এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  সমাজ  শনিবারবেলা

  • কেমন আছো, কেমন আছিস, কেমন আছেন

    অমল সরকার
    ধারাবাহিক | সমাজ | ২১ আগস্ট ২০২১ | ২০০৬ বার পঠিত
  • সম্পর্ক-সূত্র

    বীজ বপনে শুরু। তার পর দশ মাস দশ দিন। রক্তের সেই সম্পর্ক ভালবাসা যায়, অবহেলা করা যায়। ছেঁড়া যায় না। পাল্টানোও যায় না। তার পর জীবনভর কত না সম্পর্কের জন্ম। এবং মৃত্যুও।

    কিছু সম্পর্ক শাসনের, অনুশাসনের, বাঁধনের। কিছু সম্পর্ক ভেসে যাওয়ার। চলতি হাওয়ার পন্থী। কিছু সম্পর্ক আঁকড়ে রাখি। কিছু আপনিই বয়ে যেতে দিই। নাম দিতে পারি না এমন অনেক সম্পর্ক থেকে যায় মনের মণিকোঠায়। সম্পর্কের নতুন সংজ্ঞা দিচ্ছে নেট মাধ্যমও।

    শুধু কি মানুষ, সম্পর্ক তো চার পাশের কত কিছুর সঙ্গে। পুঁথি বা পর্দার চরিত্র, পুকুর ঘাট বা চিলেকোঠার সিঁড়ি। পাতার ভাঁজে রেখে দেওয়া প্রথম পাওয়া গোলাপ। রাতে গলির মোড়ে আমার ফেরার অপেক্ষায় থাকা নেড়ি। সম্পর্কের সাগরে ভাসছি, ডুবছি। সম্পর্কের নুড়ি কুড়িয়ে চলেছি। ছুঁড়ে ফেলছি।

    - চলছে, ধারাবাহিক, সম্পর্ক ।



    বেলা করে বিছানা ছাড়ার রুটিনের সেদিন অনেকটাই বদল হয়েছে।  ভোর ভোর অ্যাসাইনমেন্টে বেরিয়েছি। ট্রেন ধরার তাড়া। এত সকালে সাধারণত ট্রেন লেট করে না। লেট-লতিফ হওয়ার তাই কোনও সুযোগ নেই। একটু পা চালিয়ে হাঁটছি। ভোরের শীতল বাতাস এক লহমায় শরীর-মনকে তরতাজা করে দিয়ে গেল। সে এক দারুন অনুভূতি। 

    শীতল শব্দটা আজকাল খুব একটা শুনি না। বড়বাজারের একটি সংস্থা বছর কয়েক আগেও সভা-অনুষ্ঠানে নিখরচায় খাবার জলের গাড়ি পাঠাত। ট্যাঙ্কের গায়ে লেখা থাকত পবিত্র শীতল পানীয় জল। পাশে শিব ঠাকুরের ছবি। একজন একদিন বললেন, জানো তো, পবিত্র শব্দটির সঙ্গে ঠাকুর-দেবতার কোনও সম্পর্ক নেই। পবিত্র মানে বিশুদ্ধ। বাতাস শব্দটাও আবহাওয়ার ইংরিজি বুলেটিনের বাংলা তর্জমায় ছাড়া খুব একটা দেখি না, শুনি না। 

    যে কথা বলছিলাম, অত সকালে দেখলাম, কেউই ঠিক হাঁটে না, হাঁটা প্রতিযোগীর মতো একপ্রকার দৌড়য়। ভোরের ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা আবহাওয়ার মধ্যেই ঘাম ঝড়ান। সুগার, প্রেসারের ঠেলায় কাকভোরে উঠে মর্নিং ওয়াক বহু মানুষের রোজনামচা। সে জন্য  পোশাকআশাকও বেশ অন্যরকম। কাকু-জ্যাঠু-মাসিমা-কাকিমাদের অনেকের পায়েই কেডস, স্কিকার। দ্রুত হাঁটবেন বলে বয়স্ক মহিলারাদের কেউ কেউ দেখলাম সালোয়ার কামিজ পরেছেন। এই লেখালেখির মধ্যেই হোয়াটসঅ্যাপে সেই লাইনগুলি আবার পেলাম, ‘সারাদিন বসে অসুখের কথা/ভেবে কি সময় কাটবে?/তার থেকে চলো ভোরবেলা উঠে/রাস্তায় গিয়ে হাঁটবে।’

    সেদিন ভোরে মর্নিং ওয়াকের আমেজ উপভোগ করতে করতে হাঁটছি, কানে এল কেউ আমাকে ডাকছে। জড়ানো গলা। বুঝতে যদিও সমস্যা হল না, আমাকেই ডাকছেন কেউ। পিছনে তাকিয়ে দেখি, একদা প্রতিবেশী কাকু, অনিল দাস। রাস্তার ধারে এক বহুতলের নিচে বন্ধ দোকানের সামনে ইজি চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে বসে। 

    এটা অন্য পাড়া। স্টেশন লাগোয়া এই জমিতে কাকুরা বড় বাড়ি বানিয়ে উঠে এসেছেন অনেক বছর হল। চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে কাকুদের কলোনির বাড়িটিও ছিল তিনতলা। টাকা-পয়সা ভালোই ছিল। চেহারা, পোশাকআশাকে তা ধরা পড়ত। ভারিক্কি চেহারা। দেখে মনে হত, স্কুলের হেডমাস্টার মশাই। তবে সেকালের প্রধান শিক্ষকদের মতো গম্ভীরমুখো ছিলেন না। মুখে সদা হাসি লেগে থাকত।

    এপাড়ায় চলে আসার পরও কলোনির লোকজনের সঙ্গেই ছিল বেশি ওঠাবসা। ব্রেকফাস্ট করেই চলে আসতেন। এ-বাড়ি ও-বাড়ি-ক্লাব-পার্টি অফিস করে দুপুরে ফিরে গিয়ে ফের রোদ ফিকে হলে চলে আসতেন। নতুন বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক বলতে গেলে রাতের ঘুম আর খাওয়াদাওয়া। এক কথায় গল্পবাজ মানুষ।

    কলোনির সেই দিনগুলিতে মানুষটার বিশেষ এক অবদান ছিল। তাঁর বদান্যতাতেই আমরা প্রথম গুঁড়ো মাজন দিয়ে দাঁত মাজতে শুরু করি। তার আগে উনুনের ছাই আর নিমের ডালেরই চল ছিল বেশি। অনিল কাকাদের ছিল গুঁড়ো মাজনের ব্যবসা। কৃষ্ণা দন্তমঞ্জন। কিছুদিন পর পর টেম্পো বোঝাই করে বাইরে কোথাও পাঠানো হত। অনিল কাকার  মেয়ের নাম ছিল কৃষ্ণা।  বাড়িতে কাঠ কয়লা গুঁড়ো করে তাতে কর্পূর মিশিয়ে তৈরি হত কৃষ্ণা মাজন। পাড়ারই  কয়েকজন কাজ করতেন।

    পাড়ায় তখন রাজনীতির দুই শিবির। একদল কঠিন সিপিএম। আর একদল কঠিন কংগ্রেস। অনিল কাকা ছিলেন দ্বিতীয় দলে। ইন্দিরা গান্ধীকে বলতেন ভারতমাতা। ইমার্জেন্সির ঠিক পরের ভোটের সময় গোটা পাড়া জনতা পার্টির সমর্থক। বয়স্করা অনেকেই দিন কয়েকের জন্য দিল্লি ছুটলেন। ফিরে এলেন নতুন পার্টির দায়িত্ব নিয়ে। অনিল কাকা, আরও কয়েকজন, তখনও ইন্দিরার নামেই জয়ধ্বনি দেন। 

    সেই সব দিনে ওঁদের দেখে বুঝেছিলাম, কংগ্রেস এক বিচিত্র পার্টি। এ দলে পার্টি ক্লাসের বালাই নেই। মেম্বারশিপ নেওয়ার ব্যবস্থা আছে বটে। তবে তাতে কিছু যায় আসে না। মনের টান থাকলেই হল। অনিল কাকারা মনের টানে পার্টিটা করতেন। কথায় কথায় বলতেন, ‘বুঝলা, মাক্কু পার্টি করতে অনেক পড়ালেখা করা লাগে। তাগো সবই তো বিদেশি, দেশি কিছু নাই। আর আমাগো পার্টিরে দেখো। গোটা ইতিহাসটাই স্কুলের পাঠ্য বইতে পাইবা।’ সভা-সমিতিতে বড় নেতারাও কথাটা বলতেন, ‘স্বাধীনতার ইতিহাসই কংগ্রেসের ইতিহাস।’

    অনিল কাকাদের মতো অনেকেই সিপিএম অর্থাৎ মাকর্সবাদী কমিউনিস্ট পার্টির লোকজনকে তখনও তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে 'মাক্কু' পার্টি বলতেন। মুখে মুখে ঘুরত কথাটা। গুগুল করে দেখলাম, সেবার অর্থাৎ ১৯৭৮-এ, সিপিএমের দশম পার্টি কংগ্রেস বসেছিল জলন্ধরে। পার্টি দেওয়ালে দেওয়ালে লিখেছিল, দশম পার্টি কংগ্রেস সফল করুন, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সফল করুন, ইত্যাদি। সেই সব দিনে বাংলায় কংগ্রেসের নাম যেন মুখে আনা পাপ। তবে কলোনির কালচারে রাজনীতির ভেদাভেদ, ঝগড়াঝাটিতে একটা পরিমিতি ছিল। এক সন্ধ্যায়, পাড়ার বড় রাস্তার মোড়ের পথসভায় সিপিএমের দেওয়াল লিখন দেখিয়ে অনিল কাকা বলে বসলেন, ‘এর নাম সিপিএম। এমন ভণ্ড পার্টি দুটি নেই। বাংলায় কংগ্রেসকে কবর দেওয়ার কথা বলে, আর জলন্ধরে গিয়ে কংগ্রেস করে।’  'জবাব জবাব জবাব দিন, কংগ্রেসকে এই মাটিতে জবাব দিন', ছিল সিপিএমে খুব চালু স্লোগান।

    অনিল কাকার সে দিনের সেই মন্তব্য নিয়ে মুখ চেপে হাসাহাসি করেছিলেন মাক্কু পার্টির লোকজন। তখন ছোট, কিছুই প্রায় বুঝি না। বোঝার বয়স হওয়ার পর বুঝলাম, কংগ্রেস পার্টির সঙ্গে সিপিএমের পার্টি কংগ্রেসের কোনও সম্পর্ক নেই। আরও বুঝেছিলাম, সেটা বোঝার লোক সিপিএমেও হাতে গোনা কয়েকজন। মাক্কু পার্টিরও ষোলআনাই জানে না, বোঝে না, পার্টি কংগ্রেস কয় কাহারে। কমিউনিস্ট পার্টির বহু স্লোগানও যেন পুজোর মন্ত্রের মতো, সমস্বরে বলে, অর্থ বোধগম্য হয় না বেশিরভাগের। নিষ্ঠাবান কংগ্রেসি অনিল কাকা অনেক পরে, পার্টির অবস্থা যখন আরও সঙ্গিন, তখন পাঁচজনের কথায় পুরসভার ভোটে প্রার্থী হয়ে গোহারান হারলেন। 

    কলোনির গোড়াকার কথা, রাজনীতি ইত্যাদি নানা বিষয়ে দিনের পর দিন গল্প শুনেছি মানুষটার মুখে। সাংবাদিকতায় আসার পর মাঝেমধ্যে বলতেন, ‘তুমি তো সাংবাদিক, তোমার শোনা দরকার, কী ছিল, কী হইল।’ খুব খুশি হতেন কংগ্রেস সম্পর্কে কেউ দুটো ভালো কথা বললে। 

    সেদিন সেই, সেই ভোরবেলা, চেনা মানুষটাকে দেখেই কিনা আমার গোটা শরীর অসাড় হওয়ার জোগাড়। এটা কী করে সম্ভব? কাকু তো সেই কবেই…..। হ্যাঁ, ভুল হচ্ছে না মোটেই। এক রাতে অফিস থেকে ফিরে রাস্তার মোড়ে পাড়ার কারও মুখে পেয়েছিলাম খবরটা। অত রাত বলেই আর যাইনি। পরদিন গিয়েছিলাম কিনা মনে করতে পারলাম না। পাড়ায় কোনও স্মরণসভা হয়েছিল কি? না, তাও মনে পড়ল না। হয়ে থাকলেও আমার জানার কথা নয়। জানতে পারলেও হয়তো যাওয়া হয় উঠতো না।  শুধু মনে পড়ছে, এক রাতে অনিল কাকার খবরটা পেয়েছিলাম। আর সেই লোকটাই কি না চেয়ারে বসে জড়ানো গলায় আমাকে ডাকছে। 

    থমকে দাঁড়াই। রাস্তায় লোক চলাচল আরও বাড়লে কাছে যাই। খানিক কথা হয়। বুঝতে পারি সব কেমন গোলমাল হয়ে গেছে। দু-দণ্ড চোখ বন্ধ রেখে ভাবি, ঝড়ের গতিতে ময়না তদন্তে ডুব দি। বুঝতে চেষ্টা করি, এমন কেন হল! 

    কাকু সেদিন অনেক কিছু বলতে চাইছেন, পারছেন না, সব জড়িয়ে যাচ্ছে। বোঝার অগম্য। সবশেষে খুব চেনা কথাটুকু বুঝতে পারলাম। ট্রেনের সময় হয়ে গেছে শুনে বললেন, ‘সাবধানে যাইও।’

    সেই কবে কাকুর সেরিব্রাল অ্যাটাকের খবর পেয়ে একদিন গিয়ে দেখে এসেছিলাম। তারপর কত বছর কেটে গিয়েছে। পরে শুনেছি, অনেকটা সুস্থ হলে রোজ সকালে বাড়ির নিচে দোকানে টিনের ছাদের তলায় চেয়ারে বসিয়ে দেওয়া হত। চলমান জীবনের দৃশ্য দেখতেন বসে। তাতে নাকি ব্রেনের স্মৃতি কোষগুলি সজীব হয়। পুরনো কথা, লোকজন, ঘটনা ইত্যাদি মনে পড়ে। অনিল কাকা কি তবে সেই কারণেই ভোরের আবছা আলোতেও আমাকে চিনতে পেরেছিলেন, মনে করতে পেরেছিলেন আমার নামটা!

    আমার মনোজগত থেকে কাকু কিন্তু ততদিনে মুছে গিয়েছেন। দীর্ঘ অদর্শনে ছেলেবেলার নানা মুহূর্ত, স্নেহ, ভালোবাসা, দেশ-কাল-রাজনীতির চর্চা, পাড়ার সমস্যা নিয়ে আলোচনা, সব স্মৃতি মুহূর্তে মুছে গিয়ে কাকু আমার কাছে সে দিন যেন সাক্ষাৎ ভূত। 

    আরও এক দিন। অ্যাসাইনমেন্টের জন্য সে দিনও ভোর থাকতে বেরিয়েছি। বাড়ি থেকে খানিক দূরে আচমকা গতি রুদ্ধ হল! ল্যাম্প পোস্টে তখনও ডুম বাতি জ্বলে। এখনকার মতো ঝলমলে আলোর ব্যবস্থা হয়নি। বাল্বের স্বল্প আলোয় অভ্যস্ত চোখে ধরা পড়ল পাশাপাশি দাঁড়িয়ে টগর আর জবা ফুলের গাছ দুটি। আমাদের ছেলেবেলার দুই বন্ধু। ভোরবেলা ফুল চুরি, দুপুর-বিকেলে ডাল ছিঁড়ে খুনসুটি, গাছের আড়ালে লুকিয়ে থাকা, ওরাই তো বন্ধু-স্বজন।

    প্রায় ভোরেই মাসিমা চিৎকার-চেচামেচি জুড়ে দিতেন। ফুল ছেঁড়া তো দূরের কথা, কেউ তাঁর গাছে হাত দিক, একবারেই পছন্দ করতেন না। পাঁচজনের ছোঁয়ায় গাছ নাকি অপবিত্র হয়ে যায়  অন্ধকার থাকতে উঠে নিজের গাছের ফুলগুলি তুলে মাসিমা ঘরে ঢুকে পড়তেন। অকাল বিধবার দিনলিপিতে দিনের বাকি সময় চার দেওয়ালের বাইরে বেরনো ছিল না। শুধু গাছে কেউ হাত দিলে, ফুল ছিঁড়লে তেড়ে আসতেন। সাতসকালে ফুল তোলা নিয়ে মাসিমার সঙ্গে সেই ঝগড়াঝাটি, হুজ্জুত ছিল আমাদের একমাত্র যোগসূত্র। অনেক সময় বড়রাও ঝগড়াঝাটিতে জড়িয়ে পড়তেন। ছোটবেলায়, ভোরের আলোয় মাসিমার চেহারায় ধরা দিত ভূতের গল্পের চরিত্রেরা। ভূতের ভয় বড় বিচিত্র। যুক্তিতর্কের ঊর্ধ্বে। 

    স্ট্রিট লাইটের আবছা আলোয় সাদা থান পরা মাসিমাকে রোজ সকালেই অচেনা ঠেকত।

    কিন্তু সে তো সেই কবেকার কথা! আজ, এত বছর পর কীভাবে সম্ভব? কিন্তু এতো অবিকল মাসিমার চেহারা। পরনে সেই চেনা সাদা থান। হাতে সাজি। হ্যাঁ, ফুল তুলছেন। ঠিক ছোটবেলায় যেমনটা দেখেছি। 

    অত সকালে গলির রাস্তায় লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে। কয়েক পা এগলে বড় রাস্তায় সকালে হাঁটতে বেরনো লোকজনেরা আছে। সে অবধি পৌঁছতে পেরতেই হবে ওই গাছ দুটি, সেখানে দাঁড়িয়ে সাদা থান পরা মহিলা ফুল তুলছেন। 

    কিন্তু কী করে সম্ভব? নিজের মধ্যে খোঁজ করি, মাসিমার কোনও খবর কখনও কি কিছু শুনেছিলাম। মনে করতে পারি না। কিন্তু বিশ্বাস করতেও কেমন কেমন ঠেকছে, মাসিমা বেঁচে...। অত বয়সেও চেপে বসে ভূতের ভয়। বয়স যতই বাড়ুক কম আর বেশি,অজান্তেই এই ভয়টা আমরা বয়ে বেড়াই।

    সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে খানিক সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে যাই। গাছ দুটির সামনে রাস্তার আলোয় রক্তমাংসের মানুষটিতে চাক্ষুষ করি। বয়সের ভারে বিধ্বস্ত চেহারা। দেখে মনে হল, চোখে প্রায় কিছুই দেখেন না। দৃষ্টিহীন মানুষেরা যেমন, চেনা ছন্দে জীবন চালিয়ে নেন, বুঝলাম, প্রতিবেশী বৃদ্ধার জীবন সেভাবেই চলছে।  চোখ দিন, রাতের ফারাক করতে পারে না। গাছকে জড়িয়ে ধরে হাতের ছোঁয়ায় ফুল তুল চলেছেন মাসিমা। 

    মাসিমার দিন বদলায়নি। অনিল কাকার জীবনও কোনও অচেনা খাতে বয়নি। বদলেছি আমি। নিজেকে নিয়ে ব্যস্ততা এতটাই যে, বাড়ি থেকে ক’হাত দূরের প্রতিবেশী বৃদ্ধা যে বেঁচে আছেন, মনে রাখিনি। দীর্ঘদিনের পরিচিত অনিক কাকা বেমালুম মুছে গিয়েছিল আমার স্মৃতি থেকে।

    অনেককাল যারা ভোর দেখেননি, এক দিন পরখ করে দেখতে পারেন, নিজের পাড়া আর পরিচিতজনকে কেমন অচেনা ঠেকে। এমনও মনে হতে পারে চেনা মানুষকে দেখে ভাবলেন, এরা কারা? এত বহিরাগত কেন? 

    অনিল কাকা ও মাসিমাকে নিয়ে ঘটনা দুটি মনে পড়লে নিজেকে অপরাধী মনে হয়। মন ভারাক্রান্ত হয়ে আসে।

    দিন কয়েক আগে এক আড্ডায় একজন কথায় কথায় ঘটনা দুটির প্রসঙ্গ তুললেন। সেই সূত্র ধরে বাকিরা ছোটবেলার স্মৃতি হাতড়ে পাড়ার একদা অতি পরিচিত কিছু মুখ মনে করার চেষ্টা করলাম, অমুকের মা, অমুক মাসিমা, তমুক কাকিমা, অমুকের স্ত্রী, তমুকের দাদু, দিদা, বাবা, কাকা, দাদা, দিদি, তালিকায় নামের পর নাম যুক্ত হয়। কেউ জানি না, বাড়ি থেকে দু-হাত দুরে, ওঁরা কি বেঁচে আছেন? খোঁজ নিয়ে জানা গেল, কেউ আছেন, কেউ নেই। করোনা তো এই সেদিনের কথা। যাঁরা নেই, করোনায় মৃতদের মতোই ছিল তাঁদের শেষযাত্রা। পাশের বাড়ির এক দু-জন ছাড়া কেউ জানতে পারেনি। কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, শেষ কবে পাড়ার কাউকে আমরা বলেছি বা বলতে শুনেছি, কেমন আছেন, কেমন আছিস, কেমন আছো।

    কী খবর, কেমন আছিস, মাসিমার কী খবর, মেসোমশাই ভালো আছেন, ইত্যাদি কথাগুলি সবার কাছেই কেমন বহুকাল না শোনা ঠেকল। 

    অথচ, এই তো সেদিনের কথা, পাড়ায় কারও বিয়ে হলে নতুন বউ কিংবা বরকে দেখতে প্রতিবেশীরা রাস্তায় এসে দাঁড়াতেন। পাড়ার কেউ গত হলেও দেখা যেত একই দৃশ্য। শেষ যাত্রা চাক্ষুষ করতে গোটা পাড়া যে যার বাড়ির গেটে এসে দাঁড়াত। মাঝরাত কিংবা ভোররাতে দেহ শ্মশানের যাবে শুনে অনেকে একে তাঁকে অনুরোধ করতেন, ‘যাওয়ার সময় আমারে একটু ডেকে দিও।’ কেউ কেউ জানালার ধারে বসে সারা রাত কাটিয়ে দিতেন শেষ যাত্রার সাক্ষী থাকবেন বলে। তার আগে চলত মৃতের স্মৃতিচারণা।

    সব কিছু যে কবে বদলে গেল তারও কি খবর রেখেছি আমরা? আগের একটি লেখায় প্রতিবেশী যে কাকিমার কথা বলেছি, যিনি বাড়ির গাছের একমাত্র লাউটিও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভাগ করে নিতেন, দিন কয়েক আগে এক রাতে অফিস থেকে ফেরার সময় পাড়ার মোড়ে খবর পেলাম তিনি চলে গেছেন। গোপন গোয়েন্দা রিপোর্ট দেওয়ার মতো ফিস ফিস করে খবরটা দিলেন একজন। কাকিমার করোনার কোনও উপসর্গ ছিল না। বার্ধক্যজনিত অসুখবিসুখে ভুগছিলেন। তবু আর পাঁচটা দিনের সঙ্গে সেদিনের পাড়াটাকে মেলাতে পারলাম না। যেন শ্মশানপুরী। প্রতি রাতে খাওয়া শেষে রাস্তার মুখটায় পাড়ার ছেলেদের আড্ডা চলে। সেদিন মাত্র এক-দু’জন। পাছে শ্মশানে যাওয়ার ডাক পড়ে। 

    শুধু বয়স্করা কেন, আলোয় ঢাকা অন্ধকারের মতো নানা বয়সি বহু মানুষ  অনটন-অনাহার-মানসিক অবসাদের শিকার হয়ে একটা সময় লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যাচ্ছেন। তারপর একদিন চিরদিনের মতো চলে যান। পাশের বাড়িও জানতে পারে পচা দুর্গন্ধটা অসহনীয় হয়ে দাঁড়ালে। প্রথমে খোঁজ চলে কোথাও কেউ মরা কুকুর, বিড়াল ফেলেছে কিনা। খুঁজতে খুঁজতে মালুম হয়, গন্ধটা কারও বাড়ির বন্ধ দরজা ভেদ করে আসছে। এখন তো দারিদ্রই সিক্রেট-নম্বর ওয়ান। উপহাস, গঞ্জনার শঙ্কায় কাউকে খুব বেশি বলা যায় না। ফেসবুকে নিজেকে নিয়ে কত কিছু লেখে মানুষ। পরিজনের চিকিৎসার খরচ তোলার মতো ব্যতিক্রম বাদে ব্যক্তিগত, পারিবারিক অভাব-অনটন কেউ ‘শেয়ার’ করেছে, চোখে পড়েনি।

    মুদ্রার উল্টোপিঠ আরও ভয়ঙ্কর। জেলখানায় সেই বৃদ্ধ কেমন আছেন খবর রাখিনি। বছর কয়েক আগে পাড়ার অদূরে এক আবাসনের সেই অশীতিপর মানুষটি ক্যান্সার আক্রান্ত স্ত্রীকে নিজের হাতে খুন করে আত্মঘাতী হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। স্ত্রী’কে খুনের দায়ে তাই যাবজ্জীবন জেল হয়েছে। তিনি অনুমান করতে পারছিলেন, তাঁর দিন ঘনিয়ে আসছে। তাঁকে তাই তাড়া করে বেরাচ্ছিল একটাই প্রশ্ন, তিনি আগে চলে গেলে অসুস্থ স্ত্রীকে দেখভাল করবে কে? কিংবা যদি উল্টোটা হয়, অশক্ত শরীরে বাকি দিনগুলি তাঁরই বা ল কাটবে কীভাবে? একাকিত্বের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে বেছে নিয়েছিলেন সহমরণের পথ। অর্থের টানাটানি ছিল না। ছিল, বার্ধক্যের বোঝা ভাগ করে নেওয়ার মতো পরিজনের অভাব।

    বছর দুয়েক আগে শহরের অভিজাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের যে প্রতিভাবান ছাত্রীটি স্কুলের বাথরুমে আত্মঘাতী হল, গোটা সমাজকেই সে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়ে গিয়েছে। সুইসাইড নোটে লিখে গিয়েছে, কেউ তাঁর মন বোঝার চেষ্টা করেনি অথবা পারেনি। আর এক কিশোরী, একই পথ বেছে নিতে চেয়েছিল, তার অভিযোগ, সে বড্ড একা। একা একা কি বাঁচা যায়? 

    এই সব ঘটনা থেকে একটি বিষয়, স্পষ্ট, দুই শৈশবের সমস্যাটা আসলে অভিন্ন—একাকিত্ব। গুগলকে বললে হয়তো, একটা পরিসংখ্যানও হাজির করবে, নিঃসঙ্গ মানুষেরা সংখ্যায় কত।

    মাঝে মাঝে মনে হয়, পাড়া-পরিবার সম্পর্ক মেরামত, পুর্নস্থাপন নিয়ে কি একটি আন্দোলন শুরু করা যেতে পারে?  আন্দোলন মানে স্লোগানবাজি বলছি না। প্রচার, চর্চা, দৃষ্টি ঘোরানোর কিছু একটা করা। এই যেমন, বছর দু-আড়াই আগে নন্দনে দেখেছিলাম, গাড়ি থেকে এক অশক্ত বৃদ্ধাকে ধরাধরি করে নামাল দুই বালক। তাদের সঙ্গে মাঝবয়সি দুই মহিলা। আলাপ করে জানলাম, ছেলে ও মেয়ের ঘরের দুই নাতি এবং মেয়ে ও বউমা বৃদ্ধাকে সিনেমা দেখাতে নিয়ে এসেছেন। ব্যতিক্রমী দৃশ্য। তাই বা কম কী সব আলো নিভে যায়নি।




    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ২১ আগস্ট ২০২১ | ২০০৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ইন্দ্রাণী | ২১ আগস্ট ২০২১ ১০:৫৫496945
  • শান্তস্বরের লেখা। আগাগোড়া।ভালো লাগে।

  • ঝর্না বিশ্বাস | ২১ আগস্ট ২০২১ ১৯:১৮496973
  • কী যে সুন্দর লিখলেন...ভীষণ ভালোলাগলো...সত্যিই আমরা ভুলতে বসেছি সেই সব প্রিয় মুখ।.. .. 

  • বিপ্লব রহমান | ২২ আগস্ট ২০২১ ১১:২২496998
  • এ লেখায় মন্তব্য হয় না। দীর্ঘশ্বাস! 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন