এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  গপ্পো

  • দুটি গল্প

    মিঠুন ভৌমিক লেখকের গ্রাহক হোন
    গপ্পো | ১৩ নভেম্বর ২০১০ | ৫৪৬ বার পঠিত
  • একটি রোমহর্ষক বিপ্লবের কাহিনী
    -------
    পাহাড়ঘেরা সবুজ উপত্যকার মাঝে একফালি হ্রদ। রিশা নামে এক বাচ্চা মেয়ে ঐ উপত্যকায় রোজ তার গরুছাগলের পাল নিয়ে চরাতে যায়, ফিরে আসে সন্ধ্যায়। খুব ছোটবেলাতেই রিশার বাবা-মা মারা যান। ওর আর কোন ভাইবোনও ছিলোনা। তাই সে একাই থাকে। সারাদিন মাঠের ধারের একটা গাছের নিচে রিশা বসে বসে আকাশপাতাল ভাবে। কখনও বা ঘুমিয়েও পড়ে। ঘুমোলেই ওর স্বপ্নে হানা দেয় এক অদ্ভুৎ সুরেলা গান। মানুষের গলায় গাওয়া গান না, যেন বাঁশী আর অজানা আরো কিসের সব মিঠে ধ্বনি মিলেমিশে ঐ অপার্থিব সুর রচনা করেছে। রিশা ঘুম ভেঙে মুষড়ে পড়ে। ঐরকম একটা বাজনা থাকলে সে সারাদিন বসে বসে বাজাতে পারতো।

    রিশার গরু আর ছাগলদের পালের মধ্যে সবথেকে বয়স্ক এক রামছাগলকে সবাই নেতা বলে মানতো। রামছাগলের এক বিঘৎ লম্বা, কালো, তেল চুকচুকে দাড়ির জন্যই হয়ত তার এত নাম। সে যাই হোক, ঐ রামছাগলটির নাম ছিলো কিট্টো। একদিন দুপুরবেলা, রিশা তখন গাছের নিচে বসে থেকে থেকে ঘুমিয়ে পড়েছে, কিট্টো ঘাস চিবোতে চিবোতে সঙ্গীসাথীদের ডেকে বললো, "বন্ধুগণ, এখন আমি তোমাদের স্বাধীনতা সম্পর্কে কিছু বলবো। তোমরা কোনদিনও এই ব্যাপারে কিছু ভেবে দেখেছো কিনা জানিনা, তবে আমি ভেবেছি। আমরা ঐ একরত্তি মেয়েটির হাতের পুতুল নই। আমরা প্রত্যেকেই পশুসমাজের এক একজন প্রতিনিধি। আমরা চলনে বলনে আলাদা, পৃথক সত্ত্বার অধিকারী। আমাদের প্রত্যেকের আলাদা হয়ে থাকার অধিকার আছে।"

    এই কথায় সভার মধ্যে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হলো। এক নবীন বাছুর এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলো, "আপনি তো বুদ্ধিমান। কিন্তু আমরা মানে যারা অতটা বুদ্ধিমান নই, তারা কিভাবে আলাদা হবো? আমরা তো সবাই একইরকম দেখতে। একইভাবে হাঁটি, একই খাবার খাই। "

    তখন কিট্টো ভেবেচিন্তে বললো, "আজ থেকে তোমরা কেউ কারুর নকল করবেনা। যা এতদিন করে এসেছো, তা ভুলে যাবার চেষ্টা করবে। সমস্ত অভ্যেস পালটে ফেলবে। এইভাবে তোমরা সকলে স্বকীয়তায় উজ্জ্বল হবে।"

    সবাই মহা উত্তেজিত হয়ে উঠলো। সে এক হুলুস্থূল। কিট্টো দাড়িটা আলগোছে চুমরে একবার আকাশের দিকে চেয়ে বাড়ির দিকে চলতে শুরু করলো। তার পেছনে চিৎকার করতে করতে বাকি সবাই। আসলে ওরা কিন্তু চেঁচাচ্ছিলো না। একেকজন একেকভাবে ডাকছিলো বলে মনে হচ্ছিলো চিৎকার করছে। রিশা একটু অবাক হলো এসব দেখে। রোজ এই পশুদল শান্তিপূর্ণভাবে ঘরে ফেরে, আজ কী হলো?

    সেদিন রাতে হঠাৎ রিশার ঘুম ভেঙে গেল। বাইরে কিসের আওয়াজ পেয়ে সে জানলাটা যেই ফাঁক করেছে, অমনি বাজখাঁই গলায় কে যেন বলে উঠলো, "চুপচাপ বেরিয়ে এসো খুকি। চেঁচামিচি করলে পাথর হয়ে যাবে।"

    ভয়ে তো রিশার গা হিম। তবু কোনমতে বেচারী জড়োসড়ো হয়ে বেরিয়ে এলো। দেখে কী, বাইরে দুধসাদা জ্যোৎস্নায় তিনটে অদ্ভুত লোক ঘোরাঘুরি করছে। অদূরেই দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়াগুলোর গায়ের রং মিশমিশে কালো, ওদের নি:শ্বাসে আগুনের হলকা, চোখে ভাঁটার মত দৃষ্টি। তিনটে লোকের একটা বেজায় মোটা, দশাসই চেহারা। একটা বেজায় রোগা, তার আবার সোনালী চুল। আরেক জন এদের মাঝামাঝি, গম্ভীর হয়ে সে মাঝে মাঝেই হাত নাড়ছিলো, আর অমনি সেখানে হাজার হাজার জোনাকির আলো ফুটে উঠছিলো।

    মোটা লোকটা রিশাকে বললো, "অনেক দূর থেকে আসছি। আমাদের সব জল ফুরিয়ে গেছে। ঘোড়াগুলোরও তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। কাছেপিঠে নদীনালা আছে?"

    রিশা বললো, "আমার কাছে অল্প কিছু জল আছে। এনে দেবো?"

    তাতে ওরা তিনজনেই খুব হাসলো। হেসে বললো, "ঐটুকুতে হবেনা। বরং এক টুকরো রুটি আনো।"

    রিশা একছুটে আধপোড়া একটা রুটি এনে দিলো। ওরা চোখের নিমেষে সেই একটা থেকে একধামা কেক বানিয়ে ফেললো। তারপর পাহাড়ঘেরা হ্রদটার খোঁজ জেনে নিয়ে তিনজনেই রিশাকে খুব আদরটাদর করে বললো, "তোমাকে এই শিঙেটা দিয়ে যাচ্ছি। এইটার সুর ভারি মিঠে। দুপুরবেলা মাঠের ধারে বসে যখন ঘুম পাবে,তখন এটা বাজিও।" বলে মুচকি হেসে ঝড়ের বেগে ঘোড়ার গাড়ি করে চলে গেল। রিশা দেখলো, শিঙেটা কিসের একটা হাড় দিয়ে বানানো, বেশ চকচকে করে ঘষামাজা।

    পরদিন দুপুরবেলা। অলস মেজাজে রিশা গাছের নিচে বসে শিঙেটায় ফুঁ দিলো। দিয়েই অবাক হয়ে গেল। এমন আজব বাজনা সে জন্মে দেখেনি। না বাঁশি, না ভেঁপু, না জগঝম্প। আবার ঐগুলো সমস্তই মিলেমিশে আর আরো কী কী সব মিশে এমন অদ্ভুৎ সুর বের হচ্ছে ওটা থেকে। সাবধানে উল্টেপাল্টে দেখে, ভয়ে ভয়ে রিশা বাজাতে লাগলো শিঙেটা। সমস্ত উপত্যকায় ছড়ালো সেই সুর। পাহাড়ের অন্ধকার খাঁজগুলো, বরফঢাকা চূড়াগুলো আর তালঢ্যাঙা সব কালচে সবুজ গাছের মধ্যে দিয়ে সেই আওয়াজ পাক খেয়ে খেয়ে ঘুরতে লাগলো। হ্র দের স্থির জলেও বিলি কেটে কেটে চললো সেই সুর। মোট কথা, রিশা বেশ টের পেলো কী যেন একটা অন্যরকম হচ্ছে। আসেপাশের সমস্ত কিছুই যেন ওর বাজনার সুরে শ্বাস বন্ধ করে আছে।

    ওদিকে আগেরদিনের মত সেদিনও মাঠে সভা চলছিলো। কিট্টো তার বক্তৃতা সবে শুরু করেছে তখন। সভাসদরা এ ওর দিকে তাকিয়ে একেকজন একেকরকম ভাব করছে। ঘাস খাওয়ার ধরণ থেকে চলাফেরা, সমÙত কিছুর মধ্যেই স্বকীয়তা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করছে সবাই। কিট্টো তৃপ্তির সাথে পরবর্তী কার্য্যক্রমটা গুছিয়ে নিচ্ছে মনে মনে, এমন সময় অঘটনটা ঘটলো। প্রথমেই কালো ছোপ ছোপ দুধসাদা একটা গরু, রিশা ওর নাম দিয়েছে বিল, সামনের পা-দুটো ভাঁজ করে বসে, সবাইকে অবাক করে দিয়ে, ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদতে লাগলো। সকলে তো থ। এইভাবে কিছুক্ষণ কাটলো। তারপর দেখা গেল বিল দু-পায়ে ভর দিয়ে হাঁটার চেষ্টা করছে। বিলের হাবভাব তখন আর একটুও গরুর মত লাগছিলোনা। খুব মন দিয়ে, কখনও দু-পা, কখনও চার-পায়ে হেঁটে সে দূরের মনের দিকে চলে গেল।

    ওদিকে কিন্তু বাজনাটা বেজেই চলেছে। রিশা গাছের নিচে তন্ময় হয়ে বাজাচ্ছিলো। দেখতে দেখতে আরো চারটে জন্তু, তাদের নাম-ধাম বলে দিলে ভারি দু:খ পাবে, বিলের মত দু-পায়ে হাঁটার চেষ্টা করতে করতে বনের দিকে চলে গেল। ব্যাপার সুবিধের নয় বুঝে কিট্টো একদৌড়ে রিশার কাছে গিয়ে নিজস্ব ভাষায় ঘটনাটা বোঝাতে চাইলো। রিশা জন্তুদের সাথেই সারাদিন কাটানোর জন্য ওদের মনের ভাব কিছু কিছু বুঝতো। যদিও ভাষা বুঝতো না, তবু সে আন্দাজ করলো কিছু একটা চাঞ্চল্যকর ঘটছে। তাছাড়া সন্ধেও হয়ে আসছিলো। বাকি গরু-ছাগলদের নিয়ে রিশা বাড়ি চললো। তার মন বেশ খারাপ। আজ মোট পাঁচটা জন্তু হারিয়ে গেছে।

    সেদিন রাতে রিশার বাড়িতে একদল নতুন অতিথি এলো। এক মাঝবয়সী দম্পতি আর তাঁদের তিন ছেলেমেয়ে। মেয়ে দুটির নাম বিন আর তিন, ছেলেটির নাম নী। নী-য়ের বয়স রিশার মতই, বিন আর তিন ওদের থেকে একটু ছোটো। রাতে খাওয়ার পরে রিশা ঐ দম্পতিকে অনুরোধ করলো, যেন তারা সপরিবারে ঐ বাড়িতেই বাস করে। ঐ দম্পতিও সানন্দে রাজি হলো। বিন-তিনের মার নাম ছিলো সু। সু রিশাকেও নিজের মেয়ে বলেই ভাবলেন।

    সেদিন রাতে সবাই ঘুমিয়ে পড়ার পর বিন-তিন-নী'র বাবা চুপিসাড়ে ছাগলদের থাকার ঘরটায় ঢুকলেন। অল্পক্ষণ পরেই শোনা গেল কিট্টোর প্রবল আর্তনাদ। আওয়াজ পেয়ে সকলে খোঁয়াড়ে গিয়ে দেখলো, কে যেন কিট্টোর একটা কান কেটে নিয়েছে। কোথাও কাউকে দেখা গেল না। তখন অনেক রাত হয়ে গেছিলো, তাই কিট্টোকে অল্প সেবা সুশ্রূষা করে সকলেই আবার ঘুমোতে গেল। মনের দু:খে আর কানের ব্যথায় কিট্টো-ও ঘুমিয়ে পড়লো।

    পরেরদিন অবশ্য সবাই অবাক হয়ে দেখলো কিট্টোর কানটা আবার গজিয়ে গেছে। কিট্টোকে একইরকম লাগছিলো। যদিও সে ভেতরে ভেতরে অনেক পাল্টে গিয়েছিলো। সেদিন থেকে সে আর মাঠে বক্তৃতা দিতো না। চুপচাপ একা বসে ঘাস খেয়ে যেত সারাদিন।

    রিশাদের বাড়ির আবহাওয়াই পাল্টে গেল পরদিন থেকে। সু দারুন দারুন সব খাবার বানাতে শুরু করলেন। রিশা আর নী যেত গরু-ছাগলদের নিয়ে মাঠে। বিন-তিনও যেতো কোনো কোনো দিন। অনেকদিন রিশা মানুষ বন্ধু পায়নি কিনা, তাই সারাদিন গল্পে গল্পেই কেটে যেত ওদের। শিঙেটার কথা ওরা একরকম ভুলেই গেল। অবশ্য মনে থাকলেও সেতা পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ। একজন শিঙেটার অনেক খোঁজ করেও পায়নি। সে হলো বিন-তিন-নী'র বাবা, বিল।

    বাকি জন্তুরাও মোটামুটি খুশিই ছিলো। তারা সকলেই আগের মত করেই রইলো, একটা গরুর থেকে অন্যকে, বা একটা ছাগলের থেকে বাকিদের আলাদা করা যেতোনা সহজে। শুধু রিশা চিনতো ওদের আলাদা করে। সে কিনা ওদের সাথেই মানুষ, তাই।

    মোদ্দা কথা, এইভাবে কিট্টোর প্রস্তাবিত বিপ্লব ব্যর্থ হলো। পশুরা কেউ স্বাধীন তো হলো-ই না, বরং কয়েকদিনেই সমস্ত কিছু ভুলে গিয়ে মহানন্দে রইলো। কিট্টো যদিও কিছুই ভোলেনি, আর সেসব ভেবে সে ভারি মনমরা হয়ে থাকতো। তবে সে কিনা যুগাবতার, তার কথাই আলাদা।


    কিক্কাওয়ার গল্প
    --------------
    এক দেশে এক ছেলে ছিলো। নাম কিক্কাওয়া। ছেলেটার বয়স সাত, রোগাটে গড়ন, কপালের ডানদিকে কাটাদাগ। পাঁচ বছর বয়সে কিক্কাওয়ার কপালে একটা চোট লাগে। সেই থেকে ঈচের ওপর কিক্কাওয়ার খুব রাগ।

    ঈচের বয়স চল্লিশ। ছোট চোখ, ফরসা রং, আর আধপাকা দাড়িওয়ালা বুদ্ধিমান পুরুষ ঈচ। ঈচের কনুইতেও একটা সেলাইয়ের আবছা দাগ আছে। ঈচ ঐ দাগটাকে ভালোবাসে।

    কিক্কাওয়া রোজ রাতে ঘুমের মধ্যে ঘামে ভিজে ওঠে। উঠে বসে অভ্যাসবশে তিতিকে খোঁজে সে, এখনও। যদিও তিতি থাকেনা আসেপাশে কোনদিন। কিক্কাওয়ার হেঁচকি ওঠে সেইসময়। চেতন অবচেতনের মাঝামাঝি এক অবস্থায় সে তখন।

    তিতি না থাকলেও, নালি থাকে কাছেই। সে এসে কিক্কাওয়ার মাথায় হাত রাখে, কখনও বা অসুখটা বাড়লে, বাইরে খোলা হাওয়ায় নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয়। কোন কোন দিন চাঁদ ওঠে। জ্যোৎস্নায় ধুয়ে যাওয়া পাথরগুলোকে হাতির পাল বলে মনে হয়। নালি তার ছেলেকে গল্প বলে। হাতির গল্প, বাঘের গল্প, পরী আর রাজার সেই পুরোনো গল্পটা। শুনতে শুনতে কিক্কাওয়ার চোখ বন্ধ হয়ে আসে আবার। বাকি রাতটা নালি জেগেই থাকে। আনমনে দূরের পাহাড়, জঙ্গল আর শুকনো নদীখাতের দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ঐ জঙ্গলেই একটা প্রকান্ড ঝাঁকড়া গাছের নিচে তিতি শুয়ে আছে মাটির চাদরে শরীর ঢেকে। তিতিকে মরে যাওয়ার পরে কেমন দেখতে হয়েছে, নালি ভাবার চেষ্টা করে। মনে পড়ে না। মুখ,চোখ, শরীর, কিছুই মনে পড়েনা আর।

    দিন যায়। ক্রমশ, কিক্কাওয়া বড়ো হয়ে উঠতে থাকে। এখন তার বয়স নয়। এই বয়সেই তার চেহারা বেশ শক্তপোক্ত হয়ে উঠেছে। আগের মত রোজ সে স্বপ্ন দেখে তিতিকে খোঁজেনা। তবে তিতির কথা মনে পড়ে খুব। বিশেষ করে শুনশান, একলা দুপুরগুলোতে তিতির কথা মনে করে চোখে জল আসে তার। কিক্কাওয়া জানে এখন ওর কাঁদা বারণ। সে এখন নালির সাথে জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে যায়, পাখি মারতে যায়। একবার একটা শজারুও মেরেছিলো। কিক্কাওয়ার তীর চালানো দেখে স্বয়ং মোড়ল একদিন তারিফ করেছে। তারিফ করেছে ঈচও। সে ওর দিকে এক দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে থেকে আচমকাই হেসে উঠে নিজের হাতের তাগাটা বেঁধে দিয়েছে ওর হাতে। ঈচ নিজেও ধুরন্ধর তীরন্দাজ। তার স্বীকৃতি পাওয়া সহজ না। সবাই বলে আর কয়েক বছর পরে ঈচই মোড়ল হবে।

    কিক্কাওয়া অবশ্য তাগাটা পরেনি। ঘরের কোনায় হেলায় পড়ে আছে সেটা।

    এইরকম করেই আরো একটা বছর ঘুরে যায়। জঙ্গলে বসন্ত আসে, যায়। অল্পবয়স্ক ছেলেমেয়েরা মনোমত মানুষ খুঁজে সংসার পাতে। সংসার নিজস্ব চক্রে ঘুরতে থাকে, উদাসীন। নালির দিন ও রাতগুলো একইভাবে বাঁধা ছকে ঘোরে। ছেলেটাকে দেখে তার চোখ জুড়িয়ে যায়। সেইটুকু পাথেয় করেই নালি বেঁচে থাকে। তার ঘরের দুয়ার থেকে অন্য নারী শাপান্ত করে ফিরে যায়। কেউ বা হাসিতামাশা করে । নালি এসবে খুব একটা গা করেনা। বিগত কয়েক বছরের অভ্যাসে সে এইসব জয় করে ফেলেছে।

    তারপর এক রাতে, সেটা ঘোর অমাবশ্যার রাত, কিক্কাওয়ার ঘুম ভেঙে যায়। পাশেই নালিকে ঘুমন্ত দেখে অবাক হয় সে। নালি সাধারণত জেগেই থাকে রাতে। পরিবর্তে দুপুরের দিকে সামান্য ঘুমিয়ে নেয় কোন কোন দিন। সে যাই হোক, সাতপাঁচ ভেবে কিক্কাওয়া বাইরে আসে। বাইরে তখন আবছা আলো। এক আকাশ তারা উপুর হয়ে তাকিয়ে আছে, দেখে কেমন উদাস হয়ে যায় কিক্কাওয়া। জোনাকি আর তারার আলোয় পথ চলতে থাকে সে। সবই চেনা পথ, বুনো ফুলের গন্ধে ভিজে ভিজে হয়ে আছে। যতই চোখ সয়ে আসে, ততই চমৎকৃত হয় কিক্কাওয়া। একে একে গ্রামের অন্যান্য কুটীরগুলো দৃষ্টিগোচর হয় ওর। ওঝা আখ্‌ম আর মোড়ল নিহানের কুটীর পেরিয়ে ঈচের ঘরটা চোখে পড়ে। বেশ মজবুত ঘর, সামনের উঠোনে খুঁটির মাথায় ঈগলের পালক দিয়ে তৈরী মর্যাদাজ্ঞাপক চিহ্ন বলে দেয় এলেবেলের ঘর নয় এটা। এই গ্রামের সমস্ত বাড়ির গড়নই একরকম, শুধু উঠোনের চিহ্ন দেখে চিনতে হয় কোনটা কার বাড়ি। জানলা নেই কোন বাড়িতেই, দরজা একটাই। একটাই ঘর বাড়িগুলোতে। ছাদে একফালি গোলচে ফুটো, ধোঁয়া বেরোবার আর আলো আসার জন্য।

    কিক্কাওয়া উঠোনে দাঁড়িয়ে ইতস্তত করে। বাইরে থেকে দেখা যায়না, ঘরের ভেতরে কেউ আছে কিনা। হয়ত ঈচ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। ঈচের স্ত্রীও পাশেই ঘুমিয়ে নির্ঘাৎ, শোনা যাচ্ছে আর কদিন পরেই সে মা হবে।

    আরো সময় কাটে। দূরে কোথাও একটা রাতচরা পাখি ডাকে। হাওয়া ভারি হয়ে আসে, ভারি হয়ে চেপে বসে কিক্কাওয়ার চোখেমুখে। গ্রামের চারদিকেই হালকা জঙ্গল। সেই জঙ্গলই ক্রমশ ঘন হয়ে পাহাড় ঢেকে ফেলেছে। এই অন্ধকারে সমস্ত বনটাকেই অখন্ড মনে হয় কিক্কাওয়ার। মনে হয় সমস্ত জঙ্গলটাই একসাথে জীবন্ত হয়ে নড়াচড়া করছে।

    আরো কিছু মুহূর্ত কাটে। ঈচের কুটীর একইরকম নিস্তব্ধ, নিস্পন্দ। কিক্কাওয়া ফাঁপড়ে পড়ে। একটু চিন্তা করে নিয়ে সে মনস্থির করে। পায়ে পায়ে শিকারীর মত এগিয়ে যায় কুটীরের দিকে। একেবারে ঘরের দোরগোড়ায় পৌঁছে সে চুপিসাড়ে অপেক্ষা করে। কেটে যায় আরো কিছুক্ষণ। এবার তার সাহস বাড়ে। বুঝতে পারে ঈচ আর তার বউ দুজনেই নেশা করে অচৈতন্য এখন। সন্তর্পণে কোমরে গোঁজা ছুরিটা বের করে কিক্কাওয়া। চিতার মত গুঁড়ি মেরে, শ্বাস বন্ধ করে এগোয় সে ঘরের ভেতরে। অন্ধকারে চোখ সইয়ে নিতে সময় লাগে। তারপর অল্প অল্প করে দেখা যায় ঘরটা। এই ঘরে কিক্কাওয়া আগে কখনও আসেনি। এক পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে ঈচের বউ, দেখে সে। বাকি ঘরে কাঠকুটো আর গাছের শিকড়।

    সমস্ত ঘরটা জরিপ করে হতাশ হয় কিক্কাওয়া। ঈচ নেই। আবার গুঁড়ি মেরে সাবধানে বেরোবার চেষ্টা করতেই প্রচন্ড জোরে কি যেন এসে ধাক্কা দেয় ওর বুকে। যন্ত্রণায় ককিয়ে উঠে মাটিতে পড়ে কাতরাতে থাকে কিক্কাওয়া। ওর বুক, পেট, সারা শরীর রক্তে ভেসে যেতে থাকে । প্রায় অচৈতন্য অবস্থায় কিক্কাওয়া দেখে, মুখের কাছে ঝুঁকে পড়ে ঈচ কি যেন দেখছে। জ্ঞান হারাবার আগে, ঐ অন্ধকারেও কিক্কাওয়া দেখতে পায়, ঈচের চোখে জল।

    পরদিন গ্রামে শোরগোল পড়ে যায়। নালিকে পাওয়া যায় নিজের ঘরেই, মৃত অবস্থায়। ঈচের বউকেও কে বা কারা কণ্ঠনালী কেটে রাতের অন্ধকারে মেরে রেখে গেছে, শিউরে উঠে দেখে সবাই। ঈচকে উঠোনে পাওয়া যায়, তার কোলে ঠান্ডা হয়ে আসা দশ বছরের কিশোরের মৃতদেহ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • গপ্পো | ১৩ নভেম্বর ২০১০ | ৫৪৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লড়াকু প্রতিক্রিয়া দিন