এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • নিজেকে চেনার শুরু

    Muradul islam লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৩ মার্চ ২০১৮ | ১৪৯৯ বার পঠিত
  • রাতের শুরুর দিকে আমি গিয়েছিলাম থিয়েটারে, দারুণ সব নৃত্যগীত হবে, হবে সার্কাস ম্যাজিক। নাম জানা অনেক দেশ বিদেশ থেকে এসেছেন শিল্পী ও কলাকুশলীরা। তাদের নাম যশ খ্যাতি দিগন্ত বিস্তৃত। পোস্টারে পোস্টারে ছেয়ে গিয়েছিল আমাদের শহরের রাস্তাঘাট, দোকানপাট। এই কয়দিন এই অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে ছিল মহা উৎসবের আমেজ।

    রাত বাড়ার সাথে সাথে মানুষের ঢল নামল থিয়েটারে। যেন শহর উজার করে চলে এসেছে সবাই।
    সিটে বসে আছি আমি, একেবারে পিছনের দিকে। দর্শকদের বিমোহিত করছিল নৃত্যগীত, অভিনয়। আমার হাই উঠল, ঘুম পেল। মনে হলো সব ভারী আর্ট হচ্ছে। আমার মত আরো অনেকের, আমার মনে হয় বেশীরভাগেরই এমন লাগছিল, কিন্তু তারা নিজেদের বোদ্ধা প্রমাণের জন্যই চোখে মুখে মেকী বিস্ময় ফুটিয়ে মঞ্চে তাকিয়ে ছিল।

    আচমকা নৃত্যগীত শেষ হলো। এবার মঞ্চে জোকারের আসার কথা। কিছুক্ষণের মধ্যে সে এলোও। বেশ হন্তদন্ত হয়ে। উদ্ভট সাজপোষাক তার, উদ্ভট কথার ধরণ। মাথা নাচিয়ে বলতে লাগল কথাগুলো এক নিঃশ্বাসে, দর্শকেরা হাসিতে ফেটে পড়ল। হাসির শব্দে আমি বুঝতে পারছিলাম না জোকারটা কী বলছে। আমি কান খাড়া করলাম, মনযোগ নিবদ্ধ করলাম তার দিকে, চোখ স্থির তার মুখে।

    জোকার বলছিল, ব্যাকস্টেজে আগুন লেগেছে। আগুন ছড়িয়ে পড়ছে থিয়েটারের চারিদিকে। আমার যাদুর বাক্সে ভরে এনেছিলাম কিছু আগুন, খেলা দেখাব বলে। কিন্তু তা লাফিয়ে বেরিয়ে গেল। পোষ না মানা বেয়াড়া আগুন। অল্পক্ষণের মধ্যেই সে আগুন সমস্ত থিয়েটার ঘিরে ফেলবে। আপনারা তখন বের হতে পারবেন না। তাই বলছি, দোহাই লাগে আপনারা পালান। পালান!

    সে মঞ্চের একদিক থেকে অন্যদিকে গিয়ে, সর্বশক্তি দিয়ে বলছিল কথাগুলো। তার রঙকরা মুখে ফুটে উঠছিল অদ্ভুত মুখভঙ্গী।

    দর্শকেরা দারুণ মজা পেল। তারা হাসল আর হাসল। হাসির শব্দ যেন থিয়েটারের ছাঁদ ভেদ করে পৌছে যাচ্ছিল আল্লার আরশে। দমকা হাসির এমন ফোয়ারা স্রোত, না জানি কে দেখেছে কোন কালে। এইসব হাস্য উদ্ভূত শব্দকে একদিকে তাক করে ছুঁড়ে দিলে তার শক্তিতে ভেঙ্গে যাবে বাবেল টাওয়ারের মাথা, এমনই শক্তিধর সে হাসি, আমার মনে হচ্ছিল।

    এবং বিরক্ত লাগছিল। কারণ আমি হাসার কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলাম না জোকারটির আচরণে।

    সহ্য হলো না। থিয়েটার থেকে দ্রুত বেরিয়ে পড়লাম। হাসির শব্দ থেকে বাঁচতে কয়েক মিনিট একটানা হেঁটে গেলাম। রাস্তাঘাটে গাড়িঘোড়া নেই। শহরের সব মানুষই সম্ভবত আজ থিয়েটারে জমায়েত। উল্লেখ্য, আমাদের থিয়েটার অতিবিশাল, এবং নির্মান শৈলীর গুণে প্রচুর প্রচুর মানুষ ধরে রাখতে পারে গহীন অন্তরে তার।

    আমি পিছনে না তাকিয়ে হেঁটে গেলাম দ্রুত, এবং এরপর একসময় পিছনে তাকিয়ে দেখলাম থিয়েটারের পেছন দিক থেকে কালো কালো ধোঁয়া উড়ছে। হাসির শব্দ আসছিল, আমি আর থামলাম না। নিজের বাসার উদ্দেশ্যে হাঁটতে লাগলাম।

    রাস্তা জনমানবহীন, পেছনের হাসির শব্দ কমছে। কালো ধোঁয়ার কুন্ডলী যেহেতু দেখেছি তাই আমি জানতাম হাসি অচিরেই থেমে যাবে, চিরতরে।

    আমি এগিয়ে যাচ্ছিলাম, সহসা দেখতে পেলাম একটি লোককে, ল্যাম্পপোস্টের বাতির নিচে রাস্তায়, উবু হয়ে বসে আছে। সে যেন কিছু একটা খুঁজছে। হালকা রোগামতন দেহ গড়ন তার, লম্বা লোক। খয়েরী কোটের মত পোষাক পরে আছে, মাথায় ধূষর হ্যাট।

    আমি এগিয়ে গেলাম। লোকটি আমার দিকে ফিরেও তাকাল না।

    তার প্রতি কেন যেন সমীহ জন্মাল।

    আমি বললাম, আপনি কিছু খুঁজছেন, স্যার?

    রাস্তা থেকে একখানা কাচের আয়না হাতে তুলে নিল লোকটি। তারপর খসখসে গলায় বলল, এটা খুঁজছিলাম।

    আমি বললাম, এ তো আয়নার টুকরা, এ দিয়ে কী করবেন আপনি?

    লোকটি সামান্য হাসল। বলল, কিছু করব না।

    থিয়েটার থেকে একরকম হইচই এর শব্দ ভেসে আসতে লাগল তখন। আমি মাথা ঘুরিয়ে সেদিকে তাকালাম।

    লোকটি বলল, ওরা কি জোকারের কথায় বের হয়ে আসে নি?

    আমি লোকটার দিকে ফিরে বললাম, না। আমি বিরক্ত হয়ে বেরিয়ে এসেছি।

    লোকটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, বার বার পৃথিবীতে এমনই হয়। এটাই দেখে আসছি আমি।

    আমি জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কি আজ থিয়েটারে ছিলেন?

    লোকটি বলল, না। আমি এখানেই ছিলাম, আয়না খুঁজতে।

    লোকটিকে খুব বিষন্ন মনে হলো।

    সে আমাকে বলল, তুমি তো খুব একা হয়ে গেলে এখন।

    আমি কিছু বললাম না। কী উত্তর দেব বুঝতে পারলাম না।

    লোকটা আমার দিকে ভাঙা আয়নার টুকরা বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা নাও। একা হয়ে যাওয়া খারাপ কিছু নয়। এই আয়নার দিকে তাকিয়ে থেকো। ভালো করে তাকিয়ে থাকলে জগৎ বদলে যাবে।

    আমি আয়না হাতে নিলাম। লোকটি হনহন করে হেঁটে অন্ধকারের সাথে একেবারে মিশে গেল, নিমিষে।
    আমি বাড়ি ফিরে এলাম। আমার খারাপ লাগছিল। কারণ থিয়েটারে এতগুলো মানুষ, এতগুলো হাসি, এতগুলো আর্তচিৎকার। আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল, এবং মনে হচ্ছিল যে থিয়েটারের সব কালো ধোঁয়া এসে আমাকে ঘিরে ধরছে।

    পকেটে সেই ভাঙা আয়নার টুকরাটা ছিল। আমি তা হাতে নিয়ে এর দিকে তাকালাম। লোকটি বলেছিল এর দিকে ভালো করে তাকিয়ে থাকলে জগৎ বদলে যাবে। আমি আয়নার দিকে তাকালাম। ঝাপসা ঝাপসা কিছু একটা দেখা যেতে লাগল।

    অন্ধকার রাত্রি। শহরে উড়ছে মানুষ পোড়া ধোঁয়া। হাসি পোড়া, কান্না পোড়া ধোঁয়ার কুন্ডলী উঠছে দ্রুতবেগে আকাশের পানে। আর আমি স্থির ভাবে, স্তব্দ হয়ে তাকিয়ে আছি ভাঙা আয়নার দিকে। লোকটির কথা আমার বিশ্বাস হয়েছে। আমার মনে হয়েছে সে অনেক কিছুই জানে, সে সত্যদ্রষ্টা। সে ঈশ্বরের প্রীতিভাজন, ও পরমেশ্বরকে নিকট থেকে বুঝতে পেরেছে এমন কেউ। সে জাগতিক জীবনের খেলার ভিতরের খেলার রহস্য সম্পর্কেও জানে। তার চোখে সে দীপ্তি ছিল, তার কথায়, তার হাঁটায় সে আলোর চ্ছটা ছিল।

    আমি মগ্ন হয়ে তাই বসে আছি, আয়নার দিকে তাকিয়ে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৩ মার্চ ২০১৮ | ১৪৯৯ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    হেলেন - Muradul islam
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • দেবারতি | 127.227.16.57 (*) | ২৪ মার্চ ২০১৮ ১০:২৩63955
  • ভালো করে দেখলে জগৎ বদলে যাবে৷
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা খুশি প্রতিক্রিয়া দিন