এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • ফেসবুক সেলিব্রিটি

    জান্নাতুল ফেরদৌস লাবণ্য লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৯ মে ২০১৯ | ৯৪৯ বার পঠিত
  • দুইবার এস‌এসসি ফেইল আর ইন্টারে ইংরেজি আর আইসিটিতে পরপর তিনবার ফেইল করার পর আব্বু হাল ছেড়ে দিয়ে বললেন, "এই মেয়ে আমার চোখে মরে গেছে।"

    আত্নীয় স্বজন,পাড়া প্রতিবেশী,বন্ধুবান্ধব সবাই এক‌এক করে ধিক্কার জানিয়ে বলে গেল, তোর জীবনে কি হবে? তোর ভবিষ্যত অন্ধকার!

    সমবয়সী কাউকেই তাদের বাবা-মা আমার সাথে মিশতে দেয় না। বলে, ঐ গাধার সাথে মিশলে ওর মতো হয়ে যাবি।

    বড়বোনের বাচ্চা হবে। সে একদিন আমাকে কঠিন গলায় বললো, তুই আমার আশেপাশে আসবি না। বাচ্চা পেটে থাকতে মা যার সংস্পর্শে বেশী থাকে বাচ্চা তার মতো হয়ে যায়। খবরদার তুই আমার বাচ্চার ধারেকাছেও আসবি না।

    সবার কাছ থেকে অপমান আর অবহেলা নিতে না পেরে আমি মরার কথা চিন্তা করছিলাম। কিন্তু কিভাবে মরবো সেটা ডিসাইড করতে পারছিলাম না।

    একদিন একা একা পুকুরঘাটে বসে বসে ভাবছি পানিতে ঝাঁপ দেবো কি না। এইসময় এলাকার প্রেমিক পুরুষ স্বপন ভাই মিছাক করতে করতে পুকুরঘাটে এসেছেন কুলকুচি করতে। স্বপ্নন ভাইয়ের আরেক নাম,'লাভার বয়।' এলাকার সব মেয়েদের লাভ লেটার দিয়ে বেড়ান আর একেকদিন পালা করে একেকজনের বাড়ির জানালায় গিয়ে ঢিল মেরে শিষ দেন। বহুবার পিটানি খেয়েও শোধরাননি। তবে আমার সাথে কখনো এরকম করেননি। ইন্টার ফেইল মেয়ের পেছনে কেইবা সময় নষ্ট করে?

    তিনি আমার পাশে বসতে বসতে বললেন, আপসেট? মরার কথা ভাবছো?

    আমি জবাব দিলাম না। স্বপন ভাইয়া আবার বললেন,তোমাকে গাধা বলাটা তোমার পরিবারের অন্যায় হয়েছে। প্রত্যেকটা মানুষের মধ্যে‌ই কিছু না কিছু প্রতিভা থাকে। প্রতিভার বিকাশ করতে জানতে হয় শুধু।

    আমি মনে মনে বলছি, যেমন আপনার প্রতিভা ইভটিজিং করার!

    মুখে কিছু বললাম না। স্বপন ভাই বললেন, তোমার ভেতরেও প্রতিভা আছে। কি প্রতিভা আছে ভেবে বের করো।‌ তারপর কাল এই সময়ে এইখানে এসে আমাকে জানাবা।

    সেদিন আমি সারাদিন ভাবলাম। না ভেবেও উপায় নাই। গোসলের সময় জলকেলি করতে গিয়ে বাথরুমের দরজার ফাঁক দিয়ে সারা ঘরে পানিতে মাখামাখি করে ফেলেছি। এর শাস্তি হিসেবে আম্মা আমাকে বাথরুমে আটকে রেখেছেন।

    সেই সময়টা কাঁদতে কাঁদতে অনেক ভাবলাম। তারপর লক্ষ্য করলাম,আরে! আমিতো ভালো কাঁদতে পারি! কথায় কথায় ফিচফিচ করে কান্না! আমার ভেতরে প্রতিভা তাহলে এইটা!

    পরদিন ছুটে গেলাম স্বপন ভাইয়ের কাছে। বললাম,আমার ভেতর প্রতিভা আছে! কান্নার প্রতিভা। আমি ভালো কাঁদতে পারি।

    স্বপন ভাই হাতে কিল মেরে বললেন, তো কাঁদো! এখানে না কেঁদে ফেসবুকে গিয়ে কাঁদো। ফেসবুকে কান্নার অনেক মূল্য।

    স্বপন ভাইয়ের কথায় ফেসবুকে একটা একাউন্ট খুললাম। একটা পেজ আরেকটা ইউটিউব চ্যানেল‌ও খুললাম।

    তারপর এক শুভদিনে একটা ভিডিও তৈরি করে ফেললাম। ভিডিওতে চোখে পানি এনে হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমার বয়ফ্রেন্ড আমাকে ধোঁকা দিয়ে চলে গেছে।

    রুহ আফজা,টমেটো সস আর নেইলপলিশ এগুলো দিয়ে হাতে লাল রং মেখে সবাইকে দেখিয়ে বললাম,আমার বয়ফ্রেন্ড যদি ফিরে না আসে আমি সুইসাইড করবো। "দেখো বন্ধুরা,আমি হাত কেটেছি!" বলতে বলতে চোখ মুছলাম।

    কয়েক ঘণ্টার মধ্যে ফেসবুকের টপ নিউজ হলো এইটা। গ্রুপে গ্রুপে,পেজে পেজে শুধু আমার এই ভিডিও। আমার ফলোয়ার বাড়তে বাড়তে চল্লিশ হাজার হয়ে গেল।

    স্বপন ভাইয়া আনন্দিত স্বরে বললেন, এখন তুমি একজন ফেসবুক সেলিব্রিটি। সারাক্ষণ কান্নার ওপর থাকবা।

    আমি সারাক্ষন কাঁদি। ফুটবল খেলা দেখে কাঁদি, ক্রিকেট খেলা দেখে কাঁদি।

    মাসখানেকের মধ্যে আমার একলাখ ফলোয়ার হয়ে গেল। পেইজ আর ইউটিউব চ্যানেল দেড়লাখ ছুঁইছুঁই।

    ইদানিং আমি কান্নাকাটি বাদ দিয়ে ভারী ভারী স্টাটাস দেয়া শুরু করেছি। কখনো কখনো এস‌এসসি বা এইস‌এসসি পরীক্ষার্থীদের কিভাবে পড়াশোনা করা উচিত, পরীক্ষার হলে বিচলিত না হয়ে কিভাবে লেখা উচিত সেই বিষয়ক মোটিভেশনাল ভিডিও‌ বানিয়েও আপলোড দিই। যথারীতি হিট।

    একদিন আব্বুকে গিয়ে গম্ভীর গলায় বললাম, পৃথিবীতে যত জ্ঞানীগুণী জন্মেছেন তাদের কারোরই পড়াশোনার বিষয়ে তেমন আগ্রহ ছিলো না। পড়ালেখা সাধারণদের জন্য তৈরি হয়েছে। জ্ঞানীগুণীদের এর প্রয়োজন নেই।

    আব্বু মুখ ঘুরিয়ে খবরের কাগজ পড়ছেন। এমন ভাব করছেন যেন আমি অদৃশ্য। আমাকে তিনি দেখতেও পান না, শুনতেও পান না।

    আমি পরোয়া করলাম না। ফেসবুক সেলিব্রিটিরা এতকিছু পরোয়া করে না।

    একদিন আম্মা অপমান করলেন। রাগী গলায় বললেন, কাজ নেই কর্ম নেই,খেয়ে খেয়ে খালি ভোম্বল হচ্ছে দিন দিন! কি আছে এর কপালে?

    আগে হলে আম্মার কথা গায়ে মাখতাম না। কিন্তু এখন আমি ফেসবুক সেলিব্রিটি। আমার ইগো বেশী। সুতরাং ভাত খেলাম না।

    ফেসবুকে আমার জনৈক ভক্তকে ঘটনাটা বলতেই সে দুঃখী গলায় বললো, আপনাকে এইভাবে অপমান!? আপনি অমুক রেস্টুরেন্টে আসেন। কি খাবেন? প্রয়োজনে পুরা রেস্টুরেন্ট তুলে এনে দেবো আপনার পায়ে!

    রেস্টুরেন্টে গিয়ে ভরপেট খেয়ে আসলাম।

    এইভাবে‌ই দিন চলে যাচ্ছিলো। আব্বু এক পাত্র নিয়ে এসেছে আমার জন্য। ছেলে মাছের ব্যবসা করে। একথা শোনার পরপর‌ই তাকে দেখামাত্র তার শরীর থেকে ভক করে কাঁচামাছের গন্ধ নাকে এসে লাগলো।

    আমি ঘাড় গোঁজ করে বললাম, এ বিয়ে করবো না।

    যথারীতি আমার পরিবারের লোকজন এমন ভাব করতে লাগলো যেন কিছুই শোনেনি। বড় আপা শুধু রাগী গলায় বললেন, তোর জন্য যে ছেলে পাওয়া গেছে এই ঢের!

    আমি কাঁদতে কাঁদতে ভিডিও করে ফেসবুকে আপলোড দিয়ে দিলাম। ক্যাপশনে লিখলাম,"কেউ কি নেই যে এগিয়ে এসে আমার হাত ধরবে? এই দুঃসহ পরিবার থেকে আমাকে মুক্তি দেবে?"

    এরপরপর‌ই সন্ধ্যা থেকে আমার বাড়ির সামনে ছেলেদের লাইন লেগে গেল।

    আব্বু অবাক হয়ে একেকজনের ইন্টারভিউ নিতে লাগলেন। দেখা গেল সবাই আমার মতো ফেসবুক সেলিব্রিটি। ব্যক্তিগত জীবনে কেউ কিছু করে না।

    তাদের মধ্যেই মোটামুটি একজনকে দেখে আব্বু আমার বিয়ে দিয়ে দিলেন। সেইসাথে যৌতুক হিসেবে একটা সেলাই মেশিন দিয়ে বললেন,ফেল করা মেয়ের জন্য এরচেয়ে বেশী কিছু দিতে পারবো না।

    অল্পদিনের মধ্যেই শাবানার মতো সেলাই মেশিনের ব্যবসায় আমি ভালো হিট করে গেলাম। ফেসবুকে স্টাটাস দেয়া মাত্রই মেয়ে ভক্তগণ তাদের জামা, পেটিকোট, ব্লাউজ নিয়ে হাজির হয়ে যায়। আর আমার বর একজন গ্রাফিক্স ডিজাইনার! সরি! আসল কথা বলি, সে একজন মিমার। ফেসবুকের অনেক বড় একটা পেজে নিয়মিত মিম তৈরি করে করে আপ্লোড করে। তার‌ও প্রচুর ফ্যান ফলোয়ার।

    আমার এখন বাচ্চা হবে। সাতমাস বারোদিন চলছে। ফেসবুকে আমার একজন ভক্ত আছেন নামকরা গাইনি ডাক্তার।সেই হিসেবে বাচ্চা হ‌ওয়াতেও আশা করি কোনো সমস্যা হবে না।

    রাত জেগে ছাদে বসে তারা গুনতে গুনতে আমরা স্বামী-স্ত্রী ভবিষ্যত পরিকল্পনা করি, আমাদের সন্তান বড় হয়ে কি হবে? পেজের এডমিন না গ্রুপের এডমিন?

    লেখা- জান্নাতুল ফেরদৌস লাবণ্য
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৯ মে ২০১৯ | ৯৪৯ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • shakil | 7834.111.562323.120 (*) | ০৭ জুন ২০১৯ ০১:৩২48195
  • Hi there it’s me, I am also visiting this web site on a regular basis, this web site is, in fact, good and the users are actually sharing nice thoughts
    https://bestbuycapm.com/best-mini-tripod/
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন