এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিতে গরু: দেশ কোনদিকে? # পর্ব - ৩

    Ashoke Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ৩১ আগস্ট ২০১৬ | ২২২১ বার পঠিত
  • গরুমোষ আর দেবাসুর!

    এই সব প্রশ্ন ধরে আর সামান্য কিছুটা এগোলেই আমরা আলোচ্য সমস্যার একেবারে মূলে পৌঁছে যেতে পারব এবং সমাধানেরও কিঞ্চিত হদিশ হয়ত পেয়ে যাব।

    এবার সেই কথা।

    সকলেই জানেন, হিন্দু ধর্মের ক্ষেত্রে বৌদ্ধ খ্রিস্টান বা ইসলাম ধর্মগুলির মতো কেন্দ্রীয় শাস্ত্র গ্রন্থ, অনুশাসন, আচারবিধি, (এক বা বহু বচনে) নির্দিষ্ট দেবতা বা দেবমণ্ডলি, সামাজিক রীতি—কোনো কিছুই নেই। নৃতাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গিতে যাকে জনজাতীয় ধর্ম (tribal religion) বলা হয়, তার মতোই এর সমস্ত প্রকরণই প্রকটভাবে আঞ্চলিক, সর্বাত্মবাদী (animistic) এবং খণ্ডিত। খাদ্যাখাদ্য বিচারে চূড়ান্ত বিভিন্নতা। নাম বাদ দিলে এর মধ্যে প্রতি এক দেড়শ কিলোমিটারে সমস্ত আচার আচরণ দেবদেবী পালটে যায়। যে দুর্গা দেবী সম্পর্কে স্মৃতি ইরানী লোকসভায় প্রায় নাটুকে একখানা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন, পশ্চিম বঙ্গের বাইরে অবাঙালি হিন্দুদের মধ্যে তার কোনো চর্চাই নেই। ছট পুজো নিয়ে হিন্দি ভাষী হিন্দুর এত তীব্র আবেগ, বাংলা বা অন্ধ্রে তার কোনো গ্রাহ্যতাই দেখা যায় না। এমনকি, বিয়ের কায়দাকানুন মন্ত্রটন্ত্র আচার বিচার পোশাক—সবই অন্য রকম হয়ে যায়। এটা হিন্দু ধর্মের কোনো উদারতা বা প্রসারতা থেকে আসেনি। মার্ক্সীয় সমাজতাত্ত্বিক বিচারধারা প্রয়োগ, পূর্বসূরি চিন্তাবিদ্‌দের গবেষণা অনুসরণ, ও বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে আমার ধারণা, এর পেছনে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক কারণে প্রাচীন ভারতীয়দের সমাজ বিকাশের ইতিহাসে বিক্ষিপ্ত অশ্রেণিক জনজাতি জীবন (pre-class consensual tribal culture) থেকে শ্রেণিবিভক্ত রাজনৈতিক কেন্দ্রীয় সমাজকাঠামো (class-divided political society)-তে উত্তরণের পথে অগ্রগতির অসম্পূর্ণতা। অর্থাৎ, আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আঞ্চলিক এবং/অথবা কেন্দ্রীয়ভাবে উল্লম্ব (vertical) শ্রেণি সমাজের আবির্ভাব ঘটলেও সর্বত্রই মানুষের সামাজিক-সাংস্কৃতিক মনন জগতে বিভিন্ন জনজাতির বিচিত্র আঞ্চলিক ও স্বতন্ত্র অভ্যাস আচার ও প্রথাসমূহ অনুভূমিক (horizontal) বিচ্ছিন্নতা নিয়ে প্রায় অপরিবর্তনীয়ভাবে টিঁকে গেছে। তার ফলে সনাতন হিন্দু ধর্ম বলে যাই বলা হোক না কেন, তা শেষ বিচারে কোনো না কোনো আঞ্চলিক উপাসনা পদ্ধতির প্রতিরূপ ছাড়া আর কিছু নয় [এই বিষয়টি আমি আমার “প্রসঙ্গ ধর্ম: উদ্ভব ও বিবর্তন” (১৯৯২) বইতে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছি]।

    উনিশ শতকের মধ্য ভাগে হোরেস উইলিয়াম সাহেব গবেষণা করে সারা (অবিভক্ত) ভারতে ৪৫টি উপাসক সম্প্রদায়ের দেখা পেয়েছিলেন। শেষ ভাগে অনুসন্ধান করে অক্ষয় কুমার দত্ত পেয়েছিলেন ১৮০টি সম্প্রদায়। এই কারণেই শুধু হিন্দু বললে একজন গড় হিন্দু ব্যক্তির ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে কিছুই বোঝা বা বোঝানো যায় না। তিনি শাক্ত না শৈব, বৈষ্ণব হলে তিনি রামাচারী না কৃষ্ণভক্ত বৈষ্ণব, তিনি আসলে নিরামিষভোজী ব্রাহ্মণ না সুস্বাদু মাংসপ্রিয় ব্রাহ্মণ—এই রকম অসংখ্য পরিচয় লিপিবদ্ধ করতে হয়। আর প্রত্যেকেই ভাবেন, তাঁরটাই আসল হিন্দুত্ব, খাঁটি হিন্দু ধর্ম।

    সৌভাগ্যের কথা হল, এই ব্যাপারেও স্বামী বিবেকানন্দের খুব সুনির্দিষ্ট কিছু কথা আছে। “We must also remember that in every little village-god and every little superstition custom is that which we are accustomed to call our religious faith. But local customs are infinite and contradictory. Which are we to obey, and which not to obey? The Brâhmin of Southern India, for instance, would shrink in horror at the sight of another Brahmin eating meat; a Brahmin in the North thinks it a most glorious and holy thing to do—he kills goats by the hundred in sacrifice. If you put forward your custom, they are equally ready with theirs. Various are the customs all over India, but they are local. The greatest mistake made is that ignorant people always think that this local custom is the essence of our religion.”

    এর অনুবাদ: “. . . আমাদের স্মরণ রাখতে হবে, আমরা সচরাচর যেগুলিকে আমাদের ধর্মবিশ্বাস বলি, সেগুলি আমাদের নিজ নিজ ক্ষুদ্র গ্রাম্যদেবতা-সম্বন্ধীয় এবং কতগুলো ক্ষুদ্র কুসংস্কারপূর্ণ দেশাচার মাত্র। এরকম দেশাচার অসংখ্য এবং পরস্পর-বিরোধী। এদের মধ্যে কোনটি মানব, আর কোনটি মানব না? উদাহরণ-স্বরূপ দেখ, দাক্ষিণাত্যের একজন ব্রাহ্মণ অপর ব্রাহ্মণকে এক টুকরো মাংস খেতে দেখলে ভয়ে দুশ হাত পিছিয়ে যাবে; আর্যাবর্তের ব্রাহ্মণ কিন্তু মহাপ্রসাদের অতিশয় ভক্ত, পুজোর জন্য তিনি শত শত ছাগল বলি দিচ্ছেন। তুমি তোমার দেশাচারের দোহাই দেবে, তিনি তাঁর দেশাচারের দোহাই দেবেন। ভারতের বিভিন্ন [প্র]দেশে নানাবিধ দেশাচার আছে, কিন্তু প্রত্যেক দেশাচারই স্থান বিশেষে আবদ্ধ; কেবল অজ্ঞ ব্যক্তিরাই নিজ নিজ পল্লীতে প্রচলিত আচারকে ধর্মের সার বলে মনে করে, এটা তাদের মহাভুল।” [স্বামী বিবেকানন্দ ১৯৮৯ক, ৪৭; সাধু ভাষা থেকে চলিত ভাষায় রূপান্তরিত ও আধুনিক বানান রীতি প্রযুক্ত।]

    এই প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, দেশে এবং বিদেশে নানা বক্তৃতায় অদ্বৈত বেদান্তের “একমেবাদ্বিতীয়ম” ব্রহ্মের সপক্ষে অনেক ভালো ভালো গুরুগম্ভীর আলোচনা করলেও, ব্যবহারিক জীবনে স্বামী বিবেকানন্দ নিজেও ছিলেন তাঁর গুরুর মতোই একজন মনেপ্রাণে শাক্ত। সেই হেতু সর্ব প্রকার মাংসভোজী, ভোজন রসিক, বাঙালি ধর্মতাত্ত্বিক।

    স্বভাবতই তিনি উত্তর ভারতীয় রামাচারী বৈষ্ণবদের এবং বিশুদ্ধ-বেদপন্থী আর্যসমাজীদের নিরামিষ আহারকেন্দ্রিক ধর্মাচরণ একেবারেই পছন্দ করতেন না। সম্ভবত, শিক্ষাদীক্ষার কারণে এবং প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে তিনি খুব ভালো করেই জানতেন, গোহত্যা বিরোধী আন্দোলনের উৎসও সেই উত্তর আঞ্চলিক বৈষ্ণব পন্থাই। তার সাথে যুক্ত হয়েছিল স্বামী দয়ানন্দের আর্যসমাজ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। আর, সুলতান ও মোগল রাজত্বের পত্তন ও বিস্তার শুরুও হয়েছিল এই উত্তর ভারত থেকেই। হিন্দুসমাজের উপরতলার লোকেরা মুসলমান রাজাদের সঙ্গে ক্ষমতার ভাগাভাগিতে বোঝাপড়া করেই নিজেদের আর্থ-রাজনৈতিক ও বৈষয়িক স্বার্থ রক্ষা করে গেছে। অথচ, আদিম জনজাতি-সুলভ মনন এবং সংস্কৃতি তো তখনও সক্রিয়। ফলে, তখন থেকে নিজেদের আচার আচরণে একটা স্পষ্ট জনজাতিগত সাংস্কৃতিক পার্থক্য চিহ্নিত করতে চেয়ে প্রথমে গোমাংসের প্রতি, পরে সমস্ত আমিষের প্রতি নির্লোভ হয়ে উঠেছে এবং পরে সেই অভ্যাসই তাদের এক বংশানুক্রমিক সাধারণ ধর্মীয় অনুশাসনে পরিণত হয়েছে। উত্তর ভারতীয় হিন্দুদের নিরামিষাশী ভোজন-মেনুর এছাড়া অন্য কোনো ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না। আর তখন থেকে বুদ্ধ, কৃষি ইত্যাদির সন্ধানও শুরু করতে হয়েছে। কেন না, ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্রে এরকম নির্দেশ পাওয়ার কোনো উপায় নেই।

    স্বামী বিবেকানন্দ নিজে যেহেতু উত্তর ভারতের রাজপুত রাজাদের মধ্যে একটা ভালো সময় খুব অন্তরঙ্গভাবে কাটিয়েছিলেন, তাঁর এই সব তথ্য নিশ্চয়ই অজানা ছিল না। প্রকাশ্যে কিছু বলতে না পারলেও সেটা একেবারেই পছন্দ করেননি। হয়ত এই কারণেই ১৮৯৭ সালে এক দিন বাগবাজারের বাড়িতে এরকম গো-ভক্ত কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বামীজির সাক্ষাতকারের যে বিবরণ পাই, তাতে তাঁর অনেক দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভ যেন প্রায় বিস্ফোরণের আকারে ফেটে পড়েছিল।

    সেই সাক্ষাতকারের একটু বিস্তৃত উদ্ধৃতি বোধ হয় এই প্রবন্ধের অলঙ্করণে সহায়ক হতে পারে।
    “গোরক্ষিণী সভার জনৈক উদ্যোগী প্রচারক স্বামীজির সঙ্গে দেখা করতে এলেন . . . [এবং] স্বামীজিকে অভিবাদন করে গোমাতার একটা ছবি তাঁকে উপহার দিলেন। . . .
    স্বামীজি। আপনাদের সভার উদ্দেশ্য কী?
    প্রচারক। আমরা দেশের গোমাতাগণকে কসাইয়ের হাত থেকে রক্ষা করে থাকি। জায়গায় জায়গায় পিঁজরাপোল স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে রুগ্ন, অকর্মণ্য এবং কসাইয়ের হাত থেকে কেনা গোমাতাগণ প্রতিপালিত হন।
    স্বামীজি। এ অতি উত্তম কথা। আপনাদের আয়ের পন্থা কী?
    প্রচারক। দয়াপরবশ হয়ে আপনাদের মতো মহাপুরুষ যা দেন তার দ্বারাই সভার ওই কাজ নির্বাহ হয়।
    স্বামীজি। আপনাদের গচ্ছিত কত টাকা আছে?
    প্রচারক। মারোয়াড়ি বণিকসম্প্রদায় এই কাজের বিশেষ পৃষ্ঠপোষক। তাঁরা এই সৎ কার্যে বহু অর্থ দিয়েছেন।
    স্বামীজি। মধ্য-ভারতে এবার ভয়ানক দুর্ভিক্ষ হয়েছে। ভারত গভর্নমেন্ট নয় লক্ষ লোকের অনাহারে মৃত্যুর তালিকা প্রকাশ করেছেন। আপনাদের সভা এই দুর্ভিক্ষের সময়ে কোনো সাহায্যদানের আয়োজন করেছে কি?
    প্রচারক। আমরা দুর্ভিক্ষাদিতে সাহায্য করি না। কেবলমাত্র গোমাতাদের রক্ষা কল্পেই এই সভা স্থাপিত।
    স্বামীজি। যে দুর্ভিক্ষে আপনাদের জাতভাই লক্ষ লক্ষ মানুষ মৃত্যুমুখে পতিত হল, সামর্থ্য সত্ত্বেও আপনারা এই ভীষণ দুর্দিনে তাদের অন্ন দিয়ে সাহায্য করা উচিৎ মনে করেননি?
    প্রচারক। না। লোকের কর্মফলে—পাপে এই দুর্ভিক্ষ হয়েছিল; যেমন কর্ম তেমনি ফল হয়েছে। . . .
    স্বামীজি। যে সভা-সমিতি মানুষের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করে না, নিজের ভাই অনশনে মরছে দেখেও তার প্রাণ রক্ষার জন্য একমুঠো অন্ন না দিয়ে পশুপাখি রক্ষার জন্য রাশি রাশি অন্ন বিতরণ করে, তার সঙ্গে আমার কিছুমাত্র সহানুভূতি নেই; . . . কর্মফলে মানুষ মরছে—এরকম কর্মের দোহাই দিলে জগতে কোনো বিষয়ে চেষ্টাচরিত্র করাই একেবারে বিফল বলে সাব্যস্ত হয়। আপনাদের পশুরক্ষার কাজটাও বাদ যায় না। ওই কাজ সম্বন্ধেও বলা যেতে পারে—গোমাতারা নিজ নিজ কর্মফলেই কসাইদের হাতে যাচ্ছেন ও মরছেন, আমাদের ওতে কিছু করবার প্রয়োজন নেই।
    প্রচারক (থতমত খেয়ে)। হ্যাঁ, আপনি যা বলেছেন তা সত্য; কিন্তু শাস্ত্র বলে গরু আমাদের মাতা।
    স্বামীজি (হাসতে হাসতে)। হ্যাঁ, গরু যে আমাদের মা, তা আমি বিলক্ষণ বুঝেছি—তা না হলে এমন সব কৃতি সন্তান আর কে প্রসব করবেন?”
    [স্বামী বিবেকানন্দ ১৯৮৯গ, ৩-৪; সাধু ভাষা থেকে চলিত ভাষায় এবং আধুনিক বানান রীতিতে রূপান্তরিত।]

    লক্ষণীয়, এই কারণেই সঙ্ঘ পরিবার তাদের প্রচার যন্ত্রে বিবেকানন্দের অন্যান্য অনেক ধর্মীয় বক্তব্য ব্যবহার করলেও, গরু সম্পর্কে তাঁর মতামত নিজেদের সদস্যদের কাছেও লুকিয়ে রাখারই চেষ্টা করে থাকে। এই সাংস্কৃতিক আঞ্চলিকতার দ্বন্দ্বের খবর তারাও রাখে এবং বোঝে বলেই মনে হয়।

    তবে, এখানে আমাদের আগের কথার সূত্র ধরে প্রশ্ন উঠতে পারে, শুধু গরুই বা কেন? মোষও নয় কেন? মোষও কেন মা না হোক, নিদেন পক্ষে হিন্দুদের মাসীও হতে পারল না?

    হ্যাঁ, খুবই যথার্থ প্রশ্ন। ন্যায্য প্রশ্ন।

    এর উত্তর পেতে হলে আমাদের ধর্মশাস্ত্র ও রাজনীতির জমিন থেকে বেরিয়ে এসে কিছুক্ষণের জন্য প্রথমে জীব-আচরণ বিদ্যা (ethology)-র কাছে যেতে হবে। গরু আর মোষের জৈব বা প্রজাতিগত আচরণের পার্থক্য বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। তার মধ্যেই উত্তরটা নিহিত বলেই মনে হয়। যাঁরা গ্রামাঞ্চলে গরু এবং মোষের আচরণ খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন এবং গ্রামের কৃষকদের সঙ্গে এই বিষয়ে কথা বলেছেন, তাঁরা হয়ত জানেন যে গৃহপালিত পশু হিসাবে গরু বা ঘোড়া যতটা মানুষের পোষ মেনে যায়, মোষের ক্ষেত্রে তা হয় না। ফলে গরু সম্পর্কে কৃষি-সংশ্লিষ্ট মানুষের মনে যে নৈকট্যবোধ জন্মায়, তাকে নিয়ে নানা ধরনের মানবিক আচার আচরণ উপরস্থাপন (superimpose) বা প্রক্ষেপন (project) করার যে অবকাশ থাকে, মোষেরা সেই সুযোগ মানুষকে দেয় না।

    এমতাবস্থায়, হিন্দুধর্মের প্রায়-জনজাতি সাংস্কৃতিক স্তরে অবিবর্তিত থাকার কারণে সম্ভবত খুব সহজেই উত্তর ভারতের উচ্চ বর্ণের ব্রাহ্মণ্য চিন্তায় গরু দৈবী গুরুত্ব লাভে সক্ষম হয়েছে, আর পাশাপাশি মোষের উপর আরোপিত হয়েছে তথাকথিত নিম্নবর্ণ তথা অসুরের জন্মদাতৃত্ব। আর এই সমস্ত উপস্থাপনাই যেহেতু উত্তর ভারতের শক্তিশালী হিন্দু ব্রাহ্মণ্য জনজাতীয় লোকসংস্কৃতির বিকাশের সাথে সম্পর্কিত আঞ্চলিক ঘটনা, সেখানে চেতনে-অচেতনে গরু আর মোষের মধ্যে দেবাসুরের দ্বন্দ্ব ঢুকে বসে আছে। এই দ্বন্দ্বের আবেদন মাঝে মাঝে প্রভাব ফেললেও, শাক্ত সংস্কৃতির দাপটের ফলে পূর্ব ভারতে তা কখনই খুব বড় হয়ে দেখা দেয়নি। দিতে পারেনি। গোবলয় আর হিন্দিভাষী বলয় যে ভূগোলের মানচিত্রে প্রায় মিলে গেছে—সেটা নিতান্তই কাকতালীয় নয় বা তাচ্ছিল্যবাচক শব্দভূষণ নয় বলেই এই পাপিষ্ঠ নরাধমের দৃঢ় বিশ্বাস। লোকসংস্কৃতির অব-ট্রাইব্যাল আঞ্চলিকতার ইতিহাসই ভূগোলের এই খণ্ডচিত্রের পেছনে সক্রিয়।

    নীরবতার সময় নয়!

    কিন্তু দিন বদলাচ্ছে। বর্তমান সঙ্ঘ পরিবারের অবস্থা হল অযোগ্যের হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। হঠাৎ করে হাতে অনেকটা রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ক্ষমতা এসে পড়েছে। যা তারা কখনও আশা করতেও পারেনি। ভারতীয় বুর্জোয়ারা বিশ্ব পুঁজিবাদের সুরে সুর মিলিয়ে অর্থনীতিতে যে পুঁজিমুখী উদারিকরণের দিকে দেশকে ঠেলে নিয়ে যেতে চাইছে, প্রবৃদ্ধ ধৃতরাষ্ট্র সুলভ প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের রাজত্বে দুর্নীতিতে ঠাসা এবং ক্রমক্ষীয়মান ভোটের দিকে নজর রেখে চলা কংগ্রেস নেতৃত্বের পক্ষে সেটা সবটা করা হয়ে উঠছিল না। বুর্জোয়ারা তাই তাদের হাতের আপাতত একমাত্র বিকল্প বিজেপি এবং গুজরাত থেকে বেপরোয়া ব্যক্তিত্ব হিসাবে নরেন্দ্র মোদীকে পছন্দ করে তুলে ধরে লোকসভায় বিপুল ভোটে জিতিয়ে এনেছিল সেই সব অপূরিত কাজ ঝটাঝট সেরে ফেলার জন্য।

    এই মুহূর্তে সেই আর্থ-রাজনীতির নানা দুর্বিপাকে স্বামীজি কথিত উত্তর ভারতের সেই সব “গোমাতার কৃতি সন্তান”রাই এখন সারা ভারতের বুকে হিন্দু ধর্ম রক্ষা ও প্রচারের ঠেকা নিয়ে বসেছে। তারা তাদের আঞ্চলিক ধর্মচিন্তা বিশ্বাস আচরণ ইত্যাদি অক্লেশে সারা ভারতের উপর আজ চাপিয়ে দিতে চায়। সাধারণভাবে আমাদের দেশে এমনিতেই সুদীর্ঘকাল ধরে বিশেষ রাজনৈতিক কারণে উত্তর ভারতের ভাষা সংস্কৃতি সমগ্র দেশের জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়ে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে ধ্বংস করে পুরোপুরি এক-বর্ণ বা আদতে বর্ণহীন এক সংস্কৃতি চালু করার হীন অপপ্রচেষ্টা চলছে। তার সাথে বিজেপি-র সংসদীয় নির্বাচনী বাড়বাড়ন্তের ফলে যুক্ত হয়েছে ধর্মীয় একরৈখিকতা। আমরা কে কী খাব, কী পোশাক পরব, কোন ভাষায় কথা বলব, আমাদের দেশপ্রেম বোঝাতে হলে কী কী করতে হবে, আমাদের জলসায় কাকে আমন্ত্রণ জানানো যাবে, কাকে ডাকা যাবে না—সব নাকি ওরাই বলে দেবে! এই ধরনের অপচেষ্টাগুলি যে কোনো দেশের গণতন্ত্রের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকারক, এবং শেষ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদের সহায়ক। গরুই হয়ত এখন তার এক অন্যতম বাহক হয়ে উঠতে চলেছে।

    সময় বেশি নেই। আসুন, খুব বেশি দেরি করে ফেলার আগেই আমরা সেই পরিস্থিতি মোকাবিলার উপযুক্ত মতাদর্শিক প্রস্তুতি নিতে শুরু করি। ◙

    গ্রন্থপঞ্জি ও তথ্যসূত্র

    ১। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৯৯৫), ঘরে-বাইরে; রবীন্দ্র রচনাবলী, ৪র্থ খণ্ড, বিশ্বভারতী, কলকাতা।
    ২। স্বামী বিবেকানন্দ (১৯৮৯ক), “মাদুরা অভিনন্দনের উত্তর”; অনুবাদ দ্রষ্টব্য—স্বামীজীর বাণী ও রচনা; ৫ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।
    ৩। স্বামী বিবেকানন্দ (১৯৮৯খ), “বৌদ্ধ ভারত”, ক্যালিফর্নিয়ার প্যাসাডেনায় প্রদত্ত ভাষণ, ২ ফেব্রুয়ারি ১৯০০; অনুবাদ দ্রষ্টব্য—স্বামীজীর বাণী ও রচনা; ১০ম খণ্ড, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।
    ৪। স্বামী বিবেকানন্দ (১৯৮৯গ), “স্বামী-শিষ্য-সংবাদ”; স্বামীজীর বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড; উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা।
    ৫। অশোক মুখোপাধ্যায় (১৯৯২), প্রসঙ্গ ধর্ম: উদ্ভব ও বিবর্তন; আজ-কাল-পরশু, কলকাতা।
    ৬। B. R. Ambedkar (1990), “Did the Hindus never eat beef?”, The Untouchables: Who Were They and Why They Became Untouchables? in Dr. Babasaheb Ambedkar, Writings and Speeches, vol. 7, Government of Maharashtra, Bombay (first edition 1948).
    ৭। D. R. Bhandarkar (1940), Some Aspects of Ancient Indian Culture, University of Madras.
    ৮। Mahadev Chakravarti (1979), “Beef Eating in Ancient India”; Social Scientist, Vol. 7 No. 11, June 1979.
    ৯। Mohandas Karamchand Gandhi (1969), “Speech at Prayer Meeting”, 25 July 1947. Collected Works of M. K. Gandhi, Vol. 96; Publication Division, Government of India.
    ১০। The Hindu, 10 August 2015.
    ১১। Kancha Ilaiah (1996), “Beef, BJP and Food Rights of People”, Economic and Political Weekly, Vol. 31 No. 24, 15 June 1996.
    ১২। D. N. Jha (2002), The Myth of Holy Cow; Verso, London [originally published from Delhi as Holy Cow: Beef in Indian Dietary Traditions].
    ১৩। D. N. Jha (2002), “Paradox of the Indian Cow: Attitudes to Beef Eating in Early India”, visit: http://www.indowindow.com/sad/article.php?child=17&article=11
    ১৪। B. B. Lal (1954-55), “Report on the excavation at Hastinapur”; Ancient India, Nos. 10-11, 1954-55.
    ১৫। Rajendra Lal Mitra (1967), Beef in Ancient India; edited and annotated by Swami Bhumananda, 1926; Manisha Granthalay, Kolkata [originally published in 1872].
    ১৬। Ram Puniyani (2001), “Beef eating: strangulating history”, The Hindu, 14 August 2001;
    ১৭। Sheela Reddy (2001), “A Brahmin’s Cow Tales”, Outlook, 17 September 2001.
    ১৮। H. D. Sankalia, “The Cow in History”; Seminar, No. 93, May 1967.
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ৩১ আগস্ট ২০১৬ | ২২২১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন