এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • পালানোর দিন

    Tim লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ | ৮৬৩ বার পঠিত
  • "৯৭ নম্বর ওয়ার্ডের নাগরিক কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হচ্ছে, এবছর মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকের ...."

    একটা অটো বা ভ্যান রিক্শায় মাইক ফিট করে কেউ বলতে বলতে যাচ্ছে। সরু রাস্তার জন্য সেই স্বর কখনও থমকাচ্ছে, কখনও কেঁপে যাচ্ছে যান্ত্রিক এলোমেলোতায়। সাতানব্বই নম্বর ওয়ার্ডের প্রায় প্রতি গলি এঁদোগলিতেই ঘুরবে এই গাড়ি অন্তত একবার। সেইসব বাড়ির বারান্দা জানলা আর রোয়াকে উৎকর্ণ কিছু কান, কিছু বুকে চিনচিনে ব্যথা, কোথাও বা সামান্য পুলক। পিঠগুলো অল্প ভিজে উঠছে গুমোটে আর উত্তেজনায়। হাওয়া বইছে কখনও যদিও, তবু।

    সময়টা বাংলা মাধ্যম ইশকুলের স্বর্ণযুগ, যখন ছেলেরা ও মেয়েরা মিশতো টিশতো না। একঝলক চোখের দেখা, সামান্য ইশারা এইসব হলেই সে গল্প পল্লবিত হয়ে আলাদীনের আশ্চর্য্য প্রদীপ হয়ে যেত। প্রেম শব্দটি অতীব খারাপ কথা ছিলো। তাও অবশ্য লোকে প্রেম করতো এদিক সেদিক, গুরুজনেরা সেসবকে পিওর প্লেটোনিক লভ বলে আত্মপ্রসাদ পেতেন এবং চ্যাংড়ারা যথেচ্ছ আলোচনা করতো। সম্বচ্ছরের যাবতীয় অনুষ্ঠান, যার অধিকাংশ আজ পরম অবজ্ঞায় ধর্মীয় রিচুয়াল বলে অগ্রাহ্য করি, সেই সময় মূলত ছেলেমেয়েদের মেলামেশার জানলা ছিলো। সরস্বতীপুজোর কথা সবাই জানে। কিন্তু সবাই জানতো বলেই সেইটা ঠিক নিরাপদ ছিলোনা। আলোর বৃত্তে দাঁড়ালে পিঠে বেত পড়তো। তাই অন্য ছুতো।

    যাই হোক, গাড়িটা ঘোষণা করে টরে চলে যাওয়ার কদিন পরেই, মহালয়ার দিন বা তার আসেপাশেই, নাগরিক সম্বর্ধনা উপলক্ষে তুমুল আপ্লুত হলাম সবাই। পড়াশুনোয় সেরা ও অসেরা লোকজন সমানভাবে তাদের প্রতিভা, দেহসৌষ্ঠব, অন্যান্য আবশ্যকীয় দক্ষতা যেমন ব্যাটের হাত বা লাথির জোর বা "নারী-পুরুষের গভীর সম্পর্কের" জ্ঞান ইত্যাদি বিজ্ঞাপিত করতে লাগলো। উদ্দেশ্য, নাগরিক মঞ্চ থেকেই প্রেমের ইঁদুর দৌড়ে নিজেদের গুছিয়ে রাখা। এই সেই দিন, যেদিন সবাই নিজের নিজের তূণীর থেকে একটা চোখামত জামা পরে কিঞ্চিৎ মাঞ্জা দিয়ে সবাইকে ঠারেঠোরে "এখনই দেখচিস কি আরো আসছে, বাপ" বলে রাখবে।

    অতঃপর সেই দিন এলো। সে কি প্রচন্ড উত্তেজনা না বললে বিশ্বাস করবেন না। যেন পুজো এসেই গেছে। যেন পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলো সবে এই। যেন দেশটা ভারত ও রাজ্যটা পঃ বঙ্গ নয়। অকুস্থলে পৌঁছে দেখি লোকে লোকারণ্য। স্থানীয় একটি স্কুলের বিশাল প্রাঙ্গনে এই অনুষ্ঠান। আমাদের ওয়ার্ডে যে সমবয়সী এত ছেলেমেয়ে আছে জানতামই না। সবাই নিজ নিজ মাঞ্জাসচেতন হয়ে বিশ্রম্ভালাপে ব্যস্ত, হারপুন থেকে ব্যাঙের জননতন্ত্র সব নিয়েই বকবক চলছে। অর্ধেকটা দত্ত পাল চৌধুরি মুখস্থ বলতে পারে যে ছেলেটা সে আড়চোখে চারপাশ দেখে নিয়ে তবেই ইকোয়েশন ঝাড়ছে, যে ডাক্তার হবেই এবং কিসের হবে তাও জানে সে খুব সফিসাব্যস্ত হয়ে, প্রায় প্রেসক্রিপশন লেখার একাগ্রতায় কচিকলাপাতা শাড়ীকে লক্ষ্য করছে। এইসবের মাঝে আমি, বাবার একটা অল্টার করা প্যান্ট আর গতবছরের পুজোর জামা পরা, ফুটবল খেলে চাকরি পেতে হবে এবং সেই চাকরিতে অন্তত গ্র্যাজুয়েট না হলে পিয়নের কাজ করাবে এই ভয়ে পড়ালেখা করা আমি, কেমন হারিয়ে গেলাম। যতই সন্ধে এগোতে লাগলো, যতই চৌকস চকচকে ছেলেমেয়েরা তাদের বিভিন্ন ব্যুৎপত্তি আর অভ্যাগতরা তাঁদের জেল্লা মেলে ধরতে লাগলেন ততই মিইয়ে যেতে থাকলাম। শেষে এমন হলো, যে পালাতে পারলে বাঁচি। কিন্তু পালাতে দিলে তো। একে একে সবাইকে মঞ্চে ডাকা হবে, গিয়ে হ্যান্ডশেক করে বইয়ের বোঝা কাঁখে করে নেমে আসতে হবে। তবে সাবধান, জিভ জড়িয়ে যেন না যায়, চোখের পলক যেন না পড়ে, পায়ে হোঁচট যেন না আসে। শেক করবো কি, নার্ভাস হয়ে হাত ফাত ঘেমেই অস্থির। একপাশেই একজন পাতার নিয়ে ফান্ডা দিচ্ছে, অন্যপাশে মৃদু গুজগুজ তৃতীয় পর্যায় পঞ্চম শ্রেণীর মেয়েটিকে নিয়ে, যার দৃষ্টি কিছুতেই এদিকে ফিরছেনা। এরই মধ্যে মঞ্চে " একটি মোরগের কাহিনী"।

    সবে ভাবছি পালাবো কিনা, বইগুলো তো পেয়েই যাবো পরে কমিটির অফিস থেকে, এমন সময় পেছনের সারি থেকে একজন গম্ভীর গলায় নাম ধরে ডাকলেন। সেই সময় আমি সমস্ত বাবাদের বেজায় ভয় পেতাম। আমার নিজের বাবা অত্যন্ত ভালোমানুষ ও বকাঝকা অপছন্দ করা লোক, কিন্তু বাকি যাঁদেরই দেখতাম, সবারই গোঁফে রক্তের ছিটে আছে বলে মনে হত। যুগের দোষ, সে যাক গে। আমি সেরকমই কেউ ভেবে পেছন ফিরে দেখি, বুড়োর দাদু। অন্তত সত্তর বছর বয়স হবে তখন ওনার। রিটায়ার্ড। বায়োলজির টিউশন ফি ও দরকারে অদরকারে বই কেনার টাকা জোগাড় করতে ততদিনে ছুটকো ছাটকা টিউশনি করি। বুড়ো সেই অগতির গতি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে একজন, এবং খুবই মেধাবী একজন। নামেই প্রকাশ, অকালবার্ধক্যের জন্য এ ছেলের পড়ালেখা বাদে কিসুই হবার জো নেই তবে সে অন্য গল্প, অন্য কোনখানে।

    দাদুর গলার আওয়াজে একটু সচেতন হয়ে চট করে ভাবার চেষ্টা করলাম যে এতক্ষণ কি করছিলাম। ফার্স্ট রো'র কোনার দিকে যে মেয়েটা অবিশ্রাম হেসে চলেছে তাকে কয়েকবার দেখেছি, দাদু কি সেটা লক্ষ্য করছিলেন? আমার পাশের ইয়ারদোস্ত মাঝে মধ্যেই দু-অক্ষর চারক্ষর বলেছে কি এর মধ্যে ফিসফিসিয়ে?
    কিন্তু আমাকে আশ্বস্ত করে দাদু অন্য গল্প জুড়ে দিলেন। দিব্যি সব পুরোনো গল্প, দেশভাগের গল্প ও নানান উপাদেয় চেনা মনখারাপের গল্প সেসব। পন্ডিত মানুষ, সারাদিন বইপত্তর পড়ে অকালে ছেলে চলে যাবার শোক ভুলে থাকেন, সবেধন নীলমণি ঐ নাতি। আস্তে আস্তে কেমন একটা মায়া হলো, ওঁর পাশে গিয়ে বসলাম। চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা, পাওয়ার মনে হলো ঠিকঠাক নেই কারণ মাঝেমধ্যেই মুছতে হচ্ছিলো ওঁকে সেটা। তার্পর বাকি সন্ধেটা আর একটুও পালাতে ইচ্ছে করেনি আমার। বা, বলা উচিত হয়ত আমি পালাতে পেরেছিলাম অনেক বিশ্বাসযোগ্যভাবে, যেমন পরের আরো অনেক অনেক বছর ধরে পালাতেই থাকবো এরকম অসংখ্য সব জমায়েত থেকে।

    সেদিন আর কী কী হয়েছিলো আজ আর মনে নেই। তারাপদ রায়ের জ্ঞানগম্যি না রবিঠাকুরের ( এখানে বলে রাখি রবিঠাকুর বলে একজন আমাদের বাড়িতে বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে আসতেন, মানে ঘটক আর কি, এই সত্যি কথাটা এমনকি আমার বউও বিশ্বাস করতে চায়না, অথচ যাঁকে নিয়ে গোলমাল সেই বিখ্যাত নেমসেকই বলে গেছেন সত্যের অদ্ভুৎ হওয়ার বাধা নেই কারণ সত্য থোড়াই কেয়ার করে কে কি ভাবলো) গল্পগুচ্ছ পেয়েছিলাম তাও আজ আর আলাদা করে মনে করতে পারিনা, কিন্তু এই পালাবার অদৃশ্য চিলেকোঠা আবিষ্কার আমার মহালয়ার স্মৃতির সাথে জড়িয়ে গেছে।

    আজ আরো একটি মহলায়ার দিন, আরো একটি পুজোর ছুটিতে বাড়ি না যাওয়াটা ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে ওঠার সাথে সাথে এইসব পুরোনো ফালতু কথারাও কাছিয়ে এসেছে। অবশ্য এখানে এমনিতেই এই সময় জানলার কাচ ঝাপসা থাকে আর কখনো সখনো বরফ পড়ে, কাজে কাজেই ব্যাপারটা একেবারেই বেমানান সেকথা বলতে পারিনা।

    পালানোর দিন -২

    তো, পালানোর দিন আর কার্য্যকারণের অভাব মানুষের কোনদিনই হয়না। একটা আস্ত মধুর শব্দ এসকেপিস্ট রয়েছে ব্যাটাদের জন্য বরাদ্দ, শুনলে আলকেমিস্টের মত ঘ্যামভরা লাগে, হলেও হতে পারে নোবেলজয়ী উপন্যাসের নামের মতন। অবশ্য বিশেষনটা অনেক পরে শুনেছি নিজের ক্ষেত্রে, একবার কচিকালে প্রেম না করার (থুড়ি, হওয়ার) জন্য, অন্যবার বিদেশে বসে ল্যাজ নাড়াবার জন্য। বন্ধু বললো, দেশে বসে উপায় আছে জেনেও কম মাইনেতে বেডপ্যান নাড়ানোই দস্তুর, বুড়োবয়সে বাপমার কাছে থাকা দরকার, তাদের চিকিচ্ছের করচ নাই বা যোগাড় হলো, তাতে কি? নিজের কথা ভাবিস তুই? ছি ! জানিস অমুক খেতে না পেয়ে ফলিডল খেলো, তমুকের বিয়ে করা হলো না ইত্যাদি ইত্যাদি। কেউ দেখেনা অমুক এবং তমুকের কষ্টগুলো অনেক সময় বেবাক ভুল পথে চলে যায়, যে বা যাদের জন্য এইসব করা তারা
    (আবারো, অনেক সময়) হয়ত একজন "স্বার্থপর" মানুষের আবেগবর্জিত, যুক্তিনিষ্ঠ যত্ন পেলে ভালো থাকতো। যাক, যা গেছে তা যাক। কথা হচ্ছিলো পালানোর দিন নিয়ে। আরো আরো পালানোর দিন।

    বিখ্যাত সিনেমা বানাবার অনেক আগে থেকেই আমরা জানি বয়েজ ডোন্ট ক্রাই। অপমান হলে, কষ্ট পেলে, অক্ষম রাগে কান লাল হয়ে এলে এবং নিজেকে বাঁচানোর উপায় না পেলেও, নো, নেভার ক্রাই। জিনিসপত্তর ভাঙতে পারেন, বউ/প্রেমিকা থাকলে এবং তারা পুলিশে খবর না দিলে পেটাতে পারেন, অদ্ভুত যোগাযোগহীন (অ্যাজ ইফ চার অক্ষরের গাল খেলে চামড়ায় জ্বালা ধরে মানুষের) খিস্তি দিতে পারেন, মারামারির কথা ছেড়েই দিলাম, কিন্তু প্লিজ কেঁদে আমাগো বীরের জাতিরে এমব্যারাস করবেন না। সেই ঘি চপচপে ইম্পোর্টেড বীরত্বের ঝাঁঝে পাগলা জাতির মেম্বারশিপ নিয়ে (তাও ইকোনমি ক্লাস, থাকলেও ভালো, না থাকলে আরো ভালো) গাল ফোলে, ইমোশনে, অভিমানে, প্রধাণত অবিশ্বাসের অপমানে, বা ধরুন ছোটলোক ফোটোলোক বলে গাল খেয়ে। এইরকম সব পালানোর দিন ছিলো আমার। আর আছে স্রেফ ভয়ে ভোঁকাট্টা হওয়ার দিন। এমন বরষা ছিলো সেদিন, আঁচল ঝরিয়া পড়িলো হায় ইত্যাদি। সেইটে দিয়েই শুরু করি।

    ক্লাস ইলেভেন। টিউশনি করি। তখনও পানু কি জিনিস জানিনা, তখনও এফটিভি, টিভি সিক্স এসব ভবিষ্যতের গর্ভে (প্রসঙ্গত তখন দেশীয় জনতা টিবি-সিক্স মকবা বলে হেবি মস্তি পেত, যেন মকবা মানে হেবি একটা নিষিদ্ধ চ্যানেল)। অমৃতের ফলটল কম খাওয়া হয়েছে তখনও, খানিকটা শরত-বঙ্কিমের কুপ্রভাব, বাকিটা নেহাত সময়ের অভাবে। পড়াতে যাই হেথা হোথা দুয়েকটা। হাতে ঘড়ি মায়ের রিস্টওয়াচ, পাছে সময়ের জ্ঞান না থাকে। পায়ে স্যান্ডাক। সেই সময় এক কিশোরী আমারে ভারি এমব্যারাস করেছিলো। আজ হাসি পায়, নিজেকে ভেবেই, কিন্তু তখন ঘাম দিত তার সিল্ক স্মিতাসুলভ ব্যবহারে। কয়েকদিন পরেই, বোলে সো নিহাল, পালিয়ে আসি। অন্য টিউশনি খুঁজতে হয় এবং ষষ্ঠীর কৃপায় জুটেও যায় অল্পদিনেই। পালিয়ে আসার অনেক মাস পরে শোনা যায় সেইসব ফাঁদটাদ নাকি বিয়ের অছিলা। সেই কিশোরীর পড়াশুনো হয়না এবং যৌবন শুরু না হতেই বিয়ে হয়ে যায়। গোঁফ চুমরে মনে মনে ভারি খুশি হই। আল ইজ ওয়েল। সব চরিত্র নিষ্কলুষ, এবং ভেরি হ্যাপি এন্ডিং।

    পরের গল্প সিরিয়াস। গল্পদ্বয় বলা উচিত অশ্বীনিকুমারদ্বয়ের মত, দুই হয়েও একতাই ক্রেডিট। এক ছাত্রীর বাড়িতে তার কাকা এলেন লখনৌ থেকে। রেওয়াজি লোক, নির্ঘাৎ দিনরাত ক্লাসিকাল শুনতেন। তিনি দিন দশেকের জন্য এলেন, তারপর দুদিন ফুরোতেই বোর হয়ে গেলেন (সম্ভবত) আর এখান সেখান থেকে কাজ খুঁজে টেনে নিয়ে করতে যেতেন। এরকমই একদিন, পড়াতে গেছি। ঘরে ছাত্রীর বদলে কাকা এসে বসলেন। আমি ভাবছি এত বড়ো লোককে কি পড়াবো এমন সময় দ্কেহি উনি নিজেই এটা সেটা প্রশ্ন করছেন। তখন আমার আবার পূর্ব অভিজ্ঞতা মনে পড়লো। কেজানে হয়ত বিয়ের কেস। ওমা না, আসলে ইন্টারভিউ হচ্ছিলো। আমি বিএসসি পড়তে পড়তে কিকরে এইচেসের স্টুডেন্ট পড়াই সেসব খুব আপত্তির সাথে বললেন। আমি, বীরের জাতির ইকোনমি ক্লাস, তো তো করেও বলে উঠতেই পারলাম না তাতে কি মশায় এই করেই তো মেয়েটা পাঁচবছর পর একসাথে ফিজিক্স আর অঙ্কে পাশ করলো। তাই পালিয়ে আসি সেদিন, কাজের তাড়া আছে বলে। তবে আমার ছাত্রীটি সত্যিকারের বীরাঙ্গনা ছিলো, সে প্রবল ঝগড়া করে আমার বাড়ি এসে কেঁদেকেটে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। কাকা চলে যাওয়ার পরেই আমিও আবার পড়াতে শুরু করি, চাবুকের কটা দাগ থেকে যায়, কিন্তু বাকিসব থেকে যায় আগের মতই। আরো একদিনের কথা। এক কলেজের স্টাফ (সম্ভবত লাইব্রেরিয়ান) এর বাড়িতে ছেলেমেয়ে দুটিকেই পড়াই। সেখানে শুরুতেই ভদ্রলোক আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান হলেন। অনেকেই নাকি বলে মাধ্যমিকের অঙ্ক জানি, আসলে জানেনা। কি করি, ভারি মুশকিল। তবে পালাইনি তখনই। পালালাম আরো পরে। ততদিনে আমার খুব সুখ্যাত। পাশটাশ দিয়ে ছেলেমেয়ে দুটি গদগদ হয়েছে। ইলেভেন আর টেনের দুই মক্কেল প্রায় সমবয়সীর মত কথা বলতে চায়। তাতে হলো কি, পারিবারিক সব ব্যাপার স্যাপার সামনে এসে যেত। অদ্ভুৎ সব কেমিস্ট্রি, রহস্যময় কান্ডকারখানা। ওদের বাড়ির একতালাতেই একতা ভাতের হোটেল ছিলো। রোজ সেখানকার বাসি পচা খাবারের গন্ধে গলিতায় ম ম করতো। ওরা দিনরাত বেঁচে যাওয়া খাবারের ওপরেই থাকতো। সকালবেলা উঠে হয়ত দুটো বাসি কাটলেট খেলো। দুপুরে চারটে ডিম দিয়ে ভাত। একটুও বাড়িয়ে বলছিনা। আর খিস্তি। আমার সাথে সবাই ভদ্রভাবে কথা বলে। কিন্তু নিজেদের মধ্যে যাসসেতাই ভাষা। এইসব করতে করতেই একদিন, যথারীতি পালালাম। পড়ানো শেষ করে বলে কয়েই পালিয়ে এলাম। চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে গেলাম দায়িত্ব। যেন ঐ পরিবেশ, ঐ মানুষের অপভ্রংশ বলে যাকে অপমান করি তারা আমার ইতিহাসের শরিক নয়। আকাশ থেকে পড়েছে।
    যে ছেলেটা ফুটবল খেলতে গিয়ে চোরাগোপ্তা যৌন উত্তেজনার সুযোগ খোঁজে, যে মেয়েটা আঁটসাট পোষাকে মাষ্টারমশাইকে সিডিউস করতে চায়, যে বাবার ব্যবহার সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের তালিকায় লম্বা ফিরিস্তি বানাবে, তাও নিজের বাচ্চাদের ওপরেই, তাদের থেকে পালিয়ে যাওয়া, পালিয়ে আসা গুলো আমার কাছে অনেক ভারি লাগে। নিজের বাবা মার থেকে পালিয়ে আসার থেকেও। অন্তত সেখানে সত্যিকারের পালানো কম, যে জানে সে জানে। কিন্তু এইসব পালানো গভীর ক্ষতের মত হয়ে আছে। দোতলার বারান্দা থেকে ছুঁড়ে দেওয়া টিপ্পনি আর বিস্কুটের মত বিঁধে আছে, তাপ্পি দেওয়া প্যান্ট পরার অকারণ অপমানের মত, ইংরেজি কেত না শেখার মত, আরো হাজারো লোকের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়ার কষ্টের মত মিশে আছে রক্তে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ | ৮৬৩ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • kk | 81.236.62.176 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০২:১৮46599
  • বেশ লেখা।
  • ফরিদা | 192.64.3.17 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০২:৫৫46600
  • টিম সব মনে করিয়ে দেয় - কোনকালে পুজোপ্যাণ্ডেলে একটা বারো লাইনের কবিতার শেষ দু-লাইন ফেলে চলে আসা - পালানোর দিনে।
  • aranya | 154.160.226.53 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০৫:৩৭46601
  • বাঃ, সুন্দর
  • ranjan roy | 24.99.42.182 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০৫:৪৩46602
  • টিম,
    খুব ভাল লাগল।
  • সিকি | 127.216.225.5 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০৬:০৮46603
  • হিয়া টুপটাপ জিয়া নস্টাল ...
  • nina | 22.149.39.84 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০৬:১৫46604
  • বড্ড ভাল লেখে ছেলেটা----
  • raatri | 24.99.57.25 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০৬:৩৬46605
  • পিছনের পাতাগুলোয় চোখ চলে যায়,আরো একবার ছুঁয়ে আসি তাদের,ভালোবেসে।
  • a | 209.16.140.28 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০৮:১০46593
  • জমিয়েছো টিম্ভাই। এসব হল সেই সেদিনকার কথা যাদের ভুলে যাওয়া যায়না, তাই অনেক কষ্টে ভুলে থাকতে হয়
  • রোবু | 177.124.70.1 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০৯:২৫46594
  • আহ। আত্মার শান্তি, প্রাণের আরাম। এই লেখাটা খুব আপন লাগলো।
  • | 24.97.180.11 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ০৯:৩০46595
  • আহা চেনা চেনা দুঃখ সুখ ......
  • Tania | 218.87.233.180 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ১০:১০46606
  • ৯৭ নম্বর ওয়ার্ডের এই অনুষ্ঠানে আমিও ছিলাম কোনো একবার। সেই একই স্কুলের প্রাঙ্গন, সেই পাড়া, সেই সন্ধ্যে এত বছর পর আবার এক ঝলক ফিরে পেলাম টিমের লেখায়। ধন্যবাদ ইত্যাদির ফর্মালিটিতে না গিয়ে যাস্ট টুপি খুল্লাম। একটা চলে যাওয়া সময় থেকে একটা সন্ধ্যে ছেঁকে আনার জন্য।
  • Blank | 180.153.65.102 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ১০:৩৩46596
  • খুব ভালো লেখা রে টিম, মন কেমনের লেখা
  • i | 134.170.195.149 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ১১:৪১46597
  • টিম,
    ভালো লাগল ।
  • san | 69.144.58.33 (*) | ০৪ অক্টোবর ২০১৩ ১১:৫৭46598
  • ভাল্লাগলো।
  • pinaki | 148.227.189.9 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৩:১২46607
  • চমৎকার। কিন্তু আমার একটা সংশয় হচ্ছে। এ তো আমার ছোটোবেলার ছবি। হাঁটুর বয়েসী টিমেরও একই ছবি হয় কী করে? তাহলে কি ছবিরা বদলায় নি? ছবিরা কি বদলায় না? তাহলে কি এখনো এরকম ছবি তৈরী হয়ে চলেছে এখনকার ছেলেমেয়েদের জন্য? শুধু আমরা দেখতে পাচ্ছি না?
  • Tim | 12.133.59.201 (*) | ০৫ অক্টোবর ২০১৩ ০৪:২৩46608
  • পিনাকীদা,
    না, তুমি স্রেফ আমাকে বেশি বাচ্চা ভাবছো। ঃ-)
    সবাইকে অনেক ধন্যবাদ পড়ার জন্য।
  • Pubদা | 209.67.138.49 (*) | ০৭ অক্টোবর ২০১৩ ০৯:৩১46609
  • বাহ দারুন লাগলো ।
  • সিকি | 132.177.203.174 (*) | ০৬ মার্চ ২০১৪ ০৩:১৬46610
  • দিনগুলো অন্যরকম হয়ে যায় ...
  • | 24.97.139.236 (*) | ০৬ মার্চ ২০১৪ ০৩:৩৫46611
  • কিছু মিল কিছু অমিল
    কিন্তু তবু পালানোয় মিল আছে ভীষণভাবে।
  • rabaahuta | 172.136.192.1 (*) | ০৬ মার্চ ২০১৪ ০৬:১৭46612
  • পড়লাম- আর অনেকক্ষণ ধরে মাথায় ঘুরেই চলেছে, এরকম কত পালিয়ে যাওয়ার অস্বস্তিকর স্মৃতি।
  • aranya | 154.160.226.53 (*) | ০৬ মার্চ ২০১৪ ০৯:২৯46613
  • ভাল লাগল
  • নী-পা | 113.10.116.29 (*) | ০৬ মার্চ ২০১৪ ০৯:৩৮46614
  • .
    জিয়া ভরলি
  • de | 190.149.51.68 (*) | ০৭ মার্চ ২০১৪ ০৫:৪৫46615
  • ভারী সুন্দর! মন কেমন করা!

    তবে ষষ্ঠীর কৃপয় টিউশনিটা দারুণ!! ঃ)
  • Nina | 83.193.157.237 (*) | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ১১:৩৭46617
  • আবার পড়লাম আবারও মনটা টইটুম্বুর ভাল লাগায় -- টিম্ভাই আরও লেখ অনেক অনেক----
  • Du | 230.225.0.38 (*) | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ১২:৩৬46616
  • অনেকদিন পর টিম তেমনভাবে! মিস করে গেসলাম।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন