এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  গপ্পো

  • লাইক-ইট

    Anirban M লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ২২ মার্চ ২০২২ | ১৭৪২ বার পঠিত | রেটিং ৪.৫ (৪ জন)
  • # #
    সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে অমলবাবু বুঝলেন মনটা বেশ ফুরফুরে লাগছে। আসলে এটা কাল  রাতের রেশ। রাত তখন প্রায় বারোটা। হাই উঠে গেছে গোটা পাঁচেক, ঘুম ঘুম পাচ্ছে। এমন সময় এল। কবিতার লাইন। কবিতা যারা লেখেন তাঁরা জানেন, কবিতা খুব মারাত্মক জিনিস। একবার এলে, যতক্ষণ না লিখে ফেলা হচ্ছে, পেটের ভেতরটা গুড়গুড় করে, মন আনচান। লিখে ফেললে তবে শান্তি। অমলবাবুও দেরি করেন নি। স্ত্রী সুরমা ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছেন। চট করে কবিতাটা লিখে ফেলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে ফেসবুকে পোস্ট। কিন্তু কটা লাইক পড়ল সেটা দেখার জন্য বেশিক্ষণ জেগে থাকতে পারেন নি অমলবাবু। ঘুমে চোখ জড়িয়ে এসেছিল। কটা লাইক পড়ল সেটা দেখার জন্য আজ একটু তাড়াতাড়িই ঘুম থেকে উঠে পড়েছেন। অমলবাবু বায়বীয় কবিতা পছন্দ করেন না। তাঁর কবিতা সবই কোন না কোন সাম্প্রতিক ঘটনা অথবা মহাপুরুষদের জন্ম-মৃত্যু নিয়ে। যেমন কাল রাতে লিখেছিলেন ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ নিয়ে। বলতে নেই অসাধারণই লিখেছিলেন। বিশেষ করে শেষ দুটো লাইন  -- “চোখের বদলে চোখ নিলে সবাই হবে অন্ধ/বাঁচবে সবাই, আসবে শান্তি করলে যুদ্ধ বন্ধ”  -- ভেবে এই সকালবেলাও গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। খাট থেকে নেমে অমলবাবু হাতড়ে হাতড়ে মোবাইলটা খুঁজে বের করে বসার ঘরে এসে বসলেন। এখন সকাল পাঁচটা। সুরমা উঠতে উঠতে আরও এক ঘন্টা। ছেলে বিলু এখন চাকরি জয়েন করেছে বলে সকালে ওঠে। তবে সেও সাতটার আগে নয়। মোবাইলটা হাতে নিয়ে অমলবাবু বেশ একটা উত্তেজনা বোধ করলে্ন, রেজাল্ট বেরোনর আগের মুহূর্তের মত। তাড়াতাড়ি ফেসবুক খুলে নিজের পোস্ট করা স্ট্যাটাসে গেলেন। আর গিয়েই মনটা খারাপ হয়ে গেল। মাত্র তেরটা লাইক আর তিনটে কমেন্ট! তিনটে কমেন্ট এর একটা রমণীমোহন চাকলাদেরের। ইনি সব পোস্টেই একটাই কমেন্ট লেখেন। কমেন্টও ঠিক না, স্টিকার। একটা চে গেভারার ছবি আর তলায় লেখা ভিভা কিউবা। অন্য কেউ হলে হয়ত, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সঙ্গে আমেরিকা-কিউবার মিল টেনে এর তাৎপর্য ভাবতে বসত। কিন্তু অমলবাবু জানেন রমণীমোহনের ভাবের বর্ণমালায় এই একটি স্টিকারই আছে। অমলবাবু ভ্যালেন্টাইন ডে নিয়ে যে কবিতা লিখেছিলেন তাতেও উনি একই স্টিকার পোস্ট করেছিলেন। তার আগে বড়দিন, তারও আগে বিদ্যাসাগরের জন্মদিন। তার পরের কমেন্ট ঘনাদার। মানে এমন একজনের যার নাম ঘনশ্যাম দাস আর প্রোফাইলে ঘনাদার ছবি। সে কেয়াবাত! লিখে একুশটি গোলাপের ছবি দিয়েছে। তৃতীয় কমেন্ট বুল্টির। অমলবাবুর দিদির মেয়ে। সে লিখেছে, দারুণ হয়েছে মামা! চালিয়ে যাও। কমেন্টে তেমন কিছু না পেয়ে লাইক দেখতে শুরু করলেন। তেরজনের মধ্যে তাঁর অফিসের কিছু বন্ধু আছে, দুতিনজন ফেসবুকের বন্ধু আর বাকি কিছু আত্মীয়স্বজন যাদের বয়স সত্তরের ওপর। ফেসবুকে প্রায় চারশ’র ওপর বন্ধু তাঁর আর লাইক কিনা মোটে ১৩! কিন্তু এত কম লাইক কোনবার হয় না। হাজার না হোক, শ-দুই লাইক উনি পেয়েই থাকেন। এই তো কিছুদিন আগে যে ভাষাদিবস নিয়ে যেটা লিখেছিলেন। সেটাতেই তো প্রায় দেড়শ লাইক। আর এই কবিতাতে কিনা মাত্র তের। এমনকি তার ছোটবেলার বন্ধু সুবিমল পর্যন্ত লাইক দেন নি। অথচ গত পরশুই উনি সুবিমলের নাতির জন্য কিনে আনা ইম্পোর্টেড ন্যাপির ছবিতে লাইক দিয়েছেন। সব বেইমান! এই সব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে প্রায় সাড়ে ছটা বেজে গেল। সুরমা চা বানিয়ে দিয়ে গেছে। এমন সময় ছেলে বিলু চোখ মুছতে মুছতে ব্রাশে পেস্ট লাগালো বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে। তাকে দেখে অমলবাবুর মাথাটা আরো গরম হয়ে গেল। অন্য লোকের কথা ভেবে আর কী হবে? নিজের ছেলে যে কিনা দিনের মধ্যে সাড়ে তেরো ঘন্টা ফেসবুকে থাকে, সে কি পড়ে দেখে তার বাবার লেখা? ছোট থাকতে তাও ধরে করে কয়েকবার শুনিয়েছেন। কিন্তু এখন তো শ্রীমানকে বাড়িতেই দেখতে পাওয়া যায় না। যতক্ষণ থাকে, তখনও ঘরের দরজা বন্ধ, সারাদিনই নাকি ভিডিও কলে মিটিং চলছে! যত্ত সব!
    # #
         অফিসে এসেও মুখটা বেজার করে বসেছিলেন অমলবাবু। সেটা অবশ্য নতুন কিছু না। রিটায়ারমেন্টের আর বছরখানেক বাকি। অনেক বছর চাকরি হয়ে গেল অমলবাবুর। সেই কোন কালে সরকারি চাকরির পরীক্ষা দিয়ে ঢুকেছিলেন, তার পর বহু বছর হয়ে গেল। আর কাজ করতে ভাল লাগে না। কবে রিটায়ার করবেন সেদিকেই তাকিয়ে আছেন। রিটায়ার করলে লেখালিখিটা আরেকটু জমিয়ে করবেন ভেবে রেখেছেন অনেকদিন ধরে। তবে আজ বোধহয় তেরটা লাইকের ধাক্কায় মুখ একটু বেশিই বেজার। পাশের টেবিলের সুশান্ত ঘরে ঢুকেই বলল,
    -“কী ব্যাপার বস? মুড অফ? সম্পত্তির গোলযোগ? প্রেমে ব্যর্থ?
    “কেন? তুই কী করবি?” পাশের টেবিল থেকে ফুট কাটে প্রবীর।
    “জাপানী বশীকরণ! ইউটিউব দেখে শিখেছি। একদম শিওর শট সমাধান”।
    “সেকীরে? তেল জানতাম, বশীকরণও আছে?”
    “বাছা হোরেশিও, স্বর্গ, মর্ত্য আর ইউটিউবে কত কী আছে তা তোমার কল্পনারও অতীত!”
    “তা তো বুঝলাম। কিন্তু অমলদা’র প্রবলেম কী? প্রেম ঘটিত কেস নয়তো?” প্রবীর হাসিমুখে চোখ মারে। অমলবাবুর থেকে প্রবীর, সুশান্ত বয়সে অনেকটাই ছোট। তবে ছেলেদুটো বেশ হেল্পফুল। তাই ওদের ফক্কুরি বিশেষ গায়ে মাখেন না অমলবাবু। সুশান্ত এবার পাশে বসে গলা নামিয়ে বলে, “ সিরিয়াস কিছু নাকি অমলদা?” একটু কিন্তু কিন্তু করে অমলবাবু বলেই ফেলেন, “আমি আসলে মাঝে মাঝে একটু কবিতা লিখি”। কথা শেষ না হতেই সুশান্তর মুখে একগাল হাসি, “আরে দাদা! ফাটিয়ে দিয়েছেন তো! কনগ্র্যাটস! তা কবিরা শুনেছি মাঝে মাঝে মনখারাপ করে বসে থাকে। যুগযন্ত্রণা আর কি! তা আপনার কি সেরকম ব্যাপার নাকি?” কথাটায় মনে হয় যেন একটু হালকা চিমটি ছিল। কিন্তু অমলবাবুর এখন সেসব ভাবার সময় নেই। তিনি বলে চলেন, “আসলে আমি তো ফেসবুকেই লিখি, বুঝলে তো? আগে মোটামুটি লোকে লাইক টাইক দিত। তবে ইদানিং দেখছি তেমন লাইক টাইক আর আসছে না”। অমলবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। সুশান্ত ভুরু কুঁচকে একটু ভাবতে থাকে। তারপর জিজ্ঞেস করে “ তা, আগে আপনাকে কে লাইক দিত? তারা কি আপনাকে আনফ্রেন্ড করেছে?” অমলবাবু দেখতে পান প্রবীরও খুব মন দিয়ে শুনছে। তিনি বলে চলেন, “আনফ্রেন্ড তো কেউ করে নি। তবে অন্য একটা ব্যাপার হয়ে থাকতে পারে। আসলে আমি ওই “ফেসে-ও-বুকে কবিতা” বলে একটা গ্রুপে কবিতা লিখতাম। আমিও সবাইকে লাইক দিতাম, সবাই আমাকে লাইক দিত। এই করে দেড়-দুশ লাইক হয়েই যেত। তারপর শুরু হল ইউক্রেন যুদ্ধ। তাই নিয়ে গ্রুপের মধ্যেই বেজায় তর্কাতর্কি -- রাশিয়া ঠিক না ইউক্রেন ঠিক এই নিয়ে। আমার এমনিও এই নিয়ে খুব একটা মতামত নেই। কিন্তু সেদিন হয়েছিল কি বিকেল বেলা লোভে পড়ে দুটো সিঙ্গারা খেয়ে নিয়েছিলাম । ব্যাস! সঙ্গে সঙ্গে বেজায় গ্যাস, অম্বল। চারটে জেলুসিল, দু প্যাকেট ইনো খেয়ে আর রাতে উপোস দিয়ে তারপর সুস্থ হলাম। কিন্তু এই ঝামেলায় সেদিন আর রাশিয়া-ইউক্রেন নিয়ে মতামত দেওয়া হয় নি। এখন মনে হচ্ছে তারপর থেকে রাশিয়া, ইউক্রেন, আমেরিকা সব দলের লোকই আমাকে বয়কট করেছে। কবিতায় লাইক দিচ্ছে না কেউ”। অমলবাবু চুপ করেন। প্রবীর এতক্ষণ সব শুনছিল। কিন্তু এবার আর থাকতে পারল না। যেকোন অফিসেই একজন পাস না করা ডাক্তার থাকে। এই অফিসে সেটা প্রবীর। সে আর থাকতে না পেরে বলল, “প্যান্টাপ্রাজোল অমলদা, একটা প্যান্টাপ্রাজোল”। অমলবাবু ভেবেছিলেন প্রবীর ইয়ারকি মারছে। কিন্তু প্রবীরের দিকে তাকিয়ে বুঝলেন সে যাকে ইংরিজিতে বলে ডেড-সিরিয়াস।  প্রবীর বলে চলে, “সেদিন একটা প্যান্টাপ্রাজোল যদি খেয়ে নিতেন অমলদা, তাহলে এই কেলেঙ্কারিটাই হত না”। তাঁর সমস্যার মূল কারণ যে আসলে এন্টাসিড বাছাইএর মধ্যে লুকিয়ে আছে সেটা ভেবে অমলবাবু কেমন হতভম্ব হয়ে পড়লেন। সুশান্তই শেষে উদ্ধারকর্তার ভুমিকায় নামল, “ আহ! প্রবীর! বড্ড বাজে বকিস তুই! আপনি বলুন তো অমলদা”। অমলবাবু আবার শুরু করলেন, “এই ব্যাপারটা বুঝলে দিন কয়েক আগেকার। এর মধ্যে আমি দুটো কবিতা লিখেছি। প্রথমে গ্লোবাল ওয়ার্মিং নিয়ে। সেটায় তাও তেইশটা লাইক। পাঁচটা কমেন্ট। কাল লিখলাম ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে। তাতে মোটে তেরটা লাইক”। “হুম”, গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করে সুশান্ত, “তা কোন পক্ষের হয়ে লিখলেন, রুশ না ইউক্রেন”? “না, না, আমার লাইন যুদ্ধ নয় শান্তি চাই। একবার গ্রুপে গিয়ে দেখলাম আর কেউ এই বিষয়ে কবিতা পোস্ট করেছে কিনা। দেখলাম হরিশ চাকলাদার করেছে একটা রাশিয়ার হয়ে, আর অবনী রায় ইউক্রেনের হয়ে। তা রুশপন্থী কবিতায় প্রায় আড়াই হাজার লাইক। তার মধ্যে দু-চারটে রাশিয়ান নামও দেখলাম মনে হল। ইউক্রেন পন্থী কবিতায় প্রায় হাজার দুয়েক। যদিও গ্রুপে মেম্বার দুশ’র বেশী না। তবে পাবলিক পোস্ট। বাইরের লোকেরাও লাইক দিচ্ছে হয়ত। আর কমেন্টের তো বন্যা বইছে। মার-মার কাট-কাট ঝগড়া, বুঝতেই পারছ। একজন দেখলাম রাশিয়ান ভাষায় কীসব লিখেছে! তবে যেহেতু কেউই তার মানে বোঝে নি তাই সে ইউক্রেন পন্থী বা রুশ পন্থী বোঝা যায় নি”। এইবার প্রবীর আবার মুখ খোলে, “ এই তো অমলদা, আপনি এখনও সে জোট নিরপেক্ষতার যুগে পড়ে আছেন। এখন নিয়ম হল কাউকে একটা তেড়ে খিস্তি করুন। তাতে তার পক্ষের লোক আপনাকে তেড়ে খিস্তি করবে ঠিকই, কিন্তু তার বিপক্ষের লোকেরা আপনার পাশে দাঁড়িয়ে যাবে। তারপর তারা নিজেদের মধ্যে লড়ে যাবে, আর আপনার পোস্টের লাইক-কমেন্ট বাড়তে থাকবে। চাই কি সেই পোস্ট ভাইরালও যেতে পারেন”।
      শুনে অমলবাবুর মুখ আরো বেজার হয়ে যায়। সত্যি বলতে কী অমলবাবু এত ভেবে ঠিক লেখেন নি। ঘুম এবং আরো অনেক কিছুর মত কবিতাও তাঁর পায় আর পেলেই তিনি লিখে ফেলেন। তবে হ্যাঁ, লাইক পেতে আর কার না ভাল লাগে? তাই তেরটা লাইক তাঁকে বেজায় মর্মাহত করেছে। সুশান্ত অবশ্য করিৎকর্মা ছেলে, বসে বসে হাহুতাশ করা তার ধাতে নেই। সে সব শুনে টুনে আশ্বস্ত করে অমলবাবুকে, “কোন চিন্তা নেই অমলদা। এই অফিসে অন্তত দু-তিনশ লোক কাজ করে। সিকিউরিটির ছেলেপিলে ধরলে আরো জনা কুড়ি। এদের প্রায় সবার ফেসবুক আছে। এদের দিয়ে লাইক দেওয়ালে অন্ততঃ শ-তিনেক লাইক তো হবেই”। “এরা সবাই লাইক দেবে আমার কবিতায়? এরা কি কবিতা পড়ে?” “আহ! অমলদা! আপনি সেই ব্যাকডেটেড রয়ে গেলেন। কবিতা পড়ার সঙ্গে লাইক দেওয়ার কী সম্পর্ক? আপনি চিন্তা করবেন না। এখন কয়েকটা কাজ আছে। আজ লাঞ্চের সময় ব্যবস্থা করছি”। অমলবাবু খুব একটা আশ্বস্ত হতে পারেন না। তবু খানিকটা বিমর্ষ হয়েই ফাইল খোলেন।
     # #
      লাঞ্চ শুরু হয়েছে প্রায় আধ-ঘন্টা আগে আর শুরু হতেই সুশান্ত বেরিয়ে গেছে প্রবীরকে নিয়ে। অমলবাবু টেনশন নিয়েই বসে ছিলেন। কিন্তু ডাক্তার তাঁকে খালি পেটে টেনশন করতে বারণ করেছেন। তাই টিফিন বাক্স খুলে বসলেন আর টিফিন দেখে বেজার মুখটা আরো বেজার হয়ে গেল। রুটি আর পেঁপের তরকারি। পেঁপে তিনি দুচক্ষে দেখতে পারেন না। কিন্তু দিন চারেক আগে পেঁপের উপকারিতা নিয়ে কি একটা লেখা বেড়িয়েছে আনন্দবাজারে। তারপর থেকে সুরমা রোজ পেঁপের তরকারি দিচ্ছে টিফিনে। বেজার মুখে তাই চিবোচ্ছিলেন অমলবাবু। এমন সময় ঝড়ের বেগে ঘরে ঢুকলো সুশান্ত আর প্রবীর। সুশান্ত বলল, “অমলদা, প্রশান্ত আর অখিলদা’র সাথে কথা বলে এলাম”। অমলবাবুদের অফিসে দুটি কর্মচারী ইউনিয়ন। প্রশান্ত আর অখিল সেই দুই সংগঠনের নেতা। অমলবাবু সাতে-পাঁচে থাকেন না। তাই দুজনের সঙ্গেই তাঁর সুসম্পর্ক। “দুজনেই খুব দুঃখ করল আপনার কবিতায় মাত্র তেরটা লাইক শুনে। তবে সংগঠনগত ভাবে কবিতায় লাইক দেওয়া যাবে কিনা সেই নিয়ে কেউ শিওর নয়। দু-দলেরই ওপরের তলার মিটিং চলছে তারা রুশ পন্থী না ইউক্রেন পন্থী সেটা ঠিক করার জন্য। তার আগে কিছু হবে না। তবে আমি বললাম যে আপনার কোন লাইন নেই, জাস্ট শান্তি। তা অখিলদা বলল লাইন না থাকাও একধরণের লাইন। আমাকে জিজ্ঞেস করছিল আপনার কবিতায় ন্যাটো নিয়ে কিছু আছে? বা সিরিয়া বা লেবানন যুদ্ধের সময় কিছু লিখেছিলেন কিনা? সার্জিক্যাল স্ট্রাইক নিয়ে কিছু? আমি তো বলতে পারলাম না”। অমল বাবু বললেন, “ না, না ন্যাটো নিয়ে তো কিছু নেই। তবে সিরিয়া যুদ্ধ কবে হয়েছে সুশান্ত? মনে হয় তখন কবিতা লিখতাম না। আর সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের সময় তো তুমি জানো আমার হাত ভেঙ্গেছিল। তাই কিছু লিখি নি”। “এইটা একটু গন্ডগোল হয় গেছে অমলদা। কবিতা লিখতে হাত কেন লাগবে আজকের দিনে? ফোনে বলে দিলেই লেখা হয়ে যেত। যাই হোক, আপনি চিন্তা করবেন না। আমার আর প্রবীরের বন্ধু তো কম নেই অফিসে। তাদের দিয়ে ধরে ধরে লাইক দেওয়াব। ৫০ টা তো গ্যারান্টীড। সিকিউরিটির তিনটে বিহারি ছেলে আছে না? আসার সময় ওদের দিয়ে লাইক করালাম। আর আমার আর প্রবীরের লাইক তো আপনি পেয়েই গেছেন। আমার বউও করে দিয়েছে বলল। তবে প্রবীরের গার্লফ্রেন্ড একটু গোলমাল করছে। সে আবার পাবজি চ্যাম্পিয়ন। আপনার শান্তির লাইন তার পছন্দ নয়। তবে প্রবীর কথা বলছে। উইক-এন্ডে কনফার্ম করছি”। এই অবধি বলে প্রবীর আর সুশান্ত লাঞ্চ খেতে চলে গেল। অমলবাবু ফেসবুক খুলে দেখলেন লাইক বেড়ে আঠারো হয়েছে। মানে পাঁচটা বেড়েছে – প্রবীর, সুশান্ত, আর সিকিউরিটির তিনটি ছেলে। সুশান্ত’র বউ লাইক দেয় নি। অমলবাবু দীর্ঘশ্বাস ফেলে পেঁপে ঘন্টতে মন দেন।  
    # #
          সেদিন একটু বেশি রাতে অমলবাবু ফোন নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলেন, এমন সময় সুশান্ত’র ফোন এল।
    -“অমলদা?”
    -“হ্যাঁ, বল।“
    -“দেখুন, আমি ভেবে দেখলাম পলিটিক্যাল নেটওয়ার্ক যখন কাজ করল না, তখন ফ্যামিলি নেটওয়ার্ক ধরতে হবে। আপনি ঝটপট একটা ফ্যামিলি ট্রী বানিয়ে ফেলুন। সেখানে দশটা নোডকে অ্যাপ্রোচ করুন”।
    - “নোড?”
    - “ফ্যামিলি নেটওয়ার্কে নোড মানে আপনার আত্মীয়স্বজন! তারপর আমাদের পিরামিড স্কিমের মত এগোতে হবে। মানে এই দশজন আবার আরো দশজনকে ধরবে এরকম আর কি! আপনি আগে ফ্যামিলি ট্রী বানিয়ে ফেলুন। রাখছি”।
        ফোন রেখে অমলবাবু খাতা কলম নিয়ে বসে গেলেন। কিন্তু ফ্যামিলি ট্রী বানাতে বসে বুঝলেন তাঁর ফ্যামিলির এই প্রজন্মের খবর তিনি রাখেন না। নিজের কাকা-মামা, ভাই-বোনদের খবর তিনি যাও বা জানেন কিন্তু তাদের ছেলে-মেয়েদের কথা কিছু রাখেন না। মানে কার কটা ছেলে মেয়ে বা আদৌ বিয়ে করেছে কিনা, অমলবাবু কিছুই জানেন না।  কাকা-মামারাও হয়ত অনেকে গত হয়েছে। অন্তত বয়স অনুযায়ী তাই হওয়ার কথা। কিন্তু সেই খবরও অমলবাবু ঠিকঠাক জানেন না। প্রথমেই বড়মামার ছেলে, বিল্টুদা কে ফোন করলেন অমল। বিল্টুদা ফেসবুকে আছে। কিন্তু কখনও কিছু পোস্ট করতে দেখেন নি অমলবাবু। বিল্টুদা কবিতা লিখতেন এককালে। তাই কবিতা নিয়ে একটা আলোচনা এগিয়ে তারপর লাইকের ব্যাপারে আসবেন – এরকমই একটা প্ল্যান। বহুদিন পরে ফোন। তাই ফোন করেই এসব বলা ঠিক হবে কিনা এই নিয়ে অমলবাবুর একটু দ্বিধা ছিল। কিন্তু কোন প্ল্যানই কাজ করল না। বিল্টুদার শরীর খারাপ, ফোন ধরার অবস্থায় নেই। কথা হল ছেলের সঙ্গে। কিন্তু তাকে আর এসব কথা বলে উঠতে পারলেন না। নেক্সট ফোন টুম্পাদিকে। টুম্পাদি অমলবাবুর মেজোপিসির মেয়ে। বয়সে অমলবাবুর থেকে একটু বড়ই হবেন, তবে তাঁরা পরস্পরকে তুই-তোকারি করেন। আর টুম্পাদি বেজায় ফুর্তিবাজ। সবথেকে বড় কথা উনি ফেসবুকেও খুব অ্যাক্টিভ। টুম্পাদি ফোন ধরেই বেজায় খুশী। একথা সেকথার পর একটু সলজ্জ ভাবেই অমলবাবু ফেসবুকে লাইক দেওয়ার কথা পাড়লেন। টুম্পাদি এককথায় রাজি। বললেন উনি তো দেবেনই, ও্নার নাকি পাড়ায় দশ-বারো জনের মর্নিং-ওয়াকের একটা গ্রুপ আছে -- তাদেরও দেওয়াবেন। টুম্পাদির সঙ্গে কথা বলতে বলতেই ফোন নি্ল ওনার ছেলে বাবাই। বাবাই কোন মিডিয়া হাউসের বড়কর্তা। বাবাই ফোন নিয়ে বলল, “ফুচু মামা, তোমার প্রবলেমটা শুনলাম। তবে দেখ, এরকম আত্মীয় স্বজনের মধ্যে ফোন করে করে তুমি কটা লাইক পাবে? তার থেকে নামকরা কেউ যদি তোমার লেখা শেয়ার আর লাইক করে দেয় তাহলে তার ভক্তরাও তোমাকে লাইক দেবে”। এই প্রস্তাবে অমলবাবু অবাক হন। বলেন, “সে তো ভালো কথা। কিন্তু সেরকম কাউকে তো আমি চিনি না। তাঁরা আমার লেখা শেয়ার করবেন কেন?” অমলবাবু জিজ্ঞেস করেন। “ওহ! ফুচুমামা! তুমি কোন যুগে পড়ে আছো! নামকরা লোকেরা এরকম করেই থাকেন। তবে কিছু খরচা আছে। মানে ব্যাপারটা বিজ্ঞাপন দেওয়ার মতই। কিন্তু লোকে বুঝতে পারবে না যে সেটা বিজ্ঞাপন। তুমি টাকা দিয়ে শেয়ার করাবে, কিন্তু লোকে ভাববে তোমার লেখা ভাল লেগেছে বলে শেয়ার করছে। প্লেন এন্ড সিম্পল!” অমলবাবু প্রায়ই দেখেছেন নামকরা লোকেরা বিভিন্ন জিনিস শেয়ার করেন। কিন্তু এই সম্ভাবনাটা তাঁর মাথায় আসে নি। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কে করবে এরকম? আর খরচ কত?” “করে তো অনেকেই, কিন্তু তোমার জন্য কোন কবি করলেই ভাল হবে”। কবি পরীক্ষিৎ কুন্ডুর নাম জানো তো? উনি করেন আমি জানি। রেটটা আমি একটু খোঁজ নিয়ে জানাচ্ছি”। অমলবাবু ফোন রেখে খানিকক্ষণ চুপ করে বসে থাকেন। আজকাল সময় কত পালটে গেছে তার কোন খবরই যে উনি রাখেন না বোঝা গেল। ঘন্টাখানেক পরে বাবাই-এর ফোন এল। বাবাই বলল, “ফুচুমামা, আমি কথা বলেছি। আগে পরীক্ষিৎ-দা সেনটেন্স পিছু টাকা নিতেন তাতে লোকে পুরো কবিতাই একটা সেনটেন্সে লিখত। তখন উনি শব্দ পিছু টাকা নেওয়া শুরু করলেন তাতে লোকে দু-তিনটে শব্দ জুড়ে জুড়ে একটা শব্দ বানাত। তাই এখন উনি অক্ষর পিছু টাকা নেন। পার লেটার কুড়িটাকা। যুক্তাক্ষর হলে তিরিশ। তবে তুমি আমার মামা বলে টোটাল বিলে টেন পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দেবেন বলেছেন। তোমার কবিতায় কতগুলো অক্ষর হবে ফুচুমামা?” অমলবাবু জানেন না। বললেন গুনে দেখে পরে জানাচ্ছেন। ফোন রেখে গুনে দেখলেন সব মিলে প্রায় দুশ’ অক্ষর আবার তার মধ্যে কিছু যুক্তাক্ষর। তার মানে প্রায় হাজার পাঁচেক টাকার ধাক্কা। পাঁচ হাজার টাকা অনেক টাকা। কিছুটা মন খারাপ করেই অমলবাবু ঘুমিয়ে পড়লেন।
    # #
        পরের দিন অফিসে গিয়েও মুখ বেজার করেই বসে রইলেন অমলবাবু। প্রবীর-সুশান্তর অনেক চেষ্টাতে লাইক অবশেষে পঞ্চাশের গন্ডি ছাড়িয়েছে। এর মধ্যে অবশ্য টুম্পাদির মর্নিং-ওয়াকের গ্রুপেরও কিছু লাইক আছে। বাবাইও একটা লাইক দিয়েছে দেখলেন। ওদিকে হরিশ আর অবনীর কবিতায় লাইক পাঁচ হাজারের গন্ডি ছাড়িয়েছে। দুজনের লেখার তলায় রুশ আর ইউক্রেনপন্থীদের বাকযুদ্ধ অব্যাহত। কিছুটা অন্যমনস্ক ভাবেই দিনের কাজ শেষ করে অমলবাবু যখন অফিস ছাড়ছেন তখন প্রায় পাঁচটা। একতলায় আসতেই মুখোমুখি পড়ে গেলেন অনিমেষের। অনিমেষ ওনাদের অফিসে কম্পিউটার সংক্রান্ত কিছু একটা করে, এটা অমলবাবু জানেন। আলাদা ডিপার্টমেন্ট। তবে দেখা হলে হাই-হ্যালো হয়। প্রথমে অনিমেষই কথা শুরু করে, “অমলদা, সব ভালো তো?” “হ্যাঁ ভাই, এই চলছে”। অমলবাবু সংক্ষেপে উত্তর দিয়ে পাশ কাটাতে চান। এরপর অমলবাবুকে অবাক করে দিয়ে অনিমেষ জিজ্ঞেস করে, “আপনার নাকি কোন ফেসবুক পোস্টে লাইক আসছে না তেমন?”। অমলবাবু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেন, “তুমি জানলে কী করে? সুশান্ত বলেছে?” অনিমেষ উত্তর দেয়, “না, না, আমি অন্য জায়গা থেকে শুনলাম। কিন্তু ব্যাপারটা ঠিক কী হয়েছে? অমলবাবু পুরো গল্পটা বলেন। সব শুনে টুনে অনিমেষ বলে, “আপনি যে স্ট্র্যাটেজিতে যাচ্ছেন সেসব এখন বাতিল হয়ে গেছে। এখন এসব লাইক, কমেন্টের জন্য বট পাওয়া যায়”। “বট? মানে বটগাছ? তারা ফেসবুকে লাইক দেয়?” অমলবাবুর মুখ প্রবল বিস্ময়ে হাঁ হয়ে থাকে! অনিমেষ জোরে হেসে ওঠে, “আরে না, না। বট হল রোবটের সংক্ষিপ্ত ফর্ম। আসলে একধরণের সফটওয়ার। সেটা আপনার ফোনে থাকলে সে নিজে নিজেই বিভিন্ন প্রোফাইল থেকে আপনার লেখায় লাইক দেবে। আবার আপনার প্রোফাইল থেকেও অন্য লোকের প্রোফাইলে লাইক পড়বে। আপনি জানতেও পারবেন না। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স ওয়ালা বটও আছে, যারা লাগসই কমেন্টও জুড়ে দিতে পারে। যেমন, দাদা দারুণ হয়েছে বা চালিয়ে যান।  বা সিম্পল ইমোজি। আবার তেমন তেমন বট হলে আপনার কবিতার একটা কমপ্লিট অ্যানালিসিসও নামিয়ে দিতে পারে”। “তা ভাই, এসবে খরচ কীরকম?” অমলবাবু জানতে চান। অনিমেষ বলে চলে, “দেখুন, এমনিতে সেলেবরা যেসব ব্যবহার করে সেসব তো অনেক দামী। পাওয়াও কঠিন। এসব তো আর প্লেস্টোরে পাওয়া যায় না! তাহলে তো সবাই সেলেব হয়ে যেত। এসব অ্যাপ গোপনে ডেভেলপ হয় আর কেনাবেচা হয়। আমার কাছে একটা নতুন অ্যাপের বেটা ভার্সান এসেছে। সেইটা দিতে পারি। সমুদ্দুর রায়চৌধুরির নাম জানেন তো? আন্ডারগ্রাউন্ড ঢাকি?” “আন্ডারগ্রাউন্ড ঢাকি? সে আবার কী ব্যাপার ভাই?” অনিমেষকে বাধা দিয়ে জিজ্ঞেস করে ওঠেন অমলবাবু। অনিমেষ যেন অমলবাবুর এহেন অজ্ঞতায় কিছুটা বিরক্তই হয়। সে বলে, “উনি শুধু আন্ডারগ্রাউন্ড পার্কিং লট আর বেসমেন্টে ঢাক বাজান। বিদেশে ওনার খুব কদর। ওনাকে নেওয়ার জন্য আমেরিকার অনেক পূজোই এখন বেসমেন্টে হচ্ছে।  আড়াই লাখ ফলোয়ার। শুনেছি উনিও এই অ্যাপ ব্যবহার করেন”। “কী নাম এই অ্যাপের?” অমলবাবু কৌতুহল প্রকাশ না করে পারেন না। “লাইক-ইট”, অনিমেষ জানায়, “আমি অনেক কষ্টে একটা ডাউনলোড লিঙ্ক জোগাড় করেছি আমার ইউটিউব চ্যানেলের জন্য। এখনও ফোনে লাগাই নি। আপনাকেও দেব তাহলে”। “এর খরচ কত অনিমেষ?” অমলবাবু জানতে চান। “আমি দুহাজার দিয়ে কিনেছি। আপনি না হয় আমাকে হাজার টাকা দেবেন”। অমলবাবু রাজি হন। মাত্র এক হাজার! ঠিক হল বাড়ি গিয়ে অনিমেষ অমলবাবু কে ডাউনলোড লিঙ্কটা হোয়াটসঅ্যাপ করে দেবে। বাড়ি ফিরে অমলবাবু অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন। মোবাইল দেখতে থাকেন প্রতি পাঁচ মিনিটে। শেষ পর্যন্ত লিঙ্কটা এলো আরেকটু বেশি রাতের দিকে। অমলবাবু খুব সহজেই ইনস্টল করতে পারলেন। করার মিনিট পনের পর একবার ফেসবুকে ঢুকে দেখলেন তাঁর কবিতায় লাইকের সংখ্যা একশ ছাড়িয়ে গেছেন। অমলবাবু ফোন থেকে অনিমেষকে হাজার টাকা পাঠিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়লেন।
     # #
        পরের দিন ভোরবেলা অমলবাবুর ঘুম ভাঙল মোবাইল ফোনের ঝনঝনানিতে। ঘুম চোখে ফোন তুলে দেখলেন অন্যদিকে অনিমেষ। ফোন ধরতেই অনিমেষ আর্ত গলায় বলে উঠল, “দাদা, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আপনাকে যে অ্যাপটা দিলাম সেটা আসলে একধরণের ভাইরাস। আমার ব্যাঙ্ক আক্যাউন্ট খালি করে দিয়েছে। আপনি কী ইনস্টল করেছেন? না করে থাকলে করবেন না”। শুনেই ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল অমলবাবুর। তাড়াতাড়ি মেসেজ দেখলেন। প্রায় পাঁচটা মেসেজ ঢুকেছে কাল রাত থেকে যারা জানাচ্ছে যে কাল রাতের কয়েক ঘন্টায় তাঁর অ্যাকাউন্ট খালি হয়ে গেছে। প্রায় লাখ দুয়েক টাকা ছিল। সব শেষ। তাড়াতাড়ি স্ত্রী আর ছেলেকে ডাকলেন। খুব কিছু করার নেই আর। তবু ছেলেকে নিয়ে চললেন লালবাজার সাইবার সেলে অভিযোগ জানানোর জন্য। অনিমেষকেও বললেন লালবাজারে চলে আসার জন্য। যাওয়ার আগে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেন, “আজ সর্বস্বান্ত হলাম”।
    # #
       লালবাজার পৌঁছতে পৌঁছতে অমলবাবুর প্রায় নটা বাজল। অনিমেষ এসেছে তারও মিনিট পনের আগে। অভিযোগ জানানোর জন্য কথা হল যে অফিসারের সঙ্গে তাঁর নাম মিস্টার সরকার। তিনি সহানুভুতি জানিয়ে বললেন, “ কেন যে আপনারা এইসব ভুল করেন? কি নাম ছিল অ্যাপটার? লাইক-স্টার?” উত্তরে অনিমেষই মুখ খোলে, “ না তো! লাইক-ইট”। সরকারকে একটু চিন্তিতই দেখায়। তিনি বলেন, “তাহলে বোধহয় অনেক এরকম অ্যাপ বাজারে এসেছে। গতমাসে একই কায়দায় রঞ্জাবতী সেনের অ্যাকাউন্ট ফাঁকা হয়েছে। সেই অ্যাপটার নাম ছিল লাইক-স্টার। রঞ্জাবতী সেনকে চেনেন তো? বেণিমাধবের বিয়ে সিরিয়ালের নায়িকা”। অনিমেষ টিভি দেখেন না, কিন্তু অমলবাবু দেখেন। তাই রঞ্জাবতীকেও চেনেন। তিনি অবাক হয়েই বলে ওঠেন, “ কিন্তু এত নামকরা লোক এই ফ্রডের শিকার হল, কোন খবরের কাগজে তো বেরোয় নি”। মিস্টার সরকার বুঝিয়ে বলেন, “আসলে এই ধরণের অ্যাপ সত্যি আছে যা ফলোয়ার, লাইক সব তৈরি করে দিতে পারে। জালিয়াতরা সেই বাজারে তাদের জালিয়াতির অ্যাপ ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু এই জালিয়াতির খবর বাইরে বেরোলে এটাও লোকে জেনে যাবে যে এই সব সেলেবদের জনপ্রিয়তা অ্যাপের অবদান। সেটা আবার স্টার, প্রোডিউসার কারো জন্যই ভালো নয়। তাই সবার মুখ বন্ধ। বোঝেন তো, সবই হিসেব নিকেশের ব্যাপার। যাই হোক আমরা চেষ্টা করব আপনার টাকা উদ্ধারের। তবে কাজটা কঠিন। খুব একটা আশা দিতে পারছি না। আপনারা ফোন থেকে ওই অ্যাপটা ডিলিট করে ফেলুন। এমনি করলে হবে না। ফোনকে ফ্যাক্টরি রিসেট করুন। সবকিছু মুছে যাবে তাহলে। আর নেটব্যাঙ্কিং-এর পাসওয়ার্ডটা চেঞ্জ করে নিন”।
    # #
       লালবাজার থেকে বেরিয়ে অমলবাবু গাড়িতে উঠলেন। ছেলের গাড়ি। সেই চালায়। টাকা তো গেলই, এখন ফোনের সব মুছে দেওয়া মানে আবার সব কন্ট্যাক্ট, সব অ্যাপ নতুন করে ভরতে হবে। বিলু বলেছে সব করে দেবে। তাহলেও বেশ খানিকটা ঝামেলার ব্যাপার। এইসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে অমলবাবু ফেসবুক খুললেন। তাঁর সেই কবিতায় লাইক দুহাজার ছাড়িয়ে গেছে। তাঁর দেওয়া স্ট্যাটাস ““আজ সর্বস্বান্ত হলাম” -এ লাইক সাড়ে তিনশ। দেখতে দেখতে অমলবাবুর চোখের সামনে আরো পাঁচটা লাইক পড়ল তাঁর সর্বস্বান্ত হওয়ার খবরে। গাড়ি ততক্ষণে ধর্মতলা। অমলবাবু ছেলেকে বললেন, “ব্যাঙ্কে চল আগে। নেট ব্যাঙ্কিং ছেড়ে দিতে হবে”। লাইক-ইট তাঁর ফোনে থাকবে। অমলবাবু মনস্থির করে ফেলেছেন।
     
    (এই গল্পের চরিত্র, ঘটনা, অ্যাপ, মোবাইল, অফিস, রাস্তা ইত্যাদি সব কাল্পনিক। শুধু রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ সত্যি। বাদবাকি যেকোন মিল কাকতালীয়। তাই এই গল্পের বাস্তব-অবাস্তব বিচারে মন না দেওয়াই ভাল।)

     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • গপ্পো | ২২ মার্চ ২০২২ | ১৭৪২ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
    আরও পড়ুন
    বটগাছ - Anirban M
    আরও পড়ুন
    বর্ম - Anirban M
    আরও পড়ুন
    প্লাবন - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ২২ মার্চ ২০২২ ২১:৫৭505195
  • হা হা হা হা ব্যপপক তো। laugh
  • b | 117.194.78.25 | ২২ মার্চ ২০২২ ২২:৩১505198
  • yes
  • সংহিতা | 2409:4061:388:c2ae:a941:2d33:9fb4:fd17 | ২৩ মার্চ ২০২২ ০৮:১৭505233
  • চমৎকার হয়েছে I 
  • Amit | 121.200.237.26 | ২৩ মার্চ ২০২২ ০৮:২৯505234
  • দুর্দান্ত। 
  • kk | 97.91.203.114 | ২৩ মার্চ ২০২২ ০৮:২৯505235
  • এইটা দারুণ লাগলো!!
  • manimoy sengupta | ২৪ মার্চ ২০২২ ১৯:৩০505431
  • ওঃ ! চরম ! না, চরমতম !! 
  • kaktarua | 192.82.150.101 | ২৪ মার্চ ২০২২ ১৯:৪৪505433
  • দারুন!! 
  • Dipankar Banerjee | 223.223.145.175 | ২২ এপ্রিল ২০২২ ২৩:৫৬506818
  • দুর্দান্ত !!!
  • Prabhas Sen | ২৩ এপ্রিল ২০২২ ১৪:২০506844
  • এই গল্পের ' লাইক' হুহু করেই বাড়বে, ওসব বট অশথের দরকার হবেনা। চমৎকার গল্প। আরও চাই। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যুদ্ধ চেয়ে মতামত দিন