এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • প্লাবন

    Anirban M লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৩০৬ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  •  
    সকাল ৭টা
    ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে বিতান দেখে চারপাশটা বৃষ্টিতে ঝাপসা হয়ে আসছে। নিচে, মাটিতে জল জমছে আস্তে আস্তে। কাল রাত থেকে বৃষ্টি হচ্ছে, টানা। এরকম মেঘ ভাঙ্গা বৃষ্টি মুম্বইতে হয়েছে কয়েকবার, খবরে পড়েছে বিতান। এবার কী কলকাতার পালা? সে দাঁড়িয়ে আছে পাঁচ তলার ওপর। তার বাড়িও কি ভেসে যেতে পারে? বিতান ভয় পায় না। পাঁচতলা ভাসিয়ে নেওয়া বৃষ্টি কোথাও হয়েছে বলে জানা নেই বিতানের, তবু হলে ভাল হয়। কিছু একটা অন্তত হবে জীবনে। রোজ সকালে ওঠা, অফিস যাওয়া, টাকা রোজগার, উইকেন্ডে বউ-বাচ্চা নিয়ে খেতে যাওয়া – বিতান এখন একমাস পরের দিনের কথা আগাম বলে দিতে পারে। একটা মহাপ্লাবন এলে মন্দ হয় না, সেই যেমন বাইবেলে আছে। কিন্তু নোয়ার নৌকোতে তার জায়গা হবে কী তার? হবে না-ই মনে হয়। তবু কিছু একটা হোক। আজকাল খুব ক্লান্ত লাগে তার। বিতান চারপাশের ফ্ল্যাটে চোখ বোলায়। তাদের ক্যাম্পাসে তিন-চারটে বাড়ি আছে। সবই পাঁচতলা আর সবগুলোতে তার মতই আরো কিছু লোক থাকে যারা সবাই সকালে অফিস যায়, সন্ধেবেলা ফেরে, খাবার খায়, ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে যৌনতা, ছেলের হোমওয়ার্ক, বেড়াতে যাওয়া অনেকটা আইসক্রীমের ওপর ছড়ানো চকোলেট সসের মত পড়ে থাকে। কোন একসময় হয়ত চকোলেট সস নিয়ে উত্তেজনা ছিল, এখন আর নেই। কিন্তু আজ কিছু একটা হবে মনে হয়। জল উঠবে? ঘর ভাসবে বলে মনে হয় না। অন্ততঃ পার্কিংটা ভেসে গেলে বেশ হয়। তার হ্যাচব্যাক যাবে, কিন্তু তার সাথে সাথে এস এউ ভি, সেডান - এগুলোও তো যাবে। প্রকৃতি মৃত্যুর মত, বড়-ছোটর পার্থক্য করে না। জল উঠছে আস্তে, আস্তে। আজ কিছু একটা হোক। বিতান ঘরে যায় চা বানাতে।
       চা নিয়ে ফিরে এসে বিতান আবার ব্যালকনিতে বসে। সুতনুকা আর বিল্টু ঘুমোচ্ছে। ঘুমোক। হয়ত আজই সব শেষ হয়ে যাবে। সামনের বাড়িটার দিকে তাকায় বিতান। ব্লক এ। বিতান থাকে বি-তে। বিতানের ব্যালকনি থেকে এ ব্লকের চারটে ফ্ল্যাট নজরে আসে -- ৪,৫,৬ আর ৭ নম্বর। বিতান জানে ৪ এ অনীশ-বিদিশা থাকে, ৫ এ ডঃ মজুমদার আর তাঁর পরিবার, ৬ এ থাকে সুরজিত-মধুমিতা আর ৭ এ নতুন লোক এসেছে। ৭ এর মালিক কেজরিওয়াল নতুন ফ্ল্যাট কিনে চলে গেছে। এখন এই ফ্ল্যাটটা ভাড়া দেয়।  নতুন এসেছে একটি ছেলে আর একটি মেয়ে, কয়েক মাস হল। বিবাহিত কিনা বলা মুশকিল। ছেলেটির নাম বোধহয় আকাশ। সুতনুকা বলছিল। ওর সাথে দুধ কিনতে গিয়ে আলাপ হয়েছে। সাধারণত ফ্ল্যাটের লোকেদের সাথে আলাপ হ্য় দুর্গাপূজোর সময়। কিন্তু আকাশরা এসেছে দুর্গাপূজোর পরে। তাই কথা হয় নি কখনও। আকাশদের খুব কমই বাইরে দেখা যায়। আকাশকে তাও কয়েকবার দেখেছে বিতান, মেয়েটিকে একবারই – ওই যখন ওরা শিফট করল, তখন। মেয়েটি কাজল পরেছিল, বেশ চোখে লাগার মত, বিতানের মনে আছে। বিতান ওর নাম দেয় কাজল। এতে ভাবতে সুবিধে হবে। আকাশ-কাজলরা কখনো ঘরের জানলা খোলে না। বড় একটা বাইরেও দেখা যায় না ওদের। কিছু একটা গোলমাল আছে। এসব নিয়ে বিতান মাথা ঘামায় নি কখনো। কিন্তু আজ ভাবতে গিয়ে পুরো ব্যাপারটাই গোলমাল লাগতে থাকে। খবরের কাগজে এরকম তো প্রায়ই বেরোয় যে আবাসনগুলিতে টেররিস্ট বা বড় ক্রিমিনালরা ডেরা বেঁধেছে। আকাশ কি টেররিস্ট? না কি পরিবার থেকে পালিয়ে এসে সংসার করছে। হয়ত উঁচু জাত-নিচু জাতের ব্যাপার। বা ধর্ম। হয়ত ওরা আলাদা ধর্মের, বাড়ির ভয়ে পালিয়ে এসেছে। বিতান শুনেছে মুম্বইতে অনেক সোসাইটিতে মুসলিমদের বাড়ি ভাড়া দেয় না। কলকাতায় এসব ব্যাপার নেই এই ভেবে পুরোটা স্বস্তি পেতে গিয়েও পারে না বিতান, তার মনে পরে যায় তাদের ক্যাম্পাসের সবাই উচ্চবর্ণের হিন্দু। তাদের ক্যাম্পাসেও কি এরকম কোন নিয়ম আছে? বিতান ঠিক করে ব্যাপারটা একটু খোঁজ নিয়ে দেখতে হবে।
    বসে থাকতে থাকতে বিতান বুঝতে পারে সুতনুকা উঠে পড়েছে। আজ নির্ঘাত গীতা আসবে না। গীতা একটু দূরে বস্তিতে থাকে। একটু বৃষ্টি হলেই ওদের বস্তি ভেসে যায়, গীতা বলেছিল একবার। পাঁচতলার ওপর থেকে অবশ্য বৃষ্টি দেখতে ভালোই লাগে। যদিও জল বাড়ছে। সেই জল ভেঙ্গে বর্ষাতি পরা একটা লোক ঢুকছে তাদের ক্যাম্পাসে, বিতান খেয়াল করে। গেটে কোন সিকিউরিটি নেই, লোকটা ঢুকে পড়ে বিনা বাধায়। বিতানের কাছে ওদের সিকিউরিটি এজেন্সির ফোন নাম্বার আছে, পকেটে মোবাইলও আছে । কিন্তু বিতান ফোন করে না। দেখা যাক কী হয়। লোকটার পিঠের দিকে বর্ষাতি উঁচু হয়ে আছে। ব্যাকপ্যাক নিঃসন্দেহে। কিন্তু তার ভেতরে কী? লোকটা এ ব্লকে ঢুকে পড়ে। নিচে পার্কিং লট। লোকটা ঘুরে ঘুরে গাড়ি দেখতে থাকে। কিন্তু কেন? লোকটা কি গাড়ি চোর? না কি গাড়ির মধ্যে বোমা রাখতে চায়? পাঁচ তলার ওপর থেকে ভালো বোঝা যায় না। এমনও হতে পারে লোকটা সিঁড়ির দিকে গেল। সাধারণতঃ সিঁড়ির মুখে সিকিউরিটি থাকে। আজ যেন কেউ না থাকে। কিছু হোক একটা। ভেতর থেকে সুতনুকা ডাকে। হয় বাসন মাজা নাহলে ব্রেকফাস্ট। কিছু একটা করতে হবে। বিতান ভেতরে যায়।
     
    সকাল ১১টা
    বিতান আবার ব্যালকনিতে এসে বসে। লোকটাকে আর দেখা যায় নি। উল্টোদিকের ফ্ল্যাটগুলোর জানলা খুলেছে, ব্যালকনিতে ইতিউতি লোক এসে বসছে। শুধু ডঃ মজুমদারের ফ্ল্যাটের জানলা দরজা কিছুই খোলে নি। তাহলে কী মজুমদারের ফ্ল্যাটেই গেল লোকটা? মজুমদারদের নিয়ে কখনো আলাদা করে ভাবে নি বিতান। অবশ্য কাকে নিয়েই বা ভেবেছে? মজুমদারকে কী খুন করতে চাইতে পারে কেউ? লোকটা ডাক্তার, পয়সাকড়ি ভালোই আছে। কোন গোলমালে জড়িয়ে পড়ে থাকতে পারে। খুন হতে গেলে কী কোন যোগ্যতা লাগে? বিতান কি খুন হতে পারে কখনো? মোটিভ, মোটিভ! বিতানকে কেন কেউ খুন করতে চাইবে? বিতান ভাবার চেষ্টা করে। সেই অর্থে শত্রুতা তো তার নেই। কিন্তু গত পরশু উবার ড্রাইভারের সাথে তার ঝগড়া হয়েছিল। সে এসি চালাচ্ছিল না। শেষ পর্যন্ত চালায় কিন্তু খুব রেগে গেছিল। লোকটা বাঙালি না, যদ্দুর মনে পড়ে। সে কি খুন করতে পারে বিতানকে? মজুমদার কি এরকম কোন ঝামেলায় পড়ে থাকতে পারে? বিতান ডাক্তারবাবুকে ফোন করে। ফোন বেজে যায়। একটা ভয় বিতানের গলার কাছে দলা পাকিয়ে ওঠে।
    ভাবতে ভাবতে সামনের ব্লকের চারতলায় নজর যায়। মধুমিতা রেলিং দিয়ে বিপজ্জনক ভাবে ঝুঁকে রয়েছে। এমনিতে সব ফ্ল্যাটের বারান্দা ঘেরা গ্রিল দিয়ে। কিন্তু মধুমিতাদের ফ্ল্যাটের গ্রিলের খানিকটা জানলার মত করা। ওটা খোলা যায় এবং ফাঁকটা বেশ বড়। মধুমিতা আপাতত সেটা দিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। নিচে জল ছাড়া কিছু নেই, কেউ নেই। মধুমিতা একবার মুখ তুলে বিতানদের ফ্ল্যাটের দিকে তাকায়। কিন্তু বিতানকে বা অন্য কাউকেই নজর করে না। তার চোখে এক ভয়াবহ শূন্যতা। অন্তত বিতানের তাই মনে হয়। বিতান ভয় পেয়ে যায়। মধুমিতা কি আত্মহত্যা করতে চায়? কিন্তু কেন? বিতানের হঠাৎ মনে হয় খুন হওয়ার মত, তার আত্মহত্যা করারও যোগ্যতা নেই। আপাতত প্রশ্ন হল মধুমিতার কি আছে? বিতান চোখ বন্ধ করে মধুমিতার জীবনটা ভাবার চেষ্টা করে। মধুমিতা, সুরজিত আর তাদের মেয়ে সৌরসেনী থাকে ওই ফ্ল্যাটে। সৌরসেনী বিতানের ছেলের বিল্টুর ক্লাসমেট। তাই জন্মদিন, হ্যালোউইন এসবে বিল্টু ডাক পায়। সেই সুত্রে কয়েকবার ওদের ফ্ল্যাটে গেছে বিতান। খুব সাজানো ফ্ল্যাট। কেমন একটা সব পেয়েছির দেশে টাইপ। সুরজিত, মধুমিতা দুজনেই খুব উচ্চপদে চাকরি করে। কিন্তু শুধু সেটা নয়। ওদের বাড়িও খুব হিসেব করে সাজানো। হয় সেটা কোন ইন্টিরিয়র ডেকরেটর কে দিয়ে বা ওরাই এর পেছনে এতটা সময় দিয়েছে। এই ধরণের বাঙ্গালিদের বাড়িতে সাধারণত যামিনী রায় বা রবীন্দ্রনাথের প্রিন্ট থাকে। একটু পশ্চিমি আঁতেল হতে চায় যারা তাদের বাড়িতে মনে, ভ্যান গঘ বা খুব বেশি হলে পিকাসো কি দালি থাকে। মধুমিতাদের বাড়িতে একটা একদম অন্যরকমের প্রিন্ট ছিল। বিতান জিজ্ঞেস করে জেনেছিল পল ক্লীর ছবি। ছবিটার নাম ডেথ এন্ড ফায়ার। বিতান এমনিতে ছবি নিয়ে মাথা ঘামায় না, বিশেষ কারো নামও জানে না। উইকিপিডিয়া করে জানতে হয়েছিল। যদিও মধুমিতা-সুরজিতের সাথে কথা বলে মনে হয় নি তারাও শিল্প নিয়ে খুব ভাবিত। আবার এমনও হতে পারে বিতানকে এসব নিয়ে আলোচনার যোগ্য মনে করে নি। ছবির নামটা আবার মনে পড়ে যায় বিতানের – ডেথ এন্ড ফায়ার। এটাই কি সূত্র ছিল খুব ভয়ঙ্কর কিছুর? বিতান লক্ষ্য করে সৌরসেনী কাঁদতে কাঁদতে ব্যালকনিতে আসে। মধুমিতা ওর হাত ধরে ঢুকে যায়। তাহলে কি খুন হতে পারে? এবার যেন ছক মিলে যেতে থাকে, একটা সম্ভাব্য নকশা। বর্ষাতি পরা লোকটা হয়ত মধুমিতার প্রেমিক বা ভাড়াটে খুনি। সুরজিতকে খুন করতে এসেছে । শুনতে খুব ক্লিশে, কিন্তু খবরের কাগজে এরকম প্রায়ই পড়া যায়। ভাবতে ভাবতে বিতান সোজা হয়ে বসে। আজকের দিন খুনের জন্য আইডিয়াল। বর্ষাতিতে ঢাকা থাকলে বোঝাও যাবে না কে আসছে, কে যাচ্ছে আর তাছাড়া যদি ছু্রি মেরে খুন করে রক্ত-টক্ত চট করে ধুয়ে ফেলা যাবে। ব্রিলিয়ান্ট! বিতান ভাবার চেষ্টা করে তার সুরজিতের জন্য দুঃখ পাওয়া উচিত কিনা। যদি বিতান খুন হয় তাহলে কি তাদের ক্যাম্পাসের কেউ তাকে সত্যি মিস করবে? সুরজিত করবে কী? বিতান এরকম কাউকে মনে করতে পারে না, তার অপরাধবোধও একটু কমে আসে। বিতান আবার ক্রাইম সিন নিয়ে ভাবার চেষ্টা করে। একটা লাশ পড়ে রয়েছে মধুমিতাদের ফ্ল্যাটে। কিন্তু এটা সরাবে কী করে? নাকি মধুমিতা পুলিশ ডেকে বলবে ডাকাত এসে মেরে গেছে? বিতান হঠাৎ শুনতে পায় সুতনুকা ডাকছে তাকে। আচ্ছা, সুতনুকা কি খুন করাতে পারে তাকে? ভাবনাটা আসতে বিতান একবার থমকে যায়। তারপর ব্যালকনি ছেড়ে ঘরে ঢোকে।
     
    বিকেল ৩টে
    চান, খাওয়ার পর ছেলের আবদারে একসাথে বসে খানিক সিনেমা দেখতে হল। তাতেই বেশ কিছুটা দেরি হয়ে গেল। ফিরে এসে বিতান দেখে সামনের বাড়ির সব জানলা দরজাই বন্ধ। নিচে জল আরো বেড়েছে। বৃষ্টি একটু কমেছে মনে হয়। এ ব্লকের সামনে একটা বড় ঢাকা ভ্যান দাঁড়িয়ে। লাশ পাচা্রের জন্য হতে পারে কী? বিতান দেখতে থাকে। কিন্তু কোথাও কাউকে দেখা যায় না। ভ্যানের ভেতরে কোন ড্রাইভারও নেই। সামনের ফ্ল্যাটের সব জানলাই বন্ধ। শুধু মজুমদারদের একটা জানলা খোলা। সেখান থেকে একটা লম্বা দড়ি ঝোলানো। খুব অদ্ভুত। বিতান আরেকবার মজুমদারকে ফোন করে। এবার অন্য একটা ফোন থেকে। এটা ওর অফিস থেকে দেওয়া। অফিসের লোক ছাড়া কেউ জানে না। দু-তিনবার ফোন হওয়ার পর কেউ ফোনটা তোলে। কিন্তু ওদিক থেকে কোন আওয়াজ পাওয়া যায় না। বিতান দুতিন বার হ্যালো, হ্যালো বলে। তারপর ফোনটা কেটে যায়। নেটওয়ার্ক খারাপ থাকলে এরকম হতে পারে। অথবা হয়ত কেউ তার গলা শুনে কেটে দিল। বিতান ভাবতে চেষ্টা করে নিচে গিয়ে একবার মজুমদারদের খোঁজ নেওয়া উচিত কিনা। কিন্তু খুব একটা উৎসাহ পায় না। নিচে তাকিয়ে বিতান দেখে একটা বাচ্চা ছেলে ঘোরাঘুরি করছে। একবার ভ্যানের জানলা দিয়ে উঁকিও দিল। তারপর সেও এ ব্লকের ভেতরে ঢুকে গেল। বিতান পুরো ছবিটা মেলানোর চেষ্টা করে। কিন্তু অনেক ফাঁক। সে বোঝে পুরো ছবিটা আঁকতে গেলে নিচে নামতে হবে। কিন্তু কেন এই দুর্যোগে সে নিচে নামছে তার কী ব্যাখ্যা সে সুতনুকাকে দেবে ভেবে পায় না। সে যা ভাবছে সেটা সুতনুকাকে বলা যাবে না। তাছাড়া বিতান গোয়েন্দা নয়। সে কোন রহস্য সমাধান করতে চায় না। সে শুধু তার জীবনে একটা রোমাঞ্চকর কিছু চায় যার কেন্দ্রে হয়ত একটা ডেডবডি আছে। প্রশ্ন হল ডেডবডি কার? সেটা কি খুন? আত্মহত্যা? বিতানের মনে হয় একটা চিৎকার ভেসে আসে এ ব্লকের কোন একটা ফ্ল্যাট থেকে। আন্য সময় হলে টিভি র আওয়াজ ভেবে পাত্তা দিত না। কিন্তু আজ দিনটা অন্যরকম। বিতান এক দৃষ্টে এ ব্লকের দিকে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু কিচ্ছু হয় না। শুধু বৃষ্টির আওয়াজ। তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিতানের কেমন যেন ঘোর লাগে, সে আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে থাকে।
    বিকেল ৩-৩০
    একটা ফোন আসে। কোন ব্যাঙ্ক তাকে টাকা ধার দিতে চায়। বিতান টাকা চায় না সেটা জানানোর পর ফোনটা কেটে যায়। বিতান বিরক্ত হয়। তারপর মনে হয় ফোনটা যে মেয়েটি করেছিল তার তো এটা চাকরি। হয়ত বিতান ধার নিতে রাজি হলে মেয়েটির বোনাস হত। মেয়েটি কি বোনাস পেয়ে তার প্রেমিকের জন্য গিফট কিনতো? নাকি একটা স্কুটারের ডাউন পেমেন্ট দিত? বিতান এসব কিছুই জানে না। মেয়েটি শুধুই একটি স্বর। আর কিছুদিন পরে হয়ত এই কাজ কোন রোবট করবে, যার কোন বোনাসের প্রয়োজন থাকবে না। বিতান বোঝে মেয়েটির দিক থেকে সে একটি ফোন নম্বর শুধু, যে ধার নিতে রাজি হলে মেয়েটির প্রেমিক একটা নতুন মোবাইল পেতে পারে, বা মেয়েটির জন্য নতুন স্কুটার। সেই ধারের টাকায় কী হবে বা তা কীভাবে শোধ হবে এর কোন কিছুর সাথে মেয়েটির কোন সম্পর্ক নেই। বিতানের মনে হয় তারা কেউ আর রক্ত মাংসের মানুষ নেই। তারা এক একটা নম্বর বা একটা যান্ত্রিক স্বর। এসব ভাবতে ভাবতে বিতান মোবাইলে দেখে ৩-৩০ বাজে। শেষ সে সময় দেখেছিল ৩-১০ এ। মাঝখানের ১৫ মিনিট সে কী করেছে বা কী দেখেছে মনে করতে পারে না। সে আবার এ ব্লকের দিকে মন দেয়। হঠাৎ দেখে সেই বর্ষাতি পরা লোকটা তাদের ব্লকে ঢুকছে। কিন্তু এ ব্লকের দিক থেকে না। তাদের দুটো ব্লকের মাঝখানের রাস্তার বাঁদিক থেকে। ওদিকে সি ব্লক। তাদের ফ্ল্যাটে। কেন? তাহলে কি তাদের ব্লকে কেউ ওর নেক্সট টার্গেট? বিতান খুব দ্রুত তাদের ব্লকের পরিবারগুলোকে মনে করার চেষ্টা করে। ঠিক মনে পড়ে না। তাহলে কী তার জন্য? এটা কি সিরিয়াল কিলিং? ঘুরে ঘুরে খুন করছে? নাকি সে যা ভাবছিল সেটাই? সুতনুকার প্রেমিক? আসল টার্গেট বিতান। নাকি বিতানের কোন পুরনো কাজের প্রতিশোধ নিতে এসেছে? বিতান সেরকম কিছু মনে করতে পারে না যার জন্য সে খুন হতে পারে। যদিও আজকাল অনেক তুচ্ছ কারণেই খুন হয়। কিন্তু যদি বিতান আসল টার্গেট হয় তাহলে লোকটা এতক্ষণ ক্যাম্পাসের মধ্যে কী করছিল? আজ সে খুন হতে পারে ভেবেও বিতান খুব বিচলিত হয় না। কিছুটা যেন রোমাঞ্চ বোধ করে। কিছু একটা হবে তাহলে। কিন্তু কীভাবে খুন হবে সে? দড়ির ফাঁস? ছুরি? মাথায় হাতুড়ি? বিতান দ্রুত ভাবতে থাকে। যাই কোন না কেন, বাকি চিত্রনাট্যটা সেই লিখবে। দরজায় বেল বাজে। বিতান বোঝে সুতনুকা দরজা খুলতে বেরোচ্ছে বেডরুম থেকে।
     বিতান ঘরে ঢোকে। একটা প্রতিরোধ অন্তত হওয়া উচিত। সেরকম কোন জুতসই অস্ত্র খুঁজে পায় না বিতান। ততক্ষণে সুতনুকা দরজা খুলে ফেলেছে। দরজার ওপারে থাকা লোকটা মাথার ঢাকা সরায়। লোকটাকে চেনা চেনা লাগে বিতানের। লোকটাই মুখ খোলে,
    “বউদি, আমি গদাই। ইলেক্ট্রিক মিস্ত্রি। অনেক ফ্ল্যাটে ইলেক্ট্রিকের সমস্যা হয়েছে, আমি ঘুরে ঘুরে ঠিক করছি। আপনাদের সব ঠিক আছে তো?”
    “হ্যাঁ, আমাদের সব ঠিক আছে”।
    দরজা বন্ধ হয়ে যায়। বিতান একটু মুষড়ে পরে। কিন্তু তার ডিডাকশন ভুল হতে পারে না। হয়ত আরো একজন বর্ষাতি পরা লোক আছে, যে সামনের ব্লকে ঢুকেছে। বিতান আবার বারান্দায় ফেরে।
     
    বিকেল ৪টে
    নিচের ভ্যানের দরজা খোলা। দু-তিন জন লোককে সেখানে মাল তুলতে দেখা যায়। বিতান দেখে আকাশ আর কাজল নিচে নেমে সবকিছুর তদারক করছে। প্যাকার্স এন্ড মুভার্স। আকাশ-কাজলরা অন্য কোথাও শিফট করছে। বৃষ্টি থেমে গেছে। পাম্প চলছে কোথাও। জল নামছে আস্তে আস্তে। সামনের বারান্দায় মজুমদার দম্পতি। বিতান কে দেখে হাত নাড়ে। মজুমদারের ফোন আসে কিছুক্ষণের মধ্যে।
    “আপনার মিসড কল দেখলাম, কী ব্যাপার? সব ঠিক আছে তো”?
    “হ্যাঁ, হ্যাঁ! এমনি খবর নিচ্ছিলাম। যা ওয়েদার”।
    “সব ঠিক আছে। সন্ধেবেলা চলে আসুন। ফ্রিজে দেখলাম তোপশে মাছ রয়ে গেছে। সঙ্গে ভাল ইম্পোর্টেড স্কচ। চলবে তো”?
    “একদম! ঠিক সন্ধে সাতটায় চলে আসছি”।
    বিতান বোঝে সব স্বাভাবিক হয়ে আসছে। দরজায় বেল বাজে। বিতান খুলে দেখে মধুমিতা দাঁড়িয়ে আছে সৌরসেনীকে নিয়ে। ওদের ক্যাম্পাসে বাইশে শ্রাবণের অনুষ্ঠান করবে বাচ্চারা। তার রিহার্সাল কমিউনিটি হলে। বিল্টুকে ডাকতে এসেছে। আগেই ঠিক ছিল। বিল্টুকে চলে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে বিতান আবার বারান্দায় দাঁড়ায়। সব স্বাভাবিক হয়ে আসছে। প্লাবন এল না তাহলে। সব কিছু আবার মোলায়েম। ইম্পোর্টেড স্কচের মতই। পুরোন অভ্যাসে বিতান আমাজন, ফ্লিপকার্টে ঘুরতে থাকে। একটা মোবাইল কেনা দরকার। নতুন আইফোন লঞ্চ হয়েছে সামন্তক বলছিল। সামন্তক গ্যাজেট ফ্রিক। জামাকাপড়ের মত মোবাইল পালটায়। হঠাৎ নজরে পড়ে যায় জিনিষটা। বড়, বড় শহরের জল জমার কথা মাথায় রেখে বের করেছে – পোর্টেবল ভেলা। দরকার হলে ফুলিয়ে নেওয়া যাবে, নইলে ভাঁজ করে ছোট্ট বাক্সে রেখে দেওয়া যাবে। সঙ্গে দুটো ফোল্ডেবল দাঁড়। নামটা বেশ মজার নোয়াস আর্ক। বিতান একটা কিনে রাখবে ভাবে। প্লাবন আসবেই। বিতান জানে।
     
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৩০৬ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
    আরও পড়ুন
    বটগাছ - Anirban M
    আরও পড়ুন
    লাইক-ইট - Anirban M
    আরও পড়ুন
    বর্ম - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুদক্ষিণা গুপ্ত | 42.110.152.229 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৫:১৪497677
  • খুব ভাল লাগল। কল্পনাশক্তি ও তার প্রকাশের ভাষা দুটিই ভারী সুন্দর। 
  • Ramit Chatterjee | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৮:৫২497681
  • এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। অসম্ভব ভালো হয়েছে। একদম স্লাইস অফ লাইফ। আর শেষটাও সুন্দর।
  • Dipankar Banerjee | 2402:3a80:a8c:c3e:8f64:5229:3f40:6311 | ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ ২২:১০497694
  • দারুণ পাঠসুখকর  
  • Ranjan Roy | ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৫:৩৮497774
  • আগের লেখাগুলোর মতই, দক্ষ হাতের লেখা। লেখকের এরকম এক ডজন গল্প নিয়ে একটা চটি সংকলন বেরোতে পারে। অ্যাডমিনদের কাছে দাবি জানালাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন