এইভাবে রিকশাদুটি ক্রমে গলির মুখে বাঁক নেয়। মঞ্জু দ্যাখে কী বিচ্ছিরি পাড়াটা! চারদিকে ঘিঞ্জি বস্তি, রাস্তার ধারে ময়লা জলে থেবড়ে বসে চান করছে মুশকো মুশকো লোক। সস্তা সাবানের ফেনা গড়িয়ে যাচ্ছে ম্যানহোলের দিকে। রোদে একটা বোঁটকা গন্ধ ঝুলে রয়েছে। কর্পোরেশনের ডাস্টবিন থেকে ভাত গড়িয়ে পড়েছে রাস্তায়। তাই নিয়ে কামড়াকামড়ি করছে বেড়াল আর কাকেরা। পাশের চায়ের দোকান থেকে কেউ হাড়জিরজিরে বেড়ালটার গায়ে এক সসপ্যান ফুটন্ত জল ছুঁড়ে দিল। বেড়ালটা কাঁইমাই করে লাফিয়ে উঠল একেবারে। মঞ্জু জানে বেড়াল জলে পড়লে ল্যাও-ল্যাও করে। মায়ের পাশে বসে রিকশা থেকে মঞ্জু সব লক্ষ্য করে। ঘাড় ঘুরিয়ে দ্যাখে পিছনের রিকশায় বাবা মালপত্তর নিয়ে বসে আছে। বাবার হাতে নিউ ক্লথ সেন্টারের ক্যাটক্যাটে সবুজ প্লাস্টিক দুলছে। মঞ্জুদের রিকশাটায় প্যাডেল করার সময় মাঝে মাঝে ঘটঘট করে আওয়াজ হচ্ছে। সেই শব্দে সামনের দিকে মুখ ফেরায় মঞ্জু। রিকশাওয়ালার গোড়ালির পিছন থেকে পায়ের ডিমে বরাবর ফুলে ওঠা শিরাটার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। প্রতিবার প্যাডেল ঘোরানোর সময় তার মনে হয় শিরাটা টিনের পাদানির অমসৃণ প্রান্তে লেগে ছিঁড়ে যাবে, কিন্তু রক্তারক্তি কান্ডটা প্রতিবারই কীভাবে যেন হতে হতে বেঁচে যায়।
একসময় ওরা বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়ায়। ভাঙাচোরা বাড়িটা দেখে মঞ্জুর মনটা দমে যায়। জানলার ধুলোজমা রুগ্ন জালে চুলের কুণ্ডলী লেপ্টে রয়েছে। কোণে আটকানো একটা কোলগেটের লাল ত্যাবড়ানো বাক্স আর দু-চারটে ট্যাবলেটের চকচকে ফয়েল। দেখলেই বোঝা যায় ঘরে রোদ ঢোকে না। দিনের বেলাতেও কেমন নিঝুম হয়ে থাকে। আগের বাড়িটা এর চেয়ে ভালো ছিল। আগের পাড়াটায় মঞ্জুর দু'জন বন্ধু হয়েছিল। অথচ অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর মা বলল ওদের বাড়ি পাল্টাতে হবে। পাড়াটা নাকি বিচ্ছিরি! ওখানে থাকলে মঞ্জু বখে যাবে। বাবা সঙ্গে সঙ্গে বলেছিল নতুন পাড়া থেকে মঞ্জুর ইস্কুলটাও কাছে হবে। এও কোনো নতুন ব্যাপার নয়। প্রতিবারই বাড়ি বদলানোর সময় একটু একটু করে মঞ্জুর ইস্কুলটার দিকে এগোনো হয়। মঞ্জু ভাবে ইস্কুলের একটা ঘর ভাড়া নিলেই হয়। কয়েকদিন মঞ্জু একটু মন গুমরে থাকে। ভাত খেতে বসে গলার কাছটা ব্যথা-ব্যথা করে। তারপর যথারীতি একদিন সকালে মঞ্জুর বাবা দুটো রিকশা ডেকে আনে। মঞ্জু দ্যাখে রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে দশটা টাকা কমানোর জন্যে বিচ্ছিরি দরদস্তুর করছে তার বাবা। একসময় হাল ছেড়ে মঞ্জুর দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে বলে, যা, তোর মা-কে ডাক। আস্তে আস্তে বাঁধাছাদা করে রাখা মালপত্তরগুলো রিকশায় তোলা হয়। সবশেষে মঞ্জু আর মঞ্জুর বাবা রিকশায় চড়ে বসে। মঞ্জুর মা তখনও দু-একজন প্রতিবেশীর কাছ থেকে বিদায় নিতে ব্যস্ত। মঞ্জুর বাবা বিরক্তচোখে হাঁক দেয় — কী হল? পাশের বাড়ির কাকিমা মঞ্জুর মায়ের হাত ধরে বলে — আবার এসো কিন্তু দিদি। মঞ্জুর মা কান্না-কান্না গলায় বলে — ভুলবো না দিদি। মঞ্জু হেসে ফ্যালে। সে জানে পুরোনো পাড়ায় কোনোদিন ফিরে আসা হবেনা আর।
রিকশা থেকে সংসার নামল। ঘটি-বাটি-হাঁড়ি-ডেকচি, হাঁড়ির ভেতর একটা চামচ ঢুকে খটখট শব্দ করছে। দড়ি দিয়ে বাঁধা বিছানার তোষক। তোষকের পেটের ভেতর বালিশ, কম্বল। একটা চটের ব্যাগের মুখে মঞ্জুর বইগুলো উপচে রয়েছে। একদম উপরে ভূগোল বইয়ের মলাটটা আগেই খানিকটা ছেঁড়া ছিল, টানাটানিতে ফ্যাঁস করে খসে উড়ে গিয়ে সেটা ঝুলে রইল নর্দমার ধারে। ঠিক যেন শ্যাওলার ওপর প্রজাপতির মত একটি কমলালেবু-গোল পৃথিবী। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মঞ্জুর কানে আসে রিকশাওয়ালাদের সঙ্গে বাবার আরেকপ্রস্থ ঝগড়া। অবশেষে ভাড়া মেটানো হল। ঘুপচি ঘরে ঢুকতেই একটা ভ্যাপসা গন্ধ লাগে মঞ্জুর নাকে। তার হঠাৎ মনে হয় প্রত্যেক ভাড়াবাড়ির আলাদা আলাদা গন্ধ আছে। ঘরদোর ঝাঁট-মোছা করা হয় সারাদিন ধরে, ভেজা মেঝেতে পায়ের পাঁজ ফেলে মঞ্জু ধমক খায়। যতটা সম্ভব জিনিসপত্র গুছিয়ে বিকেলের দিকে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়ে। জানলার ধারে বসে মঞ্জুর আলিস্যি লাগে। দ্যাখে রাস্তার উল্টোদিকে ডাস্টবিনের পাশে লোম-ওঠা সেই পরাজিত বেড়ালটি নুলো চাটছে। বিকেলের রোদে মাছি উড়ে উড়ে বসছে তার গায়ে। একটি সাইকেলের ক্রিংয়ে গলির বাতাসে সতর্কতা জারি হয়।
কেউ জানে না মঞ্জুর একটা নিজস্ব খেলা আছে। দুপুরে মা ঘুমিয়ে গেলে মঞ্জু ঘরের মেঝেতে বসে খেলে। মায়ের টিকালো নাকের ডগায় সামান্য আলো পড়ে চকচক করে, সেদিকে তাকিয়ে মঞ্জু মেপে নেয় মায়ের ঘুমের গভীরতা। অসাবধান আওয়াজে ঘুম ভাঙিয়ে দিলে, মঞ্জু জানে, মা উঠে ভীষণ রেগে যাবে। তখন তার পিঠে গুমগুম কিল পড়বে। মঞ্জুর খেলাতে অবশ্য শব্দ হওয়ার কথা নয়। মেঝেতে হামাগুড়ি দিতে হয় একটু এই যা। এক ঘর থেকে অন্য ঘরে ঘুরে ঘুরে মঞ্জু মনে মনে ঘরগুলোর নাম ঠিক করে নেয়। একটা ঘর আমেরিকা, আরেকটা ব্রিটেন, রান্নাঘরটাকে ভারত বানিয়ে দিল কেন কে জানে! মশলাপাতি থাকে বলে হয়তো, ভূগোলে পড়েছে সে মশলার জন্যে স্পেন-পর্তুগাল থেকে লোকেরা আসত ভারতবর্ষে। মহাসাগরগুলো সাজিয়ে নেয় এরপর। ঘরের মেঝের ফাঁকা জায়গাটা পুরোটাই সমুদ্র। বিছানাটা হল মূল ভূখন্ড আর দু-একটা ছড়ানো-ছেটানো আসবাবপত্র, বলাই বাহুল্য, দ্বীপপুঞ্জ। যুদ্ধটা লেগে যায় কোথাও একটা। মঞ্জু খুব নিবিষ্টভাবে দ্যাখে যুদ্ধজাহাজগুলো থেকে উড়ে যাচ্ছে বোমারু বিমান। খুব মন দিয়ে সমস্যার জটিলতা সম্বন্ধে ভাবতে শুরু করে সে। আগের প্রতিটা ভাড়াবাড়িতে তৈরী করা প্রতিটি পৃথিবীর মতোই নতুন বাড়িটায় দেশ এবং সমুদ্রগুলো বানাতে তার একটা দুপুর লাগে মাত্র।
পাড়াবদল করতে করতে মঞ্জুর বন্ধুরা সব হারিয়ে যায় বারবার। বিভিন্ন খেলা থেকে বাদ পড়ে যায় সে। কোনো-কোনোদিন সন্ধ্যেবেলা বাবা বাড়ি ফিরে এসে মঞ্জুকে জিজ্ঞেস করে — বল তো, বেড়াল জলে পড়লে কীভাবে ডাকে? রাত্তিরে জানলার ওপারে ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোর নীচে গলিটা শুনশান হয়ে এলে অন্ধকারে সে মায়ের একটু কাছে ঘেঁষটে শোয়। ধীরে ধীরে মঞ্জু ঘুমিয়ে পড়লে তার মা বাবার দিকে ফিরে খুব নীচু গলায় বলে — এভাবে আর কতদিন? তার বাবা একটু পরে উত্তর দেয় — চেষ্টা করছি তো আমি, সাপ্লাই না এলে কী করব? মা একটা লম্বা শ্বাস ভেঙে ভেঙে নিঃশব্দে বের করে দেয় শ্বাসনালী থেকে — ফেলিওর হওয়া চলবে না, ফেলিওর হওয়া চলবে না কিছুতেই। এরপর কেউ কোনো কথা বলে না। ঘড়ির মৃদু টিকটিক শব্দ শোনা যায়। দূরে বড় রাস্তায় একটা গাড়ির আওয়াজ। মঞ্জুর বাবা চ্যাটচ্যাটে তরল অন্ধকারের থিতিয়ে আসা স্তরটাকে ঘুলিয়ে দিয়ে বলল — জাপান থেকে আসছে জাহাজটা চীন সমুদ্রের ভেতর দিয়ে। আটকে পড়েছে নানারকম রাজনীতির প্যাঁচে। সেরকমই শুনলাম। সাপ্লাই আসার জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া তো কোনো উপায় দেখছি না। উপায় যে আর কিচ্ছু নেই সেই কথাটা স্পষ্টভাবে তলিয়ে বুঝে নিতে নিতে মঞ্জুর মা একেবারে চুপ করে শুয়ে থাকে। দুজনেই ভাবে অপরজন ঘুমিয়ে গেছে। কিন্তু আসলে তারা একটা জাহাজের স্বপ্ন দেখছিল একসাথে। সবক'টা আলো নেভানো একটা ভুতুড়ে জাহাজ অন্ধকার চীন সমুদ্রের ফসফরাস-মাখানো ঢেউগুলোর মাঝে মিশকালো হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
কালীপুজোর রাতে হঠাৎ গোলমাল হল। মদ খেয়ে বস্তির ছেলেপুলেগুলো দারুণ হুল্লোড় জুড়েছিল। তারস্বরে বক্সে হিন্দি গান বাজছিল, মাঝেমাঝে গুবগুব করে মিউজিক। লাল-নীল ঝিনচ্যাক আলোগুলোর অনেক ওপরে ভেপার ল্যাম্পের হলদে আলোটা সরের মত ভাসছিল। মঞ্জুদের ঘরের জানলাটা ভেজিয়ে রাখা হয়েছিল। এইসময় আচমকা একটা শোরগোল শুনে মঞ্জুর মা জানলা খুলে মুখ বাড়িয়ে বুঝতে চেষ্টা করে কী ব্যাপার। টুকরো-টাকরা কথা জড়ো করে সে জানল বস্তির একটা ছেলে সুইসাইড করেছে। মঞ্জু ওঘরে পড়ছে। চুপিচুপি মঞ্জুর বাবাকে ডেকে মঞ্জুর মা বাড়ির বাইরে গেল। গলিটা লোকজনের ভিড়ে ভর্তি। সবাই নেশায় টলমল করতে করতে একটা ঘোরের ভেতর দুলছে। বোঝা গেল ছেলেটা মরেনি। সকলেই জানে ক'দিন আগে টালিগঞ্জের যে সুপারহিট হিরো ও হিরোইনের বিচ্ছেদ ঘটেছে, পাগলের মত তাদের ভক্ত ছিল ছেলেটা। ডাস্টবিনের গায়ে লাগানো লাভস্টোরির পোষ্টারগুলিতে সেই জুড়ির ছবি দেখতে দেখতেই মদের নেশায় সে আচমকা নিজের কবজিতে ব্লেডটা চালিয়ে দেয়, হাতের শিরা চিরে ডাস্টবিনের সামনেটায় মুখ থুবড়ে শুয়েছিল। এই অনর্থক ঘটনায় ঝিমঝিম নেশার জালটা ছিঁড়ে যেতে অনেকেই চটে গেছে। মঞ্জুর বাবা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে দেখল ছেলেটাকে কয়েকজন মিলে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে। মা ঘরে ঢুকতেই মঞ্জু এতক্ষণ জানলা দিয়ে উঁকিঝুকি মেরেও না মেটা কৌতুহলটা চাপতে না পেরে জিগ্যেস করল — কী হয়েছে বাইরে? তাকে বকে জানলার কাছ থেকে সরিয়ে জানলাটা বন্ধ করে দিল মঞ্জুর মা।
অনেক রাতে মঞ্জু অঘোরে ঘুমোচ্ছে যখন, মঞ্জুর মা পাশ ফিরল আস্তে আস্তে
— কাল কাগজে ছেলেটার ছবি বেরোবে, তাই না?
— হুঁ, বেরোতে পারে — ঘুমের ঘোরে জবাব দেয় মঞ্জুর বাবা।
— পেলে কিছু খবর, জাহাজটার?
— নাঃ, শুনলাম নোঙর করে দাঁড়িয়ে আছে। কলকাতা পৌঁছতে ঢের দেরী।
— ওষুধের দোকানে বলল?
একটা অস্পষ্ট উত্তরের দিকে দু'পা এগিয়েও যেন মনে পড়ে যাওয়া কথাটাকে হাতছানি দিয়ে শেষপর্যন্ত মনে মনেই সব নিস্পত্তি সেরে তবু অবসাদটাকে উগড়ে না দিয়ে পারল না মঞ্জুর বাবা — এভাবে আর কতদিন?
— অন্য কোনো উপায় তো নেই।
— নেই কি?
গলির ল্যাম্পপোস্টের মরা আলোটাকে জানলার জাল অসুখের মতন আঁকড়ে ধরেছে দেখে নিতে নিতে মঞ্জুর মা মাথা নাড়ল — নাঃ, ফেলিওর হলে চলবে না। আর কোনো উপায় নেই আমাদের। আমাদের তিনজনের।
ঘুমন্ত মঞ্জুর আপেল-মসৃণ গালে একবার আঙুল ছুঁইয়ে, যাতে ঘুম না ভেঙে যায়, সেজন্যে ফের সরিয়ে নিয়ে মঞ্জুর মা দৃঢ়ভাবে কথাটাকে শেষ করে — অন্য ওষুধগুলোয় মরে না অনেকে। আমাদের অপেক্ষা করতেই হবে জাহাজটা এসে পৌঁছানো অব্দি।
প্রায় ঘুমের মত এক নিস্তব্ধতায় তলিয়ে যেতে যেতে মঞ্জুর বাবা ও মায়ের আচ্ছন্ন ভাবনার ভেতরে জড়িয়ে যায় সেই জাহাজটা, আশ্চর্য শক্তিশালী ঘুমের ওষুধ নিয়ে যে দাঁড়িয়ে রয়েছে চীন সমুদ্রে কোনো অজানা জটিলতার কারণে। রাতের সেই বিশেষ মুহূর্তে, যখন মঞ্জুর বানানো সবক'টা পৃথিবীতে সবাই একসঙ্গে চুপ করে যায়, বকের মতন গলাটুকু উঁচিয়ে মেঝেতে এসে পড়া তীর্যক আলোর টুকরোটার ভেতর মঞ্জু দেখতে পেল একটি অলৌকিক জলযান অপেক্ষা করছে তাদের জন্যে।