এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বই

  • বাংলা কবিতায় নারী

    Jayeeta Bhattacharya লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বই | ২৬ জুলাই ২০২৩ | ৩৪৭ বার পঠিত
  • বাংলা কবিতায় নারী : জয়িতা ভট্টাচার্য

    বাংলা সাহিত্যে নারী কালি ও কলমের মতোই অনিবার্য। নারী রহস্যময়ী, ছায়াবৃত, তার দেহবল্লরী তার মায়াময় রূপ সবই সাহিত্যের উপাদান। চর্যাপদ ও বৈষ্ণব পদাবলির মূল রাধা কৃষ্ণ প্রেমলীলাকে ভক্তি একসঙ্গে দেখা হয়েছিলো।

    যদিও বাংলা সাহিত্যের প্রাচ্যের মতো কোনো পর্ববিভাগ যথার্থ রোমান্টিক যুগ, আধুনিক ও উত্তরাধুনিক যুগের স্পষ্ট বিভাজন নেই তবু লেখনশৈলীর ও ভাবগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।

    রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা প্রায় প্রথম নারীর গভীর ভূমিকা ও গুরুত্ব দেখতে পেলাম। তাঁর নারী কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কল্পনার নারী নয়।তাঁরা তাঁর বাস্তব জীবনে ও মনোজগতে স্পষ্ট প্রভাব ফেলেছেন।

    অনুপ্রেরণাদাত্রী কাদম্বরী দেবীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন অনেক কবিতা, কখনো স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর জন্য বিরহকাতর প্রেমের কবিতা। যাদের স্পর্শ তাঁকে একদ- শান্তি দিয়েছেন, লিখেছেন তাঁদের নিয়েও কবিতা।

    "আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা করে
    তার পরনে ঢাকাই শাড়ি,কপালে সিঁদুর "।

    আবার চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে কবি নারীর মাধুর্য ও শক্তিশালী রূপের প্রকাশ করেছেন। কুরূপা ও সুরূপার মধ্যে অপূর্ব দোলাচল।

    আরেকটু অগ্রসর হলে দেখা যায় কবি নজরুল ইসলাম নারীকে কবিতায় কখনো মাতৃরূপে পেতে আকুল হয়েছেন আবার প্রেয়সীর জন্য ব্যাকুলতা তাঁর বিরহের কবিতায় "প্রিয়া রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি/আঁখির পলকে মরুভূমি হয়ে গেল বনভূমি "। স্বয়ং কবিতাকেই নারীরূপের কল্পনা করেছেন।

    অন্যদিকে আধুনিক যুগে কবি জীবনানন্দ ভিন্ন মেরুতে থেকে নারীকে অবলম্বন করে কবিতা লিখেছেন। নারী সেখানে ইমেজারি ও পরমাপ্রকৃতির দ্যোতক। কখনো সুপ্ত কামনার প্রতীক কখনো বা শূন্য হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি। এভাবেই আজ বিশ্ব বাংলার এক ফ্যান্টাসি "বনলতা সেন" ক্লাসিক হয়ে গেছেন।

    "কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
    মাছরাঙাটা ভোলেননি ত দুপুরের খেলা
    শালিখ করেনা তার নীড় অবহেলা
    উচ্ছাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন
    তুমি নাই বনলতা সেন"

    পরবর্তী কালে আরেক নারী বিখ্যাত হয়ে গেছেন কবিতার মাধ্যমে। তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের "নীরা"। নীরাকে তিনি দেখেননি তাঁর দেখা বিভিন্ন নারী সান্নিধ্যের কোনো কোনো মুহূর্ত দিয়ে গড়া এই আদ্যন্ত কাল্পনিক নারী।

    "নীরার শরীর খারাপ হলে সবার মন খারাপ হয়।
    .....আজই কি ফিরেছ?
    স্বপ্নের সমুদ্রে সেকি ভয়ঙ্কর মেদহীন শব্দহীন যেন
    তিনদিন পর আত্মঘাতী হবে
    হারানো আংটির মতো দূরে
    তোমার দিগন্ত দুই উড়ুক্কু ডুবে কোনো
    জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো
    অথচ একলা ছিলে,
    ঘোরতর স্বপ্নের ভিতর তুমি একা"

    সুনীল নিজেই দুঃখ করে বলেছেন তিনি অনেকবার চেষ্টা করেছেন নীরাকে রক্ত মাংসের মানুষী হিসেবে উপস্থাপন করতে কিন্তু তা প্রতিবার পেরিয়ে গেছে শিল্পীর সীমানা।

    নীরা একটা কনসেপ্ট হয়ে থেকে গেছে। আবেগ বর্জিত ও কোনো শরীরী আবেদনবিহীন এক আইডিয়াল প্রেয়সী এবং তুমুল জনপ্রিয়।

    পূর্বে উল্লিখিত কবিদের সৃষ্ট নারীরা সকলেই যেন স্বপ্ন। ফ্যান্টাসি। তাদের বাস্তবের শক্ত মাটিতে, কষ্ট যন্ত্রণার লেশমাত্র ছোঁয় না। কেবল মাধুর্য। কিন্তু এক প্রেয়সী সে বাস্তবিক তা হয় না। তারও পরাজয় আছে।
    ক্লেশ, বেদনা মাটির সোঁদা গন্ধে ভরা তার শরীর।
    সেই জৈবিক ও জীবন জারিত নারীর কথা বলার ঝুঁকি কোনো কবি কিন্তু নেন নি জনপ্রিয়তার বা বানিজ্যমূল্যের কথা ভেবে হয়ত বা!

    ফলে এইসব নারীকে ভাবতে গেলে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়। ট্র্যাডিশনাল এলিটিস্ট কোনো নারী যার গমের মতো রং, মসৃণ আজানুলম্বিত কেশ,কাজল আঁখি এসব মনে করে নেওয়া যায় ।

    ঠিক এই এলিটিস্ট কনসেপ্ট টাই ভেঙে দিয়েছেন হাংরি আন্দোলনের পুরোধা পোস্টমডার্ন কবি, সাহিত্যিক মলয় রায়চৌধুরী।

    তার প্রেমিকা "চুমু খেয়ে টিস্যু দিয়ে ঠোঁট মুছে নেয়",

    "মাথা বেয়ে ওঠে বুনো মহিষের সিং
    ঝড়ের মস্তি দিয়ে পাউডার মাখিয়ে দিস অবন্তিকা "
    বা "হরিণের নাচের সঙ্গে কাতুকুতু''এমন সব অতিবাস্তব নিত্য ব্যবহৃত শব্দ প্রয়োগ করার ঝুঁকি, এমন অভিনবত্ব বাংলা প্রেমের কবিতায় মেটাফর ব্যবহার করার ঝুঁকি বোধহয় একমাত্র মলয় রায়চৌধুরী নিতে পেরেছেন ।

    মলয় তাঁর কবিত্বের ভারী চোগাচাপকান ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছেন এক স্বাভাবিক কামার্ত প্রেমিক। তাঁর সাহিত্য সত্ত্বা বিলীন হয়ে গেছে মানবসত্ত্বায়।

    আর তাই তাঁর প্রিয় নারী "অবন্তিকা"এক ব্যতিক্রমী উত্তরাধুনিক নারী। মলয় অনায়াসে লেখেন,

    "বোঁটায় তোর গোলাপ রং অবন্তিকা
    শরীরে তোর সবুজ ঢাকা অবন্তিকা
    আঁচড় দিই আঠা বেরোয় অবন্তিকা
    চাটতে দিস নেশায় পায় অবন্তিকা
    টাটিয়ে যাস পেট খসাস অবন্তিকা " (পপির ফুল)

    "কবিতায় নারীদের মধ্য ইমেজারি, ফ্যান্টাসি বা শুধু মাধুর্য ভেঙে দিয়ে একমাত্র মলয় রায় চৌধুরী সৃষ্টি করতে পেরেছেন উত্তরাধুনিক নারী "অবন্তিকা" এক রক্ত মাংসের নারী তার যাবতীয় যৌনতা,রিরংসা,ক্রোধ ..... তার কৃষ্ণকালো দেহ বল্লরী নিয়ে সে জৈবিক কবিতা। যে কবিতা পুরুষ এমনকি নারী পাঠককে নড়িয়ে দেয়।

    "অবন্তিকা"কোনো মিথ নয়, সে পাশের বাড়ির মেয়েটি, সে ইমলিতলার নারী, সে অন্ত্যজ মুসলমান নারী অথবা লক্ষ্নৌ এর হারেম থেকে বিতারিত হতদরিদ্র নারী, উপজাতি নারী।

    মলয় রায়চৌধুরীর অবন্তিকা তীব্র শরীরী।
    এই প্রসঙ্গে বলাই যায় মলয় রায়চৌধুরী জীবনের বাস্তবতাকে সাহিত্য করে তুলেছেন। তা ইচ্ছে মতো ম্যাজিক রিয়ালিজম এ উত্তীর্ণ হয়েও সে জীবন্ত এক শারীরিক নারী।

    এর আগে কবিরা কাব্য সাযুজ্য শব্দর বেড়া টপকে যাবার সাহস পাননি। কিন্তু অবন্তিকাকে মলয় রায়চৌধুরী টেনে হিঁচড়ে গেঁথে দিয়েছেন মাটির গভীরে।

    অবন্তিকা 'শরীরেই সার্বভৌম মননে নয় মনে করে যেসব মহিলা, মলয় তাঁদের অনায়াসে ডাকতে পারেন 'মুখপুড়ি'।
    অথচ পরক্ষণেই পড়ি
    "শ্বাস ভ্যাপসা চোখের তলায় যুদ্ধ চিহ্ন এঁকে ডেথ মেটাল মাথা দোলাচ্ছিস"এর মতো যাদুবাস্তবতা।
    চ-ী তে যেভাবে দুর্গাকে বর্ণনা করা হয়েছে প্রায় সেভাবেই দুঃসাহসী এই কবি লিখেছেন,

    "অবন্তিকা বললি তুই:
    আর্কিমিডিস দিলেন দেহের ঘনত্ব।
    রেঁধে দেকার্তে দিলেন শরীরের বাঁকগুলো।
    ইউক্লিড দিলেন গোপন ত্রিভুজ!
    লোবাচোভস্কি দিলেন সমন্বিত আদল!
    ব্রহ্মগুপ্ত দিলেন মাংসময় বুকের নীঁখুত বাতুলতা!
    শ্রীধর দিলেন আয়তন!
    আর তুই কী দিলি?অক্ষরে সাজানো যত ফাঁকা মন্তর?
    আমি বললুম :
    আমি দিয়েছি প্রেম
    অবন্তিকা তুই বললি
    প্রেম ত আলো হয়ে বেগে আসে
    আর তত বেগে চলে যায়"

    অনবদ্য ভাষায় মলয় রায়চৌধুরীর অবন্তিকা তাই আল্ট্রামর্ডান এক পরিপূর্ণ ও ইউনিভার্সাল নারী। কবিতা নারী।

    পোস্টমডার্ন সাহিত্যে বাংলা কবিতায় নারীর এই ক্রম বিবর্তন কবিতাকে বিশ্ব সাহিত্য সম মানে উত্তোররণ করেছেন বিভিন্ন কবি যার পথিকৃত সেই আধুনান্তিক কবি রবীন্দ্রনাথ।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ২৬ জুলাই ২০২৩ | ৩৪৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : [email protected]


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ভালবেসে প্রতিক্রিয়া দিন