এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ভ্রমণ

  • অচিনপুরের বালাই 

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ভ্রমণ | ২৩ জানুয়ারি ২০২২ | ২১৩০ বার পঠিত
  • চোখে জল নিয়েই লাজবন্তী দৌড়ে গেলেন ঘরে, ফিরে এলেন গামছা, তেলের শিশি আর শুকনো কাপড় নিয়ে। উবু হয়ে বসে গামছা দিয়ে মুছে দিলেন বালাইয়ের গা-মাথা-হাত এবং পায়ের অবশিষ্ট। তারপর সারা গায়ে মাথায় তেল মাখিয়ে দিলেন যত্ন করে, লুঙ্গির মতো ফেরতা দিয়ে পরিয়ে দিলেন ধুতি। লাজবন্তীর মুখে কোন কথা নেই, কিন্তু বিরাম নেই তাঁর দুই চোখের অশ্রুধারায়। তেল মাখতে মাখতেই বালাই, লাজবন্তী আর আমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গান ধরল,

    “তুমি কে? পাগলপারা হে, বহুদিনের চিনা বলে মনে হতেছে।

    বসেছিলাম বুক পেতে, পথের মাঝে আন্ধারেতে
    জীবন আলো নিয়ে তুমি ধরা দিলে যে, পাগলপারা হে।

    যতই মাখো ধুলাবালি, নেব তোমার কালো কালি,
    চলবে না হে ফাঁকিবাজি, ছাড়বো না আর হে।
    তোমার ডালে আমি যে হায়, ঝুলে আছি পাতায় পাতায়,
    রাখো কিনা রাখো ধরে তোমার কৃপায় যে, পাগলপারা হে।
    তুমি কে? পাগলপারা হে, বহুদিনের চিনা বলে মনে হতেছে”।

    আমি হেসে বললাম, “এ তোমার কথা তো নয়, বালাই। এ গান তোমার নয়। এ গান আমি বহুদিন আগেই শুনেছি, আমার বড়ো প্রিয় গান”।

    বালাই এখন জামা-কাপড় পরে ফিট-ফাট বাবুটি, হেসে বলল, “এ গান আমার নয় ঠিকই, কিন্তু আমার কথা নয় এ কথাটি আপনি কেমন করে বললেন? আপনি তখন যে গানটি আমাদের শোনালেন সে গান কী আপনি বেঁধেছিলেন? তা তো নয়, বাবু। অন্যের গানেও যে মনের কথা ফুটিয়ে তোলা যায় – সে কথাটি আপনার না জানা নয়”।

    আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললাম, “কথাটা সত্যি। যে গানে আমাদের মনের কথাই স্পষ্ট শোনা যায়, সেই গানই তো আমাদের প্রাণের গান হয়ে ওঠে!”

    চোখ নাচিয়ে বালাই বলল, “তবে? কিন্তু এসব গানও আপনি শুনলেন কোথায়? সব মেলাতেই দেখেছি আপনাদের মতো শহুরে শ্রোতারা ঘুরে ফিরে “সাধের লাউ”, “গোলেমালে পিরিত কইরো না”, কিংবা “বড়োলোকের বিটি লো”, “মেনকা মাথায় দে লো ঘোমটা” এই ধরনের গান গাইতে বারবার অনুরোধ করে। আমাদের নতুন গান তেনাদের কাছে অছ্যুত”। বালাইয়ের কথা শুনেই আমার চোখের সামনে বিভিন্ন বাউল মেলার কয়েকটা টুকরো দৃশ্য ভেসে উঠল। শুষ্ক নেশায় মত্ত শহুরে তরুণ-তরুণীদের উদ্দাম নৃত্য – আর তার সঙ্গে গলার শির ফুলিয়ে তারকা বাউলদের গাওয়া ওই গানগুলি। যে গানগুলির সারার্থ নিঃশেষে মুছে গিয়ে প্রকট হয়ে ওঠে উৎকট চটুলতা! “আপনার বুঝি বাউলদের আখড়ায় বা মেলায় যাওয়ারও অভিজ্ঞতা রয়েছে?”

    আমি বললাম, “না, না, সে তেমন কিছু না। তবে কালকূট ছদ্মনামে এক বাউলমনা মানুষের লেখা বই আমার খুব প্রিয়। তাঁর লেখা “অমৃত কুম্ভের সন্ধানে” বইতে এই গান পড়েছিলাম। ওই বই নিয়ে পরে একটা সিনেমা হয়েছিল, তাতে বিখ্যাত শিল্পী অমর পাল গানটি গেয়েছিলেন। সেই ছোকরা বয়সেই গানটি আমার মনকে বড়ো নাড়া দিয়েছিল। তাই আজও মনে আছে…”।

    আমাদের কথাবার্তার মধ্যেই আসন এনে লাজবন্তী দাওয়ায় পেতে দিলেন, বললেন, “এখানে বসেন বাবু, বেলা পড়ে এল প্রায়...খুদকুঁড়ো দুটো মুখে দিন”। তার গলা এখনও ভারি, কান্নাভেজা। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম, কিছু বললাম না, মৃদু হেসে আসনে বসলাম। আমার সামনে বালাই বসে বসে আমাকে দেখতে দেখতে বলল, “ঘরে বসে শুধু বই পড়ে মনটারে এমন বাউলো করলেন কী পেকারে বলেন তো? তখন যে পরাণসখার গানটি গাইলেন, সেটি গানটি কার, বাবু?”

    “রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর”।

    “সেই শান্তিনিকেতনের কবি, নয়? যাঁর নোবেল চুরি গেছে অনেকদিন হল”! আমি ঘাড় নাড়লাম। বালাই আবারও বলল, “শুনেছি তিনি সব বাউলের পরমবাউল। তিনি নাকি এক্কেবারে জনক রাজার মতো। সংসারধর্ম পালন করেছেন রাজার মতো, কিন্তু মনটারে তুলে রেখেছিলেন জগদীশ্বরের আড়ায়। জেবনে তিনি যতো দুঃখশোকে জেরবার হয়েছেন, ততোই বেড়েছে তাঁর ভগমানে পেত্যয়...!”

    বালাইয়ের মুখে রবীন্দ্রনাথের এমন নিখুঁত মূল্যায়ন শুনে অবাক হলাম। বাংলা ভাষায় সাম্মানিক নিয়ে উত্তীর্ণ বহু মানুষের মধ্যে এমন উপলব্ধি কোনদিন নজরে আসেনি। আমি বালাইয়ের দিকে নতুন চোখে তাকিয়ে রইলাম। আর এরই মধ্যে লাজবন্তী দু হাতে থালা নিয়ে বাইরে এলেন, প্লাস্টিকের থালায় চূড়ো করা ভাত – একপাশে কুঁদুরি ভাজা। আমার সামনে প্রথমে তারপর বালাইয়ের সামনে থালা রাখলেন। ভাতের পরিমাণ দেখে আমি বললাম, “ভাত যে একটু কমাতে হবে, দিদি? এত ভাত খেতে পারব না, তুলে নিন, লাগলে পরে আবার না হয় চেয়ে নেব”।

    ভাতের থালা বেড়ে দিয়ে লাজবন্তী ভেতরে গিয়েছিলেন, ডাল আর চুনোমাছের ঝাল আনতে। ওই সঙ্গে একটা শূণ্য থালাও আনলেন সঙ্গে। আমার থালার সামনে রেখে বললেন, “জোর করবো না, আপনার মুখে এই ভাত রুচবে কি না জানিনা, তবে যতটা পারেন…।

    দুমুঠো ভাত খালি প্লেটে তুলে রেখে হেসে বললাম, “ওই রুচির কথাটি মনেও স্থান দেবেন না, দিদি। এই বাংলার অনেক গ্রামে ঘুরে বেড়িয়েছি, ঘুরে বেড়িয়েছি কেরালা থেকে হিমাচল, গুজরাট থেকে শিলচর। নানান জায়গার বিবিধ ভাতের সন্ধান আমি পেয়েছি। কোনদিন কোথাও রুচিতে বাধে নি, সে ধনী বাড়ির সেরা বিরিয়ানিই হোক, অথবা অকিঞ্চনের পেঁয়াজ-পান্তাভাতই হোক”।

    ভাতের মাঝখানে গাব্বু বানিয়ে বললাম, “এইখানে ডাল দিন দেখি, ভাত কটা মাখি”।

    বালাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে কথা শুনছিল, ডাল দিয়ে ভাত মেখে কুঁদুরি ভাজা দিয়ে আমি গ্রাস তুলতে সে হাসল, সেও গ্রাস তুলল মুখে। একটু শক্ত মোটা মোটা ভাতের দানা - এই চালের ভাতে আমি অভ্যস্ত নই ঠিকই। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষরা এই চালের ভাতেই তৃপ্তি পান, তাঁরা বলেন এই ভাত পেটে অনেকক্ষণ থাকে – খিদের দীর্ঘ উপশম। ছোটবেলায় আমাদের গ্রামের বাড়িতেও দেখেছি, ক্ষেতে কাজ করা মুনিষদের জন্যে শক্ত চালের ভাত রান্না হত। বড়ো কানা উঁচু বেলুঞ্চিতে বেড়ে দেওয়া ভাতের চূড়ো, বার তিনেক শেষ করে তাঁরা তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলতেন। কিন্তু বাড়িতে কোন অনুষ্ঠানে সবার জন্যে সরু চালের ভাত হলে, তাঁরা বড়ো মনঃক্ষুণ্ণ হতেন, বলতেন, “এ ভাতে কী আর পেট ভরে, ছোড়দাঠাকুর? এ য্যানো ঢ্যামনা সাপকে ফড়িং গেলানো”!

    কুঁদুরি কোনদিনই আমার প্রিয় সবজি নয়, ডালটাও খেয়ে মনে হল পাঁচমিশালি ডাল – মুগ, মুশুর, ছোলা…। তবু গরম ভাতের সঙ্গে সবকিছুই শেষ করে দেওয়া গেল সহজেই। শুকনো ভাত ভেঙে হাসতে হাসতে বললাম, “এবার আপনার চুনো মাছের সর্ষে ঝালটা দিন দেখি, বালাই বলছিল অমেত্ত, অমন তার অন্য কোথাও আর পাবো না”! এবার লাজবন্তী সত্যিই লজ্জা পেলেন, আমার পাতে চুনোমাছের ঝাল তুলতে তুলতে বললেন, “ওর কথা ছাড়েন দিকি, ওর যতো ভালাই ভুলোনো কথা। অন্যের মুখে ঝাল খেয়ে লাভ কী, নিজেই খেয়ে দেখেন না। আরেক মুঠো ভাত দিই, আদ্দেক ভাত তো তুলেই দিয়েছিলেন”। চারটি ভাত আরও নিলাম।

    সর্ষের ঝোল দিয়ে মেখে ভাতের গ্রাস মুখে তুলতেই মুখের মধ্যে যেন আগুন ছুটল। এতই ঝাল। অন্যের মুখে ঝাল না খাওয়ার প্রবাদ যে এমন হাতে হাতে ফলে যাবে, কে জানত? নিজের রুচির কথা গর্ব করে একটু আগেই খুব ঢাক পিটিয়েছি, এখন সেই ঢাক আক্ষরিক অর্থেই পৌঁছোলো চুলোর দুয়োরে। অতিরিক্ত ঝাল আমার সহ্য হয় না। যদিচ ঝালের সম্মুখীন হয়েছি বহুবার - এই বাংলায়, ঊড়িষ্যায়, আসামে, তেলেঙ্গানায় এবং বাঙালের শুঁটকিতেও! আমার মুখের অবস্থা এবং খাদ্যে অনাগ্রহ দেখে লাজবন্তী এবং বালাই আমার অস্বস্তি কিছুটা আন্দাজ করে নিল।

    লাজবন্তী আন্তরিক সংকোচে বললেন, “আপনি বুঝি ঝাল খান না? এঃ রাম, দেখেন দিকি - বাকি ভাতকটা মুখে তুলবেন কী পোকারে”?

    আমি আগুন ঝরা ঠোঁটে হাসি মাখিয়ে বললাম, “কই তেমন কিছু নয় তো। এট্টু ডাল দেন দেখি”। তারপর ডাল মেখে অতি দ্রুত গলাধঃকরণ করলাম “অমেত্ত”-সম চুনোমাছের ঝাল! খাওয়া শেষ হতে লাজবন্তী বালতিতে রাখা প্লাস্টিকের মগে তুলে হাত ধোবার জল দিল। বেশ কয়েকবার কুলকুচি করে মুখের উত্তাপ অনেকটাই কমল, ধাতস্থ হলাম মুখ হাত মুছে একটা সিগারেট ধরিয়ে। বালাই তখনো খাচ্ছিল, বড়ো তৃপ্তি করে, আর আমার দিকে উদ্বিগ্ন চোখে বারবার দেখছিল।

    সিগারেট ধরিয়ে আমি লাজবন্তীকে বললাম, “আপনার অতিথি সেবা তো হয়েই গেল দিদি, এবার আপনিও বসে পড়ুন, বাইরের লোক বলে লজ্জা করবেন না। বেলা কিন্তু সত্যিই থেমে নেই”। বালাইও আমার কথার সমর্থন করল, বলল, “সত্যিই বাবুর কাছে আবার লজ্জা কিসের? তুইও এখানেই বসে যা, খেতে খেতে গল্প-সল্প করাও যাবে”।

    আমার এঁটো প্লেট সরিয়ে লাজবন্তী দাওয়ার একধারে রাখল, তারপর নিজের প্লেটে ভাত ডাল তরকারি সাজিয়ে এনে খেতে বসল, ঘরের দরজা ছেড়ে দেওয়ালে হেলান দিয়ে। খাওয়া শুরু করার আগে বলল, “ঘরে মুখশুদ্দি কিছু নেই, বাবু, জানি না খাওয়ার পর মুখে কিছু দেন কিনা”। হাতের জ্বলন্ত সিগারেট দেখিয়ে বললাম, “এই আমার মুখশুদ্ধি, দিদি, ও নিয়ে চিন্তা করবেন না”।

    কোন কথা না বলে ওরা দুজনেই খেতে লাগল, আমিও শেষ করলাম আমার সিগারেটটা। তারপর জিজ্ঞাসা করলাম, “আচ্ছা বালাই, তখন ঝড়ঝঞ্ঝার কথা বলতে মালতীমা অতটা ভেঙে পড়লেন কেন? তোমাদের কাছে এ ধরনের ঘটনা তো কিছুটা গা-সওয়া বাৎসরিক দুর্দৈব...”।

    বালাই কিছু বলার আগেই লাজবন্তী বললেন, “মালতীর বুকে যে কতো বড়ো পাথর চাপা দেওয়া আছে, সেটা তো আপনের জানার কথা নয়, বাবু। দেকতে দেকতে বারো বছর পার হয়ে গেল, সেই যে ভয়ংকর ঝড়টা এসেছিল, নাম ছিল আয়লা! আপনারা শহরের বাবুরা সে সব ঝড়ের আবার আদর করে কেমন সব নাম দেন, আয়লা, বুলবুল, ইয়াস, আম্পান…! বড্ডো ক্ষতি হয়েছিল সেবারে আমাদের এদিকে। গ্রাম কে গ্রাম ভাসিয়ে ভেঙে চুরে একেবারে তছনছ হয়ে গিয়েছিল সবকিছু”।

    কিছুক্ষণ থেমে আবার বললেন, “সেবার অবিশ্যি আমরা এখানে ছিলাম না, আউসগ্রামে রামনবমীর মেলা সেরে আমরা দল বেঁধে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম বর্ধমান আর বীরভূমের ওদিকে। তার মধ্যেই জষ্টিমাসের শুরুর দিকে আয়লা আছড়ে পড়েছিল। এদিকের সমাচার দেখেশুনে আমরা একটু দেরি করেই আষাঢ়ের মাঝামাঝি ফিরলাম। ফিরে এসে গ্রামের মানুষজনের মুখে যা শুনলাম, নিজেরাও ধ্বংসের যে সব লক্ষণ দেখলাম – সে আর আপনের শুনে কাজ নেই।

    ঝড়ের আগে ওই মালতীর ছিল উথলে ওঠা সংসার, আর মালতীর বর ছিল লক্কিমন্ত করিতকর্মা মানুষ। ধনসম্পদ যা কিছু করেছিলেন গতরে খেটে – লোক ঠকিয়ে, বজ্জাতি করে নয়। আমরা ফিরে এসে দেখলাম, মালতীদের দোতলা বাড়ির কংকালসার চেহারা – যদিও মিস্ত্রি লেগে সারাইয়ের কাজ চলছে। ওর ছেলেমেয়েদের মুখে শুনলাম – ঝড়ে ওদের ঘর দোরের ক্ষেতি হয়েছিল বেজায়। ওদের গোয়াল ঘর ধ্বসে সাফ হয়ে গিয়েছিল বিলকুল। চারটে গাই, তিনটে বাছুরের খোঁজ পাওয়া যায়নি – ওদের মধ্যে একটা গাই ছিল পোয়াতি। জল সরে যেতে ক্ষেতের জমিতে বালি পড়েছিল প্রায় আধহাত! এসব দেখে মালতীর বর কেমন যেন নিঃসাড় হয়ে গেছিল, জানেন বাবু? মুখে কোন কথা নেই, দু চোখের দৃষ্টিও কেমন বেবাক। মালতী তার দুই ছেলে আর এক মেয়ে নিয়ে সব যখন গুছিয়ে তোলার উদ্‌যোগ কচ্ছে, মালতীর বরের কোন হ্যাঁৎক্যাঁৎ নেই - বেভুল মানুষ হয়ে ঘুরে বেড়াত এদিক সেদিক। নাওয়া খাওয়ার সময় তাকে ধরে আনতে হত সাগরের পাড় থেকে কিংবা বালিচাপা মাঠ থেকে…”। দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন লাজবন্তী, মাথা নিচু করে কথা শুনছিল বালাই, সেও গভীর শ্বাস ছেড়ে আকাশপানে তাকিয়ে কিছু যেন খুঁজতে লাগল।

    “দিন দশেক পর, মানুষটাকে আর খুঁজেই পাওয়া গেল না কোথাও, জানেন বাবু!”

    আমি চমকে উঠলাম, বললাম, “সে কী? কোথায় গেলেন?”

    “আজও জানা যায়নি, বাবু, মালতীর বর কোথায় গেল। মারা গেছে না বেঁচে আছে সে কথাও জানা যায়নি আজ পর্যন্ত”। আমার চোখের সামনে ভেসে উঠল, মালতীমায়ের চেহারা - কপালে, সিঁথিতে উজ্জ্বল সিঁদুরের এয়োতি-লক্ষণ। দু হাতে তাঁর শাঁখা, পলা, সোনা বাঁধানো নোয়া। আমি জিজ্ঞাসা করলাম, “কিন্তু ওঁনাকে দেখে তো বোঝার জো নেই…”।

    লাজবন্তী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, “কেন, বাবু? বেহদিশ মানুষের জন্যে বারো বছর অপেক্ষা করার বিধেন নাকি হিন্দু শাস্ত্রে আছে?” কথাটা শুনেছি আগে, আমি বললাম, “ও হ্যাঁ, শুনেছি বটে, অমন বিধান দেওয়া আছে আমাদের শাস্ত্রে”।

    “ছমাসের ওপর হল, বারো বছর পার হয়ে গেছে, বাবু। কিন্তু মালতীকে কে মনে করাবে সে কথা? দরকারই বা কী মনে করানোর। এই বারো বছরে ওর ছেলেমেয়েদের বে হয়ে গেছে, ছেলে-মেয়েদের ঘরে ওর নাতি নাতনিও এসে গেছে – জীবন তো থেমে থাকে না বাবু। মালতীর জীবনটাই শুধু থমকে থাকে তো থাক না – সেই বারো বছর আগেকার দিনে, তাতে কার কী ক্ষতি?”

    আমিও মাথা নিচু করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেকবার মনে করলাম মালতীমায়ের মুখ, আমার কথার উত্তরে তাঁর তীব্র শোকের সেই হাহাকার করা কথাগুলোও আমার কাছে নতুন মাত্রা এনে দিল। মালতীমায়ের আবেগের প্রতি আমি মনে মনে মাথা নত করে রইলাম। বাইরে থেকে একদিনের জন্যে বেড়াতে এসে, কিছুই না জেনে তাঁর ব্যথার ক্ষতে আমিই তো খোঁচা দিয়েছিলাম!

    লাজবন্তীর খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, সকড়ি নিকিয়ে, এঁটো থালা বাসন আর বালতি নিয়ে সে চলে গেল কলতলার দিকে। আমি বালাইকে একটা সিগারেট দিলাম, নিজেও নিলাম একটা। সিগারেট ধরিয়ে বললাম, “ব্যাপ্ত এই দেশের বহু জায়গাতেই আমি গিয়েছি এবং থেকেছি, বালাই। তাদের নিবিড় জীবনযাত্রার বহু ছবিও এঁকে রেখেছি আমার মনে। কিন্তু এমন গোত্রহীন জায়গায় এসে এমন যাপন চিত্র দেখতে পাবো, কল্পনাও করিনি। আর কথা বলার আগেই মনের সুর টের পেয়ে যাওয়া তোমার মতো গাইডও পাইনি কোথাও। এখানে হয়তো আর আসব না কোনদিন – তোমাদের সঙ্গেও অন্য কোথাও আবার দেখা হওয়াও প্রায় অসম্ভব। কিন্তু তোমাদের কথা কোনদিন ভুলতে পারবো না, বালাই।”।

    “আবার দেখা হবে না কেন, বাবু? আমার সঙ্গে নাই হোক, আপনের যা স্বভাব তাতে আমার মতো বালাইয়ের অভাব কোনদিন ঘটবে না। কিন্তু ওই কথাটা ঠিক বুঝলাম না বাবু, ওই যে বললেন গাইড কথাটা…” বালাইয়ের চোখে আবার সেই মিচকে হাসি, “আমাকে গাই-বলদের দলে ঠেলে দিলেন নাকি, বাবু?”

    আমি হেসে ফেললাম, বললাম, “কথাটা গাইড, যারা বেড়াতে যাওয়া লোকেদের, নতুন জায়গার সব চিনিয়ে দেয়, বুঝিয়ে দেয়…”।

    “গাইড, বাঃ বেশ কথাটি। ইংরিজি শব্দ না বাবু? অচেনা এক মানুষ যে অচেনাকে চিনিয়ে দেয়… তাই না, বাবু?” আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম বালাইয়ের দিকে, গাইড শব্দের এমন অর্থবহ তাৎপর্য কোনদিন ভাবিনি তো! বালাই আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে গেয়ে উঠল,

    “চিনি না যেই অচিন জনে, ও সেই সাথী হল আমার সনে
    আমার মনের খপর পড়ল ধরা তাহারও মনে, সেই অচিন জনে।

    আঁধার মনে জ্বেলে আলো, জেবনের পথ দেখালো।
    অনেক কথাই হল কওয়া, কিছু রইল গোপনে, সেই অচিন জনে।

    ঘুরতে ছিলেম আপন মনে, মাঠে ঘাটে সাগর বনে।
    দেখতেছিলেম রূপের ডালি ভরে মোর দুই নয়ানে।
    তুমি এসে ধইরলে যে কর, ভুলিয়ে দিলে আপন-পর
    বসত তোমার রইবে জেনো মনের গহনে, সেই অচিন জনে”।

    মুখে মুখে বালাইয়ের এই গান বেঁধে ফেলার প্রতিভায় আমি আবার মুগ্ধ হলাম। আমি চুপ করে বসে ভাবতে লাগলাম বালাইয়ের গানের কথাগুলো। গানের মাঝখানে লাজবন্তী কাজ সেরে ফিরে এসেছিলেন। তিনিও এসে বসলেন দাওয়ায়। তাঁর মুখ দেখে বুঝলাম, বালাইয়ের গানে তিনিও বেশ বিচলিত। আমি এবার দাওয়া থেকে মাটিতে নেমে দাঁড়িয়ে বললাম, “বালাই, এবার আমাকে বিদায় দাও ভাই। দিদি, এবার তবে আমি আসি?”

    আমার কথা শুনেই লাজবন্তী এক ঝটকায় উঠে দাঁড়ালেন, কোমরে হাত রেখে রুদ্রমূর্তিতে বলে উঠলেন, “তার মানে? আপনে বালাইকে গান শুনিয়েছেন, আমাকে গান না শুনিয়ে এক পা এগোন দেখি?”

    আমি হেসে ফেললাম, বললাম, “আমি তো বালাইয়ের মতো গান বাঁধতে পারিনা, আর অমন গাইতেও শিখিনি, আমার আবার গান…”।

    বালাই চোখ টিপে বলল, “কলকাতার যাওয়ার ট্রেন সেই রাত নটা অব্দি আছে, বাবু। কোন চিন্তা না করে গুছিয়ে বসেন, দু-একখান গান শোনান। থা নইলে লাজবন্তী আমাকেও আস্তো রাখবে না…”।

    অগত্যা আবার দাওয়ায় উঠে বসলাম। লাজবন্তীও ফিক করে হেসে আবার বসলেন - ঠিক যেন ছোট্ট মেয়েটির মতো, বললেন, “লক্ষি ছেলের মতো বসেন আর গান শোনান”।

    *আয়লা ঝড়ের তাণ্ডব ঘটেছিল – ২৫ থেকে ২৭শে মে ২০০৯ (১১ থেকে ১৩ই জৈষ্ঠ্য ১৪১৬)

    (চলবে…)
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৩ জানুয়ারি ২০২২ | ২১৩০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    আকুতি  - Rashmita Das
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পলাশ ব্যানার্জী | 2409:4063:6e12:9239:5dbf:8280:e84e:6a5b | ২৪ জানুয়ারি ২০২২ ০৩:৫২503050
  • খুব ভালো লাগলো, আপনার লেখা পড়ে।
    অপেক্ষায় রইলাম পরের লেখার জন্য।
  • Dr. Avijit Ghosh | ২৪ জানুয়ারি ২০২২ ১১:৩০503056
  • খুব ভালো লাগলো । এক্সসেলেন্ট । 
  • Kishore Ghosal | ২৫ জানুয়ারি ২০২২ ১৪:০৭503087
  • পলাশবাবু ও ডক্টর অভিজিৎ বাবুকে অজস্র কৃতজ্ঞতা - মন্তব্য করার জন্যে। আপনাদের মন্তব্যেই লেখার সার্থকতা মেলে।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি মতামত দিন