এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বেকুবের ফ্রিজ | এসব হয়না - ২

    Anamitra Roy লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৭ জুলাই ২০২০ | ২৪৪৯ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • | | | | | | |
    ফ্রিজটা কথা বলে উঠলো।
    এসব তো ঘটেই থাকে লেখকের জীবনে। লেখক মানে যে লিখছে তার কথা হচ্ছে না। লেখক একটা নাম মাত্র। লেখক না বলে তাকে বেকুবও বলা যায়। তাছাড়া তার বেকুব হয়ে যাওয়া ছাড়া আর উপায়ই বা কী বিশেষত বাড়ির ফ্রিজ যদি হঠাৎ কথা বলে ওঠে একদিন চমকে দিয়ে! এতদিন তার মধ্যে প্রাণের কোনও লক্ষণ দেখেনি বেকুব। গরমে সে ঘামতো না, শীতে কম্বলের ভাগ চাইতো না, অ্যালার্ম ঘড়ির আওয়াজে উফ বলে পাশ ফিরেও শুতো না। শুধু একটা ফ্রিজের মতো, মানে ফ্রিজ যেরকম হয় আর কি, রান্নাঘরের এককোনে দাঁড়িয়ে থাকতো। ন'মাসে-ছ'মাসে এক-আধবার একটু বন্ধ রেখে মুছে নেওয়া ছাড়া আর কোনও ঝামেলাই ছিল না তার। ঝামেলাটা বাধলো দিন পনেরো আগে যখন হুইস্কি খেতে গিয়ে বেকুব দেখলো ডিপ ফ্রিজের ভেতর সমস্ত বরফ গলে জল হয়ে আছে। এর দু'দিন পর প্রায় কিলোখানেক কাঁচা মাংস পচে গেলো। সে কী দুর্গন্ধ! যেন লাশ লুকিয়ে রাখা আছে ফ্রিজের ভেতর। এরপর দেখা গেলো জল ঠান্ডা হচ্ছে না। এবেলার রান্না ওবেলা খাওয়া যাচ্ছে না আর গরম করে। সব পচে যাচ্ছে।

    এই অবধি তাও ঠিক ছিল। একটা ফ্রিজ, নেহাতই কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে; এ আর এমন কী ব্যাপার। সারিয়ে নিলেই চলতো। কিন্তু ব্যাপারটা এখানে থেমে থাকলো না। পচে যাওয়ার রোগটা ফ্রিজের ভেতর থেকে ফ্রিজের বাইরে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো ক্রমশ। প্রথমে পচলো ফ্রিজটা দাঁড়িয়ে আছে যে ট্রে-টেবিল মতো ছোট্ট জিনিসটার ওপর, সেইটা। পচে একদম গলে যাওয়া রবারের মতো হয়ে গেলো। কত টাকা দিয়ে যেন কিনতে হয়েছিল ওটা, কোম্পানি থেকে ফ্রিতে দেয়নি। এরপর ওই ট্রে-টেবলের পায়া বেয়ে ক্রমশ রান্নাঘরের মেঝে পচতে শুরু করলো। তারপর মেঝে থেকে দেওয়াল। তিনদিনের মধ্যে গোটা রান্নাঘরের সবকটা দেওয়াল পচে কিরকম যেন সবজে-কালো রঙ ধারণ করলো একটা। তার নিচ দিয়ে শিরা-উপশিরা-রক্তজালক, জেলির মতো থকথকে একটা ব্যাপার। এইভাবে রান্নঘরটাকে খাওয়া শেষ হলে সংক্রমণ চৌকাঠ ডিঙিয়ে তারপর

    বাইরে বেরিয়ে আসে।

    তখনই বেকুব ঠিক করেছিল ফ্রিজটাকে বেচে দেবে। কিন্তু, ঠিক উদ্যোগ নিয়ে উঠতে পারেনি। আসলে এত বছরের পুরনো ফ্রিজ তো, মায়া পড়ে গিয়েছিলো। আমাদের আসবাবেরা তো আমাদের বাড়িরই একজন হয়ে যায় একটা সময়ের পর! তাই না? অন্তত বেকুব সেভাবেই ভাবে। এই মায়ার ফাঁদে পড়েই তো সে বারবার লেখক থেকে বেকুব হয়। সে তার ড্রয়িংরুমের চেয়ারটির প্রতিও লয়্যাল, আবার বইয়ের তাকের বাঁ দিক থেকে সাত নম্বর বইয়ের তিনশো তিপ্পান্ন নম্বর পাতার প্রতিও। অতএব তার কোনটা সত্যি এবং কে তাকে বিশ্বাস করবে সে প্রশ্নে বরং না যাওয়াই ভালো। আপাতত মাথায় রাখা যাক যে, ফ্রিজ থেকে বেরিয়ে সেই পচে-যাওয়া-রোগ ড্রয়িংরুমের চেয়ারটাকেও খেতে শুরু করেছিল। আর বইয়ের তাকটাও সেখান থেকে খুব বেশি দূরে নয়। তাছাড়া গোটা ড্রয়িংরুমের মেঝে পাঁকের মতো আঠালো হয়ে আসছে ক্রমশ। ঘরে হাঁটা দায়। সেন্টার টেবিল থেকে ডাইনিং টেবিলে পৌঁছতে প্রায় ঘন্টাখানেক সময় লেগে যাচ্ছিলো প্রতিবার। এই ঘরটা শেষ হলে বাকি থাকবে বেডরুম আর বাথরুমগুলো খাওয়া। বাথরুমের ব্যাপারটা নিয়ে অতটাও ভাবিত নয় বেকুব, কিন্তু একটা পচে যাওয়া বেডরুমের দুর্গন্ধময় থলথলে বিছানায় সে শুতে পারবে না বাকি গোটা একটা জীবন। তাই একদিন ঘুম থেকে উঠে ফোনটা করেই ফেললো সে। আর করলো বলেই জানতে পারলো যে, ফ্রিজটাকে নিয়ে গিয়ে যন্ত্রাংশগুলো আলাদা আলাদা করে বেচবে ওরা স্ক্র‍্যাপ মার্কেটে। ওজন দরে বিক্রি হবে সব। বেচাকেনা শেষ হলে ব্যাপারখানা এমন দাঁড়াবে যেন এই পৃথিবীতে ওই ফ্রিজখানা ছিলোই না কখনও।

    ফ্রিজটা সম্ভবত টের পেয়ে থাকবে এইসব চক্রান্তের কথা। তাই সেদিন সন্ধ্যেবেলায় সে কথা বলে উঠলো। বললো, একদিন বেকুবও আর আগের মতো থাকবে না। কারও কোনও কাজে আসবে না বেকুব। একদিন ঘরের এককোনে পড়ে থেকে থেকে পরিবেশ দূষিত করা ছাড়া আর কোনও ভূমিকা থাকবে না তার এই বাড়িতে। বেকুবের কি ভালো লাগবে সেইদিন যদি তার হাত পা লিঙ্গ থেকে মাথা সব আলাদা আলাদা ভাবে বিক্রি করে দেয় কেউ? এমন কেউ যাকে সে আসলেই বিশ্বাস করেছিল; বিশ্বাস যেভাবে করে মানুষ, কোনও কারণ ছাড়াই, যেন অবিশ্বাস করার মতো কোনওকিছু ঘটেইনি কোনওদিনও?

    বেকুবের কাছে এই প্রশ্নের কোনও জবাব ছিলো না। আর তাছাড়া একটা ফ্রিজকে অতটা পাত্তা দেওয়ারই বা কী আছে যে সে একটা প্রশ্ন তুললেই তার উত্তর দিতে হবে! পরেরদিন সকালে এলো ওরা। একটা মরার খাটিয়ায় বেঁধে নিয়ে গেলো ফ্রিজটাকে। আট বছরের পুরনো ফ্রিজ। কত স্নেহে কতবেলার আদরের খাবার ঠান্ডা রাখতো এদ্দিন। চলে যাবার সময় "বলহরি হরিবোল" বলতে বলতে ওরা যখন কাঁধে তুলে নিচ্ছিলো খাটিয়াটাকে ফ্রিজটা শুধু একবার ডানদিকে মাথা ঘুরিয়ে বেকুবকে বলেছিল, "তোমার ভালো হোক!"

    সেইদিন রাত্রিবেলা হুইস্কি খেতে গিয়ে আবার ফ্রিজের অভাব বোধ করে বেকুব। তার মনে পড়ে অনলাইন সে একটা ফ্রিজ দেখেছিলো বটে। ডাবল ডোর। ফ্রস্ট ফ্রি। আরও নানান ফিচার ছিল তার। কিন্তু কিনে ফেলতে সাহস পায় না সাথেসাথে। ভাবে, থাক, সবে একটা ধকল গেলো। ক'দিন পরে কেনাই বরং ভালো। কে জানে নতুন ফ্রিজটাও যদি হঠাৎ একদিন কথা বলে ওঠে!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
    | | | | | | |
  • ব্লগ | ২৭ জুলাই ২০২০ | ২৪৪৯ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    গল্প  - Debasis Sarkar
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সায়ন্তন চৌধুরী | ০৪ অক্টোবর ২০২০ ১১:৫৩98041
  • এই সিরিজটা খুব ভালো হচ্ছিল। এই লেখাটা চমৎকার লেগেছিলো।

  • i | 203.219.27.59 | ০৪ অক্টোবর ২০২০ ১৩:৪৩98045
  • সিরিজটি পড়ছিলাম নিয়মিত ঃ মেলার মাঠে ক কুড়িয়ে পাওয়া, খাটিয়া করে যেতে যেতে ফ্রিজ বলে গেল, তোমার ভালো হোক, কিম্বা স্রোতস্বিনী একটা ম্যাজিক পুষেছিল এই বলে দুম করে একটা লেখা শুরু করে দেওয়া - প্রত্যেকটি পর্ব শেষ করে মনে হয়েছে আরো কিছু চাইছিলাম- একটা বিস্ফোরণ সম্ভবত...
    বারুদ মজুত ছিল তো-

  • Anamitra Roy | ১০ অক্টোবর ২০২০ ২৩:০২98240
  • আসবে আরও। বাড়ি পাল্টানো নিয়ে একটু ব্যস্ত রয়েছি এমাসে। একটা লেখা মাঝপথ অবধি এগিয়ে পড়ে রয়েছে। 

  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে মতামত দিন