ছুটির দিনের রাত। ঠাকুরপুকুরের কাছে এক আলো-আঁধারি বাস-স্টপে দাঁড়িয়ে আছি, এসপ্ল্যানেড যাব। দুটো তিনটে বাস ছেড়ে দিলাম, বড্ড ভিড়। নাঃ, দেরি হয়ে যাচ্ছে, এবার যা পাব তাতেই উঠে পড়তে হবে। একটা সরকারি বাস এল, হাওড়া যাবে। এটায় আগের গুলোর চেয়েও বেশি ভিড়। দরজায় লোক ঝুলছে। কিছু করার নেই। উঠতে গেলাম। পাদানিতে একটা লোক দাঁড়িয়ে আছে, দরজায় হেলান দিয়ে বাসের সামনের দিকে মুখ করে। সে তার পা একটুখানি সরিয়ে আমায় পা রাখার জায়গা দিল। টং টং করে কন্ডাক্টরের ঘন্টার শব্দ, বাস ছেড়ে দিল। ঝোলার অভ্যাস নেই অনেক দিন। দু দিকের রড ধরে বিশ্রী ভাবে বিরাট একটা ফোসকার মত বাসের গায়ে ফুলে আছি। পা স্লিপ করতে পারে যখন তখন। একটা দাঁড়িয়ে থাকা অটোরিক্সায় ধাক্কা খেতে খেতে বেঁচে গেলাম। যে লোকটা পা সরিয়ে জায়গা দিয়েছিল, সে এবার তার বাঁ হাতটা আমার পিছন দিক দিয়ে নিয়ে গিয়ে সামনের রডটা ধরল। পিঠে একটা সাপোর্ট পেলাম, আর পড়ে যাবার ভয় নেই।
একটু পরে বাসের ভেতরে যেতে পারলাম আর... আশ্চর্য ব্যাপার, ওই ভিড়ের মধ্যে বসতেও পেয়ে গেলাম। জানলার ধারে বসে যাচ্ছি... মনে হল ওই অচেনা লোকটির কথা, যে আমায় সম্ভাব্য বিপদ থেকে বাঁচাল। কি দায় পড়েছিল তার? আমার মুখটাও সে দেখেছে বলে মনে হয় না, আমি তো দেখিইনি। কোন দিন দেখা হলেও কেউ কাউকে চিনতে পারব না।
এক বন্ধু একটা গল্প বলেছিল। আদতে শিলিগুড়ির ছেলে সে। কলেজে পড়তে কলকাতায় এসে বাসে ঝুলে যাবে, হিরোগিরির ব্যাপার। কিন্তু ঝুলে যারা যায়, তারা ঝোলার কায়দা জানে। এর তা জানা নেই। বিভিন্ন বাসে বিভিন্ন লোক দায়িত্ব নিয়ে নতুন ছেলেটিকে শিখিয়ে দিয়েছিল “রড ধরে ঝোলাটার ট্যাকটিক্স”।
এক পরিচিত ভদ্রমহিলার কথা মনে পড়ল। তিনি সব সময়েই একটু অন্যমনস্ক থাকেন। জলের পাইপ বা ইলেকট্রিকের লাইনের জন্য খোঁড়া গর্তে পড়ে যাবার মুহূর্তে তাঁকে ধরে ফেলেছিলেন পাঠান স্যুট পরা এক কাবলিওয়ালা। কি এসে যেত তাঁর এক শাড়ি পরা বাঙালি হিন্দু মহিলাকে না বাঁচালে? এগুলো ‘instinct’। পলকের মধ্যে নেওয়া সিদ্ধান্ত। যাঁরা করেন, তাঁরা এভাবেই করেন। ভাবনা চিন্তা করে, পরে কী হতে পারে ভেবে কি আর সব কাজ হয়?
খবরের কাগজ খুললেই চারদিকে অমানবিক মুখের মিছিল। তার মাঝে কিছু উজ্বল ব্যতিক্রম যে থাকে না তা নয়। তবে তেমন ‘বড় মাপের’ মানবিকতা না দেখালে তো আর কাগজে জায়গা পাওয়া যায় না। তবু মনে হয় ছোট সাহায্যও কি কম? প্রতিদিনের এমন কত ছোট ছোট সাহায্য যে কত মানুষকে অন্য ভাবে খবরের কাগজে নাম ওঠান থেকে বাঁচিয়ে দিচ্ছে কে তার হিসেব রাখে।
কবীর সুমন এক ভারী আর বেঢপ চেহারার লোকের বাসে ওঠার গল্প বলেছিলেন। বাঁ হাতে চটের ব্যাগ আর ডান হাতে ছুটন্ত বাসের হাতল ধরে লোকটাও ছুটছে। একবার ফুটবোর্ডে উঠতে গিয়ে পা ফসকেছে লোকটার। তারপর...
"পড়ি-কি-মরি'র জোরে শেষমেশ ফুটবোর্ডে উঠে/ দেখলো লোকটা, ঠিক দু-তিনটে হাত যায় জুটে/ রোজকার মত আজও লোকটা অনেক দূর যাবে/ ডানপিটে লোকটাকে কারা, কোন যুদ্ধে হারাবে!"
এই দু-তিনটে হাতের মালিকদের কেউ কোনও দিন খুঁজে পাবে না। তবু তাঁরা ছিলেন, আছেন, থাকবেন, ডানপিটে মানুষদের অনেক দূর যেতে, তাদের জীবনযুদ্ধে জিততে অলক্ষ্যে থেকে সাহায্য করবেন। আর এই সমস্ত মানুষদের জন্যই শঙখ ঘোষের 'যমুনাবতী' নতুন আঙ্গিকে দেখা দেয় - "নিভন্ত এই চুল্লিতে মা / একটু আগুন দে,/ আরেকটুকাল বেঁচেই থাকি/ বাঁচার আনন্দে!"
একে অপরের প্রতি অজানা ভরসাতেই তো টিকে আছি