এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বাংলা কমিক্স ও আমাদের ছোটবেলা

    Koushik Ghosh লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০১ মার্চ ২০১৮ | ১৪৯৪ বার পঠিত
  • সবে স্লেট-পেন্সিল থেকে খাতা-পেন্সিলে উত্তরণ হচ্ছে। আঁকাবাঁকা অক্ষরে নিজের নাম লিখি। স্যার রোলকল করলে ‘ইয়েস স্যার’ বা ‘প্রেজেন্ট প্লিজ’ বলি। আমাদের বাংলা মিডিয়ামে ওইটুকু ইংরিজি-ই বলতাম। সঙ্গে চলছে যোগ-বিয়োগ আর অভিশপ্ত নামতা। একের নামতা আর দশের নামতা সবচে সুন্দর লাগতো। সকলের-ই লাগে। পাঁচেরটাও মন্দ ছিলো না। কিন্তু ঝামেলা পাকাতো বাকি সংখ্যাগুলো, বিশেষ করে পাঁচ এর পরেরগুলো। এরকম ঘোর দুর্দিনে হাতে এসে পড়লো শুকতারা পত্রিকা। কমিক্সে রঙিন বাঁটুল দি গ্রেট, আর শাদা কালোর হাঁদা-ভোঁদা। এলো বেশ স্বস্তি নিয়ে। দু-পাতায় একটা গোটা গল্প ধরা পড়তো। এক মাসের ইন্টারভ্যালে একটা সিরিয়াল যেন। তখন তো টেলি-সিরিয়াল চালু হয়নি, কার্টুন নেটওয়ার্ক বলে আমাদের সময়ে কিছু ছিলোও না। নারায়ণ দেবনাথ বলে এক ভদ্রলোক আমার মাথা-টা খেলেন। অসম্ভব গতিময় রেখাচিত্র আঁকতেন তিনি। সঙ্গে মানানসই চোখা চোখা সংলাপ। সব ছোটদেরই নিজস্ব জগত থাকে, থাকে নিজেদের খেলা। সেই জগতে বড়দের প্রবেশাধিকার নেই। আমাদের সেই একান্ত জগতে জাঁকিয়ে বসল গুটিকয়েক বিশ্বাসযোগ্য চরিত্র। বেচারা হাঁদা বেশি বুদ্ধিমান হয়েও ভোঁদার কাছে প্রায় হেরে যেত। ওর জন্য কষ্ট-ই হতো। বাঁটুল একজন অতিমানব হলেও তার একজন পিসিমা ছিলো, ফলে অবিশ্বাস্য সব ঘটনা ঘটালেও কাছের একজন বলে মনে হতো। বাঁটুলের পিসিমা, আর হাঁদা-ভোঁদার পিসেমশায়। সংলাপ, পোশাক-আশাক সবকিছু বেশ বাঙালি বাঙালি । ফলে আইডেন্টিফাই করতে কোন সমস্যাই হতো না। বড়রা আমাদের ছোট ভাবলেও আমরা নিজেদের ছোট ভাবতাম না। আর, বড়দের সঙ্গে ছোটদের জগতের যে ফারাক-টা থাকে, সেখানে একটা সূক্ষ্ম যোগসূত্র হিসেবে দেখা দিলো এই কমিক্সগুলো। আমরা বড় হতে লাগলাম, রসিকতা করতে শিখলাম এই ছবির চরিত্রগুলোর কাছ থেকে। পাটিগণিত জোর কদমে চলছে, পাশাপাশি পড়া চলছে বোর্ডিং স্কুলের কমিক্স- নন্টে ফন্টে, কেল্টু আর টেকো সুপারিন্টেন্ডেন্ট। এইসব চরিত্রগুলোর সঙ্গে থাকলে মন খারাপের অবকাশ থাকতো না। সিনেমার হোর্ডিং-য়ের বিজ্ঞাপন- ‘চলিতেছে বড়ে মস্তান’, অথচ হাঁদা ভোঁদার হাতে পয়সা নেই, হাঁদা পয়সা জোগাড়ের জন্য অভিনব উপায় বের করলো, পেছনে কাপ-ডিশ সাজিয়ে দর্শকদের জন্য- বল দিয়ে কাপ ভাঙুন, কাপ পিছু দশ পয়সা, ওদিকে ভোঁদা সেভ করতে লাগলো কাপ-ডিশ, কারণ পিশেমশায় জানলে রক্ষে থাকবে না।  অতিমানব বাঁটুলের কাজের লোক সকালের খাবার দিয়ে গেলো-আশিটা ডিমের পোচ, আর এক জাগ কফি।

    মনে আছে যখন ক্লাশ ফাইভে সেই সময়ে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মতো সহসা এলো এক মাসিহা- বেতাল বা চলমান অশরীরী। সিরিয়ালের জায়গা নিলো একটা আস্ত কমিক্স বই। ততদিনে আমরা ক্লাশ চলাকালীন ব্যাগের আড়ালে লুকিয়ে গল্পের বই রেখে স্যারেদের বোকা বানিয়ে পড়তে শিখে গেছি। ইন্দ্রজাল কমিক্সের সিরিজে বেতাল আর তার ভাইপো রেক্স, সঙ্গে কুকুর টম, বেতালের মুখে আজিব শালিক-মার্কা বেগনী মুখোশ। বেতালের বৌ ডায়না পামার বেশ অভিজাত সুন্দরী, ডায়নার দৌলতেই প্রথম রাষ্ট্রপুঞ্জ শব্দটা শুনি। দুষ্টের দমনের পাশাপাশি বেতালের আর একটা বৈশিষ্ট্য ছিলো, সে মেয়েদের ব্যাপারটা বোঝে না, অথচ মেয়েরা ঝপাঝপ বেতালের প্রেমে পড়ে। আর, নীল লম্বা জ্যাকেটে ‘আন্ধেরি রাতোঁমে’ রেক্সের ওয়াকারকাকা টহল দেয় শহর। বেতাল বিদ্যুতের চেয়ে দ্রুত বেগে ঘুষি চালায় অপরাধীদের মুখে, প্রাচীন অরণ্যের প্রবাদ মেনে।খুলির দাগ রয়ে যায় আসামীদের মুখে, আজীবন। পিগমীরা বেতালের শুভবার্তা পাঠায় ঢাকের বোলে।

    একটু বড় হয়ে যখন পাটিগণিত ছেড়ে জ্যামিতি আর বীজগণিতের শুরুয়াত, তখন আমরা মজে যাচ্ছি আনন্দমেলার ধারাবাহিকে-যে চরিত্রের নাম টিনটিন। সঙ্গে ধবধবে সাদা কুকুর কুট্টুস, আর বদরাগী অথচ সরল ক্যাপ্টেন হ্যাডক। কানে খাটো প্রফেসর ক্যাল্কুলাস,  মজাদার জন্সন ব্রাদার্স। পৃথিবীর এ-মাথা থেকে ও-মাথা ঘুরে বেড়ায় সাহসী টিনটিন, যেখানেই সে যায় সেখানেই রহস্য আর উত্তেজনা। হ্যাডকের মদপ্রীতি, আর কুট্টুসের বিরল দার্শনিকতা যারপরনাই মুগ্ধ করতো। কোথায় পাড়ি দেয়নি টিনটিন? ইউরোপ, ল্যাটিন আমেরিকা, আরব হয়ে দিল্লি ছুঁয়ে তিব্বতে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে সে বন্ধুকে বাঁচাতে যায়। এমনকি পৃথিবী ছেড়ে চাঁদেও পরিক্রমা অব্যাহত রাখে হার্জের টিনটিন। 
    ইন্দ্রজাল কমিক্সে বেতালের পাশাপাশি এক জাদুগর মুগ্ধ করে রাখতো আমাদের। নাম তার ম্যানড্রেক। ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্টে ম্যানড্রেকের জুড়ি মেলা ভার। তার জাদু ছিলো সমস্ত অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে। ছায়াপথ থেকে অনেক দূরের গ্রহ থেকে নেমে আসতো সম্রাট ম্যাগনান, বার্তা নিয়ে। লাস্ট সিনে যখন রুদ্ধশ্বাস কেয়ামত ঘনিয়ে আসতো, বাজিমাত করতো ম্যানড্রেক, প্রতিপক্ষকে বোকা বানিয়ে দিতো প্রিয় জাদুগর।

    কত যে চরিত্র ছিলো, কত গল্প! ইন্দ্রজালে ছিলো ব্রিটিশ গোয়েন্দা রিপ কার্বি, আর মার্কিন বাজ সায়ার। একজন ভারতীয় চরিত্র-ও ছিলো, যার নাম বাহাদুর। বাহাদুর আর তার সঙ্গিনী বেলা। এসবে ভরপুর ছিলো আমাদের ছোটবেলা। হ্যাঁ, আমাদের রূপকথা ছিলো এরাই; এদের সংগে থাকতে থাকতে কবে যেন বড় হয়ে গেলাম। ছেড়ে গেলো রংচটা ক্যাম্বিস বল, বৃষ্টিতে ভেজার দিন, নিরুদ্দেশে চলে গেলো বেতাল, টিনটিন, ম্যানড্রেক।।একে একে সবাই।
    কিন্তু, ছায়াপথে রঙিন আর সাদাকালো মুখগুলো আজো ভাসে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০১ মার্চ ২০১৮ | ১৪৯৪ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ঝর্না | 24.97.78.26 (*) | ০২ মার্চ ২০১৮ ০৪:০১64100
  • দারুন লেখা...
  • Koushik Ghosh | 125.187.51.104 (*) | ০৩ মার্চ ২০১৮ ০৫:০২64101
  • ধন্যবাদ।
  • aranya | 83.160.123.238 (*) | ০৪ মার্চ ২০১৮ ০৯:৪১64102
  • কৌশিক যেন আমার ছোটবেলা-টাই তুলে আনলেন
  • Koushik Ghosh | 55.64.220.205 (*) | ১৭ মার্চ ২০১৮ ০৫:৫০64103
  • ধন্যবাদ, অরণ্য।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন