এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত

    Muhammad Sadequzzaman Sharif লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০১ নভেম্বর ২০১৮ | ১৯১৯ বার পঠিত
  • ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান নামক অদ্ভুত দেশটার জন্ম হওয়ার পর সমস্ত পাকিস্তানের জনগণ যখন আবেগে ভেসে যাচ্ছিল নতুন একটা তরতাজা দেশ পেয়ে, বিশেষ করে এই দেশের পূর্ব অংশের বিপুল পরিমাণ মানুষের আনন্দের কোন সীমা ছিল না। কারন মূলত এই ভূখণ্ডের মানুষের আন্দোলনের চাওয়া পাওয়ার ফলে জন্ম নেয় পাকিস্তান নামক দেশটা। যদিও এর চেহারা ঠিক দেশের সংজ্ঞার সাথে যায় না, যদিও নিজেদের বড় একটা অংশকে ভিনদেশের সাথে রেখে আসতে হয়েছে তবুও এই জাতি খুশি ছিল। এই অংশের মানুষের কারনেই এই দেশটা জন্ম নিয়েছিল এই কথা বলা হচ্ছে কারন এই ভূখণ্ডের মানুষের সমান রাজনৈতিক সচেতন মানুষ পুরো ভারতবর্ষে ছিল কিনা সন্দেহ।

    পূর্ব পাকিস্তানিদের আনন্দের জোয়ারে ভাটা পড়তে খুব বেশি দেরি হল না। ১৪ আগস্ট পাকিস্তান জন্ম নেওয়ার পরে ওই বছরের ডিসেম্বরেই এরা দেখতে পেল পশ্চিম অংশ থেকে ডাক টিকেট, মানি অর্ডারের ফরম, সরকারি কাগজ পত্র সব আসতেছে উর্দু আর ইংরেজি ভাষায় ছাপা হয়ে। সহজ সরল মনে হলেও পূর্বে যা বলেছিলাম, এদের মত রাজনৈতিক সচেতন মানুষ এই ভূভারতে আর নাই। তাই প্রতিবাদ শুরু হয়ে গেল।

    ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি, পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নামক এক বাঙ্গালী প্রস্তাব পেশ করেন যে, উর্দু আর ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাকে যেন গণপরিষদের ভাষা হিসেবে অধিকার দেওয়া হয়। ইতিহাসের পাঠ দিব না, আমি আজকে শুধু এই লোকটা সম্পর্কে কথা বলব যিনি অসীম সাহস আর বুক ভরা দেশপ্রেম নিয়ে এই দেশে জন্ম নিয়েছিলেন।

    ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। রাজনীতিতে তিনি কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন। দারুণ ভাবে মানুষের কাছের একজন হতে পেরেছেন তিনি। জেল খেটেছেন তিনি কয়েকবার ব্রিটিশ আমলে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তিনি কংগ্রেস দলের পক্ষে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার সদস্য নির্বাচিত হন।পরে পাকিস্তানের সংবিধান রচনার জন্য ঐ বছর ডিসেম্বরে পূর্ববঙ্গ হতে তিনি পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। এবং অধিবেশনে যোগ দিয়েই তিনি ইতিহাস রচনা করেন, বাংলা কে তার অধিকার দেওয়ার জন্য বলেন। তিনি বলেন “পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশের ছয় কোটি নব্বই লাখ মানুষের মধ্যে চার কোটি চল্লিশ লাখ মানুষ বাংলা ভাষাভাষী। সুতরাং বিষয়টিকে প্রাদেশিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বাংলাকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে দেখা উচিত। তাই তিনি গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্তির দাবি করেন।তুমুল বিতর্ক হয় এই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে। স্বভাবতই ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সততা আদর্শ নিয়ে ব্যক্তি আক্রমণ করতেও পিছপা হয়নি নাজিমুদ্দিন সহ লিয়াকত আলিরা। ওই প্রস্তাব সেদিন পাস হয়নি। তবে সলতেতে আগুন ঠিকই লেগেছিল সেদিন। যে আগুন পরবর্তীতে শুধু বাংলা কে রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি এনে দেয়নি, স্বাধীন একটা দেশও এনে দিয়েছিল।

    পাকিস্তান আমলে উনাকে প্রায় নিষ্ক্রিয় করে রাখা হয়।১৯৬০ সালে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের উপর ‘এবডো’ (Elective Bodies Disqualification Order) প্রয়োগ কড়া হয়। ৬৫ সালের যুদ্ধের সময় গৃহবন্দী অবস্থায় ছিলেন তিনি।এরপর আসে একাত্তর। রাজনৈতিক প্রজ্ঞায় তিনি বেশ ভাল করেই বুঝতে পারছিলেন যে বেশ বড় কিছু হতে চলেছে।বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর তিনি কুমিল্লায় তার নিজ বাস ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। পরিস্থিতি খারাপ হওয়া শুরু হতেই তাকেও অনেকে দেশ ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য বলেন। তিনি সহজেই ভারতে চলে যেতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেই জিনিস ছিলেন না, মৃত্যু ভয় কাকে বলে জানতেন না সম্ভবত। তিনি বলেন - এইটা আমার মাতৃভূমি, এইখানে আমার জন্ম, এইখানে কাটাইলাম পুরা জীবন। এই দেশ ছাইড়া কই যামু?

    ২৫ মার্চ ঢাকায় ম্যাসাকার হয়ে যাওয়ার পর তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলেন সামরিক জান্তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে যাচ্ছে। তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সবাই কে ডেকে বললেন অবিশ্বাস কিছু কথা। তিনি বললেন -, ‘সময় খুবই কম। তোমাদের কিছু কথা বলা দরকার। আমার বেঁচে থাকার খুবই প্রয়োজন ছিল বাংলাদেশের জন্য, কিন্তু মনে হচ্ছে তা আর সম্ভব হচ্ছে না। আমার বন্ধু কন্যার (ইন্দিরা গান্ধী) সাথে এই মুহূর্তে দেখা হওয়াটা খুবই প্রয়োজন ছিল- কিন্তু এখন যদি আমি এখান থেকে চলে যাই তাহলে মিলিটারিরা আমাকে খুঁজে না পেলে আশপাশের সব লোককে মেরে ফেলবে, আগুন দিয়ে সব জ্বালিয়ে দেবে। আমাকে না পেলে নিরপরাধ মানুষগুলির প্রাণ যাবে। সেটা তো হতে পারে না। আই অ্যাম ট্রাপড।’ সেদিন তিনি আরো বলেছিলেন, ‘আমাকে নিতে এসে মিলিটারিরা দুটো জিনিস করতে পারে, তারা আমাকে ক্যান্টনমেন্টে ধরে নিয়ে গিয়ে আমাকে দিয়ে বিবৃতি দেয়ানোর চেষ্টা করাতে পারে- আর তাই যদি করে তাহলে তাদের আমি একটা কথাই বলবো-To stop kill these unarmed people, তখন তারা আমার ওপর অত্যাচার করবে এবং মেরে ফেলবে ওখানেই। আরেকটা ব্যাপার হতে পারে- মিলিটারিরা আমাকে এখানেই গুলি করে মারতে পারে।’
    সেদিন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উপস্থিত পরিবারের সবাইকে বলেছিলেন, ‘আমার অনুরোধ, তোমরা আমার মৃতদেহ বারান্দায় ফেলে রেখো যাতে সবাই আমার মৃতদেহ দেখে মনে সাহস পায়, বিদ্রোহ করবার জন্য।’ সাথে এটাও বললেন, ‘দেখো, ওরা আমাকে দুদিনের মধ্যে এসে নিয়ে যাবে।’ নাতনি আরমাকে কাছে নিয়ে বললেন, ‘পৃথিবীতে আর কেউ আমার জন্য কাঁদলেও তুই কাঁদবি না, তুই কাঁদলে আমি অনেক কষ্ট পাবো।’

    ২৯ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাঁকে ধরে নিয়ে যায় কুমিল্লা সেনানিবাসে। উনার কনিষ্ঠ পুত্রকেও ধরে আনা হয়। এই অশীতিপর বৃদ্ধর উপরে চালনা করা হয় অমানুষিক নির্যাতন। হাঁটু ভেঙ্গে দেওয়া হয় উনার, চোখ তুলে ফেলে পিশাচেরা। ১৪ এপ্রিল মারা যান এই মহান দেশপ্রেমিক। বুকের মাঝে কতখানি দেশপ্রেম থাকলে এমন ত্যাগ স্বীকার করা সম্ভব আমার জানা নেই, কিভাবে একজন মানুষ স্বেচ্ছায় সজ্ঞানে মৃত্যুর মুখোমুখি হতে পারে তা হয়ত কোন দিনই জানতে পারব না আমরা। স্বাধীনতার এত বছর পরে এক বুক ভালবাসা আর গভীর শ্রদ্ধা জানাতে পারি আমরা। যদিও তাও আর হয়ে উঠতে দেখি কই? আমরা যা করার তাই করছি। খুব যত্ন করে, সময় নিয়ে ভুলে যাচ্ছি ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত নামক এই নায়ককে। যেমন বেমালুম ভুলে গেছি আজকে এই মহান পুরুষের জন্মদিন। ১৮৮৬ সালের আজকের দিনে মানে ২ নভেম্বর ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত জন্ম গ্রহণ করেন।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০১ নভেম্বর ২০১৮ | ১৯১৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • aranya | 3478.160.342312.238 (*) | ০৬ নভেম্বর ২০১৮ ০৫:৫২63071
  • ভাল লাগল, এই স্মৃতিচারণ।
    দেশের সুসন্তান-দের আমরা ব্ড় দ্রুত ভুলে যাই..
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন