এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • প্রবাসীর পত্র

    Indrani লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ | ১৬৪৭ বার পঠিত
  • বাংলালাইভে ২০০৬ - ২০০৭ এ নিয়মিত বেরোতো প্রবাসীর পত্র। সেই ঝাঁপি থেকে কিছু কীটদষ্ট লেখা আজ আশ্বিনের রোদে মেলে দেওয়া গেল।
    হলদে কাগজ, মৃত মথ, ঝাপসা তারিখ - আমার খেরোর খাতার এই শুরু।
    ************************************

    জল-মাটি-মানুষ

    বসতখানি জনপদে। আকাশ ছুঁয়ে যায় সেন্ট্রাল পয়েন্ট টাওয়ার। দীর্ঘকায় ইমারত, হারবার ব্রিজে সাজানো আমার স্কাই লাইন।
    ঝকঝকে পথঘাট, সাইডওয়াক। সবুজ ছাতার তলায় কফি খাওয়া চলে। সিটি রেল ব্রিজ পেরোয় -খাঁড়িতে শান্ত জল, একঝাঁক বোট। শপিং মলে ম্যানিকুইনগুলি। ছুটির দিনে টরঙ্গা জু, ডার্লিং হারবার, মোনোরেল। গ্রীষ্মসন্ধ্যায় খোলা ঘাসজমিতে জ্যাজ ফেস্টিভ্যাল। হাইড পার্কের ফোয়ারা। ব্যস্ত মানুষজন। সুদেহী, ঝাঁ চকচকে। চেনা মানুষ। চেনা শহর। চেনা আখ্যান।

    অলস দুপুরটি কাটাই লাইব্রেরিতে। বই। সিনেমার ডিভিডি।পুরোনো বইটি হাতে ঠেকে চিল্ড্রেন্স সেকশনে। সাদামাটা মলাটে বৃদ্ধ মানুষটি, না কামানো গোঁফ দাড়ি, ইস্ত্রিবিহীন জামা। কনসারটিনা হাতে। মলিন ছবিটির ব্যাকগ্রাউন্ডে ধূসর ল্যান্ডস্কেপ। লম্বা জটিল নামখানি। জন মেরেডিথের ফোক সং অফ অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড দা মেন অ্যান্ড উইমেন হু স্যাং দেম।
    জন মেরেডিথ, একেবারে প্রথম লাইন থেকেই অনাগরিক সুরটি বেঁধে দেন এইভাবে - "I was only nine years old when my father died, but I have very clear memories of him. He was away droving sheep a lot of the time, out along the lower Darling River and on the Murrumbidgee, down Balranald way where he was born.'
    নাগরিকের অচেনা মানুষ, অজানা পরিবেশ, অপ্রচলিত বাদ্যযন্ত্রগুলি। হারমনিকা, ফিডল, টিন হুইশল, বাটন অ্যাকরডিয়ানের সঙ্গে ব্রুম হ্যান্ডেল আর বটল টপ দিয়ে লগারফোন। সিরিল অ্যাবটের কেরোসিন টিন ডালসিমার।
    ভেড়ার লোম ছাঁটতেন জ্যাক লাসকোম্ব - পঞ্চাশের দশকে তিনি আশি ছুঁই ছুঁই। জনের সঙ্গে তাঁর কথা রেকর্ড করা, এই বইটিতে তার ট্র্যান্সক্রিপশন। অন্যরকম ইংরেজি।
    জ্যাকের একটি গান ওয়েস্টার্ন ভিক্টোরিয়ায় এখনও গাওয়া হয়- দা ম্যান অন দা ফ্লাইং ট্রাপিজের সুরে -
    'You take off the belly-wool,
    Clean out the crutch,
    Go up the neck -
    For the rules they are such.
    You clean round the horns,
    First shoulder go down,
    One blow up the back
    And you then turn around.'
    এরপর কোরাসে --
    'Click, click,
    That's how the shears go,
    Click, click,
    So awfully quick.
    You pull out a sheep,
    He'll give a kick,
    And still hear your shears going
    Click, click-click.'
    বাল্যাবধি ভিন্ন ভিন্ন শেডে ঘুরে ঘুরে গানগুলি শেখা। কার বাঁধা, কার সুর - জ্যাক জানেন না সবসময়।
    কিংবা ইনা পপলওয়াল। পুরোনো ছোট্ট ব্রিক কটেজ, একটি স্টকিং দিয়ে গেটটি বাঁধা। কেরোসিনের কুপি জ্বলে। পাওয়ারের অভাবে রেকর্ড করা যায় না। জন অতি যত্নে লিখে আনেন সেইসব গান -- কোনওটির উপজীব্য এক অপরাধী, কোনওটিতে প্রেমিকের আহ্বান, কোনওটি বা আইরিশ ব্যালাডের অনুকরণ অথবা "বটানি বে' -'Farewell to old England for ever ...
    Singing tooral-i-ooral-iaddiday,
    Singing tooral-i-ooral-i-ay ...'
    জ্যাক লি, এডউইন গডউইন, আর্থার বুকনান, জো ক্যাশমেয়র, ফ্রেড হল্যান্ড, বিলি কফলিন ... মুখে মুখে ফেরে গানগুলি। বুশ ব্যালাডস।
    অসংখ্য গান। অনেক কথা। স্বরলিপির সুর কখনও চেনা, কখনও অচেনা। গানের কথায় এসেছে বুড়ো ঘোড়া, রেললাইন, পাড়ার মেয়েটি, ডোল অফিস, জঙ্গল, মানুষ, জল ...

    দেখা হয়ে যায় অ্যানা রিভসের সিনেমা অয়েস্টার ফারমার। সিডনি শহর থেকে ঘন্টাখানেকের ড্রাইভে হক্সবেরি নদী। মাম্বল আর ছেলে ব্রাউনি সেখানে আটপুরুষের অয়েস্টার ফারমার। সিডনি ফিশ মার্কেট লুঠ করে জ্যাক, বোনের চিকিৎসার জন্য। সেই টাকা মেইল করে দেয় হক্সবেরির ঠিকানায়, ব্রাউনির অয়েস্টার ফার্মে কাজ নেয়। টাকার প্যাকেটটির অপেক্ষায় থাকে। ক্রমশ তার অস্থিরতা, সন্দেহ বাড়ে। ওদিকে ব্রাউনির দাম্পত্য অস্বচ্ছলতায় টলমল।
    আমরা দেখি নদীতীরে ম্যানগ্রোভের জঙ্গল, হাসপাতালের নির্জন জেটি, পোস্ট অফিস, অয়েস্টার চাষের খুঁটিনাটি। উল্কি, ছেঁড়া ফাটা পোশাক, অক্ষৌরিত মুখগুলি, দুর্বোধ্য অ্যাকসেন্ট।

    সাঁকোর ওপর মিলিত হয় জ্যাক আর পার্ল। নদী আর কুকুরটি সাক্ষী থাকে। মাম্বল বানিয়ে চলে একখানি বাথটব - অজস্র মার্বেল আর সেই লুণ্ঠিত ডলার দিয়ে সাজায় পুত্রবধূর জন্য। অয়েস্টার চাষে ব্রাউনি প্রথম পুরস্কার পায়, বৌকে বাথটবটি উপহার দেয়। সহস্র চোখের মতো চেয়ে থাকে মার্বেলগুলি।
    জ্যাক চাকরি ছেড়ে শহরে চলে যেতে চায় কিন্তু শেষ অবধি ফিরে আসে। মাথার ওপর রাতের আকাশ, সেই বাথটবে শুয়ে থাকে জ্যাক আর পার্ল।

    এইভাবেই হঠাৎ কখনও দেখা হয়ে যায় চারণে আর নাগরিকে, অয়েস্টার ফারমার আর শহুরে মানুষে। বইয়ের পাতায় কিংবা সিনেমায়।
    চেনা শহরের ভেতর তখন উঁকি দিয়ে যায় অন্য শহর।
    রেডফার্ন স্টেশনের কাছে চোখে পড়ে কয়েকটি অন্যরকম মুখ, ক্যাফের এককোণে পোষা কুকুর নিয়ে বসে থাকেন মলিনবেশ বৃদ্ধ। জল জঙ্গলের ঘ্রাণ আসে তখন। নদীটি বেশি দূর নয়।


    পরীকথা

    পরীর সঙ্গে আমার শেষ দেখা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোট গল্পে। তারপর আর কোনও পরীর কাছাকাছি আসা হয়নি।
    একদিন হঠাৎই পরীস্থানের খোঁজ পাই। সিডনি শহরের কাছেপিঠেই পরীরা আছেন। চাইলেই হাজির হবেন তাঁরা। জন্মদিনের আসরে। সকালে, দুপুরে কিংবা সন্ধ্যায়। ফুরফুরে টিংকার বেল, পিনোক্কিওর ব্লু ফেয়ারি, সিন্ডারেলার ফেয়ারি গডমাদার, অথবা সাতরঙা রেনবো ফেয়ারি, ছটফটে বাটারফ্লাই ফেয়ারি, দুষ্টু-মিষ্টি টুথ ফেয়ারি।
    বেশ কয়েকটি অর্গানাইজেশনের সঙ্গে পরীদের দিব্যি জানাশোনা, প্রতিযোগিতাও বেজায় তাদের। এখানকার পরীটি আপনার শিশুটিকে দেবেন ফেয়ারি কৃস্টাল তো ওখানকার পরীটি আনবেন ম্যাজিক নেকলেস। এই পরীটি যদি শিশু অতিথিদের জন্য আনেন পরী আঁকা থালা বাটি, ওই পরীটি আনবেন পরীস্থান স্পেশাল খেলনা পুতুল। আপনি চাইলে, খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থাও পরীরাই করবেন। আপনি শুধু মেনু পছন্দ করুন। বেছে নিন পছন্দের প্যাকেজটি। তারপর ফোন কিংবা ই-মেইল। আপনার আসর কখন শুরু, কজন নিমন্ত্রিত, তাদের বয়স, কোন পরীটি চাই আপনার, কতক্ষণের জন্য -- সব জানিয়ে দিন। আসরে বাচ্চাদের সংখ্যা পনেরোর বেশি হলে অবশ্য দুজন পরীকে আসতেই হবে - সেরকমই নিয়ম- আসলে, গলা তুলে ধমক দেওয়া পরীকে মানায় না। পছন্দের প্যাকেজ অনুযায়ী অ্যাডভান্স টাকা পাঠিয়ে দিন চেকে বা ক্রেডিট কার্ডে আর অপেক্ষায় থাকুন পরীর আবির্ভাবের। শুধু শিশুরা যেন না জানে প্যাকেজের কথা। ওরা জানুক, পরী আসবে।
    এমনভাবেই এক জন্মদিনের আসরে আমার সঙ্গে পরীটির দেখা।
    বসন্তের মনোরম সকাল। রঙিন কাগজের শিকলি আর অজস্র বেলুনে সাজানো ঘরখানা। জনা পরেরোর শিশু পরীর অপেক্ষায়।
    পরীটি আসে। একহাতে তার বেতের টুকরি, অন্য হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড। হাতে গলায় ফুলের গয়না, রঙিন ডানা দুটি, গোলাপি সুদৃশ্য পোশাক, একমুখ হাসি। টুকরি থেকে একে একে বের হয় জাদু শতরঞ্চি, হৃদয় আকৃতির বেলুনসমূহ রং তুলি, গল্পের বই, রঙচঙে সব মোড়ক, একটি ছোট মিউজিক সিস্টেম। বাচ্চারা পরীকে ঘিরে বসে। পরী গল্প বলেন, গান শোনান, খেলাচ্ছলে সবাইকে উপহার দেন। পরীকে ঘিরে শিশুরা নাচে। ছবি আঁকে। পরী রং তুলিতে তাদের রাজকন্যে সাজান কিংবা প্রজাপতি, খরগোশ, জলদস্যু কিংবা স্পাইডারম্যান -- যে যেমনটি চায়। মুঠো মুঠো ফেয়ারি ডাস্ট উড়িয়ে দেন ঘরময়। টুকরি থেকে আরও বেরোয় ললিপপ আর জলছবি। শিশুরা পরীতে মজে যায়।
    সকাল গড়িয়ে দুপুর। প্যাকেজ অনুযায়ী পরীর যাওয়ার সময়। ম্লানমুখ শিশুদের কেউ কেউ পরীর উড়ান দেখতে ব্যালকনিতে এসে আকাশ খোঁজে। পরী বলেন, সামান্য দূরের পার্কটি থেকে উড়ান শুরু তাঁর। সেখানে আকাশ ঢাকেনি উঁচু বাড়ি-ডানা মেলতে সুবিধে।
    সিঁড়ি বেয়ে সদর দরজা অবধি পরীর সঙ্গে আসি। শিশুদের কৌতূহলী চোখ এড়িয়ে তার হাতে প্রাপ্য টাকা তুলে দিতে হবে। সে ক্লান্ত হাসে। পরীর মুখে খিদের গন্ধ পাই। খেয়ে যেতে বলি। ফুলের মধু ছাড়া অন্য কিছু খায় না সে-মিষ্টি হেসে একটু গলা তুলে বলে। শিশুরা যেন শুনতে পায়।
    তারপর হেঁটে যায়। ওর এক হাতে ম্যাজিক ওয়ান্ড, অন্য হাতে ভারি টুকরি। ফিরে তাকায়। ব্যালকনিতে হাত নাড়ে শিশুরা। পরী রাস্তার বাঁকে মিলিয়ে যায়।
    তখন একটি শিশু বলে ওঠে, আচমকাই -"আমি জানি, ও সত্যি পরী নয়। আমি জানি ও উড়তে পারে না। ও হেঁটে গেছে।'
    কার্পেট থেকে ফেয়ারি ডাস্টের শেষ কুচিটুকু তুলে নিল ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। দুপুরের রোদে পরীর ডানাদুটি গলে গেল।


    আইকম্‌ বাইকম্‌ গপ্পগাড়ি

    রোববারের সকালটি ঈষৎ অন্যরকম যেন। যদু মাস্টাররা আজ শ্বশুরবাড়ি যাবেন না। ছেলেপিলের হাত ধরে সোজা এসেছেন সিডনি সেন্ট্রাল স্টেশনে। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে স্টিমে টানা পুরোনো ইঞ্জিন, সঙ্গে ছোট ছোট আটখানি বগি। সেন্ট্রাল থেকে স্ট্র্যাথফিল্ড, লিডকোম্ব, ব্যাঙ্কসটাউন, সিডেনহ্যামের বৃত্তপথে আবার সেন্ট্রালে ফিরে আসা। বসন্তের বই সপ্তায় চিল্ড্রেন্স বুক কাউন্সিল অফ অস্ট্রেলিয়ার উদ্যোগ এই স্টোরিয়েন্টাল এক্সপ্রেস। গপ্পগাড়ি।

    প্ল্যাটফর্মে কাউন্সিলের স্টল। যদু মাস্টারের পকেট কিছু খালি হল শুরুতেই। বাচ্চাদের হাতে এল এক ব্যাগ বই, ব্যাজ, পেন্সিল কেস, বেলুন, এটা সেটা। প্ল্যাটফর্মে ঘুরে বেড়ায় বই-এর পাতা থেকে উঠে আসা চরিত্র সব। ব্যাগি গ্রিন ইউনিফর্মে গল্পগাড়ির কর্মীদের হাসিমুখ। উষ্ণ অভ্যর্থনা। অল অ্যাবোর্ড। সিগনাল সবুজ। গপ্পের চাকা নড়ে উঠল।
    ছোট ছোট পুরোনো বগি। আনাচে কানাচে ভিড় করে আছে গপ্পরা। অবয়বহীন আপাতত। অন্দরসজ্জায় মনে হয় এই বুঝি গোঁফ চুমরে বেরিয়ে এলেন এরকুল পোয়ারো। না, এরকুল নন, কামরায় ঘুরে বেড়ায় উইচ, ডরোথি, অ্যালিস, কাকতাড়ুয়া। অথবা স্টোরিটেলারের ব্যাজ এঁটে স্বেচ্ছা-গল্পবলিয়ে। বাচ্চার ঘিরে ধরেছে তাদের। একধারে টেবিলে রাখা বই। বিস্তর। বিক্রির জন্য। এক এক করে কামরায় আসছেন এখানকার শিশু ও কিশোর সাহিত্যের বিখ্যাত সব লেখক আর ইলাসট্রেটর। পামেলা ফ্রিডম্যান, অ্যালান বেইলি, সুজান জার্ভে, দেভ অ্যাবেলা, জুলি ভাইভাস, ক্রিস চেং। অকাতরে অটোগ্রাফ বিলোন। গল্প বলেন। নিজের লেখা পড়ে শোনান। প্রশ্নের উত্তর দেন। কু ঝিক ঝিক গল্পগাড়ি স্ট্র্যাথফিল্ড পেরোয়।
    একটি কামরায় দেখা হয়ে যায় সুজান জার্ভের সঙ্গে। হাসিমুখ, একমাথা এলোমেলো সোনালি চুল। জমিয়ে গল্প করেন। কিশোর সাহিত্যে সুজানের বেস্ট সেলার "আই অ্যাম জ্যাক' এবং সিকোয়েল "সুপারজ্যাক' আর "বাটারফ্লাই'। "আই অ্যাম জ্যাক' পড়তে পড়তে মনে হতেই পারে মনোজদের অদ্ভুত বাড়ির কথা। সুজান নিজেই বললেন, "আই অ্যাম জ্যাক অ্যান্ড সুপারজ্যাক আর ইনস্পায়ার্ড বাই মাই ওয়ান্ডারফুল ক্রেজি ফ্যামিলি।'
    "বাটারফ্লাই' আবার সম্পূর্ণ বিপরীত -- নিতান্ত শৈশবে দুর্ঘটনায় পুড়ে যাওয়া একটি মেয়ের বয়ঃসন্ধিকালীন একাকিত্ব এবং তা অতিক্রম করে যাওয়া। অনেক গল্প করলেন সুজান। সৎ লেখার কথা বললেন বারেবারে। বাচ্চাদের বললেন লিখে যেতে, শুধু লিখে যেতে -- "জাস্ট লেট ইয়োরসেল্ফ গো'।
    এ-কামরা থেকে সে-কামরা। বই কেনা। লেখকের মুখোমুখি হওয়া। কুইজের উত্তর দেওয়া। গপ্পের চাকা সিডেনহ্যাম তক। পথ ফুরোচ্ছে দ্রুত। এ যাবত কোকের ক্যান আর কমিক্সে ডুবে থাকা সহযাত্রী কিশোরের হাতে উঠে আসছে "বাটারফ্লাই'। কিশোরীর আকুল জিজ্ঞাসা "লিখতে চাই, লিখতে চাই, কেমন করে লিখব?' এই সব।
    লেখক-পাঠক কথোপকথনে ছেলেপুলের তুলনায় বাবা-মাদের উৎসাহই বেশি যদিও। তবু, হয়তো এইভাবেই, একদিন দেখা হয়ে যাবে জামাল ওয়ালেস আর উইলিয়াম ফরেস্টারে গল্পগাড়ির কামরায়। দাগা বুলোতে বুলোতে নিজস্ব লেখাটি লিখে ফেলবে নবীন কিশোর। স্বেচ্ছানির্বাসন ভেঙে বেরিয়ে আসবেন অভিমানী লেখক। উত্তরাধিকার বাহিত হবে। হয়তো।
    হয়তো, সেই বিশ্বাসেই, যাত্রা শেষের সামান্য আগে, কামরার আনাচ-কানাচে লুকিয়ে থাকা গপ্পের একটি সামনে আসে। হঠাৎ। একটি লিফলেট। জানা গেল, এই স্টিম ইঞ্জিন, এই কামরা সব এ যাবত থ্রি ওয়ান জিরো এইট লিমিটেড কোম্পানি দেখাশোনা করে এসেছে। হেরিটেজ ট্রেন ট্রিপ চালু রেখেছে আজ কুড়ি বছর -- সিডনি থেকে সেন্ট্রাল কোস্ট বা সাদার্ন হাইল্যান্ড-জর্জেস রিভারের পাশ দিয়ে, আঁধারময় ওটফোর্ড টানেলের ভেতর দিয়ে উলংগং-এর পাহাড় আর সমুদ্রে। আর মাত্রই তিন মাস। তারপর বন্ধ হয়ে যাবে থ্রি এইট জিরো ওয়ান লিমিটেড। স্টিম ইঞ্জিনটি চলে যাবে নিউ সাউথ ওয়েল্‌স ট্রান্সপোর্ট মিউজিয়ামে। কামরাগুলি নিয়ে নেবে নিউ সাউথ ওয়েলস রেলকর্প-ব্যাকপ্যাকাররা থাকবে এসে। বিশিষ্ট লেখককুল, পাঠকবৃন্দ যদি নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ারকে অনুরোধ করেন, তবে এ যাত্রা গপ্পটির পরিণতি বিয়োগান্ত হয় না। লিফলেটের বক্তব্য এইটুকুই।

    লক্ষণ তেমন নয় যদিও। সেন্ট্রালে কোঁচা সামলে নেমে যাচ্ছেন যদু মাস্টার। জামাল আর ফরেস্টার ঠিকানা বিনিময় করছেন। ঝোলাব্যাগের দুরূহ কোণে অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে লিফলেট, প্রিমিয়ারের ঠিকানা সহ; দুয়েকটি হাত ফস্কে হাওয়ায় লাট খাচ্ছে অথবা ঝকঝকে নতুন বইয়ের পেজমার্ক হিসেবে উঁকি দিচ্ছে। প্ল্যাটফর্ম ফাঁকা হচ্ছে ক্রমশ। যদু মাস্টার সামান্য অন্যমনস্ক এই মুহূর্তে। পকেটের কলমটি সুড়সুড়ি দেয়।

    গল্পগাড়ি তার বাঁশি বাজায় -টুউউট, টুউউট। স্টিম মিশে যায় রোব্বারের বাতাসে। মুচকি হেসে পষ্ট বলে যায়-"অমাবস্যা। ঘোড়ার ডিম।'


    স্মারক অথবা-

    ইদানীং পোস্টারে ছয়লাপ পাড়া। ল্যাম্পপোস্টে সাঁটা, উঁচু দেওয়ালে টাঙানো অথবা ফুটপাথে ইষৎ হেলিয়ে দাঁড় করানো চড়া হলুদের ওপর কালো মোটা হরফে লেখা পোস্টার -সেভ আওয়ার অ্যানজ্যাক হেরিটেজ বা সেভ গ্রেথওয়েট অথবা রাইট মরিস ইমিডিয়েটলি কিংবা স্টপ মরিস সেলিং আওয়ার অ্যানজ্যাক হেরিটেজ .. এইসব।
    মরিস নিউ সাউথ ওয়েলসের প্রিমিয়ার।

    লেখার সঙ্গে কোথাও একটি ম্যাপ বা পুরোনো বিশাল বাড়ির ছবি, কোথাও বা একটি অতি প্রাচীন সিপিয়া রঙের গ্রুপ ছবি-সৈনিকের বেশে, নার্সের পোশাকে নারী, পুরুষ-পরিচ্ছদ, কেশবিন্যাস সবই বেশ প্রাচীনকালের অন্তত একশো বছরের পুরোনো তো বটেই।

    'শ পুরতে আর সামান্যই বাকি। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শুরু। অস্ট্রেলিয়া একটি ফেডের‌্যাল কমনওয়েলথ সেই সময় -- বয়স বছর পনেরো। নিউজিল্যান্ড আর অস্ট্রেলিয়ার সেনা মিলে তৈরি হল অস্ট্রেলিয়া অ্যান্ড নিউজিল্যান্ড আর্মি কর্পোরেশন বা অ্যানজ্যাক - মিত্রশক্তির নৌবাহিনীর অবাধ প্রবেশের জন্য অ্যানজ্যাক আক্রমণ করল গ্যালিপলি পেনিনসুলা। উনিশশো পনেরোয়। প্রায় আট হাজার অস্ট্রেলিয়ান সেনা নিহত আর আহতের সংখ্যা অগণন।সেই সময় নর্থ সিডনি অঞ্চলের জনৈক স্যার থমাস ডিবস নিউ সাউথ ওয়েলসকে দান করলেন তাঁর বিশাল ভিক্টোরিয়ান ম্যানসন "গ্রেথোয়েট', আহত অ্যানজ্যাক সেনাদের শুশ্রুষার জন্য। উনিশশো ষোলো থেকে উনিশশো আশি রেডক্রস ব্যবহার করে গ্রেথওয়েটকে। আশি থেকে স্বাস্থ্য দফতর দায়িত্ব নেয় এই বাড়ির একটি নার্সিং হোম চালু করে।

    এখন এই বিশাল বাড়ি, সংলগ্ন বাগান ব্যবহারের অযোগ্য সর্বতোভাবে স্বাস্থ্যদফতর চাইছে গ্রেথওয়েট বিক্রি করে দিতে, চাইছে ম্যানসনটি ভেঙে গড়ে উঠুক একটি কারপার্ক, কিছু টাউনহাউস। এর আগেও, চুরানব্বই নাগাদ, সরকার একই প্রস্তাব এনেছিল কিন্তু জনমত ছিল এবারের মতোই অর্থাৎ প্রস্তাবের বিপক্ষে। সেই সময় এলেকশনের মুখে তাই বিক্রির প্রস্তাবে ধামাচাপা পড়ে। এখন আবার উদ্যোগী হয়েছে গভর্নমেন্ট। তবে, এই সময়, শুধু প্রতিবাদ নয়, নর্থ সিডনি কাউন্সিল এবারে সরকারের থেকে বাড়িটি কিনতে চেয়েছে -রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব কাউন্সিলের। একটি হেরিটেজ পার্ক গড়ে তুলবে কাউন্সিল, ম্যানসনটি অটুট রেখে। হলদে কালো পোস্টারগুলির পশ্চাৎপট এইটুকুই।

    এই বিকেলে স্যান্ডস্টোনের এই ভিক্টোরিয়ান ম্যানসনটির সামনে এসে দাঁড়াই। পোস্টারের ম্যাপ দেখে পৌঁছে গেছি। প্যাসিফিক হাইওয়ের মতো অতি ব্যস্ত রাস্তা থেকে পাঁচ মিনিটের হাঁটা পথ অথচ নাগরিক কোলাহল ফেলে আসছি রাস্তার মুখের পাবটিতে। প্রাচীন বাড়ি, প্রাচীন দুয়ার, অজস্র পাখি ডাকছে- কুলায় ফেরা পাখি সব, সূর্য অস্তগামী। হাল্কা হিমভাব।
    প্রবল অযত্নের চিহ্ন সর্বত্র। আগাছা, বিষাক্ত ঝোপ-ঝাড়, কুকুরের বর্জ্য, বিয়ারের ক্যান, প্লাস্টিক ইতস্তত -ভারী ট্রাকের টায়ারের দাগ ঘাসে। দুটি অতি প্রাচীন ডুমুর গাছ। তিনতলা প্রাসাদোপম বাড়িটির জীর্ণ অতি জীর্ণ দশা। প্রাচীন উদ্যানটিতে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল একটি ঘটনা।

    এই যুদ্ধস্মারক সংরক্ষণ নিয়ে ভারী গন্ডগোলে পড়ি একবার। সেদিন বাড়িতেই ছিলাম। একাই। দুপুরের দিকে জানলা দিয়ে হঠাৎ দেখি অ্যাম্বুলেন্স, দমকল, পুলিশের গাড়ি - কার কি হল ভাবতে ভাবতেই দরজায় করাঘাত। সিনেমায় যেমন দেখি তেমনই সপ্রতিভ ভঙ্গিতে আইডেন্টিটি কার্ড দেখান তরুণ পুলিশ অফিসারটি - "যে অবস্থায় আছেন, সেই অবস্থায় বাইরে বেরিয়ে আসুন, নীচের স্টোরেজে গুটিকয়েক গ্রেনেড পাওয়া গেছে।' অগত্যা পাসপোর্ট আর ল্যাপটপটি হাতে, চটি পরেই সটান বাইরে। জানা গেল, আমারই ওপরতলার বাসিন্দার কিছু জিনিসপত্র রাখা ছিল স্টোরেজে - বৃদ্ধ মারা গেছেন বহু বছর, বৃদ্ধাও অসুস্থ নার্সিংহোমে। তাঁদের পুত্রটি এসে স্টোরেজ পরিষ্কার করতে গিয়ে গ্রেনেডগুলি দেখে ও তৎক্ষণাৎ পুলিশে খবর দেয়। অফিসার নাম-ধাম খাতায় লিখে কাছের থানায় কফি খাওয়ার আমন্ত্রণ জানালেন। বাঘে ছুঁলে আঠারো ঘা, থানায় কফি খেলে কত -- এরকম কোনও কাল্পনিক মানসাঙ্ক কষে অকুস্থলেই দাঁড়িয়ে থাকি আমি। অতঃপর বম্ব স্কোয়াড আসে। জানা যায়, এই গ্রেনেড বিশ্বযুদ্ধের সময়ের - বৃদ্ধ ছিলেন সৈনিক, তিনি নাকি গ্রেনেডগুলি স্মারক হিসাবে তুলে রেখেছিলেন সযত্নে। পুলিশের মত সেরকমই। সত্যি কথা সঙ্গে নিয়ে বৃদ্ধ স্বর্গে গেছেন বহুদিন, বৃদ্ধাও অসুস্থ। অতএব ...

    এই জীর্ণ ম্যানসন, প্রাচীন বৃক্ষদ্বয়, সিপিয়া রং-এর গ্রুপ ছবিটি, গ্রেনেডসমূহ যুদ্ধস্মারক সংরক্ষণের একটি কোলাজ হতে পারত। আদ্যন্ত। অথচ, সেদিন, শেষ বিকেলে, সেই ডুমুর গাছের তলায় কোলাজের এই ফ্রেমটিতে ঢুকে পড়ে আরও একজন। পাঁচ ফুট ছয় ইঞ্চি। ফর্সা। চোখা, সাহেবি গড়ন ...হারবার্ট। হারবার্ট সরকার।
    মুহূর্তে, প্রাচীন গাছটি শমীবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়ে যায়। আয়ুধসকল অপেক্ষায় থাকে।


    পড়শিনগর

    মেয়েটি ছবি আঁকে। ছবি তোলেও। এটুকু জানা ছিল। ক্লেয়র কনরয়। আমার পড়শি। দেখা হয় লন্ড্রিতে। সিঁড়িতে। দেখা হয়। কথা হয় কম। মেয়েটি স্বল্পবাক। আমি মুখচোরা প্রবল। একটু হাসি-কুশল বিনিময় ...আজ গরম বেজায় ... বিকেলে বৃষ্টি নামবে ... এই ফিরলেন বুঝি?
    গত শীতের সকালে মস্ত এক ট্রাক এল বাড়ির দোরগোড়ায়। চারদিক বন্ধ বিশাল রেন্টাল ট্রাক। বাড়ি বদলালে লোকজন যেরকম ট্রাক ভাড়া করে সেরকম। ক্লেয়র সেই ট্রাক নিয়ে বেরোয় প্রায়ই। ছবি তুলতে যায়। কোনওদিন সঙ্গীসহ। কখনও একা। গ্রীষ্মে ওর একজিবিশন। এত বড় ট্রাকে কি এত সরঞ্জাম নেয় -জিগ্যেস করতে ভুলে যাই।
    শীত চলে যায়। বসন্তও। ক্লেয়র আমাকে কার্ড দেয় ওর একজিবিশনের -"লাইট স্পিড - আ জার্নি অ্যাক্রস সিডনি ইন আ পিনহোল ক্যামেরা।' অবাক লাগে। অ্যাত্ত বড় ট্রাক নিয়ে টই টই, তার সঙ্গে পিনহোল ক্যামেরা - মেলে না যেন ...

    আসে শনিবারের দুপুর। ডে স্ট্রিটে গ্যালারিটি। মোরি গ্যালারি। সাদামাটা ব্যবস্থাপনা। দেওয়ালে ফ্রেমহীন ছবিগুলি। আট ফুট বাই তিন ফুট মোটামুটি। সাদা-কালো। প্রতিটি ছবির সঙ্গে সাউন্ডট্র্যাক। এম পি থ্রিতে। ছবি তোলার এক্সপোজারের সমান সময় সাউন্ড ট্র্যাকেরও।
    ছবিগুলি সিডনি শহরের। বা শহর থেকে সামান্য দূরের। যেমন, কুড়ি মিনিট এক্সপোজারের এম টু ট্রান্স -আরবান টোলগেটের ছবি -সাউন্ডট্র্যাকে ট্যাক্সি স্টার্ট নিচ্ছে, খুচরো পয়সার আওয়াজ উঠছে টোলগেটে বা পনেরো মিনিট এক্সপোজারের কন্সট্যান্স ক্লোজ ছবিটি - একটি পরিত্যক্ত কারখানা -- সাউন্ড ট্র্যাকে গেট খোলা-বন্ধ, মেশিনের আওয়াজ গা ছমছমে - এইরকম, গোরে পয়েন্ট অয়েল টারমিনাল, বেরি আইল্যান্ড রিজার্ভ, লাইটহর্স এক্সচেঞ্জ, সিনক্লেয়ার মোটোরস ... আদ্যন্ত নাগরিক ছবি। চূড়ান্ত ব্যস্ত, ক্লান্ত, নির্জন। বন্ধ গেট, পরিত্যক্ত কারখানা, কাঁটা তারের বেড়া, বজ্রগর্ভ মেঘরাজি ফিরে ফিরে আসে ছবিগুলিতে। নেপিয়ান নদীর ছবিতে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্বন্ধে উদাসীন ক্লেয়র-বেরি আইল্যান্ড রিজারভেও একটি শূন্য বোট বাঁধা থাকে পাড়ের কাছে -তিনটি বোট উল্টে রাখা ঘাসজমিতে - আবছা জঙ্গল - বিজনতরুমূলে জল ছলছলিয়ে উঠছে...

    গ্যালারির এককোণে ক্লেয়রের পরিকল্পনার ভিডিও বিবরণ ক্লেয়র অঙ্ক কষছে -পিনহোলের মাপজোক, এক্সপোজার টাইমের হিসেবনিকেশ। ট্রাক ভাড়া করছে। তারপর ট্রাকটিতে ঢুকে শাটার বন্ধ করছে। নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ভেতরে। সে টর্চ জ্বালায়। ড্রিল করে তৈরি করে সুগোল ছিদ্র। বাকি ফুটোফাটা ব্ল্যাকটেপ দিয়ে ঢাকে ... অর্থাৎ? অর্থাৎ ট্রাকখানি-ই আদতে পিনহোল ক্যামেরা! সকালে-সন্ধ্যায় কতবার ট্রাকটি বাড়ির দোরগোড়ায় , কল্পনাও করিনি তার পিনহোলনয়নের।

    গ্যালারি থেকে বেরিয়ে ঝাঁ ঝাঁ দুপুর। ব্যস্ত শহর একলা ঝলসাচ্ছে। ক্রসিংয়ে সিগনাল সবুজ। কালো, সাদা, লাল, রুপোলি গাড়ি, মোটরবাইক, বিরাট ট্রাক ...বাসা বদলায় কেউ। আর, তার লটবহরের সঙ্গে, বন্ধ শাটারের সুগোল রন্ধ্র বেয়ে কখন ঢুকে পড়ে ফেলে আসা শহর। ট্রাকের ভিতর। কাঁটাতারের বেড়া ... বন্ধ কারখানা ... একলা তরীখান ... এক্সপোজার বদলে বদলে যায়। শাটার পড়ে। নির্মাণ চলে। পড়শির পিনহোল ক্যামেরায়।


    প্যাচওয়র্ক কুইল্ট

    '...বরিশালের কৃষকজীবন নিয়ে একটা কিংবদন্তি তখন খুব চালু ছিল। ক্ষেতে বর্ষা নেমেছে, হাঁটু অবধি জল, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে দুই চাষী ধানের চারার রক্ষণাবেক্ষণ করছে। প্রথমের প্রশ্ন, "ক দেহি, মহারাণী ভিক্টোরিয়া এহন কি করতে আছে?' ।।। উত্তর, "হে কি আর আমাগো মতো? পানি নামতেই পান্থাভাত খাইয়া কাঁথামুড়ি দিয়া উব্বুত ...'। রোমন্থন অথবা ভীমরতিপ্রাপ্তর পরচরিতচর্চা -তপন রায়চৌধুরী।

    ...'The bed itself was decorated with a patchwork quilt of great antiquity; and at the upper end, upon the side nearest to the door, hung a scanty curtain of blue check, which prevented the Zephyrs that were abroad in Kingsgate Street, from visiting Mrs. Gamp's head too roughly'.. Martin Chuzzlewit'- Charles Dickens.
    *************************************
    পাড়ার কমিউনিটি নোটিশবোর্ড। পিয়ানো শিক্ষক চাই .. অভিজ্ঞ বেবি সিটারের জন্য এই নম্বরে যোগাযোগ করুন .. যোগ শিখতে আসুন কিংবা ক্যারাটে .. মেদ কমাতে চান? .. আগামী পরশু গ্যারাজ সেল.. কুকুরছানা হারিয়ে গেছে.. একখানি কুইনসাইজ খাট জলের দরে বিক্রি হবে.. তারই মধ্যে চোখে পড়ে .. ফ্রম মাদার্স টু ডটার্স ঃ অ্যান একজিবিশন অফ প্যাচওয়ার্ক কুইল্টস। ভেন্যু নর্থ সিডনি হেরিটেজ সেন্টার, আমাদের পাড়ার স্ট্যান্টন লাইব্রেরির দোতলায়।

    অস্ট্রেলিয়ায় কলোনি পত্তনের গোড়ার দিকেই কুইল্ট আসে। এলিজাবেথ ফ্রাই কয়েদী সংশোধনাগারে কাজ করতেন। জাহাজে করে মহিলা কয়েদীরা যখন অস্ট্রেলিয়ায় আসছেন, এলিজাবেথ তাঁদের হাতে তুলে দিলেন প্যাচওয়ার্কের টুকরো, সূঁচ-সুতো। দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রায় তৈরি হতে লাগল প্যাচওয়ার্ক কুইল্ট। নকশা করা ছোট ছোট কাপড়ের ফালি সাজিয়ে প্রথম স্তর। তার তলায় ইনসুলেশন আর ব্যাকিং। একসঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে সূঁচ সুতোয় - তৈরি হয়ে যাচ্ছে প্যাচওয়ার্ক কুইল্ট।

    নয়খানি সিল্কের ফালি, ন'রকম রঙ, জুড়ে জুড়ে গড়ে ওঠা হীরকাকৃতি টুকরোগুলি পরপর সেলাই করা। এইভাবেই প্রথম স্তর। কিংবা "ইংলিশ পেপার টেম্পলেট পদ্ধতিতে হেক্সাগোনাল প্যাচ -- দুশো বছর আগে বিলেতে তুমুল জনপ্রিয় ছিল; মোটা কাগজ বা কার্ড ব্যবহার করে হেক্সাগোনাল প্যাচটি তৈরি করা, তারপরে কাগজটি সরিয়ে নেওয়া। কখনও হয়তো ভুল হয়েছে, কাগজ সরিয়ে নেওয়া হয়নি, কুইল্ট ততদিনে ঠাকুমা থেকে নাতনীর ঘরে, কাগজটি অটুট তখনও। অথবা লগ কেবিন কুইল্ট। চৌকোনা প্যাচওয়ার্কটি ব্লকটি মাঝখানে। তাকে ঘিরে লম্বাটে ফালিগুলি -- কখনও ডায়মন্ড, কখনও ক্রস, কখনও হার্ট, গাঢ় বা হাল্কা শেড মেলানো মেশানো। একটি লগ কেবিন কুইল্ট দেখলাম ১৮৮৭ নাগাদ তৈরি -- মধ্যিখানে তিনটি রিবন, একটিতে ক্রাউন, পরেরটিতে রানি ভিক্টোরিয়া, তার পরেরটিতে ভিক্টোরিয়ার জুবিলি সন ১৮৮৭। রিবন তিনটিকে ঘিরে রোজ, শ্যামরক, থিসল আর লিক-ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, স্কটল্যান্ড আর ওয়েলসের প্রতীক। মহারানির মহার্ঘ্য বালাপোষ।

    আর ওয়াগ্গা কুইল্ট। অনভিজাত, খেটে খাওয়া মানুষের দিনযাপন। অস্ট্রেলিয়ার ওয়াগ্গা ওয়াগ্গার একটি ময়দার মিলের বস্তা ব্যবহার করা হত কুইল্টগুলির ব্যাকিং মেটেরিয়াল হিসেবে। সেই থেকে এই নাম। দর্জির দোকান অথবা সেলসম্যানের ফেলে দেওয়া স্যাম্পল বুক থেকে নেওয়া হত কাপড়ের টুকরো। প্যাচওয়ার্কের জন্য। আর পুরোনো ছেঁড়া মোজা, সোয়েটার ভরে দেওয়া হত ইন্সুলেশনের জন্য।

    আঠেরোশো ছেচল্লিশ সালের একখানি কুইল্ট দেখলাম -- এক পুরুষের তৈরি। নাবিক ছিলেন তিনি। তাঁদের হামেশাই জাহাজের বিশাল বিশাল পালে রিফুকর্ম করতে হত। সেই দক্ষতাই কাজে এসেছে এক্ষেত্রে। পেপার টেম্পলেট ঘরানার সিল্কের এই কুইল্টটির চারপাশে সাদা লেস। বড় যত্নে বসানো। নাবিক নিজেই বসিয়েছিলেন নাকি নাবিকঘরণী -- কে জানে?

    কুইল্টের ভিড়ে ব্যতিক্রম একটি ড্রেসিংগাউন। ইটালি থেকে অস্ট্রেলিয়ায় আসে একটি মেয়ে, জুমা কারও। হাইস্কুলে পড়ার সময় সে নিমন্ত্রিত হত বন্ধুদের বাড়ি, রাতে থাকত সেখানে। বড়লোক বন্ধুরা সব। সিল্কের রাতপোশাক, ড্রেসিংগাউন। জুমার সাধ হোত। সাধ্য ছিল না। একদিন সে নিজেই বানিয়ে নিল নিজের ড্রেসিংগাউন। পুরোনো কাপড় কেটে। প্যাচওয়ার্কের কাজ সারা গায়ে। অদ্ভুত সুন্দর।

    ক্রেজি কুইল্ট ঘরানায় প্যাচগুলি ইচ্ছেমতো সাজানো। প্যাটার্নহীন। আপাত। তবু একটা নকশা কোথাও থেকেই যায়। অস্ট্রেলিয়ায় অভিবাসী আর শরণার্থীদের তৈরি কুইল্টের মোটিফে গোড়ার দিকে এসেছে তাঁদের ফেলে আসা দেশ, বাড়ি, ঘর, প্রকৃতি .. শ্যামরক, থিসল, লম্বা ডাঁটি সাদা লিলিক্রমে তা বদলে গেছে অস্ট্রেলিয়ান মোটিফে .. ক্যাঙারু, কোয়ালা, সাদার্ন ক্রস, নক্ষত্রপুঞ্জ..

    .. এদিকে তো সাগরপারে রানিমা বালাপোষ মুড়ি দিয়ে নিদ্রা গেলেন। ওদিকে নিজভূমে পরবাসী সব। বরিশাল থেকে গোয়ালন্দ হয়ে বনগাঁ সীমান্তে ট্রেনটি থামে। মোটিফ বদলে যেতে থাকে .. ছুটির দুপুরে জানলার খড়খড়ি বেয়ে ঘরে ঢোকে মায়াবী আলো, সাদা দেওয়ালে কালচে ডোরা আড়াআড়ি, নারকেল গাছের সিল্যুয়েট। মোটিফ বদলে যাচ্ছে .. ব্লাইন্ডের আড়াআড়ি ডোরা, সিল্যুয়েটটি মেপল ট্রির। মোটিফ বদলে যায় খাঁড়ির শান্ত জলে ঝাঁক বাঁধা বোটগুলি। মোটিফ বদলায় আবার .. রাতে আকাশে তারা ফোটে একটি দুটি .. সেই আকাশে হেলান দেয় নিঃসঙ্গ একটি ক্রেন। ব্রিজ কাঁপিয়ে ট্রেন চলে যায় কোথায় .. মোটিফ বদলে যেতেই থাকে প্রবাসীর জোড়াতালির নকশিকাঁথায়। চিরকাল।


    সেতুপ্রসঙ্গ

    দক্ষিণ গোলার্ধের শরৎ-সূচনায় সেতুটি পঞ্চসপ্ততি বৎসরে পদার্পণ করিল। অস্ট্রেলিয়ার নামোল্লেখেই যেমন ক্যাঙ্গারু, কোয়ালা এবং ক্রিকেট ভাবনায় ভাসিয়া উঠে, তেমনই সিডনি শ্রবণে মনশ্চক্ষে উদিত হয় অপেরা হাউজ এবং হারবার ব্রিজ। এই সেতুটিরই পঁচাত্তর পূর্ণ হইল সম্প্রতি। বিশাল সে সেতু। সম্ভবত পৃথিবীর প্রশস্ততম; অথচ ফেব্রুয়ারি-অন্তে এক সন্ধ্যায়, সেতুটিতে যান চলাচল বস্তুত রুদ্ধ হইয়া পড়িয়াছিল। নীলবর্ণ বাসগুলি বিবিধ বর্ণের ও আকৃতির মোটর গাড়ি সকল, মোবাইক, সাইকেল প্রভৃতি সকল প্রকার যানবাহনের গতি স্তব্ধ হয় সেইদিন। হেতু বিবৃত করি এইক্ষণে।

    দুখানি বিশালাকৃতি প্রমোদতরণী সেইদিন সিডনি বন্ধরে নোঙর করিয়াছিল -- কুইন মেরি এবং কুইন এলিজাবেথ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী সময়ে এই প্রথম দুই সুবিপুল বিলাসবহিত্র একত্রে সিডনি আসিল। অতএব জনতা হুজুগে মাতিলেন। প্রভাতে কুইন মেরি যখন বন্দরে আসিতেছিল, নবোদিত সূর্যদেব বহিত্রের বিশাল ছায়াটিকে বন্দরের নিকটস্থ সুউচ্চ হর্ম্যরাজিতে স্থাপন করিলেন। অতঃপর পাজামা পরিহিত সদ্য নিদ্রোত্থিত জনতা হর্ম্যের উচ্চতমতলে আরোহণপূর্বক রাজকীয় দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করিয়া যৎপরনাস্তি আনন্দিত হইয়া প্রাতঃরাশ ভুলিলেন। কর্মস্থলে পৌঁছিয়া কহিতে লাগিলেন -- "ওঃ ইট'স হিউজ। ওঃ ইট'স গর্জাস।' অতপর, মধ্যাহ্নভোজনকালে বিলাসতরণীযুগলের উচ্চতা, আয়তন এবং অবশ্যই উক্ত তরণীদ্বয়ের আরোহীগণের সুবিপুল ধনের পরিমাণের আনুমানিক নিরুপণ চলিল। ফলত, ভোজনান্তে তৃপ্তির উদ্‌গারের সহিত সামান্য দীর্ঘশ্বাস মিশিয়া গেল।

    অতপর সন্ধ্যা নামিল। সেই রাত্রিকালেই একটি তরণীর বন্দরের কাল সমাপ্ত হইবে। এতদুপলক্ষ্যে রাত্রি নয় ঘটিকায় আতসবাজির আয়োজন করা হইয়াছে। অতএব, জনতা কর্মক্ষেত্র হইতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া, বেশ পরিবর্তনান্তে পথে নামিলেন। আপন আপন গৃহের দূরত্ব অনুযায়ী, কেহ পদব্রজে অগ্রসর হইলেন, কেহ মোটরযানে রওনা হইলেন, কেহ বা রেলশকটে আরোহণ করিলেন। কাহারও সহিত পরিবার, জল, দুগ্ধ, শিশুখাদ্য। কেহ বিয়ারের বোতল আঁকড়িয়া বন্ধুসমভিব্যহারে যাত্রা করিলেন। আপন আপন বিবেচনামতো সকলেই সংক্ষিপ্ত ও নিরাপদ পথ নির্বাচন করিয়াছিলেন। কিন্তু সকল পথ আসিয়া হারবার ব্রিজে মিলিয়া গেল, ফলতঃ জনতা গতিরুদ্ধ হইলেন। নয়টা বাজিতে বিলম্ব নাই।। অথচ যানসকল একই স্থলে দণ্ডায়মান। শিশুদিগের কেহ কেহ সজোরে ক্রন্দন শুরু করিল, কেহ সেই অতীব সঙ্কটকালে প্রাকৃতিক বেগ অনুভব করিয়া আপন আপন জনক জননীর অপার বিরক্তিভাজন হইল। যানারোহী সকলেই তারস্বরে হর্ন বাজাইতে শুরু করিলেন এবং পার্শ্ববর্তী যানচালকের প্রতি কভু হতাশ কভু ক্রুদ্ধ লোচন স্থাপন করিতে লাগিলেন। কেবল, মদ্যপসকল শকটের গবাক্ষপথে মুণ্ড নিষ্ক্রমণপূর্বক উল্লাসের ধ্বনিতে যাত্রাপথ মুখর করিতে লাগিলেন। এই বিচিত্র সিম্ফনিতে তরণীদ্বয় যোগ দিল -- তাহারা গুরুগম্ভীর নিনাদে শিঙা ফুঁকিতে লাগিল। পুনঃ পুনঃ ভেঁপু নির্ঘোষ শুনিয়া সকলে ললাটে করাঘাতপূর্বক কহিলেন, "জিসাস! অই বোধকরি শুরু হইয়া গেল।' বাস্তবিকই বাজি শুরু হইয়া গিয়াছিল। নয়টা বাজিতেই আকাশে একখানি আলোকবিন্দু উঠিল, এক বিন্দু হইতে বাহির হইয়া আসিল সহস্র বিন্দু আলো -- কখনও তাহা সিংহের কেশরের ন্যয়, কখনও একটি বৃহৎপুষ্পের উড্ডীয়মান স্বর্ণালী পরাগরেণু সদৃশ, কখনও অগ্নিবৃক্ষরূপ। সেতুতে সেইসময় কাহারো কাহারো অবস্থান অনুকূল ছিল -- তাঁহারা বাজি দেখিয়া হৃষ্টচিত্ত হইলেন। বাকি হতভাগ্যসকল সেই স্থলে রুদ্ধগতি যানে আসীন হইয়াই পরিবহনমন্ত্রীর ঊর্দ্ধতন চৌদ্দ গোষ্ঠীর শ্রাদ্ধশান্তি সমাপ্ত করিলেন। রাজ্যের নির্বাচন আসন্ন সেইসময়।

    পরদিন সকল সংবাদপত্রের প্রথম পাতাটি দখল করিয়াছিল দুই বহিত্র এবং রুদ্ধগতি সেতুটি। দুই সপ্তাহ অতিক্রান্ত না হইতেই সেতু পুনরায় সংবাদশিরোনামে আসিল। সেদিন, ষোলই মার্চ, তাহার এই পঞ্চসপ্ততি বয়োপ্রাপ্তি উপলক্ষ্যে জনতা পদব্রজে সেতু অতিক্রম করিয়াছিলেন। পুলিশে স্বেচ্ছাসেবকে শহর পূর্ণ ছিল; প্রশাসনের তরফে, সেতুর উপর সকল প্রকার যান চলাচল বন্ধ রাখা হইয়াছিল। বিশেষ ব্যাজে, টুপিতে, টি শার্টে জনতা সাজিয়াছিলেন। ভারতীয়, ফিলিপিনো, পূর্ব ইউরোপিয়ান, ব্রিটিশ, চৈনিক, জাপানি, কোরিয়ান, আফ্রিকান -- কৃষ্ণ, বাদামি, শ্বেত, পীত -- কেহই বাদ পড়েন নাই -- সকলেই হাঁটিয়াছিলেন। এই সম্মিলিত পদচারণার প্রত্যক্ষ বিবরণ লিপিবদ্ধ করিতে প্রবাসী অপারগ। উক্ত দিবসের প্রাক্কালে প্রবাসীর নিকট বঙ্গভূমের একটি অঞ্চলের দুই রাত্রি পূর্বের নরমেধের বিশদ বিবরণ আসিয়াছিল। সে হাঁটে নাই।


    বসন্তের উত্তর

    শীতের শুরুটা এরকমই। শিরশিরে হাওয়া। পাতা ঝরতে থাকে। শুকনো মরা পাতা। বাদামি, হলদে। হাওয়ায় পাকসাট খায়, তারপর মাটি ছোঁয়। কম্যুনিটি নোটিসবোর্ডে গাঁথা কাগজগুলি হাওয়ায় ওড়ে। লম্বাটে, চৌকোনা, আয়তাকার, লাল, গোলাপি, সবুজ কাগজ। আয়তাকার কাগজখানিতে চোখ যায়। তিব্বতী শ্রমণদের অনুষ্ঠান -মন্ডলা-- নর্থ সিডনি কাউন্সিলের একটি সভাগৃহে। পাঁচদিনের অনুষ্ঠানের প্রথম দিনই উপস্থিত হই। যেতে বেলা হয়ে যায়। ততক্ষণে শুরু হয়ে গিয়েছে "মন্ডলা' নির্মাণ। সুবিশাল সভাগৃহের মাঝখানে বর্গাকার বিশাল একটি নকশার হালকা আভাস, তিনজন ভিক্ষু আসনপিঁড়ি, পাশে পিতলের বেশ কয়েকটি শঙ্কু রাখা, ভিন্ন রঙের সূক্ষ্ম মসৃণ প্রস্তরচূর্ণ ভরা শঙ্কুগুলি ...
    তিব্বতী বজ্রযান বৌদ্ধধর্ম অনুযায়ী "মন্ডলা' স্বপ্নসম্ভব, অলীক আদর্শ জগৎ সকল জীবের ঠাঁই সেথায় এবং ধ্যানে কেবল ধ্যানেই উপলব্ধি করা যায় "মন্ডলা'। প্রাচিন পুঁথিপত্র মেনে অতি যত্নে তৈরি হয় "মন্ডলা'। দেখলাম, শ্রমণত্রয় আসনপিঁড়ি অবস্থায় সামনে ঝুঁকে ছোট ধাতবদন্ড দিয়ে শঙ্কুর সম্মুখভাগ ঈষৎ ঘর্ষণ করছে, সেই মৃদু ঘর্ষণে সূক্ষ্ম প্রস্তরচূর্ণ ভরে দিচ্ছে নকশার ছোট ছোট অংশগুলি -- লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ...এইভাবেই ধীরে ধীরে "মন্ডলা' নির্মাণ। তারপর এই অসাধারণ আলপনাটি এক নিমেষে পরিষ্কার করে ফেলা হবে -- অনিত্য জীবন বোঝাতে। ভাসিয়ে দেওয়া হবে নদীতে। নদী বহন করবে ওই প্রস্তরচূর্ণ, বালি -- সকল প্রাণীর কাছে বয়ে নিয়ে যাবে শুশ্রুষা, শান্তি, সম্প্রীতি -- ওঁদের বিশ্বাস তাই।

    শীতের শুরুতে "মন্ডলা' নির্মাণশেষে ভিক্ষুরা যখন নদীতে ভাসিয়ে দিচ্ছিলেন আলপনার অবশেষ, সেই সময়ে শোনা গিয়েছিল "সেক্রেড ফুটস্টেপস ফ্রম দ্য রুফ অফ দ্য ওয়ার্ল্ড' -- অস্ট্রেলিয়ায় এসে পৌঁছেছিলেন দলাই লামা, জন হাওয়ার্ড টালবাহানা করছিলেন শীতের এই বিশিষ্ট অতিথির সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে, হাওয়ার্ডকে চাপে রাখতে রোজ হুমকি দিচ্ছিল চিন, চিনের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার মুক্ত বাণিজ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত হচ্ছিলেন সবাই, আমাদের মনে পড়ে যাচ্ছিল, ঠিক এই কারণে দলাই লামার বেলজিয়াম সফর বাতিল হওয়ার কথা। অবশেষে চিনের হুমকি উড়িয়ে দিয়ে হাওয়ার্ড দেখা করেছিলেন শীতের অতিথির সঙ্গে। দশদিনের সফর নির্বিঘ্নে শেষ হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় ড্যামেজ কন্ট্রোলের চেষ্টায় নেমেছিলেন হাওয়ার্ড। ততদিনে অলীক ভুবনের অবশেষটুকু ভাসিয়ে নিয়েছিল নদীটি।

    এই সময় পেঙ্গুইনটি এসেছিল। শীতের আর এক অতিথি। এসেছিল আড়াই হাজার কিলোমিটার সাঁতার কেটে। কোস্টাল নিউজিল্যান্ড থেকে। খাবারের খোঁজে বেরিয়ে, সিল আর হাঙরের হাত থেকে বাঁচতে দলছুট হয়ে। অর্ধমৃত অবস্থায় পৌঁছেছিল অস্ট্রেলিয়ার সেন্ট্রাল কোস্টে। অত্যন্ত দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির পেঙ্গুইনটি -- ফিওর্ডল্যান্ড ক্রেস্টেড। তার এই দুঃসাহসিক সমুদ্রযাত্রার পরই জানা গিয়েছিল আর মাত্র ২০০০টি পেঙ্গুইন আছে এই প্রজাতির। টরঙ্গা জুতে আশ্রয় হয় তার -- নাম হয় মিস্টার মুনরো, নিউজিল্যান্ডের তার বাসস্থান মুনরো বিচের নামে। জু'র বিশেষজ্ঞরা চাইছিলেন এখানে একটি মিলন ঘটুক, নতুন প্রাণ আসুক। টরঙ্গা জুতে আমি যখন তাকে দেখতে যাই, সে তখন অনেকটাই সুস্থ; ছোট ছোট ফেয়ারি পেঙ্গুইনদের কর্যকলাপ ঘাড় বেঁকিয়ে দেখছিল কিঞ্চিৎ অবজ্ঞাভরে। কমলা ঠোঁটটি তার, চোখের ওপর দিয়ে হলদে পালকের বাহার। শেষ বিকেলের সূর্যের আলোর পড়েছিল তার ওপর। সেই ছবি তুলতে গিয়ে আমি আবিষ্কার করেছিলাম ক্যামেরার ব্যাটারি শেষ।

    ফুরনো ব্যাটারি, ভিজে ঠান্ডা হাওয়া, সেন্ট্রালকোস্টের সাইক্লোন, খবরের কাগজের হেডলাইন হয়ে প্রিজনভ্যানে মুখ গুঁজে বসে থাকা মানুষটি -- আমাদের শীতকাল এইভাবেই কেটে যেতে থাকে। ফুরিয়েও আসে এক সময়। মরা ডালে পাতার অঙ্কুর দেখি। খবর আসে -- মিস্টার মুনরোর মিলন ঘটেছে সেই ছোট ছোট পেঙ্গুইনদের দুই মহিলা চকি আর মিলফোর্ডের সঙ্গে। ডিম ফুটবে শিগগিরি। এই বসন্তেই। ...

    শ্রমণত্রয় আসনপিঁড়ি । সামনে ঝুঁকে, ধাতবদন্ড দিয়ে শঙ্কুর সম্মুখভাগ ঈষৎ ঘর্ষণ করে চলেন , মৃদু ঘর্ষণে সূক্ষ্ম প্রস্তরচূর্ণ ভরে দেয় নকশার ছোট ছোট অংশগুলি -- লাল, নীল, সবুজ, হলুদ ...
    এবং নদীটি বয়ে চলে।


    এই সময়

    এখন সময় বড় অন্যরকম। এখন সময় উদ্বেগের, সময় বিষাদের। কোথায়ও বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন শিশুশরীর, কখনও রক্তে ভাসে স্টেশনচত্বর, শপিং মল, ভিড়ে ঠাসা স্টেডিয়াম, অথবা অ্যাম্বুশের মাঝখানে পড়ে যায় সাধারণ যাত্রীবাহী বাস-বুলেট গেঁথে যায় নিরীহ শিক্ষিকাকে, সন্ধ্যাবেলা ঘরে ফেরে না গৃহস্থ-স্রেফ লশ হয়ে যায়, নরদেহের টুকরোয়, রক্তে মাখামাখি পড়ে থাকে আমাদের চটি, জুতো, পুতুল, টিফিন কৌটো কিংবা বাজারের ব্যাগ। সময় বড় অন্যরকম। সময় বড় ভয়ের, সময় বড় অস্বস্তির। তুতোভাই, সিমকার্ড আর ওয়ান ওয়ে টিকেটে সন্তাসবাদীর সংজ্ঞা নিরুপণ। বুক বাজিয়ে ধর্মযুদ্ধে যায় মহাশক্তিধর, ধর্মগ্রন্থের ভুল ব্যাখ্যায়, অসম্পূর্ণ উদ্ধৃতিতে ফতোয়া জারি হয়ে যায় হুটহাট, ত্রিশূলের উঁকিঝুঁকি এদিক-ওদিক। সুশিক্ষিত মানুষের নখ দাঁত দেখা যায় ঘরোয়া আসরে। এ বড় ভয়ঙ্কর সময়।

    এসময় অন্যরকম। এ বড় বিস্মৃতির সময়। সকালের হেডলাইন বিকেলে মনে পড়ে না, আজকের কথা কাল ভুলে যাব, কালকের কথা পরশু। যদিও তাঁর অনুবাদ লাখে লাখে বিকোয়, এই অদ্ভুত সময়ে আটশো বছর আগের মানুষটিকে ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। মনে করায় ইউনেস্কো -- দু'হাজার সাতকে রুমির বছর ঘোষণা করে, সেই সূত্রেই এই শহরেও আসেন জালালুদ্দিন রুমি, সুফি সাধক, মরমিয়া কবি। সেদিনের সন্ধ্যায় সিডনি টাউন হলে ইউনেস্কো আর টার্কির পর্যটন বিভাগের উদ্যোগে অনুষ্ঠান --Whirling Dervishes - ঘুরন্ত ফকির। দু'হাজার আসনের প্রেক্ষাগৃহে কানায় কানায় ভরা। টার্কির ওপর একটি ভিডিও ক্লিপিং আর দুজন মন্ত্রীর ভাষণের পরে অনুষ্ঠানের সূত্র ধরিয়ে দেওয়া হয়। খুব সংক্ষেপে বলতে গেলে, ওটোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকেই রুমির অনুসারীরা "সামা'য় অংশ নেন। সামা খুব সম্ভব আরবী শব্দ-অনেক অর্থের মধ্যে একটি অর্থ খুব মন দিয়ে কিছু শোনা। সুফি মৌলবীরা রুমির কিছু পংক্তির সুরমূর্ছনায় ঘুরবেন, ভাববিভোর -- সেই থেকেই ঘুরন্ত ফকির কথাটি।

    স্বল্পালোকিত মঞ্চে একে একে জনা কুড়ি পুরুষ ঢুকলেন -- ধীরগতি, বিনম্র -- কালো জোব্বা, লালচে টুপি - সিক্কা। এক বৃদ্ধের টুপিতে শুধু সবুজ বর্ডার। বৃদ্ধ মঞ্চের ডানদিকে হাঁটু মুড়ে বসলেন -- বাকিরা মঞ্চের মাঝখানে তিনটি ধাপে কারোর হাতে বাদ্যযন্ত্র -- সবই অচেনা প্রায়। কেউ বা খালি হাতে -- তাঁরা গাইবেন -- সামনে স্বরলিপি। গানের দল ওপরের ধাপে, মাঝের ধাপে বাদকবৃন্দ আর নীচে সাত আটজন হাঁটু মুড়ে যাঁদের সামনে স্বরলিপির খাতা বা বাদ্যযন্ত্র কিছুই নেই। শুরুতে বাঁশি বেজে উঠল মৃদু, ধীরলয় -- "বাঁশি শোনো, শোনো বাঁশি/বাঁশি বাজে বিরহের, বাঁশি বলে ভালোবাসি'। বাঁশির পরেই একক পুরুষকণ্ঠ সুর ধরলেন -- পয়গম্বর মুহম্মদের উদ্দেশে -- অনেকটা আজানের মতো -- 'Who cares for painful days now gone/For you remain, O pure one.' একক কন্ঠের সঙ্গে সুর মেলালেন বাকিরা, আর সমস্ত বাদ্যযন্ত্র বেজে উঠল। বৃদ্ধ উথে দাঁড়ালেন। সামনের সারির ওই আটজন একে একে বৃদ্ধের দিকে এগিয়ে এলেন। প্রথমজন বৃদ্ধের কাছে এসে মাথা ঝোঁকালেন, বৃদ্ধও ঝোঁকালেন মাথা। বৃদ্ধ সামান্য এগোলেন, প্রথমজন তখন বৃদ্ধের জায়গায় দাঁড়ালেন, দ্বিতীয়জন এলেন, সেই একইরকম অভিবাদনের আদান-প্রদান -- এবারে প্রথম এগিয়ে গেলে, দ্বিতীয় ওই জায়গা নিলেন -- এইভাবে বৃত্তপথে ঘুরতে লাগলেন সবাই -- তিনবার পরিক্রমা এইভাবে নিশ্চিত জ্ঞানে, নিশ্চিত দর্শনে, নিশ্চিত উপলব্ধিতে -- In every company, I moaned and I cried/The miserable and the happy, both in friendship tried'.
    সুর বদলে গেল। বৃদ্ধ আবার মঞ্চের ডানদিকে এলেন -- প্রথম দরবেশ এগিয়ে এলেন -- বৃদ্ধের খুব কাছে -- বৃদ্ধ তার কানে কানে কিছু বললেন -- তিনি সামান্য এগিয়ে দাঁড়ালেন -- দ্বিতীয় এলেন বৃদ্ধের কানে-কানে কথা হল। 'Come, come whoever you are/Wanderer, worshipper, lover of living, it doesn't matter/Ours is not a caravan of despair/Come, even if you have broken your vow a thousand times/Come yet again, come come.'
    এবারে দ্বিতীয়জন প্রথমের কাছে এসে তাঁকে প্রদক্ষিণ করলেন যেন, প্রদক্ষিণ শেষে খুলে ফেললেন কালো জোব্বা -- ভিতরে সম্পূর্ণ সাদা পোশাক -- ঘাগরার মতো -- তলায় চাপা পাজামা -- ওপরেও সাদা জামা বহিরঙ্গের আবরণ ছেড়ে অন্তরে সত্যের সন্ধানে বোঝাতে। ঘুরতে লাগলেন আপন অক্ষ বরাবর, হাত দুটি শরীরের খুব কাছে নিয়ে ঘাড়টি ঈষৎ হেলিয়ে ক্রমে দু'হাত প্রসারিত হল -- ডান হাতের মুদ্রা ঊর্ধগামি, বাঁ হাতের মুদ্রা মাটির দিকে -- ঘুরছিলেন দম দেওয়া পুতুলের মতো -- একে একে বাকি সবাই। এই ঘূর্ণনের অর্থ -- মহাবিশ্ব, মানুষের জীবনচক্র এবং আত্মোপলব্ধিতে "ইনসান-ই-কামিল' হয়ে ওঠা --
    "উদারতায় নদীর মতো যেন, ব্যক্তিত্বে সূর্যস্বরূপ হই/পরদোষ ঢাকি রাতের আঁধার হয়ে, ক্রোধপ্রকাশে যেন মৃতবৎ রই/বিনম্রতায় মাটির কাছেই থাকি, সাগরসম সকল যেন সই/যেমন আছি তেমনই আসি যেন, যেমন আসি তেমনই যেন হই' --
    এক একটি ঘূর্ণনশেষে বাঁ হাতটি ডান কাঁধে আর ডান হাতটি বাঁ কাঁধে রেখে দাঁড়িয়ে থাকছিলেন তাঁরা, পাশাপাশি। তারপর আবার প্রদক্ষিণ, আবার ঘূর্ণন, আবার দাঁড়িয়ে থাকা কোণাকুণি দু'কাঁধ ধরে ..
    "একটি ঘূর্ণন আছে আমাদের গোপনে, গভীরে; ব্রহ্মাণ্ডকে এই, যা ঘোরাও। মাথাও জানে না পা-কে, পা-ও কি জেনেছে মাথাটিরে?'

    আটজন ফকির ঘুরে চলছিলেন মঞ্চে। প্রেক্ষাগৃহ করতালিতে মুখর হচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে বিস্ফোরণে ছিন্নভিন্ন হচ্ছিল মানবশরীরে -- লেবাননে, আফগানিস্তানে, ইরাকে, লুম্বিনী পার্ক লেসারিয়ামে, মাহিম রেলস্টেশনে, লন্ডনের বাসে..সন্ত্রাসবাদীর সংজ্ঞা নির্ধারিত হচ্ছিল ধর্মে ও শ্মশ্রুগুম্ফে। চায়ের পেয়ালার তুফানে বেরিয়ে পড়ছিল ভদ্র সুশিক্ষিত মানুষের নখদন্ত। জালালুদ্দিন রুমি বিস্মৃত হচ্ছিলেন।

    ১০
    অকালবোধন

    দেখা হওয়ার সময় হয় নি এখন। কথা ছিল না কোনই। তবু দেখা হ'ল। হঠাৎ। এই সময়।
    যখন নীলকন্ঠ পাখিটি ওড়ে নি-শিউলি ফোটে নি-কাশের গোছা দুলছে না কোত্থাও-পদ্মটি নাই- পদ্মটি নাই ...
    অস্ট্রেলিয়ান সামার তুঙ্গে,পারা ছুঁয়ে যাচ্ছে চল্লিশ প্রায়-বুশফায়ারে ঝলসাচ্ছে ভিক্টোরিয়া-ঘাম জবজবে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন ...
    অথচ তিনি এলেন।সিডনিতে।শুধুই সিডনিতে।

    প্রস্তুতি ছিল। পরিকল্পনামাফিক।
    দু'হাজার ছয়ের অক্টোবরের মাঝামাঝি শুরু হয়েছিল প্রদর্শনী-'গডেস-ডিভাইন এনার্জি'। নিউ সাউথ ওয়েলস আর্ট গ্যালারিতে।ভারত, তিব্বত আর নেপালের শ' দেড়েক ছবি আর ভাস্কর্য্য। কোনটি বৃটিশ মিউজিয়ম, কোনটি সানফ্রানসিস্কো,কোনটি বা ভারতের সংগ্রহশালা থেকে এসেছে এই প্রদর্শনীতে। দশটি কক্ষে সাজানো ছবি আর ভাস্কর্য্য-ভিন্ন শিরোনামে-'আর্লি গডেস', 'রাধা', 'দেবী', কালী', 'পার্বতী', 'তারা','কালী', 'তন্ত্র', 'বুদ্ধিস্ট গডেস' এবং 'বজ্রযান'।
    প্রদর্শনীর পাশাপাশি, নাচের আসর-ওড়িশি, ভরতনাট্যম। সেমিনার, ওয়ার্কশপ।আর সিনেমা।থীম-'গডেস'।

    এই থীমসরণি বেয়েই তাঁর আবির্ভাবের সূচনা দু'হাজার সাতের ৯-ই জানুয়ারি-'দুর্গা-ক্রিয়েটিং আ গডেস'।
    মূর্তি গড়তে কৃষ্ণনগর থেকে এসেছেন নিমাইচন্দ্র পাল মশাই তাঁর আরো দুই সঙ্গীকে নিয়ে।মুর্শিদাবাদ থেকে এসেছেন ঢাকী ছয়জনা। আর ওয়েস্ট বেঙ্গল ক্রাফট্‌স কাউন্সিলের পক্ষ থেকে উপস্থিত শ্রীমতী রুবি পালচৌধুরী।
    একচালা ট্র্যাডিশনাল প্রতিমার মিনিয়েচার ভারশানটি রাখা থাকে একপাশে আর মূল প্রতিমার খড়ের কাঠামো বাঁধা হয়, মাটি পড়ে তাতে,একমেটে, দো'মেটে... ক্রমে আদল গড়ে ওঠে...লাল রঙের গণেশটি...সবুজ অসুর...আর বাদামী সিংহমশাইএর পিঠে চড়ে কি অপরূপ রূপে বাহির হ'লে জননী-
    নির্মাণের জাদুতে বিদেশী দর্শককুল হতবাক।
    সবিস্ময়ে আর্ট গ্যালারি অপেক্ষায় থাকে ২৬ তারিখের। গ্র্যান্ড ফিনালে। পুজো আর বিসর্জন।

    ২৬শে অস্ট্রেলিয়া ডের ছুটি।আর্ট গ্যালারি উপচে পড়ে মানুষে-ধুতি, শাড়ী,জীন্স, ট্রাকস্যুট, শর্টস-কে আসে নি একচালাটির সামনে? ষোড়শোপচারে পুজো। ধূপ, ধুনো, ফুলমালা, মঙ্গলারতি, অঞ্জলি-
    ঢাকের বাদ্যির তালে শরীর দোলায় বাঙালী আর বিদেশী , মাথা নামিয়ে শান্তিজল নেয়, হাত ভ'রে প্রসাদ। বিসর্জনের সময় হয়ে আসে।
    আর্ট গ্যালারির সামনে নিয়ে আসা হয় প্রতিমা -ট্রাকে করে। ঢাকের তালে শুরু হয়ে যায় বিসর্জনের নাচ-রাস্তার উল্টোদিকের ঈষৎ উঁচু ঘাসজমিতে আমরা ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়াই।
    এই যে অসময়ের পুজো অথচ না-পুজো, এই যে খেলা খেলা বিসর্জন-ঢাকের বোলে মনে আসে না সে'কথা। প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া হাত জোড় করছেন, রুমালে চোখ মুছছেন।আর এই যে আমরা-চোখে চালশে, চুলে পাক-অবশ্যম্ভাবী মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের ছোটবেলা, আমাদের প্রথম যৌবন, মৃত প্রিয়জনসকল-ক্যামেরার লেন্স ঝাপসা দেখাচ্ছে। হয়তো রোদ, হয়তো ধুনুচির ধোঁয়া, হয়তো প্রবাসীর ন্যাকামি কেবল-
    আর্ট গ্যালারির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি-ভুবনমনোমোহিনী-ডাকের সাজে,ঢাকের বোলে, ধুনোর গন্ধে।রাস্তার এ'পারে দাঁড়িয়ে আমরা। মুঠিতে পরের প্রজন্মের হাতখানা।
    পাশে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধ। বিদেশী।শুধোন-'আর ইউ হিন্ডু?'
    'ইয়েস আই অ্যাম।' অ্যাম আই? অ্যাম আই?
    হিন্দুধর্ম-ছাতার তলায় ছাতা-বড় ছাতা, মেজ ছাতা, ছোটো ছাতা-কেমন করে কোন ছাতার তলায় ঢুকে যাচ্ছি আমাহেন ব্যক্তি-এই সব দার্শনিক কচকচি শুরু হয়ে যায়। অর্থহীন ঠেকে নিজের কানেই।
    মাঝের রাস্তাটুকু জুড়ে বিসর্জনের উদ্দাম নাচ চলছে তখন-সেখানে অস্ট্রেলিয়া ডের প্যারেড ফেরত ভীড় করছে মানুষ, হাতে অস্ট্রেলিয়ান ফ্ল্যাগ-বাঙালী, চীনা, বৃটিশ, অস্ট্রেলিয়ান, আফ্রিকান-সাদা, কালো, বাদামী, পীতবর্ণ-মিলেমিশে যাচ্ছে সব-মানুষ, মানুষ, মানুষ শুধু-
    আমরা রাস্তায় নেমে আসছি।আলগা হচ্ছে মুঠো। হারিয়ে ফেলছি-খুঁজে পাচ্ছি-হারাচ্ছি আবার-
    ঢাকের বোল ঘা দিচ্ছে বুকে...ঠাকুর থাকবে কতক্ষণ, ঠাকুর যাবে বিসর্জন-ভুবনগ্রাম ভুবনগ্রাম ভুবনগ্রাম...
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ | ১৬৪৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • শুদ্ধ | 126.193.140.28 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ০৫:৫৩47411
  • সত্যিই পরীর ডানা গলে যাওয়াটা টের পেলাম!
  • Ranjan Roy | 24.99.9.248 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ০৬:৪৪47412
  • এই লেখাগুলো দিয়েই তো চিনেছিলাম " সিডনি"র ইন্দ্রাণীকে, বাংলা লাইভের পাতায়।
  • Atoz | 161.141.84.239 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ০৭:৫৯47413
  • ছোটাইদি, মনে পড়ে গেল সেইসব দিনের কথা। সেই মাধবীলতার বারান্দা, সেই মহুয়াডালে আলোকলতার দুলুনি, সেইসব ছড়া, কবিতা,গান, গল্প। প্রত্যেকটা দিন-কত তর্কবিতর্ক, কত গল্পগাছা। বৃষ্টিশেষের কমলা মেঘের নিচে ফুটে ওঠা জুঁইফুলের সুগন্ধ নিয়ে দূর থেকে আরো দূরে চলে যাওয়া হাওয়া, সেই অবিনাশ, সেই নড়ন আর চড়ন, সেই রসায়ণের করিডরে ঝনঝন করে ভাঙা কাচ আর বাতাসে অবিমিশ্র ভালোবাসার ফিসফিস, সেই অদ্ভুত মরুশহরের সন্ধ্যা, সেই উদাসী বৃদ্ধের বাজানো সুর। সব স-অ-অ-ব মনে পড়ে গেল। "কিছুই হারায় না তো, থাকে অবিকল/ শুধু সরে সরে যায় আলোর আড়াল/ নীড়ভাঙা ঝড়রাত, সেও চলে যায়/ রাত শেষে ফুটে ওঠে সোনালি সকাল।"
  • James White | 124.198.37.155 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ১০:২১47410
  • নতুন করে পড়লাম। অসাধারণ।
  • π | 118.12.173.94 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ১১:৪৯47414
  • পরীর ডানা গলে যাওয়াতেই আটকে গেলাম। অন্য লেখাগুলো পরে পড়বো।
  • Ishani Roychaudhuri Hazra | 233.239.255.112 (*) | ০৮ অক্টোবর ২০১৩ ০৫:১৬47415
  • খুব খুব ভালো লাগল ।
  • nina | 78.37.233.36 (*) | ০৯ অক্টোবর ২০১৩ ১০:৪২47416
  • ছোটাই----এই আমার শারদীয়া উপহার-----
    নতুন করে বার বার করে পড়লাম----সেই মেয়ের হাতে লাগানো বারান্দায় মাধ্বীলতা---আকুল হয়ে ফোটা থোকায় থোকায় ফুল-----মিষ্টি মধুর গন্ধে ভরা।
  • I | 24.99.18.36 (*) | ১০ অক্টোবর ২০১৩ ০২:১৫47417
  • প্যাচওয়ার্ক কুইল্ট। আবার পড়লাম, আহ! কিন্তু সবক'টা লেখা কি একসঙ্গে ছিল, ইন্দ্রাণীদি?
  • i | 147.157.8.253 (*) | ১০ অক্টোবর ২০১৩ ০৮:৪৫47418
  • বড়াই,
    না , একসঙ্গে নয়,প্রতি মাসে একটি করে বেরোতো-এক বছরে ১৩ টি লিখেছিলাম। প্রতিটির মুড আলাদা। আমার ব্লগে ১৩ টি-ই আছে। খেরোর খাতায় ১০টি দিলাম একত্রে।

    নিনাদিদি, ঈশানী, পাই, এ টু জেড, রঞ্জনদা,শুদ্ধ, জেমস হোয়াইট,
    পোকা ধরা লেখা পড়েছেন সময় করে-কৃতজ্ঞ রইলাম।
    আর নিনাদিদি,
    পুরোনো লেখা আবার পুজোর উপহার হয় না কি? দেখা যাক কি করা যায়!
  • U | 172.229.184.102 (*) | ২৮ অক্টোবর ২০১৬ ০৪:০৯47419
  • বালার সেই সোনালি দিনগুলোর স্মৃতি জেগে উঠলো। সেই মাধবীলতা ঘেরা বারান্দায় বসে একসাথে কলতান।
    আরো লিখ, ইন্দ্রাণী। এসে এসে পড়ে যাব।
  • i | 131.44.76.216 (*) | ২৮ অক্টোবর ২০১৬ ০৮:৩৫47420
  • ইউ,
    অনেক ধন্যবাদ। নিক দেখে বুঝতে পারলাম না আপনার পরিচয়। পুরোনো মজলিশিদের একজন-এইটুকুই যা মনে হ'ল।

    এ পাতায় এখন আর নিত্য যাওয়া আসা নেই আমার।
    সম্ভব হ'লে http://dattaindrani.blogspot.com.au তে একটু ঘুরে আসবেন । মজলিশ পরবর্তী প্রায় সব টেখাই পেয়ে যাবেন ওখানে।

    ইতি আই ( মানে ইন্দ্রাণী, সিডনি)
  • Atoz | 161.141.85.8 (*) | ২৮ অক্টোবর ২০১৬ ০৮:৪৯47421
  • বহুদিন তোমার সঙ্গে কথা হয় না ছোটাইদি । আজকে এখানে তোমাকে দেখে ভাবলাম এখানেই শুভ দীপাবলি জানিয়ে যাই। ঃ-)
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভ্যাবাচ্যাকা না খেয়ে প্রতিক্রিয়া দিন