধ যজ্ঞে নেমেছিল। টিটোর পার্টিজান বাহিনী পালটা মার দিয়ে ইয়ুগোস্লাভিয়াকে নাৎসি মুক্ত করলেন, সে দলে শুধু সার্ব এবং স্লোভেন নয়, ক্রোয়াট, মন্টিনেগ্রিনও ছিলেন। তাঁরা লড়লেন বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে। যুদ্ধ শেষ হলে সকলে ভাই ভাই হয়ে গেলেন? আপাতত? যেমনটি ফ্রান্সে হয়েছিল—দেশ মুক্ত হলেই লড়াকু রেজিসতঁস ও নাৎসিদের সহযোগী ভিশি ফ্রান্সের রেজিম এক অটুট ফ্রতারনিতের সকল্পে আবদ্ধ হয়েছিলেন? চার বছরের আপোষে খুনোখুনি ভুলে গিয়ে?

    অথবা সকলে একত্র হলেন এক দক্ষিণ স্লাভের দেশের নামে (ইয়ুগো = দক্ষিণ, স্লাভিয়া = স্লাভের আবাস)? ইওসেপ ব্রজ টিটোর মা স্লোভেন, বাবা ক্রোয়াট, এক বউ সার্ব – একই অঙ্গে গোটা ইয়ুগোস্লাভিয়া যেন অখণ্ড অমিয় শ্রী টিটো? তাই কি তিনি সকলকে নিয়ে একটা দেশকে ধরে রাখতে পেরেছিলেন?

    আমার ধারণা টিটো সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে পরবর্তীকালের ইউরোপীয় সাধারণ বাজারের নীল নকশাটি এঁকেছিলেন। ছ-টি রাজ্যের নিজস্ব সংবিধান, পতাকা, জোট ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অধিকার (যেমন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আর্টিকেল ৫০ – যার দরুন ব্রেক্সিট সম্ভব হল!) কিন্তু সকলেই এক খোলা বাজারের সদস্য! মুদ্রা এক—দিনার। মানুষ, মূলধন, সকল বস্তু এবং সেবার অবাধ গতায়াত যা সাধারণ বাজারের মূলমন্ত্র। ১৯৯১ অবধি কোনো রিপাবলিকের নির্দিষ্ট সীমান্ত ছিল না। দেশটা ভাগাভাগি হবার পরে কোন রিপাবলিকের সীমানার খুঁটি কোনখানে পড়বে তা নিয়ে চুলচেরা বিতর্ক চলে। এই গত মাসে গাড়ি চালাচ্ছিলাম জার্মানি থেকে ফ্রান্সের পথে, কখন বেলজিয়ামে ঢুকে পড়েছি জানি না—ইয়ুগোস্লাভিয়া ছিল তাই, একটি অর্থনৈতিক সমবায় সমিতি। আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেমন জার্মানি বড়ো ভাই, হল্যান্ড, ফ্রান্স মেজো-সেজো ভাই। তারা মাল বেচে, অন্যেরা কেনে! পর্তুগাল গ্রিস সেই পরিবারের হতদরিদ্র পরিজন মাত্র। তাদের জার্মান গাড়ি কেনা ছাড়া গতি নেই – যাতে তারা কিনতে পারে, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক আরও ধার দেয় গ্রিসকে! সামনের বহু জন্মে তাদের ধার শোধ হওয়ার নয় (কথাটা গ্রিক মানুষের কাছে শোনা)।

    পাহাড়ে ঘেরা দেশ স্লোভেনিয়ার জনসংখ্যা মেরে কেটে বিশ লাখ। আয়তনে সুইজারল্যান্ডের অর্ধেক, পশ্চিম বাংলার এক চতুর্থাংশ। তার সমুদ্র তট মাত্র ৪৭ কিলোমিটার—মানে এই ধরুন চাঁদপাল ঘাট থেকে ডায়মন্ড হারবার। কিন্তু স্লোভেনিয়া ইয়ুগোস্লাভিয়ার জার্মানি—অস্ট্রিয়ার দোরগোড়ায় অবস্থান তার। সবচেয়ে উন্নত রাজ্য। সেথায় বেকারত্ব প্রায় নেই, অথচ বসনিয়াতে বিশ শতাংশ বেকারি। স্লোভেনিয়ার জাতীয় আয় কসভোর দশগুণ (আজকের হিসেবে স্লোভেনিয়ার জাতীয় আয় ভারতের ২%; মাথাপিছু আয় ভারতের একুশ গুণ—তিরিশ হাজার ডলার)। ইয়ুগোস্লাভ অর্থনীতির দ্বিতীয় এঞ্জিন প্রতিবেশী ক্রোয়েশিয়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নে যেমন ফ্রান্স। জার্মানি ইউরোপের বুকে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল—দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জনসংখ্যার শতাংশের হিসেবে সবচেয়ে বেশি মারা যান ডাচ নাগরিক—কিন্তু সে সব ভুলে গিয়ে ডাচ-জার্মান-ফরাসি এই খোলা বাজারে সকলেই ভাই বেরাদর—মহা সম্মিলনী সভার মূল মন্ত্র অর্থনৈতিক। লগ যা গলে।

    ১৯৪৫ সালের পরে ইয়ুগোস্লাভিয়ার জন্ম লগ্নে হয়তো সেই অর্থনৈতিক লজিক ছিল মুখ্য। আদতে সার্ব বনাম ক্রোয়াট লড়াইটা শুরু হয়েছে উনবিংশ শতাব্দীতে। অটোমান রাজত্বের কবল থেকে স্বাধীনতা লাভের পরে সার্বিয়া এক বৃহত্তর সার্বিয়ার স্বপ্ন দেখে—গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপ অস্ট্রিয়ান রাজকুমারকে হত্যা করেন বসনিয়ার মুক্তির জন্য নয়, সার্বিয়ার সীমানা বাড়ানোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু টিটোর নতুন ইয়ুগোস্লাভিয়াতে সার্ব বনাম ক্রোয়াট লড়াই মুলতুবি রইল, বিধ্বংসী যুদ্ধের পরে দেশ গড়ার দাবিতে।

    স্লোভেনিয়া আকারে ক্ষুদ্র, কিন্তু অর্থনীতিক পাওয়ার হাউস, সে তার মাল বেচল মন্টিনিগ্রো মাসিদোনিয়ায়—বিনা শুল্কে—কিনল কিছু খাদ্যশস্য মাত্র। সহজ ভিসা পদ্ধতির সুযোগে নিয়ে ফুলে ফেঁপে উঠল ক্রোয়েশিয়ার ট্যুরিজম—জাতীয় আয়ের প্রায় বিশ শতাংশ। তার এক অংশ বেলগ্রেডে গেল টিটোর রাজ্যপাট সামলানোর জন্য আর এক বিশাল অংশ গেল গরিব কসভার, মাসিদনিয়ানকে খাওয়াতে পরাতে। প্রতিবাদ করে কোনো লাভ ছিল না। ভাষা, ধর্ম অন্য হতে পারে, কিন্তু আহা, সে তো তোমারই ভাই!

    আজকের ইউরোপীয় ইউনিয়নের খাতায় মোটা ইউরো জমা দেয় জার্মানি, ফ্রান্স, হল্যান্ড, কিন্তু খানেওয়ালে ডজন – আয়ারল্যান্ড, গ্রিস, লিথুয়ানিয়া, লাটভিয়া, রোমানিয়া, বুলগারিয়া, ইত্যাদি ভাইয়েরা। ডাবলিন থেকে গলওয়ে যাওয়ার পথে দেখেছি – বারোটি সোনালি তারা মার্কা অজস্র নীল বোর্ডের ছড়াছড়ি—পথের এই অংশটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের বদান্যতায় নির্মিত হইল! এই যেমন কলকাতার বাসস্টপে দেখি—সেটি কোন বিধায়কের দানে তৈরি! রোমানিয়ায় বুখারেস্ট-ব্রাসভের পথের ধারে একই প্রকার বোর্ড আছে, তবে সে রাস্তা চাউচেস্কুর আমলের। ব্রাসেলসের দানের টাকা অন্য কারো পকেটে ঢুকেছে।

    একটা তফাৎ অবশ্য থেকে গেল – ফুটবলের মাঠে হল্যান্ড বনাম জার্মানির সাক্ষাৎ চিরাচরিত শোধ তোলার লড়াই, সেটা কখনও থামেনি। ১৯৮২ সালের বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে ফ্রান্স বনাম জার্মানির খেলায় প্রায় উন্মুক্ত গোলের দিকে ধাবমান ফরওয়ার্ড বাতিসতঁর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষে জার্মান গোলকিপার টোনি শুমাখার তাঁর দাঁত উড়িয়ে এবং পাঁজর ভেঙে দিলে ফরাসি রেডিও টিভি খবরের কাগজ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কিলিং ফিল্ড ভেরদাঁকে স্মরণ করে। খেলার মাঠে সেই পাল্টা মার দেওয়ার সুযোগটা ইয়ুগোস্লাভিয়ার ছিল না—বিশ্বকাপ অথবা ইউরোপিয়ান ফুটবলে ক্রোয়েশিয়া বনাম সার্বিয়ার দেখা হওয়ার রাস্তাটা টিটো বন্ধ করে দিয়ে যান। এক দেশ এক দল। ইয়ুগোস্লাভিয়া আটবার ফুটবল বিশ্বকাপে খেলার অধিকার অর্জন করে। ১৯৯২ সালে ইউরোপীয় প্রতিযোগিতায় যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও দেশে গৃহযুদ্ধ ঘটানোর অভিযোগে খেলতে দেওয়া হয় না। ডেনমার্ক সেই শূন্যস্থানটি নিয়ে সব ভবিষ্যতবাণীকে বিফল প্রমাণিত করে জার্মানিকে হারিয়ে ইউরোপীয় চ্যাম্পিয়ন হয়!

    ছোটো দেশ স্লোভেনিয়া বিশাল অস্ট্রো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্যের ছাতার তলায় আপন ধান্দা করে দিব্যি দিন কাটিয়েছে। ১৯১৮ সালে সেই সাম্রাজ্যের পতন হলে সারবিয়ান রাজা আলেকসান্দারের ডাকে তারা যোগ দিল স্লোভেন-ক্রোয়াট-সার্বদের এক মিলিত রাজ্যে। ব্যবস্থা ভালোই, জার্মান শিখতে হবে না, নতুন রাজ ভাষাটা মোটামুটি এমনিতেই বোধগম্য। তাছাড়া এরা স্বজাতি, স্লাভ! ১৯২৯ সালে দেশের নাম হল ইয়ুগোস্লাভিয়া। স্লোভেনিয়া তার প্রতিরক্ষা, বিদেশ দফতর ইত্যাদি ঝুট ঝামেলা বেলগ্রেডের হাতে আউটসোর্স করে মন দিল আপন উন্নতিতে, যেমন আজকের লুক্সেমবুর্গ – তাদের কুল্লে তিনশো সেপাই আছে, সামন্ত নেই।

    দ্বিতীয় যুদ্ধে স্লোভেনিয়া কিছু কনিষ্ঠ বল নিয়ে মার্শাল টিটোর পাশে দাঁড়ায়। তিনি বিজয়ী হলেন।



    জিও টিটো- বসনিয়ার দেওয়ালে ১৯৯৩; সৌজন্যে উইকি


    রজনী পোহালে দেখা গেল টিটোর ইয়ুগোস্লাভিয়া কমিউনিস্ট কিন্তু পুরোপুরি সোভিয়েত স্টাইলের কমান্ড ইকনমি নয়। মস্কো ক্রেমলিনের মতন সকল সিদ্ধান্ত বেলগ্রেড হতে নয়, স্থানীয় শ্রমিক সঙ্ঘের দ্বারা নির্ধারিত হবে। তাঁরা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য—সেখানে কোনো ছাড় নেই, গোয়েন্দা পুলিশ আছে—কিন্তু হাটে মাঠে ঘোরেন, হাল হকিকত জানেন। বিদেশ যাওয়ার, বিদেশিদের আসার বা অর্থ নিবেশ করার বাধা নেই। এককালে হাবসবুর্গ ও রাজা আলেকসান্দারকে সেলাম করেছে স্লোভেনিয়া, এবার না হয় টিটো এবং কাস্তে হাতুড়িকে সেলাম করবে—আউটসোর্সিং-এর কাজ বহাল রেখে।

    ইয়ুগোস্লাভিয়ার প্রথম বিশ বছরের অর্থনৈতিক উন্নয়ন তাক লাগানো—কেবল পূর্ব ইউরোপ নয়, সারা ইউরোপের শীর্ষে। সবচেয়ে উজ্জ্বল তারকা স্লোভেনিয়া: সে আমলে শহরভিত্তিক মাথাপিছু আয়-গণনা চালু ছিল—লুবলিয়ানার নাগরিক বেলগ্রেডের দ্বিগুণ কামায়!

    অর্থনীতিতে আমার প্রণম্য গুরু হাইমান মিন্সকি বলেছেন, সুদিনেই ভবিষ্যৎ দুর্দিনের বীজ রোপিত হয়ে থাকে,** উজ্জ্বল দিনগুলিতেই আমরা ভুলভ্রান্তি করে থাকি। তাঁর বাণীর মূল্য বারবার প্রমাণিত হয়েছে। ইয়ুগোস্লাভিয়া কোনো ব্যতিক্রম নয়। সেখানে ক্রমশ দেখা দিল নানান তাত্ত্বিক পরিবর্তন (এডভারদ কারডেলির সংশ্লিষ্ট পরিশ্রম থিওরি—বেজায় শক্ত) এবং তার সাথে এল অপ্রত্যাশিতভাবে তেলের দামে বৃদ্ধি – কারো কারো মনে থাকতে পারে—১৯৭৩ সালে কলকাতায় এক লিটার পেট্রোলের দাম ১.৭৩ পয়সা থেকে বেড়ে বোধ হয় পাঁচ টাকা হয়েছিল রাতারাতি। সেই প্রথম অয়েল শক – হল্যান্ডে তেলের অভাবে রাস্তায় গাড়ি দাঁড়িয়ে যায়। তারপর যা হয়—মিসম্যানেজমেন্ট, ইনফ্লেশন, আই এম এফের কাছে ধার, দিনারের বিনিময় মূল্যে হাজার গুণ লোকসান—এককালের জার্মানির মতন দেখা গেল দু-বিলিয়ন দিনারের নোট। সময় খারাপ। টিটো চোখ বুজলেন। এরপরে ঘটনার ঘনঘটা। এবার এক নয়, ছয় রিপাবলিক ও দুই স্বয়ংশাসিত প্রদেশ (কসভো, ভয়ভোদিনা) পালা করে রাষ্ট্রপতি হবে। তালেগোলে সারবিয়ান রাষ্ট্রপতি মিলোসেভিচ পেশী-আস্ফালন করে দুটি স্বয়ংশাসিত প্রদেশের শাসনভার নিজের হাতেই নিয়ে নিলেন – জব হম হ্যায় তো ক্যা গম হ্যায়।

    প্রথম মহাযুদ্ধে অস্ট্রিয়ান প্রজা ক্রোয়াটরা লড়েছিল বিদেশি সার্বিয়ার বিরুদ্ধে। সার্বরা সেদিন বলেছিল, এ মহা অন্যায়। আমরা সবাই আসলে সার্ব। ক্রোয়াটরা ক্যাথলিক সার্ব, বসনিয়াক হল মুসলিম সার্ব—মানে যারাই ইয়ুগোস্লাভিয়ায় বাস করে তারা সবাই অরিজিনালি সার্ব! অতএব সকল সার্ব এক হও!

    সার্ব রাষ্ট্র গড়ো।

    সার্ব বনাম ক্রোয়াটদের বিরোধের যে তুষের আগুন এতদিন ধিকি ধিকি করে জ্বলছিল, সেটি শিগগির লেলিহান আকার ধারণ করবে।

    বার্লিন দেওয়াল ভেঙেছে, জ্যোতির্ময় না আসুন—নতুন নিশান এসেছে । ১৯৯০ সালের ইলেকশানে সব কটি রিপাবলিক তুলল কাস্তে-হাতুড়ি বিবর্জিত পতাকা। কমিউনিজমের সকাল সন্ধেবেলার সেই মধুর খেলার সমাপ্তি। স্লোভেনিয়ার মানুষকে জিজ্ঞেস করা হল, আপনারা কি ইয়ুগোস্লাভিয়ার অংশ হতে চান, না স্বাধীনতা চান? ৯৬% স্লোভেনিয়ান স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিলেন।

    ২৬শে জুন ১৯৯১ স্লোভেনিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করে। তার দেখাদেখি একই দিনে ক্রোয়েশিয়া জানাল সেই একই সিদ্ধান্ত। স্লোভেনিয়ার ভেতরে মোতায়েন ইয়ুগোস্লাভ সৈন্যবাহিনী (সেখানে সার্ব-ক্রোয়াট-মন্টিনেগ্রিন এক হেঁসেলে খায়) জানে না এবার তাদের কাজ কী হবে – সার্বিয়া ফিরে যাওয়া অথবা স্লোভেনিয়ান স্বাধীনতার স্বপ্ন গুঁড়িয়ে দেওয়া। দশ দিনের মধ্যে রণাঙ্গন নিশ্চুপ – সার্বিয়ান প্রধান মিলোসেভিচ ইতিমধ্যে অন্য ডিল করেছেন। হোক স্লোভেনিয়া স্বাধীন, যা গেছে তা যাক—দাবার বোর্ডে সে একটা বোড়ে মাত্র। বিশ হাজার সার্ব সেখানে বাস করেন কিনা সন্দেহ। তাঁর আসল লড়াই এবং লক্ষ্য—ক্রোয়েশিয়ায় বসবাসকারী বিপুল সংখ্যক সার্ব নাগরিকদের জুড়ে নিয়ে এক মহান সার্বিয়া গড়ে তোলা। সাত দশক আগে গাভ্রিলো প্রিঞ্চিপ সেই আশায় অস্ট্রিয়ান সিংহাসনের উত্তরাধিকারিকে গুলি করেন সারায়েভোর মিলিয়াকা নদীর ল্যাটিন ব্রিজের ধারে।



    ক্রোয়েশিয়ান সীমান্ত চৌকি : প্রথম স্লোভেন পতাকা উত্তোলন জুন ২৪, ১৯৯১; সৌজন্যে ডয়েচে ভেলে


    ইউরোপীয় সাধারণ বাজারের তিন প্রতিনিধি* ইয়ুগোস্লাভ বিচ্ছিন্নতাবাদের সমাধা করতে জাগ্রেবে এসে স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতার অধিকার মেনে নিলেন – তাঁরা বললেন, এতেই যদি ঝগড়া বিবাদ বন্ধ হয়, তবে তাই সই। ক্রোয়েশিয়ার একটি অপূর্ব সুন্দর দ্বীপ ব্রিওনিতে জুলাই মাসের সাত তারিখে সকলে মিলে যে কাগজে সই করলেন তার মোদ্দা কথা ছিল – স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা বাকি ইয়ুগোস্লাভিয়া মেনে নিক। ছ-ভাইয়ের সংসারে একটি ভাই না হয় আলাদা ঘরকন্না করুক, মুখ দেখাদেখি তো আর বন্ধ হচ্ছে না। শুধু তাই নয়, এই তিন গুণী প্রস্তাব দিলেন ইয়ুগোস্লাভিয়াতে সাধারণ বাজারের স্টাইলে এক ইউরোপীয় মুভমেন্ট গড়ে তোলা হোক—যেমন ইউরোপীয় ইউনিয়ন চলছে। সেখানে কেউ আর ঝামেলা পাকাবে না – সকলে এক সূত্রে মন বেঁধে ‘সব কা সাথ সবকা বিকাশ’-এর মোচ্ছবে লেগে যাবে।

    বিসমার্ক দূরের কথা, এঁরা কেউ সাম্প্রতিক ইতিহাসটুকু পড়ে আসেননি। আপাত স্বাধীনতার লম্বা দড়ি ছেড়ে দিয়ে টিটো তো ঠিক সেটাই চেয়েছিলেন – রাজনীতি নয়, অর্থনীতি। লগে রহো ক্রোয়াট আউর সার্ব ভাই। চল্লিশ বছর যাবত হয়তো সেই কারণে শান্তি বজায় ছিল। এবারের বিবাদ অর্থনীতির নয়, জাতীয়তাবাদের। স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা বাকি ইয়ুগোস্লাভিয়া না হয় মেনে নিল; কিন্তু আসল সমস্যা সার্ব বনাম ক্রোয়াটদের পারস্পরিক শোধ তোলার বাসনা।

    অব হম ঘর মে ঘুস কর মারেঙ্গে।

    স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতা এল স্বল্প মূল্যে। কিন্তু ইয়ুগোস্লাভিয়ার ঘর ভাঙার সেটিই সূচনা – ঘনিয়ে আসে দেশব্যাপী অনিশ্চয়তা। এবার কার ঘর ছাড়ার পালা? কে তুলে নেবে লোটাকম্বল?

    ব্রাসেলসের তিন মহাত্মা সেদিন বোঝেননি—ব্রিওনি দ্বীপের আপাত সহজ সমাধানে নিহিত ছিল পরবর্তী পাঁচ বছরের গৃহযুদ্ধের বীজ।

    ছ-মাসের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এক বছর বাদে স্লোভেনিয়ার স্বাধীনতাকে পূর্ণ স্বীকৃতি দেবে আমেরিকা।

    রাষ্ট্রসংঘে নিজস্ব আসন। স্লোভেনিয়া এবার একটি স্বতন্ত্র দেশ। নীড় ছোটো ক্ষতি নেই। স্মল ইজ বিউটিফুল।

    ব্যাঙ্কিং


    সামনে কোনো ক্রিস্টাল বল না থাকা সত্ত্বেও, কোনোদিন পুবের দরোজা খুলতে পারে—এই আশায় আটের দশকের মাঝামাঝি সিটি ব্যাঙ্ক একটি বিশেষ দফতর খোলে ভিয়েনায়। নাম—সিটি ব্যাঙ্ক ইস্ট ওয়েস্ট। নামেন পরিচিয়তে। পূর্ব ইউরোপের জানলা। ভিক্টর ব্রুনস্ট ছিলেন তার কর্ণধার (এখন ৮৩ বছর বয়েস, ফ্লোরিডার ক্লিয়ারওয়াটারে বাস করেন)। সে সময়ে পুবে আমাদের একমাত্র শাখা বুদাপেস্তে, সেটি একটি যৌথ প্রকল্প। বার্লিন ওয়াল দাঁড়িয়ে থাকবে আরও দু-বছর। ভিক্টর বলতেন, পূর্ব ইউরোপের একটি মাত্র দেশে যদি আমরা যাই, সেটি হবে ইয়ুগোস্লাভিয়া, সেখানে কাজকর্মের বাধা নেই বললেই হয়। নিয়মিত বেলগ্রেড, জাগ্রেব যেতেন। আমাকে বলেছিলেন, বেলগ্রেড হল ওয়াশিংটন আর জাগ্রেব হচ্ছে নিউ ইয়র্ক! যত ধান্দা সেখানেই। জাগ্রেবে ব্রাঞ্চ খোলার জন্য তিনি ব্যাঙ্ককে প্রস্তাব দেন, সরেজমিন তদন্ত করতে থাকেন। একটিমাত্র ইয়ুগোস্লাভ কর্পোরেটের সঙ্গে সিটি ব্যাঙ্ক তখন ব্যবসা করছে, তার নাম এনারগোপ্রয়েকট। তারা লিবিয়া, জিম্বাবওয়েতে ব্রিজ ড্যাম বানানোর ম্যানডেট পেয়েছে।

    তখন কে জানে—বার্লিন ওয়াল ভাঙবে দু-বছর বাদে, তিন বছর বাদে ইয়ুগোস্লাভিয়া মুছে যাবে ভূগোলের পাতা থেকে আর সেই বছরেই সেনাটোরস্কা ১৬, ওয়ারশ, পোল্যান্ড হবে পূর্ব ইউরোপে আমাদের প্রথম ঠিকানা!

    ইয়ুগোস্লাভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে সিটি ব্যাঙ্কের একমাত্র কাজ ছিল নিউ ইয়র্কে তাদের ডলার ক্লিয়ারিং। তারা ডলার জমা করলে সেটিকে তাদের ইচ্ছামতো প্রাপককে পাঠানো আমাদের কাজ, অবশ্যই কিঞ্চিৎ পারিশ্রমিকের বিনিময়ে। কোনো প্রকারের আর্থিক ঝুঁকি নিতে সিটি সম্পূর্ণ অনিচ্ছুক।

    ছ-টি রিপাবলিকের কেবল আলাদা পতাকা নয়, তাদের ছিল আলাদা কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক। যেমন মনে করুন—বাংলা, বিহার, ওড়িশার রয়েছে নিজস্ব রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, যারা সুদের হার স্থির করতে পারেন, মুম্বাই যা খুশি করুক না কেন। অর্থাৎ মানিটারি পলিসির বিকেন্দ্রীকরণ। লিলিয়ানার সঙ্গে আমার যখন দেখা (১৯৭৮) তখন এই প্রথা চালু ছিল। ব্যাঙ্কের যাবতীয় ধন বা অ্যাসেট ছিল নগদে, বন্ড বা ট্রেজারি বিল রূপে নয় – কাগজ নয়, ক্যাশ! আমি যে সিলেবাস পড়ে ব্যাঙ্কিং করেছি, তার সঙ্গে একেবারেই মেলে না। সে কথা শুনে লিলিয়ানা বলেছিল, তোমাদের সিস্টেম জানতেই তো আমার এখানে আসা!

    ১৯৮৫-র পরে মুদ্রাস্ফীতিকে বশে আনবার জন্য মানিটারি পলিসিকে কেন্দ্রীভূত করা হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী আনতে মারকোভিচ নানানভাবে অর্থনীতিকে সিধে করার অসামান্য প্রচেষ্টা করেন, দিনারের বিনিময় মূল্যকে সাফল্যের সঙ্গে শায়েস্তা করেন। বিল ক্লিনটনের নির্বাচন উপদেষ্টা জেমস কারভাইল বলেছিলেন, জর্জ বুশকে হারাতে গেলে ফোকাস করুন একটা মাত্র জায়গায় – ইট ইজ দি ইকনমি, স্টুপিড।

    কিন্তু ততদিনে অর্থনীতি নয়, ইয়ুগোস্লাভিয়া জুড়ে জাতীয়তাবাদের আগুন জ্বলে উঠেছে।




    পুঃ
    * জিয়ানি দে মিচেলিস (ইতালি), শাক দে পু (লুক্সেমবুর্গ), হান্স ফ্যান ডেন ব্রুক (নেদারল্যান্ডস)। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী জন মেজর বলিষ্ঠ স্বরে এদের সমর্থন করে বলেন, এই পথেই ইয়ুগোস্লাভ বিচ্ছিন্নতাবাদী সঙ্কটের সমাধান হবে।
    ** "Stabilty leads to instability. The more stable things become the more unstable they will become when the crisis hits." – Hyman Minski (1919-1996)
    *** দেশভাগের সময় স্লোভেনিয়ার জি ডি পি ছিল ২০ বিলিয়ন ডলার; আজ ৬২ বিলিয়ন, মাথা পিছু আয় তিরিশ হাজার ডলার।



    ক্রমশ...

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ | ১০৫১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২৩:০০523740
  • আবারো তথ্যসমৃদ্ধ ফাটাফাটি একটা লেখা। 
    ''আমার ধারণা টিটো সজ্ঞানে বা অজ্ঞানে পরবর্তীকালের ইউরোপীয় সাধারণ বাজারের নীল নকশাটি এঁকেছিলেন। ''  - আমি জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের লিডার টিটোকে ছোট থেকেই নেহেরুর পাশাপাশি রাখতাম। ভাষা বা ধর্ম ভিন্ন হতে পারে,কিন্তু তারা তো তোমাদের ভাই তাই তাদের খাইয়ে পরিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে হবে - এই যে দর্শন তাই তাদের আলাদা করেছিল। 
    কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিকেন্দ্রীকরণ ধারণাটাও চমকে দেয়ার মত। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের কমন সেন্ট্রাল ব্যাংক বা মুদ্রা নিয়েও তো ডিবেটের শেষ নেই।  তাই বিকেন্দ্রীকরণ ভাল সিদ্ধান্ত ছিল কিনা বলা যাচ্ছে না কিন্তু এর পেছনের ভাল উদ্দেশ্যটুকু ঠিকই ধরা যাচ্ছে। 
    মিনস্কির মতটা 'সুদিনে দুর্দিনের বীজ  রোপিত থাকে' কথাটা মনে করাল যে আমাদের ব্যাংকের যে শাখাগুলো একসময় খুব বেশী হাততালি পায় কনফারেন্সে তাদেরই দেখা যায় একটা সময় পড়ে চোখের পানি নাকের পানিতে একাকার হতে। 
     
     
     
  • Debanjan Banerjee | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২০:৩৫523759
  • হিরেনদার আরেকটি ক্লাসিক হতে যাচ্ছে এই বইটি | ছত্রে ছত্রে অনেক না জানা ইতিহাস , অর্থনীতি আর গল্প |  নতুন আরেকটা দুনিয়া খুলে যাচ্ছে চোখের সামনে |
  • Amit | 163.116.203.89 | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৭:১৮523765
  • হিরেন দা তো ৯০-এর ওই অস্থির সময় বা তার পরে এই দেশগুলোকে খুব কাছের থেকে দেখেছেন। একটা জিনিস বুঝতে পারিনা - যুগোস্লাভিয়া ভেঙে যাওয়াতে ন্যাটোর ঠিক কি ইন্টারেস্ট থাকতে পারে ? ন্যাটো ফোর্স তো দুতিন বছর এই দেশগুলোতে বসে ছিল। অবশ্য যুক্তি দেখানো হয় মিলোসেভিচের হাতে বসনিয়ান দের মাস্যাকার ঠেকাতে। 
     
    বার্লিন ওয়াল ভাঙার পরে বা রাশিয়া ভাঙার পরে ওয়েস্ট ওভারঅল কমুনিসম এর ভয় তো অনেকটাই কমে যাওয়ার কথা। তাহলে ইউনাইটেড যুগোস্লাভিয়া থাকলে তো ইইউ র জন্যে বড়ো সিঙ্গল মার্কেট  হতে পারতো। সেখানে ছটা ছোট ছোট দেশে ভেঙে গেলে এদের কোথায় লাভ ? এতো গুলো ছোট দেশে আলাদা করে অফিস খোলা বা পার্টনারশীপ বানানো -বেশি বিজনেস ট্রাভেলস -সব মিলিয়ে কস্ট ভিউ থেকে তো এফিসিয়েন্ট মনে হয়না ? এখন যেমন স্লোভেনিয়া ডেভেলপড ইকোনমি। আগেও তারা বাকিদের থেকে এগিয়ে ছিল।কিন্তু বসনিয়া আগেও গরিব ছিল - এখনো তাই। 
     
    নাকি যুগোস্লাভিয়া কম্যুনাল কনফ্লিক্ট এমন জায়গায় আসছিলো যে আল্টিমেটলি কোনো বিজনেস ই করা যেতোনা ?হাই রিস্ক অফ বিজনেস ? পলিটিকাল আর ফিনান্সিয়াল মোটিভ গুলো তখনকার ন্যাটো বা ইইউ র স্ট্যান্ড পয়েন্ট থেকে বুঝতে চাইছি। 
  • Ranjan Roy | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৯:৪৬523766
  • দারুণ জায়গায়  এই পর্বটি শেষ  করেছেন হীরেনদা, পরেরটির অপেক্ষায়।
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১২:৩২523772
  • এই পর্বটাও দুর্ধর্ষ ছিল। পরের পর্বের জন্য অধীর আগ্রহে  অপেক্ষা করছি।
  • হীরেন সিংহরায় | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:৩১523773
  • অমিত

    ইউগোস্লাভিয়ার গৃহযুদ্ধ ছিল সার্ব এবং ক্রোয়াটদের আপোষে  শোধ তোলার লড়াই মধ্যিখানে বসনিয়ার উলুখাগড়ার প্রাণ গেল। ই ইউ বা ন্যাটোর কোন দুর্বুদ্ধি সেখানে কাজ করে নি – ৮ মে ১৯৪৫ এর পরে ইউরোপে যখন প্রথম লড়াই হলো
    তাতে ন্যাটো  দু বার সরাসরি অংশ নেয় ( মূলত আকাশ থেকে ) । স্রেব্রেনিতসা গণহত্যার পরে  মানবিক অধিকারের দাবিতে এবং সিকিউরিটি কাউন্সিলের সম্মতিতে ১৯৯৩/৪ ।  দ্বিতীয় বারের আক্রমণ ( সার্বিয়া এবং কসোভোর সার্ব সৈন্যের ওপরে )  রাষ্ট্রসঙ্ঘের অনুমোদনে নয়, আমেরিকার অভিপ্রায়ে ইতিমধ্যে ইউ এন তার শান্তি বাহিনী পাঠায়। লড়াইটা হয়ে দাঁড়াল সার্ব এবং মিলোশেভিচ বনাম বাকি দুনিয়ার । মনে রাখা ভালো স্রেব্রেনিতসা গণহত্যার পরে রাশিয়া ইতিহাসে প্রথমবার সার্বিয়ার বিরোধিতা করে ।  অন্যথায় তারা সার্বিয়ার চিরসঙ্গি ।  ধম্মে,  হরফে ভাই ভাই । রোমানিয়া গ্রিস কখনও প্রকাশ্যে সার্বিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না। একই কারণে।

    অর্থনীতির হিসেবে আপনি একেবারে ঠিক বলেছেন । অবশ্যই ইউগোস্লাভিয়া ছিল ই ইউর কাম্য পার্টনার কিন্তু ছটা রিপাবলিকের ইকনমিকস সঠিক চালাতে তারা ব্যর্থ হয়েছ ( ইট ইজ দি ইকনমি , স্টুপিড !) তাই আজ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পক্ষে স্লোভেনিয়া বসনিয়া ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে ব্যবসা করায় কোন অসুবিধে নেই – একের পর এক তারা ইউনিয়নের সদস্য হিসেবে  ঢুকে পড়েছে ( স্লোভেনিয়া ক্রোয়েশিয়া ) বা ঢুকবার পথে ( সার্বিয়া, মনটি নিগ্রো , বসনিয়া )  - ন্যাটোর সদস্য হয়েছে একাধিক দেশ ।  দেশ ভাগের পরে শুধু স্লোভেনিয়া নয়, বসনিয়ারও  আয় বেড়েছে – বসনিয়ার  মাথা পিছু আয় ব্রাসিল বা দক্ষিণ আফ্রিকার চেয়ে অনেক বেশি, ভারতের চার গুণ আজকের ইউরোপে স্মল ইজ বিউটিফুল – সে মাল্টা সাইপ্রাস হোক আর মনটি নিগ্রো বসনিয়া হোক।
  • হীরেন সিংহরায় | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৬:৩৭523774
  • রঞ্জন , রমিত 
     
    পূর্ব ইউরোপে আমার নিজের গল্প বলতে গিয়ে ইতিহাসের সঙ্গে  জড়িয়ে পড়েছি, বিশেষ করে বলকানে কবে দেড়শ বছর আগে সিগার মুখে শ্যাম্পেন সেবন করতে করতে এক গুঁফো জার্মান বলেছিলেন - ওই বলকানে কোনদিন কে একটা হুজ্জুতি করে বসবে আর বাকি ইউরোপকে তার খেসারত দিতে হবে । কথাটা আজও সত্য বেলগ্রেডে দেখবেন ন্যাটোর বোমা বর্ষণের স্মৃতি - গাভ্রিলো প্রিন্সিপের দুটো গুলির পরে একশ বছর কেটে গেছে , শঙ্কা যায় নি ! আগাম বলে রাখি সার্বিয়াএবং আলবানিয়া প্রসঙ্গে আরও বিস্তারিত বলার সুযোগ আসবে। স্লোভেনিয়াতে আমার সুখের সময় ... 
  • Ahsan ullah | ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ২৩:৪২523791
  • 1973 সালে তেলের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছিল, এর কারণ হতে পারে 1971 সালে ইউ এস $ কে ভাসমান মুদ্রা করে দেওয়া। এটা করা হয়েছিল কারণ জার্মান মার্কের কাছে মার্কিন মুদ্রা খুব মার খাচ্ছিল। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক দেশের অসহায় দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
  • হীরেন সিংহরায় | ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:০৯523797
  • আহসান ভাই

    যথার্থ । ১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট নিকসন সরকার এক আউনস সোনার সঙ্গে ৩৫ ডলারের গাঁটছড়া ছিন্ন করলে পরে ডলার সকল মুদ্রার প্রেক্ষিতে ভাসমান হয়ে যায়।  বিভিন্ন মুদ্রার দাম  বাঁধা রইল না ( এক ডলার= ছ  ভারতীয় টাকা বহুদিন ছিল আমার ছাত্রাবস্থায় ) ১৯৭৩ সালে তেলের দাম বাড়ার মূল কারণ অবশ্য সেটা নয়:  খনিজ তেল রপ্তানি কারক দেশগুলি ( OPEC) ইওম কিপ্পুর যুদ্ধে( আরব বনাম ইসরায়েল ) ইসরায়েলকে যারা সমর্থন করেছিল তাদের শাস্তি দেবার জন্য আকস্মিক দর বৃদ্ধি করে । ফলে, কেবল পশ্চিমের দেশ নয়, আপনি যেমন বলেছেন, ভারত বাংলাদেশ সহ অনেক উন্নয়নশীল দেশের জনগোষ্ঠী  তার শিকার হয়।   উলুখাগড়ার প্রাণ গেল। ,
     
  • Ahsan ullah | ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৩:৩৭523813
  • আপনার লেখা পড়ে খুব ভাল লাগে, আশা করব লিখতে থাকবেন। আমার মনে কিছু প্রশ্ন আসে যেটা আপনাকে বিস্তারিত লিখণ তআছি। ১৯৯২ -৯৩  সালে যখন ক্রোয়েশিয়া ও স্লোভেনিয়া যুগোশ্লাভিয়া যুক্তরাষ্ট্রের কাঠামো থেকে স্বাধীনতা ঘোষনা করে তখন তারা সম্ভাব্য সার্বিয় আক্রমণের আশংকা করেছিল। এই আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য জনসাধারণ এমনকি বৃদ্ধরাও অস্ত্র হাতে বনে জংগলে অবস্হান নিয়েছিল, সেইসব ছবি ও খবর বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। ।বিপত্তি বাঁধে যখন অপেক্ষাকৃত দুর্বল বসনিয়া স্বাধীনতা ঘোষনা করে, আমার অনুমান মতে সেখানে অবস্হিত সার্ব ও ক্রোয়াট জনগনকে উস্কানি দিয়েছিল পশ্চিম ইউরোপের দেশ গুলো আর এটা করা হয়েছিল ওসমানীয়া খেলাফতের উপর প্রতিশোধ নেবার স্পৃহা থেকেই। আপনি যেমনটি লিখেছেন ক্রোয়াট সার্ব ধূমায়িত দ্বন্দ্ব কেমন করে সার্ব মুসলিম দ্বন্দ্বে রুপান্তরিত হলো, আশা করব বিস্তারিত লিখবেন। 
  • হীরেন সিংহরায় | ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ১৪:৫০523834
  • আহসান ভাই

    আপনার সঙ্গে  আমি খানিকটা  সহমত। কিন্তু যতো গভীরে যাবেন তত জটিলতা বাড়ে – পাঁচশ বছরের ওসমানলি শাসনে অর্থোডক্স সার্ব ইসলামিক আলবানিয়া বসনিয়া একত্র বাস করেছে- আপোষে কোন লড়াই হয় নি।  ঠিক সে সময় ক্যাথলিক ক্রোয়াট এবং স্লোভেন বাস করেছে পশ্চিমের ক্যাথলিক রাজার শাসনে। ক্রিমিয়ার যুদ্ধের মূলে আবার সেই ধর্ম - ক্যাথলিক বনাম সার্বদের লড়াই যেখানে রাশিয়া অর্থোডক্স সার্বকে উস্কানি দেয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ক্যাথলিক ক্রোয়াট অর্থোডক্স সার্ব পিটিয়েছে। ধর্মের বিশাল ভূমিকা।  সার্ব স্লোভেন ক্রোয়াট  কখনও একসঙ্গে ঘর করে নি ১৯১৮ সালের আগে।  ইউগোস্লাভিয়া ভাঙার যুদ্ধ আসলে দ্বিপাক্ষিক কিন্তু মুশকিল হল বসনিয়াকে নিয়ে ( এবং আলবানিয়া কিন্তু সেটা আরেক বৃহৎ অধ্যায়, পরে লিখব) – ১৯৯২ সালে সার্ব এবং ক্রোয়াট চেয়েছিল বসনিয়াকে দু ভাগে ভাগ করে নিতে।  যুক্তি খানিকটা এই রকম – আমরা সবাই স্লাভ, কেউ ক্যাথলিক  কেউ অর্থোডক্স কেউ বা মুসলিম! যদি আমার লেখা গ্রন্থাকারে দেখা দেয়, এ বিষয়ে আমার নাতিদীর্ঘ পরিশিষ্ট লেখার বাসনা আছে।
     
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন