মহাভারত মহাসাগর ছেঁচে বিভিন্ন মনিমুক্তো তুলে আনার প্রয়াস৷ বিভিন্ন চেনা, অচেনা গল্পের সমাহার এই ধারাবাহিকে৷ ক্রিটিকাল থেকে ভালগেট, সব গল্পই উঠে এসেছে৷ ... ...
হাজারিবাগ জেল আসলে ছিল মূলত বিচারাধীন বন্দীদের স্বল্পকালীন আটকখানা। তাই এখানে অন্য বড় জেলের মত অত কাজকর্ম থাকতো না। সকালে, পুরুষ বিভাগের দর্জিখানায় তৈরি সরকারি উর্দিতে মেয়েরা বোতামের ঘর সেলাই করতো। তারপর উঠোন, আশপাশ পরিস্কার করা, বাগান করা, রান্না, আর গল্পগাছা। এখানে একটা অদ্ভুত নিয়ম ছিল - রোজ সকালে ডাল আর সব্জি রান্না করা দেওয়া হত, কিন্তু ময়দা আর চাল দেওয়া হত এমনি। এবার যে যারটা যেমন করে পারো ফুটিয়ে, বানিয়ে খাও। কোন জ্বালানী বা বাসন কিন্তু দেওয়া হত না! হয়তো একদিনের খাবারের বিনিময়ে একটু কয়লা পাওয়া যেত, কিন্তু রান্নার জন্যে, যে অ্যালুমিনিয়ামের পাত্রে রান্না খাবার আসতো, ভাত রুটি তার মধ্যেই বানাতে হতো। ... ...
এরপর গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে খাজ্জিয়ারের ফটকের বাইরে ছেড়ে দিলেন। পুরো রাস্তাটা নির্জন থাকলেও এই জায়গাটায় একেবারে গাড়ির এবং মানুষের মেলা বসে গেছে। খাজ্জিয়ার একেবারে প্রাকৃতিক একটা গড়ের মাঠের মত। চারদিক কালাটপ বনাঞ্চলের পাইন দিয়ে ঢাকা। বৃষ্টির জল জমে মাঝখানে একটা ছোট হ্রদ। সেখানে অবশ্য এখন গরমকালে বড় বড় মানুষসমান ঘাসের ঝোপ জন্মেছে। বর্ষাকালের পর আবার জল বাড়বে ঘাসের ঝোপ ঢেকে যাবে। শীতকালে এই উপত্যকা বরফে ঢেকে যায়। কিছু থাকার জায়গাও হয়েছে এখন খাজ্জিয়ারের কাছাকছি। ... ...
পুরুষের দৃষ্টি ... ...
অনেক রাতে, দেওয়ালের ওপর দিয়ে চেঁচিয়ে কল্পনার সঙ্গে কথা বলে ক্লান্ত হয়ে, সেলের গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে দেখতাম - জেলের দেওয়ালের বাইরের অশ্বত্থ গাছের মাথার ওপর ঝকঝকে পরিস্কার আকাশে চাঁদ উঠেছে, একটা সাদা প্যাঁচা স্থির হয়ে বসে পুরুষ ফাটকের ছাতে, উঠোনের অন্য প্রান্তে হাজার হাজার ঘুমন্ত পাখিকে বুকে নিয়ে শান্ত নিমগাছের নিচে নর্দমা থেকে বেরিয়ে ব্যাং গুলো লাফঝাঁপ করছে। ... ...
সবকিছু ঘুরেফিরে যে কেন একটা নির্দিষ্ট বিন্দুতেই ফিরে আসে ! কোভিড হানা দেবার আগে কে কবে এসব ভেবেছিল! সে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকে। ত্রিদিবের বাড়ি আসার কথা দুদিন পরে। কী অগাধ আরামের মেজাজ সারাবাড়ি জুড়ে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন স্বাভাবিক হয়েছে ত্রিদিবের। তবে সিডেটিভ চলছে।ঘুমোচ্ছেন। ... ...
জঙ্গলের মধ্যে দুঃসাহসিক বন্দুক যুদ্ধে আমার ধরা পড়া, ইউরেনিয়াম প্ল্যান্ট উড়িয়ে দেওয়ার চক্রান্ত, বিস্ফোরক দিয়ে পুলিশ থানা উড়িয়ে দেওয়া - এইসব খবর বেরুচ্ছে হৈহৈ করে। অবশেষে তদন্তকারীরা সব ফিরে গেল - দিল্লি, পাটনা, কলকাতা, পাঞ্জাবে, আমার বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য লেখা মোটা মোটা সব ফাইল নিয়ে - আমাকে আমার খুপরি সলিটারি সেলে ফেলে রেখে। বাইরের পৃথিবী, এমনকি জেলখানারও অন্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন আমার সেলে। তখনই মনে হয় আমি ঠিকঠাক বুঝতে পারলাম - গত কদিন, কয়েক সপ্তাহ ঠিক কী হচ্ছিল। এর আগে পর্যন্ত আমি বোধহয় ঠিক বুঝতেই পারিনি, কী চলছে, কী হতে পারে, কী হবে। আমার মস্তিষ্ক বোধয় এই ভয়ানক চাপ থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য আমার চিন্তা পদ্ধতিকেই কিছুটা অকেজো করে দিয়েছিল - অন্তত শুরুর কিছুদিনের ঘটনাপ্রবাহের সঙ্গে আমাকে মানিয়ে নেওয়ানোর জন্য। ... ...
শেষবারের মত অমলেন্দুর সঙ্গে কথা বললাম - বিদায় জানাতে। অমলেন্দুর মাথায় হাত ছুঁইয়ে, ওর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে হেসে কল্পনার সঙ্গে ফাটকের রক্ষীর পেছন পেছন বিশাল উঁচু কাঠের গেটের ছোট্ট নীচু দরজা পেরিয়ে জেলের অন্দরমহলে ঢুকলাম। পাথর বিছনো অন্ধকার সুড়ঙ্গের মত পথ, খালি পায়ে, রক্ষীর লন্ঠনের আলোয়, আরেকটা লোহার তারকাঁটা বসানো বড় গেট। আমরা ভেতরে ঢুকলাম, পেছনে সশব্দে গেট বন্ধ হল। ... ...
মানুষের সভ্য হওয়ার প্রথম নিদর্শন আগুন জ্বালাতে শেখা বা চাকার আবিষ্কার বলে অধিকাংশই মনে করে৷ কিন্তু আমার মতে মানুষের অন্যান্য প্রানীর থেকে আলাদা হওয়ার আসল কারণ তাদের কল্পনাপ্রবণতা৷ নিজের পারিপার্শ্বিক নিয়ে চিন্তা, বিভিন্ন গল্পকথা প্রভৃতি তৈরি৷ তাই সাঁওতাল থেকে ভিল হয়ে গোণ্ড পৃথিবীর সমস্ত আদিম আদিবাসীরই রয়েছে নিজস্ব উপকথার সম্ভার৷ রামায়ণ, মহাভারত পড়তে গিয়ে আকৃষ্ট হই এই উপকথাগুলোর উপর৷ জোগাড় করতে শুরু করি উপকথা। ভাবলাম সেই উপকথাগুলোই এক এক করে শেয়ার করি সবার সাথে৷ ... ...
মিনিট পঁয়তাল্লিশ বাদে তিনি উঠে দাঁড়ালেন, অর্জুন পাশের গাড়ি সরাতে বললেন আমরা রওনা দেব বাঘের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। রাস্তার (মানে জঙ্গলের ভেতরের কাঁচা পথ) দিকে খানিক এগিয়ে এসে এত গাড়ি দেখে বিরক্ত হয়ে তাড়ুবাবু আবার জঙ্গলের গহীন গহনে ঢুকে গেলেন। অর্জুন কিছু নির্দেশ দিয়ে গাড়ি নিয়ে গেলেন এক জলাশয়ের পাশে, তাড়ু জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দিয়ে এখানেই নাকি আসবে। আর সত্যিই এলোও। ধীরেসুস্থে এসে জলে নামল তারপর মুখ তুলে তাকালো। উফফ স্বাভাবিক পরিবেশে একদম খোলা জায়গায় খোলা গাড়িতে বাঘের সাথে প্রথম চোখাচোখি ... সে রোমাঞ্চ মানুষের জীবনে একবারই আসে, পরের পরের বারেরা শুধুই প্রথমবারের সাথে তূলনীয় হয়ে চলে। ... ...
সোনার মুখে প্রশ্রয়ের মৃদু হাসি, অস্ফুট স্বরে বললেন, “পাগল, সত্যি সত্যিই আমার এ ছেলেটার মাথায় পোকা আছে!” ... ...
আড় চোখে দেখি পাশের যাত্রী ঘাড় বেঁকিয়ে মেসেজ পড়ার চেষ্টা করছে। তাড়াতাড়ি উত্তর দিতে গেলাম “পরে কথা হবে।” মানে পি-এ-আর-ই (পরে) কে-এ-টি-এইচ-এ (কথা) ইত্যাদি। কিন্তু পি-কিউ-আর-এস এক বোতামে, জে-কে-এলও তাই। ‘আর’ পেতে তিন বার বোতাম টিপতে হবে। জ্বালাতন!! পি-এ-আর-ই লিখতে চাইছি, কিছুতেই আসছে না। আর-এর জায়গায় পি কিম্বা কিউ চলে আসছে। ডিলিট করতে গিয়ে পি-টাও মুছে গেল। একটা শব্দ লিখতে মিনিট দেড়েক চলে গেল। বন্ধ করে দিই ফোন? ছিছি, তাই করা যায়? লোকে তো এখনও তাকিয়ে আছে, ভাববে আমি মেসেজ করতে পারি না। ... ...
অন্ধকার চেনাবে রাস্তা – বাড়ির সামনের শ্বেতপাথরের ফলক চিনে নিয়ে দেশলাই কাঠি শোনাবে ইতিহাস, ঘুঙুরের ঝঙ্কার একদা এখানেই ঘুমিয়ে নিত অতীত বৈধ কোলে মাথা রেখে ... ...
মনে হলো সবারই মত যে সংগ্রামের লক্ষ্য হবে যেসব জায়গায় অন্তত ৭০% মানুষ আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় জীবন কাটাচ্ছে সেসব জায়গায় ভূমি সংস্কার করা, আর শিক্ষিত যুবকরা আস্তে আস্তে গ্রামের দিকে যেতে থাকবে, কৃষিভিত্তিক সংগ্রামী রাজনীতির প্রচার করতে আর কৃষকদের সংগ্রামের সঙ্গী হতে। অমলেন্দুর এক তুতো ভাই আমাকে নিয়ে গেল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। যেন বড় বড় জনবিরল ভুতুড়ে দালানগুলি আগাপাস্তলা স্লোগানে মোড়া। যেসব ছেলেমেয়েরা জীবন কাটিয়েছে এই শহরে, তারা তাদের আরাম, ভবিষ্যৎ, কেরিয়ার উৎসর্গ করে দিতে উদগ্রীব, কৃষকদের সংগ্রামে তাদের সঙ্গী হয়ে, একটা নতুন, সহমর্মী দেশ গড়ে তোলার জন্যে। আমার সঙ্গে যাদেরই দেখা হয়েছিল, আমি দেখছিলাম নকশালপন্থীদের প্রতি প্রকাশ্য অথবা প্রচ্ছন্ন সমর্থন, যেন সংসদীয় গণতন্ত্রে কারোরই আর আস্থা নেই, একটা বড় রকম বদলের জন্য সবাই উদগ্রীব। ... ...
উদয়পুরে এত সবুজতার কারণ পিচোলা এবং ফতেহ সাগর এই দুটো হ্রদ। পিচোলা হ্রদের মাঝখানে একটা দ্বীপে আছে জগ মন্দির। গরমকালে রানারা ওখানে গিয়ে থাকতেন, এখন সেটা একটা পাঁচতারা এবং যথেষ্ট দামী হোটেল। আর একটা দ্বীপেও 'লেক প্যালেস' বলে একটা হোটেল আছে , সেটা টাটাদের। মূল রাজপ্রাসাদেরও ক্যাম্পাসের ভেতরে দুটো বাড়ি হোটেল হিসেবে ভাড়া দেওয়া হয়। ... ...
মুগ্ধ বিস্ময় আর আগ্রহ তখন আমার, বাইরের পৃথিবী, নানান দেশ, বিদেশের মানুষজন নিয়ে। আমার কিশোরীবেলা থেকে পকেটমানি জমিয়ে রাখি, অন্য দেশে বেড়াতে যাবো বলে। বড় হয়ে, লন্ডনে আর জার্মানীতে কলেজ ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় অন্য পাঁচ মহাদেশের ছত্রছাত্রীদের সঙ্গে মিশে বুঝতে শুরু করলাম - অন্য দেশের মানুষ আমাদের কী চোখে দেখে। আমাদের, মানে বৃটিশদের। আমি বুঝতে শুরু করলাম স্কুলে পড়ানো আমাদের 'গৌরবময়' রাজকীয় ইতিহাস আসলে ঠিক তত গৌরবময় না, আর ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির দারিদ্র আর দুর্দশার পেছনে বৃটেন বা তার মত অন্যান্য কলোনীপ্রভুদের প্রভুত্বের অতীত ও নীতি টীতিগুলির কতটা অবদান। ... ...
আজকের বাংলার পরিস্থিতিতে এ গল্পটা মনে পড়ল। ... ...
“ ঘোড়ার পেছনে কখনও নিজের টাকা নিয়ে ছুটো না । ব্যাঙ্কারদের সেটা কখনও করা উচিত নয় । কিন্তু মনে রেখো - ঘোড়া হলো ব্যাঙ্কারদের বিজনেস পার্টনার । লোকে আমাদের কাছ থেকে ধার নিয়ে ঘোড়ার পেছনে পয়সা লাগাবে। সে ঘোড়া জিতলে লাভের টাকা আবার আমাদেরই সেভিংস ব্যাঙ্কে জমা দেবে “ আমি বললাম, “ আর যদি হারে ?” মুখে সেই অনবদ্য হাসি “ তখন তারা আমাদের পায়ে পড়বে আরও টাকা ধার নেওয়ার জন্যে ! ঘোড়া জিতলে আমাদের ব্যাঙ্কে পয়সা জমা করবে , হারলে ধার নেবে! “ ... ...
নাগরনো কারাজাখের যুদ্ধে যে আর্মেনিয়ানরা পালিয়ে এসে শরণার্থী হয়ে রাজধানীতে ঘুরে বেড়াচ্ছে, বারো ঘন্টা শিফ্টে কাজ করে তাদের ভারতীয় রান্না করা খাবার, পিওর ইন্ডিয়ান ফুড সরবরাহ করছে পারভেজ আর তার পরিবার। ... ...