এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  অপর বাংলা

  • রবীন্দ্র বিরোধিতার স্বরূপ ঃ পাকিস্তান পর্ব

    কুলদা রায় লেখকের গ্রাহক হোন
    অপর বাংলা | ২৩ মে ২০১১ | ৫৮৭ বার পঠিত
  • প্রথম কিস্তি

    ১.

    পাকিস্তানের জন্মমৃত্যুর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ জড়িত। পাকিস্তান শুধু একটা রাষ্ট্র নয়-একটা পন্থাও বটে। এই পাকিস্তানপন্থা মানুষের সম্প্রীতির জায়গাটি ভেঙে দিতে চেয়েছে-চেয়েছে সাম্প্রদায়িক ভেদনীতি চাগিয়ে তুলতে। উদ্দেশ্য বাঙালি নামক একটা বিকাশমান জাতির ইতিহাস ঐতিহ্য সংস্কৃতি ও রাজনীতিকে শেষ করে ফেলা। একটি নিরঙ্কুশ উপনিবেশ কায়েম করার লক্ষ্যে জাতি হিসাবে বাঙালিকে পঙ?গু করে দেওয়া।

    খুব কঠিন কথা। কিন্তু সরল সত্যি। তারা পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই এই পন্থাটিকে হাজির করে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভেতর দিয়ে। তারা ধর্মকেই রাষ্ট্র গঠনের ও জাতীয়তা নির্ধারণের একমাত্র নীতি হিসাবে গ্রহণ করে। এই নীতির মধ্যেই পাকিস্তানের জন্ম ১৯৪৭ সালে। মৃত্যু ১৯৭১ সালে। এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর থেকে পাকিস্তানের ভূতটির আছর দেখা দিচ্ছে।

    ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবে মুসলিম লীগ ভারতের মুসিলম প্রধান অঞ্চলগুলোতে স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহ গঠনের দাবী উত্থাপন করেছিল। বলা হয়েছিল , এই রাষ্ট্রসমূহের অন্তর্ভূক্ত ইউনিটগুলো হবে স্বায়ত্বশায়িত এবং সার্বভৌম। কিন্তু ১৯৪৬ সালে দিল্লীতে অন্য এক প্রস্তাবে, ভারতের উত্তর-পূর্বে বাংলা ও আসাম, উত্তর-পশ্চিমে পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান, প্রভৃতি ব্যাপক মুসলমান জনঅধ্যূষিত অঞ্চলগুলুসহ একটি মাত্র সার্বভৌম স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বস্তুত এ সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়েই প্রণীত হয়েছিল পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের স্থায়ী উপনিবেশ পরিণত করার গোপন ও সুপরিকল্পিত সনদ। তারা বলে, যেহেতু মুসলমান আন্দোলেনর ফলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তাই একটি ইসলামী রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানকে গড়ে তোলাই হবে যুক্তিসঙ্গত। অথচ মুসলিম লীগ এবং এর নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রকৃতপক্ষে কেউ-ই ধর্মানুরাগী ছিলেন না। কিংবা ইসলামের কোনোরূপ উৎকর্ষ সাধনও তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। তারা তাঁদের শোষণ কৌশলকে কার্যকর করার লক্ষ্যে ইসলাম ধর্মের একটি রাজনৈতিক সংস্করণ বের করে ফেলে। ধর্মকে যখন রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করা হয় তখন তারা ফ্যাটসীবাদে পরিণত হয়।

    পাকিস্তানের সূচনাতেই সাম্প্রদায়িক উস্কানি মূখ্য ভূমিকা নিয়েছিল। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীতে মুসলিম লীগ যে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের ডাক দেয়, মূলত তা ছিল এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার নামান্তর। ১৯৪৭ সালের পরেও এই দাঙ্গা স্থায়ী হয়েছিল। ফলে এই ভেদরাজনীতির বাইরে অবস্থান করেও অসংখ্য মানুষ বাস্তুচ্যূত হয়-- দেশচ্যূত হয়।

    পাকিস্তান সৃষ্টির বছর খানের মধ্যেই প্রথম আক্রান্ত হয় বাংলা ভাষা। শুরু হয় ভাষা সাম্প্রদায়িকতা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে বুকের রক্ত দিয়ে বাঙালিরা সে আক্রমণ প্রতিরোধ করে। এই ভাষা আন্দোলনের মধ্য থেকেই বাঙালী আত্মপরিচয় ফিরে পায়। তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ঘটে। বুঝতে পারে দ্বিজাতিতত্বের অসারতা এবং কপট রাজনীতির হিংস্রতা। বাঙালি তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্যে দিয়ে পাকিস্তানপন্থার নাগপাশ থেকে মুক্তির দাবীতে সোচ্চার হতে শুরু করে। এই মুক্তির আন্দোলনে রবীন্দ্রনাথ সহায় হয়ে উঠেন।

    পর্যায়ক্রমে পাকিপন্থা শাসকগোষ্ঠী বাংলাভাষা ও সংস্কৃতিবিরোধী বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা পূর্ববাংলায় একটি বুদ্ধিবৃত্তিক মৌলবাদি গ্রুপও তৈরি করে ফেলে। তাদের সহায়তায় কেন্দ্রীয় সরকার বাংলা হরফ পরিবর্তন, বাংলা ভাষার ইসলামী রূপদান এবং বাংলা ভাষা সংস্কার প্রভৃতি জঘণ্য কাজ শুরু করে। আক্রান্ত হন রবীন্দ্রনাথ। কালক্রমে ১৯৭১ সালে পাকিপন্থা বাঙালীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। হত্যা করে ৩০ লাখ মানুষ। ধর্ষিতা হয় ৩ লাখ নারী। দেশত্যাগের শিকার হয় এক কোটি বাঙালি। এর মধ্যে দিয়েই বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি ভুমিষ্ট হয়। রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি হয়ে ওঠে বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।

    রবীন্দ্রনাথ যে বাঙালী জাতিসত্তার সঙ্গে এত প্রখরভাবে প্রবলভাবে প্রাণবন্ত হয়ে সঙ্গী হবেন-সেটা পাকিপন্থা গোড়া থেকেই বুঝতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল বলেই পাকিস্তানের জন্মর পরপরই রবীন্দ্রবিরোধিতার বীজটি রোপণ করে।

    ২.

    পাকিস্তান শাসনামলে রবীন্দ্রনাথ নিষিদ্ধ হয়েছিলেন। এর পরিকল্পনা হয়েছিল পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই। ১৯৪১সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সংসদ ও পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হয়।

    একাত্তরের পাকবাহিনীর সহযোগী সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন একাত্তরের স্মৃতি গ্রন্থে লিখেছেন--

    আমাদের লক্ষ্য ছিল, বাংলা ভাষায় মুসলিম কালচারের পরিচয় থাকে এমন সাহিত্য সৃষ্টিতে লেখকদের উদ্বুদ্ধ করা। একই সময় পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি গঠিত হয়। সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনকে চেয়্যারম্যান নির্বাচন করা হয়। সে সময় এই সংগঠনের পক্ষ থেকে আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান প্রমুখ লেখেন, যে পাকিস্তানের স্বপ্ন তারা দেখছেন-সেখানে যে বাংলা ভাষা চালু থাকবে , সে ভাষার চরিত্র হবে হিন্দুত্ব বর্জিত।

    ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়ে গেল। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ সাহেব ঘোষণা দিলেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা নয়-একমাত্র উর্দু। যারা এর বিরোধিতা করবে তারা পাকিস্তানরে শত্রু।

    সে সময় পূর্ববঙ্গে মাত্র ১.৫২% মুসলমান অধিবাসী ছিলেন বিদেশাগত। এরা ছিলেন ধনী এবং বাস করতেন শহরে। ছিলেন উর্দুভাষী। অধিকাংশ উর্দুভাষীরা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী। আর ৯৮% মুসলমান বাস করতেন গ্রামে। এরা কথা বলতেন বাংলা ভাষায়। জীবিকার জন্য নির্ভর করতেন জমির উপর। জোলা, দরজি, ঘরামি, কশাই ইত্যাদি পেশায়ও নিয়োজিত ছিলেন অনেকে। যথারীতি উর্দুভাষী গ্রামবাসী গরীব চাষাভূষো মুসলমানদের আতরাফ বা নিম্নশ্রেণীর বলেই গণ্য করতেন।

    ভাষাতাত্ত্বিক গ্রিয়ারসন আলোচনায় মন্তব্য করেন যে, গ্রামের নিম্নশ্রেণীর হিন্দু এবং মুসলমানদের ভাষায় আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য থাকলেও ভাষাগত কোনো পার্থক্য ছিল না, অল্প কিছু ধর্মীয় শব্দ ছাড়া।

    এসব সত্ত্বেও তারা মনে করছেন রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যদি নাও হয় তাহলেও অন্তত: সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলমান তর্কাতীতভাবে দুটি আলাদা জাতি? একথা স্বীকার্য যে হিন্দুমুসলিম সংস্কৃতির মধ্যে মিল আছে, কিন্তু অমিলও কম নেই? যেখানে সেই অমিল অর্থাৎ মুসলিম সংস্কৃতির স্বাতন্ত্র্য, তার বিকাশের মধ্যেই রয়েছে "তমদ্দুনী আজাদীবাকালচারেল অটনমী'? বোঝা যায় পাকিস্তানে, মূলত পূর্ব পাকিস্তানে তাঁরা ইসলামী বা মুসলিম সংস্কৃতি চর্চার ওপর গুরুত্ব দিতে চেয়েছিলেন?১৯৪৯ সালে মাহে নও পত্রিকায় আবুল কালাম শামসুদ্দীনের কণ্ঠে এঁদের সকলের কণ্ঠের প্রতিধ্বনি শোনা যায়,'বিজাতীয়ভাবধারা, বিজাতীয় উপমা রূপক শব্দ কোন কিছুই আর নতুন পোষাক পরে পাকিস্তান সাহিত্যে চালু হতে পারবে না?' (মাহে-নও, ১৩৫৬)।

    প্রফেসর হাবিব রহমান লিখেছেন, এঁরা প্রচুর আরবি-ফারসি উপাদান আমদানি করে বাংলা ভাষাকে একটা স্বাতন্ত্র্যবাদি বৈশিষ্ট্য দিতে চান। কেবল তাই নয়, কেউ কেউ আবার আরবী হরফে বাংলা লেখার প্রস্তাব করেন। গোলাম মোস্তফা, ফররুখ আহমদ, রওশন ইয়াজদানী, তালিম হোসেন, মোফাখখারুল ইসলাম ,মীজানুর রহমান, শাহেদ আলী প্রমুখের রচনায় এই মুসলমানী বাংলা লেখার মানসিকতা অভ্রান্তভাবে প্রকাশ পেয়েছিল।

    ১৯৫১ সালে সৈয়দ আলী আহসান (জন্ম ১৯২) মাহে নও তৃতীয় বর্ষ, পঞ্চম সংখ্যা (আগস্ট ১৯৫১) পত্রিকায় "পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা সাহিত্যের ধারা' প্রবন্ধে লেখেন-

    "প্রাক্তন সম্পূর্ণ বাংলার সাহিত্যের ভাণ্ডার কখনও নি:শেষিত হবে না। সেগুলোর উপর উভয় বাংলারই পূর্ণ অধিকার আছে, কিন্তু এই অধিকার থাকার অর্থ এই নয় যে, এই সাহিত্যের ট্রেডিশনও আমরা গ্রহণ করবো। নতুন রাষ্ট্রের স্থিতির প্রয়োজনে আমরা আমাদের সাহিত্যে নতুন জীবন ও ভাবধারার প্রকাশ খুঁজবো। সে সঙ্গে একথা সত্য যে, আমাদের সাংস্কুতিক স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার এবং হয়তো বা জাতীয় সংহতির জন্য যদি প্রয়োজন হয়, আমরা রবীন্দ্রনাথকেও অস্বীকার করতে প্রস্তুত রয়েছি। সাহিত্যের চাইতে রাষ্ট্রীয় সংহতির প্রয়োজন আমাদের বেশি।?পূর্ব বাংলার সাহিত্যক্ষেত্রে আমাদের উত্তরাধিকার হলো ইসলামের প্রবহমান ঐতিহ্য, অগণিত অমার্জিত পুঁথি সাহিত্য, অজস্র গ্রাম্যগাথা, বাউল ও অসংস্কৃত অঙ্গের পল্লীগান।'

    এই উপলদ্ধি থেকে তাঁর সম্পাদিত দুখণ্ড গল্প সংগ্রহে (ঢাকা, ১৯৫২) তিনি কোনো অমুসলমান লেখকের লেখা প্রকাশ করেননি।

    কিন্তু এই ১৯৫২ সালেই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠানের বঙালি চেতনায় সমৃদ্ধ উৎসবের দেশে পরিণত হয়। এই অনুষ্ঠানে উৎসবে রবীন্দ্রসঙ্গীত, রবীন্দ্রসাহিত্য মানুষের অবলম্বন হযে দাড়ায়। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি নতুন করে জেগে ওঠে রবীন্দ্রনাথের হাত ধরে।

    মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সাত বছরের মধ্যে যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসিলম সরকারের শোচনীয় পরাজয় ঘটে। তিন শতাধিক আসনের মধ্যে তারা পায় মাত্র নটি আসন। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সালের সময়কালের মধ্যে মাত্র এক বছরের গণতন্ত্র একবার মাত্র উঁকি দিয়ে যায়। আর কখনো পাকিস্তানে ১৪ বছরের মধ্যে আসেনি।

    পাকিস্তানে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র প্রবর্তনের নানা চেষ্টার পর ১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে এবং শুরু হয় আইয়ুব খানের শক্ত শাসন। সব রকম গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়, রাজনৈতিক দল ও কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষিত হয় এবং ব্যাপক গ্রেপ্তারির মাধ্যমে কারাগার ভরে ওঠে রাজবন্দীদের দ্বারা।

    সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ছিল অস্বীকৃত এবং সভা-সমাবেশের ওপর জারি ছিল নিষেধাজ্ঞা। ঘোর অন্ধকার ওই সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো ছত্রখান অবস্থায়, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ তো দূরের কথা, দেশের মানুষের একত্র হওয়ার মতো কোনো অবলম্বনও তখন নেই। আইয়ূব খান ময়মনসিংহের এক বটতলার উকাল মোনায়েম খানকে গভর্ণর নিযুক্ত করেন। এই মোনায়েম খানই আইয়ুব খানের জল্লাদ হিসাবে আবির্ভূত হয়।

    তখন ১৯৫৯ সালের গোড়ার দিকে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের উদ্যোগে করাচিতে এক লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সেখানে আইয়ুব খান পরিস্কারভাবে ঘোষণা দেন, পাকিস্তানী ভাবদর্শের প্রতি লেখকদের আনুগত্য থাকতে হবে। পাকিস্তানের ভিতর অসাম্প্রদায়িকতা, বাঙালিত্ব, রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদিকে তিনি পঞ্চমবাহিনীর ঘটনা বলে প্রকাশ করেন। এটাকে কঠোর হাতে দমন করার নীতি ঘোষণা করেন। তার একাজে সমর্থন জানায় সাম্প্রদায়িক দক্ষিণপন্থী এবং বাঙালিত্বে হিন্দুত্ব আবিষ্কারকারী মহলসমূহ, বিশেষ করে বাঙালি-বিদ্বেষী ও জাতিবৈরের পরাক্রান্ত ক্রিমিনাল অবাঙালিরা।

    এ সময়ই সৈয়দ আলী আহসান করাচি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে বাংলা একাডেমীর পরিচালকের দায়িত্ব নেন ১৯৬০ সালে। তিনি রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের উদ্যোগ গ্রহণের বিরোধিতা করেন। বাংলা একাডেমীতে প্রফেসর আনিসুজ্জামানকে সাফ সাফ বলে দিলেন, সরকারী সিদ্ধান্তের বাইরে তিনি কিছু করবেন না। সরকারী সিদ্ধান্তটা ছিল পূর্ব পাকিস্তানে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো আয়োজন হবে না।

    এই পরিস্থিতিতে চির নূতনের ডাক দিয়ে এল পঁচিশে বৈশাখ, রবীন্দ্রনাথের শততম জন্মবার্ষিকী। বাঙালির এই মহৎ কবিকে স্মরণ করার জন্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক উদ্যোগ যে বাঙালি জাতিসত্তার পরিপ্রকাশক হয়ে উঠবে, তা শাসকগোষ্ঠী বুঝতে পেরেছিল। বাঙালিকে গড়াপেটা করে দ্বিজাতিতত্ত্ব-ভিত্তিক মুসলিম জাতি তৈরির যে প্রয়াস চলছিল, তা বড় চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে পারে রবীন্দ্রনাথ নামের কবির দ্বারা, যাঁর জন্ম আজি হতে শতবর্ষ আগে। এই উপলব্ধি থেকে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ পালনের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করল, আজাদ পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে লেখা হলো: "রবীন্দ্রনাথের দোহাই পাড়িয়া অখণ্ড বাংলার আড়ালে আমাদের তামদ্দুনিক জীবনে বিভেদ ডাকিয়া আনার সুযোগ দেওয়া চলিবে না। একদল লোক পশ্চিম বাংলার সাহিত্যের অন্ধ-অনুসারী ও ভক্ত। তাদের রবীন্দ্র-ভক্তি বিপদের কারণ হইতে পারে এবং বাইরের যারা পাকিস্তানকে দ্বিধাহীন মনে গ্রহণ করেন নাই, তারা এই সুযোগে তামদ্দুনিক খেলায় নামিতে পারে।'

    একাত্তরের ঘাতক জামাতে ইসলামীর অধ্যাপক গোলাম আজম ও তদনুসারীদের সভা আয়োজিত হয় ২৪ বৈশাখ। সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়, "পাকিস্তানিদের ইসলামভিত্তিক জাতীয়তা ও রাষ্ট্রে অখণ্ড ভারতীয় রামরাজ্যের স্বপ্নদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথকে পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় কবি হিসাবে চালু করবার জন্য একশ্রেণীর তথাকথিত সংস্কৃতিসেবী প্রদেশব্যাপী যে সাংস্কৃতিক অপচেষ্টা চালাইয়া যাইতেছে, এই সভা তাহাদের নিন্দা করিতেছে।'

    গোটা বৈশাখ মাস জুড়েই দৈনিক আজাদ পত্রিকা রবীন্দ্রনাথকে মুসলিম-বিদ্বেষী, হিন্দু ভাবধারার বাহক এবং পাকিস্তানের সংস্কৃতিক্ষেত্র অগ্রহণীয় বলে প্রচার করতে থাকে। স্বয়ং দৈনিক আজাদের সম্পাদক মোলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ স্বনামের রবীন্দ্রবিরোধী লেখা প্রকাশ করলেন।

    সে সময় পাকিস্তান সরকারের গোয়েন্দা বিভাগ প্রচার করছে, রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষ পালনের জন্য ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশন দুহাতে পয়সা ছড়াচ্ছে।

    ১৯৬১ সালের ৭ মে সন্ধ্যায় ঢাকা জেলা পরিষদ হলে ফজলুল হক সেলবর্সীর সভাপতিত্বে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয় সরকারী উদ্যোগে। আলোচকদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন জামাতে ইসলামীর গোলাম আজম, মঈনুদ্দিন, দেওয়ান আব্দুল হামিদ, মওলানা মহীউদ্দিন, হাফেজ হাবিবুর রহমান, আব্দুল মান্নান তালিব প্রমুখ। সেখানে রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে প্রচুর বিষোদ?গার হয়েছিল। সভায় বলা হয়েছিল, রবীন্দ্র-সাহিত্য হিন্দু ও ভারতীয় সাহিত্যের সঙ্গে অভিন্ন বলে রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে কোনো আয়োজনের রাজনৈতিক তাৎপর্য হল-পাকিস্তানরে জাতীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকে বানচাল করে অখণ্ড ভারতীয় রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করা। এই সভাতেই সর্বপ্রথম রবীন্দ্রনাথের নাম না করে পূর্ব পাকিস্তানের সকল বিশ্ববিদ্যালয়, একাডেমি ও বেতারকেন্দ্রকে "বিজাতীয় সঙ্গীত-সাহিত্যের অভিশাপমুক্ত' করার আহ্বান জানানো হয়।

    মজার কাণ্ড হল, সে সময় সৈয়দ আলী আহসান রবীন্দ্রজন্মশতবর্ষ অনুষ্ঠানের বিরোধিতা করলেও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে তিনি ব্যক্তিগতভাবে একটি কবিতা লিখে ফেলেন। তার ওস্তাদ প্রফেসর সাজ্জাদ হোসাইনও রবীন্দ্র-সাহিত্যের প্রশংসা করে একটি প্রবন্ধ লেখেন। সৈয়দ আলী আহসান এটা করেছিলেন ভবিষ্যতের ডিগবাজি দেওয়ার সুযোগ করে রাখার জন্য। তিনি চিরকালই খানেওয়ালা। তিনি জানতেন পাকিস্তানী এই চক্রান্ত পরাজিত হবে। আর সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন যা পাওয়ার সব পাকিস্তানে থাকতেই পেয়ে গিয়েছিলেন। নতুন করে তার পাওয়ার কিছু ছিল না। তাই তিনি পাকিস্তানী কলাবোরেটর হিসাবে দালাল আইনে আটক হয়ে জেলখানায় থেকে একটি আত্মজীবনীতে উল্লেখ করেছিলেন, রবীন্দ্র-জন্মশতবর্ষের সময় তাকে ব্যবহার করা হয়েছিল। (১৯৬৭ সালে বেনজির আহমদ, আশরাফ সিদ্দিকী ও সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইন রবীন্দ্রবিরোধিতায় সবচেয়ে বড় ভূমিকাটি রাখেন। )

    এরপর আগামী পর্বে....
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • অপর বাংলা | ২৩ মে ২০১১ | ৫৮৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন