এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ভ্রমণ  দেখেছি পথে যেতে

  • হল্যান্ডের গল্প – ৪ (শেষ পর্ব) – দ্য হেগ, রটারড্যাম এবং নটেগাছ

    সুদীপ্ত লেখকের গ্রাহক হোন
    ভ্রমণ | দেখেছি পথে যেতে | ১০ জুন ২০২৩ | ৫৪৩ বার পঠিত
  • ‘Wanderlust’ শব্দটা প্রথম শুনি ক্লাস সিক্স বা সেভেন-এ আগন্তুক সিনেমা থেকে। বলতে অসুবিধে নেই, তার সঠিক অর্থ (আক্ষরিক অর্থটুকু বাদ দিয়ে) বুঝতে অনেক সময় গেছে। হল্যান্ডে এসে ঠিক দুটি সপ্তাহান্ত পাচ্ছিলাম, তবে আপিসের কাজকর্ম বাদ দিয়ে বাকি সময়টুকু এক পল-ও নষ্ট করব না ঠিক করেছিলাম। অ্যানা ফ্র্যাঙ্কের বাড়ি ঘুরে আসার পর মনে হল, সব তো হল, নর্থ সী-কে  তো একবার দেখা হলো না! তার উপর, হল্যান্ড দেশটা যে সমুদ্রতল থেকে সত্যিই অনেক নীচে তা-ই বা চাক্ষুষ হলো কই! হান্সের গল্প তো সেই ছোটোবেলায় কিশলয়ে পড়া, কিন্তু সেই সমুদ্রের তীরের উঁচু বাঁধই (এদেশে বলে ‘ডাইক’) বা দেখা হল কই! কাছাকাছি সমুদ্র দেখতে হলে আছে হল্যান্ডের রাজধানী দ্য হেগ (এখানে ডাচরা বলে ‘দেন হাগ’, নামটা শুনে কি মনে হয়, সে বিশ্লেষণে আর যাবো না), তারপর আপিসেও সহকর্মীরা বলল, রটারড্যাম-ও ঘুরে আসতে পারো। তো ম্যাপ ইত্যাদি দেখে যা বুঝলাম, একটু কষ্ট করলে দুটো শহর-ই একদিনে ঘুরে নেওয়া যায়। তবে মিউজিয়াম ইত্যাদি বাদ দিয়ে , এত সময় পাওয়া যাবে না। সেই হিসেবে একটা প্ল্যান খাড়া করে নিলাম এপ্রিলের আট তারিখ দিন ধার্য করে।

    আট তারিখ সকালে প্রাতঃরাশ সেরে চটপট চলে এলাম এয়ারপোর্টে। ভেবে রেখেছিলাম প্রথমে যাবো দেন হাগ, তারপর সেখান থেকে চলে যাবো রটারড্যাম, পুরোটাই ইন্টারসিটি ট্রেন ধরে। প্রসঙ্গতঃ বলি এখানে প্রতি শহরের একখানি করে সেন্ট্রাল আছে, এই যেমন রটারড্যাম সেন্ট্রাল, দেন হাগ সেন্ট্রাল, অ্যামস্টারড্যাম সেন্ট্রাল, যেগুলো সেই শহরের প্রাণকেন্দ্র, মোটামুটি দর্শনীয় স্থানগুলো এই সেন্ট্রাল স্টেশনগুলোর আশেপাশে। কিন্তু এয়ারপোর্টে পৌঁছে শুনলাম, দেন হাগ-এর লাইনে কিছু কাজ চলছে বলে আজ সরাসরি কোনো ট্রেন স্কিফোল থেকে দেন হাগ যাবে না। সুতরাং ঠিক করলাম রটারড্যাম আগে গিয়ে, সেখান থেকে ইন্টারসিটি পরিবর্তন করে সোজা চলে যাবো দেন হাগ। তারপর ফেরার পথে রটারড্যাম ঘুরে হুফডর্পে ফিরবো। সেইমতো টিকিট কেটে উঠে পড়লাম রটারড্যাম সেন্ট্রাল যাওয়ার ইন্টারসিটিতে।

    ট্রেন ছেড়ে কিছুদূর এগোতেই দুদিকে আমাদের গ্রাম-বাংলার মতোই বিস্তীর্ণ ক্ষেত-খামার আর তার মাঝ বরাবর চলে যাওয়া লম্বা লম্বা ক্যানাল। আজ আবহাওয়া ভালো, রোদ-ও উঠেছে বেশ, কিন্তু খেয়াল করলাম, এই ক্ষেতগুলোর উপর চেপে বসা কুয়াশা, এত রোদেও তাদের সরে যাওয়ার কোনো ইচ্ছে নেই; কুয়াশা এত-ই জমাট যে তার ভিতর একেবারেই দৃষ্টি চলে না। ট্রেন-ও চলছে ভালো গতিতে, ১০০ কিলোমিটার কি তার বেশী। আধঘন্টা পর রটারড্যাম, স্টেশনে ঢোকার আগে থেকেই চারপাশে নানা ধরণের বাড়িঘরের নির্মাণ আর স্থাপত্য দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কোনোটাই ঠিক সাধারণ সোজাসুজিভাবে তৈরী নয়, কিছু বিশেষত্ব আছেই, কোনোটা ডানদিকে হেলানো, কোনোটা বাঁদিকে, কোনোটা একবার ডাঁয়ে, একবার বাঁয়ে ঘোরানো, বাড়িঘরের কত না রঙ্গ!  স্টেশনে নেমে যা হাঁটতে হল, মনে পড়ল হাওড়ার ১৫ নম্বর প্ল্যাটফর্মের কথা, এখনো কি সেটা তেমন-ই আছে? কে জানে! রটারড্যামে প্ল্যাটফর্ম পরিবর্তন করে আবার উঠে পড়লাম দেন হাগ অর্থাৎ দ্য হেগ যাওয়ার ইন্টারসিটি-তে। এটা অবশ্য পনেরো-কুড়ি মিনিট লাগলো।

    দেন হাগে নেমে স্টেশনের বাইরে এসে ম্যাপের সাহায্য নিতে হল। এখান থেকে প্রথমে যাবো পিস প্যালেস (Peace Palace)। কিন্তু দেখলাম পথেই পড়বে প্রথমে হেট প্লেইন, তারপর বিনেনহফ, সেখান থেকে আরও মাইল দেড়েক গেলে পিস প্যালেস। রাস্তায় চলতে চলতে মনে হল, এই শহর এখনো ঘুমিয়ে আছে, ঘড়িতে প্রায় সাড়ে ন’টা, অথচ লোক-জন নেই রাস্তায়, দোকান-বাজার সব-ই বন্ধ, কিছু কিছু ক্যাফে সবে ঝাঁপ তুলতে শুরু করেছে। এখানে বলি, এই হেট প্লেইন জায়গাটা ঠিক আমার প্ল্যানে ছিল না, রাস্তায় চলতে চলতে একদম এর মধ্যে দিয়ে যেতে হল, বুঝলাম, না এলে ভুল করতাম। একটি বিশাল মাপের স্কোয়্যার, পাশ দিয়ে সার ধরে দেশ-বিদেশের খাবারের দোকান, চেয়ার সাজানো রয়েছে, এক পাশে একটা পার্ক আর তার ওপাশে একদিকে মিউজিয়াম, আর একদিকে বিনেনহফের একাংশ। এই পার্কে রয়েছে উইলিয়াম দ্য সাইলেন্ট বা প্রিন্স অফ অরেঞ্জ অর্থাৎ অরেঞ্জ রাজবংশের একজন প্রতিভূ-র মূর্তি। প্রায় আট বছর ধরে স্পেনের রাজার শাসনের বিরুদ্ধে বিপ্লব চালিয়ে ১৬৪৮ সালে ‘ডাচ রিপাবলিক’  প্রতিষ্ঠার পিছনের এঁর অবদান সবচেয়ে বেশী ছিল। ইনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ‘হাউজ অফ নাসাউ’ তে। এতক্ষণে কিউকেনহফের (বা কয়কেনহফ) ‘অরেঞ্জ নাসাউ’-এর রহস্য ফাঁস হল, মানে সেটাও ছিল হল্যান্ডের এক রাজবংশের বা কাউন্ট-বংশের নামেই। পার্ক আর তার আশেপাশের অঞ্চল পুরনো শহরের মধ্যে পড়ে, এখান থেকেই দূরে তাকালে নতুন শহরের  কিছু স্কাই-স্ক্র্যাপার চোখে পড়ে। এই পার্ক থেকে বেরিয়ে একটু এগোতেই বেশ লম্বা একটা লেক। এটি হল হফভাইভার লেক, এর জল একেবারে টলটল করছে তা বলা চলে না, লেকের মাঝে আবার একটা একচিলতে দ্বীপের মত, পাখিদের বেশ জমাটি আড্ডাখানা সেখানে; আমি যে প্রান্তে এসে দাঁড়ালাম, ঠিক তার অপর প্রান্তে লম্বা একটা দুর্গ বা অট্টালিকা-প্রমাণ বাড়ি, আর সেটাই হল বিনেনহফ; এটি একাধারে হল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রীর আপিস, আবার এখানকার স্টেট জেনারেলের আপিস-ও বটে, আবার একে হল্যান্ডের পার্লামেন্ট-ও বলা চলে। এই চতুর্দশ শতকে তৈরী বাড়িটি থুড়ি অট্টালিকাটি পৃথিবীর প্রাচীনতম পার্লামেন্ট-গুলোর একটি আর হল্যান্ডের রাজনৈতিক প্রাণকেন্দ্র। এই সকালবেলায় সেই বিনেনহফের ছায়া এসে পড়েছে হফভাইভার লেকের জলে, অপরূপ দৃশ্য। এই লেকের পাশে একটি ছোটো গাড়িতে দেন হাগ শহর আর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের ম্যাপ রাখা রয়েছে বিনামূল্যে পর্যটক-দের বিতরণ করার জন্যে, একটা তুলে নিয়ে চোখ বুলিয়ে নিলাম। এই লেকের পার ধরে হাঁটতে হাঁটতে দেখি অনেক মানুষজন পশরা সাজিয়ে বসে গেছেন ইতিমধ্যেই, রীতিমত মেলা বসে গেছে! আর রাস্তার ওপারে ইউনাইটেড নেশনস-এর হেড-কোয়ার্টার চোখে পড়ল। পুরো বিনেনহফের চত্বরটা ঘুরে আবার এগিয়ে চললাম। এখানে একটা লেবানিজ ক্যাফে থেকে লাঞ্চ এর জন্যে খান দুয়েক টুনা আর পুলড পর্ক র‍্যাপ প্যাক করে নিয়ে নিলাম ব্যাকপ্যাকে।
     
     দেন হাগ সেন্ট্রাল স্টেশন


    উইলিয়াম, প্রিন্স অফ অরেঞ্জ - হেট প্লেইন-এর একধারে 


    বিনেনহফ আর হফভাইভার লেক


    লেকের মাঝে সেই দ্বীপ 


    রাস্তার মাঝে মাঝে রাজমুকুট,দেখে মনে হয় এগুলো রাতে বাতির কাজ করে 


    উইলিয়ামের যোদ্ধৃবেশ 


    যেতে যেতে রাস্তার বাম-পাশে এল ডাচ-রাজার কাছারি-বাড়ি, এর উল্টোদিকে উইলিয়াম অফ অরেঞ্জ-এর আর একটি ব্রোঞ্জের মূর্তি রয়েছে , ঘোড়সওয়ার সেনাপতির বেশে, হাতে ব্যাটন, কোমরে তলোয়ার।  এই বাড়ির বা ছোট প্রাসাদের সামনের রাস্তায় কিছুদূর অন্তর দুদিকে দড়িতে বেঁধে একটা করে রাজার মুকুট রাস্তার মাঝ-বরাবর ঝোলানো রয়েছে। রাজকীয় ব্যাপার বটে! তবে এখানে দেখলাম দেশের লোকজন তাদের রাজা-রাণীকে বেশ ভালোই বাসে। এ-জিনিস আর এক জায়গায় দেখেছিলাম, ভুটানে। লোক-জন রাজা-রাণী বলতে অজ্ঞান। তবে কোথাও কোথাও প্রতিবাদের চোরাস্রোত-ও আছে বৈকি এই একুশ শতকে দাঁড়িয়ে রাজাদের পারিবারিক সম্পত্তি, খরচ-খরচা এসব নিয়ে।

    এই প্রাসাদ থেকে প্রায় মাইল-খানেক হাঁটার পর বাঁদিক ঘুরেই কিছুদূরে চোখে পড়ল ছবিতে দেখা পিস প্যালেস। এর একপাশে একটি সুউচ্চ টাওয়ার আর তার লাগোয়া বাকিটা প্যালেস। একটা বড় দুর্গ-ই বলা চলে। এখানেই আছে সুবিখ্যাত আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালত (International Court of Justice), কুলভূষণ যাদব-এর মামলার সুবাদে এর কথা এখন আমরা সবাই জেনে গেছি মোটামুটি। এই প্রাসাদের ঘেরাটোপের বাইরে একটি ঘাসের লন ঘিরে পাথরের স্ল্যাবের উপর পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় লিখে রাখা ‘শান্তি’ শব্দটি। হিন্দী দেখলাম, তবে বাংলা দেখতে না পেয়ে নিরাশ হলাম।
     
    পিস প্যালেস 




    এইবার এখান থেকে দিতে হবে একটি যারপরনাই লম্বা হন্টন, যাবো নর্থ সী-কে তার পূর্ব পাড় থেকে দেখতে। পিস প্যালেস থেকে পাক্কা সাড়ে তিন কিলোমিটার হাঁটা। একদম সোজা রাস্তা তার একূল-ওকূল দেখা পাই না কিছুদূর যাওয়ার পর, রাস্তার পাশে সারি দিয়ে নানা রকমের বাড়ি-ঘর। প্রায় জনশূন্য রাস্তা, মাঝে মধ্যে ট্রামের যাওয়া আসা। আর সাইকেল-আরোহীদের ইতি-উতি যাওয়া-আসা। তবে সকালের হিমেল হাওয়া আর ঝকঝকে রোদ মিলিয়ে এই হাঁটা বেশ উপভোগ্য! প্রায় আধঘন্টা আসার পর সেই লম্বা রাস্তা যখন শেষ হল, বুঝলাম বীচ এলাকায় ঢুকে পড়েছি, হঠাৎ রাস্তাটা সোজা খাড়াই উঠে গেছে দেখি। উঠে বাঁদিকে ঘুরে এগোতেই – আরে এই তো সমুদ্র! কিন্তু যতটা উপরে উঠেছিলাম, ততটাই নীচে। আর আমি এসে দাঁড়ালাম যে রাস্তার উপর, ভালো করে তাকিয়ে দেখি, আরে কি কান্ড, এটাই যে বাঁধ অর্থাৎ ডাইক! এই বাঁধের উপর রাস্তা, ঘর-বাড়ি, দোকান-পাট দেখে বোঝার উপায় নেই, শুধু উচ্চতা দেখে বোঝা যায়। ডানদিকে দূরে দেখতে পেলাম পিয়ার। সেখানে একটা নাগরদোলাও রয়েছে, ঐ পিয়ার-গুলোতে যেমন থাকে (শিকাগোতে নেভি পিয়ারে যেমন আছে সেন্টেনিয়াল হুইল)। এগুলো খুব-ই ধীরে ধীরে ঘোরে, মানে ওই চলন্ত অবস্থায় গিয়ে টুক করে বসে পড়া যায়। এখানে কি ব্যবস্থা আর কাছে গিয়ে দেখিনি অবশ্য। পায়ে পায়ে বালির অঞ্চল পার হয়ে জলের ধারে এসে দাঁড়াই, ঢেউ দেখি। সমুদ্র বেশ শান্ত, ঢেউ থাকলেও খুব উঁচু বা ঘন ঘন নয়। আবার রাস্তায় উঠে পিয়ারের দিকে এগোতে থাকি, সমুদ্রের ধার দিয়ে অজস্র ক্যাফে আর রেস্তোঁরা, মুক্ত ছাউনি, তার তলায় টেবিলে বসলে তার মাঝখানে কাঠ-কয়লার আগুন জ্বালানোর ব্যবস্থা আছে ঠান্ডা হাওয়ার প্রকোপ থেকে বাঁচতে। পিয়ার নতুন কিছু নয়, সঙ্গে বাঞ্জি জাম্পিং, জিপ লাইনিং এসবের ব্যবস্থাও রয়েছে। তবে শেষ অবধি হেঁটে গিয়ে দিগন্তবিস্তৃত নর্থ সী-র একটা সুন্দর ভিউ পাওয়া যায়। এখান থেকে অনেক নীচে সমুদ্র। তবে ঠান্ডায় লোক জন বেশী জলে নেই, কয়েকজন সার্ফিং করছে দেখলাম। অনেক দূরে জাহাজ দেখতে পেলাম একটা-দুটো। ফেরার পথে ওই পিয়ারের রাস্তায় ছায়ায় বেঞ্চে বসে লাঞ্চ করে নিলাম। খানিক বিশ্রাম নিয়ে এবার ফেরার পালা।
     


    যতটা উঠেছি,ততটা নামছি 




    পিয়ার 


    নর্থ সী 


    নর্থ সী কিনারা - গলিপথে আটলান্টিক-ও এসেছে কি? 


    ফেরার সময় সেই একই রাস্তা ধরে (বাঁদিক ধরে এসেছিলাম, ফিরছি ডান দিক ধরে) প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হেঁটে চলে এলাম আবার দেন হাগ সেন্ট্রাল। চেপে বসলাম রটারড্যামের ইন্টারসিটি-তে।স্টেশনে নেমে বাইরে এসে বাড়ি-ঘর, এমনকি স্টেশনের স্থাপত্য দেখে একেবারে হাঁ হয়ে গেলাম। সে কি নকশাদার ব্যাপার রে ভাই! এক একটা বিল্ডিং, মার্কেট, সিনেমা হল এমনকি পার্কের গঠন আর নকশাও দেখার মত। রটারড্যাম শহরকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাজি বোমার আঘাতে পুরো গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল।  দু-একটি বাড়িঘর বাদে পুরো শহরটাই ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে আজ এই রটারড্যাম শহরকে দেখলে তাক লেগে যায়!
     
    স্টেশন থেকে বেরিয়ে


    রটারড্যাম সেন্ট্রাল স্টেশন 


    প্রথমেই কিলোমিটার খানেক হেঁটে বেশ ব্যস্ত রাস্তা, পার্ক, সিনেমা হল ইত্যাদি পার হয়ে পৌঁছে গেলাম মার্কেট হল-এ। এর ভেতরে একটা গোটা পৃথিবী যেন ভরে দেওয়া হয়েছে। পুরো জায়গাটা দুট গলিপথ দিয়ে তিন ভাগে ভাগ করা। মাঝে দুদিকে মুখ করে দু-সারি দোকান, আবার গলিপথে ওপাশেও আর এক সারি দোকান। কোন দেশের খাবারের দোকান এখানে নেই, খুঁজে পাওয়া মুশকিল! আর মানুষ-জন – সেখানেও হেন কোনো দেশ নেই বোধ হয় যেখান থেকে পর্যটক-রা এসে ভিড় জমান নি। খাবার-দাবারের সুবাসে এই বিরাটকায় হল যেন ম-ম করছে! ফেরার সময় কিছু স্ন্যাক্স করে নেওয়া যাবে ভেবে, হলের ওপাশ দিয়ে বেরোতেই সামনে একটা বিল্ডিং চোখে পড়ল যার নাম ব্লাকটোরেন, এর মাথাটা দেখে ভালো করে পুরো বাড়িটার দিকে তাকাতেই দেখি, আরে এ যে একটা গোটা পেন্সিল! বোঝো, এবার কি সর্বকর্মা-কেও খুঁজে পাবো? এবার পিছন ফিরে মার্কেট হলের দিকে তাকাতেই দেখি, আরে এ যে একটা শার্পনার! পেন্সিল আর শার্পনার – ধন্য হল্যান্ডের আর্কিটেক্ট-রা!
     
    পার্ক আর সিনেমা হল 



     


    শার্পনার - মার্কেট হল 


    ব্লাকটোরেন - পেন্সিল (সর্বকর্মা আছে নাকি কোথাও লুকিয়ে?)


    ভালো করে দেখলে শার্পনার-এর ভিতরেই পেন্সিল-কে দেখা যাবে 


    এবার পেন্সিল-বাড়ির দিকে কিছুটা এগোতেই তার পাশে চোখে পড়ল আরও একটা অভিনব জিনিস! পেন্সিল-বাড়ি অর্থাৎ ব্লাকটোরেন-এর লাগোয়া অদ্ভুত চৌকো গঠনের বাড়ি! মানে ঘর-বাড়ি চৌকো হবে তাতে আশ্চর্য কিছু নেই, কিন্তু যেভাবে তেকোনা আকারে সেগুলো ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে, মনে হবে এই খুলে পড়ে গেল বুঝি! আর এর ভেতরে একেবারে জলজ্যান্ত মানুষের বসবাস। আর ভিতর থেকে বোঝার উপায় নেই যে এগুলোর গঠন বাইরে থেকে এমনি!  সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে দেখে নিশ্চিত হওয়া গেল। এ যেন মার্ভেল এর কমিকসের পাতা থেকে উঠে আসা অন্য কোনো মহাজাগতিক ঘর-বাড়ি! এদের পোষাকি নাম ‘কিউব হাউস’। রটারড্যাম তো বটেই, গোটা হল্যান্ডের এই বাড়ি-ঘর, তাদের গঠনশৈলী, স্থাপত্য তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো।
     



     
    এখান থেকে এরপর যাবো রাইন নদী আর রটারড্যাম বন্দর দেখতে, আর অবশ্য-ই রাইন নদীর উপর বিখ্যাত এরাসমাস ব্রিজ। রাইন নদী আসলে জার্মানী থেকে নেদারল্যান্ডসে ঢুকে দু-ভাগে ভাগ হয়ে যায়। একটা ভাগ এই রটারড্যামের পাশ দিয়ে নর্থ সী চলে গেছে, আর একভাগ কিছুটা দক্ষিণ দিক দিয়ে ওই একই নর্থ সী-তে গিয়ে মিশেছে। আর এই দুটো ভাগকেই কেটেকুটে গেছে অজস্র খাল আর ছোটো-বড় নদী-নালা, কেউ জল দিয়েছে, কেউ নিয়েছে। হল্যান্ডে এদের নাম-ও আলাদা, রাইন নয়, তবে সুবিধার জন্যে আমি রাইন-ই বলছি। ডানদিকের একটা রাস্তা ধরে কিছুদূর এগিয়ে পার হলাম একটা মস্ত ক্যানাল, আর তারপর রাস্তা পার হতেই রাইন নদী তার সুবিশাল জলরাশি নিয়ে চোখের সামনে। ছোটোবেলায় ইতিহাস-ভূগোল পড়ে গড়ে ওঠা স্বপ্নগুলো এইভাবে বাস্তবের চেহারা নেবে, কে জানত! সে যাক, এখান থেকে বাঁদিকে তাকালে একটা টুকটুকে লাল ব্রিজ দেখা যায়, এটি হল উইলেম ব্রিজ। আর ডানদিকে বেশ কিছুটা দূরে, ওই তো ছবিতে দেখা এরাসমাস ব্রিজ! এর গঠনের জন্যে আদর করে ডাকা হয় ‘দ্য সোয়ান’ নামে। রাস্তার পাশে নীচে নেমে গেলে একেবারে রাইনের পাশ দিয়ে বন্দরের রাস্তা। কিছুটা এগিয়ে গেলাম। বন্দরের সামনে রাস্তার উপর সারি দিয়ে নানান দেশের পতাকা, একটা ছোটো জাহাজ-ও ডকে লাগানো আছে। এখান থেকে নদী আর এরাসমাস ব্রিজ বেশ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। এখানেই আপাততঃ এ-যাত্রায় রটারড্যাম ঘোরায় ইতি জানিয়ে ফেরার পথ ধরলাম।
     
    উইলেম ব্রিজ 


    রটারড্যাম বন্দরের একটি জেটি 


    এরাসমাস ব্রিজ - দ্য সোয়ান 



    ফেরার পথ আবার সেই মার্কেট হলের (অর্থাৎ শার্পনার) মধ্যে দিয়ে। আবার সেই জমজমাট ভিড়, সেই খাবারের সুগন্ধ! এবার কিছু গ্রীক খাবারের স্বাদ নেওয়া গেল। মার্কেট হলের ভিড় থেকে বেরিয়ে ডানদিকে একটি বহু প্রাচীন চার্চ, শুনলাম রটারড্যাম শহরে এটিই একমাত্র বেঁচে গিয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাজি বোমাবাজি থেকে। ফেরার পথে কিছু কিছু অদ্ভুত গঠনের ভাস্কর্য চোখে পড়ল, শেষ অবধি ক্লান্ত পায়ে স্টেশন পৌঁছে গেলাম। বাড়ি ফিরে দেখলাম, আজকের হাঁটাহাঁটির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে পাক্কা পনেরো কিলোমিটার!
     



     
    রটারড্যামের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার 


    এটি কি বস্তু (লোহার ছোটো গডজিলা টাইপ) বুঝি নি,তবে দেখে মনে হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কোন বিমান বা ঐ ধরণের কিছু ধ্বংসাবশেষ থেকে তৈরী,কোথাও কিছু লেখা দেখতে পেলাম না 


    পরের দিন রবিবার, আমার এবারের হল্যান্ড ভ্রমণের নটেগাছটি মুড়োলো সৌরিশের বাড়িতে, আইথুর্ণ বলে এক শহরে। এই একমাত্র দিন, যেখানে হল্যান্ডে থাকাকালীন আমি ভাত খেয়েছিলাম (একেবারে মাছ-মাংস ইত্যাদি পঞ্চব্যঞ্জন-সহ), বাকি পুরোটাই ছিল স্যালাড, স্যান্ডুইচ, বেকড আর গ্রিলড খাবার-দাবারের উপর, তা নিয়ে আমার মত খাদ্যরসিকের বিশেষ আক্ষেপ নেই যদিও। প্রায় বছর দশ-বারো পরে দেখা-সাক্ষাৎ, গলাগলি, খাওয়া-দাওয়া, আড্ডা এসব হল সৌরিশ, মধুমিতা-দের সাথে। ওদের বাড়ির ঠিক পেছনেই প্যাটিও-র পাশ দিয়ে বেশ টলটলে জলে একটা ক্যানাল বয়ে চলেছে, এই ব্যাপারটা বেশ!
    অতঃপর বাংলা বছরের শেষ পাঁচদিন কোনোমতে হল্যান্ডে থুড়ি নেদারল্যান্ডসে কাটিয়ে বাংলা নতুন বছরে্র শুরুতেই আবার এসে ছুঁয়ে ফেললাম কলকাতার মাটি, এবং প্রথমেই একটি ধাক্কা খেয়েছিলাম এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে, সেই সময় একটা হিট ওয়েভ চলছিল, মনে হল টুপ করে কেউ চুল্লীতে নামিয়ে দিল শরীরটা। যাক, কি আর করা, এটাই যে আমার চেনা আবহাওয়া আর সব ভালো-মন্দ নিয়েও কলকাতা এক বড় খারাপ অভ্যাস –

    “…এই শহর জানে আমার প্রথম সবকিছু
    পালাতে চাই যত সে আসে আমার পিছু পিছু”
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ভ্রমণ | ১০ জুন ২০২৩ | ৫৪৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে মতামত দিন