আমার খালাত বোনের তিনটা পিঠাপিঠি বাচ্চা। তিনজন কাছাকাছি ক্লাসে পরে। করোনায় সব বন্ধ ছিল প্রথম দিকে। ওদের দামী স্কুল এক সময় অনলাইনে ক্লাস শুরু করল। তিনজনের জন্য তিনটা স্মার্ট ফোন কেনা হল। তিনজন এক সাথে ক্লাস করতে লাগল। নামকাওয়াস্তে ক্লাস না, সিরিয়াস ধরনের ক্লাস। তাদের পরীক্ষা চলল, পরীক্ষাও অনলাইনে এবং কঠিন সতর্কতার সাথে। লকডাউন, করোনা, মহামারী কোন কিছুই ওদের পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটাল না। আমার খালাত বোন নিজে ডাক্তার, ওর স্বামী ডাক্তার, ওরা ওদের ছেলে মেয়েকে দেশের সেরা স্কুলে পড়ানর সামর্থ্য রাখে, তাদের কাছাকাছি যে ভাল স্কুল আছে তারা সেখানেই বাচ্চাদের পড়াচ্ছে।
ঢাকায় আমার ভাগ্নে থেকে। মাধ্যমিকে পড়ে, দ্বিতীয় বর্ষে এখন। ওকে দেখলাম অনলাইনে বিভিন্ন স্যারের কাছে পড়ছে। স্যার পড়াচ্ছে, পড়া নিচ্ছেন। একটু ঢিলেঢালা ভঙ্গি আছে কিন্তু চলছে। পড়াশোনার ভিতরে অন্তত আছে। আমার জেলা শেরপুর শহরে আমার আত্মীয় স্বজন যারা আছে তারাও চেষ্টা করে যাচ্ছে যেভাবেই হোক সন্তানদের পড়াশোনার ভিতরে রাখতে। সরাসরি স্যার বাসায় এসে পড়াচ্ছেন এখানে। ওরা গিয়েও পড়ছে স্যারের বাড়িতে। করোনার প্রাদুর্ভাব এদিকে একটু কম থাকায় অনেকেই এই কাজ করছে। স্কুল কলেজ খোলা থাকলে যেমন পড়াশোনা হত তেমন না হলেও চলছে একটু একটু করে। এদের অভিভাবকরাও মোটামুটি সচ্ছল। এত্তগুলা বিষয়ে স্যার রেখে পড়ানর সামর্থ্য রাখে সবাই।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলো অনলাইনে কার্যক্রম চালু রেখেছে। ক্লাস পরীক্ষা সব চলছে। যেহেতু সবাই সেখানে মোটামুটি আর্থিকভাবে সচ্ছল তাই তাদের কোন সমস্যা হয়নি। আমি নিশ্চয়তা দিয়ে বলতে পারি তাদের পরীক্ষার মান এক বিন্দু এদিক সেদিক হয়নি। অর্থাৎ, তাদের শিক্ষা জীবনে করোনা, মহামারী, লকডাউন যাই বলি না কেন তা খুব একটা প্রভাব ফেলেনি। টাকা সব সমস্যা সমাধান হয়ে হাজির সেখানে।
এই যে চিত্রটা এইটা একটা কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে আমাদের। পড়াশোনা বরাবরই দিন দিন অর্থ সম্পদের কাছে জিম্মি হয়ে যাচ্ছে। এই মহামারীর কালে তা যেন আরও নগ্ন হয়ে উপস্থিত হল আমাদের সামনে। কয়টা পরিবার এই ভাবে অর্থ ব্যয় করে শিক্ষা কার্যক্রম চালু রাখতে পারবে সন্তানদের জন্য? একটা স্মার্ট ফোন কেনা যাদের জন্য অসম্ভব কল্পনা তারা কীভাবে পড়াশোনা চালিয়ে যাবে? এই প্রশ্নের উত্তর কারো জানা নেই। ফলাফল ঝরে পড়ছে হাজার হাজার শিশু, কিশোর, কিশোরী।
সরকার হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করছে বিভিন্ন খাতে। অনুদান দিচ্ছে, ধার দিচ্ছে, ঋণ দিচ্ছে, ঈদের সামনে এমনে এমেনি দিল কত টাকা। কোন সমস্যা নাই এতে, মানুষের উপকার হয়েছে নিঃসন্দেহে বলা যায়। কিন্তু কেন জানি সরকার লক্ষ লক্ষ ছাত্র ছাত্রীর ব্যাপারে উদাসীন। কার্যকারী কোন পদক্ষেপ এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি আমাদের। আমরা অটো পাস নামক আজব এক পদ্ধতিতে সবাইকে পাস করায় দেওয়া দেখছি। কোন এক প্রাজ্ঞ ব্যক্তির মাথা থেকে আসা অ্যাসাইনমেন্ট নামক এক পদ্ধতি দেখেছি মেধা যাচাইয়ের। স্কুল থেকে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়ে দেওয়া হল। দুইদিন পরে বিভিন্ন ফটোস্ট্যাটের দোকানে, লাইব্রেরীতে ওই সব অ্যাসাইনমেন্ট পাওয়া যেতে থাকল। ছাত্ররা কিনে নিয়ে লিখে স্কুলে জমা দিতে লাগল। মহান শিক্ষকগণ সম্ভবত পড়েও দেখেনি এই সব জিনিস! আমার এক পরিচিত ছেলে ছাত্র পড়াত। ছাত্রের অভিভাবক জানাল যে ছাত্রকে স্কুল থেকে অ্যাসাইনমেন্ট দিয়েছে, এখন এটা করে স্কুলে জমা দিতে হবে। ও বলল যে সমস্যা নাই, আমি ওকে সাহায্য করব। কিন্তু সাহায্যে উনারা তুষ্ট না, ওকে বলা হল তাকে এই জিনিস করে দিতে হবে, ছাত্র করতে পারবে না। ছাত্র শুধু দেখে দেখে লিখবে। আজব আবদার! কিন্তু করে দিতেই হবে!
পরীক্ষা নেওয়া হল। কীভাবে? স্কুল থেকে প্রশ্ন দিয়ে দেওয়া হল। ছাত্ররা বাড়িতে বসে, মনের সুখে সেই প্রশ্নের উত্তর, নেট ঘেঁটে, বই দেখে, ফোনে গল্প করতে করতে পরীক্ষা দিল! আমরা যত্ন করে যে একটা প্রজন্মকে নষ্ট করে দিচ্ছি তা একবারের জন্যও ভাবছি না কেন? ছোটবেলা একজন আমার খাতার মলাটে লিখে দিয়েছিল - ছাত্রনং অধ্যয়নং তপঃ! অর্থ বলে দিয়েছিল, ছাত্রদের একমাত্র তপস্যা হচ্ছে অধ্যয়ন করা মানে পড়া। অধ্যয়নের সুযোগটা কই? তপস্যা তো বহুদূরের আলাপ, আমরা তো ন্যূনতম শিক্ষার সুযোগও দিতে পারছি না। শুধুই ঝরে পড়ার গল্প সব!
এই লক্ষ লক্ষ ছাত্রদের জন্য কোন একটা পরিকল্পনা কি খুব কঠিন কাজ? খুব কঠিন? যারা একটু বড়, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তাদের জন্য কিছুই করা গেল না? এদের জন্য যদি অল্প কিছু টাকা বরাদ্দ করা যেত তাহলে এদের দিয়ে সরকার তাদের নানা কাজ করিয়ে নিতে পারত। এরা একটা বছরের উপরে শুধু বসে বসে দিন কাটাচ্ছে। এখানেও সেই একই নীতি যার বা যাদের টাকা পয়সার চিন্তা নাই তারা ঠিকঠাক সামাল দিয়ে উঠছে। বাকিরা দুই চোখে অন্ধকার দেখছে। সরকার চাইলেই এদেরকে কাজে লাগাতে পারত। কিন্তু রাষ্ট্র এদের নিয়ে বিন্দুমাত্র ভাবে নাই।
এই যে হাজার হাজার ছাত্র পড়াশোনা থেকে দূরে রইল, যাদের কোন উপায় নাই পড়াশোনা চালায় যাওয়ার এই অস্থির সময়ে, এদের জন্য কেউ রইল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের কাজে লাগানো যেত কিনা আমি জানি না। এই কাজে বা অন্য যে কোন কাজে এই শক্তিকে কাজে লাগানো অবশ্যই যেত। ভাবছে কেউ এই লাইনে? কত কাজ আছে যে কাজে এদের সাহায্য নেওয়া যেত। জনস্বার্থে ব্যবহার করতে পারত এদের। এরা কিছুদিন আগে ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করে দেখিয়েছে, কিছু না হলে সেই কাজেই লাগেই দেওয়া যেত। আমার কথা হচ্ছে কিছু একটা করত। জীবন সম্পর্কে একটু ধারনা তৈরি হত। ঝরে পড়া থেকে বেঁচে যেত অনেক তরুণ। আমার কথা আজগুবি মনে হচ্ছে কিনা জানি না, আমার যা মনে হচ্ছে তাই বলছি।
স্কুল খোলা নিয়ে নানান তর্ক চলছে। তর্ক না হওয়াটাই অস্বাভাবিক হত। উন্নত বিশ্বে কোথায় কোথায় স্কুল কলেজ খুলে দেওয়া হয়েছে বা কোথায় একদিনের জন্যও স্কুল বন্ধ হয়নি তা একেকজন প্রচার করছে। এখানেই গোলটা বাঁধে। আমাদের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে আমরা ভুলে যায়। আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠী সম্পর্কে আমাদের ধারনা থাকে না এমন মন্তব্য করার আগে। যারা আমেরিকা ইউরোপের উদাহরণ দিচ্ছে তাদের ধারনাও নাই আমাদের একেকটা বিশ্ববিদ্যালয়ে যতজন ছাত্র পড়ে তা অনেক দেশের জনসংখ্যার সমান! কাজেই তাদের উদাহরণ আমাদের দেখিয়ে লাভ নাই। আমাদের সমস্যা আমাদের সমাধান করতে হবে। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে সমাধানের পথে কেউ নাই। আমরা পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের উদাহরণ নিতে পারি। আমি জানি না ওই দেশের স্কুল কলেজ খোলা কিনা। তারা কীভাবে সমাধান করছে এই সমস্যার তা আমাদের দেখা উচিত। জনসংখ্যা, ভৌগোলিক অবস্থা সব মিলিয়ে ভারতকে এই বিষয়ে অনুসরণ করা যেতে পারে। ওরাই যদি লেজেগোবরে অবস্থায় থাকে তাহলে আমাদের ভিন্ন পথে হাঁটতে হবে। আমাদের দেশে কত জ্ঞানী গুণীজন আছে, তাদের নিয়ে একটা সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। পরীক্ষা বা মুখস্থ বিদ্যা দ্বারা মেধা যাচাই ছাড়া আর কোন কোন উপায়ে ছাত্রদের মেধা যাচাই করা যায়, পড়াশোনার ভিতরে রাখা যায় এটা বের করতে হবে আমাদের। মোট কথা যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে দেওয়া যায় না।
কোন অলৌকিক সমাধানের পথে বসে থাকা কোনমতেই উচিত কাজ না। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে সরকার খুব করে একটা অলৌকিক সমাধান চাচ্ছে। এবং এটাই হচ্ছে আসল সর্বনাশ!