এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • রাজার চিঠি শারদা মণ্ডল

    Sara Man লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০১ অক্টোবর ২০২১ | ১১৯০ বার পঠিত
  • আমার বোন সর্বানী আমার থেকে প্রায় দুবছরের ছোট। তবে বোনের জন্মের আগের বেশ কিছু স্মৃতি এখনো আমি স্পষ্ট মনে করতে পারি। পাইকপাড়ায় যে বাড়িতে আমি শিশুকালে থাকতাম, সেই পরিবারের সঙ্গে এতটাই ভালো সম্পর্ক ছিল, যে বড়বেলাতেও সে বাড়ি যেতাম। গৃহকর্ত্রীকে পিসিমণি ডাকতাম। একজন দিদিভাই ছিল ব্রততী, ডাকনাম বনি, পিসিমণির মেয়ে। মাঝখানে একটি খোলা উঠোন, চারপাশে রেলিং দেওয়া বারান্দা মোজেইক করা। একতলায় আমরা থাকতাম, আর দোতলায় পিসিমণিরা। সেই দোতলার  বারান্দাতেই একটি ছবি ভেসে আসে - আপাদমস্তক উলের পোষাকে ঢেকে আমি একটা নীল প্লাস্টিক ক্রিকেট ব‍্যাট নিয়ে দাঁড়াচ্ছি আর মা একটা লাল টুকটুকে বল ছুঁড়ে দিচ্ছে। আমি একবারও ব‍্যাটে বলে সংযোগ করতে পারছিনা কিন্তু বারান্দার ব‍্যাটিং পিচে খুব দৌড়োদৌড়ি করছি, এদিক থেকে ওদিক আবার ওদিক থেকে এদিক। আচ্ছা! ব‍্যাটের দিকে বল ছুঁড়লে যে এদিকে ওদিকে দৌড়তে হয়, একথা কে শিখিয়ে দিয়েছিল - বাবা? 
     
    আবার কখনও মনে পড়ে সরস্বতী পুজো হচ্ছে, সদর দরজার কাছে বাঁদিকে প্রথম ঘরে ঠাকুর। ঘর জুড়ে অনেক কিছু সাজানো। দূরে ঠাকুরের পাশে কয়েকটা বই রাখা, ওপরেরটা আমার। নীল মলাটের ওপর লাল আর সাদা দিয়ে লেখা। আমার বইটা নিয়ে নিয়েছে সবাই। এত জিনিস টপকে আমি যেতেও পারছিনা যে তুলে আনব। মা সমানে বোঝাচ্ছে, যে ঠাকুরের কাছ থেকে বই তুলে নিতে নেই। কিন্তু আমার ভবি ভোলার নয়। বারবার দরজা দিয়ে বইটা দেখছি, সদর দরজা অবধি দৌড়োচ্ছি আর প্রচন্ড চেঁচিয়ে কাঁদছি। আচ্ছা কি বই ছিল ওটা? 
     
    দেওয়ালে ক‍্যালেন্ডার, মা কোলে করে ক‍্যালেন্ডারের সামনে আমায় নিয়ে গিয়ে বলছে এটা কে? আমি বলছি বিবেকান্দ-নন্দ। মা হাসছে, আমি হাততালি দিচ্ছি। মনে পড়ে রাস্তার উল্টো দিকে অল্প দূরে পিসির বাড়ি যেতাম। পিসির বাড়ির লম্বা জানলা, উঁচু খাট। মাদুর পেতে খাটের তলায় লাল সিমেন্টের মেঝেতে শুতাম। লম্বা জানলার নিচের অংশ দিয়ে বিকেলের রোদ ঢুকে খাটের তলায় আঁকিবুকি  কাটত। আমি দেখতাম। 
     
    করোনা অনবসরের গৃহবন্দী জীবনে মেজজ‍্যাঠাইমা মানে মঞ্জুলিকা আর আমি মানে টুম্পা ফোনে ফোনে গল্প করি। পিসির বাড়ির খাটের তলায় শোয়ার কথা বলতেই, মঞ্জু বলে, আরে ঐ খাটের তলায় তো আমি ও শুয়েছি। পিসির বাড়ি ছোটো হলেও তকতকে। খাটের তলাতেও কোনো ঝুল বা ধুলোর প্রবেশাধিকার ছিলনা। আর মা বলতো আমার পিসি ঘরে ম‍্যানেজার রাখলেও স্টিলের, এ্যালুমিনিয়ামের আর হিন্ডালিয়ামের বাসনগুলো রুপো আর পিতল কাঁসার বাসনগুলো সোনা করে রাখতো ঘষে ঘষে। বাসনে কোনদিন কোনো দাগ ধরতে দেয়নি। বয়সকালে এই পরিষ্কার করাই বাতিক হয়ে কিছুটা শুচিবাইগ্রস্ত হয়ে গিয়েছিল। পিসির গল্প করতে গিয়ে একাশি বছরের মঞ্জু আর একান্নর টুম্পা হাসে ফোনের দুপাশে। কথা বলতে বলতে মঞ্জু বলে এজীবনে অনেক কিছুই দেখলাম। ছেলে মেয়েরা প্রতিষ্ঠিত হল, নাতি নাতনিরাও সাব‍্যস্ত হল, শুধু লেখাপড়াটা হলনা রে টুম্পা। আজ এই শেষের দিনে বসে চুপচাপ ভাবি, বড় খেদ রয়ে গেল। মঞ্জু কাঁদে, টুম্পা ওপাশে মুখে হাতচাপা দেয়। চেষ্টা করে গলাটা যতটা সম্ভব স্বাভাবিক রাখার। মঞ্জু সোনার তরী আবৃত্তি করে, তার বাবা বিজয়মাধবের কাছে শেখা। টুম্পা এপাশে ফোনের কল রেকর্ডার অন করে দেয়
     
    ঐ কচি বয়সের স্মৃতি আমার দেশের বাড়ি আড়বালিয়াতেও আছে। বিকেলের হলুদ আলো, উঁচু অবধি বাঁশের ভারা, অনেক বাচ্চা সেই উঁচুতে বাঁশে দাঁড়িয়ে। নিচে অনেকে মিলে একটা বড় জাল টেনে ধরে রেখেছে। ঐ জালে একটা করে বাচ্চা লাফ দিচ্ছে। বাবার কোল থেকে আমি অবাক হয়ে দেখছি। তারপরে রোদের মধ্যেই গায়ে জল পড়ল। বৃষ্টি নামল। বাবা একটু ঝুঁকে আমাকে দুটো হাত দিয়ে আড়াল করল। বাবা দৌড়োচ্ছিল। আমি বাবার ওমে ছিলাম, তখন আমার গায়ে জল পড়ছিলনা। তারপরে কি ঘুমিয়ে গেলাম? স্মৃতিটা আর নেই। পরে বড় হয়ে মাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,
     
    - মা, এমন কিছু কি ঘটেছিল, নাকি স্বপ্ন? 
    মা অবাক হয়ে বলেছিল 
    - আড়বেলের চড়কের মেলা, বাঁশে বাঁধা চড়কগাছ। বৃষ্টি এল, তোর বোন তখন পেটে। হিসেব মতো তোর তখন একবছর চার মাস। এসব কথা বলছিস কি করে রে? 
    - মনে যে ছবি ভেসে আসে, মা। 
    - এ কি অদ্ভুত রে? 
    - আচ্ছা মা, বিয়েবাড়ি, উঠোনে ইংরেজি এইচের মতো কমলা রঙের কাঠের চেয়ার, সামনে সাইকেল ভ‍্যান, তাতে অনেক কলাপাতা, কাপড় দিয়ে ঢাকা, এমন কিছু হয়েছিল? 
    - হ‍্যাঁ, সে তো বকুলদার মেয়ে বাবলির বিয়ে, দমদমে। 
    - মা শোনোনা, একটা সিনেমা হচ্ছে, একজন লোক, দরজার পর দরজা পেরিয়ে যাচ্ছে, ওটাও তাহলে সত্যি!
    - ওটা তো প্রমথেশ বড়ুয়ার মুক্তি। 
    - প্রমথেশ বড়ুয়া! উত্তম কুমারের আইডল - পি সি বি? 
    - হ‍্যাঁ, সেই পি সি বি। বাবা ধন‍্যি তোর মনের ছবি। 
     
    বোন হবার পরে পাইকপাড়া ছেড়ে আমরা পাতিপুকুরের সরকারি আবাসনে উঠে এলাম। পাতিপুকুরে এসে মা বিবেকানন্দ বিদ‍্যাভবনে বি এ তে ভর্তি হল। আর বাবার তো ঠাকুরদার মতো ডাক্তার হবার ইচ্ছে ছিল। সে তো হলনা। বাবা সেই আশা কিছুটা হলেও পূরণ করার জন্য সরকারি হোমিওপ্যাথি কলেজে ভর্তি হল। শুরু হল সংসার, চাকরি আমাদের বড় করে তোলা আর সঙ্গে পড়াশোনা। আমরা একটা ঘরে থাকতাম। খাটটা ছিল উঁচু, তার তলায় সর্বস্ব। পাঁচ সাত  খাটের মাঝখানে আমি আর বোন দুদিকে মাথা করে, পায়ে পা ঠেকিয়ে শুতাম। দুপাশে বাবা মা। বাবা আমার দিকে মাথা করে শুত আর মায়ের মাথা বোনের দিকে। গভীর রাতে যদি ঘুম ভেঙে যেত, দেখতাম খাটের একপাশে বা মেঝেতে হারিকেন জ্বালিয়ে বাবা মা পড়াশোনা করছে। আলোটা এপাশে খবরের কাগজ দিয়ে আড়াল করা, যাতে আমাদের চোখে না পড়ে। 
     
    উঠতি ঘরের ছেলে 
    আর পড়তি ঘরের মেয়ে,
    বিদ‍্যেদেবী থাকেন তাদের
    সারা জীবন ছেয়ে। 
     
    বাবা মা দুজনেই খুব মেধাবী ছিল। কিন্তু মা যেকোনো বিষয়ে খুব উদ্বেগে ভুগত, আর বাবা নিরুত্তাপ। মা পার্ট ওয়ান পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগের দিন হয়তো ঠিক মতো প্রস্তুতি হয়নি, সেই ভেবে ভেবে বমি টমি করে একশা। পরীক্ষার দিন বাবাকে ছুটি নিতে হল, অসুস্থ মাকে নিয়ে যাবার জন্য। বাবা কিন্তু অফিস, সংসার সামলেও চুপচাপ প্রথম পরীক্ষা দিয়ে দিল, তেমন কোনো ঢেউ উঠলোনা। শুধু প্র‍্যাকটিকাল খাতার আঁকাগুলো আমার মাসি, কাবেরীকে দিয়ে আঁকাতো। মাসিমণি খুবই ভালো আঁকত। বাবা সন্ধ‍্যেবেলায় বাড়ি ফিরে ঐ আঁকার উপর বৈজ্ঞানিক বিষয়গুলো ঠিক করে নিত আর স্কেল দিয়ে লাইন টেনে লেবেলিং করতো। আমি চুপচাপ একটু দূর থেকে ড‍্যাবডেবিয়ে দেখতাম, বাবা কি করছে।
     
     বাবার একটা ট্রাঙ্ক ভর্তি করে হাড় থাকত। সেই হাড় গুলো নিয়ে বাবা পড়াশোনা করত। ঐ হাড়ের বাক্স চানঘরের ওপরে লফ্টে রাখা থাকত। আমার প্রচন্ড আকর্ষণ ছিল ঐ ট্রাঙ্কের ওপর। ট্রাঙ্ক নামলে আমি আর দূরে থাকতে পারতাম না। বাবার পিঠের ওপর দিয়ে ঝুঁকে ঝুঁকে দেখতাম। এটা ওটা জিজ্ঞেস করতাম। ঐ দেখে দেখে চিনে গিয়েছিলাম, কোন হাড়টা শরীরের কোথায় থাকে। নিজের শরীরে স্পর্শ করে ঐ হাড়গুলো অনুভব করতাম। তবে সবচেয়ে ভালো লাগত ওপরের পিঠে, কাঁধের নিচের তিনকোণা স্ক‍্যাপুলা। ওটা নিয়ে খেলতাম। বোনকে বলতাম, এ্যাই আমার স্ক‍্যাপুলায় একটু চুলকে দে তো। মাকে বলতাম, মা - আ! আমার টিবিয়া আর ফিবুলার মাঝখান টা ধরে টিপে দাও। খুব ব‍্যথা করছে। আমার রোজ রোজ সন্ধ‍্যে হলেই পা ব‍্যথা করত। মা চুল বাঁধার কালো দড়ি দিয়ে পা জড়িয়ে বেঁধে দিত। 
     
    প্রথম পরীক্ষার পর রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল বাবা পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। আর ফাইনালে বাবা তৃতীয় হয়েছিল। অনেক পরে যখন বাবার সঙ্গে গিয়ে কোনো অ্যালোপ‍্যাথি নামকরা ডাক্তার দেখিয়েছি, তখন দেখতাম বাবা গিয়ে প্রণাম করত। ওঁরা ছিলেন বাবার স‍্যার। যাই হোক, মা গ্র‍্যাজুয়েট হল, আর বাবা হোমিওপ্যাথিতে ডাক্তারি পাশ করল। আমি ততদিনে বাগবাজার মাল্টিপারপাসে কেজি ওয়ানে ভর্তি হলাম। সালটা উনিশশ পঁচাত্তর। স্কুলের দিন গুলো খুবই আনন্দে কাটত। কিন্তু বাড়ি এসে চাপা টেনশন। বাবা ফিরত রাত দশটা পার করে। মা ঘরবার করতো। শুনতাম কিসব জরুরী অবস্থা হয়েছে আমাদের দেশে, জরুরী মানে খুব দরকারি। তাই বাবার পোর্ট ট্রাস্টের অফিসে ওভারটাইম হয়, বাবাকে দেশের খুব দরকার। 
     
    আনন্দবাজারে রোজ হেডলাইনের নিচে বড় করে কুট্টির কার্টুন বেরোত। বাবা মা ব‍্যস্ত থাকার জন্য, আমরা প্রায়ই কাছেই মামার বাড়ি থাকতাম। আর তখন মামা বসে বসে কুট্টির কার্টুনের মানে বোঝাতো আমাকে। 
    - এই দেখ টুম্পা, এখানে এইযে কাপড় মুড়ি দিয়ে গণতন্ত্র শুয়ে ঘুমোচ্ছে। আর এই দেখ দরজা দিয়ে সিদ্ধার্থ বেরিয়ে যাচ্ছে। 
    - কেন মামা?
    - আরে সেদিন বুদ্ধদেবের গল্প বললাম মনে নেই? 
    - হ‍্যাঁ-অ্যাঁ
    - যশোধরা ঘুমোচ্ছিল, আর রাজপুত্র সিদ্ধার্থ বেরিয়ে গেল না?
    - হ‍্যাঁ হ‍্যাঁ
    - আরে সেটাই কুট্টি এঁকেছেন দেখ। 
    - কী?
    - আরে সিদ্ধার্থের মুখটা দেখ, নাক বের করা, তোলা চুল। এটা বুদ্ধদেব নয়, সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়, মুখ‍্যমন্ত্রী। এই দেখ ভেতরের পাতায় ছবি। মিল পাচ্ছিস? একে বলে কার্টুন। নামের মিল বলে এইভাবে দেখাচ্ছে।
    - বুদ্ধদেব কে আঁকেনি কেন?
    - আর একটু বড় হ। বুঝতে পারবি কেনো আঁকেনি। 
     
    এর মধ‍্যে আবার মায়ের এক পিস্তুত ভাই মারা গেল। কলেজে পড়ত।দুপুরে ভাত খেতে বসেছিল, বাইরে থেকে কারা ডাকল। উঠে গেল। নামতে গিয়ে সিঁড়িতেই গলা কেটে দিল। আর তার মা মানে মায়ের মেজপিসি বোবা হয়ে গেল, আর কথা বলেনা।
     
    - কে গলা কেটে দিল মা? 
    - নকশাল
    - নকশাল কে? খুব দুষ্টু লোক? এখানে আসবেনা তো? 
    - চুপ চুপ। বাড়িতে যা বললে বললে, বাইরে, ইস্কুলে এসব কথা উচ্চারণ করবেনা। 
    রাস্তা দিয়ে মিছিল যেত। জানলা দিয়ে দেখে দেখে আমি আর বোন খাটের ওপরে মায়ের লাল ব্লাউজ নিয়ে মিছিল করতাম, চেঁচাতাম - ভোট দিন বাঁ-চতে, ত্-তা-রা হাতুড়ি কাস্তে। ইন -কি-লা-ব, জিন্দা-বা-দ। ঐ জানলাই ছিল জগৎ। আইসক্রিম ওলা, ঘুঁটে উলি, বাসন উলি যেই রাস্তা দিয়ে যেত, তাকে দুজনে ডাকতাম। কেউ হাসত, কেউ রাগ করতো।
     
     পাঁচমাথার মোড় থেকে হেঁটে ইস্কুলে যেতাম। আর দোকান, দেওয়াল এসবে কি লেখা আছে ড‍্যাবডেবে চোখ দিয়ে গিলতাম। ইস্কুলে সবার নাম লেখা দুটো করে ন‍্যাপকিন, থালা, গেলাস ছিল। একটা ভাঁজ করে গলায় গুঁজে ঝোলাতে হত। আর একটা টেবিলে পেতে থালা রাখতে হত। টিফিন ইস্কুল থেকেই দিত। খাওয়ার পর সবার ফোল্ডিং খাট ছিল, সেখানে ঘুমোতে হত। তিনজন মিস ছিলেন, মিস চৌধুরী, মিস ব‍্যানার্জি আর মিস বোস। মাঠে খেলা, নাচ গান, ব্রাশ দিয়ে বালি খেলা আর হাতের কাজ, আঁকা, কাঁচি দিয়ে গোল কাটা, এইসব হত। কিন্তু মনে হত, ইস্কুলটা বড্ড তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে যেত। আর ভীষণ রেগে মাকে বলতাম, আমার ওভার টাইম হবেনা মা? আমার বুঝি কিছু জরুরী নেই? আমাকে দেশের দরকার লাগবেনা! মা গম্ভীর হয়ে বলতো, সে তো বটেই, তোমাকে দেশের খুবই দরকার। একটু বড় হলেই ওভার টাইম হবে। মায়ের কথা শুনে, বড় হলে, দেশ ঠিক কী করতে বলবে, এসব আকাশ পাতাল ভাবতে বসতাম। 
     
    কে জি টু তে উঠে গেলাম। আর কতদিন লাগবে? এখনো তো দেশ কিছুই বলছেনা। বললে আমি জানবোই বা কিকরে? চিঠি দেবে? রাঁচি থেকে বড়দাদুর চিঠি আসে। আমার চিঠি বাড়িতে আসবে নাকি ইস্কুলে? আমাদের ব্লকে পোস্টম‍্যান ঢুকলেই লক্ষ্য রাখতাম, আমার নামে কোনো চিঠি এলো? কিন্তু এই চিঠির অপেক্ষায় থাকাটা কাউকেই বলিনি, মাকেও না।
     
    আমি ওয়ানে উঠলাম। মা নিবেদিতা ইস্কুলে প্রাথমিক বিভাগে পড়ানোর চাকরি পেল। আমিও মাল্টিপারপাস ছেড়ে নিবেদিতায় ভর্তি হলাম। ওয়ানের ভর্তির পর থেকেই দেওয়ালের লেখাগুলো অনেক বদলে যাচ্ছিল। মাল্টিপারপাসের পাশে একটা দেওয়ালে বিরাট হাত, হাতের তালুতে গরাদ, গরাদের আড়ালে ছেলে। পাশে লেখা - একটি ভোট দিলে হাতে, মরবে পচে জেল হাজতে। ছি ছি একি ছবি। আর নিবেদিতা লেনের দেওয়ালে লেখা ছিল - বাংলার মাটি দুর্জয় ঘাঁটি, বুঝে নিক দুর্বৃত্ত। সঙ্গে চাষীর ছবি। লাইনটা বেশ মনে ধরল, ছবিটাও। মাকে দেখালাম। মা বলল, ওটা সুকান্তের কবিতা। বাবাকে ধরলাম, সুকান্ত কে? বাবা মায়ের দিকে তাকালো। মা সংক্ষেপে দেওয়ালের কথা বলল, আরও জুড়ে দিল, কাগজ আর দেওয়াল পড়ে পড়ে এই সব রাজনীতির দিকে নজর পড়েছে মেয়ের। দিনরাত এটা ওটা প্রশ্ন। বাবা কোনো কথা বললনা। কিন্তু পরের দিন একটা বই ধরিয়ে দিল আমার হাতে। নামটা সুকান্ত সমগ্র। আবার কিছুদিনের খাদ্য পেয়ে গেলাম। ইস্কুল যাবার পথে দেওয়াল জুড়ে রাক্ষসীর ছবি আঁকা থাকত, বড় বড় নখ ওলা, তাতে রক্ত পড়ছে। 
    - মা দেওয়ালে এত রাক্ষুসী কে আঁকে বলোতো?
    - রাক্ষুসী? ও! ঐ ইন্দিরা গান্ধীকে  আঁকে।
    - ই-ন্দি-রা গান্ধী! সে তো দারুণ দেখতে। দিল্লীতে থাকে। সিনেমার আগে, যার সিনেমা হয়, সেই তো। তার হাতে তারা হাতুড়ি কাস্তে থাকে? রাক্ষুসীর পাশে আঁকা থাকে।
    - আমি ওসব বলতে পারবোনা। বাবাকে জিজ্ঞেস কর। 
    বাবা ব‍্যাপারটা মোটামুটি বুঝিয়ে দিল। মাঠে ফুটবল খেলা হলে যেমন কয়েকটা দল থাকে, দেশ চালাতে গেলেও তেমন। লোকে যাতে চিনতে পারে, তাই সব দলের একটা করে ছবি আছে। যে জিতে যায়, সে দিল্লিতে থাকে। মনে মনে হিসেব কষে নিলাম। ইন্দিরা গান্ধী দিল্লিতে থাকে, মানে জিতে গেছে। তার ছবি হল গরু আর তার বাছুর। আর তারা হাতুড়ি কাস্তে হল তার শত্রু। তাই রাক্ষুসী আঁকে।  তবে কি বড় হলে ইন্দিরা গান্ধীই চিঠি দেবে আমাকে? কিন্তু হঠাৎ একদিন শুনলাম ইন্দিরা গান্ধী খেলায় হেরে গেছে। থমথমে মুখে ঘুরতে লাগলাম, আমার চিঠির কি হবে? মা লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল, 
    - কী হয়েছে? 
    আমি এবারে ভেঙে পড়লাম। সেই কেজি ওয়ান থেকে অপেক্ষা করছি। ভেবেছিলাম ইন্দিরা গান্ধী চিঠি দেবে ওভারটাইমের জন্য। সে হেরে গেছে। আমি তাহলে দেশের দরকারে লাগব কী করে? চোখে জল চলে এল আমার।  মা একটু সময় নিয়ে ব‍্যাপারটা বুঝল, আমার সমস‍্যাটা কী? তারপরে বলল, 
    - তুমি ভুল বুঝে কষ্ট পাচ্ছ। দেশ ঐভাবে চিঠি দেয়না। দেশ কি চায়, সেটা বইতে লেখা থাকে। আর খেলতে গেলে হারজিত হবেই। কখনো মোহনবাগান জিতবে, কখনো ইস্টবেঙ্গল। এতে দুঃখের কিছু নেই। 
    আমি কান্না ভেজা গলায় বললাম,
    - তা সে কোন বইতে দেশের দরকার লেখা থাকে, সেটা কি তোমার কাছে আছে? আমি পড়তাম তবে।
    মা তখন খাটের তলায় বইয়ের পাঁজা থেকে একটা বই বার করে গল্প পড়ে শোনালো। 
     
    বইয়ের নাম রামকৃষ্ণের কথা ও গল্প। ধর্মব‍্যাধের গল্প। একজন ব‍্যাধ নিজের সব কর্তব্য পালন করতো, কোনো অহঙ্কার করতোনা, অন‍্যের ক্ষতি চাইতোনা। তাই সে সত‍্যিকারের জ্ঞানী হল,  সন্ন‍্যাসীকে অবধি উপদেশ দিতে পারতো। গল্প পড়া শেষ করে মা বলল, যার যা কাজ সে সেটা মন দিয়ে করলেই দেশ খুশি হয়। দেশকে খুশি রাখাটাই সবার কাজ। 
    - আমি এখন কী কাজ করে দেশকে খুশি করতে পারি। 
    - পড়াশোনা করে।
    - পড়াশোনা করা দেশের কাজ? সবাই তো করেনা।
    - বয়েস অনুযায়ী কাজ বদলায়। ছোটোদের কাজ পড়াশোনা। এই বলে মা আর একটা পুরোনো বই বার করলো। একটা লাইন দেখিয়ে বলল,
    - পড়ো, কি লেখা আছে। 
    বানান করে দেখলাম লেখা আছে- ছাত্রাণাং অধ‍্যয়নং তপঃ। মানেটা মা বলে দিল, ছোটোদের কাছে বই পড়াটাই সাধনা। দেশের জ্ঞানী ঋষির কথা। বুক থেকে পাথর নেমে গেল। বাড়িতে বসে মন দিয়ে বই পড়লেই দেশ খুশি হবে। এই এত সহজ কথাটাই জানতাম না। মায়ের সঙ্গে আগেই আলোচনা করা উচিত ছিল। মা দেখছি সবই জানে। 
     
    বাবার ডাক্তারি বই অবধি ঘেঁটে ঘুঁটে দেখতে লাগলাম, বাংলায় কিছু আছে কিনা। পেয়েও গেলাম মেটেরিয়া মেডিকা। তারপর একদিন খবরের কাগজের মধ্যে একটা চকচকে বই এলো - শুকতারা। বাবা বলল, এবার থেকে তোমার জন্য প্রতি মাসে শুকতারা আসবে। এখন এটা পড়ো, মেটেরিয়া মেডিকা পরে পড়বে। সেই থেকে  মা বাবার কথা মতো বই পড়ে চলেছি। বইয়ের বাইরে তেমন করে কিছু আর শেখা হলনা। ডাকঘর পড়েছি। রাজার চিঠি আসে কিনা জানিনা। ২০১২ সালে যখন কলেজের টিচার ইন চার্জ হলাম, মমতা ব‍্যানার্জির সই করা চিঠি পেয়েছিলাম নারী দিবসে। নারী প্রশাসক হিসেবে অভিনন্দনের চিঠি, সঙ্গে বড় প‍্যাকেট মিষ্টি, ফুলের বোকে। কম্পিউটারের ডাটা অ্যালগোরিদমের কারসাজিতে, জন্মদিনে নরেন্দ্র মোদীর ছবি আর সই দেওয়া ইমেলও পেয়েছি বার দুয়েক। নিজের মনে হাসি, দেশ কি সত্যি জানতে পারে, কী কাজ করি আমি!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০১ অক্টোবর ২০২১ | ১১৯০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 2601:84:4600:5410:3c68:5db:1b69:8153 | ০২ অক্টোবর ২০২১ ০০:০৬498958
  • বেশ 
  • বিপ্লব রহমান | ০২ অক্টোবর ২০২১ ০৯:২৩498970
  • কি অপূর্ব সুন্দর শৈশবকথন! যেন সিনেমার একেকটি স্লাইড চোখের সামনে ভেসে এলো।

    লেখায় ছোট ছোট প্যারা করে লাইন স্পেস দিয়ে লিখলে অনলাইন পাঠে চোখের আরাম হয়। নইলে ঠাস বুনন লেখায় চোখে বিভ্রম ধরে। অনুগ্রহ করে সম্পাদনার ঘরে গিয়ে ঠিক করে দেবেন ভাই?

    আরো লিখুন। শুভ

     

  • Mousumi Banerjee | ০২ অক্টোবর ২০২১ ১০:৫৬498975
  • খুব খুব ভালো লাগল।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল মতামত দিন