এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • খাতাঞ্চী | 127812.61.341212.193 (*) | ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ ০৭:৩৩50070
  • .
  • কুশান | 342323.191.78.187 (*) | ৩১ জানুয়ারি ২০১৯ ০৮:৪৯50071
  • পড়ার আন্তরিক ইচ্ছে রাখি। আলোচনাটি আগ্রহ আরো বাড়িয়ে দিলো।
  • অনিকেত পথিক | 232312.15.3467.241 (*) | ০৩ মে ২০১৯ ০৭:৫৯50072
  • বাঙলায় বললে বিশ্বাসভঙ্গের সময়কাল। নিজের দেশ বলতে যে বিশ্বাস, যে আবেগ, ‘যা-ই হোক, এখানেই থাকব’ নিজের ভিটে মাটি ছেড়ে যেতে হবে না, নামক যে বিশ্বাস তা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যাবার নাম হল দেশভাগ। তাই দেশভাগকে একটা চূড়ান্ত ‘বিট্রেয়াল’ বা বিশ্বাসভঙ্গ বললে একেবারে সঠিক কথাটি বলা হয়। সুতরাঙ দেশবিভাজনের পটভূমিতে দুটি পরিবারের ওঠাপড়ার কথা পর্বে পর্বে লিখলে তাকে ‘সিজন্‌স্‌ অফ বিট্রেয়াল’ ছাড়া আর কিই বা বলা যাতে পারে ! গল্পের আঙ্গিকে লেখক দময়ন্তীর এই লেখা গুরুচন্ডালী পত্রিকায় পর্বে পর্বে প্রকাশিত হয়েছিল, মোটামুটি সেই ‘পান্ডুলিপি’ই আপাততঃ বই হিসেবে আমাদের হাতে।
    দূর্দান্ত প্রচ্ছদ সমেত গোটা বইতে প্রচুর পড়াশোনা ও যত্নের ছাপ স্পষ্ট। দেশভাগের পটভূমিতে লেখা হলেও এই কাহিনী মূলতঃ দুটি পরিবারের দিনযাপনের ও দিনবদলের দলিল, যেখানে দেশভাগ প্রায় একটি চরিত্র হিসেবে উপস্থিত। তাই একটি বহুচর্চিত বিষয় হলেও দেশভাগ এখানে কোনো চর্বিতচর্বণের অনুভূতি সৃষ্ট করেনি। উপমাহীন ঝরঝরে ভাষা এবং লেখকের যা ‘সিগনেচার স্টাইল’ সেই নিরাসক্ত বর্ণনাও এই বইয়ের সম্পদ। কোনো চরিত্রের ওপরই লেখকের কোনো পক্ষপাতিত্ব নেই, যা বিশেষভাবে উল্লেখ করার মত। গল্পের গতি কিছুটা মন্থর। তবে সেটা বড় কথা নয়। কথা হল প্রতিটি পরিচ্ছদের স্থান-কাল খুব সচেতন ভাবে খেয়াল না রাখলে ঘটনার অগ্রগতি বুঝতে অসুবিধে হবে। এই পাঠককে বার বার পাতা উলটে দেখে আসতে হয়েছে, কবেকার ও কোথাকার ঘটনা। সেটা পাঠকের ব্যর্থতা, মানে পাঠক প্রথম থেকে যথেষ্ট মনোযগী নন না কি লেখকের ত্রুটি তা বলা মুস্কিল। যেহেতু কাহিনী মূলতঃ ইতিহাসাশ্রয়ী, আর ইতিহাস একদিকেই গতিপ্রাপ্ত, তাই এত আগে পিছে করে লিখে কি বিশেষ এফেক্ট দেওয়া হয়েছে ঠিক পরিস্কার নয়।
    লেখার মাঝে মাঝে ‘কঠিন’ পূর্ববঙ্গীয় ‘ডায়ালেক্ট রয়েছে। যে পাঠক যাবতীয় পূর্ববঙ্গীয় ‘ডায়ালেক্টে’র সঙ্গে সম্যক পরিচিত নন, তাঁর ক্ষেত্রে অসুবিধে হওয়া অনিবার্য্য। যে পাঠক নিজে ছোটবেলা থেকে পূর্ববঙ্গীয় বাঙলা ভাষায় সঙ্গে ওঠাবসা করেছেন, নিজে ঢাকাই বাঙাল ভাষা ভালো বলতে ও বুঝতে পারেন কিছু ডায়ালেক্ট বুঝতে তাঁরও অসুবিধে হয়েছে। খুব আলাদা ডায়ালেক্টের ব্যবহার কি লেখার রসাস্বাদনের প্রতিকুল নয় ? এটা লেখকের বিবেচনার ওপর ছাড়া ব্যাতীত কিছু করার নেই।

    লেখক মুখবন্ধেই যা বলার বলে দিয়েছেন, তারপরও প্রতি পরিচ্ছদের শেষে পারিবারিক রেফারেন্সগুলো কিছুটা অতিরিক্ত মনে হয়েছে। এই রেফারেন্স থাকার দরুণ পাঠকের মনে কিছু অনাবশ্যক কৌতুহল তৈরী হয়। যেমন প্রমদাকান্ত কবে থেকে কলকাতায় ছিলেন, তাঁর বাড়ির আর সবাই কোথায় গেল, অন্য ভাইরা কেউ দাদার কাছে কেন সম্পত্তির ভাগ চাইল না, অমরিন্দর সিং কিভাবে সাহায্য করলেন, যোগেশের কলকাতা পৌঁছতে ক'দিন দেরী হল কেন, কি দেনা / পাওনা মেটাবার দায় ছিল, তা কিভাবে সারা হল ইত্যাদি। যেহেতু নিটোল গল্প বলার স্টাইলেই লেখা এবং পারিবারিক রেফারেন্স সমৃদ্ধ তাই এই সব প্রশ্ন। যুঁইয়ের কি হল, টুনু-ই কি ছোটপিসী, তাহলে খোকনের সঙ্গে যুঁইয়ের বিয়ে হয়েছিল, যিনি আসলে লেখকের মা ! লেখক ছোটপিসীর শূন্য থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠিত হবার কথা সূত্রে লিখেছেন কিন্তু গল্পে টুনুর কথা প্রায় কিছুই লেখেন নি তাই গল্প কিছুটা খাপছাড়া, হঠাৎ শেষ মনে হল।

    দেশভাগ, নানারকম গোলমাল, তারমধ্যে জীবনের স্বাভাবিক গতি খুব ভালো ধরে পড়েছে। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা গল্পে বস্ত্র সঙ্কটের কথা পাওয়া গেছিল, আবার এখানে সেই রেফারেন্স পাওয়া গেল। নদীর ব্রিজের ওপর বাস থামিয়ে বেছে হিন্দুদের হত্যার মত ভয়ঙ্কর ঘটনার কথা এবং তার অভিঘাতের কথা পড়ে হাড়হিম হয়ে গেল, যদিও লেখক মণীশের পরিবারের কথা কিছুটা উহ্যই রেখেছেন। বালবিধবা দুই মেয়ের কথা পড়ে আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম প্রতিশ্রুতির পিসীঠাকুমাদের কথা মনে পড়ে গেল। আবারও মনে হল হিন্দুরা নিজের ঘরের মেয়েদের ওপর যা অত্যাচার করেছে তারপর আর মুসলমানদের কথা বলা শোভা পায় না। আর ক্ষতবিক্ষত মেয়েটির মুখে ‘হায় খোদা !’ শুনে ডাক্তারবাবুর সঙ্গে পাঠকেরও সব গিসেব গোলমাল হয়ে গেল। এখানে কোনো মন্তব্যই নিস্প্রয়োজন।

    দুটি পরিবারই বাঙলাদেশের, একটি প্রায় উদবাস্তু আর একটি স্থানান্তরিত। মাঝে আছে হিন্দিভাষী বালক জামু যে খুশবন্ত সিং এর ‘ট্রেন টু পাকিস্তান’ এর স্মৃতি বহন করে। শুধু একেবারে এদেশি পরিবারের দৃষ্টিকোণটা দেখা গেল না। এইটুকুকে গল্পের খামতি বলতে মন চায় না কারণ একই কাহিনীতে সমস্ত বিষয় ধরা যায় না। তবে মনটা একটু অতৃপ্ত থাকে, এই যা। মোটের ওপর টান-টান সুখপাঠ্য (বা অবশ্যপাঠ্য) কাহিনী যেখানে ইতিহাস আর পারিবারিক দলিল পাশপাশি চলে। লেখক পারিবারিক কাহিনীর প্রতি উদাসীন থাকার চেষ্টায় চরিত্রগুলিকে কিছুটা অসম্পূর্ণ রেখেছেন, কিন্তু লেখাটি মূলতঃ কাহিনীই হয়ে উঠেছে। পর্বে পর্বে প্রকাশিত এই লেখাকে বই হিসেবে বার করার সময় হয়ত আর একটু সম্পাদনার প্রয়োজন ছিল। তা সত্ত্বেও উপস্থাপনার গভীরতায়, ভাষার সম্পদে এই কাহিনী পাঠককে মুগ্ধ ও আবিষ্ট করে একথা একবাক্যে স্বীকার করি।
  • | 670112.220.2390012.200 (*) | ০৪ মে ২০১৯ ০৭:১৬50073
  • অনিকেত পাঠক,

    অসংখ্য ধন্যবাদ জানবেন। সিজন-২ লেখার সময় এই প্রতিক্রিয়াগুলো অবশ্যই মাথায় রাখবো। (একটা ছোট্ট কথা, ধারাবাহিকের অবিকল পান্ডুলিপি ঠিক নয়, অতিরিক্ত তিনটি পরিচ্ছেদ প্রায় ৯০০০ শব্দের মত অতিরিক্ত বইটিতে অচে)।
  • | 670112.220.2390012.200 (*) | ০৪ মে ২০১৯ ০৭:২১50074
  • সোনালীর প্রতিক্রিয়াটাও আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। এখানে টুকে রাখি।

    =========================================
    সিজনস অব বিট্রেয়াল নিয়ে লিখলেন Sonali Sengupta

    "আগে এমন হতো না। বই হাতে এলেও রাখা আছে নাইটস্ট্যান্ডে। তা দুমাস তো হলোই।আচমকা ছুটিতে পড়লাম Damayanti র “সিজনস অফ বিট্রেয়াল”, গুরুচন্ডালি থেকে প্রকাশিত। ধারাবাহিকভাবে পড়ার সময়ও পড়েছি মনোযোগ দিয়ে ( লেখাটি মনোযোগ দাবি করে )। বিভিন্ন মন্তব্য জানিয়েছি লেখিকাকে। তাও অপেক্ষা করে ছিলাম বইটির জন্য। এবার পুরো বইটি ফের নতুন পাঠকের মত পড়লাম।

    সব ক্রিটিসিজমের আগে ( দমদি আমার থেকে ক্রিটিসিজমই প্রত্যাশা করেন) বইটির অক্ষরসজ্জা ও বিন্যাস নিয়ে দুয়েকটি কথা।( সবাই জানে আমি টেকনিক্যালিটি নিয়ে বড্ড মাথা ঘামাই )
    1. দময়ন্তীদির লেখা মুখবন্ধটি বইটির সবচেয়ে জরুরী সংযোজন। আমি পূর্বে পড়ে ও জেনেও যুঁইকে চিনতে পারিনি, আলাদা আলাদা গল্পে আলোড়িত হয়েছি কিন্তু পুরো ঘটনাক্রমকে সেভাবে গাঁথতে পারিনি। মুখবন্ধটি অত্যন্ত সুরচিত, পরিচ্ছন্ন।
    2. টীকা, উৎস। প্রতি পরিচ্ছেদের নিচে টীকাগুলো খুব যত্নে তৈরি করা। পরিচ্ছেদকে বুঝতে সাহায্য করে, শুধুমাত্র রেফারেন্স না দিয়ে বাক্যে উৎস লেখা পাঠকের মনোযোগ টানে। আমার এটাও খুব ভাল লেগেছে।
    .
    এবার লেখায় আসি।
    দেশভাগ বাংলা ও পাঞ্জাবের সাহিত্যের একটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গা অধিকার করে রেখেছে। অন্যান্য আঞ্চলিক সাহিত্যে যে দেশভাগ আসেনি তা নয় কিন্তু নির্মম, নিষ্ঠুর, সরাসরি বিঁধে যাওয়া অভিঘাতের কাহিনী এই দুই প্রদেশের। এই দুই প্রদেশ ছিঁড়ে যাওয়া মানুষ ও ভূমির প্রতি যে নাড়ির টান বোধ করে তা বারংবার ফিরে এসেছে একটা বিরাট সময় জুড়ে, বিভিন্ন সাহিত্যে। দময়ন্তীদি দ্বিতীয় পুরুষের চোখ দিয়ে এই ছিন্নতাকে দেখার চেষ্টা করেছেন। ফলত হয়ত কোথাও প্রথম পুরুষের যন্ত্রণা তীক্ষ্ম ও আত্মীকৃত, কোথাও ততটা নয়। দময়ন্তীদির প্রাণপণ চেষ্টা ছিল এই পুরুষের যন্ত্রণাকে সরাসরি ধরার, বিভিন্ন বয়ান, রিপোর্ট, গবেষণা ও বইয়ের মাধ্যমে, বইটির নির্মাণের সময় নিরপেক্ষ পাঠক হিসেবে উপস্থিতি থেকে জানি। কতটা সফল সেই চেষ্টা?
    .
    এ বিষয়ে মত দেওয়ার আগে বলি দময়ন্তীদির লেখা আমি কেন আলাদা করে পড়ি এবং ভবিষ্যতেও পড়ব। এই লেখিকার একটি নিজস্ব গদ্যভাষা আছে, যা বাংলার আজকের লেখালিখির পরিসরে ইউনিক। ঘরের ভিতর থেকে উঠে আসা এই ‘খরখরে’, নিরাসক্ত অথচ প্রবলভাবে অন্ত:পুরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ভাষা দময়ন্তীর লেখার সম্পদ। আমি মনে করি এই ভাষা, এই লেখাটাকে আলাদা মাত্রা দিয়েছে। অগুনতি চরিত্র ও ঘটনার বুননের মধ্যে পড়তে পড়তে আমি বারবার অনুভব করেছি একটি পরিবার ছিঁড়ে যাওয়ার, পারিবারিক মৃত্যুর অসহায়তা, জন্মের ও বিবাহের আনন্দ, সম্পদের হস্তান্তর, রক্ষার হাত। কিন্তু, এই সব পরিবারগুলো তো একটি পরিবার নয়, তবে কেন? আসলে দময়ন্তীদির লেখাটির সফলতা আমার কাছে এইটাই। সিজনস পড়তে পড়তে অবিভক্ত ভারতবর্ষ যেন অবিভক্ত এক পরিবার হয়ে ওঠে। অমরিন্দর, জামু, সুখোর মা, এই সব সম্পর্কবিহীন মানুষের চরিত্রের মধ্য দিয়ে লেখিকা আমাকে অন্তত ভারতবর্ষের এই পরিবারচরিত্রটি দেখাতে সক্ষম হয়েছেন, এবং এইজন্যে বইটি আমি সবাইকে পড়তে বলব।
    .
    আগে দময়ন্তীর লেখায় শ্বাস নেওয়ার জায়গার কমতি নিয়ে বলেছি। প্যারা কিছু কম, কিন্তু এখন মনে হয়, একটি নিজস্ব ভাষারীতি তৈরির জন্য এটি দরকার ছিল। থাক।
    লেখাটির জোর যেখানে, দুর্বলতা-ও সেখানে, আমার মতে। দেশভাগের রাজনীতি তৎকালীন মানুষের জীবনে যে প্রভাব ফেলেছিল, তার ফলে তৎকালীন রাজনীতি বা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা, বয়স্কদের কাছে শুনেছি, সমস্ত আলোচনায় কেন্দ্রীয় চরিত্র হয়ে থাকতেন। কিছু কিছু জায়গায় হন্টিংলি ছুঁয়ে গেলেও, এই ব্যাপারটা সার্বিকভাবে লেখায় মিস করেছি। একটি পেইন্টেড, বার্ডস-আই ব্যাকড্রপের অভাব।
    .
    আরেকটি ছোট জিনিস, তা হল, কলকাতার মানুষজন, বা পশ্চিমবঙ্গের মানুষজনের চোখ দিয়ে ছবিটি প্রায় দেখা হয়নি। এই বুননে তাঁদের উপস্থিতি আরো কিছুটা বেশি হলে ভাল লাগত।
    সবশেষে জানাই, এই প্রচেষ্টাকে বা এই লেখাকে বীজ বলে মনে হচ্ছে। হয়ত এই বিষয়ে আরো বড় লেখার দিন সামনে। এই বইটি সেই অপেক্ষাকে তৈরি করছে বলে, আমার কাছে অন্তত এই লেখার সফলতা নিয়ে কোন সন্দেহই রইল না।
    অসীম শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ, দময়ন্তীদি।"
  • i | 7823.33.4590012.233 (*) | ১৬ জুন ২০১৯ ০৫:২১50075
  • সিজনস অফ বিট্রেয়াল ১
    দময়ন্তী
    গুরুচন্ডালি প্রকাশন
    ১১০ টাকা (ভারত)

    সিজনস অফ বিট্রেয়াল যখন বুলবুলভাজায় ধারাবাহিক , আমি তখন মিনিস্ট্রি অফ হ্যাপিনেসে আচ্ছন্ন - সেই সময় বহু বার উদ্ধৃত করে গেছি ' হাউ টু টেল আ শ্যাটারড স্টোরি? বাই স্লোলি বিকামিং এভরিবডি। নো । বাই স্লোলি বিকামিং এভরিথিং।' বস্তুত এই লাইনগুলো আমার নিজের মগজের মধ্যে নিত্যদিন পাক খেয়েছে সেই সময়। দময়ন্তীর লেখা যখন পর্বে পর্বে পড়ছিলাম, তখন পাঠপ্রতিক্রিয়ায় অবশ্যম্ভাবী এই লাইনগুলি বেরিয়ে এসেছিল। অবশ্যম্ভাবী এই কারণেই, এ লেখা সেই বিধ্বস্ত সময়ের ধস্ত মানুষের কাহিনী আর দ্বিতীয়তঃ এ'লেখার উপকরণগুলি-দুটো বিড়াল, চৈত্যাকালী, আঁচল দিয়ে ঘষে তুলে ফেলা টিপ, মাটির হাঁড়িতে জিয়োন টাকি আর কই মাছ, সেই সময়ের পত্রিকার বিজ্ঞাপনের পাতাটি, এমনকি একটি জাঁতিকেও লেখক সুনিপুণ ব্যবহার করেছিলেন কাহিনীর বিবরণে, আর তৃতীয়তঃ ভাষা- পারিবারিক স্মৃতিকথা থেকে লেখার মূল উপাদান যেমন এসেছে তেমনই এসেছে মানানসই অন্দরমহলের ভাষা আর আশ্চর্য সব উপমা ঃ মুসুর দানার মত টিপ, ঘামের চোটে শরীর থেকে বেরিয়ে আসা এক নরশুন্দা জল-
    এই সবই দুঃখদিনের রক্তকমলের পাপড়ি যেন।
    আজ সমস্ত লেখা দুই মলাটের মধ্যে পেয়েছি। পড়ছি যখন, আমি কখনও সাধারণ পাঠক কখনও একজন উপন্যাস লিখতে চাওয়া শিক্ষার্থী।কখনও তাক থেকে নামিয়ে এনেছি বিমল করের দেয়াল। কাহিনী শেষ করে ধারাবাহিক পাঠের মন্তব্য থেকে সরছি না। অথচ এর বাইরে কিছু কথা থেকে যাচ্ছেঃ
    ক) প্রাককথনটি অতীব সুলিখিত। লেখার উপকরণ সংগ্রহ বিশদে বর্ণিত। সেইটি পড়ার পরে, পরিচ্ছেদগুলির তলার কিছু কিছু ফুটনোট আমার অপ্রয়োজনীয় মনে হয়েছে। এই প্রসঙ্গে ছোটো একটি কথা-২৩ পাতায় শেষ লাইনটি, 'শিখখি' রাখার তিনটি প্রক্রিয়ার লাইনটি কি ফুটনোটে যাবে? অর্থাৎ ঐ পরিচ্ছেদের শেষ লাইনটি হবে,'... কলকাতা বিনাপ্রশ্নে আশ্রয় দেয় তাদের'। তাই কী?
    খ)লেখাটি শুরু হয়েছে কিশোরগঞ্জ, ময়মনসিংহে, ১৯৫০ এর মার্চ মাসে, শেষ হচ্ছে রিষড়া, বিশালাক্ষীতলা, ১৯৫০ জুনে। কাহিনীর বিন্যাসে সময় ও স্থান এগিয়েছে পিছিয়েছে, বদলেছে-ধ্বংসের আগুনে আগুনে স্পেস ঘুলিয়ে ছাই ওড়ারই কথা।বা এই স্থান কালের খেলা হয়ত এক অখন্ড দেশের আকার দিতে পারত। বিশেষত এ লেখা যেখানে স্মৃতির পুনরুদ্ধার। অথচ, এ বইতে স্থান কালের খেলা লেখকের আয়ুধ হিসেবে খুব কার্যকর লাগে নি। কাহিনীটি সোজাসুজি বললেও একই অভিঘাত হ'ত সম্ভবতঃ।
    গ) এই লেখাটির বর্ণনা এমনই জীবন্ত , যে লাইনগুলি চোখে ভেসে ওঠে। কিন্তু আমার মনে হয়েছে, যেন ক্যামেরা বসানো আছে, ইনডোর সেট- চরিত্রগুলি তার সামনে কথা বলছে, ক্যামেরার অ্যাঙ্গল একচুলও বদলাচ্ছে না; কখনও আউটডোরে গিয়েও দৌড়ে আবার ফিরে আসছে ইনডোর সেটে । এই চলন আড়ষ্ট লেগেছে আমার।
    ঘ)অমরিন্দরের শিখখি রক্ষার কাহিনী বা জামুর কাহিনী এবং যেভাবে তা বর্ণিত হয়েছে তা এই বই এর সম্পদ, কিন্তু এ বলাও সেই ক্যামেরার সামনে বলে যাওয়া-ক্যামেরা একচুলও স্থান বদলানো না। লেখক স্থান, কাল নিয়ে যখন খেলার চেষ্টাই করলেন, এই কাহিনীগুলি কথকবর্ণিত না রেখে ঐ সময়ে ঐ স্থানে সরাসরি আঁকতে পারতেন না? একথাও ভাবছি।
    ঙ)সামগ্রিক কাহিনী বা উপন্যাস হিসেবে , বই টি থেকে আমার প্রত্যাশা আরো অনেক বেশি ছিল। যখন পর্বে পর্বে পড়েছি, প্রতিটি পর্ব আলাদা আলাদা করে ভালো লাগা সত্ত্বেও অনুভব করেছিলাম , আগের পর্বে ঠিক কী কী ঘটেছে তা সম্পূর্ণ মনে না থাকলেও, এমনকি না জেনেও পরের পর্বটি ভালো লাগে। বস্তুতঃ পর্বগুলি এক এক টি স্বয়ংসম্পূর্ণ রক্তমণি -তার গা দিয়ে রক্ত ও অশ্রু গড়াচ্ছে, অথচ উপন্যাসটি রক্তমণির হার হয়ে ওঠে নি যা প্রার্থিত ছিল। দেবেশ রায় সম্পাদিত 'রক্তমণির হারের' মুখবন্ধ থেকে ধার করে বললে, ' আমি চেয়েছিলাম, এই স্বয়ংসম্পূর্ণ গল্পগুলি যেন তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণতা ভেঙে ফেলে এক মহত্তর আখ্যান গড়ে তোলে'।
    হ'ল না কেন ভাবতে গিয়ে আমার মনে হ'লঃ
    ১।বুকফাটা দুঃখ , বিষাদ, টেনশন অর্থাৎ মানুষের আবেগ এলেখায় সেভাবে আসে নি। হয়ত এইটিই হতে পারত রক্তমণির হার গাঁথার বিনিসুতো-
    নিরাসক্ত কথন বইটির সম্পদ স্বীকার করেও বলি, আবেগের প্রয়োজন ছিল। যেমন একটা উদাহরণঃ যুঁইএর সীমান্ত পেরিয়ে এদেশে আসা যা দিয়ে লেখাটির শুরু ও শেষ, সেই ভয়ংকর ঘটনা নিয়ে কোনো টেনশন অনুভূত হয় নি-অথচ ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল প্রথম পরিচ্ছেদেই-বাসন ঝমঝম করে পড়ে যাওয়ার মত অনন্য উপমা দিয়ে, ছাইগাদায় খেলা করা বিড়ালছানাদের দিয়ে।
    ২। হয়ত কোনো কোনো ক্ষেত্রে, বাস্তব বর্ণনার বাইরে বেরিয়ে কল্পনার প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল লোকশ্রুতির। স্মৃতি রয়েছে, লোকশ্রুতির গল্প নেই- এও কী হয়?
    ৩। দেবেশ রায় সম্পাদিত বইতে ইন্তিজার হুসেনের গল্পের সঙ্গে তাঁর কিছু কথাও ছিল। সেইটি মনে করিঃ 'দেশভাগের অভিজ্ঞতায় এত অজস্র গিঁট, যে দেশভাগের গল্প জটিল , দুর্বোধ্য ও দূরন্বয়ী হতে বাধ্য। ' এই আখ্যানে জটিল নির্মাণ অনুপস্থিত। এই প্রসঙ্গে, দেবেশ রায় কে আবারও মনে করিঃ ' আখ্যান শব্দটির অর্থ বিপরীতময়, সংঘর্ষসঙ্কুল, রহস্যাকীর্ণ-নামপরিচয়,সংজ্ঞাপরিচয়, ইতিহাস, গল্পকথা, পুরাণ।'

    সব মিলিয়ে, আমার মনে হ'ল, লেখক এক বিরাট ক্যানভাসের সমনে দাঁড়িয়ে-সমস্ত উপকরণ মজুদ, অসাধারণ একটা স্কেচও করে নিয়েছেন চারকোলে, ক্যানভাসে রং চাপানো শুরু করেছেন-অথচ ক্যানভাস সম্পূর্ণ না করেই স্টুডিওর বাইরে বের করে এনেছেন। ক্যানভাস সম্পূর্ণ হলে , সেই নির্মাণের সামনে দাঁড়িয়ে পাঠকের স্তম্ভিত ও আচ্ছন্ন হয়ে যাওয়ার কথা ছিল সম্ভবতঃ।

    দেবেশ রায় 'রক্তমণির হারের' ভূমিকায় সাম্রাজ্য আখ্যানের বিপরীতকোটির আখ্যানের কথা বলেছেন, লিখেছেন কেন্দ্র ও পরিধিআখ্যানের কথা। এই লেখার মূল্যায়নে, সে আলোচনা পন্ডিতদের জন্য তোলা রইল।

    সিজনস ২ এর অপেক্ষায় আছি।
  • | 2345.108.9003423.61 (*) | ১৬ জুন ২০১৯ ০৫:৪৮50076
  • ধন্যবাদ। কৃতজ্ঞতা। ☺
    ল্কল্পনার দরকার ছিল পড়ে একটু মজা পেলাম।
  • i | 7823.33.4590012.233 (*) | ১৮ জুন ২০১৯ ০৮:১৭50077
  • কল্পনা প্রসঙ্গে, 'হয়ত কোনো ক্ষেত্রে.. 'লিখেছি।
    আমার মত ক'রে বিনিসুতো খুঁজতে চেয়েছি। আমি ঠিক- সে দাবীও নাই।
  • র২হ | 236712.158.565612.235 (*) | ১৫ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:০৭50078
  • | 124512.101.780112.209 (*) | ১৭ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০৮:২০50079
  • আমার রৈকো র কোন মূল্য নাই কিন্তু অনেক অনেক লোককে এই ব ই পড়তে বলে ছি , আর এক নতুন আর্কাইভিস্ট কে এই বই পড়তে বলে ছি, আর্কাইভ এ রাখা কনসিডার করতে বলেছি।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আলোচনা করতে মতামত দিন