এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • নিলামওয়ালা ছ'আনা

    Sarit Chatterjee লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ | ১৭৬০ বার পঠিত
  • নিলামওয়ালা ছ'আনা
    সরিৎ চট্টোপাধ্যায় / ছোটগল্প

    পাঁচতারা হোটেলটাকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছিল সুদর্শন ছিপছিপে লম্বা ছেলেটা। আইপিএল-এর অকশান হবে এই হোটেলেই দুদিন পর। তারকাদের পাশাপাশিই সেদিন ভাগ্যনির্ণয় হবে ওর মতো কয়েকজন প্রায় নাম না জানা খেলোয়াড়ের। পাঁচতারায় ঢোকার সৌভাগ্য হয়নি কখনো তাই পরশুর আগেই আজ একবার সব ঘুরে দেখে যেতে চায় উজান।

    আজ দুবছর হলো ফার্স্ট ডিভিশন খেলছে উজান। ওপেনিং-এ খেলে। যারা ওকে খেলতে দেখেছে, বলেছে জাত ব্যাটসম্যান ও। কিন্তু সিজানে সাতটা সেঞ্চুরি করার পরও বেঙ্গল রঞ্জি টিমে ডাক না পেয়ে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে ওর। বাড়িতে চরম অশান্তি চলছে, রুবির বাড়ি থেকেও চাপ দিচ্ছে, এমন সময় একটা ম্যাচে কামাল করে দিল উজান। চতুর্থদিনের ভেঙে পড়া পিচে একা লড়ে গেল সারাদিন। দিনের শেষে তিন ওভার বাকি থাকতে ওদের শেষ জুটি যখন জয়লাভ করল তখন ওর স্কোর ৯৬ নট আউট। পরদিন কাগজে অনেকটা জায়গা নিয়ে বেরল খবরটা। তার মাসখানেক পর এল আইপিএল থেকে নিমন্ত্রণ। কিন্তু তা বলেই যে কোনো টিম ওকে কিনবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। ওর বেস প্রাইস, কুড়ি লক্ষ টাকা। না কেনার চান্সই বেশি। ও কপি-বুক ব্যাটসম্যান, টি-টোয়েন্টি ওর স্বাভাবিক খেলা নয়।

    হোটেলের গেট দিয়ে ঢুকতেই বুকটা ঢিপঢিপ করছিল ওর। এক অপূর্ব দেখতে সুন্দরী ফ্রন্ট ডেস্ক থেকে চোখ তুলে উজানের দিকে তাকাল। উজানের গায়ে ওর ক্লাবের জার্সি। নিজেকে যে হাস্যকর রকমের বেমানান লাগছে সেটা বেশ ভালোই বুঝতে পারছিল ও। একজন মাঝবয়সী লোক ওকে দেখে হঠাৎ এগিয়ে এল, মৃদু হেসে ইংরেজিতে জিজ্ঞাসা করল, আপনি উজান আচার্য়া না?
    : হ্যাঁ।
    : আমি হাসান মেহমুদ। আপনার স্টোরিটা আমিই করেছিলাম। গ্ল্যাড টু মিট ইউ।
    : থ্যাংকিউ স্যর।
    : তুমি আজকে এখানে? অকশান তো পরশু।
    : একটু দেখে যেতে চাইছিলাম স্যর।
    : এস, তোমাকে কয়েকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিই।

    নন্দিনী গোয়েঙ্কার বয়েস চল্লিশ পার হলেও তাঁকে বিগতযৌবনা বলা যায় না। ওজন সামান্য বাড়লেও এখনো যথেষ্ট সুন্দরী। আট বছর আগে শীর্ষের অভিনেত্রীদের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ার আগেই তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন দেশের প্রথম সারীর ব্যবসায়ী সঞ্জীব গোয়েঙ্কার সঙ্গে। গোটা দেশ এখন তাঁর দিকে ঈর্ষার দৃষ্টিতে তাকায়। গতবছরের আইপিএল-এর রানার আপ টিমের আজ মালকিন তিনি।

    নন্দিনী মক্ষিরাণীর মতো তার পারিষদ দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে লিফ্ট থেকে বেরতেই ওর চোখ পড়ল নতুন ছেলেটার দিকে। তিলোত্তমা অভিনেত্রীর মুখের ভাবে লেশমাত্র পরিবর্তন হলো না। শুধু পাশের মেয়েটির কানে কানে কিছু একটা বলে তিনি এগিয়ে গেলেন ওদের দিকে।
    : আরে মেহমুদ সাব, আপ কো হি তলাশ রহে থে হম।
    : আরে বাপ রে! মল্লিকা এ হিন্দুস্তান হমে খোজ রহেঁ হ্যাঁয়, কেয়া নসিব হ্যায় হমারি!
    : আপ তো দিল্লগি কর রহে হ্যাঁয় জনাব। কুছ গুফতগু করনি থি আপসে।

    দু'জনে অল্প দূরে সরে আসে। নন্দিনী পরিষ্কার বাংলায় বলে ওঠে, কে ছেলেটা?
    : উজান। উজান আচার্য। ওপেনিং ব্যাট। জাত ব্যাটসম্যান।
    : রঞ্জি খেলেছে?
    : না, তবে খেলা উচিত ছিল। কিন্তু সিলেকশন কীভাবে হয় সে তো জানেনই ম্যাডাম। এই তো কদিন আগে একটা ৱ্যাংক টার্নার-এ সারাদিন ব্যাট করে টিমকে জিতিয়েছে। ক্লাস প্লেয়ার।
    : আপনার সিদ্ধান্তের ওপর আমি ভরসা করি মেহমুদ সাব। একবার কথা বলা যাবে?
    : অবশ্যই! আমি ডেকে দিচ্ছি।
    : না, এখানে না। আমার ঘরে। দশমিনিট পর।

    উজান বেশ ঘাবড়ে গেছিল। নন্দিনী গোয়েঙ্কা ওর সাথে দেখা করতে চায়! দরজায় টোকা দিতেই নন্দিনী দরজা খুলে হেসে ওকে অভ্যর্থনা জানাল।
    : কম ইন উজান।
    : গুড ইভনিং ম্যাম।
    : কল মি নন্দিনী। ম্যাম শুনতে একটু কেমন যেন লাগে।
    : ওমা! আপনি তো পরিষ্কার বাংলা বলেন!
    : আমি তো বাঙালিই। যদিও আলিগড়ে বড়ো হয়েছি।
    : স্যরি, জানতাম না। তবে আপনার প্রায় সব সিনেমাই দেখেছি।
    : তাই? কেমন লাগে আমাকে সিনেমায় দেখতে?
    : অপূর্ব! আপনি সে সময়ে আমার হার্টথ্রব ছিলেন।
    : সেকি! তুমি তো তখন নেহাৎ ছোট ছিলে, তাই না?
    মাথা নিচু করে হাসে উজান। বলে, ক্লাস পালিয়ে আপনার ছবি দেখতে যেতাম। একবার বাবার হাতে মারও খেয়েছিলাম।
    হাহা করে হেসে ওঠে নন্দিনী। উজানের হাত ধরে সোফায় নিয়ে এসে বসায়। তারপর সামনের সোফাটার পিঠে দুহাত রেখে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতেই জিজ্ঞাসা করে, কী ধরণের খেলোয়াড় তুমি?
    : ওপেনিং ব্যাট।
    : আর?
    : ভালো ক্লোজ-ইন ফিল্ডার।
    : কীরকমের ব্যাটসম্যান?
    : স্টেডি। মেথডিকাল। তবে অ্যাগ্রেসিভও হতে পারি।
    : তুমি বুঝতে পারছ তো তুমি টি-টোয়েন্টিতে মিসফিট?
    : না, আমি চেষ্টা করলে ...
    : ডোন্ট আরগু উইথ মি ইয়ংম্যান! তুমি একজন ক্লাসিকাল ব্যাটসম্যান। আমাকে বলো কেন তুমি আইপিএল খেলতে চাও?
    : আমার ... আমার টাকাটা খুব দরকার। ইটস্ আ নেসেসিটি!
    : গুড। তার মানে নেসেসিটি কী তুমি সেটা বোঝো? তাই তো?
    উজান মাথা নিচু করে বসে থাকে। বাবার মুখটা মনে পড়ে, মনে পড়ে ফ্যাক্টরির কালিঝুলি মাখা হাতদুটো।
    : আপনি আমাকে কী জন্যে ডেকেছিলেন?
    : তোমার কী মনে হয়?
    : আমি ... আমি ঠিক বুঝতে পারছি না।
    : লেট মি মেক এ ডিল উইথ ইউ উজান। তুমি এই সিজন আমার টিমে খেলবে। আর বেঞ্চে বসে না, মাঠে নেমে। কিন্তু আমারও একটা নেসেসিটি আছে। সেটা তোমায় পুরো করতে হবে।

    চমকে নন্দিনীর মুখের দিকে তাকায় উজান। সামান্য হাঁপাচ্ছে নন্দিনী। কিন্তু চোখ উজানের চোখ থেকে নড়ছে না। চোখ সরিয়ে নেয় উজান। নিজেকে কাঁটাতারের বেড়ায় সার্চলাইটের আলোয় আটকে পড়া অসহায় উদ্বাস্তুর মতো লাগে। ঘরের মধ্যে অনেক্ষণ শুধু দু'জনের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায়। শেষে উজানই আবার কথা বলে।
    : আমি একজনকে ভালোবাসি।
    : দ্যাটস্ নাইস। কী নাম ওর?
    : রুবি।
    : আমিও একজনকে ভালোবাসতাম। সে অবশ্য এক যুগ আগের কথা। অনেকটা তোমার মতোই দেখতে ছিল জানো।
    : আমায় একটু ভাবতে সময় দিন।
    : বেশ তো, এখন সাড়ে আটটা বাজে। আমি দশটা পর্যন্ত অপেক্ষা করব। কেমন?

    রাতের কলকাতা। কত শত মানুষের স্বপ্ন এখানে প্রতিদিন আধপেটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। শত সহস্র নিওনবাতির নিচে নেমে আসে দুঃসহ অন্ধকার। কেউ ফিরেও দেখে না।
    যেমন আজ বছর বাইশের ছেলেটা রাস্তার ওপাশে একটা গলির মুখে এক আধো অন্ধকার জায়গায় চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। অনেকগুলো স্বপ্ন আজ তার চোখে। কিন্তু তার দাম যে অনেক।
    পকেট থেকে একটা কয়েন বার করে উজান। ওর লাকি কয়েন। অনেক ম্যাচে এই কয়েন দিয়েই টস জিতেছে সে। দুবার সেটাকে লুফে নিয়ে হঠাৎ টান মেরে ওটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় উজান। অন্ধকার গলির ভেতর ধাতব শব্দটা অল্পক্ষণেই মিলিয়ে যায়।
    আর কোনোদিকে একবারও না তাকিয়ে বড়ো রাস্তাটা পার করে উজান।

    ১৩০২২০১৭
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ | ১৭৬০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভেবেচিন্তে মতামত দিন