এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • একদিন প্রতিদিন 

    Anirban M লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০৪ জুলাই ২০২৩ | ৯০৮ বার পঠিত
  •    হঠাৎ চোখটা খুলে যেতেই সুপ্রিয় বুঝল সকাল হয়ে গেছে। সুপ্রিয় রাতে চিত হয়ে শোয়। চোখ খুলতেই যেটা চোখে পড়ল সেটা হল সাদা ছাদ আর তাতে লাগানো একটা পাখা যেটা বনবন করে ঘুরছে। ঘুরতে থাকা পাখা দেখার একটা নেশা আছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আবার কেমন যেন একটা ঝিম ধরে আসে। চটকটা ভাঙ্গে তনিমার ডাকে। তনিমা – সুপ্রিয়র স্ত্রী। তনিমা কিছুটা রাগত স্বরেই ঝিঙ্কাকে চানে যেতে বলছে। ঝিঙ্কা ওদের ছবছরের মেয়ে। ঝিঙ্কার স্কুলে যাওয়ার সময় হয়ে এসেছে। স্কুল বাসের সময় হয়ে এল। রান্নাঘরে রান্নার আওয়াজ আসছে। অঞ্জলিদি এসে গেছে তার মানে। অঞ্জলিদি সুপ্রিয়দের বাড়িতে রান্নার কাজ করে। বাসন মাজা, ঘর মোছার কাজ করে সীমা। সীমা আসবে আরেকটু পরে।  বিছানা থেকে উঠে সুপ্রিয় ব্রাশে পেস্ট লাগায়। আয়নার দিকে তাকাতেই মনে পড়ে যায় আজ কুড়ি তারিখ। ক্রেডিট কার্ডের বিল এসেছে পনের তারিখ। আরও সপ্তাহ খানেক আছে বিল দেওয়ার জন্য। কিন্তু আগামী তিনদিনের মধ্যে দুটো ইএমআই কাটবে ব্যাঙ্ক – একটা হোমলোন, আরেকটা বাইক। সব মিলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার। সুপ্রিয় দাঁত মাজতে মাজতেই হিসেব করতে থাকে। একাউন্টে পড়ে আছে প্রায় হাজার তিরিশেক। কাল একটা চেক ফেলেছে দশ হাজারের। তারপরেও আরও বাকি থাকছে দশ মতো। কোথা থেকে আসবে এই টাকা এখনও বুঝতে পারছে না সুপ্রিয়। আজ একটা কোম্পানি ভিজিট আছে। সুপ্রিয় যে কোম্পানিতে মার্কেটিং এর চাকরি করে তারা বিভিন্ন কারখানার জন্য দূষণ কমানোর যন্ত্র বানায়। যন্ত্রগুলো বেশ দামি। একটার অর্ডার হলেও বেশ খানিকটা কমিশন বোনাস হিসেবে পাবে সুপ্রিয়। তাতে ইএমআই সমস্যার অনেকটাই সমাধান হয়ে যেতে পারে। এমনিতে কমিশনের টাকা ঢুকতে সময় লাগে। কিন্তু একাউন্টসের স্যান্যালদা কে বলে কয়ে একটু আগে টাকাটা ঢোকানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে এখন কারখানা কমে এসেছে। মার্কেটিং-এর কাজে প্রায়ই তাই সুপ্রিয়কে যেতে হয় রাজ্যের বাইরে – আসাম, ওড়িশা, তেলেঙ্গানা এই সব। যদিও আজকের ভিজিট কলকাতাতেই – যারা সুপ্রিয়দের যন্ত্র কিনবে সেই কারখানার হেডঅফিস কলকাতাতেই। এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে সুপ্রিয় দাঁত মাজা শেষ করে। দেখতে পায় ঝিঙ্কা স্কুল ড্রেস পরে রেডি। সুপ্রিয় ঝিঙ্কার হাত ধরে স্কুলবাসে তুলে দেওয়ার জন্য বেরিয়ে পড়ে। এই স্কুলটা তার বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। নতুন স্কুল, বেশ নাম করেছে। স্কুলের ফিসও বেশ অনেকটা বেশি – সুপ্রিয়দের সাধ্যের তুলনায়। কিন্তু তবু এই স্কুলে ভর্তি করার সময় সে বা তনিমা তা নিয়ে দুবার ভাবে নি। ভেবেছিল তারা যে সুযোগ পায় নি সেটা মেয়েকে দিতে হবে। সুপ্রিয় আর তনিমা দুজনেই সরকারি, বাংলা মিডিয়াম স্কুলে পড়েছে। সুপ্রিয়দের স্কুলটা এ অঞ্চলে বেশ পুরনো। জীর্ণ ইঁটের বাড়ি, পুরোন বেঞ্চ, টেবিল। পুরোন কমন রুমে লম্বা বেঞ্চে টিচাররা ক্লাসের মাঝখানে এসে বিশ্রাম নেন। সুপ্রিয়র মনে আছে দুটো পাখা ছিল কমন রুমে। কিন্তু তাতে গরম কমত না ঘরের। স্যারেরা রুমাল দিয়ে মাথা, ঘাড় মুছতে, মুছতে আবার ক্লাসে দৌড়চ্ছেন – এই দৃশ্য মনে গেঁথে রয়েছে সুপ্রিয়র।  ঝিঙ্কার স্কুলের সাথে ওসব স্কুলের কোন তুলনাই চলে না। মেঝেতে ঝকঝকে টাইলস। কমন রুম, অফিস আর প্রিন্সিপালের অফিসে এসি। সবথেকে বড় কথা সবাই সবসময় ইংরিজি বলছে। নিজে ভালো ইংরিজি বলতে পারে না বলে সুপ্রিয়র একটা হীনমন্যতা ছিল। নিজের মেয়ের ঝরঝরে ইংরিজি শুনে কি ভালো যে লাগে! মনে হয় সবাইকে ডেকে ডেকে শোনায়।
     
        বাসস্ট্যান্ডে পৌঁছে দেখল অন্য আরো অনেকের সাথে অভীক আর তার বাবাও অপেক্ষা করছে। অভীক ঝিঙ্কার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। এই বাসস্ট্যান্ড থেকে যারা ওঠে তাদের মধ্যে অভীকই একমাত্র ঝিঙ্কার সঙ্গে একই ক্লাসে পড়ে। অভীকের বাবা কোন একটা ব্যাঙ্কের বড় অফিসার, তনিমা বলেছিল। তনিমা, অভীকের মায়ের ফেসবুক ফ্রেন্ড। এই তো গত পরশুই তনিমা ফেসবুক খুলে দেখিয়েছিল ওদের বেড়ানোর ছবি – অভীকরা সপরিবার ইউরোপ বেড়াতে গেছিল। তনিমা কিছু বলে নি, কিন্তু অভীক বুঝতে পারে ছবি দেখে তনিমার মন খারাপ হয়েছে। বহুদিন ধরে দার্জিলিং বেড়ানোর পরিকল্পনা করে রেখেছে। কিন্তু মূলত টাকাপয়সার কারণেই কিছুতেই করে উঠতে পারছে না। ওদের দেখে অভীকের বাবা হাত নেড়ে এগিয়ে আসেন। “কী দাদা, ভালো?” সুপ্রিয় হেসে মাথা নাড়ে কিন্তু কিছুতেই অভীকের বাবার নামটা মনে করতে পারে না। কিছুটা অস্বস্তির সাথেই পালটা “আপনি ভালো তো?” জাতীয় কথা দিয়ে কথা শেষ করার চেষ্টা করে। স্কুলবাস এসে যায়। অন্য অনেক বাচ্চার সাথে অভীক, ঝিঙ্কাও বাসে উঠে যায়। সুপ্রিয় বাড়ির রাস্তা ধরতে যায় এমন সময় অভীকের বাবা এসে ওকে ডাকে, “ দাদা, একটু কথা ছিল”। সুপ্রিয় জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়। “আপনার কাছে একটু টাকা ধার পাওয়া যাবে? মানে ধরুন এই হাজার দুয়েক?” এই প্রশ্ন শুনে সুপ্রিয় এত অবাক হয় যে উত্তর দিতেও ভুলে যায়। অভীকের বাবা ব্যাঙ্কের অফিসার, সামার ভ্যাকেশনে ইউরোপে বেড়াতে যায়। সে কিনা টাকা ধার চাইছে সুপ্রিয়র কাছে! সুপ্রিয়র মুখের ভাব দেখে অভীকের বাবা বলে ওঠে “আসলে আমার একটা টাকা ইনভেস্টমেন্টে আটকে গেছে। খুব ঝামেলায় পড়ে গেছি। মাসের শেষ, বুঝতেই পারছেন”।  মাসের শেষ সুপ্রিয়র নিজেরও। একটু সংশয়ও যে হয়নি তা নয়। সত্যি অভীকের বাবার দুহাজার টাকা দরকার? আর তার জন্য আর কাউকে না পেয়ে শেষে সুপ্রিয়? সুপ্রিয়র সাথে কতটুকুই বা চেনাজানা! অবশ্য এরকমও হতে পারে চেনাজানা লোকের থেকে টাকা ধার করতে লজ্জা পাচ্ছেন অভীকের বাবা। এসব ভাবতে ভাবতেই মানিব্যাগটা খুলে দেখে সুপ্রিয়। হাজার-বারোশ টাকা মত রয়েছে। আজ বাজার থেকে কেনাকাটা করার ছিল। সুপ্রিয় তার থেকে হাজার টাকা তুলে দেয় অভীকের বাবার হাতে। আর তখনই অভীকের বাবার নামটা মনে পড়ে যায় – অম্বরীশ। মানিব্যাগ টা বন্ধ করতে করতে একটা হাসি ফুটে ওঠে সুপ্রিয়র মুখে। প্রতিশোধের হাসি। যতই তুই শালা ইটালি যাস,  ধার তো করলি এই মক্কেলের থেকেই!

       হাসিটা বেশ অনেকক্ষণ ছিল। অন্তত বাড়ি ফেরা অবধি।  বাড়ি ফিরে তনিমাকে দেখেই দশ হাজারের চিন্তাটা ফিরে আসে। তনিমা ততক্ষণে অফিস বেরোবে বলে তৈরি হচ্ছে। তনিমা সবে কাছের একটা নার্সিংহোমে কাজ পেয়েছে। বিলিং সেকশনের কাজ। মাইনে খুবই কম – আট হাজার টাকা মাত্র। কিন্তু বাড়ির কাছে বলে যখন তখন বাড়ি আসা যায়। ঝিঙ্কা দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরলে তনিমা ওকে খাইয়ে দাইয়ে আবার অফিসে যায়। ফেরে একটু রাত করে। সুপ্রিয় বাড়ি ফেরে রুটি কিনে আর ফিরে রাতে খাওয়ার মত কিছু একটা তরকারি বানায়। ততক্ষণে তনিমা ফিরে আসে। তনিমা চাকরি পেয়েছে সদ্য। মাস দুয়েক হবে। অফিস থেকে অ্যাডভ্যান্স চাইলেও পাবে না। সুপ্রিয় ভাবতে থাকে। মানিব্যাগ খুলে আরেকবার দেখে। অম্বরীশকে টাকা ধার দেওয়ার পরে আর শ’-আড়াই মত পড়ে আছে।  আর তিনটে ক্রেডিট কার্ড। সংসার প্রায় ক্রেডিট কার্ডের ওপরই চলছে বলা যায়। হঠাৎ ব্যাগের পেছনের খোপে চোখে পড়ে একটা ভিজিটিং কার্ড। অন্দরমহল ইন্টেরিওর ডেকরেশন কোম্পানি। মনে পড়ে যায় যে এটা আসলে তাদের নিজেদেরই কোম্পানি। তার আর তনিমার। তনিমার ঘর সাজানোর দিকে ঝোঁক ছিল। তারপর ইন্টেরিওর ডেকরেশনের একটা কোর্সও করে। তারপর এই কোম্পানি। কোম্পানি মানে ২০০টা ভিজিটিং কার্ড আর একটা ট্রেড লাইসেন্স। সে প্রায় মাস ছয়েক আগের কথা। তখন অনেককে কার্ড দিয়েছিল। সুপ্রিয় মিশুকে ছেলে। তাছাড়া মার্কেটিং কাজের সুত্রে অনেক ঘোরাঘুরিও করতে হয়। প্রায় ১৫০ কার্ড বিলি করে দিয়েছিল মাস খানেকের মধ্যেই। অনেকে অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।  কিন্তু কাজ আসে নি একটাও। কোম্পানি তৈরির আরও মাস তিনেক পরে তনিমা চাকরিটা পেল। তারপর এই কোম্পানির কথা ভুলেই গেছিল সুপ্রিয়। কাউকে কার্ড বিলি করার আর তাগিদ পায় নি। একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে ভেতর থেকে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখল প্রায় আটটা বাজতে চলল। তনিমা নটায় বেরোবে। সুপ্রিয় সাড়ে নটায়। দুজনেই তৈরি হতে থাকে। শুধু দশ হাজারের চিন্তাটা মাথার ভেতর খচখচ করতে থাকে।

        ঠিক সাড়ে দশটার সময় সুপ্রিয় নামল ডিজি ইন্ডাস্ট্রিসের হেড অফিসের সামনে। পিনকোড কলকাতার হলেও জায়গাটা প্রায় শহরতলি। এখানেই মাল বেচতে হবে সুপ্রিয়কে। আগে একদিন কথা বলে গেছে সুপ্রিয়। আজ একটা প্রেসেন্টেশন দেওয়ার আছে কোম্পানি মালিক দাশগুপ্ত সাহেবের সামনে। বেশ অনেক টাকার যন্ত্র, তাই সবদিক না বুঝে কোম্পানিও কিনবে না। তবে আগের রাউন্ডে অন্য ছোট-মেজ কর্তারা মোটামুটি সন্তুষ্টি দেখিয়েছেন। এখন বড় কর্তা দেখে গ্রীন সিগন্যাল দিলেই কাজ শেষ। সুপ্রিয় চুক্তিপত্রের খসড়াও নিয়ে এসেছে সঙ্গে। প্রেসেন্টেশন চলল প্রায় ঘন্টাখানেক ধরে। দাশগুপ্ত সাহেব মোটামুটি খুশি কিন্তু উনি কিছু প্রশ্ন তুললেন যার উত্তর সুপ্রিয়র কাছে নেই। সেইসব উত্তর নিয়ে পরে আরেকদিন আসা যেত কিন্তু দাশগুপ্ত সাহেব কালই বেরিয়ে যাচ্ছেন বিদেশে, প্রায় একমাসের জন্য। তাহলে পুরো ব্যাপারটা এক মাস পিছিয়ে যাবে। তাতে দাশগুপ্ত সাহেব বা সুপ্রিয়র কোম্পানি কারও খুব অসুবিধে নেই। কিন্তু কন্ট্রাক্ট সই না হলে সুপ্রিয় কমিশন পাবে না। সুপ্রিয়র হাতে অত সময় নেই। সুপ্রিয় ফোনে ধরল তার ডিপার্টমেন্টের সাহা-দা কে। সাহা দা সব শুনেটুনে বলল, “অত চিন্তা করিস না। ওরা যা বলছে সেটা আমরা করে দিতে পারব। কিন্তু তার জন্য টেকনিক্যাল কিছু জিনিশ চেঞ্জ করতে হবে, তাই কন্ট্রাক্টটাও অন্যভাবে লিখতে হবে। তুই একটু দাঁড়া, আমি লিগ্যাল আর ইঞ্জিনিয়ারিং টিম এর সাথে কথা বলে জানাচ্ছি”। সুপ্রিয় অপেক্ষা করতে থাকে ডিজি ইন্ডাস্ট্রিস এর লবিতে। এক একটা মিনিট যেন এক একটা ঘন্টার মত মনে হতে থাকে। মিনিট কুড়ি পরে সাহাদার ফোন। সাহাদা বললেন সব কথা হয়ে গেছে। নতুন করে কাগজ বানিয়ে দেবে তাদের অফিস। আপাতত যে যে জিনিষ নতুন লেখা হবে চুক্তিতে সেগুলো সাহাদা হোয়াটস্যাপে পাঠাচ্ছেন। সুপ্রিয় যেন একবার দাশগুপ্ত সাহেবকে দিয়ে মৌখিক সন্মতি নিয়ে নেন। সেইসব দেখাতে দেখাতে আরো প্রায় ঘন্টা খানেক গেল। সুপ্রিয় যখন ফাইন্যাল কাগজপত্র আনতে নিজের অফিসের দিকে রওনা দিল তখন বাজে প্রায় একটা। লাঞ্চের আর সময় হবে না আজ। যে করেই হোক আজ কন্ট্রাক্টটা ফাইনাল করতে হবে। দুপ্যাকেট পার্লে জি কিনে বাইকে স্টার্ট দেয় সুপ্রিয়।

       এখন প্রায় সাড়ে চারটে। বাইকে নিজের অফিসে ফিরতে সুপ্রিয়র লেগেছিল দেড় ঘন্টা, কাগজ পত্র নিতে আরো মিনিট পনের, ফিরতে আবারো দেড় ঘন্টা। কিন্তু ফেরার পর সে জানতে পারে দাশগুপ্ত সাহেব বেরিয়ে গেছেন বাড়ি থেকে জরুরি তলব পেয়ে। আর ফিরবেন না আজ। তার মানে পুরো ব্যাপারটা পিছিয়ে গেল প্রায় একমাস। সুপ্রিয় হতাশায় ডিজি ইন্ডাস্ট্রির লবির চেয়ারেই বসে পড়ে ধুপ করে। যে দশ হাজার পেয়ে যাবে সে ভেবেছিল তা হল না। তার মানে আর তিনদিনের মধ্যে দশ হাজার টাকা জোগাড় করতে হবে। কোথা থেকে জোগাড় হবে ভেবে পায় না সুপ্রিয়। মিনিট দশেক লবিতে বসে থাকার পরে শরীরটা টেনে বাইরে দাঁড় করায়। খিদে পেয়েছে খুব। ব্যাগ হাতড়ে দেখে পার্লে-জির দুটো প্যাকেট প্রায় অটুট। পরপর গোটা দশেক বিস্কুট খেয়ে একটু জল খায় সুপ্রিয়। তারপর ডিজি ইন্ডাস্ট্রিসের পাশের রাস্তাটা পার হয়ে একটা মাঠের পাশে এসে দাঁড়ায়। মাঠের পাশে একটা চায়ের দোকান। সেখানে একটা চা নিয়ে বসে পড়ে মাঠের দিকে মুখ করে। মাঠে ক্রিকেট চলছে। টেনিস বলের ম্যাচ। সম্ভবতঃ দুই পাড়ার ম্যাচ। চারদিকে অনেক লোক বেশ উত্তেজিত। ছোটবেলায় এসব ম্যাচ খেলায় অনেক উত্তেজনা ছিল। সুপ্রিয়র মনে পড়ে। সুপ্রিয় খেলা দেখছিল কিন্তু সেভাবে মন দিতে পারছিল না। কুড়ি হাজারের চিন্তাটা মাথা থেকে বেরোচ্ছে না। সে চিন্তা করতে থাকে কারো থেকে টাকা ধার করা যায় কিনা। বন্ধু-বান্ধব কারো সাথেই সেরকম যোগাযোগ নেই যার কাছে সহজে টাকা ধার চাওয়া যায়। বাবা-মা মারা গেছেন বেশ কিছুদিন হল। তাদের টাকাও ছিল না সেরকম। তনিমার বাবা-মা বেশ উচ্চবিত্ত। কিন্তু সুপ্রিয়-তনিমার বিয়ে ভালোবাসা করে এবং তনিমার বাবা-মা’র ইচ্ছের বিরুদ্ধে।  সুপ্রিয়র টাকা পয়সা নেই, সে তনিমাকে ভাল রাখতে পারবে না এই যুক্তিতেই তনিমার বাবা-মা এই বিয়েতে মত দেননি। ঝিঙ্কা হওয়ার পর এখন পরিস্থিতি অনেক স্বাভাবিক। কিন্তু তনিমার মনে কোথাও একটা ক্ষতচিহ্ন রয়ে গেছে সুপ্রিয় বুঝতে পারে। তাই তাঁদের কাছে টাকা পয়সা চাওয়া তনিমা কিছুতেই মেনে নেবে বলে মনে হয় না। কিন্তু সুপ্রিয়র পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গেছে। বাড়ি ফিরে তনিমার সাথে কথা বলতে হবে বলে সুপ্রিয় ঠিক করে।
      
      কিন্তু সে পরে হবে। এখন সুপ্রিয় খেলাটাতেই মন দেয় মন শান্ত রাখার জন্য। খানিকক্ষণ পরে সুপ্রিয় খেয়াল করে সে বেশ খেলার মধ্যে ঢুকে গেছে। মাঠের পাশে রাখা স্কোরবোর্ড দেখে আর চা-দোকানের লোকজনের সাথে কথা বলে সে খেলার হালহকিকত বুঝে নেয়। খেলা হচ্ছে দাদাভাই সঙ্ঘের সঙ্গে ইলেভেন বুলেটস-এর। এই দুই ক্লাবের সদস্যরাই আগে ইউনাইটেড ফ্রেন্ডস বলে একটা ক্লাব করেছিল। এখন ঝগড়া-ঝাঁটি করে দুটো ক্লাব করেছে। সুতরাং ম্যাচ নিয়ে সবাই খুব উত্তেজিত। আপাতত পরিস্থিতি হচ্ছে প্রথমে ব্যাট করে দাদাভাই সঙ্ঘ কুড়ি ওভারে দেড়শ রান করেছে। তারপর নেমে ইলেভেন বুলেটস পনেরো ওভারে একশ তুলে দিয়েছে। কিন্তু ওদের সাত উইকেট চলে গেছে। চা-ওয়ালার থেকে সুপ্রিয় এও জানতে পারে নীল টি-শার্ট পড়ে যে ব্যাট করছে তার নাম পল্টন। পল্টন খুব দারুন প্লেয়ার না। ওদের কোন এক স্টার প্লেয়ার না আসায় সবাই ধরে বেঁধে নামিয়ে দিয়েছে। কিন্তু এখন ইলেভেন বুলেটসের ভাগ্য নির্ভর করছে পল্টনের ওপরেই। সুপ্রিয় এ পাড়ার কেউ না হয়েও কেমন করে যেন পল্টনের সাপোর্টার হয়ে যায়। ছেলেটা বেশ ভালো ব্যাট করছে। প্রতি ওভারেই পাঁচ-ছয় করে নিচ্ছে। কিন্তু উল্টোদিকের ব্যাটসম্যানটি একেবারেই অগা। ব্যাটে-বলেই হচ্ছে না। বলতে বলতে উলটোদিকের ব্যাটসম্যান্ আউট! ওভারের শেষ বলে। পরের ওভারের প্রথম বলে পল্টন একরান নিল। এখন যে বল করছে সে নাকি দাদাভাইদের বেস্ট বোলার। এর নাম ভাইয়া। পল্টনের উল্টোদিকে এখন যে নেমেছে তার নাম ইনু। বোঝাই যাচ্ছে ইনু বল প্রায় চোখেই দেখতে পাচ্ছে না। পরের পাঁচটা বলে কোন রান হল না। আবার উল্টো দিকে পল্টন। পল্টন বুঝে গেছে ইনুর মেয়াদ আর বেশিক্ষণ নয়। পল্টন প্রথম বলে চালালো। কিন্তু ব্যাটে বলে হল না। পরের বলও মিস। তৃতীয় বলও মারতে গিয়ে উঠে গেল ওপরে। সহজ ক্যাচ। কিন্তু কী করে কে জানে ফিল্ডার মিস করল। সুপ্রিয় দূর থেকেই বুঝতে পারল পল্টন স্নায়ুর ওপর নিয়ন্ত্রণ হারাচ্ছে। পল্টনও বুঝেছে বোধহয়। সে খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল উইকেটের দিকে তাকিয়ে। হঠাত কে যেন মাঠের বাইরে থেকে চেঁচিয়ে উঠল, “মাথা ঠিক রাখ পল্টন, খেলা ঘুরবে”। ডাকটা শুনে বুকের ভেতরটা ছাঁত করে ওঠে সুপ্রিয়র। এ যেন অবিকল তার বাবা’র গলা। কিন্তু তার বাবা মারা গেছেন আজ পাঁচ বছর হতে চলল। সুপ্রিয় মাথা ঘুরিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কে ডাকটা দিল। কিন্তু মাঠের বাইরে এখন অনেক লোক, সুপ্রিয় বুঝতে পারল না। কিন্তু পরের বলে পল্টন কোন ঝুঁকি নিল না। সামনের পা বাড়িয়ে ফরোয়ার্ড ডিফেন্স। ক্রিকেটের বইতে যেমন থাকে। সুপ্রিয় উদগ্রীব হয়ে তাকিয়ে থাকে পরের বলের জন্য। আর তিন ওভার পাঁচ বল। তিরিশ রান বাকি। হাতে দুই উইকেট। এমন সময় একটা অচেনা নাম্বার থেকে ফোন আসে। কিছুটা বিরক্ত হয়েই ফোন তোলে সুপ্রিয়। ফোনের ওদিকে একটা অচেনা গলা শোনা যায়, “অন্দরমহল ইন্টেরিওর ডেকরেশন?” এটা শুনেই সুপ্রিয় সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে, “হ্যাঁ, বলুন”। ফোনের উল্টোদিক বলে, “ আমার নাম সমীরণ সেনগুপ্ত। আপনাদের কার্ডটা আমাকে তমালদা দিয়েছেন। আমি ওনার থেকে একটা ফ্ল্যাট কিনেছি। সেই ফ্ল্যাটটার ভেতরের কাজ করানোর জন্য আমরা ইন্টেরিওর ডেকরেটর খুঁজছি। আপনি কি আজ একবার দেখা করতে পারবেন? আমরা যে ফ্ল্যাটটা কিনেছি তার পাশেই আমরা ভাড়া আছি এখন”। সুপ্রিয় ঠিকানাটা বুঝে নিয়ে বাইকের ওপর বসে বাইকে স্টার্ট দেওয়ার আগে মাঠের দিকে তাকায়। তিন ওভারে কুড়ি রান দরকার। ইনু আউট হয়ে গেছে। হাতে আর এক উইকেট। পল্টন ফ্রন্টফুটে একটা কভার ড্রাইভ মারল। দুজন ফিল্ডারের মাঝখান দিয়ে বল পথ করে নিল বাউন্ডারির। আর ষোল রান। সুপ্রিয় বাইকে স্টার্ট দিল।  
     
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০৪ জুলাই ২০২৩ | ৯০৮ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
    আরও পড়ুন
    বটগাছ - Anirban M
    আরও পড়ুন
    লাইক-ইট - Anirban M
    আরও পড়ুন
    বর্ম - Anirban M
    আরও পড়ুন
    প্লাবন - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ০৪ জুলাই ২০২৩ ২১:৩৯520999
  • বাহ। 
  • kk | 2607:fb91:810:54ec:11c2:c266:bd2b:8813 | ০৫ জুলাই ২০২৩ ০০:১৩521006
  • সুন্দর গল্প। ভালো লাগলো।
  • স্বাতী রায় | 117.194.34.235 | ০৬ জুলাই ২০২৩ ১৪:৪৪521048
  • ভালো লাগল। 
  • Ranjan Roy | ০৭ জুলাই ২০২৩ ০২:৩০521055
  • খুব ভাল লেখা।
    সুপ্রিয়  ও পল্টন যেন সমদ্বিবাহু ত্রিভুজ। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন