১.
জহির যখন জানতে পারল প্রিয়াঙ্কার জীবনে আরেকজন আছে, কথাটা সে হেসেই উড়িয়ে দিল। প্রিয়াঙ্কাকে সে চেনে। ও তো পরকীয়া করার মতো মেয়েই না! এরপর সেই পরোপকারী যখন প্রিয়াঙ্কার এক্সট্রা-ম্যারিটাল অ্যাফেয়ারের অকাট্য প্রমাণ হাজির করলেন তার সামনে, সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল। জহির সেদিন সন্ধ্যায় মেডিক্যালের সামনে গাড়ি থামাল, ড্রাইভারকে গাড়ি নিয়ে চলে যেতে বলে কিছুক্ষণ উদ্দেশ্যহীন ঘুরে বেড়াল। কোথায় যাওয়া উচিত সে বুঝতে পারছিল না। একবার ভাবলো আজিমপুরে তার বোনের শ্বশুরবাড়িতে যাবে, আরেকবার ভাবল এই শহর ছেড়ে পালাবে, চলে যাবে দূরে কোথাও।
শেষ পর্যন্ত জহির তার বাড়িতে ফিরে এল। ওর বাপ-মা সিলেটে ওর বড়ো ভাইয়ের সাথে থাকে, ঢাকায় সে প্রিয়াঙ্কার সাথে থাকে। জহির বাড়িতে ফিরে, জামাকাপড় না ছেড়ে, বিছানায় শুয়ে পড়ল দেয়ালের দিকে মুখ করে।
সে কারো সাথে কথা বলতে চায় না।
২.
বাসরঘরে ঢুকে প্রিয়াঙ্কাকে যখন দেখেছিল জহির, তার মনে হয়েছিল এই মেয়েটা খুব সুন্দর। আগুনের মত উষ্ণ না, বরফের মতো ঠাণ্ডা। এর আগে প্রিয়াঙ্কাকে বেশ কয়েকবার দেখেছে, কিন্তু কখনোই এতোটা সুন্দর মনে হয় নি। ইয়ারদোস্তোরা তাকে যথারীতি বলেছিল, প্রথম রাতে বিলাই মারতে হয়, কিন্তু জহির বাসরঘরে কোনো বিলাই খুঁজে পায় নি। সে পুরনো দিনের বাংলা সিনেমায় দেখেছে, বাসররাতে বৌয়ের ঘোমটা খুলে থুতনি ধরে নাড়া নিয়ে বলতে হয় তোমার মুখখানি চাঁদের মতো, আর বৌ জামাইয়ের পায়ে ধরে সালাম করে। সে-রাতে এসবের কিছুই হয় নি, প্রিয়াঙ্কাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছিল, ওকে দেখে জহিরের মায়া লাগছিল। সে ওকে ঘুমিয়ে যেতে বলেছিল, এবং ঘুমিয়ে গেছে এ-ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর, ওর কপালে নিঃশব্দে চুমু খেয়েছিল।
পরদিন রাতেই প্রিয়াঙ্কা নিজের শরীর খুলে দেয়।
বিয়ের হপ্তাখানেকের মধ্যেই জহিরের মনে হয় যে ওর বৌটা বোকা, আর কিছুটা শিশুসুলভ। সংসারের বাইরে অন্য কোনো ব্যাপারে আগ্রহ নেই। ইংরেজি সাহিত্যে পড়েছে, ভালো ছাত্রী ছিল, চেষ্টাচরিত্র করলে কাজ জোটানো কঠিন কিছু না। কিন্তু প্রিয়াঙ্কার কর্মজীবী নারী হওয়ার আগ্রহ নেই। জহির ওকে বুঝিয়েছে, আজকালকার যুগে মেয়েরা ঘরে বসে থাকে নাকি, তাছাড়া ঘরের কাজ করতে তো গৃহকর্মীই আছে। সারাদিন ঘরে বসে থাকতে খারাপ লাগে না? একটা কিছু কর, প্রিয়াঙ্কা, কিছু একটা কর!
৩.
প্রিয়াঙ্কা একটা নামকরা বেসরকারি ব্যাংকে জয়েন করল। জহির সফল ব্যবসায়ী, টাকাপয়সার অভাব নেই ওর। তবে সে প্রিয়াঙ্কার চাকুরিপ্রাপ্তির সংবাদে খুশী হলো, এটা ওর জন্য একটা স্ট্যাটাসের ব্যাপার।
৪.
জহিরকে প্রিয়াঙ্কা একেবারে হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসে। জহির খুব কেয়ারিং। জহিরের মতো ভালো ছেলে সে কমই দেখেছে।
সমস্যা একটাই, জহির প্রিয়াঙ্কার শরীরটাকে বোঝে না। প্রিয়াঙ্কা নিজের সাথে নিজে অনেক যুদ্ধ করেছে, নিজেকে বারবার বুঝিয়েছে এটা কোনো ব্যাপার না, মানুষের মনটাই সব। এরপর একটা সময় গিয়ে সে বুঝতে পেরেছে, মানুষ মূলত জন্তু, শরীরের সমর্থন ছাড়া মনকে বেশিদিন বাঁচানো কঠিন।
তাই প্রিয়াঙ্কা যেদিন নিজেকে সুমনের বাহুডোরে আবিষ্কার করল, সে এতোটুকু অবাক হলো না। শুরুর দিকে প্রিয়াঙ্কার মধ্যে অপরাধবোধ কাজ করত। তার মনে হতো সে আসলে জহিরকে ঠকাচ্ছে। তার মনে হল সে একটা খারাপ মেয়ে। কিন্তু আস্তে আস্তে সে অভ্যস্ত হয়ে গেল, এক দ্বৈত জীবনযাপনে, নিজের কাজের পক্ষে যুক্তিও দাঁড় করিয়ে ফেলল। সে তো জহিরের সাথে নিয়মমাফিক সংসার করছে, স্বামী হিসেবে জহিরের যা কিছু পাওনা তার কোনোটা দিতেই সে কার্পণ্য করছে না, আর সময় হলে জহিরের সন্তানের মাও হবে। খারাপ মেয়ে হতে যাবে কেন সে, জহিরকে সে সত্যিই ভালোবাসে, সুমনকে তো তার দরকার শুধুই শরীরের জন্য।
৫.
অনেকদিন পর জহির সিঁথির নাম্বারে ফোন করলো। কথা বলল অনেকক্ষণ, তারপর দেখা করতে চাইল। ফোন রেখে সিঁথি নিজের মনেই হেসে উঠল। বহুবছর ধরে সে এই দিনটির অপেক্ষা করেছে। জহিরকে সে বিয়ে করতে চেয়েছিল, পারে নি। জহির ওকে ফিরিয়ে দিয়েছিল, বলেছিল সে বরাবরই স্রেফ বন্ধু হিসেবে দেখে এসেছে ওকে, এরচে বেশি কিছু নয়। তাদের পড়াশোনার পাঠ বহু আগে চুকেছে, কিন্তু সিঁথি জহিরকে কখনোই ভুলতে পারে নি।
ইউনিভার্সিটির সেই দিনগুলিতে জহির সিঁথিকে ভালোবাসত না। এখনো ভালোবাসে না। কিন্তু কাউকে বিছানায় নিতে ভালোবাসা জরুরি না।
সিঁথিকে তার লাগবে, সংসার বা সন্তানের জন্য না, প্রিয়াঙ্কার ওপর শোধ নেয়ার জন্য।
৬.
সুমন আর সিঁথি ডাইনিং রুমে বসে আছে। ওদের বাবা-মা কয়েক বছর আগে ঢাকা-আরিচা মহাসড়কে এক মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। বছরের এই দিনটিতে ওরা দুই ভাইবোন টেবিলভর্তি খাবার সামনে নিয়ে বসে থাকে, কিন্তু কিছু খেতে পারে না।
৭.
আজকে সাদাফের জন্মদিন। ওই তো সাদাফ ফুঁ দিয়ে মোমবাতি নেভাচ্ছে। বার্থডে কেক কাটছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো হাসিমুখে হাততালি দিচ্ছে। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থডে ডিয়ার সাদাফ, হ্যাপি বার্থডে টুউউউ ইউউউউউউ। সাদাফের পেছনে দাঁড়িয়ে আছে চারজন অসুখী মানুষ। তারা হল ওর আব্বু, ওর আম্মু, ওর সুমন আঙ্কেল, আর ওর সিঁথি আন্টি।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।