এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • হেলেন

    Muradul islam লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ২৭ আগস্ট ২০১৯ | ২৭২০ বার পঠিত
  • হেলেন

    এমন হয়, প্রায়শই হয়। কথাবার্তায় উঠে আসে কোনও কোনও নাম। আমাদের লেখকের ক্ষেত্রেও তাই হলো। লেখক ও তার বন্ধু হাসানুজ্জামান ইনু সেইদিন রাত আটটা ন’টার দিকে জিন্দাবাজারে হাঁটছিলেন। তারা বাদাম খাচ্ছিলেন এবং বলছিলেন যে রিকাবিবাজার যাবেন, ও সেখানে গুড়ের চা খাবেন।

    তখন শীতের সময়। চারিদিকে পড়েছে শীত। মানুষজন গরম কাপড় পরে বের হয়েছেন। অনেকে ব্যস্তভাবে হাঁটছেন, অনেকে দাঁড়িয়ে ভাপা পিঠা খাচ্ছেন। ব্যস্ত রাতের পূণ্যভূমি।

    এমন অবস্থায় আমাদের লেখক ও তার বন্ধু হাঁটতে হাঁটতে বললেন হেলেনের কথা। ইনু বললেন, তার পরিচিত একজন মহিলার নাম হেলেন। মহিলার স্বামীর নাম মাহবুবুর রহমান।

    লেখকের মনে হলো যে তিনিও একজন মহিলাকে চেনেন, যার নাম হেলেন, কিন্তু তার স্বামীর নাম মাহবুবুর রহমান কি না তিনি তা জানেন না।

    এটাই গল্পের মূল সমস্যা। হেলেন ও মাহবুবুর রহমান।

    লেখকের বন্ধু ইনু বললেন, “এটা তো খুব অদ্ভুত! অদ্ভুত নয় কী?”

    লেখক জিজ্ঞেস করলেন, “কোনটা অদ্ভুত?”

    লেখকের বন্ধু বললেন, “এই যে, মহিলার নাম হেলেন!”
    লেখক তখন ভাবলেন যে হয়ত তা অদ্ভুতই। কারণ এই নাম শোনা যায় না। বিখ্যাত ট্রয়ের হেলেনের কথা শোনা যায়। ট্রয়ের যুদ্ধ হেলেনের জন্যই হয়েছে বলে অনেকে বলে থাকেন। কিন্তু বাংলাদেশে সেই হেলেনের সূত্রে কি নাম রাখবে লোকে?

    ঘটনা ধীরে ধীরে গুরুতর হতে শুরু করলো যখন আমাদের লেখক খোঁজ নিয়ে দেখতে চাইলেন তার জানা সেই হেলেনের স্বামীর নাম মাহবুবুর রহমান কি না। তিনি রিকাবিবাজার পয়েন্টে, স্টেডিয়ামের পাশে বসে গুড়ের চা খেতে খেতে বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিলেন। সবার কাছেই তিনি হেলেনের ব্যাপারে খোঁজ নিলেন ও তার স্বামীর নাম জানতে চাইলেন।

    অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি জানতে পারলেন, হ্যা, তার জানা সেই হেলেনের স্বামীর নামও মাহবুবুর রহমান।

    তখন লেখকের বন্ধু হাসানুজ্জামান ইনু বললেন যে, হতে পারে এই হেলেনই আমার পরিচিত হেলেন। হতে পারে তারা দুইজন নন। হতে পারে আমরা একজনকেই দুই দিক দিয়ে চিনি। এবং তার স্বামীর নাম দুই দিক দিয়েই মাহবুবুর রহমান।

    এই এক নতুন সমস্যায় লেখক, আবার খোঁজখবর নেয়া শুরু করলেন। তার বন্ধুও খোঁজ নিতে শুরু করলেন। এই খোঁজাখোঁজির এক পর্যায়ে তারা দুইজনই হেলেনের ফেইসবুক আইডির খোঁজ পেলেন। কিন্তু দেখা গেল আইডি দুইটা, অর্থাৎ হেলেন দুইজন।

    এবং অদ্ভুত বিষয়, দুই হেলেনের স্বামীর নামই মাহবুবুর রহমান।

    এটা কেমন করে হয়?

    লেখক এবং তার বন্ধু চা শেষ করলেন। তারা ওয়ান টাইম প্লাস্টিক গ্লাসটি ফেলে দিয়ে পরস্পরের দিকে তাকালেন। তারা দুজনই বুঝতে পারলেন যে নতুন একটি সমস্যার উদয় হয়েছে। হেলেনদের স্বামীর নাম কেন মাহবুবুর রহমান হয়?

    অথবা আসলে কি সব হেলেনেরই স্বামীর নাম মাহবুবুর রহমান?

    লেখক ও তার বন্ধু এবার আরো খোঁজাখোঁজি শুরু করলেন। তারা সমস্ত শহরের এবং সমস্ত দেশের হেলেনদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া শুরু করলেন। তারা জানতে চাইলেন যে হেলেনদের স্বামীর নাম কি মাহবুবুর রহমান? আসলেই?

    এই খোঁজা বৃথা গেল না।

    কয়েকদিন সময় লাগল একটা মোটামোটি ধারণা পেতে। একেবারে ঠিকঠাক ধারণা পাওয়া অসম্ভব। কারণ শহর ও দেশ অনেক বড় বিষয়। আর হেলেনেরা প্রকাশ্য নয়। কতো কতো হেলেন যে কতো ভাবে লুকিয়ে থাকে শহর ও দেশের নানা স্থানে, তাই সব জানা সম্ভব হয় না।

    কিন্তু যা মোটামোটি জানা গেল তাতেই বিস্ময়।
    দেখা গেল, জানা সব হেলেনের স্বামীর নামই মাহবুবুর রহমান হয়।

    লেখক এবং তার বন্ধু অবাক হলেন। লেখক তার বন্ধু হাসানুজ্জামান ইনুকে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কেমন করে হইতেছে?

    লেখকের বন্ধু স্পষ্ট করে কিছু বলতে পারলেন না। তিনি কেবল বললেন, জানেন, কেবল গড অলমাইটি।

    এই হেলেন ও তার স্বামী মাহবুবুর রহমান জনিত সমস্যা আমাদের লেখককে প্রায় উদভ্রান্ত করে তুললো। তিনি তার খোঁজ থামালেন না। তিনি খোঁজতে থাকলেন এবং খোঁজতেই থাকলেন। তার মনে হলো যে কোথাও কোন সমস্যা আছে। এমন হবার কথা নয়। এমন হয় না কোথাও, কোনকালে। কোনকালেই সব হেলেনদের স্বামী মাহবুবুর রহমান হতে পারে না।

    লেখকের দিন যায় নিত্য নতুন হেলেনদের খুঁজে এবং তাদের স্বামীর নাম জানতে জানতে।

    যেখানেই তিনি খোঁজ পেতেন যে একজন হেলেন আছেন, তিনি সেখানে গিয়ে উপস্থিত হতেন। জানার চেষ্টা করতেন তার স্বামীর নাম কী। প্রতিবারই দেখা যেত নাম কোনও না কোনভাবে মাহবুবুর রহমান।

    হতাশ ও বিষন্ন হয়ে পড়লেন আমাদের লেখক।

    একপর্যায়ে তিনি জগৎ সংসারের উপর সব আশা ছেড়ে দিলেন, ও লেখালেখি ছেড়ে দিলেন।

    তিনি লেখালেখি ছেড়ে দিয়ে কাঠের ব্যবসা শুরু করেন। সেই ব্যবসার নাম থিসিয়াস উড। তার ব্যবসা খুব ভালো চলে নি। নানাবিদ ব্যবসায়িক সমস্যায় পড়ে আস্তে আস্তে একসময় সাময়িক ভাবে তিনি ভুলে যান হেলেন ও মাহবুবুর রহমানকে।

    তার বিয়ে হয়। বউ সুন্দরী, নানা গুণে গুণান্বিত মহিলা। তিনি তার সাপেক্ষে অনেক ভালো বউ পেয়েছিলেন, এটা বলে ফেলা যায়।

    কিন্তু হঠাৎ একদিন, এক শীতের রাতে আমাদের লেখক জানতে পারেন তার স্ত্রীর নাম হেলেন।

    বাচ্চাকালে প্রথম এই নামই রাখা হয়েছিল। পরে স্কুলে ভর্তির সময় বাদ দেয়া হলেও এই নামেও তাকে চিনে থাকেন নিজ বাড়ির লোকজন।

    এটা জানার পরে লেখকের মাথা ঘুরে যায়। হেলেন ও মাহবুবুর রহমান জনিত সমস্যাটি তার মাথায় চলে আসে। তার মনে হতে থাকে তিনি দেখেছেন সব হেলেনের স্বামীর নাম অবশ্যই, অবশ্যই মাহবুবুর রহমান।

    ভাবতে ভাবতে আমাদের লেখক পড়ে যান।
    তার মাথায় পানি ঢেলে জ্ঞান ফেরানো হয়। তিনি উঠে দাঁড়ান এবং দৌড়ে চলে যান আয়নার সামনে।

    আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে তিনি নিজেকে দেখতে থাকেন, নিরীক্ষণ করতে থাকেন।

    তিনি নিজেকে দেখেন আর ভাবেন, তিনি কি মাহবুবুর রহমান? নাকি তার স্ত্রী আসল হেলেন নন, নকল হেলেন?

    আমাদের লেখকের নিজেকে নিয়ে সংশয় জাগে কারণ তিনি অনেক অনেক হেলেন দেখেছেন, এবং তাদের সবার স্বামীই মাহবুবুর রহমান। অতএব, তিনি হয়ত মাহবুবুর রহমান অথবা তিনি তার স্ত্রী’র স্বামী নন। এর ব্যতিক্রম হতে পারে না বলে তার মনে হলো, কারণ এতদিন খুঁজেও তিনি এর ব্যতয় দেখেন নি।

    লেখকের মা বেঁচে ছিলেন। তিনি সুস্থ অবস্থায় বাস করে আসছিলেন লেখকের বোনের সাথে, তবে তার অনেক বয়স হয়েছিল, গলা বসে গেছে, সম্ভবত অতিরিক্ত সুপারি খাবার কারণে।

    লেখক তাকে ফোন দিয়ে বললেন, আম্মা, আমার নাম কি মাহবুবুর রহমান?

    বসা গলা নিয়ে অবাক হয়ে লেখকের মা জবাব দেন, এইটা কি কও বাপ? তোমার নাম মাহবুবুর রহমান হইব কেন? তর নাম তো মোঃ হামিদুর রহমান।

    লেখক বলেন, কিন্তু আম্মা, জন্মের পরে আমার নাম কি মাহবুবুর রহমান রাখছিলেন কেউ? বা কেউ কি আমারে মাহবুবুর রহমান নাম দিছিলেন?

    লেখকের মা উত্তর দেন, তুই এইসব কি কস ? তরে মাহবুবুর রহমান নাম দিব কেন? তর কি শরীর খারাপ, বাপ?

    লেখক আর কোন কথা বলেন না। ফোন রেখে দেন।

    তার অস্বস্থি বাড়ে, কেবই বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে তিনি তার বন্ধু হাসানুজ্জামান ইনুর সাথে যোগাযোগ করেন। অনেক বছর এই বন্ধুর সাথে যোগাযোগ নাই। ফোন দিয়েই তিনি তাকে বলেন, বন্ধু, হেলেনের কথা কি তর মনে আছে?

    বন্ধু বলেন, কোন হেলেন?

    ঐ যে, যার স্বামীর নাম মাহবুবুর রহমান।

    হ্যা, আমরা তো দেখছিলাম হেলেনদের স্বামীর নাম মাহবুবুর রহমান হয়। কিন্তু এটা তো অনেক আগের কথা। এটা নিয়ে সমস্যা কি আবার?

    আরে না, হইছে কি, তোর ভাবী, মানে আবার বউয়ের নামও হেলেন।

    তাতে কী?

    কিন্তু আমার নাম তো মাহবুবুর রহমান নয়।

    সত্যি কি নয়?

    হ্যা, সত্যি।

    তাহলে তো ভালোই হলো। আমরা পাইয়া গেলাম একজন হেলেন যার স্বামীর নাম মাহবুবুর রহমান নয়। অতএব, সব হেলেনদের স্বামীর নাম মাহবুবুর রহমান নয়।

    কিন্তু এটা কি হয়?

    কেন হয় না?

    মানে, আমরা যে এতো এতো হেলেনদের দেখলাম। এখন তো আমার সন্দেহ হইতেছে হয় আমার নাম মাহবুবুর রহমান অথবা আমি কোন হেলেনের স্বামী নই।

    এটা কেমন কথা বন্ধু? তর নাম মাহবুবুর রহমান হইতে যাবে কেন? তোর তো মাথা খারাপ হইয়া যাইতেছে মনে হয়। এসব চিন্তা বাদ দে। জগতে অনেক হেলেন আছে যাদের স্বামীর নাম মাহবুবুর রহমান নয়। আবার সব মাহবুবুর রহমানের স্ত্রীর নাম কি হেলেন হয়? আমার মনে হয়, হয় না। অর্থাৎ, আমাদের জানাশোনায় কোন সমস্যা ছিল।

    লেখক তবু সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি বন্ধুর সাথে কথা বলা বন্ধ করলেন।

    এরপর থেকে তার মাথায় নানা ধরণের সন্দেহ ভর করত। সেগুলিকে সাথে নিয়ে অনেক কষ্টে তিনি সংসার ও জীবন যাপন করে যাচ্ছিলেন। তার স্ত্রীর সাথে অনেক সব ঝামেলার সৃষ্টি হলো।

    লেখক প্রায়ই একা একা শহরের রাস্তায় হাঁটতেন। বিশেষত রাত্রি নিশাকালে। পেছন থেকে তাকে হাঁটতে দেখলে একটি বিষন্ন মূর্তির মতো লাগত। নিস্তব্দতার ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে
    তিনি একবার এসে পড়েছিলেন শাহজালাল (র) এর পবিত্র মাজারের পাশে। তখন রাত্রি দ্বিপ্রহর।

    এখানে একটি অদ্ভুত লোকের সাথে তার পরিচয় হয়।

    লোকটির চোখ ঘোলাটে, পরনে বেশ দামী পোষাক। বেশ রঙচঙা একটা রিকশায় বসেছিল সে। লেখকের পাশে এসে রিকশাটি থামে।

    লোকটি তার কালো চশমা খুলে হাসিমুখে বলে, উঠে পড়ুন স্যার। এটা আমার প্রাইভেট রিকশা। যেখানে যেতে চান পৌছে দিতে পারব।

    আমাদের লেখক রিকশায় উঠে পড়লেন। এতে ছিনতাই বা চুরির ভয় ছিল কারণ লোকটি অপরিচিত এবং সময়ও তখন অসময়। কিন্তু লেখকের কাছে তেমন মূল্যবান কিছু ছিল না, এবং তিনি তার সমস্যা নিয়ে চিন্তায় বিমর্ষ ছিলেন। তাই তিনি উঠে পড়েছিলেন।

    তিনি লোকটাকে বললেন, রাতে কালো চশমা পরেছেন কেন?

    লোকটি হাসিমুখে বলল, আরাম বোধ হয়। আপনার নাম কি? আমার নাম মাহবুবুর রহমান।

    লেখক নামটি শুনে প্রায় আৎকে উঠেছিলেন। রিকশা ততক্ষণে চলতে শুরু করেছে।

    লেখক লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার স্ত্রীর নাম কি?

    লোকটি হাসিমুখে বলল, হেলেন।

    লেখক তখন বুঝতে পারলেন একটা অপরিচিত লোককে এভাবে হুট করে স্ত্রীর নাম জিজ্ঞেস করা শোভন না। তিনি একজন ভদ্রলোক ছিলেন। তাই লোকটিকে বললেন, আমি দুঃখপ্রকাশ করছি। এভাবে আমার জিজ্ঞেস করা ঠিক হয় নি হয়ত। কিন্তু আসলে এই সমস্যাটি নিয়ে আছি আমি দীর্ঘদিন। তাই আপনার নাম শুনে জিজ্ঞেস করে ফেললাম। কিছু মনে করবেন না প্লিজ।

    লোকটি হেসে বলল, সমস্যা নেই স্যার। এমন সবাই-ই জিজ্ঞেস করে।

    লেখক অবাক কন্ঠে বললেন, সবাই জিজ্ঞেস করে মানে?

    লোকটি বলল, জিজ্ঞেস করে মানে জিজ্ঞেস করে আর কি। তাদের জানতে ইচ্ছা হয় নিশ্চয়ই। হয়ত তারাও আপনার মতো কোন একটা সমস্যা নিয়ে আছে।

    লেখক কী বলবেন বুঝে পেলেন না।

    লোকটি বলল, তবে স্যার, আমি আছি আরেক সমস্যায়। সমস্যাটা আমার বউকে নিয়েই। আমার জীবনটা যন্ত্রণাময় করে দিচ্ছে। আমি এর থেকে নিস্তার চাই।

    লেখক বললেন, আমিও একটি যন্ত্রণাময় পরিস্থিতিতে আছি। আমার সমস্যার সাথেও আমার স্ত্রী যুক্ত আছে।

    লোকটি হেসে বলল, তাহলে তো হয়েই গেল। আমরা দুজন একই পথের পথিক। দুই ভাই আমরা। স্ট্রেঞ্জারস অন এ রিকশা। আমরা চাইলে কিন্তু ভাই ভাই মিলে আমাদের সমস্যাটির সমাধান করতে পারি।

    লেখক জিজ্ঞেস করলেন, কীরকম?

    লোকটি বলল, এই যেমন ধরুন, আপনি আমার সমস্যার সমাধান করলেন, আর আমি আপনার সমস্যার সমাধান করলাম। মার্ডারের ক্ষেত্রে নিতান্ত অপরিচিত একজন মার্ডার করলে কেউ মোটিভ খুঁজে পাবে না, ধরতেও পারবে না। তাছাড়া পারফেক্ট মার্ডার নিয়ে আমার বিস্তর পড়াশোনা আছে।

    লেখক জিজ্ঞেস করলেন, মার্ডারের কথা আসছে কেন?

    লোকটি বলল, এতেই সব সমস্যার সমাধান স্যার। আমি আইডিয়াটি একটা ফিল্ম থেকে পেয়েছি। হিচককের ফিল্ম। আপনি কি হিচকক দেখেন?

    লেখক বললেন, না দেখি না। রিকশা থামান, আমি নামব।

    লোকটি বলল, আরে কী বলেন! এখানে কোথায় নামবেন? আপনাকে আপনার বাসার সামনেই নামিয়ে দেব। আচ্ছা, আপনার স্ত্রীর নামও তো হেলেন?

    লেখক আবার অবাক হলেন। তিনি বললেন, হ্যা, কিন্তু আপনি কী করে জানলেন?

    লোকটি হেসে বলল, একই ধরণের সমস্যা যাদের তারা পরস্পরের গভীরের খবর বুঝতে পারে স্যার।

    লেখক বললেন, যাই হোক, আমি আপনার সাথে কথা বলব না। আপনার আইডিয়া আমার পছন্দ হয় নি। আমি মার্ডার করতে পারব না। আমি রিকশা থেকে এখনই নামব।

    লোকটি হেসে বলল, ঠিক আছে স্যার। কোন সমস্যা নেই। আমি প্রস্তাব দিলাম। আপনি ভেবে দেখুন। ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিন। আপাতত আমরা ঐ কামারের দোকানটার সামনে নামি।

    একটা কামারের দোকান ছিল অনতিদূরে, বন্ধ অবস্থায়। রিকশা এর সামনে এসে থামলো।

    লেখক রিকশা থেকে নামলেন, লোকটিও নামলো। লোকটি নেমে দোকানের বন্ধ শাটারে থাবা দিয়ে ডাকতে শুরু করলো।

    কয়েক মিনিট পরে ভেতর থেকে ফ্যাসফ্যাসে গলায় আওয়াজ এলো, কী চাই?

    লোকটি বলল, আরে ভাই জিনিস দরকার। দরজা খুলেন। সন্ধ্যা বেলা ঘুম দিলে হবে?

    ভেতর থেকে আওয়াজ এলো, এখন সন্ধ্যা না মিয়া। রাইত তিনডা বাজে।

    লোকটি বলল, যাইহোক ভাই, দরজা খুলেন। নগদ পাবেন, বেশি বেশি।

    টাকার লোভে ভেতর থেকে একজন রুগ্ন লোক শাটার খুলল।

    লেখকের সাথের লোকটি বলল, আমারে জিনিস দেন, পিচ্চিটা।

    সে তার পকেটে হাত দিয়ে এক বান্ডিল টাকা বের করল। এরপর এই টাকা লেখকের হাতে দিয়ে বলল, স্যার, আপনি স্বাক্ষী হয়ে টাকাটা ওর হাতে তুলে দেন। এইসব ব্যবসায়ীরা বেইমান হয়, পরে মিথ্যা বলে। নিয়ে বলে নেই নাই।

    লেখক টাকা নিলেন ও দোকানের লোকটাকে দিলেন। লোকটা লেখকের হাতেই কাগজে মোড়ানো একটি বস্তু তুলে দিল। লেখকের আগ্রহ হলো এটা কী দেখার জন্য। তিনি কাগজ সরিয়ে দেখলেন ধারালো ছুরি।

    লেখক জিনিসটি তার পাশের লোকটিকে দিলেন। লোকটি হেসে তা হাতে নিল। এদিকে দোকানওয়ালা শাটার ফেলে দিয়েছে।

    লোকটি তখন লেখককে বলল, স্যার, দেখলেন কী বিষয়?

    লেখক বললেন, কী বিষয়?

    এই যে লোকটা এই রাতেও শাটার খুললো, কেবল টাকার জন্য।

    হ্যা, দেখলাম।

    এমনই হয় স্যার। টাকার জন্য সবই হয়। টাকাই দুনিয়া চালায়।

    হুম।

    টাকাতেই মানুষ পর হয় আবার আপন হয়। কতো স্ত্রী স্বামীকে পছন্দ করে না টাকা নেই বলে। স্বামীকে রেখে টাকাওয়ালার সাথে প্রেম করে। আচ্ছা, আপনি কী করেন?

    আমি লেখি।

    লেখালেখি করেন?

    হ্যা।

    এই দেশে লেখালেখি করে তো টাকা নেই।

    হ্যা, নেই।

    তাহলে তো সমস্যা।

    সমস্যাই। কিন্তু এ নিয়ে আমি ভাবিত নই।

    কেন? আপনার কি টাকা লাগে না?

    লাগে, কিন্তু আমি তার চাইতেও জটিল সমস্যায় পড়ে রয়েছি।

    সব সমস্যারই সমাধান আছে স্যার। খালি দেখার ভঙ্গি বদলাতে হয়।

    এইভাবে কথা বলতে বলতে লেখক ও লোকটি পাশাপাশি হাঁটছিলেন। রাত তখন গভীর। রাস্তায় জনমানব নেই। কেবল দেখা যাচ্ছিল একটি কুকুরকে, উদভ্রান্তের মতো এদিক ওদিক হাঁটছে।

    লেখকের বাসার সামনে আসার পর লোকটি থামল। লেখককে বলল, স্যার আমার গন্তব্যে এসে গেছি। আজই কাজ সেরে যাই।

    লেখক জিজ্ঞেস করলেন, কী কাজ?

    লোকটি বলল, আপনি তো সিদ্ধান্ত নেন নি তাই ভেবেচিন্তে জানাবেন। কিন্তু আমার সেই সমস্যা নেই। আমি আপনার হেলেনজনিত সমস্যা আজই দূর করে দেব। আপনি পরে সময় করে আমারটার ব্যবস্থা করবেন।

    এটা বলার পরে লোকটি আর কিছু শোনার অপেক্ষা করলো না। কী এক কৌশলে জানলা খুলে সেদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল ঘরের ভেতরে। লেখকও গেলেন তার পিছু পিছু।

    গিয়ে দেখলেন লোকটি অবলীলায় হেঁটে তার স্ত্রীর কক্ষে গেলো, যেটি তাদের বেডরুম।

    অবশ্য লেখক এখানে ঘুমাতেন না। তিনি ড্রয়িং রুমের ফ্লোরে ঘুমাতেন।

    লেখক দেখলেন লোকটি তার স্ত্রীকে ছুরি দিয়ে রক্তাক্ত করে ফেললো দ্রুতই। এই সময়ে লেখকের ইচ্ছা হয়েছিল লোকটির হাত থেকে তার স্ত্রীকে বাঁচাতে। তিনি লোকটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে ফেলেন। এবং দেখা যায় তার নিজের হাতই রক্তাক্ত হয়ে উঠেছে, এবং তার হাতেই ছুরি।

    লেখক লোকটিকে আর ঘরে দেখতে পেলেন না। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখলেন লোকটি হন হন করে হেঁটে অন্ধকারে মিলিয়ে যাচ্ছে, মিলিয়ে যাচ্ছে মাহবুবুর রহমান।

    আর এদিকে লেখকের সামনেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন হেলেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২৭ আগস্ট ২০১৯ | ২৭২০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    ইঁদুর  - Anirban M
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। খেলতে খেলতে প্রতিক্রিয়া দিন