কাট থ্রি। দু’হাজার দুই সালের বিজয়া দশমী’র পরের দিন।
আপিস থেকে বেরিয়ে শ্যামবাজারের মিনি ধরে এ ভি স্কুল। গন্তব্য আমার গিন্নির সেজ মাসীর বাড়ি। উপলক্ষ বিজয়ার প্রণাম। গিন্নি টবিন রোড থেকে বাস ধরে উল্টোপারের বাস স্টপেজে। অতঃপর ট্যাঁপা ট্যেঁপি হাত ধরাধরি করে সেই – গিন্নি’র গুণ্ডিচা বাড়ি।
প্রণাম ইত্যাদি সেরে ফিশফ্রাই খেতে খেতে ডান চোখে একটা অস্বস্তি। দেখতে কেমন লাগছে যেন। যেন ঘরের সবকিছুর ডাইমেনশন ঠিক নেই মনে হচ্ছে। এচোখ ওচোখ খোলা বন্ধ করেও সেই একই অনুভূতি। একজনকে দিয়ে আনালাম একটা মামুলি আই ড্রপ। চোখে দিলামও। কিন্তু নো রেজাল্ট ! অতঃপর ওখান থেকেই আমার চোখের ডাক্তারবাবুকে ফোন। শুনেটুনে বললেন চেম্বারে চলে যেতে। দমদম স্টেশনের কাছে।
একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুট ছুট ছুট। ততক্ষণে দুরের টিউবলাইট গুলো সবুজ। সোজা টিউবলাইট যেন এঁকেবেঁকে পথ যদি না শেষ হয়। সাদা হয়ে গেল সবুজ।
সব রোগী দেখা শেষ করে ডাক দিলেন ডাক্তারবাবু। ততক্ষণে আমি বুঝে গেছি যে একটা বড় কিছু গড়বড়। শুয়ে পরলাম টেবিলে। অনেকক্ষন ধরে সেই কয়লাখনির হেডলাইট লাগিয়ে আর পেরেকের মাথা দিয়ে বিভিন্ন দিক থেকে সাঙ্গ করলেন চোখ-পরীক্ষা। বললেন আবার আগামীকাল সকালে উনি আরেকবার দেখবেন। বাড়ি গিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা শুধু। ডিট্যাচমেন্ট হয়েছে – মানে রেটিনা ছিঁড়েছে। উনি জানেন যে আমি আবার শঙ্কর নেত্রালয় ভক্ত। উনিও সেখানকার ছাত্র ছিলেন। বললেন যতো তাড়াতাড়ি চেন্নাই যাওয়া যায় ততই মঙ্গল।
ক্রমে ক্রমে সেই বার্তা রটি গেল বটে। পরের দিন আমার অফিস থেকেই টিকিট কাটা হয়ে গেল। প্লেনের। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের সন্ধ্যেবেলার ফ্লাইটে। প্রচুর ভাড়া তখন। এসব প্রাইভেট এয়ারলাইন্স তখনো বহুদূর। দুদিনের জন্য আমাদের অফিস গেস্ট হাউসটাও পাওয়া গেল। রাত পৌনে দশটায় পৌঁছলাম নেত্রালয়ে।
শঙ্কর নেত্রালয়ের কলেজ রোডের এমার্জেন্সি ৩৬৫ X ২৪ ঘন্টাই খোলা। মাত্র দুটো পেশেন্ট সাথে বাড়ির লোকজন। আরেকজনও একই ফ্লাইটে গেছেন কলকাতা থেকে।
আমার এমআরডি (ওখানকার ৬৯ঙ) নাম্বার জিজ্ঞেস করলেন ডাক্তার। গোটা শঙ্কর নেত্রালয় তখন সুন্নুনাটা। ডাক্তার এক সিকিউরিটিকে ডেকে আমার নাম্বার দিয়ে ফাইলটা আনতে বললেন। বিশ্বাস করুন ঠিক পাঁচ মিনিট। আমার সেই “এ্যালারজিক টু সালফার” লেখা ফাইল ডাক্তারবাবুর টেবিলে। তখন ডানচোখ পুরো অন্ধকার। কালো – নিকষ কালো।
যদিও প্রথম দেখেই ডাক্তার জানালেন যে ভর্তি হতে হবে কিন্তু তারপরে সম্ভবত সিনিয়রকে ফোনে জানালেন। স্থির হ’ল পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ আবার এই এমার্জেন্সিতেই আসতে হবে।
হাসপাতাল থেকে অটো ধরে গ্রীমস্ লেন। গেস্ট হাউসে ঢোকা গেল। আমার দৃষ্টি কেবল একটা চোখেই। দুর্গা নাম জপতে জপতে রাত্তিরটা কাটলো কোনো রকমে। উৎকণ্ঠায় ঘিরে আছে মনের অন্দরমহল। ফিরে পাবো তো ডান চোখের আলো !!
যথারীতি পরেরদিন হাসপাতালের এমার্জেন্সিতে পৌঁছনো মাত্রই শুরু হয়ে গেল ডাক্তারদের ব্যাপক কর্মকাণ্ড। ভর্তি হয়ে আমার জায়গা হ’ল একটা কেবিনে। আর সারাদিন ধরে অজস্র ডাক্তারদের আসাযাওয়া আর চোখে সেই হেডলাইটের জোরালো আলোয় খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখা। যদিও ওই জোরালো আলোর বিন্দুমাত্র জেল্লা ঢুকছিলো না চোখে। জানলাম আমায় যিনি অপারেশন করবেন তাঁর নাম ডাক্তার মুনা ভিণ্ডে। পরেরদিন ঠিক সকাল আটটায় আমায় দিয়ে সেদিনের অপারেশন শুরু হবে। এমার্জেন্সি এতটাই…।
হাতে ওয়াকিটকি নিয়ে কথা কইতে কইতে আমায় সেদিন সকালে অপারেশন থিয়েটারে ঘরে পৌঁছে দিল দুজন। স্ট্রেচারের বিছানায় শুয়ে শুয়ে অজ্ঞান করার আগে অব্দি দেখছিলাম একটা সুশৃঙ্খল টিমওয়ার্কের সুনিপুন ব্যস্ততা। আমাকে পুরো অজ্ঞান করে দেওয়া হল। সাড়ে চার ঘন্টার অপারেশন।
জ্ঞান যখন এলো তখনো আমি সম্ভবত ওটি’র বাইরের ঘরে। তারপরে ঘুম ঘুম আর ঘুম। আর কিছুই মনে নেই সেদিনের সন্ধ্যে অব্দি।
সেই সকাল থেকে একটানা অপারেশন করে ডাক্তার ম্যাডাম যখন আমার কেবিনে এলেন তখন চেন্নাই-এর আকাশ বেশ অন্ধকার। শঙ্কর নেত্রালয়ের ডাক্তারদের একদিন আউটডোর আর পরের দিন ওটি। এমন ভাবেই শিডিউল তৈরি থাকে। আর চোখের যে স্পেশালাইজেশন হয় তা বুঝেছিলাম এখানে এসেই। কেউ রেটিনা, কেউ কর্নিয়া, কেউ গ্লুকোমা ইত্যাদি নানান ভাগ। অর্থাৎ সাধারণভাবে যিনি ছানি অপারেশন করছেন তিনি রেটিনা অপারেশন করেনই না। এছাড়া সিনিয়র ডাক্তারদের ওখানে পড়াতেই হয় মাস্টার্স করতে আসা স্টুডেন্টদের।
ডাক্তার ম্যাম দেখা করে দুচারটে কথা বলে বিদায় নিলেন। রাতের খাওয়া খেয়ে আবার ঘুম। পরের দিন টানা রেস্ট। ডান চোখ তখনো অন্ধকার।
রেস্টের দিন ছিল রবিবার। বেশ মনে আছে। সেদিন অল্প হাঁটা চলার অনুমতি মিলেছিল। সক্কাল থেকেই একটা ঘটাংঘট আওয়াজ পাচ্ছিলাম মাঝে মধ্যেই। এসব ব্যাপারে আমার উৎসাহ অনেকটা ফেলুদার কাছাকাছি। জিজ্ঞেস করতে করতে গিয়ে জানা গেল, রবিবার যেহেতু আউটডোর বন্ধ তাই শঙ্করা নেত্রালয়ের যতোগুলি লিফট্ আছে সেসবগুলোর টেস্ট চলছে যাতে অন্যদিনগুলোয় যেন গড়বড় না করে। নিয়মিত তাই লিফটের স্বাস্থ্য পরীক্ষা চলে প্রতি রবিবার।
আরেকটা কথা বলে ফেলি এই ফাঁকে। অবাক হয়ে আগের দেখেছিলাম এই কলেজ রোড এর মেন বিল্ডিং-র প্রতি ফ্লোরেই একটা ছোট্ট লিফট্। সাইজ যার এই ধরুন দু ফুট বাই দেড় ফুট। অনুসন্ধানে জানা গেল যে এগুলো ওই পেশেন্টদের ফাইল বয়ে বেড়ায়। ফাইলগুলো যেহেতু থাকে বেসমেন্টে তাই প্রতিদিন প্রয়োজনমত ফাইলগুলো সেখান থেকে নির্দ্দিষ্ট ফ্লোরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যে ফ্লোরের ফাইল সেই ফ্লোরে ওই লিফটের ওপরের একটা আলো জ্বলে ওঠে। উল্টোদিকে বসে থাকা সিস্টারের সেই ফ্লোরের নির্দিষ্ট ফাইল বার করে নেন তৎপরতায়। কি অসাধারণ সিস্টেম ! আমাদের দেশ এই ভারতেই।
প্রসঙ্গত বলি, হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট এর দুবছরের কোর্স আগেই চালু করেছিল শঙ্করা নেত্রালয় চেন্নাই। এখন তার সাথে যুক্ত হয়েছে নানান ধরনের চোখের চিকিৎসা ও ম্যানেজমেন্ট কোর্স। ভাবলেই কেমন যেন মাথা ঘোরে আমার ! এই ম্যানেজমেন্ট যদি শুধুমাত্র আমাদের যে কোনো একটা মিউনিসিপ্যালিটি চালাতো শুধু টেস্ট করতে তাহলে ভারতের চেহারা অন্যরকম হতই হ’ত। এদের পরিচালিত কোর্সগুলো জানতে নিচের লিংক দেখতে পারেন -
http://wwwthesnacademyacin/এই হল ডাক্তার এস এস বদ্রীনাথ-র (Dr Sengamedu Srinivasa Badrinath(Dr SSB)স্বপ্নের ফসল। যা আজ সারা ভারত শুধু নয় ভারতের বাইরেও যথেষ্ট পরিচিত শুধুমাত্র চোখের হাসপাতাল বলে নয়, প্রত্যেক বছর এক দল করে চোখের ডাক্তার ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারা ভারতে।
সেঙ্গামেডু শ্রীনিবাস বদ্রিনাথ (জন্ম ২৪ফেব্রুয়ারি ১৯৪০) হলেন ভারতের অন্যতম বৃহত্তম দাতব্য চক্ষু হাসপাতাল, চেন্নাইয়ের শঙ্করা নেত্রালয় -এর ভারতীয় প্রতিষ্ঠাতা এবং চেয়ারম্যান ইমেরিটাস। তিনি ন্যাশনাল একাডেমি অফ মেডিকেল সায়েন্সের একজন নির্বাচিত ফেলো। তিনি ১৯৯৬ সালে ভারতের প্রজাতন্ত্রের তৃতীয়-সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার ‘পদ্মভূষণ’ লাভ করেন। তিনি পদ্মশ্রী এবং ডঃ বিসি রায় পুরস্কার সহ আরও অনেক পুরস্কার লাভ করেন।
আরো বিশদে জানতে
https://enwikipediaorg/wiki/S_S_Badrinathএকটা মাত্র মানুষ ইচ্ছে করলে কি কি করতে পারে তার অনেকগুলো উদাহরণ আছে আমাদের দেশেই। কি কি করতে পারার সাথে অবশ্যই জড়িয়ে থাকে দেশের মানুষের মঙ্গল। আবার এ দেশে এমনও উদাহরণ আছে যে সামাজিক কর্তব্য তো দূরের কথা যারা গোটা দেশটাকেই- হাতের মুঠোয় পুরে ফেলার লক্ষ্য নিয়েই অবিচল থাকে। সেই সমস্ত মানুষজন প্রয়োজনে দেশের আইন অব্দি বদলে দিতে পারে যা শুধু তাদের পরিবারেরই স্বার্থ রক্ষা করবে। সামাজিক দায়িত্ব তো দূরের কথা !
এই বয়সে এসে নিজের ওপরে খুবই ঘেন্না করে। আমাদের ছাত্র জীবনে কতো না শ্লোগান শুনেছি – ‘টাটা-বিড়লার কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’। অথচ এই টাটা-বিড়লা-গোয়েঙ্কা ইত্যাদি সে সময়ের পুঁজিপতিরা সামাজিক দায়িত্ব পালনে অনেকখানি ভূমিকা নিয়েছিলেন।
……চলবে……পরের পর্বে…
#
©গৌতমদত্ত