এ লেখা লিখতে গিয়ে গুগুল মামা’র সৌজন্যে জানা যাচ্ছে অনেককিছুই। আপনাদেরও একটু বিরক্তি ঘটাই— ।
ভারতের বাণিজ্য শহর মুম্বাইতে ১৯৮৭ সালে চোখের ব্যাপার নিয়েই হয়েছিল একটা কনফারেন্স। সেই কনফারেন্সের কারণে এক ইতালিয়ান কোম্পানি অপ্টিকন (Opticon) নিয়ে এসেছিল এক phacoemulsification machine।
মুম্বাইবাসী চোখের সার্জেন ডাঃ কেইকি আর মেহতা অনেক ব্যঙ্গ সয়েও কিনেছিলেন সেই ফেকোমালসিফিকেশন যন্ত্রটি। তিনি ছিলেন Mehta International Eye Institute and the Colaba Eye Hospital এর জনক। এক সাক্ষাৎকারে ডাঃ মেহতা বলেছেন যে সেসময় আমাদের তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো বেসিক থেকেই যা কিছু শুরু করবে এই ছিল ধারণা। কিন্তু সেই ধারণা পাল্টে তিনি কিনলেন এ মেশিন যাতে আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্ব যেন এক্কেরে আধুনিকতম যন্ত্রের সাহায্য নিয়েই এগিয়ে যেতে পারে।
প্রথম কেনা এই ফেকো মেশিনটি বসেছিল ডাক্তার মেহতার বাড়ির বৈঠকখানায়। মেশিন বসানোর পরে যখন ডাক্তার মেহতা এই মেশিনের একটা ম্যানুয়াল চাইলেন তখন তাদের কর্মকতা নাকি বলেছিলেন যে এ মেশিনে মাত্র চারখানা কানেকশন। তার জন্যে আবার ম্যানুয়াল কি হবে ?
১৯৮৮ তে তিনি উড়ে যান আমেরিকা যুক্তরাস্ট্রে ডাক্তার উইলিয়াম এফ ম্যালোনির কাছে এ সম্পর্কে বিস্তারিত জ্ঞান অর্জন করতে। তারপর থেকে আর পেছনে তাকাননি ডাক্তার মেহতা। ভারতও অর্জন করল এই নতুন মেশিনটার সুবিধে।
https://wwwhealiocom/news/ophthalmology/20120325/father-of-indian-phaco-continues-to-build-on-legacy-of-innovation১৯৭৬ সালে আত্মপ্রকাশ করা এই শঙ্কর নেত্রালয়ে এই ফেকো মেশিন এসেছিল কলকাতায় আসার অনেক আগেই। অন্তত আমার জ্ঞানমতো। সে সময়ে অবশ্য দুচার জন শঙ্কর নেত্রালয় থেকে মাস্টার্স করা চোখের ডাক্তারবাবুরা এ শহরে ছড়িয়ে পরেছেন এক নতুন দিশা দেখাতে।
যদিও আমার বরানগরের ডাক্তারবাবু সেদিনও দেখেশুনে বলেন যে কিছুই হয়নি আমার। এসব মনের ভুল। কি আর বলি !
মাস তিনেক বাদে আবার চেন্নাই। হয়ে গেল ছানি অপারেশন। “ডে কেয়ার প্রসেস” কথাটাও সেই প্রথম শোনা। একটু দূরের সদ্য স্থাপিত হওয়া অন্য একটি ইউনিটে অপারেশন করলেন ডাঃ রবিশঙ্কর। ঘণ্টা দুয়েক বাদেই ফিরে এলাম গেস্ট হাউসে। ডান চোখে তুলোর গোল ব্যাণ্ডেজ।
পরের দিন আবার যেতে হল সেখানেই। ডাক্তার যখন চোখের ব্যান্ডেজ খুলে দিলেন তখন যে কি এক অসাধারণ অনুভুতি হয়েছিল তা এতোদিন পরেও যেন অনুভবে আনতে পারি। চশমা ছাড়া ডান চোখে ঝকঝকে দৃষ্টি। অনেক আলো যেন ঝাঁপ দিয়ে চোখে ঢুকলো সেদিন আমার।
মনে আছে একটা ছোট্ট আইওয়া টেপরেকর্ডার নিয়ে গেছিলাম আমি যদি ডাক্তারের পরামর্শ রেকর্ড করে রাখতে পারা যায়। অনুমতি চাইলাম। সস্নেহে দিলেন তা ! আজও খুঁজলে পাবো হয়তো সেই “TDK” ক্যাসেট যার মধ্যে ধরা আছে ডাক্তার রবিশঙ্করের আফটার অপারেশন এ্যাডভাইজ।
*
এরপরে আমার বাঁ-চোখ অপারেশন হয় দু’হাজার সালে।
সেবারে অন্য ডাক্তার। আর অপারেশনের জন্য ওদের
JKCN ইউনিটে এক রাত থাকতেও হয়েছিল। এ হাসপাতালটি কলেজ রোডের মূল হাসপাতালটি’র কিছুটা পেছন দিকে। সেটাও ছিল “ফেকো” সার্জারি। আমি তখন এই অপারেশনের পরের ব্যাপারগুলোয় বেশ রপ্ত।
নির্দ্দিষ্ট দিনে যথারীতি অপারেশন হয়ে গেল। সম্ভবত দুপুরের পরে হয়েছিল এ অপারেশন। আমি একাই শুয়ে আছি। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নামল। রাত বাড়ল। তারপরে রাতের হালকাপুলকা খাবার খেয়ে একটানা ঘুম। ঘুমটা ভেঙে গেল ভোর চারটে সাড়ে চারটে নাগাদ। চোখে তখন হাল্কা ব্যথা। একটু অস্বস্তি। এরই মধ্যে সিস্টারের যাওয়া আসা। নিস্তব্ধ চারদিক। চেন্নাই এর এই অঞ্চলটা সত্যিই বেশ নির্জন। আর গাড়ির হর্ণ তো দূর-অস্ত্। আমাদের মেডিক্যাল কলেজের সামনে বা অন্যান্য চিকিৎসা-কেন্দ্রের বাইরে “নো-হর্ন” এর ছবি আঁকা গোল গোল বোর্ড বিভিন্ন জায়গায় লটকানো থাকলেও কে আর মনে রাখে তা ! কিন্তু চেন্নাই ব্যতিক্রম।
ঘন্টাখানেক পার হ’ল। ঘড়ি তখন ভোর পাঁচটা আর সাড়ে পাঁচটার মধ্যেই। চোখের ব্যথাটা অল্প বাড়ছে। একান্ত নিরুপায় হয়ে সিস্টার বেল-এ হাত দিলাম। বাইরের আওয়াজটা বেশ শোনা গেল। এরমধ্যেই খটখট হাল্কা শব্দে সিস্টারের পদধ্বনি। “গুড মর্নিং…ইয়েস…”
ঋজু বেশ দীর্ঘাঙ্গী এক কেরালা-কন্যার আহ্বান। আমার সিস্টার। আমার দেবদূত। আমার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল। মধুর কণ্ঠে সেই গোল গোল শব্দের ইংরেজি অনর্গল। বললাম – সিস্টার আমার চোখটায় হাল্কা একটা ব্যথা হচ্ছে। গিভ মি সাম মেডিসিন…।
হোমের আগুনে ঘি পড়ল যেন ! রোষায়িত নেত্রে কঠিন স্বরে প্রশ্ন ধেয়ে এল। কখন থেকে হচ্ছে এই ব্যথা ? উত্তরে বললাম, এই ভোরে ঘুম ভাঙার পর থেকে।
কে শোনে কার কথা ! শ্যামাঙ্গী তখন ক্রোধে আরক্ত। কতো যে অজানা অচেনা শব্দের কঠিন উচ্চারণ আমার কানের পর্দায় লহরীর পর লহরীর তুলিয়া বহে গেল সে কথা আর না বলাই উপাদেয়।
সারাংশ যা বুঝলাম তা এই যে আমার এই চোখের ব্যথা কাল নাকি সারারাত্তির ধরেই ভোগ করেছি আমি। লজ্জায় তাঁকে ডাকিনি। বোঝানোর চেষ্টা জলেই গেল। গজগজ করতে করতে আমার ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল আমার ঘর ছাড়লেন দ্রুত পায়ে। হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম যেন। ব্যথা তখন কোন চোখে তা ভুলতে বসেছি।
ওমা ! আবার খটখটিয়ে শ্যামাঙ্গীর আগমন। হাতে ট্যাবলেট। ক্রুদ্ধ ভাব বহাল তখনো। এক হাতে জলের গ্লাস আর ট্যাবলেট বাড়িয়ে ধরা অন্য হাত। বাধ্য শিশুর মতো হাত থেকে ট্যাবলেটখানা নিয়ে মুখে। আধাশোয়া আমি তখন। মুখে ঠেকলো জলের গ্লাস। ক্যোঁৎ করে গিলে নিলাম ব্যথার উপশম। চারদিক আবার নিস্তব্ধ। খটখটিয়ে আমার খাট সোজা করে দিয়ে আবার প্রস্থান কেরালীনি’র।
“
নার্সকে পছন্দ হলে অর্ধেক অসুখ সেরে যায়
শূন্যতা, ডেটলগন্ধ, ভাতে মাছি--সব ভালোলাগে
পুরোপুরি সেরে উঠলে ডিসচার্জ--
সেই ভয়ে ভয়ে
বাকীটা জীবন তাই
অর্ধেক অসুখ নিয়ে হাসপাতালে থেকে যেতে হয় ” ( - ‘নার্স’ - রণজিৎ দাশ।)
……চলবে……পরের পর্বে…
#
©গৌতমদত্ত