এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  স্মৃতিচারণ  স্মৃতিকথা

  • গোবিন্দ ধর-এর নেয়া সাক্ষাৎকার

    Malay Roychoudhury লেখকের গ্রাহক হোন
    স্মৃতিচারণ | স্মৃতিকথা | ০৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ১১৪০ বার পঠিত
  • 1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 | 30 | 31 | 32 | 33 | 34 | 35 | 36 | 37 | 38 | 39 | 40 | 41 | 42 | 43 | 44 | 45 | 46 | 47 | 48 | 49 | 50 | 51 | 52 | 53 | 54 | 55 | 56 | 58 | 59 | 60 | 61 | 62 | 63 | 64 | 65 | 66 | 67 | 68 | 69 | 70 | 71 | 72 | 73 | 74 | 75 | 76 | 77 | 78 | 79 | 80 | 81 | 82 | 83 | 84 | 85 | 86 | 87 | 88 | 89 | 90 | 91 | 92 | 93
    মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গোবিন্দ ধর

    ভাদ্র-আশ্বিন ১৪২৮, দুই মাস প্রশ্নোত্তরে মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গোবিন্দ ধর



    গোবিন্দ : আপনি প্রচুর সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। দুটি সংকলন আছে আপনার সাক্ষাৎকারের। কিন্তু বেশিরভাগ প্রশ্নকর্তা হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন। আপনার জীবন, চিন্তাধারা, অভিজ্ঞতা ও গ্রন্হাবলী নিয়ে বিশেষ প্রশ্ন কেউ করেননি। আমি সেই ধরনের প্রশ্ন করতে চাই, যা অন্যেরা করেননি। আপনার শৈশব কেটেছে পাটনার ইমলিতলা নামে এক অন্ত্যজ বস্তিতে, সেখানে কৈশোরে কুলসুম আপা নামের এক কিশোরীর সঙ্গে আপনার জীবনে যৌনতার প্রথম পরিচয়। তা কি প্রেম ছিল? আপনার ধর্মনিরপেক্ষতার বীজ হিসাবে কি কাজ করেছিল ঘটনাটা?



    মলয় : না, তা প্রেম ছিল না। উনি আমাকে গালিব আর ফয়েজের কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন আর নিজেই এগিয়ে এসে সংসর্গ পাতিয়েছিলেন। ইমলিতলা পাড়া ছিল চোর,ডাকাত, পকেটমার অধ্যুষিত গরিব দলিতদের পাড়া, তাদের বাড়িতে অবাধে ঢুকে পড়া যেতো। কুলসুম আপাদের বাড়িতেও, এমনকী ওদের শিয়া মসজিদের ভেতরেও খেলা করার সময়ে ঢুকে লুকিয়েছি, নামাজ পড়ার মাদুরের পেছনে লুকিয়েছি। এখন ভারতীয় সমাজ এমন স্তরে পৌঁছেচে যে অমন বাল্যকাল অভাবনীয় মনে হবে। আমার ধর্মনিরপেক্ষতা বা ব্যাপারটাকে যা-ই বলো, ওই পাড়াতেই সূচিত হয়েছিল। দাদা সমীর রায়চৌধুরী এই অভিজ্ঞতাকে বলেছেন একলেকটিক। রামমোহন রায় সেমিনারি ব্রাহ্ম স্কুলে পড়ার সময়ে আমার ক্রাশ ছিলেন গ্রন্হাগারিক নমিতা চক্রবর্তী, যাঁর প্রভাবে আমি মার্কসবাদে আকৃষ্ট হয়েছিলুম। আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে এনার নাম সুমিতা চক্রবর্তী। উনি আমাকে ব্রাহ্ম কবি-লেখকদের রচনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন।



    গোবিন্দ : সেই পাড়ায় আপনারা নাকি পোড়া ইঁদুর, শুয়োরের মাংস, ছাগলের নাড়িভূঁড়ির কাবাব, তাড়ি, দিশি মদ, গাঁজা ইত্যাদি খেতেন। বাড়িতে তার জন্য পিটুনি খেতেন না?



    মলয় : দাদা বলতো বাড়িতে বলবি না, মৌরি খেয়ে নে। কিন্তু মুখে গন্ধ শুঁকে মা টের পেয়ে যেতেন আর বকুনি দিতেন। কিন্তু পাড়ার লোকেদের টানে আবার অমন কাণ্ড করতুম। এই সমস্ত কারণে দাদা ম্যাট্রিক পাশ করার পর বাবা ওনাকে কলকাতা সিটি কলেজে ভর্তি করে দিয়েছিলেন, আর নিজে একটা ঝোপড়ি কিনে দরিয়াপুর নামে সুন্নি মুসলমান পাড়ায় বাড়ি করেন। আমি সেই বাড়িতে একা থাকতুম। আমার বাল্যস্মৃতি ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ আর ‘ছোটোলোকের যুববেলা’ পড়লে জানতে পারবে নানা ঘটনা। সিটি কলেজে দাদার সহপাঠী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। চাইবাসা আর ডালটনগঞ্জে দাদা মৎস্য বিভাগে পোস্টেড থাকার সময়ে প্রচুর মহুয়ার মদ খেয়েছি। দাদা হরিণের মাংস খাবারও ব্যবস্হা করে দিতেন। কতো রকমের মাছ যে খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই ; গেঁড়ি-গুগলির বিরিয়ানিও খেয়েছি। তবে সবচেয়ে কড়া মদ হলো সালফি, অবুঝমাঢ় জঙ্গলের উপজাতিরা খায়। সালফি গাছ অনেকটা খেজুরগাছের মতন, খেজুরের মতনই রস বের করে, অবশ্য বেশ গাঢ়, ওদের দুবেলার নেশা আর ভোজনপর্ব তাতেই হয়ে যায়। ওখানকার অভিজ্ঞতা নিয়ে ‘ঔরস’ নামে আমার একটা উপন্যাস আছে।

    গোবিন্দ : ওই পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলাধুলা করতেন? গরিব নিম্নবর্ণের বিহারি ছেলে-মেয়ের সঙ্গে?



    মলয় : হ্যাঁ, তাছাড়া আর কাদের সঙ্গে খেলবো? স্কুলে ভর্তি হবার পরও ওদের সঙ্গে খেলাধুলা করতুম। স্কুলের বন্ধুরা কেউ ইমলিতলায় আসতো না। এমনকি তথাকথিত সংস্কৃতিবান বাঙালিরাও ইমলিতলা পাড়া এড়িয়ে চলতেন। ছোটোবেলায় নর্দমা থেকে লাট্টু, ড্যাঙ্গুলি, মার্বেল, রবারের বল কাঠি দিয়ে তুলে রাস্তার কলের জলে ধুয়ে নিয়ে খেলতুম। নর্দমাগুলো ছিল অত্যন্ত নোংরা, তাতে পাড়ার বাচ্চারা হাগতো। বাড়িতে জানতে পারলে বড়োজেঠিমা গায়ে গঙ্গাজল ছিটিয়ে শুদ্ধ করে দিতেন। বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই যে হাংরি আন্দোলনে এই পাড়ার অবদান কতোটা।



    গোবিন্দ : আপনার নাকি এক জাঠতুতো ভাই ছিল যাকে বড়োজেঠামশায় এক বেশ্যার থেকে কিনেছিলেন?



    মলয় : হ্যাঁ, ছিল। মেজদা। অনেককাল পর্যন্ত জানতুম না যে মেজদাকে কেনা হয়েছিল। মেজদা যখন জানতে পারল তখন বাংলায় কথা বলা বন্ধ করে কেবল হিন্দিতে কথা বলতো। পাড়ার প্রভাবে গুণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। কম বয়সে মারা যায়। তবে মেজদার দাপটের দরুণ কেউ আমাদের ঘাঁটাতো না।



    গোবিন্দ : আপনি নিজেই নিজের ইনটারভিউ নিয়েছিলেন শুনেছি। কাদের ছিল অমন প্রস্তাব?



    মলয় : চন্দননগরের ‘দাহপত্র’ পত্রিকার সম্পাদক কমলকুমার দত্ত’র আইডিয়া ছিল। দাহপত্রতে প্রকাশিত হবার পর পুস্তিকার আকারে ২০০৪ সালে বইমেলায় বেরিয়েছিল। পুস্তিকাটার নাম দেয়া হয়েছিল ‘প্রতিস্ব পরিসরের অবিনির্মাণ’। প্রচ্ছদে পোরট্রেট এঁকে দিয়েছিলেন পূর্ণেন্দু পত্রী। এবার চান্স পেলে অন্যরকম আত্ম-প্রশ্ন তুলবো।

    গোবিন্দ : হাংরিদের বোহেমিয়ান বলা হয় কেন?

    মলয় : বাঙালির সনাতন সমাজের অনুশাসনে খাপ না খেলে ব্যক্তির আউল, বাউল, ফকির, সাধু, সন্ন্যাসী, বহুরুপী, বৈরাগী ইত্যাদি হবার সুযোগ ছিল, এখনও আছে। ঘটনাটাকে প্রাকৃতিক বলে মেনে নিতো সমাজ। এই কারণেই বোহেমিয়ান নামে কোনো ভাবকল্প বঙ্গসমাজে ছিল না। অথচ আধুনিকতাবাদী ও নবজাগৃতিবাদী ইউরোপে, সংস্কৃতি ব্যাপারটার উদ্ভবের দরুণ, যারা সমরূপতায় খাপ খায় না, তাদের বেয়াদপি সামলাতে ঘোর ঝামেলায় পড়েছে সমাজ। তাদের লাইনে এনে সংস্কৃতিবান করার জন্য অনুভব করেছে একটি আধিপত্যবাদী নিরঙ্কুশ ক্ষমতার প্রয়োজনীয়তা। সনাতন সমাজে যা ছিল স্বাভাবিক তা হয়ে গেল অস্বাভাবিক। যে খাপ খায় না সে ‘অপর’। ইউরোপের নতুন ব্যবস্হা অনুযায়ী তাদের সংশোধন, দোষত্রুটিমুক্ত করে নেবার ফন্দিফিকির তৈরি করা হলো। ফলে সামাজিক স্হিতি আনতে রাষ্ট্র হয়ে উঠলো জরুরি। রাষ্ট্র তার সংস্হাগুলোর মাধ্যমে লাটের পর লাট একই রকম মানব উৎপাদনের কারখানা হয়ে গেল। যারা সেই ফ্রেমওয়র্কের বাইরে, তাদের ‘বোহেমিয়ান’ তকমা দেবার চল শুরু হলো। এদেশে তাদের নকল করা আরম্ভ করলো সমাজের কর্তারা।



    গোবিন্দ : নবারুণ ভট্টাচার্যের গল্প-উপন্যাস আলোচনার সময়ে প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন নবারুণ সমাজ নিয়ে ভাবতেন। হাংরিরা আত্মচিন্তার লেখা লিখতেন। আপনি কী বলবেন?
    মলয় : প্রবুদ্ধ ঘোষ একটা হাংরি বুলেটিন পড়ে নিজস্ব ধারণা গড়ে নিয়েছেন। উনি হাংরিদের রাজনীতি বিষয়ক, ধর্ম বিষয়ক, অশ্লীলতা বিষয়ক ইশতাহারগুলো পড়েননি। তাছাড়া আমি ভারতীয়, বিশেষ করে বাঙালি সমাজের, বিস্তারিত আলোচনা করেছি আমার প্রবন্ধগুলোতে, ‘পোস্টমডার্ন কালখণ্ড ও বাঙালির পতন’ পুস্তিকায় যেটা প্রকাশ করেছিলেন সুকুমার রায়, ‘খনন প্রকাশনী, থেকে এবং আমার প্রবন্ধ ‘উত্তরদার্শনিকতা’তে যা প্রমা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। দুটো প্রবন্ধই আমার প্রবন্ধসংগ্রহের দ্বিতীয় খণ্ডে আছে। বইটা মুর্শিদ প্রকাশ করেছে আবিষ্কার প্রকাশনী থেকে। আসলে, কৌম-নিরপেক্ষ ব্যক্তি হতে পারে না। সে নানারকম কৌমের অন্তর্গত। যেমন একজন বাংলাদেশি মানুষ একই সঙ্গে বাংলাভাষী কৌম, ইসলামি কৌম, সুন্নি কৌম ইত্যাদির অন্তর্গত-- সে ইংল্যাণ্ডে গিয়েও বাঙালি হোটেল খোঁজে, বাঙালিদের আড্ডা খোঁজে। প্রবুদ্ধ ঘোষ, মনে হয়, আমার কোনও প্রবন্ধের বই আর উপন্যাস পড়েননি, যতোটা উনি নবারুণ ভট্টাচার্য পড়েছেন।



    গোবিন্দ: : আপনারা, হাংরিরা, শুনেছি যৌনকর্মীদের পাড়ায় যেতেন। ‘কৃত্তিবাসের’ কবি-লেখকরাও যেতেন অথচ তা স্বীকার করেননি নিজেদের জীবনীতে ; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ওনার ‘অর্ধেক জীবন বইতে চেপে গেছেন। ওনারা বুদ্ধদেব বসুর বোদলেয়ার পড়ে আর আপনাদের সংবাদ পড়ে হাংরিদের নকল করা আরম্ভ করেন বলে মনে হয়। সুনীলের এই ‘হিমযুগ’ কবিতা পড়লে আপনাদের আর সোনাগাছির প্রভাব স্পষ্ট হয়ে যায়। উনি লিখেছিলেন,“শরীরের যুদ্ধ থেকে বহুদূর চলে গিয়ে ফিরে আসি শরীরের কাছে/কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-/শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোঃস্নার মতো যোনি/মধুকূপী ঘাসের মতন রোম, কিছুটা খয়েরি/কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে-/আমার নিশ্বাস পড়ে দ্রুত, বড়ো ঘাম হয়, মুখে আসে স’তি/কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।/নয় ক্রুদ্ধ যুদ্ধ, ঠোঁটে রক্ত, জঙ্ঘার উত্থান, নয় ভালোবাসা/ভালোবাসা চলে যায় একমাস সতোরো দিন পরে/অথবা বৎসর কাটে, যুগ, তবু সভ্যতা রয়েছে আজও তেমনি বর্বর/তুমি হও নদীর গর্ভের মতো, গভীরতা, ঠান্ডা, দেবদূতী/কথা দিয়েছিলে তুমি উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।/মৃত শহরের পাশে জেগে উঠে দেখি আমার প্লেগ, পরমাণু কিছু নয়,/স্বপ্ন অপছন্দ হলে পুনরায় দেখাবার নিয়ম হয়েছে/মানুষ গিয়েছে মরে, মানুষ রয়েছে আজও বেঁচে/ভুল স্বপ্নে, শিশিরে ধুয়েছো বুক, কোমল জ্যোৎস্নার মতো যোনী/তুমি কথা দিয়েছিলে…../এবার তোমার কাছে হয়েছি নিঃশেষে নতজানু/কথা রাখো! নয় রক্তে অশ্বখুর, স্তনে দাঁত, বাঘের আঁচড় কিংবা/ঊরুর শীৎকার/মোহমুগ্ধরের মতো পাছা আর দুলিও না, তুমি হৃদয় ও শরীরে ভাষ্য/নও, বেশ্যা নও, তুমি শেষবার/পৃথিবীর মুক্তি চেয়েছিলে, মুক্তি, হিমযুগ, কথা দিয়েছিলে তুমি/উদাসীন সঙ্গম শেখাবে।”

    মলয় : কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর কবিদের কবিতায় বাঁকবদল ঘটেছিল হাংরি আন্দোলনের প্রভাবে। শরৎ মুখোপাধ্যায়ও হাংরি আন্দোলনের প্রভাবে অমন অভিজ্ঞতার কবিতা লিখেছিলেন, এই যেমন, কৃত্তিবাসের ষোল নম্বর সংকলন সম্বন্ধে শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় লিখেছিলেন, ‘ষোল নম্বর সংকলনে কৃত্তিবাস ফেটে বেরুল। তারিখ ১৩৬৯ চৈত্র। কবিত্বের খোলস ছেড়ে একদল অতৃপ্ত যুবকের অকস্মাৎ বেরিয়ে পড়ার জন্যে প্রচন্ড অস্বস্তি ও বেগের প্রয়োজন ছিল। অ্যালেনদের সাহচর্য তা জুগিয়েছিল আমাদের। ঘামে নুন, যোনিদেশে চুল( পৃঃ ৫), দেখেছি সঙ্গম ঢের সোজা, এমনকি বেশ্যারও হৃদয়ে পথ আছে ( পৃঃ ২২), যোনির ঝিনুকে রাখা পোকাগুলি মুক্তা হয়ে গিয়েছে বিস্ময়ে ( পৃঃ ৪৫),আসলে যে কান্ড ঘটেছিল সব কবিদের বুকের মধ্যে তা হল প্রচন্ড বিরক্তি থেকে উদ্ভুত ধ্বংস করার ইচ্ছে – সৃষ্টির নামান্তর – যা কিছু পুরনো পচা, ভালমন্দ সোনারুপোর খনি, এমনকি নিজেদের শরীর ও অস্তিত্ব – সর্বস্বের সর্বনাশ। “ ( শরৎকুমার মুখোপাধ্যায়, কৃত্তিবাসের রামায়ণ, কৃত্তিবাস পঞ্চবিংশ সংকলন, ১৯৬৮)। তারিখগুলো দেখলেই বোঝা যায় যে ওনারা হাংরিদের টেক্কা দেবার চেষ্টা করছেন।



    গোবিন্দ : ওনাদের গোষ্ঠীতে শরৎকুমার কিন্তু স্পষ্টবক্তা ছিলেন, যা ভাবতেন তাই লিখতেন। বীজেশ সাহার ‘মাসিক কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় উনি লিখেছিলেন, ( কৃত্তিবাস, এপ্রিল-জুন, ২০১৭ ) : "শঙ্খ ঘোষ মহাশয় কিছুদিন আগে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের হাত থেকে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার গ্রহণ করলেন। কয়েক বছর আগে প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ীর হাত থেকে তিনি অন্য একটি পুরস্কার নিতে অসন্মত হন, কারণ তিনি ছিলেন হিন্দুবাদী, বিজেপি পার্টির নেতা। শঙ্খ ঘোষ যে সিপিএম-সিপিআই দলের সমর্থক এ কথা আমরা আগেই জানতাম, কিন্তু একথা জানতাম না প্রধানমন্ত্রী পদ পেলেও পার্টির নামের দুর্গন্ধ মোছে না। কবি হিসেবে শঙ্খ ঘোষকে আমি পঞ্চাশ দশকের প্রধানতম কবি বলতে চাই না। আমার মতে, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রধানতম কবি। তারপর প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত এবং আলোক সরকার।"



    মলয় : শঙ্খ ঘোষ লোকটি সত্যিই অদ্ভুত ছিলেন। ‘শব্দ ও সত্য’ নামে একটা প্রবন্ধ ১৯৭১ সালে লিখেছিলেন, অথচ জানতেন না যে মামলাটা আমার বিরুদ্ধে হয়েছিল, পঁয়ত্রিশ মাস ধরে, আর আমার সাজা হয়েছিল। আমি অনুবাদের সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলুম, তা উনি বিশ্বাস করেননি, প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়কে বলে আমার চিঠির কপি আনিয়েছিলেন। আসলে শৈলেশ্বর ঘোষ ওনাকে যা বোঝাতো উনি তা-ই বুঝতেন। সমরজিৎ সিংহ তো লিখেছেন যে যখন শ্যামবাজারে থাকতেন তখন দেখতেন শৈলেশ্বর প্রতিদিনই শঙ্খ ঘোষের বাড়িতে গিয়ে বসে আছেন। শৈলেশ্বর যে শেষ জীবনে তৃণমূলের পার্থ চ্যাটার্জির সঙ্গে পুরস্কারের আশায় মেলামেশা আরম্ভ করেছিলেন, তাও শঙ্খ ঘোষের ওসকানিতে। শম্ভু রক্ষিত একবার চটে গিয়ে শঙ্খবাবুকে জিগ্যেস করেছিল, আপনি গয়লাঘোষ না কায়েত ঘোষ, তার কারণ শৈলেশ্বর আর সুভাষ ছিল গয়লাঘোষ।



    গোবিন্দ : শুনেছি, হাংরি আন্দোলনের প্রচার-প্রসার চেপে দেবার জন্য সেই সময়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘কবিতা-ঘন্টিকী’, প্রতি ঘণ্টার কবিতা-পত্রিকা৷৷

    মলয় : হ্যাঁ। ২৩ বৈশাখ ১৩৭৩, ৭ মে ১৯৬৬ সকাল দশটায় প্রকাশিত হয়েছিল ‘কবিতা-ঘন্টিকী’, প্রতি ঘণ্টার কাব্যপত্র৷ তারিখ দেখেই তো বোঝা যায় যে হাংরি আন্দোলনের বুলেটিনগুলোর আর সংবাদপত্রের খবরের দামামাকে চেপে দেবার চেষ্টা।



    গোবিন্দ : সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ছিলেন আপনাদের হাংরি আন্দোলনে। উনি প্রতিষ্ঠানবিরিধী হিসাবে নিজেকে প্রচার করতেন, অথচ আপনার বিরুদ্ধে মুচলেকা লিখে আন্দোলন ত্যাগ করেন।

    মলয় : হ্যাঁ। ১৯৮৭ সালে সুমিতাভ ঘোষালকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, “আমি হারি আন্দোলনের সঙ্গে ভীষণভাবেই জড়িত ছিলাম। হাংরি আন্দোলনের আদর্শ — আমার ভালো লেগেছিল, এবং আমি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম। এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু পরের দিকে ওরা আমাকে না জানিয়ে আমার নামে পত্রিকা টত্রিকা বার করে। যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল। তখন আমি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। কিন্তু এই হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সুনীল আমেরিকায়। এই আন্দোলনকে সুনীলের অসাক্ষাতে একটা ক্যু বলতে পারা যায়।প্রতিষ্ঠানের লোভ আমার কোনোদিনই ছিল না। বাংলাদেশে যদি কেউ আগাগোড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভূমিকা পালন করে থাকে তবে তা আমি। আমার ‘বিজনের রক্তমাংস’ গল্পটি বেরোনোর পর থেকে আমার সে ভূমিকা অব্যাহত।আমি মনে করি ওরকমভাবে দল পাকিয়ে সাহিত্য হয় না। একজন লেখক নিজেই অতীত, নিজেই ভবিষ্যত, নিজেই সমাজ, নিজেই সভ্যতা, এবং নিজেই সবকিছু। সাহিত্য সৃষ্টিতে দলের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না।আমি মুচলেকা দিয়েছিলাম তার দুটো কারণ। এক, আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই, আর দুই, আমার বউ আমাকে জেলে যেতে বারণ করেছিল। বউ বলল, যে একেই তো তোমার মতো মদ্যপকে বিয়ে করার জন্য আমার আত্মীয় পরিজনরা সব আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছে। তার ওপর তুমি যদি জেলে যাও তাহলে সোনায় সোহাগা হবে। সেই জন্যে আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করি।” সন্দীপনের নামে কোনও বুলেটিন প্রকাশিত হয়নি। উনি বরং দেবী রায়কে চিঠি লিখে নির্দেশ দিতেন কী-কী করা উচিত।



    গোবিন্দ : আপনার অভিজ্ঞতার কথা বলুন। বিদেশে গিয়ে যৌনকর্মীদের পাড়ায় গেছেন?

    মলয় : না, সোনাগাছির কথা কেবল সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, হাংরি বুলেটিনে। আমার মামলার সময়ে সিনিয়র উকিল চণ্ডীচরণ মৈত্র’র চেম্বার ছিল সোনাগাছিতে ঢোকার অবিনাশ কবিরাজ লেনের ঠিক উল্টো দিকে। উকিলের জানলা দিয়ে দেখতে পেতুম শনিবার সন্ধ্যায় পার্বতীচরণ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে পুরো কৃত্তিবাস বাহিনী ঢুকছে সোনাগাছিতে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া। মোড়ের পানের দোকান থেকে গোড়ের মালা আর বাংলা মদের কয়েকটা বোতল নিয়ে ঢুকতো। ওদের যৌনকবিতাগুলো সোনাগাছির মেয়েদের সঙ্গে মাঝরাত কাটানোর অভিজ্ঞতায় ভরপুর। বাঙালি বাড়ির বউরা তখন ওসব যৌন-আঙ্গিক অ্যালাউ করতো না বলে মনে হয়।

    গোবিন্দ : আপনি? আপনারা?



    মলয়: আমার পিসেমশায় যাওয়া আরম্ভ করেন। ওনার দেখাদেখি ওনার বড়ো ছেলে অজয় বা সেন্টুদা ঢুঁ মারা আরম্ভ করেন। সেন্টুদা আমাকে ওই পাড়ার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। দুপুর বেলায় রেট কম থাকে বলে সেন্টুদা দুপুরে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। হাংরিদের মধ্যে শৈলেশ্বর ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর রেগুলার যেতো, প্রৌঢ় বয়সেও, ওদের পরস্পরের চিঠিতে পাবে ওদের প্রিয় যৌনকর্মী বেবি, মীরা, দীপ্তির নাম। সবচেয়ে ভীতিকর হল কোনও যৌনকর্মীর প্রেমে পড়া। এখন তো আলো ঝলমলে অন্য চেহারা নিয়ে ফেলেছে এলাকাটা। আধুনিকা যৌনকর্মীরা জিনস-স্কার্ট পরে রাস্তার মাঝখানেই দাঁড়িয়ে থাকেন, স্টাইলে সিগারেট ফোঁকেন। বিদেশে যৌনকর্মীদের পাড়ায় গিয়ে দেখে বেড়িয়েছি কিন্তু কারোর সঙ্গে শুইনি, কেননা যৌনরোগকে আমার ভীষণ ভয়। বোদলেয়ারের জীবনী পড়ে আরও আতঙ্কিত হই। বিদেশিনীদের কাছে সারা পৃথিবী থেকে খদ্দেররা যায়। ভিয়েৎনামের যুদ্ধের কারণে থাইল্যাণ্ড হয়ে গিয়েছিল যৌনকর্মীদের বিরাট বাজার; কাঁচের দেয়ালের ওইদিকে মেয়েরা বুক খুলে আর জাঙিয়া পরে খদ্দের ডাকতো। আমস্টারডামে একটা পাড়া ছিল যার গলিগুলোতে বিশাল কাচের জানলার সামনে প্রায় উলঙ্গ মেয়েরা ফিকে লাল আলোয় বসে থাকতো আর নীল আলো জ্বললে বুঝতে হতো সমকামীদের ডাকছে। পাড়ার বাড়িগুলো তৈরি হয়েছিল নেপোলিয়ানের হুকুমে। গলিগুলো এতো সরু যে দোতলায় আসবাব তুলতে হলে দড়ি বেঁধে তুলতে হয়। চারিদিকে খাল। সৈন্যরা নৌকো করে এসে রাত কাটাতো। গাঁজার দোকানকে ওরা বলে কাফে। যৌনতার নানারকমের খেলনা আছে নারী আর পুরুষের জন্য। নাটক অভিনীত হয়, সঙ্গম করার।



    গোবিন্দ : আপনার আত্মজীবনীতে এসব এসেছে?

    মলয় : হ্যাঁ, ‘ছোটোলোকের শেষবেলা’তে এসেছে। তাছাড়া ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে আমি ওই সময়ের সবাইকে আর ঘটনাগুলোকে তুলে এনেছি। উপন্যাসটা প্রতিভাস প্রকাশিত ‘তিনটি নষ্ট উপন্যাস-এর অন্তর্ভুক্ত। মামলার সময়ে আমার শরীর হঠাৎ খারাপ হয়ে যেতে পাটনায় ফিরে গিয়েছিলুম আর আমাদের পারিবারিক ডাক্তার অক্ষয় গুপ্ত সংবাদপত্র পড়ে ধরে নিয়েছিলেন যে আমার যৌনরোগ হয়েছে আর বরাদ্দ করেছিলেন পেনিসিলিন অয়েল ইনজেকশান। জানতে পেরে পরের দিনই কমপাউণ্ডারকে বলেছিলুম, আর দিতে হবে না, ও-রোগ আমার হয়নি, হবে না।



    গোবিন্দ : আপনার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে আপনার আর আপনার দাদার বন্ধুরা চরিত্র। সমালোচিত হয়েছেন সেকারণে?



    মলয় : হ্যাঁ। অমিতাভ প্রহরাজ লিখেছিল, পড়ে দেখতে পারো, অমিতাভ প্রহরাজ সমালোচনা করেছেন এইভাবে, “মলয়দা মানে মলয় রায়চৌধুরীর রাহুকেতু উপন্যাসের জন্য গান্ধী বার্থডের আগের রাতের রামের মতো বিক্রী হচ্ছে। সামান্য উল্টেপাল্টে পড়া হলো আর স্বাভাবিকভাবেই বেশ ঝাঁঝালো কথা-প্রতিকথা জমে উঠলো। একভাবে বলতে গেলে মলয় রায়চৌধুরীর “রাহুকেতু” দিয়ে লেখামোর প্রথম সেশানের বৌনি হলো। মলয়দা বিজ্ঞাপনে যা বলেছিলেন তা অতি সত্য। এতে রক্তমাংসের সুনীল শক্তি সন্দীপন দীপক খুব প্রবলভাবে আছেন। সুনীল হয়েছেন অসীম গাঙ্গুলী, শক্তি হরিপদ রায়, সন্দীপন প্রদীপন চ্যাটার্জী যার অফিসের নাম নৃপতি চাটুজ্জে। কৃত্তিবাস হয়েছে রামায়ণ নট্ট কোম্পানি, আনন্দবাজার মহাভারত নট্ট কোম্পানি। সুনীল কখনো কখনো রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী। মলয়দা নিজে রাহুল, সমীরদা অনিকেত। উপন্যাসের শুরুই রাহুলকে পুলিশের গ্রেফতার ও তার পেছনে নেপথ্য কাহিনী নিয়ে। সুনীলের মার্গারিটারও উল্লেখ রয়েছে। সুনীল বা অসীম আইওয়া থেকে ফিরে এলে রাহুলের কাছে একটা টেলিগ্রাম আসে “অধিকারী হ্যাজ কাম ব্যাক। এ বিগ কনস্পিরেসি ইজ গোইং অন। – সিংহবাহিনী”। রাহুল প্রথমে বুঝতে পারেনি কে টেলিগ্রামটি পাঠিয়েছে। কিন্তু যারা সময়ের ওই চত্বরটি নিয়ে কিঞ্চিত নাড়াঘাঁটা করেছেন তাঁদের “সিংহবাহিনী” বললেই সেই চরম রঙীন চরিত্রটির কথা মনে পড়বেই। ওয়ান এ্যান্ড অনলি কে জি বা কৃষ্ণগোপাল মল্লিক, যিনি নিজেও এসেছেন পরে কাহিনীতে। এইরকম ছোটখাটো এ্যানেকডোটসে ভর্ত্তি রাহুকেতু। আর বিতর্কিত ঘটনার তো আস্ত শপিং মল রয়েছে ওতে। সে রামায়ণ নট্ট কোম্পানির অধিকারী রাহুলকে ডেকে থ্রেট দেওয়া বা রাহুলের পালটা বলা “আপনার প্রথম বই এর সমস্ত খরচ তো আমার দাদা অনিকেত দিয়েছিলেন”। বা দেবী রায়কে তার প্রকৃত নাম হারাধন ধাড়া বলে ডেকে মস্করা করা, ইত্যাদি অগুন্তি রেফারেন্সের ছড়াছড়ি। ফলে হয়তো মলয়দার কাম্য ছিল না, কিন্তু একটা রগরগে স্ক্যান্ডাল কোশেন্ট উপন্যাসটির সঙ্গে জুড়ে গেছে। আমি বইটি নিয়ে কিছুটা বক্তিমে করলাম এই কারনেই যে এটি লেখামোর প্রথম সেশানের সূচনাবিন্দু। আমার মলয়দার কাছে দুটি অতি বিনীত প্রশ্ন আছে, ধৃষ্টতা মাফ করবেন, এক) এই লেখাটা ওনাদের জীবদ্দশায় কি বের করা যেত না? কারন মৃতদেহ প্রতিবাদ করতে পারে না, দুই) নামগুলো যখন কাল্পনিক নামই দিলেন, তখন ও দিকে অসীম, হরিপদ রায়, নৃপতি চাটুজ্জে ইত্যাদি ধরনের নাম আর আপনার বা আপনার দাদার নাম রাহুল বা অনিকেতের মতো স্মার্ট ফিল্মি হীরো টাইপের কেন? এটা কি নামকরন থেকেই দুটো পৃথক ক্লাস বা শ্রেণী বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা? যদি তাইই হয় তাহলে ‘দেবী রায়কে ওরা ইচ্ছে করে হারাধন ধাড়া বলে ডেকে মর্ষকামী আনন্দ পেত’ বলে ওদের খিস্তি দিলেন কেন? সেই একই মর্ষকামীতার দোষে তো তাহলে আপনিও দুষ্ট লেখাটির প্রথম পাতা থেকে, যেখানে নামকরণ করেছেন, এমন কি অসীম ওরফে সুনীলের ঠিকানা বলতে গিয়ে বলেছেন ওঝাপুর। মলয়দা, আপনি বয়োঃজ্যেষ্ঠ পণ্ডিত মানুষ, লেখক হিসেবেও অত্যুচ্চ মানের, আপনাকে সরাসরি মুখের ওপর হয়তো কেউ কিছু বলবেনা। আপনার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেই বলি, একটা অতি অপ্রিয় সত্যি যে লুকিয়ে নয় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে আছে। রাহুকেতুর এই গরম কেকতুল্য বিক্রীর পেছনে কিন্তু সেই সুনীল, শক্তি, সন্দীপন, কৃত্তিবাস প্রমূখেরাই রয়েছে। লেখাটা কাঁচু, মাচু আর পাঁচুকে নিয়ে হলে এই চাহিদা হতোনা। তবে এটা অনস্বীকার্য যে ফিকশান ন্যারেটিভে আপনার নিজস্ব তকনিক ও প্রকরণ অসামান্য, যার ফলে এক সম্পূর্ণ অন্য আঙ্গিকের ভাষা হওয়া সত্ত্বেও রিডেবিলিটি খুবই হাই, এক বিরল কম্বো। যদিও সেটা বিচার করার যোগ্যতা হয়তো আমার নেই, ঔদ্ধত্য ক্ষমা করবেন।”

    গোবিন্দ : কুলসুম আপা, তারপর এই ধরণের জীবনযাত্রা, আপনার নিজেকে কলুষিত মনে হয়নি? ইমলিতলা পাড়ায় থাকলেও, আপনার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের সদস্য হিসাবে, ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান হিসাবে, আপনার মূল্যবোধ তো মধ্যবিত্ত বাঙালির? সেই প্রেক্ষিতে নিজের মূল্যায়ন করে মনে হয়নি যে অধঃপতনের পথে যাত্রা করছেন?



    মলয় : না হয়নি। বলতে গেলে ইমলিতলা পাড়াই ছিল আমার মূল্যবোধ গড়ে ওঠার বনেদ। ওই পাড়ায় দোল খেলার দিন অন্ত্যজ বউরা কেউ নিষেধ মানতো না, আমার বয়ঃসন্ধিতেও তারা জড়িয়ে চুমু খেয়ে উত্তেজিত করে দিতো। রঙের বদলে নর্দমার জল, গোবর-গোলা জল ঢেলে দিত গায়ে। মুখে গোবর মাখিয়ে দিতো। এমন পাড়া ছিল যে গয়লাটাও দুধ দিতে এসে আমার মা, জেঠিমার নাম ধরে ডাকতো। বাড়ির মধ্যে একটা কুয়ো ছিল, তার চারিধারে বিহারি বউরা ওদের পরিবারের কারোর বিয়ের সময়ে এসে এমন গান গাইতো যাকে লোকে বলবে অশ্লীল।



    গোবিন্দ : যেমন?

    মলয় : যেমন, বাঙলায় বলছি, পাটনাইয়া মগহি গানের বাঙলা। এবার নে মশারি টাঙা, শশা, বেগুন, তেল মাখিয়ে নে, নইলে চিৎকার করে পাড়া মাথায় করবি। এরকম নানা গান। বড়ো জেঠা তাই কুয়োটা বন্ধ করিয়ে দিয়েছিলেন।

    গোবিন্দ : অর্থাৎ আপনি গ্রামের মানুষ নন, শহরের মানুষ। তবু আপনার বইতে, যেমন ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, ‘নামগন্ধ’, ‘জলাঞ্জলি’, ‘ঔরস’ ইত্যাদি উপন্যাসে গ্রাম এসেছে বিপুলভাবে। কেমন করে আপনি বর্ণনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুললেন? ‘ঔরস’ উপন্যাসে আপনি অবুঝমাঢ়ের মাওবাদী এলাকা ডিটেলে বর্ণনা করেছেন।



    মলয় : চাকুরিসূত্রে সারা ভারতের গ্রামগঞ্জ ঘুরেছি, চাষি, তাঁতি, জেলে, কামার, কুমোর, খেতমজুর, নৌকোর ছুতোর আর নিম্নবর্ণের মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়েছি ক্ষেত্রসমীক্ষায়। অধিকাংশ চরিত্র পেয়েছি সমীক্ষার সময়ে। তার আগে যখন রিজার্ভ ব্যাঙ্কে চাকুরি করতুম তখন সহকর্মীদের গ্রামে গেছি। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকরিটা ছেড়ে এআরডিসিতে গেলুম, সেখান থেকে নাবার্ড। রিজার্ভ ব্যাঙ্কের চাকুরিটা ছেড়েছিলুম গ্রামের জীবন আর মানুষ দেখার লোভে। এখন তো আমার যা পেনশন তার চেয়ে বেশি পেনশন পায় রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পিওন। তবে প্রচুর ঘোরাঘুরি করেছিলুম তখন। পশ্চিমবাংলায় সিপিএমের ভয়ে অনেকে কথা বলতে চাইতো না বলে দাড়ি বাড়িয়ে অবাঙালি এম আর চৌধারী হয়ে গিয়েছিলুম, হিন্দিতে কথা বলতুম। ট্যুরের সময়ে বহু গ্রামে আমার স্ত্রীকেও নিয়ে গেছি যাতে গ্রামের গরিব পরিবারের অন্দরমহলের খবর পাই।



    গোবিন্দ : আপনার স্ত্রী রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় ছিলেন?

    মলয় : হ্যাঁ। অনেক কাপ আর শিল্ড ছিল ওদের বাড়িতে। শীতের সময়ে ওরা ওল্ড মঙ্ক রাম খেয়ে খেলতো।

    গোবিন্দ : কোনও বিশেষ স্মৃতি?

    মলয় : প্রচুর স্মৃতি জমে আছে, লিখেছিও কিছু-কিছু। সবচেয়ে বিস্ময়কর হলো হিমালয়ের তরাইতে খাঁটি ভারতীয় গরু আছে কিনা তার তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে এক মরা বাঘিনীর স্মৃতি, যার রক্তাক্ত যোনিও আকর্ষণ করেছিল। স্হানীয় লোকেরা, সকলেই হিন্দু, বাঘিনীর মাংস-হাড় ইত্যাদি সংগ্রহের জন্যে কাড়াকাড়ি করেছিল। একজন আমাকে আর আমার সহকর্মীকে রেঁধে খাইয়েছিল। ইঁদুর খেয়েছি শৈশবে, বাঘ খেলুম যৌবনে। ঘোরাঘুরির চাকরির আগে জানতুম না কতোরকমের গরু, ছাগল, শুয়োর, মুর্গি, হাঁস, চাল, আলু, সবজি ইত্যাদি হয়। জলসেচের কতোরকমের ব্যবস্হা আছে আর কোন ফসলে কখন কীরকম জলসেচের দরকার হয় কিছুই জানতুম না। যেখানে-সেখানে ঘুমোবার আর বনবাদাড়ে হাগার স্মৃতি আছে। অজ পাড়াগাঁয়ে গেলে হাগতে যেতে হতো আখখেতে, ধানখেতে, গাছের আড়ালে, নদীর ধারে। দাদার যখন দুমকায় পোস্টিঙ হয়েছিল তখন পায়খানাটায় দরোজা ছিল না, কিন্তু তার সামনে একটা কাঁঠালগাছ আড়ালের কাজ করতো। গাছে ঝুলে থাকা এঁচোড়ে হিপিরা নিজেদের পোশাক ঝুলিয়ে হাগতে যেতো। আমি তো এনসিসির ইনফ্যান্ট্রি ব্রিগেডে ছিলুম। দল বেঁধে সাতসকালে সবাই মিলে গোল হয়ে বসে হাগার অভিজ্ঞতা ছিল। বিয়ের পর পাঞ্জাবে এক বন্ধুর গ্রামে গিয়েছিলুম, সেখানে গিয়ে আমার শহুরে হকি-খেলোয়াড় বউকেও খেতে হাগতে যেতে হতো।



    গোবিন্দ : হাংরি আন্দোলনের সময়কার স্মৃতি?

    মলয় : লিখেছি তো? পড়োনি? এটা পড়ো। “হাতে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশের দল রাতে নিয়ে চলল বাঁকিপুর বা পিরবহোর থানায়, সোজা লকআপে, অন্ধকার, আলো নেই, পাশের লকআপে বেশ্যার দলের চেঁচামেচি, লকআপে সাত-আটজন কয়েদি, নানা অভিযোগে, ডাকাতি আর খুনও। ফুলপ্যান্টের ভেতরে ইঁদুর ঢুকে এলো, পা ঝেড়ে বের করলুম, বাড়ি থেকে খাবার এসেছিল, কিন্তু একে অন্ধকার, তায়ে লকআপের অভিজ্ঞতা, খাওয়া গেল না। সকালে স্হানীয় খবরের কাগজে গ্রেপ্তারির খবর শুনে নমিতা চক্রবর্তী সাহস যুগিয়ে গেলেন, বহুদিন পর ওনাকে দেখলুম, চোখে চশমা, টিচারি শুরু করেছেন, আমার নকাকিমা যে স্কুলে পড়ান সেখানে। নমিতাদি বেঁচে থাকলে জানতে চাইতুম, ভেঙে পড়া সোভিয়েত রাশিয়ায় কোথা থেকে এতো মহাকোটিপতি আর মহাচোরাকারবারী আচমকা উদয় হল, এতো ভিকিরি, এতো ছিঁচকে চুনোপুঁটি! হাগবার জন্য কোমরে দড়ি পরিয়ে হাগতে পাঠানো হলো, ঘুড়ি ওড়ানোর মতন করে ঢিল দিয়ে লাটাই ধরে থাকলো একজন কন্সটেবল আর আমি হাগতে গেলুম, চারিদিকে কয়েদিদের গু, জল পড়ে চলেছে কল থেকে, পোঁদ এগিয়ে ছুঁচিয়ে নিলুম। আবার হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে কয়েদিদের সঙ্গে হাঁটতে-হাঁটতে ফৌজদারি আদালত। বাবা বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে ডেকে এনেছিলেন, যিনি হাইকোর্টে প্র্যাকটিস করতেন। কলকাতার পুলিস রিমান্ড চাইছিল। বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখে জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট জামিন দিয়ে বললেন কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে আত্মসমর্পণ করতে। বসন্ত বন্দ্যোপাধ্যায় হলেন লেখিকা এনাক্ষী ব্যানার্জি আর মীনাক্ষী মুখার্জির বাবা। বাড়ি এসে নিজেকে নবীকরণ করে পৌঁছোলুম উত্তরপাড়ায়, পেছন-পেছন বড়োজ্যাঠা আর বাবা। দাদাও চাইবাসায় গ্রেপ্তার হয়ে চাইবাসা থেকে এসে পৌঁছোলো। জমায়েত দেখে, দাদা গ্রেপ্তার হয়েছে শুনে ঠাকুমার হার্ট অ্যাটাক হয়ে গেল। অন্যান্য জেঠা-কাকারা আর পিসেমশায় এসে পৌঁছোলেন। ব্যাংকশাল কোর্টে সারেন্ডার করে জানতে পারলুম দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষও গ্রেপ্তার হয়েছে। জামিনের পর আদালত বলল লালবাজারে গিয়ে প্রেস সেকশানে হাজিরা দিতে। লালবাজারে হাজিরা দিতে গিয়ে কফিহাউসে পুলিশ ইনফরমারদের কথা জানতে পারলুম, যারা হাংরি আন্দোলনের বুলেটিন বই পত্রিকা এনে-এনে জড়ো করেছে প্রেস সেকশানে। আশ্চর্য যে মুখের দিকে তাকিয়েও কেন বুঝতে পারিনি যে অমুক লোকটা, যে আমার দিকে বারবার তাকাচ্ছে সে ইনফরমার, তমুক যুবক যে আমার কাছ থেকে বুলেটিন চেয়ে নিয়ে গেল, সে পুলিশের খোচর। মামলার সময় যখন এরা কাঠগড়ায় আমার বিরুদ্ধে দাঁড়ালো তখন টের পেলুম -- তাদের নাম পবিত্র বল্লভ আর সমীর বসু। সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষের মুখের দিকে তাকিয়েও কি কখনও জানতে পেরেছিলুম যে ওরা পিঠে ছুরি মারবে। অবশ্য আঁচ করা উচিত ছিল, কেননা ওরা দুজনেই লালবাজারে ইন্সপেক্টরের হম্বিতম্বিতে কেঁদে একশা, সেই ইন্সপেক্টর অনিল ব্যানার্জি, পরে নকশাল বিনাশে নাম করেছিল। আঘাত তো লোকে করবেই, কিন্তু সব আঘাতে আদর করে হাত বোলানো যায় না। বেশির ভাগ আঘাতের দাগ দেহের চামড়ায় পুষে রাখতে হয়। মামলার সময়টা বেশ খারাপ গেছে, কলকাতায় মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না, সাসপেন্ড হবার দরুণ মামলার খরচ, যাতায়াতের খরচ আর খাবার খরচ সামলানো কঠিন হয়ে গিয়েছিল। একই শার্ট-প্যাণ্ট প্রায় পনেরো দিন অনেক সময়ে এক মাস, পরে চালিয়েছি। সবসুদ্ধ পঁয়ত্রিশ মাস মামলা চলেছিল। উত্তরপাড়ার খণ্ডহরে থাকা যেতো কেসের ডেটের মাঝে হাতে সময় থাকলে, কেননা তখন সেরকমভাবে ইলেকট্রিক ট্রেন শুরু হয়নি আর প্যাসেঞ্জার ট্রেনের কোনো নির্ধারিত সময় ছিল না। সুবিমল বসাকের জেঠার স্যাকরার দোকানে বৈঠকখানা পাড়ায় থাকতুম মাঝেমধ্যে আর হাগতে যেতুম শেয়ালদায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে, রাস্তার কলগুলো এতো নিচু ছিল যে তার তলায় প্রায় শুয়ে স্নান করতে হতো। ফলে প্রতিদিন স্নানের অভ্যাস ছাড়তে হয়েছিল। শহরে যাদের মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই তাদের কাছে সবচেয়ে বড়ো সমস্যা হল হাগা, কোথায় গিয়ে হাগা যায়। তখন তো সুলভ শৌচালয় আরম্ভ হয়নি। আহিরিটোলায় রাতে থাকতে পেলে অন্ধকার থাকতে গঙ্গার পাড় ছিল সবচেয়ে সহজ। এটা সেন্টুদার শেখানো; পিসেমশায়ের আটজন বাচ্চা আর একটা পায়খানা, গঙ্গার পাড়ে গিয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে হাগা পেলে পায়জামা বা প্যান্ট নামিয়ে হেগে নাও আর গঙ্গায় পোঁদ ঠেকিয়ে ছুঁচিয়ে নাও। হাগা পেলে হেগে নেওয়ার মতন আর কোনও আনন্দ নেই। সেন্টুদা পরামর্শ দিয়েছিল যে রাতে হোটেলে থাকার চেয়ে ভালো জায়গা হলো অবিনাশ কবিরাজ লেনের কোনো ঘরে কাউকে সারা রাতের জন্যে প্রেমিকার দাম দেয়া। কিন্তু সেখানেও তো ভোরবেলা উঠে হাগার সমস্যা। সেখানে রাত কাটালেও হাগতে ছুটতে হতো বড়োবাজারে হিন্দি পত্রিকা “জ্ঞানোদয়” এর সম্পাদক শরদ দেওড়ার মারোয়াড়ি গদিতে। এই গদিতে শুয়েও রাত কাটিয়েছি, যতো রাত বেড়েছে ততো শোবার লোকের ভিড় বেড়েছে, কেননা বাইরে থেকে যে ব্যাবসাদাররা কলকাতায় আসতো তারা মারোয়াড়িদের গদিতে শোয়া পছন্দ করতো। বাদবাকি সকলের বিরুদ্ধে আরোপ তুলে নিয়ে, ৩রা মে ১৯৬৫ আমার বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করল পুলিশ। তার সঙ্গের নথিগুলো থেকে জানতে পারলুম হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্রব অস্বীকার করে মুচলেকা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছে সুভাষ ঘোষ আর শৈলেশ্বর ঘোষ, মামলা থেকে নিজেদের বাঁচাবার জন্য। এও জানলুম যে আমার বিরুদ্ধে পুলিশের হয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর উৎপলকুমার বসু, এঁরাও নিজেদের হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সংশ্রব অস্বীকার করেছেন। উৎপল চাকরি খুইয়ে গিন্সবার্গের সুপারিশে ইংল্যাণ্ডে চাকরি পেয়ে চলে গেলেন। সুভাষ আর শৈলেশ্বর আমার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়ে ক্ষান্ত দেয়নি, একের পর এক লেখায় হাংরি আন্দোলনের ইতিহাসকে বিকৃত করে গেছে, সময়ের সঙ্গে তাল দিয়ে আমার প্রতি ঘৃণার মাত্রা বাড়িয়ে তুলেছে, এমনকি নিজের বউ-বাচ্চাদেরও এ-ব্যাপারে ট্রেনিং দিয়ে গেছে ; ফলে ওদের নিজেদের মরচে-পড়া ছোরাগুলোই অকালে রোগ হয়ে ওদের বুকে বিঁধেছে।”



    গোবিন্দ : হাংরি মামলা নিয়ে প্রচুর পরস্পরবিরোধী কথা শোনা যায়।

    মলয় : তুমি অলোক গোস্বামীর সম্প্রতি প্রকাশিত বই মেমারি লোকাল পড়ে দেখো, ব্যাপারটা অন্তত কিছুটা স্পষ্ট হবে। অলোক লিখেছেন, “অরুণেশের (ঘোষ) ব্যাগে আচমকা পেয়ে গিয়েছিলাম ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকার সেই সংখ্যাটি। কিন্তু অরুণেশদা কিছুতেই দেবেন না পত্রিকাটা, ভালো কইরে বোঝার চেষ্টা করো হাংরি ফিলজফিটারে। আগেই এই সব ল্যাখা পড়লে সব গুলায় যাবে। কিন্তু আমাকে রুখিবে কে! প্রায় জবরদস্তি ম্যাগাজিনটা কেড়ে নিয়ে কোচবিহার থেকে মাথাভাঙ্গা যাত্রাপথে ভিড় বাসের মেঝেতে বসে পত্রিকাটা শেষ করেছিলাম। এবং স্বীকার করতে বাধা নেই, সত্যিই মাথার ভেতরটা কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল। সেদিন জেনেছিলাম শৈলেশ্বর ঘোষ রচিত ‘তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি শূণ্য বিছানায়’ কবিতাটা নয় বরং মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটাকেই অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। জেনেছিলাম, হাংরি জেনারেশন মুভমেন্ট মলয়ের নেতৃত্বেই ঘটেছিল এবং কেসটাও সাজানো হয়েছিল মলয়েরই বিরুদ্ধে।”

    গোবিন্দ : হাংরিদের মধ্যে আর কারা বিদেশে গিয়েছিলেন?

    মলয় : প্রদীপ চৌধুরী বেশ কয়েকবার প্যারিসে গিয়েছিল। ভালো ফরাসি ভাষা জানতো। কবিতা লিখতো ফরাসি ভাষায়, ফরাসি কবিদের বাংলায় অনুবাদ করতো, জ্যাক কেরুয়াক সম্পর্কে ফরাসি ভাষায় বই আছে ওর। কিন্তু হাংরিদের কবিতা ফরাসি ভাষায় অনুবাদ করেনি। প্যারিসে গিয়ে বক্তৃতাও দিয়েছে। বোদলেয়ার ভেরলেনের জীবনী পড়ে গিয়েছিল যৌনকর্মীদের পাড়া লাতিন কোয়ার্টারে, সেখানে দুজন দীর্ঘাঙ্গিনী যৌনকর্মী ওর টাকাকড়ি কেড়ে নিয়েছিল; তারপর থেকে ফরাসি বন্ধুদের সঙ্গে যেতো। ও থাকতো সেই হোটেলটায় যেখানে গিন্সবার্গ, বারোজ, কেরুয়াক আর অন্য কবিরা থাকতো। প্রদীপের একটা কবিতা নিয়ে একজন ব্যালেরিনা প্যারিসের মঞ্চে ব্যালে অভিনয় করেছিলেন।

    গোবিন্দ : আপনাদের ঘটনাবহুল জীবন নিয়ে একটা হাংরি ফিল্ম হওয়া উচিত ছিল।

    মলয় : ভবিষ্যতে কেউ করতে পারে হয়তো। ইউরোপ-আমেরিকার কবি-লেখকদের নিয়ে তো হয়েছে। সুপ্রীতি বর্মণকে বলেছিলুম। উনি বললেন, প্রথমে আলোচনা করে স্ক্রিপ্ট তৈরি করতে হবে, তারপর বাজেটের ব্যাপার আছে। সুপ্রীতি বর্মণ লিখেছেন, “এটাই ওনার স্বকীয়তা। আর আমার যৌনতার শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি ওনার কবিতাসমগ্রের আলোচনা। তাই অশ্লীলতা নয় এটা একটা সাধনার মোক্ষপ্রাপ্তি আমার কাছে।” ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতার কাঠামো নিয়ে মৃগাঙ্কশেখর একটা ফিল্ম করেছে পাঁচ হাজার টাকায়, দেশ-বিদেশে পুরস্কারও পেয়েছে। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটির একক পারফরমেন্স করেছিলেন স্নাতকোত্তর ছাত্র সৌরদীপ রায়। ঢাকা নিবাসী তারেক হায়দার চৌধুরী লিখেছিলেন, “হাংরি মুভমেন্টের কথা উঠে এসেছে চলচ্চিত্রেও। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'বাইশে শ্রাবণ' চলচ্চিত্রের নিবারণ চক্রবর্তীর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? নিবারণরূপী গৌতম ঘোষকে সৃজিত হাজির করেছিলেন একজন হাংরিয়ালিস্ট কবির চরিত্রে। উদ্ধত, অহংকারী আর খ্যাপাটে নিবারণ সিস্টেম নিয়ে বললেন- একটা পচে যাওয়া সিস্টেম, প্রত্যেকটা মানুষ পঁচে যাওয়া। কয়েকটা লাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।” এই সিস্টেমের সাথে হাংরি প্রজন্মের দ্বন্দ্ব ছিল প্রকাশ্য।” তবে আমার মনে হয়, সৃজিতের ফিল্মটা হাংরি আন্দোলনকে বদনাম করেছে বেশি। হাংরিরা কেউই ওই নিবারণ চক্রবর্তী টাইপ ছিল না।



    গোবিন্দ : সবাই প্রায় সেকথা বলেন। মৃগাঙ্কর ফিল্মটা আমি দেখিনি।



    মলয় : ফিল্মটা সম্পর্কে অনুপম মুখোপাধ্যায় এই চিঠিটা মৃগাঙ্ককে লিখেছিলেন, আর তাতে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ কথা ছিল। অনুপম লিখেছিলেন, “মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে যেটা করেছে, তোমাদের ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বাংলা সিনেমার ক্ষেত্রেও সেটাই করেছে, আমার মনে হয়, তবে সেটা বুঝতে বঙ্গবাসীর সময় লাগবে। অবিশ্যি উল্টোটাই হওয়ার কথা ছিল। কবিতার তুলনায় সিনেমা অনেক তাৎক্ষণিক ফলাফল দর্শায়। কিন্তু এই সিনেমা, বাস্তবিকই, আপামরের অগোচরে রয়ে গেছে। সেটাই প্রত্যাশিত। এবং এই চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক। বঙ্গীয়, কিন্তু বাঙালি একে আমি বলব না। তোমাদের এই সিনেমাটি আদতে সিনে-কবিতা। একটি শিল্প মাধ্যম তখনই নিজেকে অতিক্রম করে, যখন তার মধ্যে আরো এক বা একাধিক শিল্পমাধ্যমের যোগসাজশ দেখা যায়, এবং সেটা সার্থক হয়। এই সিনেমায় সার্থক কবিতা হয়েছে।একটি কবিতায় আজকাল আমরা দৃশ্য ও শ্রাব্যের একটা দুর্দান্ত নাগরদোলা আশা করি, আমাদের জীবনের সঙ্গে তবেই সেটা যায়, যেখান থেকে সহসা ছিটকে পড়তে হয় না। মলয়দার কবিতাটা আমাদের ঠিক সেটাই দিয়েছিল। একের পর এক দৃশ্য, যেটাকে আমরা চিন্তার বিকল্প হিসেবে গ্রহণ করেছি। তোমরাও সেটাই দিয়েছ। কাহিনির ধার ধারোনি। আমার দেখা সবচেয়ে গল্পহীন বাংলা সিনেমা এটা। টেকনিকালি কব্জির জোর প্রতিটি শটেই দেখতে পেয়েছি। কোনোরকম স্পেশাল এফেক্ট ছাড়াই ম্যাজিক করেছে ক্যামেরা। রঙের ব্যবহার অসামান্য। ভায়োলেন্স আর সেক্স যে এই ছবিতে একবারও ভালগারিটির ধারেকাছে যায়নি, সেটাই সবচেয়ে বড় কারিগরি সাফল্য। সেক্সের ব্যবহার তো কসমিক হয়েছে। তোমার লিঙ্গ যে এমন ঈর্ষনীয়রকমের বড়, জেনে চমকে গেছি। নিজেকে এমন সাহসে সঙ্গে ব্যবহার করলে, নারী চরিত্রের বেলায় সেটা হল না কেন? একটা পেনিট্রেশন থাকলে কোনোরকম প্রেজুডিসের ধারেকাছেই থাকতে না তো! অবিশ্যি অমন অভিনেত্রী পাওয়াটাও একটা চাপ, সেটা বুঝি। আন্ডারগ্রাউন্ড সিনেমায় কেউ ওই রিস্ক কেন নেবে! তুমি নিজে যেটা করেছ।স্যালুট রইল।এই ভায়োলেন্স কি বাঙালি নিতে পারবে? আমার অনেক সময় বার্গম্যানের ‘পার্সোনা’-র সেই ওপেনিং শটগুলো মনে পড়ে গেছে। আমি চমকাইনি, তবে চুপিচুপি বলে রাখি, ব্যোমকে গেছি। এই তো চাই নন্দীগ্রামের দেশে! এই তো চাই, যেখানে পারিবারিক বা জননৈতিক দ্বন্দ্বের ফয়সালা করে দেয় অস্ত্র। যেখানে ব্লগারের রক্তে মাটি ততটা ভেজে না, যতটা আমাদের বিবেক। স্রেফ বলি, একটা অভিজ্ঞতা পেলাম। সারাজীবন যে ভুলব না, কথা দিতেই পারি। জন্মান্তরের কথাটা দিতে পারছি না। পরের জন্মে যেন এমন আত্মাকাঁপানো ছবির দরকার না হয়। যেন নতুন সত্যযুগে কম্পিত আত্মাকে সঙ্গে রেখেই জন্মাই।



    গোবিন্দ : আসামের যুগশঙ্খ পত্রিকার সাংবাদিক বাসব রায় ২০১৮ সালে পুজোর সময়ে একটা ইনটারেসটিঙ পোস্ট দিয়েছিলেন। এই যে, এটা, “বাসব রায়-এর টাইমলাইন থেকে, পোস্টের নাম “মলয়ের জায়গা”। পড়ে দেখুন। “এতে কোনো সন্দেহ নেই যে আত্মীয়-পরিজনের বাইরে আমি যাঁর নাম প্রথম শুনেছি, তিনি, মলয় রায়চৌধুরী। হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথ নন, মলয় রায়চৌধুরী। আমি যখন বড় হচ্ছি, ওই ১৯৬৬ থেকে, চারপাশে শুধু একজনের কথাই চর্চিত, তিনি, মলয় রায়চৌধুরী। ১৯৬৪ সালে মলয় নেমে আসছেন ব্যাঙ্কশাল কোর্টের সিঁড়ি দিয়ে, একা। আর ধীরে ধীরে তিনি চর্চায় চলে আসছেন কলকাতা সন্নিহিত অঞ্চলের। তখন বেহালা, যেখানে আমার ছোটবেলা কেটেছে, কলকাতার মধ্যে ছিল না। বেহালার সাবর্ণপাড়ার দ্বাদশ মন্দিরের চাতালে কিংবা শখেরবাজার মোড়ের আড্ডায় শুধুই মলয়। তো আমি মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে বড় হয়েছি বললে সম্ভবত অত্যুক্তি হয় না। ইস্কুলে যাই, সেখানে শিক্ষকরা আলোচনা করেন মলয়কে নিয়ে; ঘরে ফিরি, দাদা-কাকারা আলোচনা করেন মলয়কে নিয়ে ; একটু সন্ধ্যায় পাড়ার কালভার্টেও আলোচনার একটাই বিষয় - মলয়। মলয়-বাসুদেব-ফাল্গুনী-শৈলেশ্বর-সুবো-সুবিমল-দেবী-অবনী-প্রদীপ প্রমুখ তখন আমাদের ঘরের ছেলে। তাঁদের লেখা যেখান থেকে হোক সংগ্রহ করে পড়ছেন বয়োজ্যেষ্ঠরা। এই আবহে আমি বড় হয়েছি। আর তাই মূলধারার সাহিত্যের প্রতি কখনো আগ্রহ বোধ করিনি। ১৪-১৫ বছরের মধ্যেই আমি পড়ে নিয়েছি ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বা ‘চর্মরোগ’। এবং সেখান থেকেই এই প্রতীতী সম্ভবত জন্মে যায় যে সাহিত্য বলতে এসবই, বাস্তবতা-জীবন-অন্ত্যজ-প্রান্তিক স্বর ছাড়া সাহিত্য হয় না। এর বেশ কিছু পড়ে যখন আনন্দবাজারীয় লেখালিখি পড়তে গেছি, হাসি পেয়েছে। বাজারি আনন্দের প্রকাশিত সাহিত্য ওই সুখী মধ্যবিত্তের জন্য। সেখানে একটা কৃত্রিম ভাষা, নাটকীয় কিছু শব্দের সমাহার। সেখানে জীবন, অন্তত আমি, কখনো খুঁজে পাইনি। অথচ শিক্ষিত বাঙালি ওইসব পড়েই নিজেকে এলেমদার, পণ্ডিত মনে করেছে, করে।আর ঠিক এখানেই মলয় ধাক্কা মারেন। বাংলা গদ্যের রীতি ঠিক কী হবে তা সম্ভবত ঠিক হয়ে যায় রবীন্দ্রনাথ নোবেল পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে, যে লিখলে ওই জোব্বা পরা বুড়োর মতোই লিখতে হবে। এবং এরপর যাঁরা লিখতে এসেছেন, যেমন শরৎ-তারাশঙ্কর-মানিক-বিভূতি-শরদিন্দু থেকে হালের সুনীল-শীর্ষেন্দু-সমরেশরা, কেউ ওই গদ্যের বাইরে যেতে পারেননি। বিষয় যাঁর যেমনই হোক, গদ্যের রীতি বা ভাষার আঙ্গিক ও প্রকরণ সেই রাবিন্দ্রিক। এবং বাজার বা বাংলা সাহিত্যের কলকাত্তাইয়া প্রতিষ্ঠান এই গদ্যকেই প্রমোট করেছে। পাঠকও খুশি থেকেছেন এই গদ্য পড়ে। এর বাইরে না লেখক না পাঠক কেউই ভাবতে পারেননি। মলয় রায়চৌধুরী ঠিক এই জায়গাটাকেই ধাক্কা দিয়েছিলেন। তাঁর বহুচর্চিত কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ থেকে হালের ‘ছোটলোকের ছেলেবেলা’ লেখাতেও ওই ধাক্কা স্পষ্ট। লেখালিখিতে বাস্তবতা-জীবন যেমন মলয় রায়চৌধুরী প্রথম বাংলা সাহিত্যে এনেছেন, ঠিক তেমনই গদ্যের ভাঙচুর তাঁর লেখাতেই আমরা প্রথম দেখতে পেয়েছি। আর এজন্যই প্রতিষ্ঠান তাঁকে ব্রাত্য করে রেখেছিল, হয়তো-বা এখনও করেই রেখেছে। মলয়ের প্রথম প্রকাশিত বই সম্ভবত ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’। সেখানে মলয় কী লিখেছেন তা এখানে আলোচ্য নয়। বলার কথা হল, মলয় হাফ লিটারেট সাহিত্যিক নন, পড়াশোনা করেই লিখতে এসেছিলেন। আর সেজন্য মলয়ের লেখালিখি যতটা না আবেগের তার চেয়ে অনেক বেশি মেধাজারিত। কোনো এক সাক্ষাৎকারে মলয় জানিয়েছেন যে বৈদ্যুতিক ছুতার লিখতে লেগেছিল তিন মাস। কেন? না, প্রতিটি শব্দ অনেক চিন্তা করে বসাতে হয়েছে।‘তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম’---এই লাইন মলয়কে লিখতে হয়েছে, বাংলাভাষাকে ধাক্কা দেওয়ার জন্য। আর কে না জানে ‘ভাষাকে যে আক্রমণ করে সে-ই ভাষাকে বাঁচায়।’ মিথ্যে না বলতে কী, রক্তরস কমে যাওয়া বাংলাভাষাকে ওই মলয় রায়চৌধুরীই প্রথম আক্রমণ করেন। তাঁর সেই শক্তি ছিল বলেই প্রতিষ্ঠান তাঁকে উঠোনে প্রবেশের অনুমতি দেয়নি। বরং মলয়দের শক্তি পাঠক-সহ-প্রতিষ্ঠানকে গ্রাস করে নিতে পারে ভেবেই তাঁরা সম্মিলিত আক্রমণের সামনে পড়েন। যার ফলশ্রুতি কিছু বই নিষিদ্ধ, মামলা, মলয় দোষী সাব্যস্ত এবং তারপর ১৯৬৭ সালে মামলায় জয়।এর ফলে মলয়ের কী হয়েছে সে বিচার অন্যরা করবেন, বাংলাভাষার যে বিপুল ক্ষতি হয়ে গেল তা অনস্বীকার্য। কেননা মলয় তো বটেই, ইদানীং অজিত রায়-রবীন্দ্র গুহ-রণবীর পুরকায়স্থরা তুলে আনছেন যে নিচুতলার সংস্কৃতি, জীবনযাপনের শৈলী, আচার-আচরণ, ক্রোধ-আনন্দ, প্রেম-ভালোবাসা... অসম্ভব দরকারি ছিল বাংলা সাহিত্যে। এগুলো বাদ দিয়ে সাহিত্য যেন একেবারে ম্যাড়ম্যাড়ে। মলয় রায়চৌধুরী প্রথম এই ভাবনা এনেছিলেন বাংলা সাহিত্যে। কী? না, নিজেকে সাংস্কৃতিক জারজ ঘোষণা করে সরাসরি বলেছিলেন, অন্ত্যজ-প্রান্তিক স্বর উঠে আসা উচিত সাহিত্যে। এবং তা হবে সরাসরি। সেখানে কোনো ফাঁকি থাকবে না। আর তাই, মলয় রায়চৌধুরীর, ঠিক এই জায়গায় কাল্ট ফিগারের সম্মান প্রাপ্য।মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে অনেকেই লিখেছেন, ভবিষ্যতেও লিখবেন, মলয় হলেন বাংলা সাহিত্যের জায়মান কিংবদন্তি, যাঁকে আনগ্ন শুষে নিলেও শেষ হয় না। কবি-প্রাবন্ধিক-উপন্যাসকার যেভাবেই তাঁকে অভিহিত করা হোক না কেন, কোনোটাই মলয় সম্পর্কে শেষ কথা নয়।আর তাই একটা লেখায় সমগ্র মলয় রায়চৌধুরীকে ধরা আমি তো আমি, শিবের বাপেরও অসাধ্য কাজ! আর তাই আমি অন্য দু-একটি কথা বলি। মলয়ের উদ্যোগে হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন স্বাভাবিকভাবেই সকলে একে অচ্ছু্ৎ ঘোষণা করেছিলেন। আজ হাংরি আন্দোলনকে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী আন্দোলনের মর্যাদা পাচ্ছে। আর তাই বিখ্যাতরা যেভাবেই হোক হাংরির ঝোল নিজের কোলে টানতে ব্যস্ত। শৈলেশ্বর ঘোষ হাংরি-মামলার পর মুচলেকা দিয়েছিলেন, সবাই জানেন। পরে তিনিই হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে কলার তুলে হাঁটতে শুরু করেন, আমি দেখেছি। আপাত-ঋষি শঙ্খ ঘোষ এমনভাবে এতদিন লেখালিখি করেছেন যে হাংরি শব্দটাই শোনেননি বা শুনলে তাঁর হার্টফেল হবে। তো তিনি সম্প্রতি একটি হাংরি সংকলনে নিজের কবিতা রেখে যার-পর-নেই আহ্লাদিত। সৌজন্য শৈলেশ্বর ঘোষ। সাহিত্যিক-সততায় মলয় রায়চৌধুরীর পক্ষে আদালতে কথা বলে অনেকটা আলো পেয়েছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তো তিনিই আমাকে রেকর্ডেড ইন্টারভিউতে বললেন ২০০৬ সালে যে ‘হাংরি আন্দোলনের জন্য মলয় ঠিক আমার আমেরিকা-বাসের সময়টাই বেছে নিয়েছিল।’ তো তাতে কী হল? সুনীল, ‘আমি থাকলে ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব স্বাভাবিকভাবেই আমার হাতে থাকত।’ এখান থেকে বোঝা যায়, হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে যেভাবেই হোক নাম জড়ানোর কী আকুল প্রচেষ্টা সুনীলের! ছো... আর এই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ই কৃত্তিবাস-এ মলয়ের কবিতা ছাপাননি। সাহিত্যিক সততা আর কাকে বলে! যে কোনো আন্দোলনের একটা প্রকরণ আছে। আছে একটা স্ফুলিঙ্গ। আন্দোলনকে যত দমিয়ে রাখা হয় ততই আন্দোলনের অন্তঃশক্তি বাড়ে। আর সেটা হাংরি মুভমেন্টের ক্ষেত্রেও সমান সত্য। আজও যখন কেউ ‘ছোটলোক’-এর সংস্কৃতি তুলে আনেন কবিতায়-গদ্যে, আমরা বলি বাঃ তুই তো হাংরিদের মতো লিখছিস। এবং সত্তরের অরুণেশ, আটের অজিত রায়, নয়ের রাজা সরকার, শূন্য দশকের বিকাশ সরকার, প্রথম দশকের তিস্তা, কিংবা বেশ আগের রবীন্দ্র গুহ, নবারুণ ভট্টাচার্য (যদিও কৃত্রিম ভাষা), দেবীপ্রসাদ সিংহ, সমরজিৎ সিংহ (গদ্য), আফসার আহমেদ, দুলাল ঘোষ, অলোক গোস্বামী, এমনকি স্বপ্নময় চক্রবর্তীও ; হালের কান্তারভূষণ নন্দী, মৃণালকান্তি দেবনাথ, ধীরাজ চক্রবর্তীরাও জেনে বা না-জেনে সেই হাংরিদের লিগ্যাসি হয়ে উঠেছেন। এঁরা ভেঙে ফেলেছেন মূলধারার বাংলা সাহিত্যের যাবতীয় ফর্ম, তাঁদের লেখায় উঠে আসছে অন্ত্যজ জীবনযাপন, প্রেম, ক্রোধ, দুঃখ, আনন্দের কথা। এখানেই মলয় রায়চৌধুরী অমর হয়ে যান। শেষ কথাটা হল, আমার প্রথম সন্তান জন্মানোর পর, এক মধ্যরাতে, বউ, একটু হেসে, বলে, ‘শুধু এই ল্যাওড়াটা দিয়া তুমি বাবা হইয়া গেলা।’ ‘এসব তুমি কী বলছ!’‘কেন করতে পারলে কইতে পারুম না?’তখন আমার মলয় রায়চৌধুরীর কথা মনে পড়ল।

    মলয় : বাসব বলেছেন আমরা বাংলা ভাষায় “অপর” সাহিত্যের পথনির্দেশক।

    গোবিন্দ : দারুণ।

    মলয় : অনেক কিছু ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। গবেষকরা একত্র করছেন। ‘বর্তমান’ পত্রিকার সহসম্পাদক পার্থ মুখোপাধ্যায় যেটা লিখেছিলেন সেটা পড়ে দ্যাখো : “কোনো কোনো লেখক থাকেন সব দেশে সব কালেই, সময়ের চাপ যাঁকে/যাঁদের সইতে হয় সবথেকে বেশি --- হয়তো বা সময়ের থেকে তাঁরা বেশ খানিকটা এগিয়ে থাকেন, এগিয়ে ভাবেন বলেই। বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে, কালে তো অবস্থাটা আরো একটু বেশিই ঘোরালো, কারণ এখানে তাঁদের সামাল দিতে হয় সময়ের চাপকে এটা যেমন ঘটনা, তেমনি, সেইসঙ্গে নিজস্ব নির্মাণের প্রক্রিয়ার চাপটাও এক্ষেত্রে, বলা বাহুল্য, সমান কার্যকরী রয়ে যায়। এ দুইয়ের সমান চাপ ব্যক্তি মানুষটিকে, অর্থাৎ যিনি নিজের মতো করে ভাবতে চেষ্টা করবেন, স্রোতের সামান্য বিপরীতে হলেও দাঁড়িয়ে, তাঁকে /তাঁদের সর্বদা যে সিধে থাকতে দেয় না, অনবরত চেষ্টা করে নুইয়ে দিতে, এ আমরা প্রায়শ দেখেছি তো বটেই, দেখি ও দেখবও। দেখব কারণ, এই দেখাটাকেই বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে ঔপনিবেশিক ও তথাকথিত উত্তর-ঔপনিবেশিক ভাবনার ইতিহাস তার নিজস্ব নির্বিকার নিয়মে নির্মাণ করে থাকে। এই ভয়াবহ বিভিন্নমুখী চাপ স্ব-অভিমুখী একজন ব্যক্তি মানুষকে তুবড়ে দুমড়ে কীভাবে মাপমতন করে নিতে চায় তার নিদর্শন আমাদের চারপাশে আমরা প্রতিনিয়ত যেমন দেখি, তেমনি কাউকে কাউকে এমনো আবার দেখা যায় যিনি বা যাঁরা এই চাপকে হয়তো সর্বতোভাবে ঠেকাতে পারেন না ঠিকই, কিন্তু সেই না পারাটাকেও যে কীভাবে নিজের হয়ে-ওঠার প্রক্রিয়ার অন্তর্গত করে নেওয়া যায় তার জন্যে নিরন্তর প্রচেষ্টা, হ্যাঁ, প্রচেষ্টাই বলা যাক, চালান। তবে কিনা আমাদের এই কর্তাভজা কালে, যখন শাসকের সংস্কৃতিহীনতার সাংস্কৃতিক বারফট্টাইকেও আমাদের মানতে বাধ্য করা হয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য তথা সংস্কৃতির মূলধারা বলে, তখন, এঁদের দেখা মেলে বটে তবে কিনা হরদম মোটেই নয়। গত শতকের শেষ-সত্তর থেকে আশির দশকের গোড়ায় আমরা যখন সদ্য হাংরি প্রজন্ম সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হয়ে উঠছি তখন একটি নাম আমাদের চারপাশে সসম্ভ্রম কিছু বা ভীতির সঙ্গে উচ্চারিত হত, সে নাম মলয় রায়চৌধুরীর। তাঁর মাত্রই দু-একটি লেখার সঙ্গে (বই নয়) পরিচয় তার আগে আমাদের একেবারে যে হয়নি তা নিশ্চয় নয়, কিন্তু মূলত যেটা হয়েছিল তা হল উক্ত আন্দোলন-জনিত হইচই সম্পর্কেই ওয়াকিবহাল হওয়া। এবং যা হবার হয়, আমাদের চোখ এবং মন দুই-ই ধাঁধিয়ে যায়।তখনো ক্ষুধার্ত প্রজন্মের নামবাহী কিছু পুরনো পত্র-পত্রিকা মিলত এখানে-ওখানে। চোখ ও মন দুইয়েরই সচকিত হবার যথেষ্ট কারণ, বলা বাহুল্য, নিহিত ছিল তাইতেই। তবে যেটা ভেবে তখন সত্যিই অবাক লাগত সেটা হল, আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বলে খ্যাত অন্যান্যদের লেখা ও বইপত্র যদি বা মেলে, এমনকী কিছু পুরনো পত্র-পত্রিকাও, তাহলে এই একজনের কিছু লেখা বা বইপত্র একেবারেই মেলে না কেন!যাই হোক, মোদ্দা বিষয়টা যেটা তা হল, মলয় রায়চৌধুরী নামে ব্যক্তি-সাহিত্যিক তথা চিন্তককে তখনো আমরা চিনি না বলাই ভালো; চিনব আরো পরে, আটের একদম শেষ, না, নয়ের গোড়াতেই সম্ভবত, যখন শিবনারায়ণ রায় কলকাতায় ফিরে এসেছেন, শুরু হয়েছে ‘জিজ্ঞাসা’ নামে একটি যথেষ্টই গম্ভীর দর্শন কিন্তু আকর্ষণীয় পত্রিকা; কেবল তা-ই নয়, তাঁর সঙ্গে আমাদের মতন নেহাৎই এলেবেলে আর অপাংক্তেয়দেরও আড্ডা জমছে, মাঝেমধ্যে হলেও। এবং তখনো, আগেই বলেছি যে, আমাদের হাতে এসে পৌঁছয়নি ‘মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর’; সে বই ১৯৮৫ সালে বেরোলেও আমরা অন্তত পড়িনি তখনো। জানতামও না ইকনমিকসে স্নাতকোত্তর মলয় ব্যাঙ্ক নোট পুড়িয়ে নষ্ট করার জীবিকা দিয়ে আরম্ভ করে ঢের দিন হল গ্রামোন্নয়ন বিশেষজ্ঞের চাকরিতে কেবল যোগই দেননি, সেইসূত্রে বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে গাঁয়ে–গঞ্জে চাষি-জেলে-তাঁতি-হস্তশিল্পীদের সঙ্গ করেছেন শুধু নয়, সবথেকে বড় কথা, ভারত বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ নামে ভূখণ্ডটিকে হাতের তালুর মতো চেনবার সুযোগ পেয়েছেন --- যা যতদিন যাবে ছায়া তো ফেলবেই, সেই সঙ্গে তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেবে (ও নিয়েছে) ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’, ‘জলাঞ্জলি’, ‘নামগন্ধ’, ‘রাহুকেতু’-র মতো উপন্যাসের পাশাপাশি এমনকী ‘নখদন্ত’ বা ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’-র মতো স্তরে স্তরে, আঙুল দিয়ে দেখিয়ে-চিনিয়ে দেওয়া যায় এমনভাবে বিন্যস্ত অথচ আপাত-এলোমেলো গ্রন্থরাজিও --- যা আমাদের সযত্ন-লালিত সাহিত্য-সংস্কৃতি তো বটেই, এমনকী আমাদের রক্তের অভ্যন্তরে প্রোথিত থাকা গোটা হয়ে-ওঠার ঔপনিবেশিক ও উত্তর-ঔপনিবেশিক জীবনধারণারও শিকড় অবধি আমূল নড়বড়ে করে ফেলার স্পর্ধা দেখাবে।এবং কথা হচ্ছে, এইটা করতে গিয়ে তিনি, মলয়, আদ্যন্ত যেটা করেন/করেছেন তা হল, নিজের সময় ও সমকালকে তো বটেই, এমনকী নিজের সামাজিক অবস্থানকেও সেই সঙ্গে, কতকগুলো মূল প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন, যা একই সঙ্গে আমাদের, পাঠকদের মনোসামাজিক ভিতকেও কাঁপিয়ে দিয়েছে। যেমন ধরা যাক, মলয় কেবল নিজেকে কালচারাল বাস্টার্ডই বলেননি, প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে গোঁড়া ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মেও আত্মজীবনীর পাতায় নিজের পরিবারের এমন কিছু বাঁক তুলে দিয়েছেন যা অবশ্যম্ভাবীভাবে সঙ্গেসঙ্গেই ঔপনিবেশিক মনোসামাজিক ভূমিতে আজন্ম লালিত পারিবারিক ধারণার কেন্দ্রে গিয়ে আঘাত করে (যেমন, ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’-য় সটান বলে দেওয়া, যে, তাঁর জ্যাঠতুতো ভাই তাঁর জ্যাঠামশাইয়ের নিজের ছেলে নয়, তাকে এক বেশ্যার কাছ থেকে কেনা হয়েছিল। কুলসম আপার ঘটনাটাও অবশ্যই এই পর্যায়েই পড়বে।) ; এবং করে যেহেতু, ফলে সব মিলিয়ে তাঁকে বাংলা সাহিত্যের মূল ধারায় আজও ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। কেবল তা-ই নয়, এর অভিঘাতেই ২০১৫-তে এসেও মলয়কে জানাতে হয়, ‘এতকাল পাঠকরা আমার বইপত্র খুঁজেও পেতেন না। তাঁদের দৃষ্টিতে আমার মামলাটাই জীবন্ত ছিল।’ বা আশির দশকের শেষের পর্বেও তাঁর অভিজ্ঞতা বলে, ‘কলকাতার সম্পাদকরা ভয়ে সিটিয়ে থাকত, ওই অশ্লীল কবিতার ভয়ে...’ একদিকে অবস্থা ছিল এই, আবার অন্য দিকে ক্ষুধার্ত প্রজন্মের এমন একটা বাজার তৈরি করে তোলে যেখানে মলয় কী বলেন বা ভাবেন নয়, বরং আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়ায় তাঁদের একদা কর্মকাণ্ড বা ওইসব তথাকথিত-যৌন অনুষঙ্গগুলি, যেগুলি মলয়রা সেদিন তাঁদের কবিতায়/লেখায় ব্যবহার করছিলেন। এই দিকটিকেই ফণিশ্বরনাথ রেণু হাংরি মামলা চলার সময় মলয়ের কাছে চিহ্নিত করেছিলেন এইভাবে যে, ‘এই যে তোমার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নিয়ে অবসিনিটি আর সাবভারশানের মামলা আরম্ভ হল তো, তুমি দেখবে তুমি ক্রমশ ওই অশ্লীলতার জন্যই পাঠকদের সঙ্গে অ্যাসোসিয়েটেড হয়ে যাচ্ছো ; শুঁটকি মাছের গন্ধ আমাদের ভালো লাগে, টাটকার থেকেও বেশি টানে।’ বা গিন্সবার্গ বলেছিলেন, ‘এত কবিতা লিখছি, তবু সবাই কবিতার চেয়ে আমি কী করে বেড়িয়েছি তাতে ইন্টারেস্টেড।’ স্বাভাবিক। স্বাভাবিক যে-মানসিকতা উপরিউক্ত এই বাজারটা নির্মাণ করে তিলে তিলে, করে এবং শৈশব থেকেই আমাকে-আপনাকে ঝুঁটি ধরে তার অধীনে নিয়ে গিয়ে ফেলে প্রশ্নাতীত ক্ষমতার আঙুলে, তার দৃষ্টিকোণ থেকে। কেউ কেউ বলবেন হয়ত এখন অবস্থা বদলেছে, অন্তত উপরের দিক থেকে হলেও খানিকটা, কিন্তু বাংলা কবিতা বলুন বা গদ্যের মূল যে ভাবনাধারা, তার ক্ষেত্রে সে বদল, পাঠক জানেন, তা-ও ওই ওপর ওপর, এবং ওই খানিকটাই। হ্যাঁ, আর তাই এখন আর মলয়ের লেখাকে সেই অর্থে অশ্লীল হয়ত বলা হয় না ঠিক কথা, কিন্তু মলয় কি সেই অর্থে আবার যাকে বলে বহুলপঠিতও বটে? এখনও? না হলে, কেন নন?নন কারণ, মলয় কিন্তু সেই অর্থে যাকে বলে সাহিত্য/লেখালেখিকে দেখার যে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে নির্মাণ করে দেওয়া অ্যাটিট্যুড, যাকে আমাদের দেশে আমাদের তদবধি প্রচলিত দেখার চোখকে ধ্বংস করে সেই উপনিবেশ পর্বের গোড়াতেই তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল, এবং যত দিন গেছে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যা কিছু সামান্য বিবর্তিত হয়েছে মাত্র, এবং একই সঙ্গে বিশেষ করে দাঁতে-নখে আরো আক্রমণাত্মক ও সার্বিক হয়ে উঠেছে, তাকে মান্য করে নিজের রচনার ভাবনা কাঠামোকে নির্মাণ করেননি/ করেন না। বরং আমরা যে প্রশ্নের কথা বলছিলাম, তাকে সেই প্রশ্নেরই সম্মুখীন করে দেন। যে ভূমি থেকে ২০১৭-তে এসেও তিনি এরকম বলেন যে, ‘আমি মূলত সমাজের পর্যবেক্ষক এবং নিজের মতামত উপস্থাপন করি।’ কেবল তা-ই নয়, এই জায়গা থেকেই আরো বলার যে, মলয়ের উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা সমূহ বিপজ্জনক ; কারণ, মলয় যা লেখেন তার অনেকটাই বিস্ফোরক রকম ইন্সটিঙ্কটিভ। তাঁর লেখা, তা সে যে গোত্রেরই হোক, স্পষ্ট একটা রক্তান্তর্গত রাজনৈতিক মতামত বহন করে। এবং এই বহন করাটাকে মলয়, আরো অনেকের মতো, ভাষার আচ্ছাদনে আড়াল তো করেনই না, বরং, সেই ভাষার অস্ত্রেই, তাকে হা-হা রকম হাটখোলা করে মেলে ধরেন। আর এটা তিনি করেন যেহেতু নিজের ইন্সটিঙ্কটে নিহিত রাজনৈতিক অবস্থান থেকেই, নিজস্ব নির্মাণের পাথেয়, কিম্বা বলা যাক উপাদান তিনি যেহেতু সংগ্রহ করে নেন এর অভ্যন্তর থেকেই, ফলে, ১৯৯৫-এ কলকাতায় এই নিবন্ধকারের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তাঁর সটান ছোবল তুলতে বাধে না, যে, ‘কে প্রলেতারিয়েত? তুমি, না যারা এটা পড়বে--- কারা? যাদের বাড়ির ভেতরেই পায়খানা থাকে, তাদের প্রলেতারিয়েত বলা যায় না।’ কেবল তা-ই নয়, নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তাঁকে ভুরু কুঁচকে বলতে হয়, ‘বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারগুলো, যিনি বা যাঁরা সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, তা একটা বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থন যোগাবার জন্যে নেওয়া... প্রায় সবই মোটিভেটেড। সকলেই মোটামুটি একটা হাংরি ইমেজ নির্মাণ বা অবিনির্মাণের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করেছেন। ...অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাঁরা, সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা, নিজেদের ডিসকোর্সকে জায়গা করে দিতে চেয়েছেন।’ অর্থাৎ মলয় চিহ্নিত করেছেন কীভাবে তাঁর পরের প্রজন্ম, তৎকালীন সময় থেকে দূরে/পরিবর্তিত কালে বসেও, অন্তর্গত সামাজিক-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণের চাপের সৃষ্টি হিসাবে সেই সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানের স্বার্থকেই বজায় রাখবার দায় থেকে গৃহীত হাংরি ইমেজকে খাড়া রাখবার বাধ্যতামূলক দায়িত্ব পালন করছে যেমন একদিকে, তেমনি অন্যদিকে হাংরি আন্দোলন নামে এক বিস্ফোরণের চরিত্রকেও এই ক্ষমতার চোখ এবং মন দিয়েই দেখতে ও পড়তে মগ্ন থাকছে। এই অবস্থা ও অবস্থানের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারাকে মলয় বলছেন পীড়া, যে পীড়াকে, মলয়ের স্পষ্ট বক্তব্য, ‘শেয়ার করা যায় না।’ এবং শুধু তা-ই নয়, এই পীড়াই তাঁকে যে এম আর চোওধারি নামে আরেক অস্তিত্বকেও খাড়া করতে বাধ্য করেছে তা-ও মলয়ের বয়ানেই আমরা জানতে পারছি। এটা একটা দিক, আর অন্য দিকে এই এখান থেকেই জাত হয় সেই পরিস্থিতি যেখানে মলয় বলেছেন, ‘গ্রহণ-বর্জনের বৈভিন্ন্যের নিরন্তর টানাপোড়েনে পাঠকৃতি-বিশেষ তার নিজের পরিসর অহরহ গড়ে নিতে থাকে। তার কিনারায় গালে হাত রেখে বসে থাকা ছাড়া আমার কিছু করার নেই।’ এবং এইখানেই মলয় নিজের জন্যে ‘ফালচার’-শীর্ষক এক বর্গ নির্মাণ করে নেন --- যার গভীরে নিহিত থাকে একটা ‘ইরর‍্যাশন্যালিটি’, যাকে আবার নির্মাণ করছে, মলয় বলছেন, ‘পাশাপাশি মিশনারি স্কুল আর ব্রাহ্ম স্কুল’-এর যাদু-বাস্তবতা --- যে বাস্তবতাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে মলয় লিখছেন, ‘আমাদের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ ছিলেন, ব্রাহ্ম বলে। পিরিলি বাউনদের বজরা উত্তরপাড়ার গঙ্গায় ভাসলে স্নান অর্ধসমাপ্ত রেখে ঠাকুমার পালকি ফিরে আসত। সিনেমা দেখা নিষিদ্ধ ছিল কেননা তা লোচ্চাদের তামাসবিনি।’ এবং এইখানেই ‘প্রাক-ঔপনিবেশিক সাবটেরানিয়ান এথনিক বাঙালিয়ানা’ আর মিশনারি স্কুলের মূল্যবোধের মধ্যে সংঘাতটা বাধে, এবং মলয়ের রক্তান্তর্গত রাজনীতির ভাবনা-বিশ্ব তথা দেখার-চোখ গড়ে ওঠে। এই দেখার চোখটাই তাঁকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এর মতো লেখা, ‘শয়তানের মুখ’ বা ‘জখম’-এর মতো হাড় অব্দি চমকে দেওয়া কাব্যগ্রন্থ, ‘নপুংপুং’,’ইল্লত’,’হিবাকুষা’-র মতো নাটক বা রাজনীতি ও ধর্ম নিয়ে ম্যানিফেস্টোগুলি, যা মলয় রায়চৌধুরী নামক ব্যক্তিটিকে রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর্ণধারদের বিপরীতে গলিয়াথের বিরুদ্ধে ডেভিডের মতো বিপজ্জনক অবস্থানে দাঁড় করিয়ে অশ্লীলতার সঙ্গে সঙ্গে স্বাধীনতার পর প্রথম একজন কবির বিরুদ্ধে রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের মামলা/তকমা ঝুলিয়ে দেয় (সে অভিযোগ অবিশ্যি পরে তুলে নেওয়া হয়েছিল। তবু)। এবং সম্ভবত এইখান থেকেই অদ্যাবধি মলয়ের বই যত না, বেশি আলোচিত হয়েছেন মলয় নিজে—হয়েছেন কারণ, মলয় যে নিজেকেই লেখার বিষয় করেছেন। করেছেন নিজের সামান্য-টিল্টেড দেখার চোখকেই, যে চোখ দ্যাখে ‘কোরা মার্কিন কাপড়ের পুঁটুলিতে রাজপথ থেকে ছেঁকে তোলা মানবলাবণ্য’ (মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর ) বা যে চোখের দৃষ্টিশক্তির অভ্যন্তরে নিহিত থাকে ‘গহ্বরতীর্থের কুশীলব’ কিম্বা ‘ঘোগ’-এর ভাষা-বাস্তবতার শিকড়। বিষয়কেন্দ্রহীন মুক্ত সূচনা ও মুক্ত সমাপ্তির মধ্যবর্তী পর্বে লজিক্যাল সিকোয়েন্স-বর্জিত ছেঁড়া ছেঁড়া চিত্রকল্পে গেঁথে তোলা এই যে সব পাঠবস্তু, যাদের হাঁ-মুখে নির্বিচারে ঢুকে যায় দলা পাকিয়ে ওঠা রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি মথিত আমাদের গোটা সমসময়, যার সম্মুখবর্তী না হলে বোঝাই যায় না কেন, কোন জায়গা থেকে বাজার নামক প্রধান ডিসকোর্সের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মলয় বলেন তিনি কবিতাকে, লেখালেখিকে জীবনে ফিরিয়ে দিতে চান ( অনেকটা ক্ষেত্রে দিয়েওছেন। অন্তত ‘যে জীবন ফড়িংয়ের দোয়েলের’, ‘ভালোবাসার উৎসব’-এর মতো লেখা বা ধরা যাক ‘রাহুকেতু’-র মতো উপন্যাসটি পড়ে উঠলে বেশ টের পাওয়া যায়), এবং কেন আজও মলয়ের লেখালেখি নিয়ে যে কোনো আলোচনার কেন্দ্রে ঘুরেফিরে এসে যায়ই হাংরি প্রসঙ্গ এবং তৎসংক্রান্ত ডিবেটগুলি, যা, নিহিত উত্তেজনার কারণেই অনেকটা, মুহূর্তে পাঠকের নজরের লক্ষ্যবিন্দুকে গ্রাস করে এমনকী যখন স্বয়ং মলয় বলেই দিচ্ছেন যে তিনি মলয় রায়চৌধুরী হিসেবেই পরিচিত হতে চান, হাংরি বা অ-হাংরি হিসেবে নয়, তখনো গোটা আলোচনাটিরই ভরকেন্দ্রকে, ক্ষমতার ইচ্ছে/স্ট্রাটেজি-মতো, বাধ্যতামূলক ভিন্নমুখী করে দিয়ে। মলয় রায়চৌধুরীর লেখালেখি সম্পর্কে তা-ই আপাতত কথা রয়ে যায় একটাই, যে, তিনি আমাদের মানসিকতার গভীরে বাজারি আঙুলে আমূল প্রোথিত করে দিতে চাওয়া মানসিকতাটাকেই প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে তার প্রেক্ষিতেই নিজেকে যাচিয়ে দেখতে চান। এই চাওয়াটাই মলয়কে প্রতি মুহূর্তে যেমন সমকালীন রাখে, বিপজ্জনক হিসাবে প্রতিভাত করে, তেমনি আদ্যন্ত সচেতন নিজস্বতায় জারিতও করে নিঃসন্দেহে। তাঁর গল্প-উপন্যাস বলুন বা কবিতা, নাটক কিম্বা কাব্যনাট্যগুলি, সাক্ষাৎকার ও প্রবন্ধ অথবা আত্মজীবনী --- সবের মধ্যেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মিশে থাকেন সেই মানুষটি, উত্তর-ঔপনিবেশিক আধুনিকতার বিষ-আঙুল যাঁর ভাবনা-কেন্দ্রে কোনো রদ-বদলই ঘটাতে পারেনি, বরং নিজেই সামান্য হলেও বদলে গেছে --- এই যা!

    গোবিন্দ : চমৎকার মূল্যায়ন।

    মলয় : ২০১৮ সালে জ্যোতির্ময় মুখোপাধ্যায় আমার জাদুবাস্তব গল্প ‘জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা’ আলোচনার সময়ে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ মারফত আমার ক্ষতিকর ব্র্যাণ্ডিং নিয়ে একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন। সয়ে যাবার পর ভাবলাম, জিন্নতুলবিলাদের রূপকথা নামের কাহিনির বুনন ও বাঙালি ‘পলিটি’ সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরীর ভাবনাচিন্তা নিয়েই লিখি। মুসলমান শাসকরা বঙ্গদেশকে বলতেন জিন্নত-উল-বিলাদ। অর্থাৎ মর্ত্যের স্বর্গ। কিন্তু গল্পের প্রেক্ষাপট অখণ্ড বাংলা নয়, মূলত পশ্চিমবঙ্গকে নিয়ে। উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থনৈতিক, প্রসাশনিক, শিক্ষাব‍্যবস্থা ইত‍্যাদির কঙ্কালটা চোখের সামনে ঝুলিয়ে দেওয়াই মলয়ের ঝুলির এই আড়ালে অরূপকথনের লক্ষ্য।‘যাতুধান তরফদার…. এই দেশের এক অতি বৃদ্ধ শকুন, এককালের বিশাল পরিবারের অভিজ্ঞ কুলপতি, যার পরিবারে যুবক নাতি শিলাদ ছাড়া আর কেউ বেঁচে নেই।’…….উত্তর-ঔপনিবেশিক পশ্চিমবাংলায় ক্রমশ ভেঙে পড়ছে একান্নবর্তী পরিবারগুলো। টুকরো টুকরো হয়ে পড়ছে পরিবারগুলোর গঠন ও সামাজিক দায়দায়িত্ব এবং মূল‍্যবোধ। যৌথ-পরিবারের শেষ উত্তরাধিকারী মলয় রায়চৌধুরীর কি দীর্ঘশ্বাস পড়েছে যাতুধান তরফদারের বুকের বিদার থেকে? তাঁর ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ কি প্রতিফলিত এই অরূপকথনে? জানি না। কিন্তু প্রাক-ঔপনিবেশিক সাবটেরানিয়ান এথনিক বাঙালিয়ানা যে আর সম্ভব নয় সেটা মলয় রায়চৌধুরীর’ বিভিন্ন প্রবন্ধে আমরা পড়েছি। খোপ-বাড়ির খোপে খোপে বাস করা বাঙালির চিন্তা জগতেও যে দৈন্যতা প্রকট হয়ে উঠেছে এই ব‍্যাপারেও মলয় রায়চৌধুরী তাঁর প্রবন্ধগুলোতে বিশ্লেষণ করেছেন, বিশেষ করে তাঁর ‘উত্তরদার্শনিকতা’ প্রবন্ধে। মলয় রায়চৌধুরী, স্বীকার করেন যে, লেখালেখি ঘরের দরজা জানলা এঁটে সাধনা নয়। মানুষ ও সমাজবর্জিত হয়ে চিন্তাজগতে ঢেউ তোলা নয়। তাতে সাহিত্য খন্ডিত বা একপেশে হয়ে পড়ে, তাতে আর যা হোক সমাজের আসল চিত্রটি প্রতিফলিত হয় না। লেখক-শিল্পী যত মানুষের সাথে মিশবেন, যত সমাজের আনাচে কানাচে পৌঁছাবেন তত পুষ্ট হবে তার অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতার ইরিটেশনেই নির্মিত হবে সাহিত্য, শিল্প। মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে উৎপলকুমার বসু লিখেছেন যে, ‘বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল। তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণকারী প্রবণতা লক্ষ করি। কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন — “লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে।” বলা বাহুল্য, তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি। তিনি বলেছেন, “পলিটি”-র কথা। আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব — মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন।’ ‘জিন্নতুলবিলাদ’ সম্পর্কিত কাহিনি জুড়েই লেখকের এই অভিজ্ঞতা বা শিলাদের মাধ্যমে তাঁর রাজনৈতিক মননের জার্নিটা স্পষ্ট। জল-স্থল-অন্তরীক্ষ, দিন-রাত, জঙ্গল-নদী, আন্ডার গ্রাউন্ড-মাল্টিপ্লেক্স, বেশ‍্যাপল্লী-ক্লাসরুম ইত্যাদি সময় পরিবেশ ও অবস্থানের যে বর্ণনা আমরা পাই এবং তার সাথে সাথে যেভাবে পাল্টে যাচ্ছে মানুষের প্রকৃতি তা যে মোটেই ভাববিলাসে লিখিত নয়, এইটুকু স্পষ্ট বুঝে নেওয়া যায়। ঘটনা, পরিবেশ ও চরিত্রের এই নিঁখুত নির্মাণ বা শার্পনেস্ স্পষ্ট করে দেয় যে এ সবই লেখকের অভিজ্ঞতালব্ধ। আমরা জানি যে গ্রামোন্নয়ন অফিসারের চাকুরিতে তিনি প্রায় চল্লিশ বছর ভারতের, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার, গ্রামে-গঞ্জে চাষি, তাঁতি, জেলে, ছুতোর, খেতমজুর ইত্যাদি মানুষের জীবনযাত্রা খুব কাছ থেকে দেখেছেন। গল্পকার উত্তরঔপনিবেশিক বাঙালির বাস্তবজীবনকে অনবরত স্ক‍্যানিং করে গেছেন। পাঠবস্তু নির্মাণে তাই কোনো বাছবিচার নেই। নেই নেকুপুসু মার্কা শ্লীল-অশ্লীলের দ্বন্দ্ব। গল্পের সাবজেক্ট পজিশনেও তাই বহুত্বের যথেচ্ছাচার স্পষ্ট। গল্পের হাঁ-মুখে সেঁধিয়ে গেছে বিজ্ঞান, ইতিহাস, ভূগোল, রাজনীতি, সমাজ, ধর্ম, শিক্ষা, সন্ত্রাসবাদ, যৌনতা ইত্যাদি। অনায়াসে সবকিছুকে আত্মসাৎ করে নিয়েছে পাঠবস্তুটি। কখনো পাশাপাশি আবার কখনও বা একটার সাথে আর একটা পেঁচিয়ে পেঁচিয়ে অবস্থান করছে। পাঠককে যে সবসময় পাকগুলো খুলে খুলে পড়তে হবে এমনও নয়। পাঠবস্তুটি সবকিছু গলাধঃকরণ করে নিজেই একটা আলাদা সাবজেক্ট-বহুত্ব গড়ে তুলেছে। সবজিগুলো তাই তাদের একই খেতে উৎপাদিত হয়েই খুশি। অথচ কনট্রাস্টটি হলো পাঠবস্তুটি যখন বহুধায় বিভক্ত তখন শিলাদকে সামনে রেখে গল্পকার মলয় রায়চৌধুরী নির্মাণ করে গেছেন ব‍্যক্তির নিজস্বতা বা ইউনিকনেস। একদিকে গল্পের কৌম-পরিসর বাড়িয়েছেন, খুলে দিয়েছেন পাঠবস্তুকে। অপরদিকে ব‍্যক্তিকে একক হিসাবে ধরে ব‍্যক্তির ভালোলাগা, মন্দলাগা, সাদা কালো ধলো দিয়ে নির্মাণ করেছেন ব‍্যক্তির নিজস্বতা। সামাজিক জীব হয়েও ব‍্যক্তি এককের নিজস্বতা বা ইউনিকনেস নির্মাণের চেষ্টা চালিয়ে গেছেন পুরো অরূপকথন জুড়ে। .যৌনতা এবং জাতিপ্রথার দ্বন্দ্ব এসেছে এভাবেই, স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত। জীবনের অংশ হিসেবে নয়, সমাজের সদস্যদের জীবনযাপনের অবিচ্ছেদ্য ক্রিয়া হিসাবে। ইয়েস্ দ‍্যাট্ .স্বমেহনকে মলয় রায়চৌধুরী একবারো যৌনক্রিয়ার মধ্যে ফেলেননি। এটা আমার বেশ আবাকই লেগেছে, বরঞ্চ মাছ-শিলাদ খোঁজ করছে সমকামী সঙ্গীর। ‘মাছসমাজে সমকামের গোপন গোষ্ঠীটার সাকিন-ঠিকুজি জানলে কিছুটা অন্তত দুঃখামৃত বেরিয়ে যেত।’ যৌনতা নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর এই দ্বিধাহীন স্পষ্ট ও বহুরৈখিক ভাবনার পরিচয় পাই হাংরি আন্দোলনের সময় থেকেই। তার বিখ্যাত কবিতা ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’-এই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত যৌনচেতনা। এই কবিতাটির উপর অশ্লীলতার অভিযোগ উঠেছিল। যদিও আমার মনে হয় প্রশাসনের কাছে এই অশ্লীলতার অভিযোগটি করার উদ্দেশ্য ছিল যেনতেন প্রকারেণ একটা অভিযোগ খাড়া করা। কোমরে দড়ি বেঁধে ঘোরানোর মানসে করা দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ধোপে টিকবে না দেখে, এবং সেই অভিযোগটা আদালতে এনে ফেললে নিজেদেরই নিম্নদেশ বস্ত্রহীন হবে দেখে, অশ্লীলতার অভিযোগটিকেই ভেসে যাওয়া খড়খুটো হিসাবে ধরা। যদিও এই অভিযোগটিতে মলয় রায়চৌধুরীর লাভ হয়েছিল প্রচুর, ও ক্ষতিও। মামলা চলাকালীন সময়ে মলয় রায়চৌধুরীর নিঃসঙ্গে, কপর্দকহীন, অসহায় ও অসহ্য জীবনের কথা মাথায় রেখেও বলব এই অভিযোগ রাতারাতি মলয় রায়চৌধুরীকে হেডলাইন বানিয়ে ফেলেছিল। দেশে ও বিদেশেও। এই একটি কবিতা মলয় রায়চৌধুরীকে খ‍্যাতির চূড়ায় টেনে তুলেছে, তাঁকে মিথ বানিয়ে তুলেছে। এই ব‍্যপারটা আমরা সবাই জানি, নতুন করে আর কিছু বলার নেই। হাংরি আন্দোলন ও ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নিয়েও কোনো একদিন আমার মতামত লিখব কোথাও। দীর্ঘ প্রস্তুতি ও চিন্তা ভাবনা সত্ত্বেও কীভাবে একটা ছোট্ট ভুল এক আলোকবর্ষ দূরত্বের ঠিকানা খুঁজে নিয়েছিল বলব সেটাও কোনো একদিন। কিন্তু আমার মনে হয়েছে গ্রেপ্তারি ও কবিতাকেন্দ্রিক মামলা, এই ঘটনাটি মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষতিও করেছে প্রচুর এবং করে চলেছে আজও। ব‍্যক্তি মলয় রায়চৌধুরীর কথা অনুমান করতে পারি, কিন্তু সৃষ্টিশীল মলয় রায়চৌধুরীর ক্ষতিটা অপরিসীম। মলয় রায়চৌধুরীকে মিথ বানিয়ে আর ওই একটি কবিতাতে মগজ নয় শুধু হাত সেঁকেই মলয় রায়চৌধুরীকে পাঠক-পাঠিকারা স‍্যালুট ঠোকে বারংবার। এই প্রসঙ্গে জিন্নতুলবিলাদে একটি চরিত্রের উক্তি প্রসঙ্গিক: ‘আমাকে কেউ শ্রদ্ধাভক্তি করে না, ওরা জাস্ট আমার কংকালটাকে ভয় পায়। কেননা কংকালটা হল আমার রাজনৈতিক জীবনের কিংবদন্তি।’ মলয় রায়চৌধুরীর রচনাগুলোর আগে-আগে ছোটে ওনার কিংবদন্তি। অথচ ওনার লেখা পড়ে যেটুকু বুঝেছি, প্রায় শতাধিক বই আছে ওনার, উনি বারবার চেয়েছেন বা মনে করেন, লেখক নয়, রচনা-বিশেষের গুরুত্ব থাকা উচিত পাঠকের কাছে। অথচ ওনার ক্ষেত্রে ঘটে ঠিক উল্টোটাই। সাধারণ পাঠক-পাঠিকা ওনার অন্য লেখা পড়েন না বা পড়তে চান না, ওই একটা কবিতা দিয়েই দূর থেকে মেপে নিতে চান মলয় রায়চৌধুরীকে। অথচ যখন তিনি বারবার বদলে ফেলছেন তাঁর গদ্যের ডিকশন, কবিতার ফর্ম, সিরিয়াস পাঠক ছাড়া খেয়াল করেন না সেটা।একইসাথে ধর্মের নামে নষ্টামিকে তুলে ধরতেও তিনি পিছহাত নন। ধর্মকে নিয়ে ঠাট্টা বিদ্রুপও করেছেন অনায়াসে। অবলীলায় আঘাত করেছেন ধর্মের অচলায়তনে। ‘ওকে পোড়ালে ও হিঁদু হয়ে যেত আর পুঁতে দিলে মোচোরমান, তাই ওকে ওভাবে ফেলে দিয়েছে। ওর মড়া বদ-ভাবনার বাতাসে ভরা, খেলেই তোর বায়ু রোগ হতো। আর উড়তে পারতিস না।’ অবশ্য ধর্মের নামে বিভিন্ন অমানবিক অনাচারের বিরুদ্ধে তিনি চিরদিনই সোচ্চার। হাংরি আন্দোলনের সময়েও তাই দেখি আলাদা ভাবে ধর্ম নিয়ে ইশতাহার। শিলাদকে তার দাদু বলছে, ‘এই যে শঙ্কর, রামানুজ, বল্লভাচার্য, শ্রীধরস্বামী, নিম্বকাচার্য, মাধবাচার্য, কেবলভক্তি, বলদেব বিদ্যাভূষণ, মধুসূদন সরস্বতী, ওনারা তো তোর-আমার জন্যে ভগবানের কথা ব্যাখ্যা করেননি; করেছেন নিজেদের আর চেলাদের জন্যে।’ এইভাবেই ধর্মের মুলো ঝুলিয়ে চলছে অবিরত ধর্মের গুরুঠাকুরদের ব‍্যবসা। বংশপরম্পরায় বসে খাওয়ার সুবন্দো‍বস্ত। রাজতন্ত্র আর ধর্ম চিরদিনই হাতে হাত মিলিয়ে হেঁটেছে। একজন আর একজনকে পুষ্ট করে ক্ষমতা বাড়িয়েছে দুজনরেই, যাতে নিশ্চিন্তে ভোগবিলাসে দিন কেটে যায় এবং রাত। ‘লর্ড মাত্রেই তাদের পি.এ., পি.এস., স্ত্রী ছেলে মেয়ের জন্যে অনেক কিছু করে, যাতে তারা কয়েক পুরুষ বিলাস বৈভব ক্ষমতায় থাকে।’ এই কথাটি এখনকার রাজনৈতিক নেতাদের জীবনের সত্য। টকে যাওয়া রাজনীতি আর সমাজের পচনশীল শবগুলোর ভিতরেও গলা পর্যন্ত ঢুকিয়ে দিতে তাঁর আপত্তি নেই। ছিঁড়ে ছিঁড়ে টেনে আনেন বঙ্গসমাজের পচা-মাংসের টুকরো, পচে-যাওয়া নাড়িভুঁড়ি। এখানে ‘অপার্টি’ শব্দটির প্রয়োগ বিশেষভাবে লক্ষ্যনীয়। তুমি আমার দলের নও, মানে তুমি ‘অপর’, দি আদার। বিরোধী পার্টি আবার কী বস্তু? খায় না মাথায় দেয়? সংসদীয় রাজনীতিতে বিরোধী দলের গুরুত্ব অপরিসীম, কে বলল? ওসব বইয়েতে লেখা থাকে, বাস্তবে নয়। ‘সেই থেকে ফিবছর মেমননের স্মৃতিতে একদল পাখি জেতে আর আরেকদল হারে।’ সুবিধাবাদী রাজনীতির মুখোশ খুলেছেন তিনি অনায়াসেই। ‘এই যেমন কাশ্মীরে বোমাবাজদের সম্পর্কে যে ধরনের ভাষ্য দেয়া হয়, ত্রিপুরার বোমাবাজদের সম্পর্কে তার চেয়ে গরম ভাষ্য দেয়া হয়। কেননা ত্রিপুরায় ভাষ্যকারের মেসো-জ্যাঠা-কাকা-মামা থাকে। কাশ্মীরে ভাষ্যকারের কেউ থাকে না।’

    সংবাদমাধ‍্যমের দ্বিচারিতা, নিজেদের লাভের কথা মাথায় রেখে মিথ্যা খবর তৈরি করাকেও তিনি মোটেই ভালোভাবে নেননি। ‘আপনার অবৈধ প্রেম যাতে ব্রেকিং নিউজ হয় তার জন্যে নিউজ চ্যানেলদের বলে দেব, সে বাবদ এক্সট্রা দিতে হবে না, বিজ্ঞাপন থেকে কভার করে নেব।’হাংরি আন্দোলনের সময় দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগটা চেপে গিয়ে অশ্লীলতার অভিযোগটা সামনে আনা। হাংরি মানে যে কবি ও কবিতার (সৃষ্টিশীলতা) সর্বগ্রাসী ক্ষুধা, সর্বগ্রাস, অনেক দিন খেতে না পাওয়া মানুষের মতো গোগ্রাসে খেয়ে ফেলা সবকিছুই, খাওয়ার নিয়ম নীতি শিষ্টাচার কিছুই না মেনে। কবিতার পাঠবস্তুটি কখনো কোনকিছুতে বাছবিচার করবে না, তার প্রকান্ড হাঁ-মুখে তলিয়ে যাবে সবকিছুই। থাকবে না কোনো বাইনারি বৈপরীত্য, হ‍্যাঁ-না, ঠিক-ভুল, ন‍্যায়-অন‍্যায়, শ্লীল-অশ্লীলের দ্বন্দ্ব, এটাকে সম্পূর্ণ না জেনে, না বুঝে প্রচার করা হল হাংরি আন্দোলন মানে না খেয়ে, খালি পেটে কবিতা লেখা। তারসাথে নেশা করা, যৌনক্ষুধা ইত্যাদির মশালাদার খবর তো আছেই। সেই সময়ের সংবাদপত্রের পাতা ওলটালেই চোখে পড়বে নানা রকমের রসালো গালগল্প তৈরি করেছে লেখক-সাংবাদিকরা। জ্যোতির্ময় দত্ত লিখেছিলেন, ‘বাংরিজি সাহিত্যে ক্ষুধিত বংশ’। প্রশাসনের মিথ্যা আশ্বাস আর মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ভুলিয়ে রাখার এক ওয়েস্টবেঙ্গলসম দক্ষতা এড়িয়ে যায়নি গল্পকারের চোখ থেকে। হাংরি আন্দোলনের সময় প্রশাসনের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার এটাও ছিল একটা মস্ত কারণ। হাংরি আন্দোলনের পরপরই পশ্চিমবঙ্গে ঘটে গেছিল নকশাল আন্দোলন। দেবেশ রায় এই দুটি আন্দোলনে একই বিশ্ববীক্ষার কথা বলেছিলেন। অথচ দুটোর উদ্দেশ্য, প্রস্তুতি ও গভীরতা সম্পূর্ণ আলাদা। হাংরি আন্দোলন যেখানে দেশভাগোত্তর বিপর্যয়ের সামনে দাঁড়িয়ে সংস্কৃতি, ধর্ম, শিল্প ও সাহিত্যে স্থিতাবস্থার বিরুদ্ধে আঘাত হানার চেষ্টা করেছিল, সেখানে নকশাল আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল মার্কসীয় পন্হায় রাজনৈতিক ক্ষমতাদখল। হাংরি আন্দোলনে ক্ষমতার বিরুদ্ধে যে জেহাদ তার কারণ মূলত প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং শিল্প ও সাহিত্যকে প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণের বাণিজ্যিক প্রয়াস। শিল্প ও সাহিত্যের পায়ে ভিক্টোরিয়ান মূল‍্যবোধের বেড়ি পরিয়ে দেওয়া। তাছাড়া শিল্প ও সাহিত্যজগতের মানুষের মধ্যে এসেছিল জাড্যের উদাসীন স্থিতাবস্থা। সমাজবিমুখ হয়ে সাহিত্য ও শিল্পের বাজার আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। ভাবনাতেও এসে গেছিল দৈন্য। কোনো নতুন আইডিয়া নেই। শুধু কালিতে কালি বুলিয়ে সুখী সুখী নির্মাণই ছিল শিল্প ও সাহিত্য সাধনা। এরসাথে যুক্ত হয়েছিল ক্ষমতার পদলেহন করে স্বীকৃতি যোগাড়। ঠিক এই জায়গাতেই আঘাত হেনেছিল হাংরি আন্দোলন। যদিও অ্যাবস্ট্রাক্ট সিস্টেমের নি-জার্ক প্রতিক্রিয়ায় আজও কোনো হেলদোল নেই। হাংরি একটা কামড় দিতে পেড়েছিল সেই পচাগলা মাংসে। হাংরি আন্দোলনে আন্ডারগ্রাউন্ড বা চোরাগোপ্তা পথের কোনো স্থান ছিল না। যুদ্ধটা সামনাসামনি। আর ক্ষমতার উৎস বন্দুকের নল নয়, কলম-তুলি। যা মুখোশ খোলে, রক্ত খায় না। ‘ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচি শুনতে পেয়ে সেদিকে এগিয়ে দেখল জঙ্গিলা গোষ্ঠীর প্রতিনিধিদের গুপ্ত গুলছররা চলছে।’….নকশাল আন্দোলন ছিল অপরদিকে চোরাপথে গেরিলা কায়দায় আঘাত হানা, এখন মাওবাদীরা জঙ্গলে লুকিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রয়াস করছেন, ভারতের জাতিপ্রথার কোনো বিশ্লেষণ তাঁরা করেন না। গল্পকার যে এই চোরাগোপ্তা পথে মানুষখুনের আন্দোলনগুলিকে ভালো ভাবে নেননি তা স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই গল্প থেকে। ‘সবাই ইংরেজিতে কথা বলছিল, তর্কাতর্কি করছিল, চাপানউতর করছিল; মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা।’ মার্কসবাদকে সামনে রেখে দেশে দেশে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে সবচেয়ে ভুল ছিল, আঞ্চলিক বা নিজস্ব সমস্যাকে বিচার বা বিশ্লেষণ না করে সবকিছুকেই মার্কসবাদের আলোকে ফেলা। অর্থাৎ এখানেও যেন সেই ধর্মের মতো গোঁড়ামি। নিজস্ব চিন্তাভাবনা নয়, নিজের সমাজকে চিনে বিচার বিশ্লেষণ নয়, ধর্মগ্রন্থের মতো একটি বইয়ের কথাগুলিকে চিরসত‍্য ধরে তা প্রশ্নহীন আনুগত্যে পালন করে যাওয়া। ‘মনে হল ওটাই জঙ্গিলাদের পিতৃভাষা’-র মধ্য দিয়ে গল্পকার যেন এটাই বোঝাতে চাইলেন যে, কীভাবে আন্দোলনকারীরা নিজেদের ভারতীয় আইডেন্টিটি ভুলে গিয়ে, নিজেদের চিন্তাভাবনার পরিসরটাকে শূন্য করে ক্রমাগত কপচে যায় মুখস্থ করা বুলি। আর অ্যাকশন্ ঠিক সেই আদি অকৃত্রিম পথেই। নিজস্ব পথ আবিস্কারের কোনো চেষ্টা নেই। শুধু সমাজ-বদলকারীদের নয়, সুখী সামাজিক মানুষদের শ্রেণিবিভাজন’টাও তিনি ধরেছেন নিপুণভাবে। ‘রয়েছে যবাক্ষারজান জলের নিচড়া বর্গ, রোদবৃষ্টিমাখা জলের উচড়া বর্গের সঙ্গে মাঝামাঝি জলের নিচড়া বর্গ। অতি নিচড়া বর্গের গায়ে আঁশ নেই চোয়াল নেই ডানা নেই, তলানি খায়। নিচড়া বর্গের গায়ে হাড় নেই, সবই কার্টিলেজ, কানকোর জায়গায় খড়খড়ি; জলের বেসমেন্টে নামলে চোখের তলায় গর্ত দিয়ে শ্বাস নেয়। আর উচড়া বর্গ তো রোদের পাউডার চাঁদের ক্রিম আর শিশিরের পারফিউম মেখে চোপরদিন গোমরে ঝিকিমিকি।’ এই বিভাজনকে বৈচিত্র্য মেনে মানুষ’ও বেশ খুশি। তাই সুখী খুশি কানে যদি কেউ নতুন কিছু শোনাতে যায় শোনে না, ভাবতেও চায় না, শুনতেও। ‘রঙিন কাউকে দেখলেই ওদের পোঁদে হিং জমে’। চিরদিনই নতুন কিছু যাঁরা জানাতে চেয়েছেন মানুষকে, তাঁদের বিরোধিতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। ‘রঙিন বলে ওই সব বর্গের মাছেরা কেউই শিলাদকে নিজেদের লোক বলে মনে করে না, অথচ খুব হিংসে করে।’এই অরূপকথনে সাম্রাজ্যবাদীশক্তির দাদাগিরিকেও তিনি শিলাদের মাধ্যমে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। ‘এই বোটকা মালটা কোত্থেকে এল রে সুনন্দা, আমেরিকা না ইজরায়েল? সেই বুড়ো বাঘটার এলাকা গায়ের জোরে জবরদখল করে বসে আছে।’ হয়তো উপনিবেশের রঙ পাল্টে গেছে, ‘নিজেকে আলেকজান্ডার কিংবা দারিয়ুস ভাবছে, মুতে-মুতে জবরদখল আর পাকাপাকি রাজ্যপাট, হাঃ হাঃ হাঃ…’ এখন লক্ষ্য অর্থনৈতিক উপনিবেশ স্থাপন। কিন্তু তার এফেক্ট একই। অসংখ্য হাড়জিরজিরে মানুষের লাশের উপর গুটিকয় নাদুসনুদুস মানুষের ভুড়ি ভুড়ি ভুরিভোজ। ‘দ্যাখে কি, গির্গিটবোমা অ্যানোলের পচাগলা লাশের মোরব্বা চেখে-চেখে খাচ্ছে মার্কিন কানিমাগুর আর ব্রিটিশ পাঁকাল।’

    পশ্চিমবঙ্গের পুঁথিনির্ভর শিক্ষকমুখী শিক্ষাব‍্যবস্থার হাল যে কতখানি করুণ তা আর নতুন করে আলোচনার কিছু নেই। এটা যেন ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে, সবাই মানে তবু হরিদাসের গোয়াল খালি থাকে না। উপায়ও নেই। যেন তেন প্রকারেণ চাই ডিগ্রি, পরীক্ষায় পাশ করাটাই সাফল্যের খতিয়ান। শিক্ষা? সেটা আবার কী স‍্যার? ‘শিমুল-পলাশের ডালে-ডালে ঠাকুরাল-বাঁদর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ছাত্র পড়ানো দেখছিল শিলাদ। প্রগতিশীল বাঁদর স্কুলের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেশ হোঁতকা-হোঁতকি রাঙা পোঁদা রাঙামুখো। কারোর চতুর্থ হাতে বিপত্তারিণির হর্তুকি, কারোর তৃতীয় হাতে জয় বজরংবলির মাদুলি, কারোর দ্বিতীয় হাতে রুপোর চেনে মাকলা-বাঁশের শেকড় বাঁধা। ছাত্র-ছাত্রীরা রোগা টিংটিঙে।’….শিক্ষকরা নিজেরাই কুসংস্কারাচ্ছন্ন, আর তারাই দেয় বিজ্ঞানের শিক্ষা। অর্থনৈতিক ভাবে পিছিয়ে-পড়া ছেলেমেয়েরা আসে ফ্রি স্কুলে শিক্ষা নিতে। বাড়িতে ঠিকঠাক খেতেও পায় না। অপুষ্টি শরীরে ও মনে, আর তারাই মুখস্থ করে বাড়ি ফেরে ভিটামিন কাহারে কয়। এই দূরাবস্থা থেকে আজ আশার আলো স্কুলে-স্কুলে মিড-ডে মিল প্রকল্প। এই গল্পটি যখন লেখা হচ্ছে তখন মিড-ডে মিল চালু হয়নি। তাই গল্পকারের তর্জনী নিক্ষেপ সফল। অবশ্য শুধু সরকারি ফ্রি স্কুল নয়, ঝাঁ চকচকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষাব‍্যবস্থাও যে খুব ভালো এমনও নয়। সামগ্রিকভাবে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষাব‍্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হলো নাম্বার, আরো নাম্বার, আরো আরো নাম্বার। নো ইনোভেশন ওনলি মুখস্থং নোটং। উদাসীন পৃথিবীটা আমাকে লাথিয়ে-লাথিয়ে আমারই স্বাধীনতায় ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলছে, আর আমি, পাখনা চাপড়ে বিলাপ করতে বাধ্য হচ্ছি। সম্ভাবনার সুযোগ সুবিধের মধ্যেই আমাকে কাৎ মেরে-মেরে খতিয়ে বেরোতে হবে। না কি?’ প্রশ্ন করতে বাধ‍্য হই নিজেকে, আর উত্তর? ‘নিজেকে নিজের কাছে, নিজের বাছবিচারের সম্ভবানার কাছে, বেঁচে থাকার খামখেয়ালি অথচ নির্বিকার স্রোতের কাছে, নিজেকে পরাজিত লাগে, হেরো, পরাভূত।’



    গোবিন্দ : কবিতাটা একইসঙ্গে আপনার পক্ষে ও বিপক্ষে গেছে, এই তর্ক কিন্তু সত্যি।

    প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার (Stark Electric Jesus)

    মলয় : ইউটিউবে অনেকে আমার এই কবিতাটা আবৃত্তি করেছেন। মহিলা কবি ও ঔপন্যাসিক মোহনা সেতু আবৃত্তি করার পর লিখেছেন, “যদি আমায় জিজ্ঞাসা করা হয়, আমি সবথেকে বেশি কোন কবিতা পড়েছি তবে আমি দুইটা কবিতার নাম বলব। এক. বিদ্রোহী; দুই. প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার। ৯০ লাইনের দীর্ঘ কবিতা মুখস্ত হয়ে গিয়েছে পড়তে পড়তে। অবশ্য এই কবিতা কোনো পুরুষেরই। আমি যেহেতু সমপ্রেমী না সেহেতু একজন নারীকে যোনী মেলে ধরার কথা বলতে পারি না। কিন্তু কবিতাটি আমার এত পছন্দ যে এসমস্ত কিছুকে পাত্তা দিলাম না। "কেউ কথা রাখেনি" কবিতা যখন আমি সহ অনেক নারী পাঠ করতে বলি, এখন তার বুকে শুধুই মাংসের গন্ধ, এখনো সে যেকোনো নারী --- তখন এই কবিতায় বাধ্যবাধকতা থাকার কথা না।”

    গোবিন্দ : আপনার বহু কবিতা ইউটিউবে পাঠ করেছেন অনেকে। আপনিও অনেক কবির কবিতা পাঠ করেছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে সম্ভবত বর্তমান প্রজন্মে সদ্য লিখতে এসেছেন। আপনি যে নতুন কবিদের উৎসাহ দেন তা সকলেই স্বীকার করেন।

    মলয় : এই কবিতাটা এ-পর্যন্ত ইউটিউবে আবৃত্তি করেছেন, মোহনা সেতু ছাড়া, শিবাশীস দাশগুপ্ত, তনুময় গোস্বামী, অ্যালেন সাইফুল, রাজা মুখার্জি, সন্ধি মুহিদ, রাজীব চৌধুরী, নুর হোসাইন, দেবাশীস ভট্টাচার্য, আদিত্য শুভ, শশীপ্রসাদ শীল, কৌস্তুভ গাঙ্গুলি, আদিত্য অনাম আর দীপ সেন। আরেকটা কবিতা, ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো’, সেটাও ইউটিউবে এ-পর্যন্ত আবৃত্তি করেছেন সুস্মিতা বোস, শারমিন সুবহা, মিতালী সেন, মোহনা সেতু, সাদিয়া সোবহান সারা, সিলভিয়া নাজনীন এবং মৌ মধুবন্তী।

    গোবিন্দ : আপনার প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতা বিদেশে যতো বিখ্যাত, এখানকার অধ্যাপকরা ততোই এড়িয়ে চলেন, দেখেছি। বরং বাংলাদেশের তরুণ কবিরা এই কবিতাকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছেন।



    মলয় : তা সত্যি। ইউরোপের ভাষাগুলোতে অনুবাদ হয়েছে, তুর্কি আর আরবিতেও হয়েছে। তুর্কিতে দুবার অনুবাদ হয়েছে, প্রথমবার করেছিলেন পেলিন আবায় নামে একজন যুবতী। ভাবতে পারো? মুসলমান-প্রধান দেশে একজন তরুণী এই কবিতাটা অনুবাদ করেছিলেন? পশ্চিম বাংলার কবি-ঔপন্যাসিক অনুপম মুখোপাথ্যায়ের এই কথাগুলো থেকে কারণ কিছুটা খোলোশা হয়, উনি বলেছেন, “ মলয় রায়চৌধুরী। আমার মনে হয় এই মুহূর্তে তিনি বাংলা সাহিত্যের একমাত্র জীবিত আন্তর্জাতিক সাহিত্যিক। প্রায় একাই জ্বলে থাকা আগুন। তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় দু-দশক হয়ে গেল। আমার এই সম্পর্ক থেকে পাওয়ার ভাগটা এতই বেশি, এত কিছুই শিখেছি তাঁর কাছে, এটাকে প্রায় একতরফা সম্পর্কই বলা যায়। এখনও তিনি লেখায় সমান সক্রিয়। এমনকি, হয়ত আগের চেয়েও সক্রিয় ও সজীব মনে হচ্ছে তাঁকে আমার আজকাল। আসন্ন শারদীয়ায় আপনারা একাধিক পত্রিকায় তাঁর করা অনুবাদ পাবেন, পত্রিকাগুলোর ঠিকানা নিজেই বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়ে দিয়েছেন। হয়ত এই মুহূর্তেই একটা উপন্যাস লিখছেন, যেটা পড়ার পরে আমাদের অনেক কিছু নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। আত্মপ্রচারে তিনি একটা নতুন দিকই খুলে দিয়েছেন, যেদিকটাতে পা রাখার ফলে আমাকেও অনেকে আজ চেনেন। প্রতিষ্ঠান নয়, নিজেই নিজেকে বহন করেন এই লেখক। বন্ধুর বদলে শত্রু কুড়িয়ে চলা এই লেখক। এই কবি।



    গোবিন্দ : যথার্থ বলেছেন অনুপম। মেইনস্ট্রিম সাহিত্যে আপনার শত্রুসংখ্যা বেড়ে চলেছে পশ্চিমবাংলায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায় পুলিশের কাছে দেয়া স্টেটমেন্টে লিখেছিলেন, “আমার মতে মলয় রায়চৌধুরীর রচনাগুলো মানসিক বিকৃতিতে পরিপূর্ণ এবং তার ভাষা নোংরা। মলয় রায়চৌধুরীর লেখা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ শিরোনামের কবিতাটির ঘোর নিন্দা করেছি।” অথচ সেই সময়ে ঔপন্যাসিক রবীন্দ্র গুহ লিখেছিলেন, “আমি, সমীর রায়চৌধুরী ও সুবিমল বসাক তিনজনে কলেজ স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে হাংরির সেই সংখ্যাটি থেকে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ পড়েছি। পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে দারুন আলোড়ন। পুলিশ অনেক দিন থেকেই ফাঁদ পেতে ছিল। কয়েক কপি সংগ্রহ করে দৌড়োল লালবাজার থানায় জমা দিতে। শুরু হল ধরপাকড়। লাথানি। হেনস্হা। অনেকেই কলকাতা থেকে পালাল। কেউ কেউ মুচলেকা দিয়ে ‘আজকাল’ এবং ‘আনন্দবাজারের’ তু-তু চাকর হয়ে গেল। যুদ্ধের ময়দানে দ্রোহপুরুষ মাত্র তুমি। অত হুজ্জোতের মধ্যেও আমি শুধিয়েছিলাম --- ‘কেমন লাগছে?’ তুমি উল্লাস করে হেসেছিলে। বলেছিলে -- “এভারেস্টের চুড়োয় একটি মাত্র সিংহাসন, আমি মলয় রায়চৌধুরী, সেখানে বসে আছি।” অমিয় দেবনাথ লিখেছিলেন, “কবিতাটা পোষ্ট করার পর আমার মিনিমাম ৫০ জন বন্ধু বিচ্ছেদ ঘটেছিলো। সেদিন পৈশাচিক আনন্দ পেয়েছিলাম।”

    মলয় : কী আর বলবো, বলো! এটা পড়েছো, অনিন্দ বড়ুয়ার অনুবাদ করা, “চট্টগ্রামের ভাষায়" প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার? ----- অ-খোদা মরি যাইয়ুম যাইযুম / আঁর চঁ’ড়া জ্বলি যারগই আঠাইট্যা ঠাডারে / আঁই কী গউজ্জুম কডে যাইয়ুম / অ’মারে কিচ্ছু গম ন লাগের / লেয়-পড়া বেগ্গুন লাথি মারি / যাইয়ুমগই শুভা / শুভা আঁরে তোঁয়ার তরমুজ-কঅরর / ভিতরে ঘইলতা দ’/ ঘুটঘুইট্টা আঁধারত খইর খইর / মশারির লুডি পইজ্জা ছামাত / বেক নাকল তুলি নিবার পর শেষ / নাকলঅ আঁরে ফেলাই যারগই / আঁইত আর ন পারির, / মেলা কাঁচ ভাঙি যারগই আঁই জানি / শুভা, হেডা মেলি ধর, / শান্তি দ শিরা বেগ্গুনে চৌগরপানি / আনি লই যারগই কইলজার ভিতরে / আদিকাইল্যা ব্যারামে পুঁচি যারগই / মগজর হাঁছোড়াইন্যা অউনর ফুঁয়া / অ’মা, তুঁই আঁরে কঙ্কাল সিবে কিল্লাই জনম ন’দ? / তইলে ত আঁই দুইকুটি অলোকবর্ষ / ভগবাইন্যার পোঁদত চুম খাইতাম / এয়াত কিচ্ছু ভালা ন লাগের আঁত্তে / কিচ্ছুই ভালা ন লাগের / উগ্যাত্তুন দু’য়া চুম দিলে উর্বিষ লা’য় / জোরগড়ি চুইদত্তাম যাই কতবার / ইয়াপোয়ার নাম প’ড়ি / গম কামন ফিরি গেইগই….”, আর কায়েস মাহমুদ স্নিগ্ধ করেছেন নোয়াখালির ভাষায়, “ওরে মারে মরি যাইয়ুম মরি যাইয়ুম মরি যাইয়ুম। /আঁর সামবা জ্বলি যারগই দারুয়ার আগুনে”।

    আঁই কিত্তাম, কোনায় যাইতাম কইতাম হারি না, / দিলের ভিত্রে শান্তি আইয়ে না এক্কানাও। / এগিন হুঁথি মুঁতিত লাইত্থাই চলি যাইয়ুম রে শুভা। / শুভা আঁরে এক্কানা তোঁর ভিত্রে চলি যাইতে দে, গেঁডিত গেঁডিত আঁডি যাইতে দে। / আন্দারের ভিত্রে রাইত নামাইন্না আন্দারের ভিত্রে মশাইর টানাইন্না ছামার মইদ্যে, / বেজ্ঞিন নাও চলি গেসে, অন এই নাওগাও চলি যারগই গাঁডের কিনারের তুন। / উফঃ আর হারি না রে, লাগে য্যান খালি গেলাস বাংগের। / শুভা ভোদা খুলি আঁর দুয়ারে খাড়া, সুখ দে শুভা, তোরে সুদি। / গিরার গিরার কান্দন খালি চলি আইয়ের আঁর দিলের গোড়াত। / বিমারে বিমারে হঁসি গেসে আঁর গিলু বরা গরম ঠাডা। / এরে মা, তুঁই আঁরে খালি আড্ডিত কেন হ্যাডে লইলি না? / গোসত দিসত গাত, নইলে তো দুই কুটি সন ঠাউরের হোন্দে চুম্মাচুম্মি কইত্তাম, ওরে মা। / আঁর বালা লাগে না, আঁর আর কিছুই বালা লাগে না। / গন গন চুম্মাইলে আঁর গা গিনগিনায়, / সুদতে সুদতে বেডিরে থুই রঙ তামশাত চলি আইসি ম্যালা দিন / আঁর কইবতার ঠকঠকাইন্না খাড়াইন্না হ্যাডায়। / এগিন কিয়া অইতে আছে, কিয়া অইতে আসে আঁর সিনার বিত্রে ওরে ঠাউর / বেজ্ঞিন বাংগি গুড়াগুড়া করি হালামু, বাংগি হালামু এরে মাদারচোতের হুত / বাংগি হালামু তোগো ডঙের নাচন কোন্দন/আঁই কইদিলাম উডাই আনমু শুভারে, আঁর শুভা, আঁর শান্তির শুভা। / হেতিরে গুঞ্জাই থোনের তুই কোনাইগার মাংতার হুত হালা?



    গোবিন্দ : অভাবনীয়! বাংলাদেশে আপনি জনপ্রিয় কবি, আলোচক, ঔপন্যাসিক। ২০০৮ সালে নির্ঝর নৈঃশব্দ আপনার ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটা সামহোয়ার ব্লগে পোস্ট করার পর যে বিতর্ক আরম্ভ হয়েছিল, তা আজও চলছে। এ পর্যন্ত পছন্দ করেছেন ৩৪৭ জন, মন্তব্য করেছেন ১০৪ জন।বাংলাদেশের মহিলা গল্পকার ২০০৮ সালেই লিখেছিলেন, “আমি একজন কবিতার পাঠক হিসেবে বলতে চাই কবিতাটি আমার কাছে অসাধরণ মনে হয়েছে। শ্লীলতা কিংবা অশ্লীলতা বিচার করার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না। যার বদহজম হবে সে পড়বে না। যার সহ্য করার ক্ষমতা আছে সে পড়বে।” ২০১০ সালে বাংলাদেশের কবি অমিত চক্রবর্তী লিখেছিলেন, “সময়কে অতিক্রম করা কবিতা এটি। যারা নিন্দা করেছেন তাদের বলছি কবিতা শব্দ শালীনতা বা ভাবসৌন্দর্য্য নয়। কবিতা কবির একান্ত অনুভুতি। ফিল করতে না পারলে পড়বেন না কিন্তু মলয় রায় চৌধুরীর কবিতা নিয়ে মন্তব্য করার স্পর্ধা বর্জন করবেন।” ওই বছরই হাসান মাহবুব লিখেছিলেন, “প্রথমত, শারিরীক যন্ত্রণা নিয়া এই কবিতাটা লেখা হয় নাই। এটা তার চেয়েও বেশি কিছু। তবে প্রকাশভঙ্গি দেখে মানুষ ভুল বুঝতে পারে। আর যেসব শব্দের উদাহরণ তুমি দিছো অরণ্যরে কবি কিন্তু সেই টাইপ শব্দ ইউজ করে নাই। যোনী না লিখে তো অন্য কিছুও লিখতে পারতো, তাইনা? অথবা স্তনের পরিবর্তে অন্যকিছু? অমিত ঠিকই বলসে, ফিল ইট। এটা শারিরীক কামনা বাসনার কবিতা না। এটা এক অসহনীয় যন্ত্রনার বহিঃপ্রকাশ।”



    মলয় : ফেসবুকে দেখি আজকাল আমার কবিতা অনেকে পোস্ট করেন। আমার উপন্যাসও আলোচনা করেছেন অনেকে, সম্ভবত ইনটারনেট আসার সুবিধার কারণে। আমার উপন্যাস "অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস" অবলম্বনে বাংলাদেশের কবি আসমা অধরা একটা কবিতা লিখেছিলেন। ওই উপন্যাসে নায়ক নিজেকে নানা রকমের কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেছে। কবিতাটা এরকম, “বুকের মধ্যিখানে নিঁখুত জীপার / খুলে দেখিয়ে দেয়া যেত লাঙ্গলের ফলা / করেছে এফোঁড়ওফোঁড় হৃদবিন্যাস / অযথা জমে থাকা টক্সিন ক্রমেই লাম্প / অথচ স্ফটিক স্বেদবিন্ধুতেও তেমনি পয়জনাস! / মেঘের জলদ কি জানে অক্সিটোসিন, / ব্যাপক জাগরণ কালীন ঘুম? / ক্ষরণ ও মন্থনে কার্ডিওভাস্কুলেশন; / যে কুকুর আঁচড়ে দেয় ত্বক ও শিরাবিন্যাস / তাকে বলি কানে কানে, শেফার্ড নয়, পুডল ভালোবাসি!”

    গোবিন্দ : ফেরলিংঘেট্টি, যিনি অ্যালেন গিন্সবার্গের হাউল আর ক্যাডিশ প্রকাশ করেছিলেন, আপনাদের কবিতা ওনার পত্রিকায় ছেপেছিলেন, তিনি নাকি আদালতের রায় পড়ে লিখেছিলেন, ভুল ইংরেজিতে হাস্যকর আদেশ।



    মলয় : লোয়ার কোর্টে আমাকে সাজা দেবার কারণ হিসাবে জজসাহেব লিখেছিলেন, “Applying the test to the offending poem and realising it as a whole, it appears to be per se obscene. In bizarre style it starts with restless impatience of a sensuous man for a woman obsessed with uncontrollable urge for sexual intercourse followed by a description of vagina, uterus, clitoris, seminal fluid, and other parts of the female body and organ, beasting of the man’s innate impulse and conscious skill as to how to enjoy a woman, blaspheming God and prefaing parents accusing them of homosexuality and masterbation, debasing all that is noble and beautiful in human love and relationship. In a piece of self-analysis and eroticism in autobiographical or confessional vein when the poet engages himself in a mercilessly obnoxious and revolting self-denigration and resortage of sexual vulgarity to a degree of perversion and morbidity far exceeding the customary and permissible limits of candour in description or representation. It is patently offensive to what is called contemporary community standards. It’s predominant appeal to an average man considered as a whole is to prurient interest, in a shameful or morbid interest in nudity, sex and excretion. Considering it’s dominant theme it is dirt for dirt’s sake, or, what is commonly called hardcore pornography, suggesting to the mind of those in whose hands it may fall stinking wearysome and suffocating thoughts of a most impure and libidinous character and thus tending to deprave and corrupt them without any rendering social or artistic value and importance. By no stretch of imagination can it be called, what has been argued, an artistic piece of erotic realism opening up new dimension to contemporary Bengali literature or of a kind of experimental piece of writing, but appears to be a report of a repressed or a more pervert mind who is obsessed with sex in all it’s nakedness and thrives on, or revel, in utter vulgarity and profanity preoccupied with morbid eroticism and promiscuit in all it’s naked ugliness and uncontrolled passion for opposite sex. It transgresses public decency and morality substantially, rather at public decency and morality by it’s highly morbid erotic effect unredeemed by anything literary or artistic. It is an affront to current community standards of decency or morality. The writing viewed separately and as a whole treats with sex, that great motivating force in human life, in a manner that surpasses the permissible limits judged from our community standards and as there is no redeeming or social value or gain to society which canbe said to preponderate, I must hold that the writing has failed to satisfy time-honoured test. Therefore, it has got to be stamped out since it comes within the purview of Section 292 of Indian Penal Code. Accused is accordingly found guilty of the offence Under Section 292 Indian Penal Code and is convicted thereunder and sentenced to pay a fine of Rs. 200/- in default simple imprisonment for one month. Copies of the impugned publication seized be destroyed.”

    গোবিন্দ : অ্যালেন গিন্সবার্গ আপনাদের পাটনার বাড়িতে কতো সালে এসেছিলেন? আপনি ওনার হাউল আর ক্যাডিশ অনুবাদ করেছিলেন। শিলচরের কবি বিকাশ সরকারের কাছে শুনেছি ওনার ‘লেখাকর্মী’ পত্রিকায় ক্যাডিশ প্রকাশিত হয়েছিল। বিকাশ সরকারের সঙ্গে কেমন করে যোগাযোগ হলো?



    মলয় : হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল ১৯৬১ সালে আর গিন্সবার্গ পাটনায় এসেছিলেন ১৯৬৩ সালে। উত্তরবঙ্গে যখন হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হলো তখন থেকেই বিকাশের সঙ্গে আমার যোগাযোগ। বিকাশ বেশ কয়েকটা পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বা প্রকাশ করেছিলেন। ‘থাবা’, ‘বিচিত্রবিশ্ব’, ‘জনপদ সমাচার’, ‘সময়প্রবাহ’, তারপর যুগশঙ্খতে যোগ দিতে ২০০৪ সালে চলে গেলেন গুয়াহাটি। ২০১৫ সাল থেকে কলকাতায় আছেন। ‘বিচিত্রবিশ্ব’ পত্রিকায় আমার বহু কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ; যুগশঙ্খতেও প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশ কর্মকার যখন এলাহাবাদে ছিলেন আর আমি ছিলুম লখনউতে তখন আমরা দুজনে মিলে একটা বুলেটিন বের করতুম। তাতে থাকতো প্রকাশ কর্মকারের ড্রইঙ আর আমার কবিতা। এগুলো বিকাশ রিপ্রিন্ট করেছিল ‘বিচিত্রবিশ্ব’ পত্রিকায়, সব হারিয়ে ফেলেছি। লেখাকর্মী পত্রিকার ওই কপিটা গিন্সবার্গের সংগ্রহশালার কিউরেটার বিল মর্গান এসে নিয়ে গিয়েছিলেন।

    গোবিন্দ : উত্তরবঙ্গের হাংরি আন্দোলনে বিকাশ সরকার ছিলেন?

    মলয় : হ্যাঁ, ছিল বলেই তো যোগাযোগ হয়েছিল। তখন উত্তরবঙ্গ থেকে বেশ কয়েকটা হাংরি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। অনুভব সরকারের ‘টার্মিনাস’, জীবতোষ দাশের ‘রোবোট’, সুব্রত রায়ের ‘হাংরি ২১০০’, মনোজ রাউতের ‘ধৃতরাষ্ট্র’, রাজা সরকারের ‘কুরুক্ষেত্র’, অলোক গোস্বামীর ‘কনসেনট্রেশন ক্যাম্প’, অরুণেশ ঘোষের ‘জিরাফ’ ইত্যাদি। ওরা বেশ সাড়া ফেলে দিয়েছিল। শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ মিলে ওদের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করে ভণ্ডুল করে দিয়েছিল। উত্তরবঙ্গে হাংরি আন্দোলন নিয়ে আলোচনার সময়ে বিকাশকে কেন বাদ দেয়া হয়, জানি না। অলোক গোস্বামীর ‘মেমারি লোকাল’ স্মৃতিকথাতেও বিকাশ সরকারের কোনও উল্লেখ নেই। অবশ্য সাধারণ পাঠকরা তো আমার নাম শোনেনি, বই পড়েনি। কীই বা বলি। সম্প্রতি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর দুটো কবিতা পোস্ট করেছিলুম; দেখলুম ওনার মতো প্রতিভাবান কবির নাম শোনেনি অনেকে।

    গোবিন্দ : ফেসবুকে সুতীর্থ দাশ-এর মতন পাঠকও আছেন, জানি না এপারের না ওপারের। উনি লিখেছেন, “স্বীকার করছি পড়ি নি, কারণ মলয় রায়চৌধুরী সুনীল-সমরেশ - শীর্ষেন্দু" দের মতো জনপ্রিয় নন, বা পুজোসংখ্যা, আলোচনাসভা, পত্রিকার সাহিত্যপাতার প্রথমে নাম থাকে না। আমার কথাই বলছি - আমি বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হয়েও অনার্স পাশ করার পরেও জানতাম না মলয় রায় চৌধুরী কে, বা হাংরি আন্দোলন কী? সত্যি বলতে আপনার নাম প্রথম শুনেছি "বাইশে শ্রাবণ" চলচ্চিত্রে। তারপর "আধুনিক কবিতার ইতিহাস" বইয়ের শেষে বর্ণানুক্রমিক সূচী খুঁজে আধ পৃষ্টা লেখা পেয়েছি মলয় রায় চৌধুরী সম্বন্ধে। এই দশার কারণ- আমাদের চিনিয়ে দেয়া হয় না, আমরা কাগজ পড়ে যাদের বড় বড় ছাপানো ছবি দেখি তাদেরই চিনি। আমরা পাঠ্যসূচির তালিকাভুক্ত লেখকদের গল্প কবিতা উপন্যাস অপন্যাসই গিলি। আমাদের শিক্ষকগণ সিলেবাসের লক্ষণরেখা অতিক্রম করে বাইরে যান না, কোনো প্রশ্ন করলে রেগে ওঠেন। রাত পোহালে এম এ পরীক্ষা দিচ্ছি। আমাদের অনেকের বাড়িতে বাংলা অভিধান পর্যন্ত নেই, মলয় রায় চৌধুরী নামটা আমাদের কানে পৌঁছানোর আগেই আমরা হয়তো বিদ্যালয়মহাবিদ্যালয়ে হাজিরা খাতা বগলদাবা করে সাহিত্য পড়াতে যাবো। এটা শপিংমলের যুগ, যেটা সাজানো থাকে সেটাই আমাদের চোখে পড়ে...ক্ষমা করবেন...আমরা আপনাকে চিনতে পারি নি, আরো এক শতাব্দী পেরোলে চিনতে পারবো কিনা সন্দেহ আছে....

    মলয় : এটা পড়েছিলুম। আমারই একটা পোস্টে ইনি এই মন্তব্য করেছিলেন। আমি লিখেছিলুম, “৫০০০ ফেসবুক বন্ধু। ১০০ জনের মতন কেবল আমার একটা-দুটো বই পড়েছেন। ৪৯০০ জনকে "আমার কোন বই পড়েছেন" জানতে চাইলে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' ছাড়া আর কিছু বলতে পারেন না।”

    গোবিন্দ: শান্তনু বেজ নামে একজন লিখেছেন, “মলয়দা, জানেন আজ অধিকাংশ মিথোস্ক্রিয়া অভ্যাস করে। কেউ আর স্বভোজী নয়। অনেকেই আপনার হাতটা চাইছে তাদের চুলকানি পিঠে আসুক। অনেকেই আপনার উপস্থিতি চাইছে তাদের ইনবক্সে। কি দারুন ভাবে চাওয়া হচ্ছে, একজন অসুস্থ আশির মানুষের কাছ থেকে উৎসাহের "ৎ" টুকু। আমরা যারা, লিখি সবাই আর নির্মোহ নেই। আমরা আজ সবাই সঙ্ঘদোষ চাইছি। সঙ্গদোষ নয়। তাই, তুমি আমার না পড়লে, আমি পগাড় পার। জানি তুমি আমারও কিছু লেখা পড়োনি। আর লিখেছি যা তাতে একটা বাজারের চালান কোনমতে ভরপুর হতে পারে। আর আমিও তোমার গল্প সংগ্রহ, নেক্রপুরুষ এবং মধ্যবর্তীর ধারাবাহিক লেখা ছাড়া বিশেষ কিছুই পড়িনি। কিন্তু, একটা রাস্তা রাস্তা মনে হয়েছে। .... আমি বিশ্বাস করি যে কবি উৎসাহ শব্দে অনুঘটক খুঁজে কবিতা বা তার কাজকর্ম করে, তার বাঁদরের মই সংক্রান্ত অঙ্কটি খুব প্রিয় ...একটা কবির শুধু মাত্র একলা হয়ে যাওয়া দরকার, এটাই আমি শিখেছি একজন অগ্রজ কবির কাছ থেকে। আর এটাই আমার শ্রেষ্ঠ ঐ "ৎ" বলে মনে করি।আমি আপনাকে বিশেষ পড়িনি। কিন্তু, পড়বো। আর, আমি মাচা এবং খাঁচা এই দুটি শব্দকে ঘেন্না করি ...ভালো থাকবেন, সুস্থ থাকবেন মলয়দা।”

    মলয় : হোসেন মোতাহার নামে একজন বেশ ইনটারেস্টিং কথা লিখেছেন, “মীজানুর রহমান চৌধুরীর ত্রৈমাসিক পত্রিকা দিয়া আপনার লেখার লগে পরিচয় আমার। হাংরির কিংবদন্তী পুরুষ আপনে। প্রচণ্ড আলোড়িত হৈসিলাম।প্রতিক্রিয়াশীল প্রতিষ্ঠানের পোঁদে লাত্থি দেওনের সাহস আপনের থিক্যা পাইসিলাম। তথাকথিত বামেরে চিনসি আপনেরে দিয়া। উৎপলদত্ত আপনেগরে হাংড়ি বইল্যা টিটকারি মার্সিল। সুনীল্যা আপনেরে পদ্মাপাড়ের রক্তের গরম দেখাইসিল। দমেন নাই।এখুনে এই ফিড়িং ফিড়িং ফকিন্নি ফেসবন্দুর কাছ থিকা কী ঘোড়ারডিম আশা করেন! যন্ত্র চালাইবো না বই পড়বো?” গোবিন্দ, তুমি জানো কি না জানি না, মীজানুর রহমান আমার "নামগন্ধ" উপন্যাস প্রকাশ করেছিলেন। কলকাতায় আমার বাসায় এসে বলেছিলেন যে কোনো পত্রিকাই বইটা আলোচনা করতে চায় না। "হাংরি কিংবদন্তি" বই করে বের করতে চেয়েছিলেন কিন্তু সুনীলরা শামসুর রাহমানের মাধ্যমে চাপ দিয়ে প্রকাশ করতে দেননি।

    গোবিন্দ : আপনার বিরোধিতার জন্যই পঞ্চাশের কবিরা বিরোধ করেছিলেন, নাকি?

    মলয় : সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর উৎপলকুমার বসু যে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তা ঠিক আমার বিরুদ্ধে নয়। পড়ে দেখতে পারো।

    গোবিন্দ : বাই দ্য ওয়ে, সন্দীপন তাঁর সাক্ষ্যে কবিতাটি সম্পর্কে বলেছিলেন - "পড়ে মনে হয়, একজন যুবকের স্বীকৃতি। তার আইডেনটিটি আবিষ্কারের চেষ্টা। সে জানতে চাইছে সে কে। এটা একটা নতুন ধরণের সাহিত্য প্রচেষ্টা, একটা এক্সপিরিমেন্ট। এরকম সাহিত্য-প্রচেষ্টা বাংলা সাহিত্যের উৎকর্ষের জন্য দরকার। এরকম ৯৯৯টা লেখা হওয়ার পর হয়তো একজন জিনিয়াস জন্মাতে পারে। সাহিত্যের জন্য এক্সপিরিমেন্ট খুবই দরকার।
    প্রসিকিউটর : আপনি কি লেখাটাকে ইম্‌মরাল বলেন?
    সন্দীপন : আমি মনে করি সাহিত্যে সে সব প্রযোজ্য নয়।
    প্রসিকিউটর : এটা পড়ে আপনার মনে কোনো ডিপ্রেভিং এফেক্ট হয়েছিল কি?
    সন্দীপন : না, সেসব হয়নি।
    বিচারক অমল মিত্র - ডু ইউ কনসিডার দি অ্যাকিউসড পোয়েট এ পায়োনিয়ার ইন দিস ফিল্ড?
    সন্দীপন : আমি যেটা বলতে চেয়েছি তা হল এই কবিতাটি নতুন। এটা সার্থক বা ভালো কবিতা কিনা জানি না। সাহিত্যে নতুন-নতুন এক্সপিরিমেন্ট দরকার। সেই হিসেবে কবিতাটি ঠিক দরকার ছিল।
    উৎপলকুমার বসুর প্রসঙ্গে আসি। তাঁকে যখন প্রশ্ন করা হয়, 'এটা পড়ে আপনার কী ইমপ্রেশান হয়েছিল',
    উৎপল বলেন - এটা আমার সম্পূর্ণ নতুন ধরণের কবিতা মনে হয়েছিল। এক্সপিরিমেন্টাল। তাছাড়া এটা অ্যাংগুইশড ও অ্যাংরি লেখা। হাংরি লেখা।
    প্রসিকিউটর : অ্যাংরি? অ্যাংগুইশড?
    উৎপল : উত্তেজনা ধরে রাখার কবিতা। যেন একটা নাগরিক টেনশন। টেনশনের মাঝে লেখা। ... কবির এক বিশেষ মানসিক অবস্থা চিত্রিত করার জন্য সেই অ্যাংগুইশড অবস্থার কবিতা। কবিতাটা একটা সেন্স ওব এগজিসটেনশিয়াল ডিসগাস্ট ক্যারি করে।
    প্রসিকিউটর : এটা কি আপনার ডিবচিং মনে নয়?
    উৎপল : না। সেরকম কিছু নয়। ডিসগাস্ট ক্যারিইং।
    ম্যাজিস্ট্রেট :'ডিসগাস্টটা আসছে কোত্থেকে? তা কি সামাজিক। না কবির নিজের'?
    উৎপল : তা জানিনা। কবি তো সমাজেরই মানুষ। তবে যেমন-যেমন কবিতাটা এগিয়েছে, কবির ব্যক্তিগত ডিসগাস্ট এসে পড়েছে। কবিতাটা সফল।

    মলয় : এখান তরুণতম প্রজন্ম আমার বইপত্র পড়ছে। কলকাতার কবি সুনন্দা চক্রবর্তী অবশ্য বলেছেন, “এ কবিতাটা আমি আজ ইস্তক যতবার পড়েছি, ততবার ভিন্ন উপলব্ধি হয়েছে।” ইনটারনেটে তরুণ সান্যালের একটা চিঠি আছে, আমাকে লেখা, তাতে উনি এই কবিতার একটা আইনি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, সেটা এরকম, “আপনার ডিফেন্সে মূল প্রশ্ন হওয়া উচিত : ১ ) আধুনিক জীবনে ব্যক্তিত্বের খণ্ডীকরণ মাতৃগর্ভে প্রত্যাবর্তনের তৃষ্ণা জাগরুক করতে পারে, সাক্ষ্য হিসেবে ভুরি-ভুরি সমাজতাত্বিকের রচনা কোট করা যায়। যেমন সাহিত্য ও সময়ের দ্বন্দ্বে ব্যক্তিমানুষের মনঃরূপায়ণ ফ্র্যাগমেন্টেশন অফ পার্সোনালিটি ইত্যাদি, এবং সামাজিক এলিয়েনেশন। ক) অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের বিপুল বিস্তার ; খ ) সামাজিক পরিবর্তনের অতি দ্রুতগতি এবং ; গ ) ক্ষমতার মুখোমুখি অসহায়তা — ব্যক্তিকে সত্যই চূর্ন করছে। এসট্রেঞ্জ করছে, স্ট্রেনজার করছে। আপনার রচনাকে আমি সবরকম ওই এসট্রেনজমেন্টের রূপায়ণ বলে দেখতে ভালোবাসি। শুভা হল যেন পিতামহকথনের সত্যযুগ, গোলডেন এজ — আধুনিক সাইকোঅ্যানালিস্টের কাছে নিশ্চিন্তিবোধের সিমবায়োটিক রমণী। এদিকে অ্যাপ্রোচ করা ভালো — এতে আমাদের দেশে আইন-আদালতে একটা উদাহরণও স্হাপন করা যায়। ২ ) অশ্লীলতার সংজ্ঞা এবং অশ্লীলতা সম্পর্কিত বাংলা রচনায় কীভাবে এবং কোথায় দেখা যাচ্ছে তার উদাহরণসহ ডিফেন্সে এসট্যাবলিশমেন্টের প্রতি চ্যালেঞ্জ জানানো যায়। ৩ ) আপনাদের রচনা সাহিত্যকর্মীদের মধ্যেই একমাত্র বিতরণ হয় বলে স্বীকৃত।”
    গোবিন্দ : শুনেছি অধ্যাপকরা এই কবিতা নিয়ে এমফিল ও পিএইচডি প্রস্তাব সহজে অনুমোদন করেন না। তার কারণ আপনাদের বইপত্র সহজে পাওয়া যায় না এবং আলোচনাও বিরল। গবেষণা করতে হলে গাইড চাই তো?

    মলয় : তরুণরাই এখন গাইড। যেমন সুকান্ত মহাবিদ্যালয়ের অধ্যাপক শুভশ্রী দাস, আমার লেখায় জাদুবাস্তবতা নিয়ে গবেষণা করছেন। শিউলি বসাক করছেন। রূপসা দাশ করেছেন। বিষ্ণুচন্দ্র দে আর উমাশঙ্কর বর্মা অলরেডি পিএইচডি করেছেন।

    গোবিন্দ : পশ্চিমবাংলার কবি তৈমুর খান বলেছেন, “বাংলা কবিতার হাতেখড়ি থেকেই বাংলা সাহিত্যে একটা গর্জন শুনেছিলাম, সেই গর্জনের নাম মলয় রায়চৌধুরী (জন্ম ২৯ অক্টোবর ১৯৩৯)। ১৯৯১ সালে একবার বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় এসে বাঁশদ্রোণীতে কলিম খানসহ এই চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়ের (সমীর ও মলয় রায়চৌধুরীর) সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেদিন অনেকগুলো বইপত্রও আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। ভারী ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে সেই গর্জনগুচ্ছের কাছে নিজেকে বসিয়েছিলামও। অনেকদিন কেটে গেল। অনেক জলও গড়াল। অনেক নির্ঘুম রাতে অনুভব করি — “চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছেআমি আর পার্ছি না, অজস্র কাচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে”(প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার)কবিতার “আমি” আমার আমিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। যে পর্যাপ্ত আদিমতা নিয়ে, অস্থিরতা নিয়ে, শূন্যতা ও যৌনতা নিয়ে আমি জেগে উঠতে চেয়েছি, এই কবিতা যেন তারই মূলে তরঙ্গাঘাত করে ঠেলে দিয়েছে আমাকে। পোস্ট মডার্ন কখনোই বুঝতে চাইনি। তার ব্যাকরণও আমার দরকার হয়নি। শুধু এক মুক্তির পক্ষতাড়না শিল্প ও জীবনাচারকে নাড়িয়ে দিয়েছে। কী উল্লাস, কী আত্মক্ষরণ, কী অভিব্যক্তির মোক্ষম বিস্ময় যা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। এক আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আমার ঘুম ও জাগরণ, আমার প্রেম ও যৌনাকাঙ্ক্ষা, আমার পূর্ব ও উত্তরজন্মের মহানির্বাণ ব্যাপ্ত হয়ে ওঠে। “শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও”না, শুভার কাছে শুধু শান্তি চেয়েই জীবনের সমূহ প্রয়াসকে পরিচালনা করা যায় না। তরুণ গড়ুরের ক্ষুধাকে নিবৃত্তি দেওয়া যায় না। দেহবাদের চরম সীমানা পেরিয়ে গেলেও শব্দহীন কিছু কঁকানি আর মৃত্যুর সদর্থক চৈতন্যও খেলা করে। অসাম্ভাব্যতার ভেতর নিরর্থক জৈবক্রিয়ার সঞ্চারী বিন্যাস আত্মনিবিষ্ট সান্নিধ্যকেই ইংগিত করে। তাই শেষ পর্যন্ত “ন্যাংটো মলয়কে” দেখতে পাই। “মলয়” আমাদেরই অভিন্ন সত্তার ব্যাপ্তি। ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কবি, অনুবাদক, সাংবাদিক এবং হাংরিয়ালিজম্ ও পোস্ট মডার্নিজম্ এর রূপকার মলয় রায়চৌধুরীকে এক বহুমুখী উত্থান ও জীবনপর্যটক বলেই মনে হয়েছে আমার। পরিবর্তনশীল জগতের প্রবহমান অস্তিত্ব নিয়ে তিনি ঝংকৃত ও পরিব্যাপ্ত। শুধু কুশলী শিল্পী হিসেবে নয়, শিল্প ভাঙার শিল্পী হিসেবেও। তিনি কখনোই নিয়ন্ত্রিত ও সীমায়িত হতে চাননি। সামাজিক হয়েও সমাজমননের অভ্যন্তরে বিরাজ করেন। শরীরবৃত্তীয় পর্যায়গুলি সক্ষমতার সঙ্গে লালন করেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর লেখায় ফিরে আসে মগ্নচৈতন্যের অবধারিত ক্রিয়াকলাপ। প্রজ্ঞানাচারী বৈভাষিক মিথলজি। প্রথম কাব্যগ্রন্থ “শয়তানের মুখ” জলবিভাজিকার ক্রমিক বিন্যস্ত থেকে উঠে আসে সত্তার বহুমুখীন পর্যায়। ঐতিহ্যকে ভেঙে ঐতিহ্য গড়া, আবার তাকে অস্বীকার, ক্রমবর্ধমান এই প্রবাহ থেকেই তাঁর লক্ষ্যহীন লক্ষ্য। অনুবাদের ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন — উইলিয়াম ব্লেক, জাঁ ককতো, সালভাদোর দালি, পল গঁগা, ব্লাইজি সঁদরা, ত্রিস্তান জারা, অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, পাবলো নেরুদা এবং ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা। প্রতিটিতেই স্বকীয়তার ছাপ স্পষ্ট।তবু নিজের কাজের জন্য তিনি প্রশংসা, পুরস্কার কিছুই গ্রহণ করেননি। সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি জানেন সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা। এই মাহাত্ম্য তাঁকে আরও সুউচ্চতা দান করেছে।মলয় রায়চৌধুরী আমাদের যে আবহাওয়ায়, যে মৃত্যুতে, যে বেঁচে ওঠার মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে আছেন, তার প্রতিটি বোধেই আমরা আজ তাঁকে উপলব্ধি করতে পারি।” নন্দিতা দেবসিংহ নামে এক তরুণী জানিয়েছেন যে এই কবিতা পড়ে ওনার বাবা ওনার নাম রেখেচিলেন নন্দিতা, বক্তব্যের সত্যিমিথ্যা জানি না, তবে এরকম প্রতিক্রিয়াও বর্তমান সময়ের তরুণীদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে।



    মলয় : সত্তর দশকের কবি দেবযানী বসু এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, “'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কাব্যের জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে কোমরে দড়ি বেঁধে জেলে পোরা হয়েছিল। তিনি অশ্লীলতার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন।যুগের সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই কাব্যের অশ্লীলতা এখন আর অশ্লীল নেই। প্রকট যৌনতায় কবিতার রহস্যময়তা মার খায়। রহস্যময়তা বজায় রাখার দাবি মিটিয়ে অশ্লীলতা আনা খুব সহজ কাজ নয়।”

    গোবিন্দ : সত্তরের পর থেকে আপনি একটা উচ্চতা পেয়েছেন। কেন জানেন? বাংলাদেশ সৃষ্টি এবং রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বাংলাভাষার প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশে টাইপরাইটার বর্জন করে কমপিউটার চালু করেছিল, বাংলা ফন্টও বাংলাদেশের আবিষ্কার। এখন তো অভ্র না হলে লেখা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। পশ্চিমবাংলায় বামফ্রন্ট কমপিউটার ঢুকতে দেয়নি। এই ব্যাপারে ভারতে বাঙালিরা পিছিয়ে পড়েছে।

    মলয় : হ্যাঁ। মোইন রিয়াদ নামে উইকিপেডিয়ার জনৈক বাংলাদেশি সম্পাদক উইকিতে ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ নামে একটা আলাদা পেজ খুলে দিয়েছেন।

    গোবিন্দ : আপনারা বেনারস আর কাঠমাণ্ডুতে হিপি-হিপিনীসঙ্গ করেছিলেন শুনেছি। গাঁজা, চরস, হ্যাশিশ, আফিম, মেসকালিন, এলএসডি ইত্যাদি টেনে নেশা করার সুযোগ হয়েছিল।



    মলয় : আমার ইরটিক উপন্যাস ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ পড়লে তোমার আইডিয়া হবে। হিপি-হিপিনীরা আসতো হিচহাইক করে যাকে ওরা বলতো হিপি ট্রেইল। আমেরিকা থেকে অ্যামস্টারডমে গিয়ে, ইউরোপের দেশগুলো হয়ে তুর্কি, ইরাক, ইরান, আফগানিস্তান, পাকিস্তান হয়ে ভারতের বেনারস। তারপর বেনারস থেকে কাঠমাণ্ডু। আফগানিস্তান থেকে আনতো আফিম- চরস আর পাকিস্তান থেকে গাঁজাফুলের গুঁড়ো যাকে ওখানে বলতো গর্দা। এলএসডি আনতো ক্যাপসুলে আর ব্লটিঙপেপারে ভিজিয়ে। আশির দশকে আমেরিকার চাপে সব দেশে মাদক নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিল, যদিও এখন খোদ আমেরিকাতেই নানা রকমের গাঁজার দোকান হয়েছে। সেদিন প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় ফোন করে বলছিল যে যৌবনে এলোমেলো জীবন কাটিয়েছিলুম বলে এখন আমায় নানা রোগে ভুগতে হচ্ছে।



    গোবিন্দ : কলকাতায় কবিদের কাছে খালাসিটোলার এতো নামডাক। আপনি যেতেন?

    মলয় : ওখানেও প্রথমবার গেছি সেন্টুদার সঙ্গে। পরে লেখক বন্ধুদের সঙ্গে। অবনী ধর একটা টেবিলে উঠে জীবনানন্দের জন্মদিনে নেচেছিল, সেটা ‘অমৃত’ পত্রিকায় আর ‘দি স্টেটসম্যান’ সংবাদপত্রে খবর হয়েছিল। ক্লিন্টন বি সিলি ওনার জীবনানন্দ বিষয়ক ‘এ পোয়েট অ্যাপার্ট’ বইতে ঘটনাটার উল্লেখ করেছেন। তখনকার দিনে খালাসিটোলার বাইরে গাঁজা-চরস-আফিমের একটা সরকারি দোকান ছিল; সেখান থেকে একটা পুরিয়া কিনে এগোতেই কমলকুমার মজুমদারের সামনাসামনি হই ; টাকার টানাটানি আর মামলার খরচ জানতে পেরে উনি আমাকে একটা একশো টাকার নোট দিয়েছিলেন। সুভাষ ঘোষ অবশ্য খালাসিটোলার বদলে পছন্দ করতো সেন্ট্রাল অ্যাভেনিউতে ‘অম্বর’ বার।



    গোবিন্দ : আপনি জীবনী লিখেছেন বা জীবন ও শিল্প বিশ্লেষণ করেছেন এবং অনুবাদ করেছেন বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, অ্যালেন গিন্সবার্গ, পল ভেরলেন, সালভাদোর দালি, পল গঁগা, জাঁ জেনে, মায়াকভস্কি, জীবনানন্দ দাশ, নজরুল ইসলাম, দস্তয়েভস্কি, জাঁ-লুক গোদার প্রমুখের। মনে হয় আপনি যেন এঁদের প্রতি আকৃষ্ট, আপনার জীবন ও চরিত্র ও লেখালিখির সঙ্গে এনাদের মিল আছে বলে? তা কি স্বীকার করেন?



    মলয় : এটা ঠিক যে এনারা আমাকে আকর্ষণ করেছেন। বোদলেয়ারের আর জীবনানন্দের মতন আমিও একজন পথচর, যদিও করোনা ভাইরাসের কারণে আর বয়সের দরুণ আজকাল আর বেরোই না, কিন্তু আমি জেমস জয়েস, মার্সেল প্রুস্ত, হেনরি মিলার, হুলিও কোর্তাজার, ফুয়েন্তেস, শিবনারায়ণ রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, আনা আখমাতোভা, ওসিপ ম্যানডেলস্টাম, পিকাসো, মার্কেজ, সিলভিয়া প্লাথ,মালার্মে, পাবলো নেরুদা, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, ফালগুনী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ প্রমুখকে নিয়েও লিখেছি ; এমনকী আমেরিকার রেড ইন্ডিয়ান গল্পকার হায়মেওস্ট স্টর্মকে নিয়েও লিখেছি। শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পর্কে আমার প্রবন্ধে কিন্তু গালমন্দ করিনি, যেমনটা উনি আমাকে প্রাণ ভরে দিয়ে গেছেন।

    গোবিন্দ : শৈলেশ্বর ঘোষ যে হাংরি রচনা সংকলিত করেছেন তা থেকে আপনি, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, আলো মিত্র, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই প্রমুখদের বাদ দিয়েছেন, উত্তরবঙ্গের হাংরি আন্দোলনকারীরাও বাদ গেছেন। আপনিও নাকি ওনাদের বাদ দিয়েছেন?

    মলয় : না, আমি কাউকে আমার সম্পাদিত সংকলন থেকে বাদ দিইনি। বস্তুত হাংরি বুলেটিন আর জেব্রা পত্রিকা ছাড়া আমি কোনও হাংরি সংকলন সম্পাদনা করিনি। আসলে শৈলেশ্বর-সুভাষ আমার মামলায় রাজসাক্ষী হবার দরুন অপরাধবোধে ভুগতেন, এটা কমন ক্রিমিনাল সাইকোলজি।



    গোবিন্দ : বাঙালি মহিলা কবিদের প্রতি আপনার পক্ষপাত দেখা যায়। আপনি যশোধরা রায়চৌধুরী, সোনালী চক্রবর্তী, বহতা অংশুমালী মুখোপাধ্যায়, সোনালী মিত্র, জয়িতা ভট্টাচার্য, মিতুল দত্ত, শ্রীদর্শিনী মুখোপাধ্যায়, আসমা অধরা, মুনীরা চৌধুরী প্রমুখের নাম উল্লেখ করেন, কয়েকজনের বইয়ের ভূমিকাও লিখেছেন। তরুণ পুরুষ কবিদের নিয়ে আপনি আশাবাদী নিশ্চয়ই। কিন্তু পিঠ চাপড়ানোর একটা রেওয়াজ চলছে। এতে সাহিত্যের লাভক্ষতি কি তেমন হচ্ছে?



    মলয় : পিঠ চাপড়ানি তো ভালোই। আমার মামলার সময়ে পিঠচাপড়ানি পেলে কাজে দিতো। তার বদলে আমি পেয়েছিলুম কেবল টিটকিরি, আক্রমণ, বিদ্বেষ। সংবাদপত্রগুলো যা ইচ্ছে তা-ই লিখতো। বুদ্ধদেব বসু আমার নাম শুনেই আমাকে ওনার দরোজা থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আবু সয়ীদ আইয়ুব আমার বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটা চিঠি লিখেছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গকে। এমনকী বন্ধুরাও আমাকে অপছন্দ করতো। শৈলেশ্বর ঘোষ মারা যাবার পর ওর শিষ্যরা আমার বিরুদ্ধে লিখে চলেছে। ঢাকায় একটা বই বেরিয়েছে কবি প্রকাশনী থেকে, তাতে মোস্তাফিজ কারিগর আর সৌম্য সরকার নামে দুজন আমাকে আক্রমণ করেছেন, আমার বইপত্র না পড়েই। তরুণরা তো নানা রকমের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে, নতুন ভাবনা নতুন আঙ্গিক আনার প্রয়াস করছে, যদিও বয়সের কারণে আমি এখন আর অতো পড়ার অবসর পাই না। আমার পছন্দ হলে আমি প্রশংসা করি ; তা অন্যের পছন্দ নাও হতে পারে। মুনীরা চৌধুরীর কবিতা পড়েছ? অসাধারণ প্রতিমাভাঙনের কাজ আছে ওনার কবিতায় -- সুইসাইড করেছিলেন জলে ডুবে।



    গোবিন্দ :প্রায় সকল প্রকাশক, লেখক যখন পাঠক-শূন্যতা টের পান তখন কেউ কেউ একেকটি মেলায় কোনও কোনও বইয়ের দ্বিতীয় তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশ হওয়ার বিজ্ঞাপন দেন। এটা তাহলে পাঠকশূন্যতা নয়? নাকি অন্য কোন যাদুবলে একজন লেখক পাঠকপ্রিয় হয়ে ওঠেন? কিংবা একজন প্রকাশক পাঠকের চাহিদা সত্যি সত্যি অগ্রীম ধরে নিতে পারেন?
    মলয় : অনেকের বই বিজ্ঞাপনের জোরে বিক্রি হয়, অনেকের বই পাঠকের মুখে-মুখে ছড়িয়ে পড়ে। অনেকের বই আবার সাংস্কৃতিক রাজনীতির কারণে বিক্রি হয় না। প্রকাশককে হুমকি দেয়ায় অনেকের বই আটকে যায়। পাঠকের অভাব আছে বলে আমার মনে হয় না। যাঁরা লিটল ম্যাগাজিন প্রকাশনা থেকে বই প্রকাশ করেন তাঁদের অসুবিধা হলো কলেজ স্ট্রিটে বিক্রির ব্যবস্হা না থাকা। যাঁরা কলকাতার বাইরে থাকেন তাঁদের তো একেবারে সুযোগ-সুবিধা নেই। তবু তাঁদের প্রকাশ করা বইয়েরও পাঠক আছে। দাদা ‘হাওয়া৪৯’ পত্রিকা প্রকাশ করার সময়ে যে বইগুলো বের করেছিল সেগুলোর ভালোই চাহিদা ছিল। এখন ‘হাওয়া৪৯’ সম্পাদনা করে মুর্শিদ। ও আবিষ্কার প্রকাশনী খুলেছে, ওর বের করা বইগুলো ভালোই বিক্রি হয়, ও বিভিন্ন মেলাতেও অংশ নেয়।

    গোবিন্দ : পারিবারিক কোনও স্মৃতি?

    মলয় : আমাদের বসতবাড়ি ছিল হুগলি জেলার উত্তরপাড়ায়। আমরা সাবর্ণ রায়চৌধুরী বলে বাড়ির নাম ছিল সাবর্ণ ভিলা, তিনশো বছরের পুরোনো বাড়ি। অবশ্য আদি নিবাস বলতে হলে লক্ষীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা বলতে হয়, যিনি যশোরে মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য ছিলেন, মোগলদের কাছ থেকে রায়চৌধুরী উপাধি আর কলকাতার জায়গিরদারি পেয়ে চলে আসেন। সাবর্ণ ভিলা হয়ে গিয়েছিল খণ্ডহর। আমার খুড়তুতো বোন পুটিকে ওর বাবা প্রেমিকের সঙ্গে বিয়ে অনুমোদন না করার দরুন পুটি সবচেয়ে বড়ো ঘরের কড়িকাঠ থেকে ঝুলে আত্মহত্যা করে নিয়েছিল। আর তার পরদিনই ঘরটা ওপরের স্ট্রাকচারসহ হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ে। বস্তুত ব্যাপারটা ছিল যেন সাবর্ণ ভিলার আত্মহত্যা। পুটির আত্মহত্যা আমি ভুলতে পারিনি। এক্ষুনি তোমাকে পিসেমশায়ের কথা বলছিলুম, উনিও মাঝরাতে আহিরিটোলার বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেন ; ওনার পকেটের চিরকুটে লেখা ছিল ‘আনন্দ ধারা বহিছে ভূবনে’। বিশাল বাড়িটা ভাঙাচোরা অবস্হায় থাকার দরুণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময়ে দাদার বন্ধুদের পরামর্শে কয়েকজন শিক্ষার্থী মুক্তিযোদ্ধাকে ঠাঁই দিতে সুবিধা হয়েছিল।



    গোবিন্দ : আপনার কলেজ জীবনের গল্প বলুন? তখনকার বিশেষ স্মৃতি?

    মলয় : আমি পড়তুম পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে। আইএ পড়ার সময়ে যোগ দিয়েছিলুম ন্যাশানাল ক্যাডেট কোর-এ, বন্দুক-পিস্তল চালানো আর নানা জায়গা দেখার লোভে। থ্রিনটথ্রি আর বাইশ বোরের রাইফেল চালিয়েছি। তখনকার পিস্তলগুলো বেশ ভারি হতো। থ্রিনটথ্রিতে প্রতিবার বুলেট ভরতে হতো, এখন কালাশনিকভ থেকে বুলেট বেরোয় চেপে রাখা পেচ্ছাপের মতন। ওই সময়েই আমার বন্ধু তরুণ শুরের মামার ট্রাকে করে নানা জায়গায় গেছি, যেখানে ট্রাকগুলো মাল নিয়ে যেতো। আমরা বসতুম ড্রাইভারের পাশে আর শুতুম ড্রাইভারের পেছনের বেঞ্চে। ওরা চালাতো রাতের বেলায় আর ঘুমোতো দিনের বেলায়। রুটে কোথায় কোথায় গ্রামের বউরা টাকা কামাবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকে তা ওরা জানতো, আর নেমে, তেরপল বিছিয়ে শট মেরে আসতো। বউগুলো বেশ্যা নয়, বাড়ির বউ ; কম বয়সী মেয়েরাও থাকতো। দেদার কান্ট্রি লিকার আর তন্দুরি মুর্গি খেতো, আমরাও খেতুম ওদের সঙ্গে। পুলিশ আর অকট্রয় কর্মীদের ঘুষ নেয়া দেখতুম। তরুণের মামা আলাদা করে ঘুষের টাকা দিয়ে দিতেন ড্রাইভারদের।



    গোবিন্দ : পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধের সাথে কোনভাবে যুক্ত ছিলেন?

    মলয় : পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা কবি-লেখকদের আশ্রয় দেয়া আর লুকিয়ে রাখাকে যদি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে যোগাযোগ মনে করো, তাহলে ছিল।

    গোবিন্দ : আপনার গল্প উপন্যাসে দেশভাগ,মুক্তিযুদ্ধ কিরকম এসেছে?

    মলয় : দেশভাগ এসেছে আমার কবিতায়, গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে। ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে পাবে দেশভাগে চলে আসার পর একজন বামপন্হীর দ্রোহ আর শেষ পর্যন্ত তার পরিবর্তন। ‘ঔরস’ উপন্যাসে পাবে ১৯৭১-এর বীরাঙ্গনা আর সন্তানকে কেমনভাবে আশ্রয় দিয়েছিলেন, বিয়ে করেছিলেন এক স্কুল শিক্ষক। ‘নখদন্ত’ কাহিনির পোস্টমডার্ন স্ট্রাকচারে পাবে। বহু কবিতায় পাবে।



    গোবিন্দ : আপনার সাহিত্যে দেশ ভাগের প্রভাব কতটুকু? কিংবা এই বিষয়টি কেমন করে আসে?

    মলয় : নিজস্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া আমি লিখতে পারি না, যদিও চেষ্টা করি। সেজন্য দেশভাগ যেটুকু এসেছে তা দেখে। আমি তো পূর্ববঙ্গের মানুষ নই। পঞ্চাশের দশকে শেয়ালদায় উদ্বাস্তুদের ভয়ঙ্কর অবস্হা নিজের চোখে দেখার দরুনই আমি আর দাদা আন্দোলনের কথা ভেবেছিলুম। দেশভাগে যে নিম্নবর্ণের উদ্বাস্তুরা এসেছিলেন তাঁদের সঙ্গে মিশেছি হিমালয়ের তরাইতে, মানা ক্যাম্পে, ছত্তিসগঢ় আর মধ্যপ্রদেশে, মোতিহারিতে, মহারাষ্ট্রে। এনারা এসেছেন আমার লেখায়। এখন মরিচঝাঁপি নিয়ে একটা ডিটেকটিভ উপন্যাস লেখার তোড়জোড় করছি।



    গোবিন্দ : পরিবারের কেউ মুক্তিযুদ্ধের সাথে কোনভাবে যুক্ত ছিলেন?

    মলয় : পরিবার বলতে তো বাবা-মা-দাদা আর আমি। কেউই সরাসরি যুক্ত ছিলুম না।

    গোবিন্দ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে কিংবা মুক্তিযুদ্ধে বাঙালিরা এত আন্তরিক কেন ছিলো?

    মলয় : সিমপল। বাঙালি বলে।

    গোবিন্দ :দেশভাগের ফলে আমাদের বাংলা সাহিত্যের উপর কিরকম প্রভাব পড়ে?

    মলয় : আমার মনে হয় সেইভাবে পড়েনি যেমনটা বিশ্বযুদ্ধ, সোভিয়েত শাসন ফেলেছে ইউরোপের লেখায় বা লাতিন আমেরিকার ইতিহাস ফেলেছে স্প্যানিশ সাহিত্যে।

    গোবিন্দ : বাঙালি জাতির জীবনে কাঁটাতার নিশ্চয়ই খণ্ডিত জাতিসত্তার জন্ম দিয়েছে? নাকি এর প্রভাব শুধু শিল্পসাহিত্যেই বাস্তবে কিছুই নয়?

    মলয় : বলা কঠিন। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ক্রমশ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছেন, মূলত সউদি আরব, পাকিস্তান, তুর্কি ইত্যাদি দেশের প্রভাবে। এখন আফগানিস্তান একটা ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়িয়েছে। এপার বাংলায় আর ত্রিপুরায় বিজেপি জিতলেও বাঙালিরা সেইভাবে হিন্দুত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়নি। লেখকরা অবশ্য একটা পৃথক সেকুলার মিলনক্ষেত্র তৈরি করে রেখেছেন।

    গোবিন্দ : হাংরি উত্থানের দিনগুলোর অর্জন বলুন?

    মলয় : আমি আর কী বলব। লেখক-পাঠক হিসাবে এই বিশ্লেষণ তো তোমাদের করা দরকার।

    গোবিন্দ : তবু প্রথমটা আপনার কাছ থেকে শুনতে চাই।

    মলয় : এই বিষয়ে আমার লেখা থেকে কিছুটা পড়ো। ১৯৫৯-৬০ সালে আমি দুটি লেখা নিয়ে কাজ করছিলুম। একটা হল ইতিহাসের দর্শন যা পরে বিংশ শতাব্দী পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।অন্যটি মার্কসবাদের উত্তরাধিকার যা পরে গ্রন্হাকারে প্রকাশিত হয়েছিল, এবং যার প্রকাশক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।এই দুটো লেখা নিয়ে কাজ করার সময়ে হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা আমার মাথায় আসে। হাংরি আন্দোলনের হাংরি শব্দটা আমি পেয়েছিলুম ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসার-এর ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে। ওই সময়ে, ১৯৬১ সালে, আমার মনে হয়েছিল যে স্বদেশী আন্দোলোনের সময়ে জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তরঔপনিবেশিক কালখণ্ডে।উপরোক্ত রচনা দুটির খসড়া লেখার সময়ে আমার নজরে পড়েছিল অসওয়াল্ড স্পেংলার-এর লেখা দি ডিক্লাইন অব দিওয়েস্ট বইটি, যার মূল বক্তব্য থেকে আমি গড়ে তুলেছিলুম আন্দোলনের দার্শনিক প্রেক্ষিত। ১৯৬০ সালে আমি একুশ বছরের ছিলুম। স্পেংলার বলেছিলেন যে একটি সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈব প্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে। কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় থেকে আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তা-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন। আমার মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে ও প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। এখানে বলা ভালো যে আমি কলকাতার আদিনিবাসী পরিবার সাবর্ণ চৌধুরীদের বংশজ, এবং সেজন্যে বহু ব্যাপার আমার নজরে সেভাবে খোলসা হয় যা অন্যান্য লেখকদের ক্ষেত্রে সম্ভব নয়।ওই চিন্তা-ভাবনার দরুণ আমার মনে হয়েছিল যে কিঞ্চিদধিক হলেও, এমনকি যদি ডিরোজিওর পর্যায়েরও না হয়, তবু হস্তক্ষেপ দরকার, আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন। আমি আমার বন্ধু দেবী রায়কে, দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে, দাদার বন্ধু শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে, আমার আইডিয়া ব্যাখ্যা করি, এবং প্রস্তাব দিই যে আমরা হাংরি নামের একটা আন্দোলন আরম্ভ করব। ১৯৫৯ থেকে টানা দুবছরের বেশি সে-সময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায় দাদার চাইবাসার বাড়িতে থাকতেন। দাদার শ্যালিকা শীলা চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমিক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্হ হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য-এর প্রেমের কবিতাগুলো শীলার প্রেমে লিখিত। দাদার চাইবাসার বাড়ি, যা বর্তমানে ঝাড়খণ্ড রাজ্যের অন্যতম শহর তখন ছিল বনাঞ্চল। দাদার চালাঘরটি ছিল নিমডি নামে সাঁওতাল-হো অধ্যুষিত গ্রামের পাহাড় টিলার ওপর, যা সে-সময়ে ছিল তরুণ শিল্পী-সাহিত্যিকদের আড্ডা। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অরণ্যের দিনরাত্রি উপন্যাসটির পটভূমি ও চরিত্র সবই চাইবাসা-কেন্দ্রিক; তাঁর সন্তু হল দাদার শ্যালক সন্তু এবং কাকাবাবু হল সন্তুর কাকাবাবু। সে যাই হোক, ১৯৬১ সালে যখন হাংরি আন্দোলনের প্রথম বুলেটিন প্রকাশিত হয়, এবং ১৯৬২ সালে বেশ কয়েক মাস পর্যন্ত, আমারা ওই চার জনই ছিলুম আন্দোলনের নিউক্লিয়াস।ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের বনেদেরব ওপর, অর্থাৎ আন্দোলনগুলো ছিল টাইম স্পেসিফিক বা সময়-কেন্দ্রিক। কল্লোল গোষ্ঠি এবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী তাঁদের ডিসকোর্সে যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলোও ছিল কলোনোয়াল ইসথেটিক রিয়ালিটি বা ঔপনিবেশিক নন্দন-বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেননা সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা নির্ভর এবং তাদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত। সময়ানুক্রমী ভাবকল্পের গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদের পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, এবং স্হানিকতা ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে। ১৯৬১ সালের প্রথম বুলেটিন থেকেই হাংরি আন্দোলন চেষ্টা করল সময়তাড়িত চিন্তাতন্ত্র থেকে পৃথক পরিসরলব্ধ চিন্তাতন্ত্র গড়ে তুলতে। সময়ানুক্রমী ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে মননসন্ত্রাস তৈরি করে, তার দরুণ প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে নিরুপণ করা হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্হানাঙ্ক নির্ণবের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্বসৌধ নির্মাণ। ঠিক এই জন্যই, ইউরোপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে যাচাই করলে দেখা যাবে যে, ব্যক্তি-প্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো।কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখব যে পুঁজি-বলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে সমসাময়িক শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন। এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠীও সীমিত হয়ে গেছে দুতিনজন মেধাসত্বাধিকারীর নামে। পক্ষান্তরে, আমরা যদি ঔপনিবেশিক নন্দনতত্বের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবি, তাহলে দেখব যে পদাবলী সাহিত্য নামক স্পেস বা পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব বা শাক্ত কাজ; মঙ্গলকাব্য নামক ম্যাক্রো-পরিসরে পাবো মনসা বা চণ্ডী বা শিব বা কালিকা বা শিতলা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর। লক্ষণীয় যে প্রাকঔপনিবেশিক কালখণ্ডে এই সমস্ত মাইক্রো-পরিসরগুলো ছিল গুরুত্বপূর্ণ, তার রচয়িতারা নন। তার কারণ সৃজনশিলতার ক্ষেত্রে ব্যক্তিমালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্বের ফসল। সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিটি উপনিবেশে গিয়ে এই ফসলটির চাষ করেছে। ইতিহাসের দর্শন নিয়ে কাজ করার সময়ে আমার মনে হয়েছিল যে স্পেস বা স্হানিকতার অবদান হল পৃথিবী জুড়ে হাজার রকমের ভাষার মানুষ, হাজার রকমের উচ্চারণ ও বাকশৈলী, যখন কিনা ভাষা তৈরির ব্যাপারে মানুষ জৈবিকভাবে প্রোগ্রামড। একদিকে এই বিস্ময়কর বহুত্ব; অন্যদিকে সময়কে একটিমাত্র রেখা-বরাবর এগিয়ে যাবার ভাবকল্পনাটি, যিনি ভাবছেন সেই ব্যক্তির নির্বাচিত ইচ্ছানুযায়ী, বহু ঘটনাকে, যা অন্যত্র ঘটে গেছে বা ঘটছে, তাকে বেমালুম বাদ দেবার অনুমিত নকশা গড়ে ফ্যা।এ। বাদ দেবার এই ব্যাপারটা, আমি সে-সময়ে যতটুকু বুঝেছিলুম, তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছিল লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্হায়ি বন্দোবস্তের ফলে বাঙালির ডিসকোর্সটি উচ্চবর্ণের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায়, যার ফলে নিম্নবর্গের যে প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্স বাঙালির সংস্কৃতিতে ছেয়ে ছিল, তা ঔপনিবেশিক আমলে লোপাট হয়ে যাওয়ায়। আমার মনে হয়েছিল যে ম্যাকলে সাহেবের চাপানো শিক্ষাপদ্ধতির কারণে বাঙালির নিজস্ব স্পেস বা পরিসরকে অবজ্ঞা করে ওই সময়ের অধিকাংশ কবিলেখক মানসিকভাবে নিজেদের শামিল করে নিয়েছিলেন ইউরোপীয় সময়-রেখাটিতে। একারণেই, তখনকার প্রাতিষ্ঠানিক সন্দর্ভের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের প্রতিসন্দর্ভের সংঘাত আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল প্রথম বুলেটিন থেকেই, এবং তার মাত্রা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছিল প্রতিটি বুলেটিন প্রকাশিত হবার সাথে-সাথে, যা আমি বহু পরে জানতে পারি, কাউনসিল ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর সচিব এ বি শাহ, পি ই এন ইনডিয়া-র অধ্যক্ষ নিসিম এজেকিয়েল, এবং ভারত সরকারের সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা পুপুল জয়াকার-এর কাছ থেকে। অমনধারা সংঘাত বঙ্গজীবনে ইতোপূর্বে ঘটেছিল। ইংরেজরা সময়কেন্দ্রিক মননবৃত্তি আনার পর প্রাগাধুনিক পরিসরমূলক বা স্হানিক ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বাঙালি ভাবুকের জীবনে ও তার পাঠবস্তুতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনি আর ছটফটানি, রচনার আদল-আদরায় পরিবর্তনসহ, দেখা দিয়েছিল, যেমন ইয়ং বেঙ্গল সদস্যদের ক্ষেত্রে ( হেনরি লুইভিভিয়ান ডিরোজিও, কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ ) এবং মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও আরও অনেকের ক্ষেত্রে। একইভাবে, হাংরি আন্দোলন যখন সময়কেন্দ্রিক ঔপনিবেশিক চিন্তাতন্ত্র থেকে ছিঁড়ে আলাদা হয়, উত্তরঔপনিবেশিক আমলে আবার স্হানিকতার চিন্তাতন্ত্রে ফিরে যাবার চেষ্টা করেছিল, তখন আন্দোলনকারীদের জীবনে, কার্যকলাপে ও পাঠবস্তুর আদল-আদরায় অনুরূপ ঝাঁকুনি, ছটফটানি ও সমসাময়িক নন্দনকাঠামো থেকে ষ্কৃতির প্রয়াস দেখা গিয়েছিল। তা না হলে আর হাংরি আন্দোলনকারীরা সাহিত্য ছাড়াও রাজনীতি, ধর্ম, উদ্দেশ্য, স্বাধীনতা, দর্শনভাবনা, ছবিআঁকা, সংস্কৃতি ইত্যাদি বিষয়ে ইস্তাহার প্রকাশ করবেন কেন?

    গোবিন্দ : আপনি পড়েছেন কী না জানি না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আত্মজীবনী (২০০২) "অর্ধেক জীবন" গ্রন্হে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে বলেছেন, “দেশে ফেরার পর বেশ কিছু বন্ধুর উষ্ণ অভ্যর্থনা পেলেও বন্ধুত্বের ব্যাপারেই জীবনের প্রথম চরম আঘাতটাও পাই এই সময়। এর দু-এক দিনের মধ্যেই হাংরি জেনারেশনের সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরীকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সমীর কলেজ জীবন থেকেই আমার বন্ধু, চাইবাসা-ডালটনগঞ্জে তার বাড়িতে কত দিন ও রাত কাটিয়েছি, বন্ধুকৃত্যে সে অতি উদার, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্হের প্রকাশকও সমীর। মলয়কেও চিনি তার ছোটবয়স থেকে। হাংরি জেনারেশন আন্দোলন শুরু হয় আমার অনুপস্হিতিতে ও অজ্ঞাতসারে। সেই সময়কার ইংল্যাণ্ডের অ্যাংরি ইয়াং মেন আর আমেরিকার বিট জেনারেশন, এই দুই আন্দোলনের ধারা মিলিয়ে সম্ভবত হাংরি আন্দোলনের চিন্তা দানা বেঁধেছিল, হয়তো অ্যালেন গিন্সবার্গের প্রেরণাও ছিল কিছুটা এবং মুখ্য ভূমিকা ছিল মলয়ের। যেসব বন্ধুদের সঙ্গে আমার প্রতিদিন ওঠাবসা, তারা একটা নতুন কিছু করতে যাচ্ছে সম্পূর্ণ আমাকে বাদ দিয়ে? এর কী কারণ থাকতে পারে, তা আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। বন্ধুদের কাছে আমি অসহ্য হয়ে উঠেছি, কিংবা আমার হাতে নেতৃত্ব চলে যাওয়ার আশঙ্কা? একটা গভীর বেদনাবোধ আমি লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছিলাম। আমার ফেরার কয়েক দিনের মধ্যেই কাকতালীয়ের মতন পুলিশ গ্রেপ্তার করে সমীর ও মলয়কে। তাতে কয়েকজন মনে করল আমিই ওদের ধরিয়ে দিয়েছি। যেন দমদমে পদার্পণ করেই আমি পুলিশ কমিশনারকে টেলিফোনে আদেশ করেছি, ওই কটাকে ধরে গারদে পুরুন তো! পুলিশি তৎপরতার সূত্রপাতেই হাংরি জেনারেশনের প্রথম সারির নেতারা সবাই পুলিশের কাছে মুচলেকা দিয়ে জানিয়ে আসে, ভবিষ্যতে ওরা ওই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখবে না। সমীরও ছাড়া পেয়ে যায়, মামলা হয় শুধু মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে, অশ্লীলতার অভিযোগে। সেই সময় মলয় খানিকটা একা হয়ে পড়ে। মামলা ওঠার আগে মলয় আমার বাড়িতে এসে অনুরোধ জানায় আমাকে তার পক্ষ নিয়ে সাক্ষ্য দিতে হবে। আমি তৎক্ষণাত রাজি হয়ে জানিয়েছিলাম পৃথিবীর যে কোনো দেশেই সাহিত্যের ব্যাপারে পুলিশের হস্তক্ষেপের আমি বিরোধিতা করব।”

    মলয় : না, ওনার বইটা পড়িনি। তবে ওনার বক্তব্যটা জানি। সুনীল কেমন করে ভেবেছিলেন যে আমার মতন একজন অখ্যাত পাটনাইয়া যুবক, যে আবার ওনার বন্ধুর ছোটো ভাই, তাঁকে বাদ দেবার কথা ভাববে? আমি তো ছিলুম ফেকলু পাটনাইয়া। ওনার “সুনীলকে লেখা চিঠি” বইটা পড়ে দেখতে পারো। আমি ওনাকে নেতৃত্ব নিতে বলেছিলুম, কিন্তু উনি সাড়া দেননি। উনি এতোটাই চটে ছিলেন আমার ওপর যে দাদাকে লিখেছিলেন, “সাক্ষীর কাঠগড়ায় মলয়ের কবিতা আমাকে পুরো পড়তে দেওয়া হয়। পড়ে আমার গা রি-রি করে। এমন বাজে কবিতা যে আমাকে পযতে বাধ্য করা হল, সে জন্য আমি ক্ষুব্ধ বোধ করি --- আমার সময় কম, কবিতা কম পড়ি, আমার রুচির সঙ্গে মেলে না --- এমন কবিতা পড়ে আমি মাথাকে বিরক্ত করতে চাই না। মলয়ের তিন পাতা রচনায় একটা লাইনেও কবিতার চিহ্ণ নেই।” এই চিঠিটা ইনটারনেটে বহু সাইটে আছে। সুনীল আমার ওপরে চিৎকার করে বলেছিলেন, “আমি কি শক্তির থুতু চাটবো?”

    গোবিন্দ : ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা সম্পর্কে?

    মলয় : হ্যাঁ। উনি বেঁচে থাকতেই টের পেয়ে গিয়েছিলেন যে তরুণতম প্রজন্মের কাছে কবিতাটা আইকনিক হয়ে গেছে, পৃথিবীর নানা ভাষায় অনুবাদ হয়েছে, ফিল্ম হয়েছে। হাংরি আন্দোলনের খ্যাত বা কুখ্যাতি উনি আমারিকায় থাকতে শুনেছিলেন, তাই ভাবছিলেন কলকাতায় সবই বুঝি দখল হয়ে গেল। যুগশঙ্খ পত্রিকায় বাসব রায়কে দেয়া সাক্ষাৎকারে উনি বলেছিলেন, “মলয় আমার অনুপস্হিতির সুযোগ নিয়েছিল”। আরে, আমি তো তখন অখ্যাত। ওনার উপস্হিতিতেও যা করতুম ওনার অনুপস্হিতিতেও তাই করেছি।

    গোবিন্দ : উনি আমেরিকা থেকে আপনাকে আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন শুনেছি।

    মলয় : হ্যাঁ। দুটো চিঠিই নেটে নানা সাইটে পাবে। ১০ই জুন ১৯৬৪ সালের চিঠিতে আয়ওয়া থেকে আমাকে যে চিঠিটা লিখেছিলেন, তার একটা প্যারা এরকম, “চালিয়ে যাও ওসব আন্দোলন কিংবা জেনারেশনের ভণ্ডামি। আমার ওসব পড়তে কিংবা দেখতে মজাই লাগে। দূর থেকে। সাহিত্যের ওপর মৌরসি পাট্টা বসাতে এক-এক দলের অত লোভ কী করে আসে, কী জানি। তবে একটা কথা জানিয়ে রাখা ভালো। আমাকে দেখেছ নিশ্চয় শান্তশিষ্ট, ভালো মানুষ। আমি তাই-ই, যদিও গায়ে পদ্মাপাড়ের রক্ত আছে। সুতরাং তোমাদের উচিত আমাকে দূরে-দূরে রাখা, বেশি খোঁচাখুঁচি না করা। নইলে হঠাৎ উত্তেজিত হলে কী করব বলা যায় না।”

    গোবিন্দ: উনিই তো আপনার প্রথম কাব্যগ্রন্হ “শয়তানের মুখ”-এর প্রকাশক। আপনার তো কবিতা লিখে সাহিত্যে হাতেখড়ি। আড্ডার দিনগুলোর কথা শুনবো?

    মলয় : না, আমি প্রথমে প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেছিলুম। আমার ধারাবাহিক গদ্য ‘ইতিহাসের দর্শন’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। তারপর লিখি ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’। এই বিষয়গুলো নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা হতো না। দাদার বন্ধুদের সঙ্গে হতো, দীপক মজুমদার আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে। সিপিএম সরকারে আসার পর সুভাষ ঘোষ আর বাসুদেব দাশগুপ্ত রাজনীতিতে আগ্রহী হয়। সুনীল আমার প্রথম কবিতার বইয়ের প্রকাশক হলেও হাংরি আন্দোলনের পর কৃত্তিবাস পত্রিকার জন্য আমার কাছে কখনও লেখা চাননি। এমনকি দাদা সমীর রায়চৌধুরীর কাছেও কবিতা চাননি অথচ দাদা ওনার প্রথম কবিতার বই “একা এবং কয়েকজন” বইটা নিজের প্রথম মাইনের টাকায় ছেপেছিল। কৃত্তিবাস ছাপাবার খরচও দাদা দিতো, “সুনীলকে লেখা চিঠি” বইটা পড়লে জানতে পারবে। দাদা অবসর নিয়ে কলকাতায় এসে “হাওয়া৪৯” নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ আর সম্পাদনা আরম্ভ করেন; তাতে সুনীল কোনও লেখা কখনও দেননি। সম্ভবত প্রতিটি লেখার জন্য উনি টাকা নিতেন বলে।

    গোবিন্দ :কি করে মনে হলো কবিতার পাশাপাশি গল্প উপন্যাসও আপনার বিষয়?

    মলয় : না, না। উপন্যাস আর গল্প লেখা আরম্ভ করেছি বেশ দেরিতে। গল্প আশির দশকে আর উপন্যাস নব্বুই দশকে। আমার প্রথম উপন্যাস ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’। তবে আমি সব জনারের উপন্যাস লিখেছি, এমনকী ডিটেকটিভ আর ইরটিক উপন্যাসও। অভিজ্ঞতা প্রচুর জমেছিল সারা ভারত ঘোরাঘুরি করে, বন্ধুবান্ধব-বান্ধবীও ছিল, তাদের নিয়ে প্রথমে লেখার ইচ্ছে হয়েছিল। ঔপন্যাসিক বা গল্পকার হবো ভেবে সেসব লিখিনি। প্রতিভাস থেকে আমার উপন্যাস সংকলন বেরিয়েছে “তিনটি নষ্ট উপন্যাস” নামে, তাতে যে প্রথম উপন্যাস আছে “ঔরস” নামে, সেটা সম্পর্কে গুরুচণ্ডালী সাইটে রঞ্জন রায় লিখেছিলেন,”দু’দিন ধরে কোনরকমে নাওয়া-খাওয়া সেরে একটানা পড়ে শেষ করলাম – “ঔরস” উপন্যাস। অসাধারণ লেগেছে। হয়ত মলয়বাউকে নিয়ে কিছু পূর্ব ধারণার কারণে এমন গদ্যরচনা আসা করিনি। এটি উপন্যাসের ভঙ্গিমায় একটি সোশিও অ্যান্থ্রপলজিক্যাল বয়ানকথা।আমি বীজাপুর, নারায়নপুর, কোন্ডাগাঁও, বস্তার, দন্তেওয়াড়া সুকমা গেছি। অবুঝমাড়ে ঢুকি নি। বেশ কিছু প্রত্যক্ষদর্শীর রিপোর্ট পড়েছি যাতে শহুরে মানুষের রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রবল।এই প্রথম ‘অবুঝমাড়’ নিয়ে একটি অথেন্টিক লেখা পড়লাম, তার প্রকৃতি, বনসম্পদ ও মানুষ নিয়ে। আশি পেরোনো মলয়বাবু কবে এসব এমন নিবিড় করে দেখলেন? আমি মাথা নোয়ালাম। যারা পড়েন নি পড়ে ফেলুন; ঠকবেন না — গ্যারান্টি!

    গোবিন্দ : আরেকটু বিশদ করুন।

    মলয় : আমি একটা প্রবন্ধে আমার লেখালিখি নিয়ে লিখেছিলুম। তোমাদের কাছে সহজে পৌঁছোয়না বলে কথাগুলো আবার বলি, প্রবন্ধটা থেকেই বলি, “দেখি খুল্লামখুল্লা লেখার চেষ্টা করে কতোটা কি তুলে আনতে পারি! উপন্যাস লিখতে বসে ঘটনা খুঁড়ে তোলার ব্যাগড়া হয় না। জীবনকেচ্ছা লিখতে বসে কেচ্ছা-সদিচ্ছা-অনিচ্ছা মিশ খেয়ে যেতে পারে, তার কারণ আমি তো আর বুদ্ধিজীবি নই। জানি যে মানুষ ঈশ্বর গণতন্ত্র আর বিজ্ঞান হেরে ভুত…..বাঙালি সাহিত্যিকদের চাঁদমারি ভাগ্য যে তাঁদের ইউরোপীয় সাহিত্যের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয় না। বাংলা পাল্প ফিকশন হলো ঘোলা জলের আয়নায় মুখদর্শন। সাহিত্যজগত থেকে ছিঁড়ে নিজেকে আলাদা না করলে লেখালিখি করা যায় না। আমি সাহিত্যিক লাউডগাগিরিতে ভুগি না, বুঝলেন তো! আমার লেখালিখি নিছক সাহিত্য নয়। গণপাঠককে আনন্দ দেবার জন্য নয় তা। পাঠককে চৌচির করে তার ভেতরে সমাজরাষ্ট্রের গুগোবর ভরে দেবার জন্য। আর আমি শিল্প ব্যাপারটার বিরুদ্ধে, কেননা আমাকে সারিয়ে প্রাচীন গ্রিক হেলেনিক সমাজের যোগ্য করে তোলা যাবে না। আমি চাই না যে আমার শবযাত্রায় কবি লেখকরা ভিড় করুক। একজনকেও চাই না…আমি লেখালিখি বেছে নিইনি, লেখালিখি আমাকে বেছে নিয়েছে। প্রথম আদিম মানুষ যেমন পাথরের ছোরা আবিষ্কার করেছিল তেমনই আমি নিজের লেখালিখির অস্ত্রশস্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছি।”

    গোবিন্দ : এ যাবৎ পেয়েছেন অনেক সম্মান। লিখেছেন অনেক গল্প। প্রকৃতপক্ষে বাংলা সাহিত্যের অবস্থান কোন জায়গায়?

    মলয় : সম্মান আবার কোথায় পেলুম? কেবল তো জুতো-লাথি খেয়েছি। বাংলা সাহিত্যের অবস্হান খুবই উঁচু জায়গায়। দুর্ভাগ্যবশত অনুবাদকের অভাব। রবীন্দ্রনাথকেও নিজে অনুবাদ করে ইউরোপীয়দের পড়াতে হয়েছিল। এই বইটা পড়েছো? ”সাতটা ক্ষুধার্ত পত্রিকার সংকলন” ( সম্পাদনা: শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রকাশক: দে'জ পাবলিশিং)। এতে আমার চোদ্দপুরুষকে গালমন্দ করা হয়েছে। বইটা প্রকাশের ব্যবস্হা করে দিয়েছিলেন শঙ্খ ঘোষ। ‘শব্দ ও সত্য” নামে একটা প্রবন্ধ লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, একটু আগে বলেছিলুম, পড়ে মনে হবে আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়নি, জেল-জরিমানা হয়নি।

    গোবিন্দ : প্রেম নিয়ে আপনার ভাবনা?

    মলয় : যা জয়দেব, বিদ্যাপতি, ভারতচন্দ্রের, রবীন্দ্রনাথের, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, বোদলেয়ারের।

    গোবিন্দ : আপনার প্রেমিকাদেরকে অনেক কবিতা আছে। বলুন।

    মলয় : হ্যাঁ। কীই বা বলব। সবই তো রোমিও বলে দিয়েছিল জুলিয়েটকে আর বোদলেয়ার বলেছিলেন জাঁ দুভাল, মাদাম সাবাতিয়ে, মাদাম দোব্রুঁকে।

    গোবিন্দ : কী লিখি কেন লিখি?

    মলয় : যা ইচ্ছা হয় লিখি। কী, কেন ইত্যাদি ভাবি না। তবে কী পড়ি আর কেন পড়ি তা বলা যায়।

    গোবিন্দ : হাংরি আন্দোলন কি সে অর্থে সফল বলে সমীর রায়চৌধুরী কিংবা আপনিও মনে করেন?

    মলয় : এসব তোমরা ভাববে।

    গোবিন্দ : এই সময় দাঁড়িয়ে কি মনে হয় হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজন ছিলো?

    মলয় : ছিল নিশ্চয়ই, তা নয়তো হলো কেন?

    গোবিন্দ : কবিতায় শ্লীল অশ্লীল শব্দোচ্চারণের সুস্পষ্ট কোন নিধি নিষেধ হয়?

    মলয় : ভারতীয় অলঙ্কারশাস্ত্রে শ্লীল-অশ্লীলের উল্লেখ বা বর্গীকরণ নেই। ওটা ইসলাম আর প্রোটেস্ট্যান্ট ভিকটোরিয় খ্রিস্টধর্মীদের আমদানি। মনে হয় তা থেকে আমরা শামুকের গতিতে মুক্ত করতে পারছি আমাদের কাজগুলোকে। আমাদের অলঙ্কারশাস্ত্র অনুযায়ী কাব্যরস নয় প্রকার। যথা: (১) আদি, (২) বীর, (৩) করুণ, (৪) অদ্ভুত, (৫) হাস্য, (৬) ভয়ানক, (৭) বীভৎস, (৮) রৌদ্র এবং (৯) শান্ত। আদিরসই তো ইরটিসিটি নিয়ে। আদিরস (the erotic) হলো নায়ক-নায়িকার অনুরাগবিষয়ক ভাব। ম্যাকলের সিলেবাস আমাদের ওপরে চেপে গেল আর আমাদের আদিরস লোপাট হয়ে গেল। এমনকি, কবিয়ালদেরও আমরা ছোটোলোক দেগে সাহিত্য থেকে ছাঁটাই করে দিলুম। একবার আলোচনায় তথাগত চট্টোপাধ্যায় বলেছিলেন, আমি তথাগতর বক্তব্য পুরোটা কোট করছি, “আদিরস মানে শৃঙ্গাররস। আদিরস মানে অশ্লীলের সমার্থক, এই ব্যপারটা খুব সম্ভব উনিশশতকেই হয়েছে। কাব্যশাস্ত্রের ১০টি রস

    ১. শৃঙ্গার: শৃঙ্গ শব্দের অর্থ হলো কামেদেব। শৃঙ্গের আর (আগমন) হয় যাতে, তাই শৃঙ্গার। এর অপর নাম আদিরস। নরনারীর দৈহিক সম্ভোগের ইচ্ছায় যে অনুরাগের সৃষ্টি হয়, তাকেই শৃঙ্গার একেই বলা হয়। প্রেমপ্রকাশ কাব্যে এই রসের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।

    ২. বীর: দয়া, ধর্ম, দান এবং যুদ্ধের নিমিত্তে এই রসের উদ্ভব হয়। এর প্রত্যেকটির ভিতরে জয় লাভের ভাব থাকে। যার দ্বারা প্রতিকুল পরিবেশকে পরাজিত করে জয়ী হওয়ার উদ্দীপনা প্রকাশ করা হয়। একই সাথে এতে থাকে বীরোচিত প্রতীজ্ঞা। ভয়ানক, শান্ত রস বিরোধী। যেমন−
    বারিদপ্রতিম স্বনে স্বনি উত্তরিলা
    সুগ্রীব; "মরিব, নহে মারিব রাবণে,
    এ প্রতিজ্ঞা শূরশ্রেষ্ঠ, তব পদতলে!
    - মেঘনাদ বধ, সপ্তম সর্গ। মধুসূদন

    ৩. করুণ: আকাঙ্ক্ষা নষ্ট হলে, অকল্যাণ হলে, প্রিয়জন বিয়োগ ইত্যাদিতে এই রসের সৃষ্টি হয়। মূলত শোকের ভাব এতে প্রকাশ পায়। শৃঙ্গার এবং হাস্যরস এর বিরোধী। যেমন−
    কাঁদিলা রাক্ষসবধূ তিতি অশ্রুনীরে
    শোকাকুলা। ভবতলে মূর্ত্তিমতী দয়া
    সীতারূপে, পরদুঃখে কাতর সতত,
    কহিলা− সজল আঁখি সখীরে;−
    কুক্ষণে জনম মম, সরমা রাক্ষসি!
    - মেঘনাদ বধ, নবম সর্গ। মধুসূদন

    ৪. রৌদ্র: ক্রোধ রস থেকে এই রস উৎপন্ন হয়। ক্রোধের উগ্রতা এবং ভয়ঙ্কর রূপ হলো এই রস। এই কারণে ক্রোধকে এর স্থায়ীভাব হিসেবে উল্লেখ করা হয়। অলঙ্কার শাস্ত্রে একে রক্তবর্ণ ও রুদ্রদৈবত নামে অভিহিত করা হয়েছে। যেমন−
    কি কহিলি, বাসন্তি? পর্ব্বত-গৃহ ছাড়ি,
    বাহিরায় যবে নদী সিন্ধুর উদ্দেশে,
    কার হেন সাধ্য যে সে রোধে তার গতি?
    - মেঘনাদ বধ, তৃতীয় সর্গ। মধুসূদন

    ৫. অদ্ভুত: আশ্চর্যজনক কোনো বিষয় থেকে উদ্ভুত বিস্ময়কর ভাবই হলো অদ্ভুত রস। সাধারণ অলৌকিক কোনো বিষয়কে এই রসকে উজ্জীবিত করা হয়। [ বিস্তারিত: অদ্ভুতরস ]

    ৬. ভয়ানক: ভয় থেকে এই রসের উদ্ভব। বিপদজনক বা ভীতিপ্রত কোনো বিষয় থেকে মনে যে ভাবের সঞ্চার হয়, প্রকাশই ভয়ানক।

    ৭. বীভৎস: কোনো কুৎসিৎ বিষয়ের প্রতি ঘৃণা থেকে বিভৎস রসের সৃষ্টি হয়।

    ৮. হাস্য: কৌতুকজনক বাক্য বা আচরণ থেকে এই রসের উদ্ভব হয়।

    ৯. শান্ত: চিত্তকে প্রশান্ত দেয় এমন ভাব থেকে শান্ত রসের উদ্ভব হয়।

    ১০.বাৎসল্য: সন্তানের প্রতি স্নেহের যে ভাবের উদ্ভব ঘটে, তাই বাৎসল্য রস। "

    গোবিন্দ : আপনার কি এখন মনে হয় যে হাংরি বুলেটিনগুলোতে আমাদের আদিরস বা শৃঙ্গাররস আলোচনা করলে আপনাদের আক্রমণ করার আগে সমালোচকরা দুবার ভাবতেন।

    মলয় : সমালোচকরা হয়তো পিছু হটতেন কিন্তু আক্রমণ করা ছাড়তেন না। আমার উকিল ব্যাঙ্কশাল কোর্টে আদিরসের প্রয়োগ নিয়ে তর্ক দিয়েছিলেন কিন্তু জজসাহেব তাকে স্বীকৃতি দেননি। প্রধান আক্রমণ ছিল যে আমরা ছোটোলোক বর্গ থেকে এসে সাহিত্যের আঙিনায় ঢুকে পড়ে তিরিশ থেকে পঞ্চাশ পর্যন্ত সাহিত্যের মানদণ্ডকে ভেঙে ফেলছি, সাহিত্যিক মূল্যবোধ দখল করে নিতে চাইছি। তুমি জানো না বোধহয়, দেবী রায় ছিলেন কৈবর্ত্য পরিবারের, উনিই বুলেটিনগুলো ওনার হাওড়ার বস্তিবাড়ি থেকে প্রকাশ করতেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় থাকতেন উল্টোডাঙার বস্তিতে। সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অবনী ধর ছিলেন উদ্বাস্তু পরিবারের। আর আমার কথা তো বলেইছি, পাটনার অন্ত্যজপাড়া ইমলিতলা থেকে।

    গোবিন্দ : ১৩ই সেপ্টেম্বর ২০২১এর আনন্দবাজার পত্রিকায় অভীক সরকার লিখেছেন, ‘আমি কী রকমভাবে বেঁচে আছি’। কৃশকায় একটি কাব্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছিল ১৩৭২ সনে (১৯৬৬) মধ্যচৈত্রে। কবিতার সংখ্যা ৭১। কবির নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। বইটি দৈবাৎ আমার হাতে আসে, বাবার বইপত্রের মধ্য থেকে। তখন আমার মেরেকেটে ১৫ বছর। সত্যি বলতে কি, আমার পুরো জীবনটাই লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল ওই কবিতাগুলো। সেই থেকে আজীবন ওই কাব্যগ্রন্থটি আমার কাছে অভিজ্ঞতার এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজ মাঝে মাঝে ভাবি, কেন ঘটেছিল এরকম? ওই কবিতাগুলির ছত্রে-ছত্রে প্রকৃতপক্ষে লুকিয়ে আছে এক অমোঘ ডিসগাস্ট, ব্যবস্থার প্রতি রাগী এক যুবকের প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ মুষ্ট্যাঘাত, প্রচলিত সমাজ-সংসার-সংশ্লিষ্ট মূল্যবোধ আর ভণ্ডামিকে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ করার গনগনে গর্জন। এক ছন্নছাড়া, প্রতিষ্ঠানবিরোধী, উদ্ধত তরুণের সঙ্গে কাব্যসংলাপে সেই যে জড়িয়ে পড়লাম, ওই কবিতা থেকে আর মন সরাতে পারলাম কই? পরবর্তী কালে, পরবর্তী জীবনে, দেশবিদেশের বহু মহৎ কবিতা বা কাব্যগ্রন্থ পড়ার সৌভাগ্য হয়েছে, কিন্তু এই বইয়ের স্বরদ্যুতি আমার কাছে অমলিন। কেননা তীব্র ক্রোধ, তীক্ষ্ণ প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা, অগ্নিভ অভিমান বহুক্ষেত্রেই কাব্যসংরূপে ততটা সার্থক হতে পারে না। প্রতিবাদী কবিতায় সারা বিশ্বজুড়েই প্রায়শই প্রতিবাদের অনুপাত এত বেশি হয়ে ওঠে যে, কবিতা বিষয়টাই বনবাসে চলে যায়। এ ক্ষেত্রে জাদুবলে সুনীল অকল্পনীয় এক আধুনিক কাব্যভাষাকে রপ্ত করেছেন। যেখানে নির্ধারিত ছন্দে অথবা গদ্যস্পন্দে ব্যক্তিজীবনের রাগ, দুঃখ, হতাশা, কল্পনা, স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন, বাস্তব-পরাবাস্তব, প্রেম, যৌনতা, রিরংসা, একাকিত্ব আর অস্তিত্ব জিজ্ঞাসার স্নায়ুকম্পনগুলিকে অত্যাশ্চর্য রুক্ষনৈপুণ্যে প্রকাশ করা যায়। একটু ভেবে দেখলে মনে হয়, পরবর্তী কালপর্বের অতি তরুণ কবিদের কাব্য উচ্চারণে এই কেতাবের স্বরক্ষেপ প্রভাব ফেলেছে। ভাস্কর চক্রবর্তী, শামসের আনোয়ার কিংবা সুব্রত চক্রবর্তীর গোড়ার যুগের কবিতার দিকে তাকিয়ে দেখুন। আপনার কি মনে হয় যে অভীক মজুমদার ইচ্ছাকৃতভাবে শৈলেশ্বর ঘোষ, ফালগুনী রায়, সুবো আচার্য, ত্রিদিব মিত্র, প্রদীপ চৌধুরী এবং আপনার নাম আলোচনা থেকে বাদ দিয়েছেন?

    মলয় : উনি লিখে থাকলেও বিভাগীয় সম্পাদক নামগুলো ছাঁটাই করে দিয়ে থাকবেন। কিংবা অভীক মজুমদারমশায়কে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল অমন করে লিখতে। একে আনন্দবাজার, তায় সুনীলকে বলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানবিরোধী। কবিতাগুলো সুনীল লিখেছিলেন হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার পর। বস্তুত হাংরি আন্দোলন ওনার কবিতার ধারাই পালটে দিয়েছিল।

    গোবিন্দ : আপনাদের আন্দোলনের প্রভাব পরবর্তী প্রজন্মগুলোর মহিলা কবিদের লেখায় দেখা গেছে। আলোচকরা তাও স্বীকার করতে চান না। তাকে পঞ্চাশের কবিদের প্রভাব বলে চালান। যেমন কবি যশোধরা রায়চৌধুরী তাঁর ব্লগে লিখেছেন, “বাঙালির রচিসংস্কৃতির অবদমিত যৌনবোধের প্রকাশ যখন কবিতার মানক, জীবনানন্দীয় কুয়াশায় যখন তরুণ কবিরা আচ্ছন্ন, তখনি কৃত্তিবাস আন্দোলন আনল ভাংচুরের পালা। মেধার সরণি ছেড়ে আত্মজৈবনিকের, স্বীকারোক্তির নতুন দিগন্ত খুললেন এই আন্দোলনের পুরোধা প্রধান পুরুষ কবিরা। সুনীল-শরৎ-শক্তি-তারাপদ… পাশাপাশি তুষার রায়, বেলাল চৌধুরী তন্ময় দত্তরা। সেই মুহূর্তের অ-প্রাতিষ্ঠানিকতার শেষ কথা এই কবিদের হাত থেকে বেরিয়ে আসা তাজা স্বতঃস্ফূর্ত কবিতাগুলি। বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘস্থায়ী এক প্রভাব। কবিতায় মেয়েদের পদচারণা তখন যথেষ্ট সীমিত।” অথচ পঞ্চাশের কবিদের প্রভাবিত করেছিল হাংরি আন্দোলন, তা উনি উল্লেখ করেন নি। আপনাদের পরের কয়েকজন মহিলা কবিকেও হাংরি আন্দোলন বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছিল। মিতুল দত্ত’র ‘দুর্বার জন্য কবিতা’ পযে দেখুন, “……. যেভাবে বুক দুটোকে বেঁধে রাখিস / মনে হয় ওরা তোর মেয়ে / একটুখানি ঢিলে দিলে বেয়াড়া অসভ্য হয়ে / ডেকে আনবে পাড়ার ছেলেদের / স্নানের সময় যেই খুলে দিস / হুটোপাটি করে ওরা স্নান করে / কেউ কাউকে একটু কষ্ট না দিয়ে / যে যার মতো একা।”

    মলয় : জানি। দেবারতি মিত্র লিখেছিলেন, “অসম্ভব অনুরক্তা শিশুসুলভতা নিয়ে / অচেনা আশ্চর্‌য এক লালচে কিসমিসরঙা / ফুলের কোরক মুখে টপ করে পোরে, / মাতৃদুধের মত স্বাদু রস টানে/ ক্রমে তার মুখে আসে / ঈষদচ্ছ অনতিশীতোষ্ণ গলা মোম / টুপটাপ মুখের গহবরে ঝরে পড়ে / পেলিকান পাখিদের সদ্যোজাত ডিম ভেঙে জমাট কুসুম নয় / একটু আঁষটে নোনতা স্বচ্ছ সাদা জেলি” (পৃথিবীর সৌন্দর্য একাকী তারা দুজন)। মল্লিকা সেনগুপ্ত লিখেছিলেন, “নারীর জরায়ুজমি লাঙল চাইছে / যদি অসমর্থ হই, ভাড়া করে, নিয়োজিত করে/অথবা যে কোনভাবে বীজ এনে দেব”। কিংবা, “মশারি গুঁজে দিয়ে যেই সে শোয় তার / স্বামীর কালো হাত হাতড়ে খুঁজে নিল / দেহের সাপব্যাং, লাগছে ছাড় দেখি / ক্রোধে সে কালো হাত মুচড়ে দিল বুক / বলল, শোন শ্বেতা, ঢলানি করবে না…” (স্বামীর কালো হাত)। রমা ঘোষ লিখেছেন, “কুড়িয়ে পেলাম ঘুর্নিবীজ বলা যায় না / আমার কত সুখ হয়েছে বলা যায় না / ঘুমের মধ্যে তোমার বাকল জড়িয়ে ছিলাম / ঘুম ভাঙতে তোমার শিকড় নিচ্ছি টেনে / তলিয়ে যাচ্ছি তোমার মধ্যে তলিয়ে যাচ্ছি, নীতা!… / রাত্রি দুটোয় আমায় তুমি পড়বে ঝুঁকে / বটের নিবিড় গাঢ় আঠায় কপাল ওষ্ঠ / ক্ষুধাই শুধু বুঝতে পারে স্তনবৃন্তের সুধা!” (ঘুর্নিবীজ)। সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন, “কাটাকুটি খেলতে গিয়ে বরাবর ভুল ঘরে ভুল গোল্লাগুলি / বসিয়েছ। দাঁত দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছ নিজের দুই ঠোঁট। / জ্যান্ত শুক্রবীজগুলি মুখে শুষে নাও আজ আর থুৎকারে / থুৎকারে ছুঁড়ে ফেলে দাও প্রাণহীন মরা – কুকুরের মতো।” (শুক্রস্হান)। চৈতালী চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন, “যার কোন উত্থানপতন নেই, আমি সেই / ছাতাপড়া অঙ্গটিকে গড় না করতেই পারি / যদ্যপি সে আমার স্বামীর। / শেষ জলবিন্দুটিকে, নিঃশেষ, না পাই, তো / যাঞচা করতে পারি অন্য মেঘ / যদি অহল্যাও হই, ইন্দ্রের কাছে যাব, বার বার / পাষাণ হব না।” (একটি শারীরিক কবিতা)।

    গোবিন্দ : হাংরি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কবিতার বাঁক বিশ্লেষণ করেন প্লীজ?

    মলয় : আমার যে সাক্ষাৎকারের বই বেরিয়েছে প্রতিভাস থেকে, তাতে পাবে। তালিকাটা দীর্ঘ।

    গোবিন্দ : হাংরি আন্দোলনে কারা যুক্ত হয়েছিলেন?এখনো কি তাদের উচ্চারণে হাংরি আন্দোলনের ছাপ আছে?

    মলয় : অনেকে। অনেকে। তিরিশ-চল্লিশজন। ১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন দত্ত, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অনিল করঞ্জাই এবং করুণনিধান মুখোপাধ্যায় ছিলেন চিত্রকর। সত্তর দশকের শেষে যাঁরা পুনরায় আন্দোলনটিকে জিইয়ে তোলার চেষ্টা করেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অরুণেশ ঘোষ, অরণি বসু, অরুণ বণিক, অলোক গোস্বামী, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্য মালাকার, কিশোর সাহা, জামালউদ্দিন, জীবতোষ দাশ, দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নির্মল হালদার, দেবজ্যোতি রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, বিজন রায়, রবিউল, সমীরণ ঘোষ, রতন নন্দী, রাজা সরকার, সত্যেন চক্রবর্তী, সৈকত রক্ষিত, সুব্রত রায়, সুব্রত চক্রবর্তী, রসরাজ নাথ, সেলিম মোস্তফা, শঙ্খপল্লব আদিত্য, সুভাষ কুন্ডু, স্বপন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। এখনও লেখায় টিকে আছি আমি আর পরের প্রজন্মের কয়েকজন। আর যে দুয়েকজন বেঁচে আছেন, তাঁরা লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছেন বা স্বাস্থ্যের কারণে লিখতে পারেন না।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    1 | 2 | 3 | 4 | 5 | 6 | 7 | 8 | 9 | 10 | 11 | 12 | 13 | 14 | 15 | 16 | 17 | 18 | 19 | 20 | 21 | 22 | 23 | 24 | 25 | 26 | 27 | 28 | 29 | 30 | 31 | 32 | 33 | 34 | 35 | 36 | 37 | 38 | 39 | 40 | 41 | 42 | 43 | 44 | 45 | 46 | 47 | 48 | 49 | 50 | 51 | 52 | 53 | 54 | 55 | 56 | 58 | 59 | 60 | 61 | 62 | 63 | 64 | 65 | 66 | 67 | 68 | 69 | 70 | 71 | 72 | 73 | 74 | 75 | 76 | 77 | 78 | 79 | 80 | 81 | 82 | 83 | 84 | 85 | 86 | 87 | 88 | 89 | 90 | 91 | 92 | 93
  • স্মৃতিচারণ | ০৩ ডিসেম্বর ২০২২ | ১১৪০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • :-? | 165.1.172.196 | ০৫ ডিসেম্বর ২০২২ ০৯:৩৪514407
  • "...একথা জানতাম না প্রধানমন্ত্রী পদ পেলেও পার্টির নামের দুর্গন্ধ মোছে না। ..."
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন